টের পেত তাদের ঘুপচি ঘরের নানা অলি-গলি খুলে যেতে দেখে । সারা বছর যে সব কোনা ঢাকা থাকত জিনিসপত্রে সে সব কোনায় এসে লাগত জল আলো আর হাওয়া । তার কিছুদিন পরেই বেজে উঠত ঢাক, এসে পড়ত পুজো । মনে হত তার, পুজোর সঙ্গে গলি খোলা আর বন্ধের যোগ খুব গভীর । যেমন হুচুক পাড়ার মূল রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত ষষ্ঠীর দিন থেকে । তার বদলে খুলে যেত অচেনা এক গলি রাস্তা । পুজোর কটা দিন গলিই হয়ে উঠত মূল । বড় বড় ট্রাক আর বাস এ কটা দিন ঢুকতে পারত না ও পথে । পায়ে চলা মানুষদের ভিড় দখল করে নিত ওই গলিপথ । আর বাড়িতেও পথের মতো দেবীই ছিলেন তার আলিবাবা, তাদের ঘর দুয়ারের চিচিং খুলে দিতেন তিনি । বন্ধ ঘরে অন্ধ গলি খুলে যেত এই কয়েক দিন । আলিবাবাদেবীর ডানহাত ছিলেন মা আর মায়ের নিচে বাবা । এ যেন মজাদার এক তিনতলা ব্যবস্থা । সবার ওপর দেবী, তার তলায় মা আর তার নিচেই বাবা । পিরামিডের খেলা দেখার সূত্রে সে জানে পিরামিডের তলার লোকেরা বেসামাল হলেই চিত্তির । তাই বাবা তলায় থাকলে কী হবে বাবাই সবচেয়ে দরকারি লোক । একটু বেসামাল হলেই যে টলে পড়বে মা, আর সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে পড়ে যাবেন ঠাকুর । তাই পুজোর কদিন বাবাকে খুব দরকারি মনে হত তার । বাড়ি ভরা পোকারা অবশ্য মাকেই ক্ষমতাশালী বলে মনে করত । কারণ মায়ের গলা ।
তাদের ঘর ভরা থাকত নানা জিনিসে । সেগুলো যে সব সময় কাজে লাগত তা নয় । তবে ফেলা হত না । ভাঙা বালতি, তোবড়ানো মগ, পুরনো ট্রাঙ্ক, খারাপ হয়ে যাওয়া মা বাবার বিয়েতে পাওয়া হিটার, পুরনো জুতো ... । এই সব রোজ কাজে না লাগা প্রায় বাতিল অথচ না ফেলা জিনিস ঢেকে দিত তাদের ঘর গেরস্তালি । আর সেই সব জিনিসের আনাচে কানাচে এসে বাসা বুনত পোকা মাকড়ের দল । পোকাদের মধ্যে আরশোলা আর মাকড়সাই প্রধান । তারা যত না চোখে দেখে তার থেকে ঢের বেশি কানে শোনে । অন্তত সে তো তাই মনে করত । ফলে বাবা নয়, মা-ই ছিল তাদের ভয়ের কারণ । মায়ের তীব্র গলা ছড়িয়ে পড়ত তাদের বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে । কাজেই পোকাদের মহল্লা সচকিত হয়ে উঠত ।
বেঞ্চি লাগানো যে খাটে শোবার ঘর ভরা সেই খাটের পেছনে ছিল না-খোলা এক জানলা । সেই জানলার সামনের তাকে থাকত ট্রাঙ্ক । বাথরুমের সামনের এক চিলতে বরাদ্দ ছিল বাতিল বালতি মগের জন্য । খারাপ হিটার পেয়েছিল কয়লার ড্রামের পাশের ছোট্ট ফালিটুকু । সারা বছর এই সব কোনা খামচিতে অবিচলিত থেকে যেত তারা ও তাদের আশ্রিত পোকারা । শুধু পুজোর মাসখানেক আগে, আকাশ দেখে নয়, ক্যালেণ্ডার দেখে মা নেমে পড়ত তাদের সারা বছরের নিশ্চিন্ততা ধুয়ে মুছে সাফ করার কাজে ।
দেবী আলিবাবার ডানহাত, তার মা, যে শরতে উঠে-পড়ে লেগেছেন সে সশব্দ খবর প্রথম ছড়িয়ে পড়ত আরশোলাদের মহলে । সাবান ও সোডা মেশানো তরল গরম জল তাদের গুহাঘরের দখল নিত রোদমাখা এক রবিবারের সকালবেলায় । মায়ের ইন্সট্রাক্সন অনুসারে বাবা বালতি আর মগ নিয়ে কাজে নামত । যে সব কোণে মঙ্গলাদির ঘর মোছার নেতা প্রবেশে অনিচ্ছুক সেসব কোণ তখন বাবার দখলে । পুজো আসছে বাড়ি ঝকঝকে করা চাই । না হলে ঠাকুর রেগে যাবেন যে । বাড়িতে আরশোলা চলবে না, মাকড়সা ও ঝুল যেন না থাকে, পুরনো জিনিসপত্র থাকতে পারে তবে সেগুলো সাফ সুতরো হওয়া চাই । সুতরাং সাফাই চলছে চলবে । গরম জল গায়ে লাগামাত্র উড়তে থাকে আরশোলার দল আর লাফাতে থাকে সে । মাকড়সাগুলো ক্ষিপ্র গতিতে পালায় । যে ট্রাঙ্ক তোলা ও বন্ধ থাকে বছরভোর, বাবা খাটে উঠে তাকে নামানোর চেষ্টা করে । ট্রাঙ্কের তলায় যে কাগজ দেওয়া ছিল, তা হলুদ হয়ে গেছে ততদিনে । সেই হলুদ কাগজ থেকে মাথা তুলছে গত বছরের হাসি-খুশি নায়িকা । সিনেমার খবরের পাতা কাগজের অন্যান্য পাতার থেকে মোটা আর চকচকে হয় বলে তারাই ট্রাঙ্কের তলায় থাকার যোগ্য বলে বিবেচিত । এ বছর যে রাজকন্যা ট্রাঙ্কের তলায় চলে গেল তার মুক্তি হয় পরের বছর । তাই ঠাকুর তার কাছে শুধু আলিবাবাই হয়ে ওঠেন না হয়ে ওঠেন রূপকথার ভালো রাজপুত্র । বন্দী রাজকন্যাকে উদ্ধার করাই তো তার কাজ । এ কাজেও বাবাই ভরসা । তার মা বলত, শিবপুজো করে বাবার মতো বুড়ো বর পেয়েছে । শিব পুজোয় অরুচি । রুচি থাক আর না থাক বাবাই কিন্তু ট্রাঙ্ক চাপা হলুদ কাগজ থেকে সিনেমার রাজকন্যাকে বাইরে আনত । মা বলত বাবা নাকি ঘর জ্বালানি পর ভোলানি । হবেও বা ।
এই আগমনী গানের মতো আগমনী সাফাই অভিযানে এক বছর ঘটে যায় অদ্ভুত এক কাণ্ড । সে বছর দেবী দোলায় এসেছিলেন না ঘোড়ায় এসেছিলেন তার মনে নেই । শুধু মনে আছে মিহি কিচকিচ শব্দ । তার জন্য কোনও প্রস্তুতি ছিল না তাদের, শুধু ছিল শব্দের ইশারা । তাদের অগোচরে তাদের গেরস্তালিতে ঢুকে পড়েছিল তারা । ঢুকেছিল আকাশ থেকে । সে তাই ভেবেছিল । কেননা মাকে জিজ্ঞাসা করে সে জানতে পেরেছিল কোনও একদিন আকাশের শিবঠাকুর তাকে কাপড়ে ঢেকে ফেলে দেয় তাদের ভাড়া বাড়ির দরজায় । আর কান্নার শব্দ শুনে মা তাকে তুলে নেয় ঘরে । সুতরাং যে কোনও প্রাণ-ই যে আকাশ থেকে পড়ে ও পড়ামাত্র শব্দ করে এ কথা সে মেনে নেয় । সেবার সাফাই অভিযানের শেষের দিকে শোবার ঘরে এসে তারা একটা অচেনা শব্দ শুনতে পায় । কিচকিচ, তবে পাখির নয় । কিসের শব্দ কোথা থেকে আসছে তা একটু পরেই জানতে পারে তারা । আর জানার সঙ্গে সঙ্গে মা দ্বিগুণ শব্দে প্রবল হয়ে ওঠে । কারণ বাবা । জানলায় রাখা ট্রাঙ্ক ভুল করে ভালো করে লাগায়নি বাবা ফলে সেখানে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে । শিশু নেংটি খানচারেক । লাল । চোখ ফোটেনি । আলো দেখেনি । শুধু শব্দ শিখেছে ।
তাদেরকে মায়ের কথামতো আলোমাখা উঠোনে নিয়ে যাওয়া স্থির হয় । কাজটা সহজ ছিল না । খুব সাবধানে ট্রাঙ্ক থেকে অন্য জিনিস বের করা হয় । খাটের ওপর জমতে থাকে পুরনো চাদর, সোয়েটার, ছোটো হয়ে যাওয়া জামা, রোজ কাজে না লাগা বাবা মায়ের বিয়েতে পাওয়া ধাতব বাসন । চেনা খাট অচেনা হয়ে ওঠে । সেই জমা জিনিসের পাশ দিয়ে খুব সাবধানে ট্রাঙ্কখানা দুহাতে ধরে উঠোনে নিয়ে যায় বাবা । ভেতরের লাল লাল, চোখ না ফোটা প্রাণীর দল বুঝতেও পারে না খোলা আলোয় যাচ্ছে তারা । যে আলোর উঠোন দেখার চোখ ফোটেনি তাদের সেই উঠোনে ট্রাঙ্ক উলটে ঢেলে দেওয়া হয় তাদের । যে আকাশ থেকে নেমে এসেছিল তারা সেই আকাশ থেকে নেমে আসে কাকের দল । মা বাবা আর তার চোখের সামনেই লাল প্রাণীর দল আলো দেখার আগেই শেষ । কাকের নাগাল থেকে রেহাই পায়নি কেউ । শরতের সকাল বেলা সে কিছুই বুঝতে পারে না । শুধু মনে হয় মা তার কান্না শুনে দরজা থেকে তুলে নিয়েছিল অথচ এই নেংটির দলকে ফেলে দেওয়া হল উঠোনে ।
সেবার পুজোয় মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়েও সে বুঝতে পারেনি কেন মা তাদের ঘর ভরা জিনিসের মধ্যে রেখে দিল না ওদের । সেবার পাড়ার পুজোয় খুব বড় করে বানানো হয়েছিল মহিষাসুর । মণ্ডপে বারবার অসুরকে দেখছিল সে । দেবীর পা তার রক্তমাখা বুকের ওপর । তবু মাটির অসুরের মুখে লেগেছিল একফালি হাসি ।
(পরবাস ৪৬, অক্টোবর, ২০১০)