• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৪ | ডিসেম্বর ২০০৯ | গল্প
    Share
  • স্প্যাগেটি জংশন : কৌশিক সেন



    রোজ সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওদের দুজনকেই হিউস্টনের সবচেয়ে ব্যস্ত একটা স্প্যাগেটি জংশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় । নানাদিক থেকে ডজনখানেক ফ্লাইওভার ওখানে ভিড় জমায়, বাম্পার টু বাম্পার হাজার হাজার গাড়ি গুটগুট করে এগোতে থাকে । একটার মাথার উপর একটা, হাইওয়েগুলোর একদিকে হেডলাইটের আলো উজ্জ্বল হলুদ, অন্যদিকে টেইললাইটের গাঢ় লাল, প্রতিবার ব্রেক চাপার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো বাড়ছে কমছে । ওপর থেকে দেখতে বেশ লাগে কিন্তু ওইসব গাড়িতে সবাই সাধারণত গোমড়ামুখ, সারাদিনের কাজে ক্লান্ত । যদিও পথ অনেকেরই এক কেউ কারো সহযাত্রী নয় সবাই চলেছে যে যার গাড়িতে, আলাদা গতি কিংবা উচ্চতায় । একই ল্যাণ্ডমার্ক সবাইকে পেরোতে হবে কিন্তু কারো সঙ্গে কারো দেখা হবার যো নেই ।

    এইসব এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতে শর্মিলা গাড়ি চালায় । অভিজিতের কালো বি-এম-ডবলিউ হয়তো বা আশেপাশেই আছে । ওর অফিস আর শর্মিলার হাসপাতাল শহরের দুইপ্রান্তে, এই জংশনটা ওরা প্রায় একই সময়ে কিন্তু আলাদা হাইওয়ে দিয়ে পার হয় । ওদের একজিটের ঠিক সামনেই একটা বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন জ্বলজ্বল করে - খুব হাসিখুশি আর নিঁখুত একটা পরিবারের ছবি, মধ্য তিরিশের বাবা-মা, বছর দশেকের একটি ছেলে, তার চেয়ে সামান্য ছোটো একটি মেয়ে । কোনো ইনসিওরেন্স কোম্পানির বিজ্ঞাপন । `লিভ লাইফ অ্যাণ্ড গেট আ লাইফ' ছবিটার তলায় লেখা । একজিটে ঢোকার আগে শর্মিলা ছবিটার দিকে প্রতিদিন এক ঝলক তাকায় । স্টুডিওয় গিয়ে তোলালে ওর পারিবারিক ছবিটাও অবিকল এইরকম দেখাবে । শর্মিলা আর অভিজিত্‌, ঋতম আর রিনি মিলে ওরা যাকে বলে ষোলোর উপর আঠারো আনা সফল এন-আর-আই পরিবার । দুজনের কাজ, শহরতলির বাড়ি আর প্রাইভেট স্কুল নিয়ে ওদের ভরাট সংসারের কোথাও কোনো ছন্দপতন নেই । তবু ওই কথাটা, `গেট আ লাইফ' এক একদিন নাছোড়বান্দা মাছির মত শর্মিলার মগজের চারিদিকে ভোঁ ভোঁ করে ।

    `আয় যেরকম কথা ছিল
    তেমনি করে বাঁচি

    তেমনি করে কেউ বাঁচেনা
    নজর করে দেখরে সোনা
    ঘোড়ার পিঠে রক্ত শোষে
    বিদঘুটে এক মাছি ।'
    শঙ্খ ঘোষের কবিতা শেষ হতে না হতেই ও বাড়ি পৌঁছে যায়, রিমোটের হাল্কা চাপে খুলে যায় গ্যারেজের দরজা ।

    `একটু আগে হলিডে ইন থেকে একজন ফোন করে তোমাকে চাইছিল । টিভি চলছিল নামটা ঠিক শুনতে পাইনি, রেখে দিয়েছি ।'

    অভিজিৎ খাটের উপর বসে আছে, ল্যাপটপ থেকে চোখ না তুলেই কথাটা বললো । শর্মিলাও সোজা খাটের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে । সারাদিনের কাজের ক্লান্তি এইসময়টা ওকে পেড়ে ফেলে । ও পাত্তা দিল না, `বেশ করেছো । টেলিমার্কেটার হবে ।'

    `টেলিমার্কেটার নয়, তোমাকে নাম ধরে ডাকল ।'
    `ও বাংলা অ্যাসোসিয়েশন বা দুর্গাবাড়ির কেউ হবে ।'
    `শর্মি, নম্বরটা একটা হোটেলের, তাছাড়া লোকটার কথা শুনে মনে হল কিছু একটা বিশেষ দরকার । একটু দেখোই না ।'
    `আচ্ছা আপদ তো । তুমি এতো অধৈর্য কেন । নাকি সন্দেহবাতিক হচ্ছে আজকাল ।'
    `এটা বিলো দি বেল্ট শর্মি । আমার মনে হল ফোনটা দরকারি তাই ।'
    `আচ্ছা আচ্ছা দেখবো, এখন একগাদা কাজ ।'

    ওদের সন্ধ্যাগুলো আর ওদের নিজেদের নয় । বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক, নিজেদের অফিসের কাজ, দুচারটে দরকারি ফোন শেষ করতে করতেই খাবার সময় হয়ে যায় । পরদিনে ভোর রাত্তির থেকে আবার ছোটা স্কুলে, অফিসে, হাসপাতালে । শর্মিলা ফোনটার কথা বেমালুম ভুলে গেল ।


    অফিসে অভিজিতকে ইদানীং বেশ একটু চাপ নিতে হচ্ছে । এই টালমাটাল বাজারে ওদের টেক কোম্পানির খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থা নয়, প্রতি কোয়ার্টারেই শেয়ারের অধোগতি । চারদিকে নানা গুজব ম ম করছে - মার্জার, অ্যাকুইসিশন, ফারলো, লে-অফ । অভিজিতের মনে পড়ে যায় বছর দুয়েক আগের কথা । ওরা তখন নিজেদের মনে করতো দিনদুনিয়ার মালিক, ব্যবসা আগুনের মত ছড়াচ্ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে । শেয়ারের দাম বাড়ছিল হু হু করে, ওরাও যত পারে স্টক কিনে জমা করেছিল । রাত্রে কমপিউটার খুলে ও শর্মিলাকে টাকার অঙ্কটা দেখাতো আর ঠাট্টা করে হাসপাতালের বাজে চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলতো । এখন খুব মেজাজ খারাপ হলে ও চোখ বুজে সেই সময়ের কথা মনে করে ।

    `শর্মি চলো আলাস্কা ঘুরে আসি - এই দ্যাখো মাত্র দিনদশেকের ত্রক্রুজ ।'
    `ওরেবাবা ! এ তো পনেরো হাজার ডলারের ধাক্কা । প্লেনের টিকিট নিয়ে কুড়ি ছুঁয়ে যাবে । খুব টাকা হয়েছে না ।'

    `হয়েছেই তো । কটা শেয়ার বেচলেই ওই টাকা উঠে যাবে । কাম অন শর্মি, লেটস গেট আ লাইফ এগেইন ।'

    `এই তো ফ্লোরিডা থেকে বেড়িয়ে ফিরলে বাবা । তাছাড়া তুমি তো ছুটিতেও কমপিউটারে খুটখাট কাজ করে যাবে । আমার ক্লিনিক, বাচ্চাদের পড়াশুনো এ সবকিছু দু হপ্তার জন্য টাঙিয়ে রাখলেই হলো ? একটু প্ল্যান করে পরের বছর না হয় ।'

    `উফ তোমার সব কিছু পরের বছর - বেড়ানো, আদর খাওয়া ।'
    `অ্যাই মিথ্যুক ।'
    `আই অ্যাম অ্যাট দি জেনিথ নাউ শর্মি । আমার সব কিছু এক্ষুনি চাই । পরের বছর না এমনকি পরের হপ্তায়ও না ।'

    তারপর ল্যাপটপ মাটিতে নেমে যেত, বিছানায় দোলা লাগাতো সমুদ্রের ঢেউ । ডুবে যেতে যেতেও শর্মি অস্ফুটে বলে উঠত - `দরজাটা অভি, বাচ্চাগুলো ঘুমায়নি এখনো ।'

    এইসব দিনগুলো আস্তে আস্তে স্মৃতি হয়ে যাবে বোধহয় ।

    ফোনের আওয়াজে ওর দিবাস্বপ্ন ভাঙলো । `হাই আভি দিস ইস ক্যারল । তোমাকে একজন সকালে ফোন করেছিল । নম্বর রেখেছে, বলল পার্সোনাল ।'

    নম্বরটা অভির অচেনা লাগল । নামটা দুর্বোধ্য, দেশি কেউ হবে নির্ঘাত্‌, ক্যারল কি শুনেছে কি লিখেছে কে জানে । কদিন আগে ওর এক আই-আই-টি'র বন্ধু চেন্নাই থেকে ফোন করে খাঁটি তামিল উচ্চারণে নাম বলেছিল চিন্তালাপুত্তি গিরিধরন । বেচারা ক্যারলের মুখটা দেখার মত হয়েছিল সেদিন । এই সাতসকালে খোশগল্প করার সময় নেই, অভিজিৎ অন্যমনস্কভাবে নম্বরটা পকেটে চালান করে দিল । সামনে কম্পিউটার সারা দুনিয়া থেকে খবর পাঠাচ্ছে, ওর কাজ সেগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে মাপজোপ করে কতগুলো ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়া । সব ফাইলেই মোটামুটি খারাপ খবর, অভিজিৎ নোট নিতে নিতে ভাবল আজকে আর কোথায় চাকরি গেল কে জানে ।

    `আভি, আমি লাঞ্চে যাচ্ছি, আসবে নাকি ?'
    `তুমি ঘুরে এসো ক্যারল, আমি আরেকটু কাজ সেরে যাবো ।'
    `ওকে । তোমার অসুবিধা হবে না তো । ঠিক দশ মিনিটে ফিরছি ।'

    ক্যারল একঝলক হাসি আর সুগন্ধ ছড়িয়ে চলে গেল । মেয়েটা সদ্য কলেজ ছেড়েছে, আপাতত এই সংস্থায় ইনটার্ন । ছিপছিপে চেহারার ব্রুনেট, যেমন চার্মিং তেমন চালাক, সবার সাথেই সুন্দর ব্যবহার করে, আবার বাছা বাছা কয়েকজনের সঙ্গে খুব আলগোছে একটুখানি ফ্লার্টিংও মিশিয়ে দেয় । ওর হেঁটে যাওয়ার নিখুঁত ভঙ্গিমা আর কাঁধের উপর ঢেউখেলানো বাদামি চুলের দিকে তাকিয়ে অভিজৎ একটা শ্বাস চাপল । মনের মধ্যে স্পষ্ট একটা ডানা ঝটপটানির আওয়াজ । কি হবে এতো সাবধান হয়ে, ইচ্ছে করছে তো গেলেই হয় দু-একদিন ওর সঙ্গে লাঞ্চে । বন্ধুত্ব করতে ক্ষতি কি, আগের ইনটার্ন ছেলেটার সঙ্গে তো হরদম মেলামেশা করতে । নাকি সাবধান থাকাই ভালো, তুমি দায়িত্ববান স্বামী, স্নেহময় বাবা, সমাজের চোখে আদর্শ সংসারী, পিছল জমিতে হাঁটার ঝুঁকি নিতে যেওনা, শেষকালে কোমর ভেঙে দ' হয়ে থাকবে । ইচ্ছাটাকে লাগাম পরাও, মনের চড়াইপাখিটাকে পোষ মানিয়ে খাঁচায় পোরো । অভিজিৎ নিজের মনেই একটু হাসে তারপর আবার কমপিউটারের দিকে চোখ ফেরায় । ভাগ্যিস ব্যবহার দেখেই চরিত্রবিচার হয়, মনের খবর কেউ রাখেনা ।

    সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কাজকর্ম শেষ করে অভিজিতের ফোনটার কথা মনে পড়লো । পকেটে হাত দিয়ে দেখে স্টিকি নোটটা কোথ্থাও নেই । বেশি কিছু না ভেবেই ও বাড়ির পথ ধরলো, যার দরকার সে নিশ্চয়ই আবার ফোন করবে ।

    `ডক্টর বাসু একটা এক্সট্রা পেশেন্ট দেখতে পারবেন আজ সকালে ? এক্ষুনি রিকোয়েস্ট এসেছে, কিন্তু ওভারবুক করতে হবে ।'

    শর্মিলা বিরক্ত হল । একেই আজ একগাদা নতুন পেশেন্ট তার ওপরে আরেকটা চাপবে । আজকাল ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে, আগের মত দিনরাত কাজ করতে পারেনা । আর কাজ মানেই তো বাড়ি ফিরতে দেরি আর অভিজিতের হাঁড়িমুখ । কিন্তু না বলাও ওর ধাতে নেই ।

    `অপেক্ষা করতে হবে, আমি ব্যস্ত, তবে লাঞ্চের আগে দেখে দেবো । যদি তাড়াতাড়ি থাকে জো কে দেখাতে বলো ।'

    জোনাথন শর্মিলার অ্যাসিস্ট্যান্ট, অল্পবয়সী তুখোড় ছোকরা, ও আসার পর থেকে শর্মিলার দিনগুলো কিছুটা সহজ হয়েছে ।

    কয়েক ঘন্টা কাজ করার পর একটু কফি ব্রেক । লাউঞ্জে যথারীতি লম্বা একটা কাপ নিয়ে পবন আডিগে হাজির । নামকরা কার্ডিওথোরাসিক সার্জন কিন্তু এদিকে পেটে পেটে নাটক পাগলা মারাঠি । শর্মিলার সঙ্গে নাটক দেখতে গিয়েই আলাপ । কলেজে শর্মিলাও নাটক পাগল ছিল, গ্রুপ থিয়েটার করতো, বেশ একটা ঝাঁঝালো রাজনৈতিক গ্রুপ । তারই মধ্যে কোথা থেকে এসে পড়ল এক সফল, রাগী, কনফিডেন্ট, এন আর আই যুবক, কয়েক মাসের মধ্যে ওকে পিঁড়িতে তুলে, সিঁদুর লাগিয়ে, প্লেনে চাপিয়ে হাজির করল সোজা হিউস্টনে । বাবা-মা মনের মত জামাই পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হলেন, শর্মিলাও ভাবলো বন্যা এলে পুরনো অনেক কিছু ভেসে যাওয়াই তো স্বাভাবিক । এখন মনে হয় জল সরে যাচ্ছে, পলিতে আটকে আছে কত কিছুই ।

    পবনের সাথে কি খুব বেশিরকম দেখা হয়ে যাচ্ছে আজকাল ? ওর সঙ্গে নাটক বা কবিতা নিয়ে কথা বলা যায় তাইজন্য কি ? মাঝে মাঝে মনে হয় লোকটা লেডিকিলার টাইপের নয়তো । কেমন যেন সোজা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, গা শিরশির করে এক এক সময় । ওকে এড়িয়ে চলতে গিয়েও মাঝে মাঝে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলে কি শর্মিলা ?

    পবন আজকে মুডে আছে । জোর করে ওকে কফি কিনে দিল তারপর কথায় কথায় একদম দেরি । প্রায় ছুট্টে অফিসে ঢুকে দেখে যা ভেবেছিল তাই । সেই ওভারবুকড পেশেন্ট পরে আসবে বলে চলে গেছে, জো কে দেখাতে চায়নি । একটু অপরাধবোধ হলো কিন্তু কি আর করা । ফোন তুলে ও সেক্রেটারিকে বলে দিল কাল সকালে ওকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে দিতে- `বাই দা ওয়ে নামটা কি যেন ওই পেশেন্টের আর অসুখটাই বা কি ?'

    `নাম বলেছিল জ্যটির্মায়া বাট্টাচারায়া আর ডায়াগনোসিস লিউকোমিয়া । বেশ অসুস্থ মনে হচ্ছিল কিন্তু ।'
    `কি বললে ? কি নাম বলেছিল ! ও মাই গড !'
    গাড়িটা এদিক ওদিক করে তাড়াতাড়ি ছোটার চেষ্টা করছে, কিন্তু হিউস্টনের ট্র্যাফিক বড় সোজা জিনিস নয় । শর্মিলা একহাতে স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে কাঁপা গলায় মেসেজ রাখলো । `অভি প্লিজ এক্ষুনি আমাকে রিং ব্যাক করো, ভীষণ বিপদ আমি তোমার অফিসে আসছি !'

    `ক্যারল আই নিউ টু লিভ নাউ ।'
    `কি হয়েছে আভি তোমাকে এমন আপসেট হতে তো কখনো দেখিনি । তুমি চলে যাও কাজ আমি সামলে নেবো । মিসেস বাসু ফোন করেছিলেন, বাচ্চারা ঠিক আছে আশা করি ।' অভিজিৎ ফোনটা রেখেই বেরিয়ে যাচ্ছে, উত্তর দিল না ।

    এখন ওরা দুজন হাসপাতালের একটা বেডের সামনে নিঝুম হয়ে বসে আছে । ঘরের মধ্যে আধো অন্ধকার, বয়স্ক এক ভদ্রলোক বিছানায় আধশোয়া, স্যালাইন পোলে নানারকম প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝোলানো, পাম্প আর মনিটরের আলোগুলো জ্বলছে নিভছে ।

    `জ্যোতিদা আমাদের একটা খবর দিলেন না কেন আগে থেকে ?'
    `দিয়েছিলাম তো, তোমাদের দুজনকেই ফোন করেছিলাম । আমার কাছে তোমাদের বাড়ির নম্বর ছিল আর অভির অফিসের । বাড়িতে অভি এমন রাগ রাগ গলায় কথা বললো যে ঘাবড়ে গেলাম । আর অফিসে ফোন করলেই একটা মেয়ে ধরে, সে ছাই আমার কথাই বোঝেনা আর আমিও তথৈবচ । আসলে তোমাদের একটু সারপ্রাইজ দেবার ইচ্ছাটাও ছিল । রবিবার তোমাদের বাড়িও গেছিলাম হোটেল থেকে ট্যাক্সি নিয়ে । বাড়ি বন্ধ তোমরা কোথাও গেছিলে বোধহয় । পর্চের সিঁড়িতে বসে ছিলাম, ও বাবা কোথা থেকে এক পুলিশ এসে গেল । তোমাদের কোনো প্রতিবেশীই ডেকে থাকবে । আমি কে, এখানে কি করছি এই সব প্রশ্ন । আমার পাসপোর্ট হোটেলে, অন্য কোনো আইডেন্টিটিও নেই, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, জামা-কাপড়ও বিজাতীয় । হোমলেস বা চোর-ছ্যাঁচড় ভেবে অ্যারেস্ট করে আরকি । কোনোরকমে বুঝিয়ে সুজিয়ে ছাড়া পেলাম । তারপর শর্মি'র ক্লিনিকে গেলাম তো একটা ছোকরামত ছেলে এসে বলল, ডক্টর বাসু নেই, জামা খুলে শুয়ে পড়ুন, আমি আপনাকে দেখবো । আবার পালিয়ে এলুম । তারপর দেখি কম্প দিয়ে জ্বর এসেছে আর হোটেলের লোকেরা অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিলো ।'

    `একটা ই-মেইল করতে পারতেন তো । মা বাবাকেও জানাননি যে এখানে আসছেন, তায় আবার এরকম অসুখ নিয়ে ।'

    `ওই যে বললাম ইচ্ছা ছিল তোদের বেশ একটা সারপ্রাইজ দেবো । দরজা খুলে দেখতিস জ্যোতিদা দাঁড়িয়ে আছে, কেমন অবাক হতিস বল ? বাচ্চাগুলো তো বড় হয়ে গেছে চিনতেও পারতো না । দেখ অসুখ নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না ভাবলাম অন্তত প্রথম দেখা হওয়াটা আগের মতই হইহই করে হওয়া উচিৎ । দেখ দেখি আমার খামখেয়ালির জন্য তোদের কি ছিদ্দাৎ হলো ।'

    `কিছু হয়নি জ্যোতিদা, আমরা লজ্জায় মরে যাচ্ছি । আপনি অসুস্থ শরীরে আমাদের কাছে এসেছেন আর আমরা নিজেদের নিয়ে এমনই ব্যস্ত ।' শর্মিলা কাঁদছে, মাথা নামিয়ে চুপচাপ বসে আছে অভিজিৎ ।

    জ্যোতির্ময় ভটচাজ শর্মিলা-অভিজিতের ম্যাচমেকার । মানুষটি ব্যাচেলর এবং চিরসবুজ । সিটি কলেজের পার্টটাইম চাকরি, দুই ঘরের বাসা, নাটকের দল আর লেখালেখি নিয়ে নিজে মহানন্দে তো থাকতেনই, চারপাশের সকলকেও মাতিয়ে রাখতেন । সাংসারিক কোনো ব্যাপারেই ওঁর কোনো মাথাব্যাথা ছিল না, গ্রুপ থিয়েটারই জীবনের সবকিছু । জ্যোতিদার কাছেই শর্মিলার অভিনয়ে হাতেখড়ি, রবীন্দ্রসংগীত আর বাংলাসাহিত্য ভালোবাসতে শেখা । উনিশ বছর বয়েসে যা হয়, একটা বেপরোয়া ইনফ্যাচুয়েশনও বাসা বাঁধছিল ভেতরে ভেতরে । নানা ইঙ্গিতে ও আরেকটু কাছে আসতে চাইতো কিন্তু জ্যোতিদা নিপুণভাবে পিছলে যেতেন । এরই মধ্যে একদিন খুব ক্যাজুয়ালি উনি বলেছিলেন, `চল তোর সাথে আমার ভাইপোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, আমেরিকায় থাকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ।'

    জ্যোতিদার সেই ভাইপো অভিজিৎ । বিয়ে করতেই দেশে এসেছে কিন্তু সাবেক পদ্ধতিতে মেয়ে দেখতে নারাজ, আলাপ না করে বিয়ে করবে না । স্বভাবে কাকার ঠিক উলটো, একটু মেজাজি, প্র্যাগম্যাটিক এবং সোজা কথার লোক । জ্যোতিদা আগে থেকেই ওকে তৈরি করে রেখেছিলেন, শর্মিলাকে ওর দেখেই পছন্দ হয়ে গেল, আর সেটা জানিয়েও দিল সাথে সাথে । উনি নানা কায়দায় ওদের দুজনকে কাছাকাছি এনে দিতেন, শর্মিলাও অবাক হয়ে দেখতো যে জ্যোতিদার কল্পলোকের তুলনায় অভিজিতের আমেরিকান ড্রিম ওকে কম উত্তেজিত করে না । দেখতে দেখতে শর্মিলার ফাইনাল শেষ আর দুই বাড়িতে কথাবার্তাও পাকা । শর্মিলা বিয়ের আগের দিন ছদ্ম অভিমানভরে জ্যোতিদাকে বলেছিল, `আমাকে ভালোবাসেন না বলে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন তাইতো ?'

    জ্যোতিদা হা হা করে হেসেছিলেন, `না রে পাগলি, ভালোবাসি বলেই তো ভালো জিনিষটা তোর জন্য সরিয়ে রেখে দিয়েছিলাম ।'

    সেই জ্যোতিদা আজ এখানে এইভাবে হাসপাতালের বেডে । হায় ভগবান উনি কি ভেবেছিলেন যে লেক গার্ডেনসের বাড়ির মত বেল দিলেই মাসি দরজা খুলে দেবে আর উনি একটা বই হাতে গ্যাঁট হয়ে বসে যাবেন ।

    শর্মিলা কথাও বলতে পারছে না, শুনছে কাকা-ভাইপোর কথাবার্তা ।
    `কাকা তোমার লিউকোমিয়া হয়েছে এটা মা জানে ?'
    `দেখ দাদা চলে যাবার পর বৌদি এমনিতেই কেমন একটু হয়ে গেছেন ওঁকে এক্ষুনি আরেকটা শক দিতে চাইনি । প্রথম কেমোথেরাপিটার পর বেশ ভালোই ছিলাম । দুনম্বরটার আগেই রিল্যাপস করলো । বম্বে গেছিলাম ওরা বলে দিল যে, খারাপ টাইপের রোগ, বোন ম্যারো ট্রানসপ্ল্যান্ট করাতে হবে তবে তাতেও ভালো হবার সম্ভাবনা দশ থেকে কুড়ি পার্সেন্ট বিশেষ করে আমার বয়েসে । আমি জানি শর্মি এসব নিয়ে কাজ করে ভাবলাম ওর সঙ্গে দেখাও করে যাই, মুফতে কনসালটও করিয়ে আসি । কেউ টেরও পাবে না ভাববে আমি বম্বের থিয়েটার ফেষ্টিভ্যালে গেছি ।' জ্যোতিদার হাসিটা আগের মতই ।

    গভীর রাত্রে ওরা একসঙ্গে বাড়ি ফিরছে । সেই একই রাস্তা, সেই স্প্যাগেটি জংশন ফাঁকা শুনশান, দু একটা গাড়ি তীব্র বেগে ছুটছে শুধু ।

    `শর্মি, কাকার অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ ?'
    `বেশ খারাপ অভি । আপাতত এট নিউমোনিয়া, ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু কাকার অসুখটা সবচেয়ে বিচ্ছিরি ধরনের অ্যাকিউট লিউকেমিয়া । সবচেয়ে বড় কথা ট্র্যান্সপ্ল্যান্ট বললেই করা যায় না, ম্যাচিং ডোনার চাই, তারপর বিরাট খরচের ধাক্কা, প্রায় একশো হাজার ডলার । ওনার তো এদেশে ইনসিওরেনস নেই ।

    `সেটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা । একটু সুস্থ হলে কাকাকে নিয়ে তাহলে আমি দেশে ফিরে যাবো তারপর টাটাতেই বরং - আচ্ছা টাটায় তোমার চেনাজানা কেউ নেই ?'

    `আছে হয়ত' শর্মিলা ক্লান্ত স্বরে বলল ।
    পরের সপ্তাহে জ্যোতির্ময়বাবুর দেশে ফেরার কথা । এখন শনিবার রাত বারোটা, উনি গেস্ট রুমে ঘুমিয়ে আছেন বাচ্চারাও ছোটদাদুর সঙ্গে খেলা শেষ করে ঘুমোতে গেছে, বিরাট বাড়িটায় শুধু অভিজিৎ আর শর্মিলার চোখে ঘুম নেই ।

    `তুমি ডিপ্রেসড হয়ে আছ শর্মি ?'
    `ডিপ্রেসড ! আই অ্যাম রিয়ালি ডিভাস্টেটেড অভি । তাও দেখো আমি তোমার প্ল্যান মেনে নিয়েছি । আমি জানি ওটাই প্র্যাকটিক্যাল । কিন্তু ডাক্তার হিসাবে আমার আরো চেষ্টা করার ছিল, সে দু:খ আমার মরলেও যাবে না । আমরা কেমন বিচ্ছিন্ন আর যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি দেখো, একটা মানুষ তিন দিন ধরে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতেই পারল না । এরপর যখন ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাবে ওদের সাথেও কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেখা করতে হবে অভি ? এই বাস্তবতাই কি অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য ? অবশ্য ভেবে আর কি হবে লেটস নট টক অ্যাবাউট ইট ।'

    অভিজিৎ পায়চারি করতে করতে শোবার ঘরের বড় আলোটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো, ওর গেঞ্জি আর সর্টস পরা সুঠাম চেহারাটা আধা অন্ধকারে সিল্যুট ।

    `না লেটস টক । কথাগুলো কদিন ধরেই বলব ভাবছি । আজকাল আমাদের কমিউনিকেশন খারাপ হয়ে গেছে, আমাদের রাস্তা একসময় একই ছিল এখন আলাদা হতে হতে ওই হতচ্ছাড়া স্প্যাগেটি জংশনের মত তালগোল পাকিয়ে গেছে বোধহয় । দূর থেকে দেখলে বেশ অর্গানাইজড লাগে কিন্তু আমরা আসলে প্রত্যেকে একা একা ছুটছি । কাকা আসার পর এই একটা সুযোগ এসেছে, আমরা আবার এক রাস্তায় ফিরতে পারি ।'

    ভেবে দেখলে নতুন করে লজ্জা পাবার মত কোনো কাজ কিন্তু আমরা করিনি । আমরা এদেশের নিয়ম মেনে, প্রাইভেসি বাঁচিয়ে চলতে অভ্যস্ত । আমরা খবর না দিয়ে কারো বাড়ি যেতে চাই না, সেটা অভদ্রতা । গায়ে পড়ে কারো উপকার করতে যাইনা কারণ সেটা নাক গলানোর সামিল । দানধ্যান করলে ট্যাক্সের ছাড়পত্রটি সাবধানে রেখে দিই । বাড়িতে নিয়মিত টাকা অনেকেই পাঠাই কিন্তু উটকো কোনো খরচাপাতির ঝুঁকি নিতে চাই না । এ সবই আমরা করি প্র্যাকটিক্যালিটির কথা ভেবে, এর মধ্যে ভালো-খারাপের কোনো প্রশ্নই নেই । এমনকি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও একজন হঠাৎ স্যাক্রিফাইস করতে চাইলে অপরজন বাগড়া দেবে কারণ একজনের আবেগ অন্যজনের কাছে পাগলামো, একজনের প্রিয়জন অন্যজনের কাছে আপদ । কিন্তু কাকার ব্যাপারটা আলাদা, ইন ফ্যাক্ট ইট ইস আ রেয়ার অপরচুনিটি ।'

    অভিজিৎ দম নেবার জন্য থামল । শর্মিলা অবাক হয়ে ওর কথা শুনছে । কতদিন পরে একসঙ্গে এত কথা বলছে অভি ।

    `কাকা এমন একজন মানুষ যাকে আমরা দুজনেই ভালোবাসি তাই দুজনেই অপরাধবোধে ভুগছি । এটা একটা মস্ত সুযোগ । এই মওকায় আমরা একদম ইমপ্র্যাকটিক্যাল, নিজেদের স্বার্থের উলটোদিকে কিছু একটা করে ফেলতে পারি । সামথিং রিস্কি, সামথিং বিগার দ্যান আওয়ারসেলভস । হয়তো তুমিও আমাকে বারণ করবে না আমিও করবো না তোমাকে । এর জন্যই হয়তো উই উইল নট ফল অ্যাপার্ট, আমরা আবার এক রাস্তায় হাঁটা অভ্যাস করতে পারব । তাই বলছি যে কাকা আমাদের সঙ্গেই থাকুন, আমরা টাকাপয়সার দায়িত্ব নেবো, ওঁর চিকিত্সা এখানেই হোক । লেটস গো ফর ট্রানসপ্ল্যান্ট । আর ম্যারো ডোনার একজন তো তোমার সামনেই খাড়া আছে । অবশ্য মজ্জা বলে যদি কিছু বাকি থাকে, এতদিন সংসার করে হাড়ে হাড়ে দুব্বো গজিয়ে যাবার কথা ।'

    `ঢের হয়েছে । লেকচার থামিয়ে এখানে এসো প্রফেসর সাহেব । দেখি একটু হাড়গুলোয় কতখানি দুব্বো গজিয়েছে ।'

    এক ঝটকায় ওকে কাছে টেনে নেয় শর্মিলা । ওর হাসির শব্দ সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে । `এই কথাটা গলায় আটকে ছিল, বলতে ভয় পাচ্ছিলাম অভি । থ্যাঙ্কস ফর বিইং আ ম্যান । এসো আবার এক রাস্তায় হাঁটি ।'




    (ডিসেম্বর, ২০০৯; পরবাস-৪৪)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments