• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৬ | সেপ্টেম্বর ২০১০ | গল্প
    Share
  • চতুর্থ পুরুষ : দময়ন্তী বসু সিং



    রুদ্রাংশু,

    আজ আমি ছেলেমানুষী খুশির হাল্কা হাওয়ায় ভাসছি । গরম দুপুরে শিমূল তুলো । ওরা কি আমার মতো আনন্দে ভাসে ? এক অবয়বহীন নির্ভার আনন্দে আমি ভাসছি, উড়ছি, ভাসছি - ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছি অনেক দূরের কোনো সময়ে - অন্য কোনোখানে -

    আনন্দের কারণটা এখন আমার প্রাণের বন্ধু, আমার কনফিদান্তে-কে না বলা পর্যন্ত শান্তি নেই !

    তুই যখন কলকাতায় ছিলি, হাত বাড়ালেই তোকে পাওয়া যেত । মন ভাল না লাগলেই তোকে ফোন করতাম, নয়তো সোজা তোদের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতাম । তোর মা আমাকে কী ভালোই বাসতেন ! আমি বুঝতাম উনি মনে মনে আমাকে ছেলের বৌ হিসেবে দেখছেন । অস্বস্তি হতো সে কথা ভেবে, কিন্তু এসব ভাবনা ছিল উভয় পক্ষেই উহ্য, তাই করবারও কিছু ছিল না । আর তুই ? ইশকুলে আমাদের আলাপের পরে-পরেই সেই সত্যযুগে আমাকে পাঠিয়েছিলি এক অনবদ্য প্রেমের কবিতা (কেন কবিতা লেখা ছেড়ে দিলি বল্‌ তো ?) । সে কবিতা পড়ে আমার কি ভীষণ বুক-কাঁপুনি রে বাবা ! এতো সুন্দর কথা এতো সুন্দর করে এর আগে তো কেউ বলেনি । আমি কি এতই অভিপ্রেত ? আমার অহং তৃপ্ত হয়েছিল, কিন্তু রসায়ন জাগলো কই ? তুই বুদ্ধিমান ছেলে, চট্‌ করে বুঝে ফেললি ব্যাপারটা । আর কখনো কোনও দাবীদাওয়ার মধ্যেই গেলি না । উল্টে আমাকে প্রশ্রয় দিলি অপর্যাপ্ত । হয়ে উঠলি আমার জীবনের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান, যেখানে আমার দোষত্রুটি, স্খলন-পতন, দ্বিধাদ্বন্দ্ব সব কিছু নিয়ে অকুন্ঠিত দাঁড়াতে পারি । তুই আমাকে কখনো বিচার করিসনি, সমালোচনা করিসনি, কোনো বাগাড়ম্বর না করেই বুঝিয়ে দিয়েছিস আমার জন্য তুই সবসময় আছিস, থাকবি ।

    আজ বলতে দ্বিধা নেই, শঙ্খ কিন্তু আমাকে তোর মতো নি:স্বার্থ ভালোবাসা কখনোই দিতে পারেনি । কে জানে, তুই আমার স্বামী হলে হয়তো তুই-ও পারতি না । ভেবে দেখেছি, এই স্বামী-স্ত্রী-র সম্পর্কটাই গোলমেলে । দেওয়া-নেওয়ার একটা হিসেব তার মধ্যে থেকেই যায়, সফলতম বিবাহেও অনেক বেদনা - ক্ষোভ - অভিযোগ - তিক্ততা জমা হয় । সেইজন্যে, পুরুষ-নারীর আদর্শ সম্পর্ক বিবাহের মধ্যে খোঁজা বাতুলতা ।

    অথচ দ্যাখ্‌, শঙ্খ, আমি, তুই - আমরা তো ছোট থেকে একসঙ্গে পড়েছি - স্কুলের শেষ দু'বছর, তারপর কলেজ । কতদিনের বন্ধু আমরা - সহপাঠী, সমবয়স্ক, সমমনস্ক । শেষ পর্যন্ত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নকশাল করা কমরেড । তবে শঙ্খ ছিল আমাদের গুরুস্থানীয়, অত্যন্ত মেধাবী, বয়সের তুলনায় অতি পরিণত, চিন্তাশীল এক পণ্ডিত মানুষ । ওর কথা ধ্রুববাক্য । ওরকম অন্ধভাবে যাকে এযাডমায়ার করেছি, সে আমাকে হঠাৎ একদিন বিয়ে করতে চাওয়ায় নিজের সৌভাগ্যে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম । আমার মতো তুচ্ছ একটি মেয়েকে শঙ্খর মতো অসাধারণ পুরুষ যে স্ত্রীর সম্মান দিতে চাইছে তা ভেবেই আমার সর্বশরীর পুলকিত হয়েছিল, সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের প্রশ্নই ওঠেনি ।

    তা বলে কি ওকে আমি তোর চেয়ে বেশি ভালোবাসতাম ? তার প্রেমে পড়েছিলাম ? তা কিন্তু নয় । তবে বিয়ে করার পক্ষে তাকে আদর্শ পুরুষ বলেই মনে হয়েছিল আমার । আমাদের বিয়েতে মুখে তুই যতই খুশি দেখিয়ে থাক তখন, ভেতরটা যে তোর রক্তাক্ত হয়েছিল তা আমি জানতাম । শঙ্খও জানতো । আসলে আমাদের তিনজনের মধ্যে এই জানা-বোঝার ব্যাপারটা ছিল গভীর ও সম্পূর্ণ । যে কারণে আমরা ত্রিভুজ প্রেমের নায়ক নায়িকা না হয়ে, হয়েছিলাম নকশাল আন্দোলনের মুখ্য ত্রয়ী - পরস্পরের প্রতি তীব্রভাবে অনুরক্ত তিন বন্ধু ।

    যে কোন কারণেই হোক, দোষে-গুণে মেলানো এই আমার ভেতরকার মানবী-সত্বা নিশ্চয়ই শরীরের উর্দ্ধে উঠতে পেরেছিল তোর কাছে, নইলে আমাদের সম্পর্ক আজও কি করে অটুট রইলো ? `প্রেম' দিতে পারিনি বলে আমাকে পরিত্যাগ করিসনি তুই, আমি যে-ভালোবাসা দিতে পেরেছি তার অসম্মান করিসনি কখনো । আমাদের সম্পর্ক বিরল-নজির হলেও, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি নেই শঙ্খর । কারণ সে জানে আমি আর তুই এক বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি, কিন্তু শারীরিকভাবে সম্পৃক্ত হইনি কোনদিনই ।

    কিন্তু জাহিরুল ? বাংলাদেশে থাকতে আমার সঙ্গে যে একটি সহজসরল বাঙাল ছেলের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল এ কথাটা শঙ্খকে কখনো বলতে পারলাম না কেন বল্‌ তো ? কারণ একটাই । বাসনা-কামনার অন্তর্গত এই স্থূল দেহ, নারী-পুরুষের যৌন আকর্ষণ, - শঙ্খর সঙ্গে আমার বিবাহিত জীবনে তার ভূমিকা ছিল নগণ্য । তবুও সে আমার স্বামী । আমার শরীরের প্রতি ওর আগ্রহ থাক বা না থাক, আমি অন্য কোন পুরুষের প্রতি শারীরিকভাবে আকর্ষিত হয়েছিলাম কখনো, এবং তাকে গ্রহণ করেছিলাম - এটা জানলে গভীরভাবে অসম্মানিত বোধ করবে ও । আমি জানি, যুক্তিবুদ্ধি আদর্শের কাছে দায়বদ্ধ শঙ্খ স্ত্রী-র জীবনের কোন ক্ষণস্থায়ী দুর্বলতা বা আকস্মিক স্খলন নি:শব্দে মেনে নেবে । বিচ্ছেদ তো নয়ই, সামান্য অসভ্যতাও করবে না । কিন্তু কষ্ট পাবে । `স্বামী' বলে সম্ভবত অপমাণিত বোধ করবে । জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও সবসময় সবার চেয়ে এগিয়ে, হীনমন্যতায় ভোগবার কোনও কারণ কখনো ঘটেনি ওর জীবনে । সে যদি হঠাৎ জানে তার স্ত্রী যুক্তিবুদ্ধিহীনভাবে কোন এক নেহাৎ সাধারণ ছেলের প্রেমে পড়ে পাগল হয়েছিল কোনদিন, এক ধরণের পরাজয়ের গ্লানি ওকে কুরে কুরে খাবে । আমি শঙ্খের স্ত্রী, ওকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি; ওর জ্ঞানবুদ্ধি, বিদ্যাশিক্ষা, ধৈর্যস্থৈর্য এখনো আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে, সেইজন্যেই অন্য কারো কাছে ছোট হবার গ্লানি থেকে ওকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমারই । জাহিরুলের প্রতি উদ্দাম প্রেমে যদি বা আমি ভেসে গিয়েছিলাম একদা, শঙ্খ ছাড়া কাউকে স্বামী হিসেবে কল্পনা করিনি কখনো ।

    তোকে আমি বাংলাদেশ থেকে ফিরে এসেই জাহিরুলের কথা বলেছিলাম । আমার জীবনের এত বড় ঘটনাটা তোকে একেবারেই বলবো না তা তো হতেই পারে না । কিন্তু তোকেও সেদিন আমি সম্পূর্ণ সত্য বলতে পারিনি রে রুদ্র । অনেক রেখেঢেকে, নিজেকে বাঁচিয়ে বলেছিলাম; যেন একটা শরীরের ষড়যন্ত্রে মনের শুভবুদ্ধি লোপ পাওয়া নেহাৎ অঘটন ছিল জাহিরুল আর আমার সম্পর্ক, বিদেশী উপন্যাসে পড়া `ঝোড়ো এযাফেয়ার' । কিন্তু প্রথম থেকেই আমি জানতাম জাহিরুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কে কোন ফাঁকও ছিল না, ফাঁকিও ছিল না । তাকে ভালোবেসেই প্রেমে পড়ার অর্থ এবং স্বাদ জেনেছিলাম আমি । সেই জীবনে প্রথম । তাকে ছেড়ে আসার কষ্ট - অসহ্য কষ্ট - আজও আমার বুকের মধ্যে যে দপদপ করে জ্বলছে, তা তোকেও কোনদিন বলতে পারিনি ।

    এ সব শুনতে তোর ভালো লাগছে না জানি । আমার সঙ্গে তোর সম্পর্ক প্লেটনিক না হলেই যে তুই অনেক বেশি সুখী হতি তা আমার অজানা নয় । শরীরের শুচিবায়ু যদি জলাঞ্জলিই দিলাম, সে ব্যক্তি তোরই হওয়া উচিত ছিল । কিন্তু কি করবো বল্‌ ? শরীরের ইচ্ছে না হলে যে তাকে জাগানোই যায় না । আর কেন যে সে অকুস্থানে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে হঠাৎ জেগে উঠেছিল তারও কোনো ব্যাখ্যা জানি না । দেহেরও মন আছে, আর তা যে একেবারেই আমার ইচ্ছের অধীন নয়, জাহিরুলের প্রেমে পড়েই সেটা বুঝেছিলাম ।

    আমি যখন ইউ. এন- এর একটা এযাসাইনমেন্ট নিয়ে ফীল্ড ওয়ার্ক করতে এক বছরের জন্যে ঢাকায় যাই তখন আমি, তুই, শঙ্খ একসঙ্গেই এক ফ্ল্যাটে ছিলাম বস্টনে । যৌবনের আদর্শবাদের সঙ্গে বাস্তবের অনতিক্রম্য ব্যবধান আমরা মেনে নিয়েছি তখন । দেশোদ্ধারের জন্যে কয়েকটি উত্সর্গীকৃত যুবক-যুবতীর কুরবানী যে যথেষ্ট নয় এ কথা বুঝতে আমাদের সময় লেগেছিল । তার মধ্যে হত্যা, মৃত্যু, জেল, অত্যাচার অনেক কিছুই হলো, অযথা কতগুলো তাজা-রক্ত বন্ধু হারালাম, খামোখা মরলো কিছু নিরীহ মানুষ, জনসাধারণকে সঙ্গে টানতে পারলাম না আমরা, নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে উঠতে লাগলাম ত্রক্রমশ । বিপ্লবের কোমর ভেঙে গেল । তখন আমাদের বিত্তবান অভিভাবকেরা তাদের ভগ্নস্বপ্ন, ভগ্নস্বাস্থ্য, হতক্লান্ত, পরাজিত, লুকিয়ে-পালিয়ে থাকা বুদ্ধিমান উজ্জ্বল মেধাবী ছেলেমেয়ে গুলোকে বাঁচাতে যেন-তেন প্রকারে বিদেশ পাঠিয়ে ঘাড় থেকে নকশালের ভূত নামাবার ব্যবস্থা করেছিলেন । সত্যি বলতে, আমাদের প্রাণেও বাঁচিয়েছিলেন । আমেরিকায় এসে আবার পড়াশুনোর জগতে ফিরে যেতে আমাদের ভালো লেগেছিল । বস্টনে থিতু হয়ে বসে আমাদের তিনজনের সংসারে নতুন রং আনতে মা হতে চাইলাম আমি । শুভায়ু জন্মালো ।

    শুভায়ু তখন বছর দুয়েকের, প্রথম বিশ্বের সমৃদ্ধি এবং স্বাচ্ছন্দ্যে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি আমরা, ইউ. এন - এর এই অফারটা হঠাত্‌-ই পেয়ে গেলাম । নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউ. এন. নানা প্রজেক্ট তৈরি করেছে সে দেশটাকে জানতে, বুঝতে । শুভায়ুকে ছেড়ে যেতে আমি দ্বিধা করেছিলাম, কিন্তু তোরা সেটা হেসেই উড়িয়ে দিলি । তোরা দুই বাবা যে এক মায়ের চেয়ে ঢের ভালোভাবে ওকে দেখবি এ কথা আমিও মনে মনে জানতাম । অতএব তোদের জিম্মায় শুভায়ুকে রেখে আমি এক বছরের জন্য ঢাকা চলে গেলাম ।

    জাহিরুল ছিল আমার বিভাগে রিসার্চ এযাসিসটেন্ট, সবে এম. এ. পাশ করে ঢুকেছে । আমার সহকারী হিসেবে আমাকে নিয়ে গ্রামে-মফস্বলে ঘোরার কাজে ওকেই বহাল করলেন বিভাগীয় প্রধান । বাংলাদেশের সহজ সরল সাদাসিধে ছেলে জাহিরুল, আমাদের মতো প্রেসিডেন্সী, হারভার্ড, এম. আই. টি.-র দরজা পেরোয়নি, ফরিদপুর থেকে ঢাকা আসাই ছিল তার `বিলাত দর্শন' ! ইংরিজি বলায় রপ্ত নয়, কথায় বাঙাল টান স্পষ্ট । ও আমার চেয়ে বয়সে অনেকটা ছোট ছিল বলেই বোধহয় তাকে নেহাৎ বাচ্চা ছেলে হিসেবেই দেখেছিলাম, তার যে একটা `পুরুষ' সংজ্ঞা আছে সে বিষয়েও সচেতন ছিলাম না । নিতান্তই বাধ্য ছাত্রের মতো আমার কাজে লাগতে সতত উত্সুক ।

    জাহিরুলের কাছে আমি ছিলাম `দেবী' সমান, আমার মতো হাজার গুণ দিয়ে গড়া মহিলা সে নাকি আগে কখনো দেখেনি । তার ওপর নকশাল আন্দোলন করেছি, জেল খেটেছি, পুলিশের হাতে মার খেয়েছি - এসব জেনে তো সে আরোই মুগ্ধ । তোদের ভালোবাসা আর ওর ভালোবাসার মধ্যে একটা বিরাট তফাৎ ছিল । ও আমাকে সরাসরি পুজো করতো । ওর চোখের ভাষাতেই সেটা পড়তে পারতাম আমি । সস্নেহে ওর এক মাথা ঝাঁকড়া চুল নেড়ে দিয়ে বলতাম, "ভাগ্যিস তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল ! নয়তো জানতামই না আমি এমন একজন দেবী-মহিলা !" চোখে হাসতো লাজুক জাহিরুল, "ভাগ্য তো আমার ।"

    বাংলাদেশের আনাচ-কানাচ আমরা একসঙ্গে ঘুরছি তখন । ফীল্ড ওয়ার্কের সঙ্গে সঙ্গে `নিজের দেশ' দেখবার নেশা আমাকে পেয়ে বসেছে । আমি তো পূর্ববঙ্গ এর আগে চোখেও দেখিনি, কিন্তু মা-বাবা দাদু-দিদার কাছে তাদের দেশের গল্প মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম, বাড়িতে তাঁরা বাঙাল ভাষাতেই কথা বলতেন । তাঁদের কাছে যে সব গ্রাম, শহর, জেলা, এমনকি পাড়া-মহল্লার নাম শুনেছি, সর্বত্র গিয়েছি । কুমিল্লা, নোয়াখালি, মাদারিপুর, নীলফামারি, মালখানগর, বরিশাল, ফরিদপুর - কোথায় না নিজের শিকড়ের সন্ধানে ঘুরেছি তখন ! আমরা আজন্ম কলকাতা থেকেও `পূর্ববঙ্গীয়' - গর্বিত `বাঙাল' । হয়তো তাই, কী এক অমোঘ নাড়ির টান অনুভব করেছিলাম সেই কখনো-না-দেখা পূর্বপুরুষের দেশের প্রতি । আমার মায়ের কাছে তাদের একান্নবর্তী পরিবারের যে বসতবাড়ির গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছিলাম সেই জমিদারী ছিল বিক্রমপুরের হাসারা গ্রামে । ঘটনাচক্রে দেখা গেল জাহিরুলের মায়ের বাপের বাড়ির গ্রামও হাসারা । চমত্কার যোগাযোগ । এক সকালে রওনা হলাম আমার রোমান্টিক কল্পনার শেষ বিন্দু মায়েদের সিং দরজাওয়ালা চার দালানের জমিদার বাড়ি দেখতে - হাসারা গ্রামে ।

    খালবিলে ঘেরা পূর্ববঙ্গের সেই গ্রামে পৌঁছে আমার হৃদপিণ্ড লাফাচ্ছিল চাপা উত্তেজনায় । কিন্তু খোঁজাখুঁজি করে হাসারার সোমেদের ভিটেতে পৌঁছে বেদনায় ভেঙে গিয়েছিল আমার বুক । নেই, কিছু নেই সেই পুরোনো বাড়ির, সব ধূলিস্মাৎ । শুধু একপাশের একটি দোতলা দালান এখনো দাঁড়িয়ে আছে । সেখানে এখন যারা থাকে তাদের পূর্বপুরুষ জল সরবরাহ করতো বাবুদের । সামনের সিং দরজা বা বাইর বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই, আছে শুধু ভাঙাচোরা অবস্থায় পিছনের দরজাটুকু, যাকে বলা হতো পাছদুয়ার, যেখান দিয়ে মেয়েরা খালে যেতেন, রান্নাঘরের বাসন ধোওয়া হতো, উচ্ছিষ্ট ভাত জমতো জলের নিচের সিঁড়িতে হাঁটুসমান, ছোটবড় মাছ এসে সেই ভাত ঠুকরে খেতো । আমার বাবার পরিবার দেশ বিভাগের অনেক আগেই কলকাতা চলে এসে এই বঙ্গে স্থায়ী বাসা করেছিলেন, কিন্তু আমার অতি-সম্পন্ন দাদু-দিদা শেষ পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন বলে দেশ বিভাগ তাদের পথে বসিয়ে দেয় । দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করেই কটেছে তাঁদের শেষ জীবন । আর আমার মায়ের ঠাকুমা, যিনি কিনা জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ, হাতভর্তি সোনার চুড়ি, গলায় সাতপ্যাঁচের হার পরে রাণীর দাপটে বিরাট যুক্ত-সংসারের কতৃত্ব করতেন, অবস্থার এই বৈষম্য সহ্য করতে না পেরে পাগল হয়ে যান । ছোটবেলায় আমি তাঁকে দেখেছি রেফিউজি কলোনির দরমার ঘরের মাটির মেঝেতে নিজের নোংরায় মাখামাখি শুয়ে থাকতে ।

    জাহিরুলের দিদিমা ফতিমাবিবি বলেছিলেন, `আমরা মাত্র তিনপুরুষের মুসলমান মামুনি । মাঝে মাঝে ভাবি সব হিন্দুরা তখন মুসলমান হইয়া গ্যালেই তো ল্যাঠা চুইকা যাইত । হর্বস্ব খোয়াইবার চাওন জাত দ্যাওন ভালো আছিল না ?' ব্যাপারটা যে আরো অনেক জটিল তাঁকে আমি বোঝাবার চেষ্টাও করিনি ।

    জানি, হাসারায় আমি বুকভরা কষ্ট নিয়ে নিশ্চয়ই খুব স্পর্শকাতর মনের অবস্থায় ছিলাম, আর জাহিরুল কোনো দোষ না করেই অপরাধবোধে কাতর । আমরা দেশবিভাগের বলি হলাম বলেই শেষপর্যন্ত ওরা একটা নতুন রাষ্ট্র গড়তে পারলো - সেই অপরাধবোধ । পাকিস্তানের হাত থেকে পূর্ববঙ্গ ভেঙে এনেও বাঙালিরা এক হলো না, হলো বাঙালি মুসলমানের আলাদা `বাংলাদেশ' - সেই অপরাধবোধ । বাংলাদেশ আমার নয়, জাহিরুলের, এমন অসম্ভবও সম্ভব হয়ে গেল রাজনীতির খেলায় - সেই অপরাধবোধ । আমার মায়ের পরিবারের মতো হাজার হাজার পরিবারের সব কষ্টের জন্য দায়ী যেন ও-ই । কোন এক সম্পন্ন হিন্দু পরিবারের একদা চকমিলানো বাড়ির ধ্বংসস্তূপে পাছদুয়ারের খালে নেমে যাওয়া ভাঙা সিঁড়িতে বসে এক অসহায় কষ্টে আমরা একাত্ম হয়েছিলাম । কার দোষে, কার দোষে এমন হলো জাহিরুল - বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে ভাসিয়েছিলাম আমি । বন-বাদাড়ে অন্ধকার ঝামড়ে নেমেছিল, খালের জল নিথর, অবিশ্বাস্য স্তব্ধতা চারিদিকে, হাজার জোনাকির নি:শব্দ জ্বলা-নেবা ছাড়া পৃথিবীতে যেন আমি আর জাহিরুল ছাড়া আর কেউ ছিল না । আমাকে শান্ত করতে হঠাৎ জাহিরুল ওর দু'হাতের মধ্যে সাপ্টে নিয়েছিল আমাকে । ওর বুকে মুখ রেখে আমি সহসা জেনেছিলাম সে পুরুষ । আমার সমস্ত কষ্টের আবেগ নিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম ওকে, অন্ধকারে খুঁজেছিলাম ওর বলিষ্ঠ শরীর, ওর ঠোঁট । যেন আমাদের মিলনের মধ্য দিয়েই সব বিভেদ ঘুচে যাবে, সবার অপরাধের স্খালন হবে ।

    হ্যাঁ, আভিধানিক সংজ্ঞায় আমাদের সম্পর্ককে `এযাফেয়ার' বলতেই হয়, যেহেতু তা ছিল অস্থায়ী । আর অস্থায়ী বলেই তীব্র আর উদ্দাম । তার ওপর আমি ছিলাম বিবাহিত, সন্তানের মা এবং বয়সে বড় । ক্লাসিকেল এযাফেয়ারের সব রসালো রসদই মজুদ ছিল । কিন্তু আমরা দু-জনেই জানতাম, যখন আমরা শারীরিক দূরত্বে চলে যাবো এ সম্পর্ক স্থায়ী হয়ে থাকবে আমাদের মনে । জাহিরুলের কাছে আমি যা পেয়েছিলাম, সমাজসংস্কারের ভয়ে আমি যে তা থেকে নিজেকে জোর করে সরিয়ে নিইনি এর জন্য আজও কৃতজ্ঞবোধ করি ভাগ্যের কাছে । আমার নারীত্বের সার্থকতা সুচিন্তিত বিবাহে বা পরিকল্পিত মাতৃত্বে পাইনি, পেয়েছিলাম জাহিরুলের আবেগমথিত প্রেমে ।

    আসলে কী জানিস ? আমার যৌবনের প্যাশন সবটাই ঢেলে দিয়েছিলাম নকশাল আন্দোলনের পায়ে । সেটাই ছিল তীব্রতম রোমান্স - আমার প্রেম - এক মহৎ আদর্শবাদ ! শঙ্খর দ্বারা মুগ্ধ ছিলাম ঠিকই, ভালোওবেসেছিলাম, কিন্তু আমাদের সম্পর্কের মধ্যে প্রেমের উন্মাদনা ছিল না, শরীরের নেশা ছিল না, যৌনতার আকর্ষণ ছিল না, অদর্শণে অস্থির হওয়া ছিল না । প্রেমের সব পাগলামী সন্নিহিত হয়েছিল নতুন বিপ্লবের স্বপ্নে । আর শঙ্খ তো জন্মমুহূর্ত থেকেই স্থিতধী - শান্ত, গম্ভীর, স্বল্পবাক, শীতল শোণিতের মানুষ । সে ছিল বিপ্লবের থিওরেটিশিয়ান । ও ছকতো প্ল্যান, আমি আর তুই ওর ডানহাত - বাঁ হাত হয়ে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়তাম । আমার স্ফূর্তি, প্রাণবন্ত চঞ্চলতা, সাহস শঙ্খকে আকর্ষণ করেছিল, ওর পাণ্ডিত্য, স্থৈর্য, চরিত্রের গভীরতা আমাকে । বিপরীত স্বভাবের আকর্ষণ ছিল, অথচ চিন্তাভাবনাআদর্শে আমরা ছিলাম একাত্ম । আদর্শ স্বামী-স্ত্রী অবশ্যই । কিন্তু শরীর-মনের সব গ্রন্থী আলগা করে দিয়ে চাওয়াপাওয়ার উদ্দাম, অসতর্ক, দায়িত্বহীন, প্রতিটি ইন্দ্রিয়ে নেশা ধরানো আনন্দ আমার অভিজ্ঞতার বাইরেই থেকে যেত যদি না সেই সন্ধ্যায় জাহিরুল আমাকে স্পর্শ করতো ।

    কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে বিচ্ছেদও ছিল অবশ্যম্ভাবী । দু'জনেই সে বিষয়ে সতত সচেতন ছিলাম বলেই হয়তো প্রতি মুহূর্তের সান্নিধ্য দামী ছিল আমাদের কাছে ।

    এক বুক গোপন কষ্ট নিয়ে যথাসময়ে ফিরে এসেছিলাম কাজ শেষ করে । শঙ্খর সঙ্গে একত্র জীবনের শান্ত, সারবান নিরাপত্তায় বিন্দুমাত্র চিড় ধরায়নি আমার জাহিরুলের প্রতি না-ভুলতে-পারা প্রেম । অনেকদিন পর্যন্ত আমরা পরস্পরকে আঁকড়ে ছিলাম চিঠির মধ্য দিয়ে । তারপর একদিন শঙ্খ আর আমি শুভায়ুকে নিয়ে ফিরে এলাম দেশে । তুই এলি না ।

    খুব অদ্ভুতভাবে তোর থেকে বিচ্ছিন্ন হবার নতুন ধাক্কাটাই আমাকে জাহিরুলের সঙ্গে বিচ্ছেদটা মেনে নিতে শেখাল । জাহিরুল যখন ফুলব্রাইট নিয়ে আমেরিকায় পৌঁছলো, আমার বন্ধন থেকে তাকে মুক্ত করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝপ করে চিঠি দেওয়া বন্ধ করে দিলাম । আমরা তখন কলকাতায় স্থিত । মনে হয়েছিল এই পরিণতিহীন সম্পর্ক টেনে চললে অকারণে ওর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে । তারপরেও অনেক অনেক চিঠি লিখে জবাব না পেয়ে একদিন সে-ও লিখেছিল তার শেষ চিঠি ।

    "- ঠিক আছে । তোমাকে আর কোনদিন বিরক্ত করবো না । কিন্তু তোমার ইচ্ছে মতো এ সম্পর্ক তুমি শেষ করে দিতে পারো, এমন ভাবলে ভুল করবে । যেখানে তুমি আমার, সেখানে তুমি আমারই থাকবে চিরকাল - আমার মৃত্যুদিন পর্যন্ত ।

    কেড়ে নিতে পারবে না
    যা আমাকে দিয়েছো কখনো ।
    শরীরের অন্ধকারে
    আমার অস্তিত্ব জুড়ে
    ভরা আছে তোমার নির্যাস
    পবিত্র - যেহেতু তা ব্যক্তিগত

    গোপন সিন্দুকে
    যত্নে রাখা নিভৃত আতর ।

    আমি যেখানেই যাই
    সুগন্ধে মদির
    সঙ্গে থাকে তোমার আদর ।


    আজ দুই দশক হতে চললো তার সঙ্গে যোগাযোগ নেই বটে, কিন্তু জাহিরুলকে ভুলে থেকেছি এ কথা বললে ভয়ঙ্কর মিথ্যে বলা হবে । ওই যে বললাম, আমার বুকের ধুকপুকানির মধ্যেই ওর অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে । যখন এই সুস্থির, সফল, পরিশীলিত জীবনের নিরাপত্তায় আমার প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে, পুরোনো পাগলামিকে ফিরে পেতে চেয়ে জাহিরুলকেই খুঁজি আমার স্মৃতির মধ্যে । চোখে ভাসে সেই অবিশ্বাস্য ছ'টা মাস, অন্ধ আবেগে ভেসে যাওয়ার সুখ, ইন্দ্রিয়ের পরতে পরতে ঢেউ-এর অস্থিরতা । ভাবি, আমি তাকে খুঁজে বের করতে চাই না, কিন্তু দৈব ? আবার কোন দৈব কি তাকে আর একবার আমার কাছে নিয়ে আসতে পারে না ?

    তুই কি বিশ্বাস করবি দৈবের সেই দয়া জাহিরুলের কন্ঠস্বর হয়ে ভেসে এলো আমার কাছে নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দিনে ? ভণিতামাত্র না করে কি বললো জানিস ? `- এক্ষুনি এসো । আছি এই হোটেলের এত নম্বর ঘরে । আর শোনো, সেই তসরের শাড়িটা পোরো যেটা পরে হাসারা গিয়েছিলে । জানি ওটা তুমি সযত্নে তুলে রেখেছো ।' তারপর স্তম্ভিত আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই রেখে দিল ফোন । আত্মবিশ্বাসটা একবার দ্যাখ !

    কতকাল বাদে সেই সবুজপাড় তসরটা বার করলাম আমি । বুক ভরে পুরোনো গন্ধ নিলাম, তোলপাড় বুকের তলায় অনুভব করলাম সেই অপাপবিদ্ধ ছেলেটির সরল ভালোবাসা । নতুন শতাব্দীর প্রথম দিনে জাহিরুল তবে আমার কাছে ফিরে এলো ! জেনেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি । আর সত্যিই যখন ওর মুখোমুখি হলাম মুহূর্তে কোথায় ভেসে গেল কুড়ি বছরের বিচ্ছেদ ! আমি যেখানে তার, সেখানে অন্য কারো জায়গা নেই । জাহিরুল সেই অমোঘ অধিকারে আমাকে কাছে টানলো, যে অধিকারে দীর্ঘ অদর্শণের পর সন্তান জড়িয়ে ধরে মা-কে, স্বামী আদর করে স্ত্রী-কে, আর তোর মতো প্রিয় বন্ধু আলিঙ্গন করে বান্ধবীকে । ভাঁজহীন সময় গড়িয়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে আমার জীবন থেকে কখনোই মুছে যায়নি । আজ মধ্যবয়সী আমি পরিণতবয়স্ক জাহিরুলের অতি-চেনা সান্নিধ্যে সারাদিন কাটিয়ে এসে খুশির হাওয়ায় ভাসছি । হাল্কা, পরিতৃপ্ত নির্ভার । গরম দুপুরে শিমূল তুলো । এই আনন্দের শরিক কাউকে না করতে পারলে মনে হচ্ছে আমি ফেটে যাবো । তুই ছাড়া আর কে বুঝবে আমার এই সৃষ্টিছাড়া গোপন কথা ?

    জাহিরুলকে হিংসে করিস না রুদ্র, আমার জীবনে তোরা কেউ কারো বিকল্প নোস । স্বামী হিসেবে শঙ্খ, বন্ধু হিসেবে তুই, আর আমার সন্তান শুভায়ু, যেখানেই তোরা থাক না কেন, সতত যেমন আমার অস্তিত্বের অংশ হয়ে থাকবি, জাহিরুলও তাই । সে আমার জীবনের চতুর্থ পুরুষ । আমার চিরস্থায়ী প্রেম ।

    নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে রে আজ, কেমন যেন ভরা-ভরা, সুখ যেন উপচে পড়তে চাইছে । কষ্ট শুধু একটাই । আজও, শঙ্খর সম্মানরক্ষার্থে, জাহিরুলের কথাটা ওকে বলতে পারলাম না ।

    ( পরবাস ৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments