• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৫ | এপ্রিল ২০১০ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থসমালোচনা: রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান, রাধাশ্যাম রায় ও তত্কালীন বঙ্গসমাজ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, Pt Mallikarjun Mansur : RASA YATRA : my journey in music : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    ॥ গুরুমারা বিদ্যে বা একটি ক্লাসিকের জন্ম ॥

    রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান, ড: আশিস বসুমল্লিক. "প্রতিভাস", কলকাতা. প্রথম প্রকাশ অক্টোবর ২০০৪।
    গত সংখ্যায় আমরা এক হিন্দি সঙ্গীতগ্রন্থের আলোচনাপ্রসঙ্গে সঙ্গীতের ওপর 'বাহিরি' প্রভাবের কথা বলেছিলাম। আর এ'বারেই হাতে এসে গেল "রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান"-এর ওপর এই কোষধর্মী গ্রন্থখানি, সাহিত্যমূল্যেও যাকে বেশ উঁচুতে স্থান দিতে হবে।

    রমাঁ রলাঁ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে "ত্রিশ কোটি ভারতীয়ের হাজার বছরের সাধনার নির্যাস" বলেছিলেন। সেই মতো, শ্রীরবীন্দ্রনাথকে শুধু ত্রিশ কোটি ভারতীয়ের কেন, বিশ্বসাহিত্য-শিল্প-সঙ্গীত ধারার এক উল্লেখযোগ্য বাঁক বললে অত্যুক্তি হয় না। কত ধারা যে এসে মিশেছে এখানে - আর ফের নতুন ধারায় প্রবাহিত করে দিয়ে গেছে নদীটিকে। বিশ্বের ইতিহাসে এমন polymath প্রতিভা অ্যারিস্টট্ল(??) বা ভিঞ্চি ছাড়া আর বেশি কেউ নেই ।

    যে-সময় রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব, তখন সবে সবে ভারতে সিপাহি বিদ্রোহ শেষে কোম্পানির আমল থেকে রানীর শাসনকালে উত্তীর্ণ হওয়া গেছে । শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে পুরাতনি প্রভাব রয়েছে ভালোমতোই, আবার আধুনিক য়ুরোপীয় প্রভাবও প্রবলভাবে এসে পড়েছে। মাইকেলের কাব্যে বা রবীন্দ্রনাথের গানে বা রাজা রবিবর্মার চিত্রে এ' মিলন, এ' প্রভাব ভালোমতো অনুভূত হয় ।

    আলোচ্য গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের গানে এই প্রভাবের আলোচনা করা হয়েছে। প্রভাব, মানে উভয় ধারারই - প্রাচীন ভারতীয় ধ্রুপদ-খেয়াল-টপ্পা-ভজনের, আবার য়ুরোপীয় সারিগান বা অপেরা সঙ্গীতেরও । শুধু এ'ই নয়, আছে লোকগীতি ও ধর্মগীতির প্রভাবের আলোচনাও। এবং শুধুমাত্র আলোচনাই নয়, বহু বহু উপযোগী তালিকা ও পুঙ্খানুপুঙ্খ উদাহরণ দিয়ে এক আঁটোসাটো কাজ করেছেন ড: বসুমল্লিক, কোনো খঁংউত ধরার উপায় রাখেননি।

    আলোচ্য বিষয়ের অধ্যায় ভাগ ও প্রস্তুত তালিকার এক নমুনা-সূচির দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে । যেমন,

    প্রথম অধ্যায় : 'ভাঙাগান' কী ও কেন? পরিচয় ও পরিধি।
    দ্বিতীয় অধ্যায় : 'ভাঙাগান' সৃষ্টির প্রথম সূত্রপাত।
    তৃতীয় অধ্যায় : 'ভাঙাগান'-এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা ও সংখ্যা নির্ণয়।
    চতুর্থ অধ্যায় : পূর্বসূরী গায়কদের প্রভাব-------নিধুবাবু, লালন ফকির, মধুসূদন কিন্নর, বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী প্রমুখ।
    পঞ্চম অধ্যায় : পারিবারিক ঐতিহ্য।
    ষষ্ঠ অধ্যায় : ঠাকুরবাড়ির সাঙ্গীতিক পরিমণ্ডল - যদুভট্ট থেকে মৌলাবক্স-রসুলবক্স হয়ে রাধিকা গোস্বামী।
    অষ্টম অধ্যায় : পর্ব-ভিত্তিক কালানুক্রমিক স্তর-বিন্যাস।
    নবম ও দশম অধ্যায় : হিন্দুস্তানি, লোকগান ও কর্ণাটকী সঙ্গীতের প্রভাব।
    একাদশ অধ্যায় : বিলিতি গান।
    চতুর্দশ অধ্যায় : তাল।
    অষ্টাদশ অধ্যায় : এক বিপ্রতীপ দৃষ্টিভঙ্গী।
    ঊনবিংশ অধ্যায় : উপসংহার ও উত্তরাধিকার।


    এত বিস্তৃত তালিকা পেশের লক্ষ্য পাঠককে গ্রন্থখানির পরিধির আঁচ দেওয়া । এবং শুধু বিরাট পরিধি নয় আলোচনার গভীরতায় ও তার গুণগত মানেও পাঠকের প্রত্যাশাকে বারংবার ছাপিয়ে গেছেন ড: বসুমল্লিক । উত্সাহী পাঠকমাত্রেরই অনুসন্ধিত্সা জাগবে, দেখি তো দেখি তো চেনা গান "আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার"-এর ওপর কোন্‌ ধ্রুপদ-গানের প্রভাব রয়েছে, বা "বিশ্ববীণা রবে বিশ্বজন মোহিছে" তাহলে কর্ণাটকী প্রভাবে রচিত, ইত্যাদি ? এই `প্রভাব' সহজে নজরে পড়ে না, গভীর খঁংউড়তে হয় । এই রাগ-তাল-লয় নিয়ে অবাধে খেলা করেছেন বলেই তিনি বিশ্বকবি । তিনি অনুকরণিক নন, আত্মীকরণিক । আর অনন্য মুন্সিয়ানায় ও প্রভূত পরিশ্রমে দুই মলাটের মধ্যে এ' বইখানি পাঠকের হাতে তুলে দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন ড: বসুমল্লিক । এ' এক মহান গ্রন্থ । যে কোনো রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রেমীর অবশ্যপাঠ্য ও রেফারেন্সের জন্য ঘরে রেখে দেবার মতো বই । নৈলে, চট্‌ করে যদি দেখে নেবার প্রয়োজন হয়, "চরণধ্বনি শুনি তব নাথ" বা "মন্দিরে মম কে আসিলে হে" গান কোন্‌ মূল গানের প্রভাবে রচিত ? কী তার রাগ, তাল ও লয় ? কোথায় একাধারে পাবো তা ? পাবো এই গ্রন্থে, হাতের কাছেই । এত বিস্তৃত আলোচনা সত্ত্বেও বইখানি যে মাত্র ২৬০ পৃষ্ঠার মধ্যে বেঁধে রাখা গেছে, অকারণ কলেবর বৃদ্ধি করা হয় নি, সেটা লেখকের সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধের পরিচয় দেয় ।

    লেখক ড: আশিস বসুমল্লিক খুব নামী সঙ্গীতশাস্ত্রী নন এখনও, পেশায় প্রাণরসায়নের অধ্যাপক । কিন্তু বড্ড দামি কাজ করেছেন এ'খানি । পঞ্চান্ন বত্সর পূর্বে লিখিত এ'গোত্রের প্রথম বই-------ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণীকৃত "রবীন্দ্রসঙ্গীতের ত্রিবেণী সঙ্গম" (১৯৫৫) সত্যিই পাঠকের মন পূর্ণত ভরায় না, তা তার অতি ক্ষীণ অবয়বের জন্য । আমরা তাতেই ক্ষান্ত থেকে গিয়েছিলাম । কিন্তু এইখান থেকেই একলব্য ড: বসুমল্লিক বিবিদিদিকে তাঁর গুরু মেনে দশ বছর আগে শুরু করে দিয়েছিলেন তাঁর পথ চলা, যার ফল এই ক্লাসিক গ্রন্থখানি । হঁযা, গুরুকে ছাপিয়ে গেছেন অনেকখানিই । ইন্দিরা দেবী বেঁচে থাকলে দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করতেন তাঁকে । আমরা পাঠকরা সেলাম জানাচ্ছি ।

    দু'একটি কথা বইখানির উপস্থাপনা প্রসঙ্গে : 'প্রতিভাস' নতুন প্রকাশনালয় । এরই মধ্যে নাম মন্দ করেনি । কিন্তু এতো মুদ্রণপ্রমাদ থাকবে কেন ? অধ্যায় ভাগ ও নতুন অধ্যায় শুরুর ক্ষেত্রে প্রচলিত দৃষ্টিনন্দন রীতিও মানা হয়নি-------এক-আধ পাতা না-ছেড়ে রাখার ফলে কোথায় যে একটা অধ্যায় শেষ হয়ে পরেরটা শুরু হয়ে গেল, বোঝা ভার ।

    অসাধারণ তালিকাগুলির উপস্থাপনা যেন অনেকটা দায়সারা । একের সঙ্গে পরেরটা মিশে মিশে গেছে । বিভ্রান্তিকর । পরিষ্কার টেবিল করে দেওয়া উচিত ছিল । প্রচ্ছদ সাদামাটা, ছবিটিতে মৌলিকতার অভাব আছে । পৃষ্ঠ-প্রচ্ছদে লম্বা রচনা লেখা হয়ে গেছে, 'এপিলোগ' লেখাটাও তো একটা আর্ট !

    শেষে একটি মূল্যবান "আকর গ্রন্থ"-তালিকা দেওয়া হয়েছে । একটি বিস্তৃত শব্দতালিকা থাকলে বড্ড ভালো হত । যেমন, পাঠশেষে দেখতে চাইছিলাম 'সারিগান' বা 'কর্ণাটকী'-গানের আলোচনা বইটির কোথায় কোথায় রয়েছে ? পেলাম না । ফের চিহ্নিত অংশগুলি ঘেঁটে ঘেঁটে যেতে হল ।

    তবে, গ্রন্থখানির উচ্চমানের কাছে এ'সকল খামতিগুলি ঢাকা পড়ে যায়, যদিও পরবর্তী সংস্করণে এ'ত্রুটিগুলি বিদূরিত হয়েছে, দেখতে চাই ।

    ফের সাধুবাদ জানাই ।
    ॥ ধান ভানতে শিবের গীত এবং আমি আমি আমি আমি ॥


    রাধাশ্যাম রায় ও তত্কালীন বঙ্গসমাজ , অজিতকুমার চট্টোপাধ্যায়, দে'জ পাবলিশিং , কলকাতা; প্রথম প্রকাশ : অক্টোবর ২০০১ । ISBN: 81-7612-823-6


    বাঙালির কোনো বাণিজ্যিক ইতিহাস নেই ।

    না, অমনি ফস্‌ করে দশম শতাব্দীতে সপ্তগ্রামের বণিকদের সুবর্ণদ্বীপে গুড় ও সূক্ষ্মবস্ত্রের সমুদ্রবাণিজ্যের প্রসঙ্গ তুলে তর্ক জুড়লে চলবে না । আধুনিক বাঙলায় রাজনীতি, সমাজ-সংস্কার বা সাহিত্য-শিল্পক্ষেত্রে যেখানে রামমোহন-সুরেন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাউদ্দীন খানের মত দিক্পাল জন্মেছেন, বাণিজ্যক্ষেত্রে সে-গোত্রের কোনো জামশেদজি বা ঘনশ্যামদাসজির জন্ম বাঙলা দিতে পারেনি । এটা বাস্তব । একমাত্র ব্যতিক্রম প্রিন্স দ্বারকানাথ ।

    এর কারণ খোঁজা বর্তমান নিবন্ধের পরিধিতে আঁটে না । তবু, এটা তো সত্যি যে, দেশে দেশে কালে কালে বাণিজ্যের প্রয়োজন মানুষের চাহিদার মধ্যেই জন্ম নিয়েছে, এবং তার মধ্যে আর্থিক-লেনদেন বাণিজ্য (যথা ব্যাঙ্কিং বা ইন্সুরেন্স) এক প্রাথমিক প্রয়োজন, যা নানা দেশি ধাঁচে প্রায় সর্বত্রই দেখা দিয়েছিল (উদা : উত্তর ও পশ্চিম ভারতের সাহুকার বা সরাফ সম্প্রদায়) । ১৮৯৪-এ লাহৌরে মাত্র বিশ হাজার টাকা দেশীয় মূলধনে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের জন্ম হয়েছিল । তার পরেপরেই ১৮৯৯-তে ভারতের অপরপ্রান্তে কেরলে কায়স্থকুলপুঙ্গব আপ্পু নেড়ুঙ্গাড়ির হাতে জন্মেছিল নেড়ুঙ্গাড়ি ব্যাঙ্ক । এ' প্রয়োজন কি বাঙলায় অনুভূত হয় নি ? এটা কি আদৌ সম্ভব, যেখানে কুমিল্লাকে বলা হত 'ল্যাণ্ড অব্‌ ব্যাঙ্কস এণ্ড ট্যাঙ্কস' ? হঁযা, কুমিল্লারই এক জাতীয়তাবাদী শিক্ষকের হাত ধরে আলোচ্য গ্রন্থের মূলবিন্দু 'পিয়ারলেস' সংস্থার জন্ম হয়েছিল, যা বয়সে আজ আশি ছঁংউতে চলেছে । বাণিজ্য-ভোঁতা বাঙালির ইতিহাসে 'পিয়ারলেস' সংস্থা তাই এক বিশিষ্ট উল্লেখের দাবি রাখে ।

    বছর ত্রিশের এক 'বঙ্গাল' শিক্ষক । জাতি গড়ার পিছনে তার আর্থিক মেরুদণ্ডটি দৃঢ় করার মানসে শিক্ষকতা ছেড়ে আর্থিক লেনদেন ব্যবসায় নেমে পড়লেন । ১৯৩২-এ শুরু হল 'পিয়ারলেস'-এর জয়যাত্রা, যা আজও মাথা উঁচু করে টিঁকে আছে । না, আজকের আরেক নামি বাঙালির আর্থিকসংস্থা "সহারা"-র মত দেখনদারি ও চটক 'পিয়ারলেস'-এর কোনোদিনই ছিল না । প্রতিষ্ঠাতার মত সংস্থাটিও সর্বদাই একটু অগোচরে থেকে যেতে চেয়েছে । পিয়ারলেসের সাফল্যের এ' এক চাবিকাঠি মানতে হবে ।

    আলোচ্য গ্রন্থখানি অবশ্য পিয়ারলেস সংস্থার ইতিহাস নয় । তবে, এ' বইখানি যে আদৌ কোন্‌ হাঁসজারু, পঠনশেষেও পাঠকের মনে সে-ধন্ধ থেকেই যায় । লেখকের পিতা ছিলেন পিয়ারলেস প্রতিষ্ঠাতা রাধাশ্যাম রায়ের বাল্যবন্ধু, এবং লেখক তাঁকে জীবনদেবতা মেনেছিলেন-------সেই অধিকারেই তাঁর এ' কলম-তর্পণ ! নানা নামে প্রায় ছ'-ছ' খানি 'ভূমিকা'-র পাথর ডিঙিয়ে গ্রন্থের মূল অঙ্গে প্রবেশ করেও বারেবারে হোঁচট খেতে হয়, প্রাঞ্জল হয় না কী পড়ছি, কেন পড়ছি এবং প্রতিষ্ঠাতা রাধাশ্যাম রায়ের জীবন ও তত্কালীন বাঙলার অর্থনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী ? অহেতুক স্থূল (পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৬৮) বইখানির বারোআনা জোড়া কেবল লেখকের দীর্ঘ কর্মজীবন লণ্ডনে কাটানোর গপ্প, সুইত্জারল্যাণ্ড ভ্রমণ ও তত্সম্পর্কিত চিত্র-------এ'রকম অবান্তর বিষয়ে । গঁযাটের পয়সা খরচা করে (কম নয়, দু-দুটি কড়কড় শ' টাকার নোট) কেন এ'সব ছাইপাঁশ পড়তে বাধ্য থাকব ? মনে হচ্ছিল, চটকদার শিরোনামের আড়ালে এ'হেন বিভ্রান্তিকর আত্মপ্রচার পাঠক-ঠকানো ছাড়া আর কিছু নয়, এবং আইন করে এ'সব বন্ধ করা উচিত । কথায় বলে, "ধান ভানতে শিবের গীত" । তা, এ'তো শুধু গীত নয়, গীতমালা । এ'গ্রন্থে শিবের গীতই কেবল গাওয়া হয়ে চলল, ধানটা আর ভাঙা হয়ে উঠল না ।

    কয়েকটি তথ্য নিষ্ঠ প্রসঙ্গ :

    ১। পিয়ারলেসের "forfeiture clause" -এর প্রসঙ্গ তুলে বহু বহু বার লেখক ধানাই-পানাই করেছেন, কিন্তু কোথাও স্পষ্ট হল না clause -খানি আদৌ কী, এবং কেন লেখক বোর্ড-মেম্বার হিসেবে তার বিরোধিতা করে গেছেন, এবং কেন তিনি সে- clause রদ করতে সমর্থ হলেন না । এ'সংক্রান্ত একটি পরিশিষ্ট থাকলে ভালো হত । `পরিশিষ্ট'-নামের যেটি আছে তাতে হাবিজাবি কিছু সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক চিঠি ছাপিয়ে পৃষ্ঠা ভরানো হয়েছে ।

    ২। আশির দশকের শেষপাদে বাঙলার তুখোড় অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্তিরমশায় পিয়ারলেসকে 'ব্যান' কেন করেছিলেন ? ভেবেছিলাম এ'গ্রন্থে তার কারণ কিছু পড়তে পাবো । চতুর্দশ অধ্যায়ে সমস্যাটিকে সামান্য ছোঁয়া হয়েছে মাত্র, ধোঁয়াশা কাটেনি ।

    ৩। শিরোনামে শিবনাথ শাস্ত্রীমশায়কে অনুকরণ করলেও এখানে 'রামতনু'-র 'রামতনু' (পড়ুন 'রাধাশ্যাম রায়ের' 'রাধাশ্যাম রায়' ) হয়ে ওঠার কোনো হদিশ নেই । সেই ভূয়োদর্শী মানুষটির বাল্য, শিক্ষা, পারিবারিক পরিমণ্ডল, ব্যবসাক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাহল এ'সবের কোনো বিস্তৃত আলোচনা নেই । সবই খাপছাড়া । এ'সবের মধ্যে দিয়েই না তিনি এক ফ্ল্যাগশিপের কাণ্ডারী হয়ে উঠেছিলেন, এক স্বপ্নের সাকারকর্তা ! সে-সবের খতিয়ান কোথায় এ' কিম্ভূত গ্রন্থে ?

    ৪। আর 'তত্কালীন বঙ্গসমাজ' ? লেখক রোমান ইতিহাস থেকে গৌতম বুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-------কোন্‌ অনাবশ্যক প্রসঙ্গের না অবতারণা করেছেন । কেবল বঙ্গটাই বাদ ।

    এ'গ্রন্থখানি অজিত চাটুজ্যেমশয় আদতে নাকি লিখেছিলেন ইংরিজিতে । শ্যামাপ্রসাদ সরকারকৃত বঙ্গানুবাদের মান দশে সওয়া তিন (মানে এগ্রিগেটে ফেল) । জনপ্রিয় কোষগ্রন্থ সংসদ "বাঙালি চরিতাভিধান"-এ রাধাশ্যাম রায় বা তত্পুত্র ও পিয়ারলেসের 'আসল' প্রতিষ্ঠাতা বি কে রায় (ভূদেব) -এর নামে কোনো ভুক্তি নেই (বাঙালির বাণিজ্য-উদাসীনতার এ' আরেক উদাহরণ) । ভেবেছিলাম বইতে -কুমিল্লার সেই প্রথম বাণিজ্য-পরিবারটির বিশদ বিবরণ পাবো, কিছু ছবি সহ । কিস্যু নেই । প্রচ্ছদে উডকাট টাইপের অনুকরণ করে `পুরনো'-কালের গন্ধ আনার চেষ্টা হয়েছে । এ' আরেক বিভ্রান্তি । মুদ্রণ-প্রমাদ দু-একটির বেশি চোখে পড়েনি । দ্বিতীয় ও তৃতীয় মলাটের এ'হেন নিরেস মানের গ্রন্থ ও লেখক পরিচিতি কমই পড়তে পাওয়া যায় ।

    অন্তিম নিবেদন : লেখক অজিত চট্টোপাধ্যায় মহাশয় নামী চার্টার্ড একাউন্টান্ট, আজও পিয়ারলেসের বোর্ড-মেম্বার । কলমখানি বালান্স-সিট যাঁচার জন্য আটাকে রাখলেই পারতেন । ইতিহাস বা আত্মজীবনী লেখা যাহার-তাহার কাম না ।

    ॥ স্বচ্ছ বাঙলায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান ॥


    প্রাকৃতিক বিপর্যয় ; ভবানীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়; জ্ঞান বিচিত্রা প্রকাশনী; আগরতলা , ত্রিপুরা . প্রথম প্রকাশ : জানু ২০০৩ ISBN: 81-86792-42-2


    "প্রকৃতির ভয়াল রূপের মধ্যে কখনো-কখনো তার শান্ত-প্রসন্ন রূপটি হারিয়ে যায় । প্রকৃতির অস্তিত্ব সম্পর্কে উদাসীন ও নি:স্পৃহ মানুষের পক্ষে তখন সেই উদাসীনতা ও নি:স্পৃহতা কাটিয়ে ওঠা ছাড়া উপায় থাকে না । তাকে তখন বোঝার চেষ্টা করতে হয় প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর বৈজ্ঞানিক কারণ, খোঁজার চেষ্টা করতে হয় বিপর্যয় থেকে বাঁচার ও বিপর্যয়-জনিত ক্ষয়-ক্ষতি কমানোর উপায়, আর এ'জন্য তাকে কাজে লাগাতে হয় তার আয়ত্তে আসা সর্বাধুনিক প্রকৌশলগুলোকে ।" -------পৃষ্ঠ-প্রচ্ছদে লিখেছেন লেখক ভবানীপ্রসাদ ।

    স্বভাবত:ই, আশার পারদ চড়ে । কারণ, বাঙলাভাষায় ঠিক এমন বিষয়ের ওপর আগে কোনো একটি বই চোখে পড়েনি, যদিও একক একক ভাবে 'বন্যা' বা 'ভূকম্প' নিয়ে গোটা বই বা বিজ্ঞান-পত্রিকার নিবেদিত-সংখ্যা (dedicated issue) বেরিয়েছে ।

    ধন্যবাদ, নিরাশ করেননি লেখক । বরং দুশো পাতার বইখানিতে আশার অতিরিক্তই দিয়েছেন ।

    সহজবোধ্য ভাষায় যে-কোনো কঠিন বিষয়ের উপস্থাপনা এক অতি উচ্চাঙ্গের আর্ট । আম লেখকের কাম এ' না । এতে রীতিমত মুন্সিয়ানার প্রয়োজন পড়ে । বিশেষত:, বিষয় যদি 'প্রাকৃতিক দুর্যোগ'-এর মত 'বিস্তৃত' (all-encompassing) বিষয় হয়, যাতে ভূ-বিজ্ঞান থেকে পদার্থবিদ্যা থেকে জলবায়ু বিদ্যা-------কার না ছোঁয়া এসে পড়ে । এবং, বিষয়-নির্বাচনেও বর্তমান লেখক যখন বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, খরা থেকে ধস, অগ্নুচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প কিছুই বাদ দেননি । লিখিত বিষয়গুলির ওপর কেবল চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া মাত্র নয়, মোটামুটি গভীর জ্ঞান পেতেও শ'-দুই পৃষ্ঠার এই বইখানি বেশ । একে তাই কেবল বাংলায় লেখা 'কিশোর পাঠ্য' বইয়ের তালিকায় ফেলে দেওয়া যায় না । এ' হল মাতৃভাষায় লেখা এক অতি উপযোগী জ্ঞানভাণ্ডার ।

    উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক্‌ 'অগ্নুচ্ছ্বাস'-এর অধ্যায়খানি । এতে যেমন Gutenberg discontinuity-Lehmann discontinuity -র আলোচনা এসেছে, তেমনই মহাদেশীয় সরণ-প্রসঙ্গে আলফ্রেড ওয়েগেনারের প্যানাজিয় তত্ত্বও সংক্ষেপে আলোচিত হয়েছে । এবং সঙ্গে আছে ছোট ছোট উপযোগী স্কেচের ভাণ্ডার । যেখানেই ব্যাখ্যানের প্রয়োজন হয়েছে, ছবি, তালিকা ও সারণী দিয়ে প্রাঞ্জল করা হয়েছে-------এইটে বড় ভালো লাগল । হঁযা, বিজ্ঞান-সাহিত্যের সেটাই দস্তুর বটে, তবে অনেক সময় তা অধিক কচকচিতে ভরে যায় । আনন্দের কথা, বর্তমান গ্রন্থে সেটা হয়নি । এবং বহুক্ষেত্রেই শুধুমাত্র `কী' `কেন'-র আলোচনামাত্র নয়, আধুনিক 'বিপর্যয় মোকাবিলা' (Disaster Management) -রও জরুরি আলোচনা রয়েছে, যেমন, `সাইক্লোনের আগে পরে কী করতে হবে' বা ভূকম্পের ক্ষেত্রে `জরুরি অবস্থায় কিছু নিয়ম মেনে চলা দরকার' ইত্যাদি ।

    `বন্যা'-র অধ্যায়টি পড়ে সবচেয়ে ভালো লেগেছে । কারণ, এতে অতি সহজ করে নদী-উপনদীর জীবন থেকে তার চলার ধরন থেকে তার পলি জমার সমস্যা হয়ে বাঁধের ভূমিকা আলোচনা করা হয়েছে মাত্র বিশ পাতার মধ্যে । সঙ্গের স্কেচ ও তালিকাগুলিও অত্যন্ত উপযোগী ।

    বাংলায় নামী বিজ্ঞান-সাহিত্যিকের কমি নেই । রামেন্দ্রসুন্দর থেকে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য হয়ে হাল-অতীতের সমরজিৎ কর বা আজকের পথিক গুহ-------অনেকেই মনকাড়া লিখেছেন বা লিখছেন । বর্তমান লেখকও তাঁদের মধ্যে স্থান করে নিতে পারেন । এনার লেখা আমরা অনেকদিন থেকেই `কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞান', `উত্স মানুষ' বা `গণশক্তি'-র মত নামী পত্রিকার পাতায় পড়ে এসেছি । বর্তমান বইখানি পড়ে সে-ভালোলাগা বাড়ল ।

    অধ্যায়ের নামগুলি নামী কবিতার লাইন তুলে তুলে নেওয়ার মধ্যে নতুনত্ব আছে, যেমন, "পথ সম্মুখে যাহা পাই যাই চুর্ণি" (`সাইক্লোন'-অধ্যায়) বা "থর থর করি কাঁপিছে ভূধর" (`ভূমিকম্প' অধ্যায় প্রসঙ্গে) । কিন্তু অধ্যায়-শিরোনামের পরেপরেই যে এক-একটি করে ইংরেজি উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, তার সংগতি খঁংউজে পেতে বেগ পেতে হয়েছে । যেমন, `অগ্নুচ্ছ্বাস'-অধ্যায়ে Altgeld -এর উদ্ধৃতি "All great reforms......come from the bottom and not the top..." | John Peter Altgeld -কে তো বামপন্থী আমেরিকান রাজনীতিক ও সমাজ-সংস্কারকরূপে জানি, `অগ্নুচ্ছ্বাস'-এর সঙ্গে এ' উদ্ধৃতির সম্পর্ক কী থাকতে পারে ? !---বা, রবীন্দ্রনাথ কোথায় "শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা"-প্রসঙ্গে বলেছেন, "I am compelled to utter a truism in asserting that physical catastrophes have their inevitable and exclusive origin in certain combinations of physical facts" ? --------খঁংউজে পেলাম না ।---

    শেষে, `পরিশিষ্ট'-এর শব্দপঞ্জিটি কাজের. উত্সর্গ-পত্রটি মন-কাঁদায়, লিখেছেন, "প্রতিটা বিপর্যয়ে / ঝরে যায় অনেক না-ফোটা তরতাজা কঁংউড়ি / থেমে যায় উত্ফুল্লতা, চিরদিনের মতো / ওরা কিন্তু জানতেও পারে না, হারিয়ে যায় / রেখে যায় আমাদের // সেই কঁংউড়িদের স্মরণে ॥" (কিন্তু, 'উত্ফুল্লতা' শব্দটি ব্যাকরণগতভাবে ভুল নয় ?)

    ত্রিপুরার "জ্ঞান-বিচিত্রা"-প্রকাশনার বই এটি । এনাদের আরও নানান বিষয়ের বই আগে পড়েছি ও মনে মনে সাধুবাদ দিয়েছি । কম বাজেটে, রঙিন ছবিছাবা ছাড়াও স্বল্পদামে কী করে একটি ভালো বই পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়া যায়-------অনেক নামী হাউজের শেখার আছে এঁংএদর কাছ থেকে । মুদ্রণ-প্রমাদ একটিও চোখে পড়ল না । কেবল, প্রচ্ছদখানি বড্ড সাদামাটা হয়ে গেল যে । আরেকটু শিল্প-সুষমা মণ্ডিত হলে ভালো লাগত ।


    ॥ রসযাত্রা ॥


    Pt Mallikarjun Mansur : RASA YATRA : my journey in music, Translated from the Kannada by Pt Rajshekhar Mansur . Lotus Collection , Roli Books , New Delhi . First published in English 2005 ISBN: 81-7436-406-4 আতাই

    কোঙ্কনের নামী বন্দর গোয়ার মাইল বিশেক পুবে স্বল্পখ্যাত ধারওয়ার শহর । তার পাঁচ মাইল পশ্চিমে গণ্ডগ্রাম 'মনসুর' । এমনিতে ভারতের এ'হেন লক্ষ গ্রামের মধ্যে `মনসুর'-এর কোনো গুরুত্ব থাকত না যদি না বিগত শতাব্দীর প্রথম দশকে এক দেবশিশুর জন্ম হত এর মাটিতে । ভারতের অগণিত সঙ্গীতপ্রেমীর হৃদয়াসনের অনামী কৃষক ভীমরায়াম্মা গৌড়ার এই সুপুত্রটি স্থায়ী আসন পেতে রেখেছেন মল্লিকার্জুন মনসুর নামে । ভারতীয় উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের জগতে বংশগৌরব এক ভারি চিজ মানা হয়, আর এটা যার নেই, 'আতাই'-নামে তাকে হেয় করার চল আছে । সে-অর্থে মল্লিকার্জুন `আতাই' ছিলেন (যেমন ছিলেন আরেক দিকপাল আচার্য আলাউদ্দিন খাঁন সাহেবও !) । মিঞা তানসেনের গুরু হরিদাস স্বামীর বংশধর নাথ বিশ্বম্ভর ছিলেন ওস্তাদ আল্লাদিয়া খাঁনের বংশের আদিপুরুষ । তাই, মল্লিকার্জুনের `সঙ্গীত-নাটক-একাডেমি' (১৯৭২) বা 'পদ্মবিভূষণ' (১৯৯২) পুরষ্কারপ্রাপ্তি নয়, শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার তিনি বোধহয় পেয়েছিলেন তাঁর গুরুর গুরু আল্লদিয়া খাঁন সাহেবের কাছ থেকে, যখন তিনি মল্লিকার্জুনকে আখতারী বাঈয়ের শিক্ষক হিসেবে লক্ষ্মৌ যেতে দেননি । বলেছিলেন, "বেটা মনজির এন্তেকালের পরে এই মল্লিকার্জুনই আমাদের জয়পুর ঘরানার 'অর্জুন' ! এঁকে আমি যেতে দিতে পারিনে ।" মুহূর্তে সেই অখ্যাত গ্রাম্যবালক 'আতাই' থেকে তিনশ' বছরের পুরানা ঘরানার প্রতিভূ-পুরুষে উন্নীত হলেন !

    যদিও সেই আপাদমস্তক সরল সঙ্গীতসাধকের তাতে বিশেষ হেলদোল ছিল বলে মনে হয় না ।


    অ-নক্ষত্রতন্ত্র

    নৈলে কি মল্লিকার্জুনের মত প্রতিভার সর্বভারতীয় স্বীকৃতি পেতে ষাট বছর অপেক্ষা করতে হয়, যেখানে তাঁর রয়েছে সুদীর্ঘ তালিমের ইতিহাস ? প্রথমে দশবছর বয়স থেকে গোয়ালিয়র ঘরানার গুরু নীলকন্ঠ বুয়ার কাছে ছয় বছরের শিক্ষা (সোজা নয়, দিনে দশ-দশ ঘন্টা করে, ভোর চারটে থেকে শুরু), তারপর জয়পুর ঘরানার দুই আল্লাদিয়া-পুত্র মন্জি ও ভুর্জি খাঁন সাহেবের কাছে তিন-তিন ছয় বছর (প্রতিদিন ছয়-সাত ঘন্টার তালিম ও রেওয়াজ) । আসলে, শিখতে পাওয়ার সুযোগকে চিরদিনই তিনি মহ্ফিলে বসার চেয়ে উচ্চে স্থান দিয়ে এসেছিলেন । বলতেন, "মহ্ফিল তো যে কোনো সময় করা যায় । শিখতে পাওয়ার সুযোগই বারবার আসে না । নাম ও অর্থের পিছনে ছুটো না । সাচ্চা শিক্ষা থাকলে নাম-যশ এমনিতেই আসবে ।"

    এ-ই ছিলেন পণ্ডিত মল্লিকার্জুন মনসুর-------আধুনিক ভারতের মার্গসঙ্গীত জগতের এক পুরোধা-পুরুষ । এক সত্‌, সরল সঙ্গীতসাধক, এক দেবতূল্য মানুষ-------যা তাঁর সান্নিধ্যে যাঁরাই এসেছেন, অনুভব করেছেন । আজকের `স্টারডম'-এর যুগে যেমনটি খঁংউজে পাওয়া ভার । আজ আর তাই কোনো মল্লিকার্জুন মনসুর নেই-ও আমাদের মধ্যে ।



    মল্লিকার্জুন, দ জিনিয়স :

    কিন্তু বেঁচে আছে তাঁর গায়ন । যেমন, রাগ শুদ্ধ নট । কোলহাপুরের বালাজী মন্দিরের দুয়ারে বসে এ'রাগ গাইতেন ওস্তাদ আল্লাদিয়া খাঁন সাহেব । এক্কেবারেই তাঁর নিজ ঘরানার চিজ । ভুর্জি খাঁন সাহেব তিন-তিন ঘন্টার তালিমে এ'রাগ তোলাতেন মল্লিকার্জুনের গলায় । আজও পুরনো ক্যাসেট শুনে দেখুন-------কী অনায়াসে, কী সুরে এ'রাগ গাইতেন মনসুর সাহেব !

    হঁযা, এই মানুষটিকে জানতে তাঁর এই আত্মজীবনী পড়তেই হবে । মূল কন্নড় থেকে ইঙ্গ-অনুবাদ করেছেন তাঁর গায়ক-অধ্যাপক সুপুত্র রাজশেখর মনসুর, যাঁকে বহু কনসার্টে বাপের পেছনে গলা দিতে ও তানপুরো ধরতে দেখা যেত । অতি সারল্যে পিতার আত্মজীবনীর সু-অনুবাদ করে গেছেন রাজশেখর, এবং নিজের বি-গোত্রে বিবাহের জন্যে বাপের বিরাগভাজন হবার অধ্যায়টিও বাদ দেননি । অবধারিতভাবে এসেছে মল্লিকার্জুনের ঈশ্বরপ্রেম ও নানান অলৌকিক অনুভবের প্রসঙ্গও-------মুরগহ মঠে স্বামী মৃত্যুঞ্জয় স্বামীর সঙ্গলাভ, শ্রীশৈল তীর্থে মাতৃবিয়োগ ইত্যাদি । তাঁর উচ্চতার সঙ্গীত সাধককে চিনতে আত্মজীবনীর এ'সকল অধ্যায়গুলি বড় সহায়ক হয় ।

    দু' একখানি ঘটনার উল্লেখ বড়ই সুখপাঠ্য, যেমন :

    ক) ১৯৮১-র ১৮ই সেপ্টেম্বরের সন্ধ্যায় কানাড়া ব্যাঙ্ক তাদের ১০০১তম শাখার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পথিমধ্যে এক প্যাণ্ডাল করে মনসুর সাহেবকে গাইতে বসিয়ে দিয়েছে । শ্রোতা বলতে কিছু গাঁইয়া-হাটুরে মানুষ তাঁদের গাই-বলদ নিয়ে এসে বসে আছেন জেনারেল ম্যানেজারের আগমন-প্রতীক্ষায় । রাজশেখর গাঁইগঁংউই করলেন, "এদের সামনে কী করে গাওয়া সম্ভব ?" মল্লিকার্জুন বললেন, "আমরা গাইতে এসেছি, বেটা । তানপুরো বাঁধো । স্বরজ লাগাও," আর ধরলেন ইমনে খেয়াল, "বীত গয়ে রয়না"--- পাক্কা চল্লিশ মিনিট । গান শেষে গ্রাম্য চাষা থেকে জেনারেল ম্যানেজারের চোখে জল !

    এই হল শুদ্ধ সঙ্গীতের আবেদন ।

    আবার এই মনসুর সাহেবই পুনার এক নামি কোম্পানির ডিনার পার্টিতে গাইতে অস্বীকার করেছিলেন, বলেছিলেন, "আমরা ক্লাব-সিঙ্গার নই । সকলে যখন খাওয়া-দাওয়া করছেন, আমরা তখন গাইবো না । এতে সঙ্গীতের অপমান ।" অগ্রিম ফেরৎ দিয়ে চলে আসেন আর কি ! শেষে কোম্পানির মালিক এসে হাতজোড় করাতে ডিনার শেষে মহানন্দে আড়াই ঘন্টা শুনিয়েছিলেন জেতশ্রী ও জেতকল্যাণ !

    খ) একাশি বছর বয়সে পণ্ডিতজী কিডনিরোগের সুরাহার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হলেন । ডায়ালিসিস চলছে, নানা সঁংঊচ-টিউব শরীরে প্রোথিত রয়েছে । পুত্র রাজশেখরকে ডেকে বললেন, "গা তো বেটা সেই বন্দিশ খানি : দুখ দূর করিয়ো ।" অবাক রাজশেখর ! ড: তলওয়ালকর ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন । শুরু হল রাগ ভৈরব । নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল ডায়ালিসিস ।

    এ'ঘটনার তুলনীয় ওস্তাদ আব্দুল করিমের প্রয়াণরাত্রে সেই অখ্যাত মাদ্রাজী রেলস্টেশনে বসে তাঁর দরবারী কানাড়ার গায়ন !

    এ'হেন বেশ কিছু ঘটনার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন রাজশেখর সু-প্রক্ষিপ্ত অংশে । মানে, ১৯৮১-এ' মল্লিকার্জুন সাহেব তাঁর এই আত্মজীবনী লিখন শেষ করা ও ১৯৯২-এ' তাঁর প্রয়াণের মধ্যেকার কিছু অনুভূতি পুত্র রাজশেখর তাঁর নিজের কলমে সংযোজিত করেছেন । এ' অংশের শ্রেষ্ঠ হল তাঁর তেরো খানি `স্মরণীয়' মহফিলের উল্লেখ ও মনোজ্ঞ বর্ণনা ।

    এই ছিলেন অতুলনীয় পণ্ডিত মল্লিকার্জুন মনসুর সাহেব ! এ' নিবন্ধ এই মহান সঙ্গীতকারের জীবনস্মৃতি তর্পণ নয়, তাঁর আত্মজীবনী "রসযাত্রা"-র গ্রন্থপরিচয় মাত্র । কিন্তু মল্লিকার্জুন মনসুর নামটি কানে এলেই এত আবেগ, এত শ্রদ্ধা, এত ভালোবাসা এসে পড়ে, যে বারবার তাঁর জীবন ও কর্মের স্মৃতিচারণে ফিরে যেতে হয় ।

    তবে, আলোচ্য গ্রন্থখানি এক চমত্কার গ্রন্থ বটে-------দেড়শ' পৃষ্ঠার মধ্যে দিল্লির রলি বুকস-এর এক আঁটোসাটো নিবেদন । প্রচ্ছদখানি চমত্কার, চমত্কার হয়েছে । অন্দরের প্রাসঙ্গিক আলোকচিত্রগুলিও মনোগ্রাহী । মুদ্রণ-প্রমাদ চোখে পড়ল না কোনো । কেবল একফর্মার কিছুটা পুরো উল্টো ছাপাই হয়ে গেছে (পৃ ১০১ থেকে ১১৬) ।



    (পরবাস-৪৫, এপ্রিল, ২০১০)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments