"গানের সুরে পুরাণ শ্রুতিঅর্থাত্; পটুয়ারা লোকশিক্ষকের কাজ করতেন ।
     ইতিহাসের বাণী;
দেশের নরনারীর ঘরে
     এরাই দিত আনি ।"
![]() |
হয়েছে পরপর জুড়ে পিছনে একটি মোটা কাগজ লাগিয়ে |
সেইসব অঞ্চলে সময় যেন থমকে আছে `হর্ষচরিত' ও `মুদ্রারাক্ষসে'র যুগে । যে সময় যমপট্টিক সুদীর্ঘ লাটাই এর মত করে জড়ানো পটের উপর যমরাজ ও যমালয়ের নানা ভয়ঙ্কর দৃশ্য লিখে গান গেয়ে গৃহস্থ বাড়িতে বা একসাথে অনেক লোক জমায়েত হলে পথেই পট দেখাতেন । গুরুসদয় দত্ত তাঁর `পটুয়া সঙ্গীতে' লিখেছেন - "লেখ্য চিত্র এবং ছবি অঙ্কন করাকে `চিত্রলেখন' বলা হইত । বর্তমানে পটুয়াগণ `চিত্রলেখা' কথাটির উপরি-উক্ত ব্যুত্পত্তি-সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও `পট আঁকা' না বলিয়া `পট লেখা' বলিয়া থাকে । এই `লেখা' কথাটি হইতেই তাহাদের সঙ্গে প্রাচীন চিত্র লেখকদের সংযোগ সহজেই অনুমান করা যায় ।" জড়ানো বা লাটাই, চৌকো এবং অতি আধুনিক কালে বৃত্তাকার - প্রধানত আকৃতির দিক থেকে এই তিন ভাগে পটচিত্রকে ভাগ করা যায় । চৌকো পটের মধ্যে বিখ্যাত হল কালীঘাট পট এবং চক্ষুদান পট ।
পূর্ব ভারতের সাঁওতাল পরগণা, দক্ষিণ বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ড), পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় মূলত সাঁওতাল ও ভূমিজ গোষ্ঠীর লোকবিশ্বাস থেকে চক্ষুদান পট ও যাদুপটুয়া শ্রেণির উত্পত্তি । কোন সাঁওতাল গ্রামে মানুষ মারা গেলে সেই মৃতের বাড়িতে যাদব পাটকার বা যাদু পটুয়া এসে উপস্থিত হন এবং বলেন তিনি মারাংবুরুর সাহায্যে জানতে পেরেছেন সেই বাড়িতে কেউ মারা গেছেন । আর ঐ মৃত ব্যাক্তির আত্মা ইহজগতে পাপের জন্য পরলোকে চক্ষুহীন অবস্থায় কষ্ট পাচ্ছেন । প্রসঙ্গত কমলকুমার মজুমদারের `পটকথা' প্রবন্ধের অংশবিশেষ মনে আসে :- "এ বাড়ির বুড়া কয়েকদিন হল গত হয়েছে । তাই বেনাগাছ পোঁতা, সেখানে কিছু পাখির চঞ্চলতা । চিত্রকর হাঁকে ...... বুড়া কষ্ট পাচ্ছে, তার জামবাটি আমাকে দাও, সঙ্গে যাবে বুড়া - পান-তামাক পাবে ।" কোথাও থালা, কোথাও বাটি, কোথাও চাল-ডাল, একটু সম্পন্ন ঘর হলে মুরগী বা ছাগলও দাবী করেন যাদু পটুয়ারা । তার বদলে ওঁরা মৃতব্যক্তির `চক্ষুদান' করেন । সঙ্গে নিয়ে আসা ছবির সাদা অক্ষিগোলকে তুলির সাহায্যে কালো বিন্দুর একটি ফোঁটা - ব্যস, স্বর্গে মৃতব্যক্তির কষ্টের অবসান ! তবে ১৯৫৭ সালে লেখা কমলকুমার মজুমদারের প্রবন্ধের সময়কাল থেকে ২০০৩-এ আমার ক্ষেত্রসমীক্ষা কালে সেই বিশ্বাসের ভার যে অনেকটাই লঘু হয়ে গেছে তা নিজেই দেখেছি ।
![]() |
শিল্পী : বীরেন্দ্র চিত্রকর |
![]() |
|
![]() |
বীরেন্দ্র চিত্রকর দুমকার কুসুমঘাটায় নিজগৃহে । |
![]() |
শিল্পী : আনন্দ চিত্রকর |
তথ্যসূত্র :
১) পূর্বভারতের পটচিত্র - সুমনা দত্ত চট্টোপাধ্যায় (যন্ত্রস্থ)
২) পশ্চিমবঙ্গের পটচিত্র - অশোক ভট্টাচার্য সম্পাদিত
৩) পটুয়া সঙ্গীত - গুরুসদয় দত্ত
৪) বিভাব, ১৪১০ - কমলকুমার মজুমদার সংখ্যা
(পরবাস-৪৫, এপ্রিল, ২০১০ )