• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৬ | সেপ্টেম্বর ২০১০ | গল্প
    Share
  • সব পেয়েছির দেশ : রুচিরা



    ॥ ১ ॥


    পাশের ঘরে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় । উঠে দেখি শাশুড়িমা তাঁর ঘরে ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে রয়েছেন । বোধশক্তিহীন এই মানুষটাকে দেখলে কে বিশ্বাস করবে যে এককালে পান থেকে চুন খসলে ইনি দশটা কথা শোনাতে এক মুহূর্ত ইতস্তত করতেন না । রোগা শরীরটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে শুইয়ে দিই বিছানায় । দ্রুত গতিতে সংসারের কাজ সারি । ছেলেমেয়ে স্কুলে চলে যায় । সমীরণকে পরিষ্কার করে ওর হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিই । রুমা এসে পড়ে । তাকে সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে গোগ্রাসে খাবার গিলে বেরিয়ে পড়ি স্কুলে ।

    বাস ট্যাক্সি রিক্সা আর লোকে গিজগিজ করছে রাস্তা । তার মধ্যেই বাজার বসেছে এক দিকে । কতকাল এই একই দৃশ্য দেখে চলেছি । একটু দৃশ্যবদল, একটু খোলা আকাশের জন্যে মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে যায় প্রানটা । অথচ চোখ বন্ধ করেও অন্য কোন জায়গার কথা ভাবতে পারি না আমি । আমার রংচটা সংসার, স্কুল, এই পাড়া, ভিড় বাস এই গোলকধাঁধাই আমার পৃথিবী । মাঝে মাঝে নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করে সত্যি বেঁচে আছি তো !

    খবরের কাগজওয়ালা রাস্তা আটকে দাঁড়ায় - বৌদি, লাস্ট দুমাসের টাকা বাকি পড়ে আছে । এখন কি দিতে পারবেন ? ঝাঁঝিয়ে উঠি আমি - জানো না এই সময় আমি স্কুলে বেরোই ? কাল সকালে এসো ।

    উর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে থাকি । প্রচণ্ড ভিড় বাস । কোনোক্রমে নিজেকে গুঁজে দিই । কাগজওয়ালাকে নতুন মাস পড়লে আসতে বললেই হত । অতগুলো টাকা কোথা থেকে দেবো । দু'রকমের কাগজ আসে বাড়িতে । একটা বন্ধ করে দিলে টাকার একটু সাশ্রয় হত । কিন্তু বললেই গোঁসা হবে সমীরণের । এমনিতেই এত বছর ধরে ভুগে ভুগে সবসময় কেমন তিতিবিরক্ত হয়ে থাকে মানুষটা । তার ওপর সারাদিন বাড়িতে বসে বসে দুটো কাগজের সব মারামারি আর খুনোখুনির খবর মুখস্থ করে ।

    বাস থেকে নেমে ঠিক স্কুলে ঢোকার সময় মোবাইলটা বেজে ওঠে । মায়ের ফোন ।

    - ফোন করার আর সময় পেলে না ?

    - লেবুতলা স্কুলের ক্লার্ক বিমলবাবু এসেছিলেন । পরের রবিবার স্কুলের রজতজয়ন্তীর অনুষ্ঠান । তোকে নিমন্ত্রণের চিঠি দিয়ে গেছেন । অনেক করে যেতে বলেছেন ।

    - বললেই যেতে হবে নাকি ?

    - তুই বড্ড খিটখিটে হয়ে গেছিস অন্বেষা ।

    - সে তো তুমি বলবেই । তোমাকে তো আর রুগী নিয়ে দিনরাত ঘর করতে হয় না । সারাদিন খাটতে খাটতে আমার মুখে রক্ত উঠে যাওয়ার জোগাড় ।

    লেবুতলা স্কুলের রজতজয়ন্তী । সে অনুষ্ঠানের আবার এত ঘটা কিসের ? শুধু শুধু পয়সার শ্রাদ্ধ করা । স্কুলে গাদা স্টুডেন্ট । বসার বেঞ্চ পর্যন্ত নেই । বৃষ্টি হলেই টালির চাল দিয়ে জল পড়ে । ক্লাস বন্ধ হয়ে যায় । সে সব না সারিয়ে লোকজনকে নিমন্ত্রণ করে ফুর্তি করার ব্যবস্থা হচ্ছে । মাথাটা গরম হয়ে যায় আমার । ঐ ধ্যারধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না । ওরা নিশ্চয় ওঁত পেতে আছে । গেলেই মোটা চাঁদা চাইবে । তার ওপর যাতায়াতের খরচ । ট্রেন থেকে নেমে রিক্সা, তারপর বাস, নৌকো, আবার রিক্সা । এতো কাণ্ড করে যাওয়া আবার সেই দিনেই ফেরা । তাছাড়া রবিবার দিনটায় কত কাজ থাকে বাড়িতে । দু দুটো রুগীকে ফেলে কোথাও যাওয়ার জো আছে !



    ॥ ২ ॥


    কদিন ধরে লেবুতলা আমায় তাড়া করে বেড়ালো । কাজ করতে করতে বার বার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি । মানসচক্ষে কেবলই ভেসে উঠছে সবুজ ধানে ভরা মাঠ, তার মাঝখানে ভাঙ্গাচোরা লেবুতলা স্কুল । ধানে নতুন শিস এলে কেমন একটা মিষ্টি সুবাসে ভরে যেত স্কুলটা । এক যুগ আগে আমার সঙ্গে কি একটা সামান্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল । তাও এত কাল পরে মনে করে আমায় নিমন্ত্রণ করেছে ভেবে আশ্চর্য লাগছে খুব । মা জোর করছে - `ঘুরে আয় । কতদিন কোথাও যাসনি । আমি এদিকটা সামলে দেব ।' অথচ যখন ঐ লেবুতলা স্কুলে চাকরি পেয়েছিলাম তখন এই মা-ই কিছুতেই জয়েন করতে দিতে রাজি হয়নি । কত দুশ্চিন্তা - `অত দূর যাতায়াত করতে পারবি না । অসুস্থ হয়ে পড়বি । আলো নেই পাখা নেই অমন অজ পাড়াগাঁয়ে কেউ যায় ?'

    শেষে থাকতে না পেরে একদিন বিমলদাকে ফোন করলাম । আমার গলা শুনেই পুরোনো দিনের মতো উচ্ছ্বল হয়ে উঠলেন তিনি - আমি কদিন ধরেই তোমার ফোনের অপেক্ষা করছিলাম । রবিবার আসছ তো ?

    - এতদূর যাওয়া বড্ড পরিশ্রমের বিমলদা ।

    - কিছু পরিশ্রম নয় । দিনকাল অনেক বদলে গেছে । ধর্মতলা থেকে গাদিয়াড়ার বাস ধরবে । দামোদর নদীটা পেরোলে একটু খেয়াল রেখো । প্রথমে চালতাপুকুর স্টপেজ । তারপরেই মোহনপুর । মোহনপুরে নেমে একটা রিক্সা করে নিও । লেবুতলা স্কুল বললেই পৌঁছে দেবে । মনে রেখো আমরা সবাই তোমার পথ চেয়ে থাকব । তোমার আসা চাই-ই চাই ।

    বিমলদার অকৃত্রিম আন্তরিকতা আমার ভেতরের কোনো এক জমাটবাঁধা অন্ধকারকে ছিন্নভিন্ন করে দিল । সব প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে গেল । রবিবার আসতেই আমি মায়ের হাতে আমার সংসার সমর্পণ করে ধর্মতলা থেকে গাদিয়াড়ার বাসে চেপে বসলাম । দেখতে দেখতে শহরের কংক্রীটের জঙ্গল পেরিয়ে বাস এসে পড়ল ন্যাশানাল হাইওয়েতে । আশেপাশের সব গাড়িকে ওভারটেক করে হু হু করে ছুটে চলল বাস । সমীরণ খুব ভালোবাসত এরকম ছুটে চলা । জোরে, আরো জোরে । সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলো । মারাত্মক গতির নেশা ছিল । বিদেশে থাকাকালীন ছুটি পেলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম আমরা । কোনদিন ভাবিনি ছুটতে ছুটতে একদিন হুমড়ি খেয়ে পড়ব সবাই, চলাটাই থেমে যাবে । ভাগ্যিস লেবুতলার নিমন্ত্রণটা এলো । কতকাল পরে সব ছেড়ে এমন বেরিয়ে পড়েছি । দুরন্ত নীল আকাশ । অথৈ সবুজ প্রকৃতি । লেবুতলায় বসবাসের দিনগুলো ছিল এমনই সবুজের মধ্যে ডুবে থাকা । কলকাতা থেকে ডেলি প্যাসেঞ্জারী করা যেতনা । তাই স্কুলের পাশেই একজনের বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম । শনিবার স্কুল করে বাড়ি চলে আসতাম । আবার সোমবার সকালে ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাওয়া । স্মৃতির পাতায় লেখা সেই দিনগুলো আজ যেন একটা গল্প মনে হয় ।

    ॥ ৩ ॥


    লেবুতলা বালিকা বিদ্যালয় । গ্রামের নামেই স্কুল । শুধু মেয়েদের জন্যে হাইস্কুল ওই অঞ্চলে আর একটাও ছিল না তখন । অনেক ছাত্রী । সেই তুলনায় হাতে গোনা ক্লাসরুম । ইঁটের বাড়ি, টালির চাল । চারিদিকে ধানের ক্ষেত । আশে পাশের গ্রামের বেশিরভাগ লোকই ছিল গরিব । কিন্তু সব সময় হাসি লেগে থাকত সবার মুখে ।

    স্কুলে ক্লাস নিতে নিতে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ত একটা রোগা লোক স্কুলের মাঠ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে । লোকটার মাথায় পাগড়ি । কখনো টুপি । ঘোড়াটা খুব ধীরে হাঁটত । লোকটারও কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না । ঘোড়ায় বসে আপন মনে সে জাল বুনতো । লোকটা স্কুলের এলাকায় ঢুকে পড়লে সারা স্কুলটা নিস্তব্ধ হয়ে যেত । ছাত্রীরা দিদিমনির কথা না শুনে হাঁ করে বাইরে তাকিয়ে থাকত । দিদিমনিরাও পড়ানো ছেড়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকতো । ছাত্রীরা বলাবলি করতো - `দেখেছিস, কেমন নবাবের মতো নুরো যাতায়াত করে । অনেকের পয়সা থাকতে পারে । কিন্তু কার এমন মেজাজ আছে যে ঘোড়ায় চেপে কাজে যায় ?' সারা স্কুলে চাপা একঝলক আনন্দ আর কৌতুকের ঢেউ বয়ে যেত । যখন দূরে রাজমিস্ত্রীর কাজ পড়ত বা আত্মীয়ের বাড়ি বা হাটে বাজারে যেতে হত তখন নূরো ঘোড়ায় চড়ে যেত । কাজ সেরে পড়ন্ত বেলায় বাড়ি ফিরত । স্কুলের কোনো প্রাচীর ছিল না । তিন চার ফুট চওড়া একটা নালা ছিল সামনেই । কোনোদিন হয়তো একটু বৃষ্টি হয়েছে । গ্রামের রাস্তাঘাট কাদা হয়ে গেছে । নূরোর ঘোড়া স্কুলের নালার ধারে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তো । নালা পেরনো ঘোড়ার পক্ষে অসম্ভব । অগত্যা নূরো ঘোড়া থেকে নামত । ঘোড়াকে বলত - `বড্ড দুর্বল হয়ে গেছিস । ঠিকঠাক ছোলা ভূষি খাওয়াতে পারিনা তোকে । কি আর করব বল । আমিও তো মাছ মাংস খেতে পাইনা ।' ঘোড়ার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে লাগাম ধরে ঘোড়াটাকে নালা পার করিয়ে দিতো । তারপর আবার ঘোড়ায় উঠতো ।

    নুরোর পুরো নাম ছিল নূর মহম্মদ । ছোটোখাটো চেহারা । একটু দাড়ি ছিল । সামান্য খুঁড়িয়ে চলত । খুব অভাবের সংসার ছিল তার । নিজের কোনো জমিজমা ছিল না । লোকের বাড়ি খেটে খেত । খুব ভালোবাসত রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে । কিন্তু গ্রামে আর কটা ইঁটের বাড়ি । তাই মনের মতো কাজ জুটতো না মোটেই । তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না । ধানের মরশুমে চাষের কাজ করত । বাকি সময় পুকুরে মাছ ধরে দেওয়া, গাছ থেকে নারকেল পেড়ে দেওয়া এই সব ফাইফরমাস খেটেই চালিয়ে নিত । কোনোদিন মজুরী বাবদ দশ পনেরো সের চাল পেলে সেটা একটা থলেতে ভরে আনত । স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখা যেত নূরো ঘোড়ার পিঠে বসে জাল বুনছে । মাথায় চালের বস্তা । স্কুলের কোনো ছাত্রী বলতো - `ও নূরো চাচা, চালের বস্তাটা মাথায় কেন বইছ ? ঘোড়ার পিঠে রেখে দাও । তোমার কষ্ট কম হবে ।' সে বলতো - `আমার ঘোড়াটা যে খুব দুর্বল । আমার একটু কষ্ট হোক । অবলা জীবটার একটু কষ্ট কমুক ।'

    সেবার লেবুতলার পঞ্চুবাবু মারা গেলেন । তার ছেলের খুব ইচ্ছে বাবার নামে একটা স্মৃতি মন্দির তৈরি করে দেবে । কিন্তু পয়সা নেই । একদিন নূরোকে কথায় কথায় তা জানাতেই নূরো খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল । বলল - তোর কোনো চিন্তা নেই । তুই খানিকটা সিমেন্ট বালি আর ইঁট কিনে আন । সবটা কেনার যদি পয়সা না থাকে তো চল আমিও তোর সঙ্গে কারখানায় যাচ্ছি । ইঁট ধার দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেব ।

    - সে তো বুঝলাম । কিন্তু তোমায় মজুরি দেবো কি করে ?

    - ওটা একটা ভাবনার বিষয় নাকি । তোর বাড়িতে খেয়ে নেবো । পারলে একটু চাল দিয়ে দিস । মেয়েটা খেয়ে পরে বাঁচবে । এক দিনে দিতে না পারিস পরে পরে দিলেও হবে । পঞ্চু চাচার জন্যে এইটুকু করতে পারব না ?

    কার্ত্তিক মাস এলেই গ্রামের সব বাড়িতে বাড়িতে নাম সংকীর্তন শুরু হয়ে যায় । নূরো এই সময় সারা মাস হিন্দুদের সঙ্গে দল বেঁধে হরিনাম করে বেড়াতো । হিন্দুদের কেউ মারা গেলে খোল করতাল বাজিয়ে হরিনাম গাইতে গাইতে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হত । ঘাটক্রিয়ার সময়ও হরিনাম সংকীর্তন হত । সেই সব নাম সংকীর্তনেও নূরো অংশগ্রহন করত । হিন্দুরা নূরোকে বির্ধমী বলে কোনোদিন অবজ্ঞা করেনি । ছোঁয়াছুঁয়ির কোনো প্রশ্নও উঠতো না । মুসলিমদের মধ্যে কেউ কেউ বলতো - কী রে নূরো, মুসলমান হয়ে হরিনাম করতে যাস । তোর ধর্ম থাকবে তো ?

    নূরো বলতো - বড্ড ভালো লাগে চাচা । আমি তো এসব করেও সেই একই নূরোই আছি । ইসলাম ধর্মমতে সকাল সন্ধ্যে নামাজ পড়ি । আসলে কী জানো । হরিনাম করলে মনে হয় আমি আল্লাকেই ডাকছি । আল্লাকেই আমার মনের কথা জানাচ্ছি । আমি কোনো তফাত বুঝতে পারি না । তোমরা আমাকে হরিনাম করতে বারন কোরোনা চাচা । আমার মনে হয় আল্লা হিন্দুদের বোঝার জন্যে তাদের মতো করে নাম সংকীর্তনের ব্যবস্থা করেছেন ।

    ॥ ৪ ॥


    বিকেলগুলো খুব গড়িমসি করে কেটে যেত । জানলা দিয়ে দেখতাম রাস্তার লোক চলাচল । একদিন বিকেল বেলা একটা গল্পের বই পড়ছি মন দিয়ে । জানলা দিয়ে উঁকি মারল একটা বাচ্চা মেয়ে । ফরসা টুকটুকে গায়ের রঙ । রোগা পাতলা চেহারা । কোলে একটা কুকুর ছানা ।

    - তুমিই নাকি নতুন দিদিমনি । শহর থেকে এসেছো ।

    - তুই কে ? ভেতরে আয় ।

    - আমি শবনম । ওই পাড়ায় থাকি ।

    আঙ্গুল দিয়ে দেখালো খালের ওদিকের জোড়াদীঘি গ্রামটার দিকে ।

    - আচ্ছা দিদিমনি । শহরে নাকি অনেক গাড়ি চলে । অনেক পাকাবাড়ি আছে । সত্যি ?

    - সত্যি ।

    - তুমি আমাকে শহরের গল্প বলবে ? আমার খুব গল্প শুনতে ইচ্ছে করে ।

    - শহরের গল্প কি আবার একটা বলার মতো গল্প হল নাকি । আমি তোকে রাজকন্যার গল্প বলব । শুনবি ? চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার - রাজকন্যা কে ?

    - একটা মেয়ে । যেমন ধর তুই ।

    - আমি রাজকন্যা । আর তুমি ?

    - আমি একটা পরী ।

    - পরী কী করে ?

    - তাহলে তো তোকে পুরো গল্পটা বলতে হবে ।

    সেই শুরু । পরে জানলাম ও নূরোর মেয়ে । আব্বা কাজে বেরিয়ে গেলেই পাড়া বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে । আর বিকেলে আমার স্কুল শেষ হলেই এসে যেত আমার কাছে । `পরী দিদিমনি একটা গল্প বল ।' `পরী দিদিমনি আমার খিদে পেয়েছে একটু খেতে দাও ।' রোজ বিকেলে আমরা দুজনে মুড়ি খেতাম আর সঙ্গে চলত গল্প । রাজা রানী রাজকন্যা রাজপুত্র রাক্ষস খোক্কস হয়ে উঠলো ওর কল্পনার পৃথিবী । রূপকথার গল্পের এমন ভক্ত হয়ে পড়ল যে রোজ গল্প বলার জন্যে বায়না করত । শনিবার বাড়ি ফিরলে মাঝে মাঝে ওর জন্যে নতুন রূপকথার বই কিনে নিয়ে যেতাম । একই গল্প দশবার করে শুনতে তার কোনো ক্লান্তি ছিল না । কিন্তু আমার ক্লান্তি লাগত । তখন শুরু করলাম গল্প বানানোর খেলা । একটু আমি বলব । একটু ও বলবে । এইভাবে তৈরি হত নতুন নতুন হরেক ধরনের গল্প ।

    একদিন শবনম ছুটতে ছুটতে এসে আমায় জিগ্যেস করলো - আচ্ছা তুমি কোনোদিন রাজা দেখেছ ?

    - তোর আব্বাই তো একজন রাজা । এরকম ভালোমানুষ আমি আর দুটো দেখিনি ।

    - দূর তুমি কিচ্ছু বোঝোনা দিদিমনি । রাজার বিশাল বাড়ি থাকে । সেখানে অনেক রকম খাবার থাকে । রাজার বাড়ির লোকেদের কখনো খিদে পায়না । তাদের অনেক নতুন জামা জুতো । জানো, আমি কাল এক রাজাকে দেখেছি ।

    - কে সেই রাজা ?

    - তুমি মশাচাচাকে চেনো ?

    শবনমের এই মশাচাচাকে কে না চেনে । আসল নাম নিরঞ্জন চৌধুরি । স্কুলের কাছেই বাড়ি । পুকুর বাগান ধানক্ষেত সমেত বেশ অনেকটা জায়গা । ঘন করে গাছ লাগিয়ে বেড়া দেওয়া চারপাশে । লোকের মনে একটা কুসংস্কার আছে । ওর মুখ দেখলে নাকি সময় খারাপ যাবে, অর্থহানি, মানহানি হবে । তাই কেউ কোনো ভালো কাজে বেরোলে ওর বাড়ির পাশ দিয়ে না গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যায় । নেহাত কারো যখন পয়সার খুব অভাব হয়, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন তারা দুরু দুরু বক্ষে ঘটি-বাটি গয়নাগাটি বা বাড়ির দলিল জামা বা ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে ও বাড়ি ঢোকে । মশা সে সব জিনিস বন্ধক রেখে তাদের চড়া সুদে টাকা ধার দেয় । পিতৃপুরুষের ব্যবসা । লোকের রক্ত চুষে খায় বলে আড়ালে ওকে সবাই মশা বলে ডাকে । কিন্তু শবনমের সঙ্গে কি সম্পর্ক ?

    - তুই চিনলি কি করে ?

    - জানো সবাই বলে ও মানুষের রক্ত চুষে খায় । তার মানে ও আসলে রাক্ষস । তাই না দিদিমনি ?

    সবেতেই আমাকে সাক্ষী মানতো । বাধ্য হয়ে বললাম - তা হতে পারে । আমি তো কোনোদিন দেখিনি তাকে ।

    - আমি দেখেছি কাল । আব্বার কদিন কোনো কাজ নেই । তাই বাজার ছিল না কিছু । আমি পারুদের পুকুরে কলমি শাক তুলতে গিয়েছিলাম । উঠে দেখি ভুলো পালিয়েছে । ভুলোর পেছনে দৌড়তে দৌড়তে ঢুকে পড়েছিলাম মশাচাচার বাগানে । বাগানে ঢুকে দেখি কত সব্জি । ভাবলাম একটু অপেক্ষা করলে রাজাকে দেখতে পাব ঠিক । কিন্তু খুব খিদে পেয়ে গেল । ভাবলাম পরে একদিন আসব । চলে আসতে যাচ্ছিলাম । দেখি অনেকগুলো ঢ্যাঁড়োস হয়ে আছে । তেল দিয়ে মেখে ঢ্যাঁড়োস ভাতে খেতে খুব ভাল লাগে । তাই পটাপট চারটে ঢ্যাঁড়োস তুলে নিলাম । হঠাৎ একজন কোথা থেকে এসে খপ করে আমার হাতটা ধরল । বলল - জানিস আমি কে ? কোন সাহসে আমার বাগানে চুরি করিস । আমি বললাম - তুমি তো রাজা । তোমার তো খাবার অভাব নেই । কিন্তু আমার ভাত খাওয়ার কিছু নেই আজকে । তাই চারটে ঢ্যাঁড়োস তুলেছি । চুরি করিনি তো ।

    - তারপর ?

    - তখন লোকটা বলল ও রাজা নয় ওর নাম মশা । আমি তো শুনে খুব ভয় পেয়ে গেলাম । কিন্তু লোকটা আমায় একটুও বকল না । সব কটা ঢ্যাঁড়োস দিয়ে দিলো আবার ঘর থেকে দুটো আলুও এনে দিল । তাহলে বলো লোকটা সত্যিই রাজা কিনা ? তাছাড়া লোকটা একেবারেই রাক্ষসের মতো দেখতে নয় । লোকেরা সবাই ওকে মিছিমিছি রাক্ষস ভাবে আর ভয় পায় । তাই না দিদিমনি ?

    - ঠিক তাই ।

    তারপর কদিন মেয়েটা আমার বাড়িতে আসে না । আমার চিন্তা হল । শরীর খারাপ নাকি । ও না এলে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে বিকেলগুলো । ঘরে মন বসে না । হাঁটতে হাঁটতে ওর পাড়ায় গেলাম । সবাই বলল সে ভালোই আছে । কিন্তু কোথায় গেছে জানেনা । পরদিন বিকেলে আদরের ভুলোকে ট্যাঁকে নিয়ে সে এল । এক হাতে ছিপ আর নারকেল মালা ভর্তি কেঁচো ।

    - পরী দিদিমনি আমায় খুঁজছিলে ?

    - হ্যাঁ । তোকে দেখিনি কদিন ।

    - আমি এখন রোজ রাজাচাচার পুকুরে ছিপ ফেলতে যাই । এই দেখো মাছের টোপ ।

    - রাজাচাচা কে ?

    - মশাচাচা গো । ওই তো আসল রাজা । ভালো নাম দিয়েছি না ? জানো রাজাচাচাও আমার সঙ্গে ছিপ ফেলে । আমি বলেছিলাম - তোমার পুকুর । আমি যা ধরব তার অর্ধেক তোমাকে দিয়ে দেবো । কিন্তু রাজি হলনা । বলল - যার যার, তার তার । সেটাও মানে না মাঝে মাঝে । আমি কোনো মাছ ধরতে না পারলে রাজাচাচা নিজের ভাগ থেকে আমায় দিয়ে দেয় ।

    - কি মাছ ধরিস ?

    - পুঁটি আর বেলে মাছ । কিন্তু চাচা একদিন দুটো রুই মাছ ধরেছিল । একটার পেট ভর্তি ডিম ছিল বলে ওটাকে ছেড়ে দিল । অন্যটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল । গোটা মাছ দেখে আব্বা তো বিশ্বাসই করছিল না । মাছ নিয়ে আবার ফেরত দিতে এসেছিল চাচাকে । চাচা বলল ওটা আমাকেই দিয়েছে । সে কী স্বাদ মাছটার ।

    - বাহ খুব ভালো ।

    - জানো দিদিমনি । তুমি যে সব গল্প বলেছ সব গল্প আমি একটা একটা করে রাজাচাচাকে শোনাই । রাজাচাচা তো রোজ বায়না করে আরো একটা শুনবে বলে । কিন্তু আমি একটার বেশি বলিনা । আমার গল্পের ঝুলি শেষ হয়ে যাবে না ? আমি তো আর বই পড়তে পারি না যে নতুন গল্প পড়ে নেব ।

    - তুই স্কুলে ভর্তি হয়ে যা । তাহলেই পড়তে শিখে যাবি ।

    - আব্বা যে ভর্তি করাতে চায় না । আমার খুব স্কুলে পড়তে ইচ্ছে করে গো দিদিমনি ।

    আমি আবার আগের মতো আমার বিকেলগুলো গল্পের বই নিয়ে কাটিয়ে দিই । একদিন শুনলাম শবনমের খুব শরীর খারাপ । ডাক্তার বলেছে ওর রক্তের দোষ আছে । ও বেশিদিন বাঁচবে না । আমার বুকের মধ্যে হাহাকার ওঠে । শবনমের বাড়িতে গিয়ে দেখি শবনম শুয়ে আছে । পাশে তার আব্বা আর রাজাচাচা । আগের দিন ছিপ ফেলতে গিয়ে নাকি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যায় । নিরঞ্জনবাবুই কোলে করে নিয়ে ছোটেন গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের বাড়ি । তিনি ছিলেন না । পাশের গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন নামকরা ডাক্তার বসেছিল সেদিন । একজন সাইকেলে করে পৌঁছে দেয় । ডাক্তার বলেছেন থ্যালাসেমিয়া আছে । তাই ওর গায়ের রঙ এমন সাদা । রক্ত পরীক্ষা করতে হবে । এক সপ্তাহ পরে এসে রিপোর্ট দেখিয়ে যেতে বলেছেন । তারপর সত্যিই থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ল । ডাক্তার বললেন যতই চেষ্টা করো এই চিকিত্সায় বেশিদিন রুগীকে বাঁচানো যাবে না । চোখের সামনে একমাসের মধ্যেই মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেল । চিকিত্সার অনেক খরচ । নূরো নিরঞ্জনবাবুর হাতেপায়ে ধরে অনেক টাকা ধার করে । কী বন্ধক রেখেছিল কেউ জানে না । চিকিত্সা শুরু হয় ।

    তারপরে আমার বিয়ের ঠিক হল । চাকরি ছেড়ে কলকাতা চলে এলাম । বিয়ে করে সমীরণের সঙ্গে উড়ে গেলাম আমেরিকা - সত্যিকারের রূপকথার রাজ্যে । দুই রাজপুত্রের জন্ম দিয়ে আমি রাজরানি হলাম । মাঝে মাঝে মনে পড়ত লেবুতলার কথা । শবনমের জন্যে মন খারাপ লাগত । ভাগ্যিস ওর মৃত্যুটা নিজের চোখে দেখতে হয়নি । তারপর সেই ভয়ংকর গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট । সমীরণের শরীরের নীচের অংশটা প্যারালিসিস হয়ে গেল । আমার জীবনের সব রূপকথা, সব বিশ্বাস ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল ।

    ॥ ৫ ॥


    - মোহনপুরে নামবেন তো বৌদি ।

    বাসের কনডাক্টার হাঁক দেয় । তাড়াতাড়ি করে ভিড় ঠেলে নেমে পড়ি । রিক্সা ধরি । স্কুলের বিশাল গেটে নামিয়ে দেয় রিক্সা । সুন্দর রঙ করা বিশাল স্কুল কমপাউণ্ড । আমার বিস্ময় বাঁধ মানে না । মিনাদি, পারুলদি, বিমলদা সবাই আমাকে দেখে এগিয়ে আসে হৈ হৈ করে । সবার বয়স বেড়ে গেছে কিন্তু চোখ মুখে চকচক করছে আনন্দ ।

    - কী যে ভালো লাগছে তোমাকে দেখে । কেমন আছ বলো । দ্যাখো চিনতে পারছ স্কুলটাকে ?

    - সত্যি চিনতে পারছিলাম না । এমন অসম্ভবকে সম্ভব করলেন কী করে ? কোনো সরকারি অনুদান পেয়েছেন নাকি ?

    - তোমার মনে আছে নিরঞ্জনবাবুকে ? তিনিই টাকা দিয়েছেন এটা বানানোর জন্যে ।

    - নিরঞ্জনবাবু ?

    - অবশ্য সঙ্গে কিছু অদ্ভূত শর্ত জুড়ে দিয়েছেন ।

    আমার মুখ আক্ষরিক ভাবেই হাঁ হয়ে যায় । তখনই দেখি নিরঞ্জনবাবু এগিয়ে আসছেন আমার দিকেই ।

    - আপনিই কি অন্বেষা দিদিমনি ? আপনার সঙ্গে আলাপ করার অনেকদিনের ইচ্ছে ।

    - তাই নাকি ?

    - আপনি যখন এখানে ছিলেন তখন আপনার সঙ্গে কোনোদিন কথা বলার সৌভাগ্য হয়নি ।

    চা দিয়ে যেতে বলে একটা ছেলেকে । স্কুলের পেছনে নতুন তৈরি করা বিশাল খেলার মাঠ । তার এক পাশে রাখা বেঞ্চে বসি আমরা । স্পোর্টস চলছে । একদিকে বসে আঁকো । একদিকে অংক দৌড় । এর পরেই বোধহয় হাঁড়িভাঙা খেলা হবে । অনেক মাটির হাঁড়ি এনে রাখা আছে পাশে ।

    - জানেন দিদিমনি শবনমের আব্বা যেদিন মারা যায় সেই দিনটা আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না ।

    - নূরো মারা গেছে ? কবে ?

    আপনি যে বছর চলে গেলেন তার পরের বছরই । আশেপাশের সব গ্রামের লোকেরা ভিড় করেছিল গোরস্থানে । শবনম একপাশে চুপটি করে বসে ছিল আগাগোড়া । একফোঁটা কাঁদে নি । হাসেও নি । মুখে কোনো ভাবান্তর নেই । আমি পাশে বসে জিগ্যেস করি - রাজকন্যা কী ভাবছিস এতো ?

    - ভাবছি আব্বা কতদূরে গেল এতক্ষণে ?

    - কেন ? কতদূরে গেলে তুই খুশি হবি ।

    - মেঘ পেরিয়ে চাঁদ তারাদের পেরিয়ে চলে যেতে হবে অনেকটা রাস্তা । তারপর যেতে যেতে পড়বে রামধনুদের দেশ । রামধনুদের ছাড়িয়ে আর একটু যেতে পারলেই এসে পড়বে সেই সব পেয়েছির দেশ ।

    - কে বলেছে তোকে এসব কথা ?

    - পরী দিদিমনি বলেছে । বলেছে সেখানে আকাশটা ঘন নীল । সেখানে সব স্বপ্নরা সত্যি হয় । সেখানে আব্বা পৌঁছে গেলেই আব্বার স্বপ্নটা পূরন হয়ে যাবে । যখন স্বপ্নগুলো সব হারিয়ে যায় তখন সেই স্বপ্নদের খুঁজে পেতে যেতে হয় ঐ সব পেয়েছির দেশে । তাই তো আব্বা গেল ।

    - কী স্বপ্ন দেখতো তোর আব্বা ?

    - আব্বা স্বপ্ন দেখতো আমি একদিন ভালো হয়ে যাব । আর সবার মতো আমার গায়ের রঙ কালো হয়ে যাবে । আর আমি পরী দিদিমনির মতো গল্পের বই পড়তে শিখে যাব । এই দেখো আব্বা একটা চিঠি লিখে গেছে তোমাকে । পড়লেই বুঝতে পারবে সব ।

    ওর হাতের মুঠো থেকে কাগজ নিয়ে দেখি আমারই হাতে লেখা `শবনম বন্ধক রইল' । নীচে নূরোর টিপ ছাপ । মেয়েটাকে বন্ধক রেখে টাকা নিয়েছিল নূরো । সেই থেকে শবনম আমার কাছে ।

    আমি প্রায় চিত্কার করে উঠি - শবনম বেঁচে আছে এখনো ?

    - হ্যাঁ । সে কথা কেউ আপনাকে বলেনি ? বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছিল জানেন মেয়েটার ওপর । ভাবলাম এত পয়সা যখন ঢালছিই ওর চিকিত্সার জন্যে তবে ওর স্কুলে পড়ার সাধটাই বা অপূর্ণ রাখি কেন । মেয়েটা স্কুলে পড়তে চাইত কেন জানেন ? যাতে ও রূপকথার গল্প পড়তে পায় । আপনি নেই, কে ওকে গল্প বলবে ? আপনার কথা খুব বলত । স্কুলে ভর্তি হয়ে যখন পড়তে শিখে গেল তখন অনেক গল্পের বই কিনে দিয়েছি ওকে । হাসপাতাল মাঝে মাঝেই ভর্তি হতে হত । তখন ওর সঙ্গী ছিল শুধু গল্পের বই । ও বেশি দিন বাঁচবে না ভেবে আমি মনখারাপ করলে আমায় বলত - ভেবো না রাজাচাচা । রাজকন্যা তোমার বেঁচে থাকবে । আমি একদিন বললাম - তুই যদি বেঁচে থাকিস তুই যা চাইবি আমি দেবো ।

    - আকাশ থেকে চাঁদ তারা পেড়ে এনে দিতে বললেও দেবে ?

    - দেবো ।

    - তাহলে তুমি বরং লেবুতলা স্কুলটাকে অনেক বড় করে দাও । যাতে অনেক মেয়েরা গল্পের বই পড়তে শেখে ।

    ভগবানের কী অসীম কৃপা জানেন দিদিমনি । খুব ভালো চিকিত্সা ওকে দিতে পারিনি । টিমটিমে প্রদীপের শিখার মতো ও ছোটখাটো রোগা শরীরেই বেঁচে রইল । চৌদ্দ বছর বয়স পেরিয়ে গেল । ডাক্তার বিশ্বাসই করতে পারে না । বলে মিরাকল । তারপর ওর পেটটা ফুলতে আরম্ভ করল । কী বিশাল ফুলে গেল কয়েকমাসের মধ্যেই । ভাবলাম আর বাঁচবে না । হাসপাতালে নিয়ে যেতে ডাক্তার বলল টিউমার । সেটা অপারেশন করার পর মেয়েটা হঠাৎ সেরে গেল । ওর গায়ের রঙ স্বাভাবিক হয়ে গেল । লম্বায় বাড়ল কতটা । এখনও মেয়েটা সাধারণের থেকে অনেকটা দুর্বল । ওর বিশ্বাস ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন আপনি । আপনি যদি সব পেয়েছির দেশের হদিস না দিতেন ও বাঁচত না । আমার মনে হয় ওকে বাঁচিয়েছে ওর বিশ্বাস । সেই বিশ্বাস আপনিই দিয়েছিলেন ওকে । আপনি ওকে স্বপ্ন দেখতে, কল্পনা করতে শিখিয়েছিলেন । মিরাকল এমনি এমনি ঘটেনি । তাই আমি স্কুল বিল্ডিংটা তৈরি করে দিয়েছি । নাম রেখেছি - সব পেয়েছির দেশ । নামটা ভালো লেগেছে আপনার ?

    - হ্যাঁ খুব সুন্দর নাম । কিন্তু আপনি কী একটা শর্ত রেখেছেন শুনলাম ।

    - হ্যাঁ একটা শর্ত আছে । সিলেবাসের বাইরে একটা করে এক্সট্রা ক্লাস করাতে হবে দিদিমনিদের । গল্প বলার আর শোনার ক্লাস । না হলে তো শবনমের ইচ্ছেটাই পূরণ হবে না । জানিনা মেয়েটা আরো কতদিন বাঁচবে ।

    - শবনম কোথায় । আমার যে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ওকে ।

    - ডাকছি দাঁড়ান । খেলাতেই কোথাও নিশ্চয় সাহায্য করছে দিদিমনিদের । আপনি এসেছেন জানেনা ।

    একটু পরেই একটা বছর আঠারো কুড়ির মেয়ে ছুটে আসে । আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে - পরী দিদিমনি তুমি এসেছো ? তোমাকে দেখতে আমার কী ইচ্ছে করত । জানো, আমি এই বছর মাধ্যমিক পাস করেছি ।

    আমি আনন্দে ওকে জড়িয়ে ধরি । আমার বুকের ভিতর নিভে যাওয়া প্রদীপের শিখায় আলো জ্বেলে দেয় শবনম । জলে ভরে যায় আমার চোখ । আমি চোখ বন্ধ করি । তীব্র ভাবে বিশ্বাস করি সমীরণ ঠিক ভালো হয়ে উঠবে একদিন । আমাদের সংসারে আবার ফিরে আসবে হাসি আর রঙ ।

    ( পরবাস ৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments