• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৫ | এপ্রিল ২০১০ | প্রবন্ধ
    Share
  • দুমকার চক্ষুদান পট : সুমনা দত্ত চট্টোপাধ্যায়

    ২০১০-এর কলকাতায় আলোকিত বহুতল, শপিং কমপ্লেক্স্‌, আইনক্স্‌, এস্কেলেটর, ইন্টারনেট ইত্যাদির অনায়াস যুগে বসে ভাবতেও অবাক লাগে মাত্র ষাট কি সত্তর বছর আগে আমাদের দেশে সারাদিন পরিশ্রমের পর মানুষের সান্ধ্য বিনোদন বলতে ছিল কথক ঠাকুরের রামায়ণ-মহাভারত বা ভাগবত পাঠ ! তারপর রেডিও এল, এল কলের গান - কিন্তু তা শোনা যেত তথাকথিত উচ্চবিত্ত বাড়িতেই । আমজনতার জন্য যাত্রা, কথকতা, কীর্তন ..... আর হ্যাঁ, পট । পটচিত্র । পটের গান । খোদ কলকাতায় না হলেও কলকাতার পার্শ্ববর্তী জেলা - যেমন, হাওড়া-হুগলী-চব্বিশ পরগণা ইত্যাদিতেও দিনের বেলা গৃহস্থ বাড়িতে চাল-ডাল-আলু-পটলের বিনিময়ে পটচিত্র দেখিয়ে, পটের গান শুনিয়ে যেতেন পটুয়ারা । গুরুসদয় দত্তের `পটুয়া' কবিতায় যেমন পাই -

    "গানের সুরে পুরাণ শ্রুতি
         ইতিহাসের বাণী;
    দেশের নরনারীর ঘরে
         এরাই দিত আনি ।"
    অর্থাত্‌; পটুয়ারা লোকশিক্ষকের কাজ করতেন ।

    পটগুলিকে সংরক্ষণ করা
    হয়েছে পরপর জুড়ে
    পিছনে একটি মোটা
    কাগজ লাগিয়ে
    যে সব জেলার উল্লেখ করলাম সেখানকার পটুয়ারা কেউই বর্তমানে পটের কাজ শিখতে বা পট দেখিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে গান শোনাতে আগ্রহী নন । তাঁরা বেছে নিয়েছেন অন্য জীবিকা । পূর্বের পটুয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে ক্ষেত্রসমীক্ষা করতে গিয়ে `অমুক পোটোর বাড়ি যাব' বললে লোকে এখন অবাক চোখে তাকান । কিন্তু এমন গ্রাম এখনও আছে যেখানের মানুষ সোত্সাহে পথ দেখিয়ে নিয়ে যান `যাদু পটুয়ার বাড়ি' এবং পটের গান শোনবার আশায় নিজেরাও কাজ ফেলে সেখানে থেকে যান ।

    সেইসব অঞ্চলে সময় যেন থমকে আছে `হর্ষচরিত' ও `মুদ্রারাক্ষসে'র যুগে । যে সময় যমপট্টিক সুদীর্ঘ লাটাই এর মত করে জড়ানো পটের উপর যমরাজ ও যমালয়ের নানা ভয়ঙ্কর দৃশ্য লিখে গান গেয়ে গৃহস্থ বাড়িতে বা একসাথে অনেক লোক জমায়েত হলে পথেই পট দেখাতেন । গুরুসদয় দত্ত তাঁর `পটুয়া সঙ্গীতে' লিখেছেন - "লেখ্য চিত্র এবং ছবি অঙ্কন করাকে `চিত্রলেখন' বলা হইত । বর্তমানে পটুয়াগণ `চিত্রলেখা' কথাটির উপরি-উক্ত ব্যুত্পত্তি-সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও `পট আঁকা' না বলিয়া `পট লেখা' বলিয়া থাকে । এই `লেখা' কথাটি হইতেই তাহাদের সঙ্গে প্রাচীন চিত্র লেখকদের সংযোগ সহজেই অনুমান করা যায় ।" জড়ানো বা লাটাই, চৌকো এবং অতি আধুনিক কালে বৃত্তাকার - প্রধানত আকৃতির দিক থেকে এই তিন ভাগে পটচিত্রকে ভাগ করা যায় । চৌকো পটের মধ্যে বিখ্যাত হল কালীঘাট পট এবং চক্ষুদান পট ।

    পূর্ব ভারতের সাঁওতাল পরগণা, দক্ষিণ বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ড), পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় মূলত সাঁওতাল ও ভূমিজ গোষ্ঠীর লোকবিশ্বাস থেকে চক্ষুদান পট ও যাদুপটুয়া শ্রেণির উত্পত্তি । কোন সাঁওতাল গ্রামে মানুষ মারা গেলে সেই মৃতের বাড়িতে যাদব পাটকার বা যাদু পটুয়া এসে উপস্থিত হন এবং বলেন তিনি মারাংবুরুর সাহায্যে জানতে পেরেছেন সেই বাড়িতে কেউ মারা গেছেন । আর ঐ মৃত ব্যাক্তির আত্মা ইহজগতে পাপের জন্য পরলোকে চক্ষুহীন অবস্থায় কষ্ট পাচ্ছেন । প্রসঙ্গত কমলকুমার মজুমদারের `পটকথা' প্রবন্ধের অংশবিশেষ মনে আসে :- "এ বাড়ির বুড়া কয়েকদিন হল গত হয়েছে । তাই বেনাগাছ পোঁতা, সেখানে কিছু পাখির চঞ্চলতা । চিত্রকর হাঁকে ...... বুড়া কষ্ট পাচ্ছে, তার জামবাটি আমাকে দাও, সঙ্গে যাবে বুড়া - পান-তামাক পাবে ।" কোথাও থালা, কোথাও বাটি, কোথাও চাল-ডাল, একটু সম্পন্ন ঘর হলে মুরগী বা ছাগলও দাবী করেন যাদু পটুয়ারা । তার বদলে ওঁরা মৃতব্যক্তির `চক্ষুদান' করেন । সঙ্গে নিয়ে আসা ছবির সাদা অক্ষিগোলকে তুলির সাহায্যে কালো বিন্দুর একটি ফোঁটা - ব্যস, স্বর্গে মৃতব্যক্তির কষ্টের অবসান ! তবে ১৯৫৭ সালে লেখা কমলকুমার মজুমদারের প্রবন্ধের সময়কাল থেকে ২০০৩-এ আমার ক্ষেত্রসমীক্ষা কালে সেই বিশ্বাসের ভার যে অনেকটাই লঘু হয়ে গেছে তা নিজেই দেখেছি ।

    দুমকার আদিবাসী পটে কালী
    শিল্পী : বীরেন্দ্র চিত্রকর
    ২০০৩ সালের ২৪শে অক্টোবর মেদিনীপুরের রঞ্জিত চিত্রকরকে পথ প্রদর্শক করে দুমকা জেলার একটি গ্রাম কুসুমঘাটার দিকে `যাদু পটুয়া'র খোঁজে আমাদের যাত্রা শুরু হল । দুমকা থেকে বাসে চেপে ডেলাহির মাটিতে যখন নামলাম ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে নয় । এরপর সাত কিলোমিটার হাঁটা পথ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চলেছি । মঞ্জিল নদী পেরোতেই দূরে ধূসর নীল স্বপ্নের মত দুমকার পাহাড়গুলো দেখা যেতে লাগলো । আমরা পেরিয়ে গেলাম মছলিয়াপুর এবং একফসলী জমির বিস্তীর্ণ ক্ষেত । পৌঁছালাম কুসুমঘাটা গ্রামের সবচেয়ে প্রাচীন যাদুপটুয়া বীরেন্দ্র চিত্রকরের বাড়ি । গ্রামটিতে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, একটি মাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় । সেখানে সাঁওতাল ছেলেকেও হিন্দি পড়তে হয় বলে একটা ক্ষোভ লক্ষ করলাম । গ্রামটিতে শিক্ষার হার খুবই কম । বীরেন্দ্র চিত্রকর, তাঁর স্ত্রী, কন্যা মঞ্জু - সকলেই নিরক্ষর । বীরেন্দ্র পটের গান মনে রাখেন কেবলমাত্র কানে শুনে । দুমকা জেলার জামতাড়া, শিকারী পাড়া, পাহাড়পুর, আমগাছি, দুমদুমি, পাথরচাপড়ি ইত্যাদি গ্রামে পট দেখিয়ে গান শোনাতে যান এই বাহাত্তর বছর বয়সেও । কোন ছেলে নেই বলে দু:খ করছিলেন । কেননা বাড়ির মেয়েরা পট দেখাতে যান না ।

    কুসুমঘাটায় যাদু পটুয়া বীরেন্দ্র চিত্রকরের স্ত্রীর সাথে
    সাঁওতালদের পটুয়ারা বলেন মাঝি । বীরেন্দ্র চিত্রকর জানালেন তাঁর বাবা ঁবিশ্বনাথ, জেঠা ঁভগীরথ যখন পট দেখাতেন তখন পারলৌকিক ক্রিয়াকর্মে সাঁওতালদের যেমন বিশ্বাস ছিল বর্তমানে তা অনেক কমে গেছে । ফলে কেউ মারা গেলেই আজ আর যাদুপটুয়ার ডাক পড়ে না । তবু ওঁরা যান । বীরেন্দ্র (৭২), মতিলাল (৬৫), সনাতন (৪০), কানাই (৩৬), সহদেব (৩২) প্রমুখ চিত্রকরেরা । বেশিরভাগ সময়ে থালা, বাটি, কাপড়, চাল ইত্যাদিতেই খুশি থাকতে হয় । মুরগী বা ছাগল মেলে খুবই কম । আমরা যেদিন গেছি তার ঠিক আগের দিনই বীরেন্দ্র একটি মুরগী পেয়েছেন । তাই তাঁর স্ত্রী বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন আমাদের খেয়ে যেতে । যাঁদের নিজেদেরই অন্ন সংস্থান কঠিন, তাঁদের আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করল ।

    সরকারী পুরস্কারের সার্টিফিকেট হাতে
    বীরেন্দ্র চিত্রকর দুমকার কুসুমঘাটায় নিজগৃহে ।
    কুসুমঘাটায় যে দশজন যাদু পটুয়া এখনও টিঁকে আছেন, তাঁরা সকলেই আগে থেকে ছোট ছেলে-মেয়ে, বুড়ো-বুড়ি, যুবক-যুবতী, ইত্যাদি নানা বয়সের মৃত মানুষের ছবি এঁকে রেখে দেন । তারপর যে বাড়িতে যে বয়সী নারী বা পুরুষ মারা যান সেখানে সেই ধরনের ছবি ঝুলি থেকে বের করেন । অবিকল যে হবে না - সে তো বলাই বাহুল্য । সাধারণত বুড়ো বা বুড়ির ছবিতে চুল সব সাদা, হাতে লাঠি, পিঠটা একটু কুঁজো হয় । যুবক হলে হাতে তীর-ধনুক বা গলায় ঝোলানো থাকে মাদল । যুবতীর কালো খোঁপায় লাল বা কমলা রঙা ফুল গোঁজা থাকে । ছোট ছেলেমেয়েদের ছবিগুলি আকারে খুবই ছোট হয় । খালি গা, হাফ প্যান্ট বা ঢোলা ইজের পরানো - তবে শিশুদের ছবি সংখ্যায় কম আঁকেন । কেন ? শিশুমৃত্যুর হার কি কম ? তা নয়; বীরেন্দ্র জানালেন ঐ সব বাড়িতে যেতে খারাপ লাগে । বয়স্ক লোক - অনেক জমি জিরেত রেখে মারা গেছেন, সেই সব বাড়িতে পাওনাগণ্ডা নিয়ে দর কষাকষি করা যায় । পরিজনরা যাদু পটুয়ার দাবী মিটিয়ে সদ্য চোখদান করা ছবিটি নিয়ে তেল হলুদ মাখিয়ে নদী বা পুকুরে ভাসিয়ে দেন । যাতে অন্য কেউ আর ঐ মৃত আত্মার ছবিটি ব্যবহার করতে না পারেন । ছবিতে রঙের বাহুল্য একেবারেই নেই । অধিকাংশরই গাত্রবর্ণ খয়েরি এবং পরিধানে শ্বেত-বস্ত্র । পায়ের কাছে হাঁস, মুরগী, ছাগল বা থালাবাসন আঁকা থাকে । কালো রঙের জন্য ভূষোকালি ব্যবহার করা হয় ।

    করমবিন্তি পটের খণ্ডাংশ, দুমকা;
    শিল্পী : আনন্দ চিত্রকর
    কেবলমাত্র চক্ষুদান পট এঁকে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয় বলে এঁরা গ্রামে গ্রামে জড়ানো পট দেখিয়ে গান করে থাকেন । সাঁওতালদের বাহা পরব, বাঁধ্না, করমবিন্তি ইত্যাদি নিয়ে যেমন ছবি ও গান আছে তেমনিই কৃষ্ণলীলা, কালী, যম, মহাদেব প্রভৃতির পটও আছে । পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাগুলির সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের পটের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হল রঙ ব্যবহারে । অনুজ্জ্বল, একঘেয়ে রঙ ব্যবহার এখানকার বৈশিষ্ট্য । বিভিন্ন গাছগাছালির রস নয়, এঁরা নদীর ধারে অনেক খুঁজে লাল, হলুদ পাথর বার করে শিলে ঘসে নেন । ভূষাকালির কালোর সঙ্গে লাল মিশিয়ে তৈরি করেন খয়েরি, হলুদ আর লালে কমলা ইত্যাদি । খুব বেশি রঙের বৈচিত্র্য দেখা যায় না এঁদের পটে । সাঁওতাল দেবতা সিংবোঙা, পুট্রে মারাংবুরু এবং তালারে জাহেরা এই তিন দেব-দেবীর ছবি আঁকা থাকে সাঁওতাল জন্মবৃত্তান্তের উপর । এঁরাই মেদিনীপুরের পটুয়াদের হাতে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রাতে পরিণত হয়েছেন । কারণ শহুরে মানুষদের কাছে বোধগম্য করার একটা দায় রয়ে গেছে নয়া পটুয়াদের । এমনকি দুমকা থেকে বেশ কিছু পট কিনে এনে অনেক বেশি দামে বিক্রি করেন তাঁরা । এইভাবে পটুয়াদের মধ্যেই এক শ্রেণির দালাল তৈরি হচ্ছে । বিক্রয়যোগ্যতা অনুযায়ী পটের অনুকরণও চলতে থাকে । এগুলি নকল পট - তাই দেশি বিদেশি মানুষ সংগ্রহ করছেন অনেক বেশি দাম দিয়ে । অথচ যাদু পটুয়াদের আদৌ কোন উন্নতি হচ্ছে না । শুধু মানুষ যে ভুল বুঝছেন তাই নয়, এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জেলাগত তথা রাজ্যগত পটশিল্প বৈশিষ্ট্য । যে পটুয়া অন্যের ছবি নকল করছেন তাঁকে কারিগর বলা যেতে পারে কিন্তু শিল্পী তো বলতে পারি না । গবেষক ছাড়া এ তফাত চট করে ধরা কঠিন । যাদু পটুয়াদের বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হল সরাসরি ওঁদের চক্ষুদান পট বা জড়ানো পট কেনা, প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা । নইলে দালালরাই স্ফীত হবে, যাদব পাটকারেরা সেই তিমিরেই থাকবেন ।

    তথ্যসূত্র :

    ১) পূর্বভারতের পটচিত্র - সুমনা দত্ত চট্টোপাধ্যায় (যন্ত্রস্থ)

    ২) পশ্চিমবঙ্গের পটচিত্র - অশোক ভট্টাচার্য সম্পাদিত

    ৩) পটুয়া সঙ্গীত - গুরুসদয় দত্ত

    ৪) বিভাব, ১৪১০ - কমলকুমার মজুমদার সংখ্যা

    (পরবাস-৪৫, এপ্রিল, ২০১০ )

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)