• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৪ | ডিসেম্বর ২০০৯ | গল্প
    Share
  • মাটি : সাবর্ণি চক্রবর্তী



    এখন কৃষ্ণপক্ষ । মাঝরাত । আকাশে চাঁদ নেই । আছে মেঘের বড় বড় টুকরো । চারপাশে একটা অন্ধকারের প্রলেপ । জমির একধারে গ্রামের রাস্তার লাগোয়া তারাপদর মাঠকোঠার বাড়ি - তার দোতলার ঘরে ঘুমোচ্ছে ওর ছেলে অসীম আর তার বউ - আরতি । তারাপদ দাঁড়িয়ে তার জমিতে । জমির নরম, উর্বর মাটি - বছর বছর ওর ভাত যুগিয়েছে । মাটি এখন বৃষ্টিভেজা - ধানের চারা রুইলে সোনা ফলবে । কিন্তু এখন এই চাষের মাঠ খালি - খাঁ খাঁ করছে । তারাপদ এক পা এগোয় - মাটিতে পা ডুবে যেতে চায় - বড় আদরে ওর পায়ের পাতা জড়িয়ে ধরে এই মাটি । তারাপদ বড় একটা শ্বাস ফেলে । এই রাত কাটবে - আসবে দিন - ও ছাড়বে তার ঘর - পেছনে পড়ে থাকবে এই জমি - তার মাটি ।

    তারাপদ সামনে ঝুঁকলো - একমুঠো ভিজে মাটি তুলে নাকের কাছে ধরলো । একটা সোঁদা, মিঠে গন্ধ । ও বুক ভরে এই গন্ধ টেনে নেয় । হাতের আঙুলের ফাঁকে কি একটা কিলবিল করছে । অন্ধকারে দেখতে না পেলেও ও ঠিক বোঝে - ধানের পোকা । ধানের চাষ হলে ঐ পোকায় ভরিয়ে দিত চারাগুলো । অনেকবার চাষের সময় পোকা হয়েছে । স্প্রে করতে হয়েছে পোকা মারার বিষ । চাষের জমির ওপর দু ফুট দাঁড়ানো জল - তার ওপর চারাগুলো মাথা তুলে রয়েছে । সেই জলের ভেতর পাইপ হাতে তারাপদ - পরনের কাপড় জলে ভিজে না যায় সেজন্যে লেংটির মত করে পরা - পোকা মারার ধোঁয়ার মত গুঁড়ো বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে চারাগুলোর ওপর । পেছনে মাছ ধরার পলো হাতে সুমতি ।

    গোড়ার দিকে মৃদু আপত্তি তুলেছে সুমতি । ঐ জলের ভেতর কুচো কুচো অনেক মাছ - সব তো মরে যাবে । তারাপদর তখন জোয়ান বয়েস - মাথা গরম । হাতে স্প্রে করার পাইপ না থাকলে হয়তো বউয়ের গালে বসিয়ে দিত এক থাপ্পড় । খেঁকিয়ে উঠল, গাধার মত কথা বলছিস কেন ? মাছগুলোকে বাঁচাতে গিয়ে কি ধানগাছগুলোকে মারব ?

    আর ঘাঁটায়নি সুমতি । রেগে গেলে মানুষটা সাক্ষাৎ যম । পলো দিয়ে যতটা পারে জ্যান্ত মাছ ধরে নেয় । স্প্রে করার পরে সব মাছ ভেসে ওঠে - তবে মরা । কুড়মুড়ে করে ভাজা করে সুমতি । তারাপদ দুপুরের পান্তাভাত আর রগরগে ঝাল কাঁচালঙ্কার সঙ্গে সেই মাছভাজা খেয়ে বড় খুশি হয় । রাতে ওর ঘনিষ্ঠতা থেকে সুমতি বোঝে - আজ মানুষটা মাছভাজা খুব সোয়াদ করে খেয়েছে ।

    তারাপদ থমকে দাঁড়ায় । আনমনে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেছে জমির শেষে - আলের গায়ে । এখানে আলের নিচের দিকে গর্ত - তার ভেতরে সুড়ঙ্গপথ । সেখানে রয়েছে বাস্তুসাপ । প্রত্যেকবার চাষের আগে তার দয়া চাইই চাই - নইলে জমি মুখ ঘুরিয়ে নেবে - ধান শুকিয়ে খাক হবে । ব্যাঙ মেরে গর্তের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে আসত তারাপদ । পরের দিন আর ব্যাঙটাকে দেখতে পেত না - বুঝত তেনারা ভোগ নিয়ে নিয়েছেন । তার পরেই না জমি উগরে দিত - যা লাগাও তার হাজারগুণ । ধান, আলু, লাল টমেটো, সরষে, ঘন সবুজ রঙের লঙ্কা ।

    একবার একটা পাপ লেগেছিলো । আগাছা হয়েছিলো জমির ধারে ধারে । কাস্তে দিয়ে তা পরিষ্কার করতে লেগে পড়েছিলো ওরা দুজন । মুঠোয় ধরে আগাছা উপড়ে তোলে - নইলে বাঁ হাত দিয়ে টেনে ধরে ডান হাতের কাস্তে দিয়ে গোড়া থেকে কেটে দেয় । আগে আগে তারাপদ - পেছনে সুমতি । দিনের আলো প্রায় নিভে এসেছে - মাঠের চারপাশ প্রায় সাফ করে ফেলেছে ওরা । তারাপদর কানে এলো একটা ভয় পাওয়া অস্ফুট আওয়াজ । সুমতির গলা । চট করে পেছনে ঘুরলো তারাপদ ।

    ওর থেকে হাত চারেক দূরে সুমতি । - ভয়ে চোখ দুটো বড় হয়ে গেছে - মুখটা হাঁ করা । ওর আর সুমতির মাঝখানে সুমতির দিকে মুখ করে আড়াই হাত লম্বা খাড়া হয়ে উঠেছে - মাথাটা খুব বড় নয় - পড়ন্ত রোদে কালো চাবুকের মত শরীর চকচক করছে ।

    এক মুহূর্তেরও অনেক কম সময় । তারাপদর মাথায় একরাশ চিন্তা খেলে গেলো । বাস্তু সাপ কি ? হাতের কাস্তে ও কি চালাবে ? চালালে কি পাপ হবে ? না চালালে কি সুমতি - ওর বউটা - মরে যাবে ?

    এসব প্রশ্নের উত্তরের সময় কোথায় ? তারাপদ দেখলো ও ধরে ফেলেছে সাপটার কোমর - চালিয়ে দিয়েছে ওর কাস্তে । সরীসৃপটার মুণ্ডুসমেত খানিকটা শরীর মাটিতে ছিটকে পড়ে ছটফট করছিলো - ওর বাঁ হাতের মুঠোয় ধরা বাকি শরীরটাও ধড়ফড় করছিলো - কালচে রক্ত বেরিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো পায়ের নিচের ভূঁই আর ওর হাত, পা, পরনের কাপড় ।

    সুমতির চোখে এখন অন্য ধরনের ভয় । বলল, মেরে ফ্যাললে ? যদি পাপ লাগে ?

    সে ভয়টা এখন তারাপদও পেয়েছে । কিন্তু মুখে ধমকে উঠল, চুপ কর্‌ । এ না করলে তো তোকে কাটত ।

    সাপটার ধড়টা ছেড়ে দিলো তারাপদ । থপ করে মাটিতে পড়লো ওটা । কালচে রক্ত এখনও বেরোচ্ছে - তবে খুব বেশি নয় । কম প্রেসারের জলের লাইনে ফাটা থাকলে সে জায়গা দিয়ে যেরকম বেরোয় সেরকম ।

    পরনের রক্তমাখা কাপড়টা খুলে ফেলে তা দিয়ে হাতের আর গায়ের রক্ত মুছে নিলো তারাপদ । পরনে খালি একটা টাইট জাঙিয়া । সন্ধে নামছে - সামনে খালি সুমতি - লজ্জা আর করবে কাকে ? বলল, শালা, পুরো কাপড়টা বরবাদ । ওটাকে গোর দেব, একটা গর্ত খোঁড় দিনি ।

    ওরা মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলো শরীরের টুকরোদুটো । ঘরে নিয়ে গিয়ে কাপড়টা পুড়িয়েছিলো । সেদিন সন্ধে দেবার পর সুমতি বলেছিল, কাল একবার মা মনসার থানে যাবো । তুমিও সঙ্গে চল, দুজনে পুজো দিয়ে আসব ।

    তারাপদ বসে পড়ে মাটির ওপর । যদিও চারপাশ অন্ধকার ও চিনতে পারে - এই সেই জায়গা । সে ঘটনার পর থেকে এ জায়গাটার চারপাশে অনেকটা জমি ছেড়ে রেখে চাষ করেছে তারপদ । তবে আগাছাও হতে দেয়নি । জমির টুকরোটার একপাশে আল আর তিন পাশে ফসলের ক্ষেত - তিনপাশে সবুজের ভেতর কুমারী হয়ে থাকা একটুকরো ভূঁই । বেশ কয়েক বছর পরে মাথায় একটা খেয়াল চেপেছিলো - জায়গাটা আবার খুঁড়ে দেখেছিলো - সেই শরীরের টুকরো দুটো কি অবস্থায় আছে ? কিছু নেই - মাটি সব হজম করে নিয়েছে । একটা অন্ধ ভিখিরি ওদের গাঁয়ে মাঝে মাঝে আসত ভিক্ষে করতে । ও গান গেয়ে ভিক্ষে করত - মাটি হবে আসনবাড়ি - মাটিই হবে বিছানা ।

    ওরা এসেছিলো প্রায় ছ'মাস আগে - নাকি আট মাস ? অত খেয়াল নেই তারাপদর । দুটো গাড়ি এসেছিলো । একটা পুরোনো ধরনের জীপগাড়ি - মার্কামারা সরকারী আপিসের গাড়ি । আর একটা বড় গাড়ি - ঐ যে কি টাটা সুমো না কি যেন নাম । তারাপদর চাষের জমি মাঠকোঠার পেছন দিকে । সামনের দিকে রাস্তা - যদিও মাটির, বর্ষাকাল না হলে গাড়ি চলতে কোন অসুবিধে নেই । বেলা তখন ভর দুপুর - ঠা ঠা রোদের ভেতর মাথায় একটা গামছা বেঁধে নিয়ে তারাপদ ক্ষেতে পাওয়ার টিলার চালাচ্ছে । জমির একপাশে সরষের চাষ করবে - শীত যখন জাঁকিয়ে পড়বে জমির ভেতর থেকে সরষে গাছ মাথা তুলবে । তার ডগায় থাকবে হলুদ সরষে ফুল - শীতের হাওয়ায় ফুলগুলো দুলবে এপাশে ওপাশে । গত দুবছর ধরে তারাপদ সরষের চাষ ধরেছে - লাভ ভালোই হয়েছে । পাওয়ার টিলারটা কিনেছে বছর তিনেক হয়ে গেলো । এটাতে চাষের খুব সুবিধে - পরিশ্রমও কম । তারাপদর বয়েস হচ্ছে - জোয়ান বয়সের অসুরের খাটুনি আর ওর পক্ষে সম্ভব নয় । ভাগ্যিস যন্ত্রটা কিনেছিলো । দাম পড়েছিলো হাজার চল্লিশের মতো - পঁচিশ ওর কাছে ছিলো - বাকিটা স্থানীয় মিনি ব্যাঙ্কের থেকে ধার । গাড়ির আওয়াজ বন্ধ হয়েছিলো ওর বাড়ির সামনেই । তারাপদ অবাক হয়েছিল, একটু ভয়ও পেয়েছিলো । গাড়ি চড়ে কারা এলো ওর বাড়িতে ? চাষের যন্ত্রসঙ্গী ঠেলতে ঠেলতে বাড়ির দিকে এগিয়েছিলো তারাপদ ।

    বাড়িটা অনেক লোকে গমগম করছে - সরকারী, বেসরকারী সব লোকই আছে । বড় গাড়িটার ড্রাইভার এর মধ্যেই ওর গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলেছে, আর ঘোরাতে গিয়ে রাস্তার ধারের একটা সোনাঝুরি গাছকে গুঁতো মেরে ভেঙে দিয়েছে । কাণ্ডটার মাঝের থেকে ওপরের অংশটা ভেঙে গিয়ে কাত হয়ে পড়েছে - যে কোনো সময় ওটুকু পুরো ভেঙে পড়ে যাবে । প্রায় মৃত গাছটাকে দেখে তারাপদর কষ্ট হয়, রাগও হয় ড্রাইভারটার ওপর । অল্পবয়েসী একটা জোয়ান ছেলে - গরমের জন্যে শার্ট না পরে একটা হাতকাটা গেঞ্জি পরে আছে - ও এখনও ব্যস্ত গাড়িটাকে একটু এগিয়ে একটু পেছিয়ে দাঁড় করাবার একটা সুবিধেমত জায়গা করে নেবার জন্যে ।

    অতিথিদের অভ্যর্থনা করছে অসীম । আসুন, আসুন, ঘরে এসে বসুন - ও উদয়দা, সাহেবকে বল জুতো পরেই ভেতরে আসতে - আরতি, চা নিয়ে এসো - বাইরে গাড়ির ড্রাইভারদেরও দিও ।

    অসীম আপিস থেকে চলে এসেছে । তার মানে ও জানতো সাহেবরা কখন আসবে । অসীম পঞ্চায়েত আপিসে খাতা লেখার কাজ করে - উচ্চ মাধ্যমিক পাশ দিয়েছে তো । এখানকার সরকারী আপিসগুলোর লোকজন সব ওর চেনা । বাপ চাষা হলেও অসীমের চেহারাটা একটু অন্যরকম । তারাপদর ছেলে বলে বোঝা যায় ঠিকই - কিন্তু লেখাপড়া শিখে, শহরের বাবুদের সঙ্গে মিশে ওর চোখে মুখে চালচলনে একটা সপ্রতিভ ভাব । তারাপদ তো একটু সমীহই করে তার ছেলেকে । ও আজকাল আবার সাইকেল চালিয়ে সন্ধেবেলা কাছের শহরে কম্পিউটার শিখতে যায় - পঞ্চায়েত আপিসেও নাকি শীগগিরই ওই যন্ত্র চালু হয়ে যাবে । ছেলে বাবুদের সঙ্গে এক আধটা ইংরেজি কথাও বলছে - ছেলের জন্যে গর্ব অনুভব করে তারাপদ - মরা বউএর জন্যে দরদ নতুন করে চাগাড় দেয় । ক্লাস ফাইভের পর ছেলেকে লেখাপড়া ছাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলো তারাপদ । সুমতি বলেছিলো - না । ছেলে লেখাপড়া করবে । পাশ দেবে - মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ।

    রেগে তারাপদ ধরেছিলো বউএর চুলের মুঠি । হারামজাদি - ক্ষেতে লাঙল চষবে কে ? ওর বাপ কি চিরকাল বেঁচে থাকবে ?

    সুমতি পাল্টা রাগেনি । খুব শান্তভাবে বলেছিল, চুল ছাডৌ. । ছেলেকে লেখাপড়া শিখতে না দিলে আমি গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে মরব । ও পড়াশোনা করে চাকরি করবে । আমরা তখন ক্ষেত চাষের জন্যে লোক রাখব ।

    তারাপদর হাতের মুঠো আলগা হয়ে গিয়েছিলো । বাপ্রে - যদি সত্যিই গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যে হয় । তবুও মুখে একটু ঝাঁঝ দেখিয়ে বলেছিলো - তবে কর - মাগি, তোর যা ইচ্ছে ।

    অসীমের জন্ম - সে তিরিশ বছরের ওপর হয়ে গেলো - তারাপদর অত খেয়াল নেই । দুপুরবেলা ক্ষেতে তারাপদর ভাত নিয়ে এলো সুমতি । একেবারে ভরা পোয়াতি । এসেই থপ করে বসে পড়লো মাটির ওপর । চোখে মুখে ব্যথার ছাপ । হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বরকে বলল, সময় হয়ে গেছে । হাসপাতালে নে চলো এবার ।

    এর আগে দু দুবার সুমতির পেট নষ্ট হয়ে গেছে । ভাত পড়ে রইলো মাঠে - তারাপদ পাঁজাকোলা করে বউকে ঘরে নিয়ে এলো । হাসপাতাল মানে হেলথ্‌ সেন্টার - সেখানে নিয়ে যেতে হবে । ওদের পাড়াতেই থাকে নগেন দলুই - ওর একটা ভ্যান রিকশা ছিলো - পায়ে প্যাডেল করার । ভাগ্য ভালো - ওকে বাড়িতেই পাওয়া গেলো । দুপুরবেলা ভ্যান রিকশা নিয়ে বাড়িতে খেতে এসেছিলো । ভ্যান রিকশায় সুমতিকে শুইয়ে ওকে ধরে বসলো তারাপদ - রিকশা চালালো নগেন । গ্রামের এবড়ো খেবড়ো মাটির আর খোয়ার রাস্তায় রিকশা ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোয় আর তারাপদ ভাবে বউ এর গর্ভপাত না হয়ে যায় । হেলথ্‌ সেন্টারে আবার ডাক্তারবাবু ছিলো না । সে নাকি লম্বা ছুটিতে । কি সব পরীক্ষা দেবে, তাই কলকাতায় বাড়িতে বসে পড়াশোনা করছে । ছেলে হয়েছিলো নার্সদিদির হাতে । ক'দিন পর সাইকেল রিক্সায় বউকে চাপিয়ে পাশে বসে বাড়ি ফিরেছিলো তারাপদ - বউ এর কোলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তোয়ালেতে জড়ানো কালো কুলো নাদুস নুদুস চেহারার বাচ্চা ।

    তারাপদর চমক ভাঙে অসীমের কথায় । বাবা, সাহেবরা তোমাকে কিছু বলবেন । তুমি বসো - ওরা যা বলবেন তার জবাব দাও । তারাপদর বাড়িতে একটাই চেয়ার - তার আবার একটা হাতল ভাঙা - অসীম সেটা নিয়ে এসেছে বাপের বসার জন্যে । তারাপদ বসলো । ওর হাতে পায়ে মাটি - হাত পা ধোবার সময় পায়নি - একটু কুন্ঠিতভাবে ও বসলো বাবুদের সামনে । ওর মুখোমুখি ওরই চৌকিতে বসেছে সরকারী সাহেব, সে আপিসের বড়বাবু আর উদয় শীট - এখানকার মাতব্বর লোক । বড়বাবু একটা নীল রঙের দাগ দিয়ে ছককাটা বড় কাগজ ভাঁজ খুলে মেলে ধরেছেন - একটা জায়গায় আঙুল দেখিয়ে বলছেন - এই যে, এখানে । দাগ নং আটাত্তর, পাঁচ একর জমি, তার সঙ্গে বাস্তুভিটে । নাম তারাপদ মণ্ডল, পিতা ঁদুখীরাম মণ্ডল - কমপেনসেশন হবে তিন লাখ বিয়াল্লিশ হাজার চারশো বাহাত্তর ।

    আরে রাজা হয়ে গেলি রে তারাপদ - উদয় শীট নিজের উরুতে জোরালো একটা চাপড় মেরে হাহা করে হেসে উঠলো । পাশে দাঁড়ানো অসীমেরও মুখভরা হাসি ।

    জবুথবু হুতুমথুমো হয়ে বসেছিলো তারাপদ - এর আগে ওর বাড়িতে কখনো এ জাতীয় অতিথি পা ফেলেনি । খানিকটা ফালতু কথা, কিছুটা কাজের কথা হচ্ছিলো - বেশিরভাগই অসীমের সঙ্গে । তার মধ্যে আরতি খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো । প্রত্যেকের জন্যে একটা করে বড় বাটি আর একটা প্লেট । বাটিভর্তি ঝাঁঝালো সরষের তেলে মাখা মুড়ি - সেই সঙ্গে পেঁয়াজি - আরতিই ভেজেছে । মুড়ির ওপর সুন্দর করে শুইয়ে রাখা বড়সড় একটা ঘন সবুজ রঙের বোঁটাসুদ্ধু কাঁচালঙ্কা । প্লেটে প্রকাণ্ড সাইজের দুটো করে রাজভোগ - হাতে যাতে রস না লাগে প্লেটে একটা করে চামচও দিয়ে দিয়েছে আরতি । সরকারী বাবুরা লঙ্কায় একটা কামড় দিয়েই সেটা বোঁটা ধরে সরিয়ে রাখলেন - বড্ড ঝাল । তারপর আরতি চা নিয়ে এলো । বড় সাহেবের জন্যে চিনেমাটির কাপে করে চা । বাকি সকলের জন্যে মাটির বড় খুরির ব্যবস্থা । কারণ আর সব কাপগুলো খুঁতো - হয় ফাট ধরা, নয় হাতলভাঙা । এর মধ্যেই অসীম কাজের কাজ করে যাচ্ছিলো - গোটা গোটা অক্ষরে সরকারী ফর্মের শূন্যস্থানগুলি ভরতি করছিলো । তারাপদর খাওয়া শেষ হলে স্নেহের সুরে আদেশ করলো - বাবা, হাত ধুয়ে এস । এখানে তোমাকে একটা সই দিতে হবে ।

    কেন সই দিতে হবে তারাপদ তখনও ভালো বোঝেনি । যখন বাবুরা কথা বলছিলো ও ভাবছিলো সরষে চাষের কথা - বীজ ছড়াতে হবে, গাছ হবে, হলদে ফুল হবে । সরষের দরটা কিরকম পাওয়া যাবে সেটা একটা চিন্তার কথা । সরষে চাষের জন্যে টাকা কিছুটা নিয়েছে মিনি ব্যাঙ্ক থেকে - বাকিটা নগদে গৌর রায়ের থেকে । গৌর ব্যাটা ফড়ে - পুরো ফসলটাই ও তুলে নিয়ে যাবে - লাভের গুড়ের বেশিরভাগটাই ও খাবে ।

    কিছু কিছু কথা ওর মাথায় ঢুকছিলো । এ অঞ্চলে বিরাট কারখানা হবে । হাজার হাজার লোকের চাকরি হবে, আরও অনেক লোক এ জায়গায় ব্যবসা-বাণিজ্য করবে । কিন্তু তার জন্যে জমি চাই । খালি যে তারাপদই জমি দেবে তা নয় । চার পাশের বহু চাষের জমির মালিক ফর্ম ভরে, সই করে, টিপছাপ মেরে সরকারকে দিয়ে দিয়েছে । জমির জন্যে যে টাকা তাও খুব তাড়াতাড়িই সরকার দিয়ে দিচ্ছে - প্রায় হাতে হাতেই ।

    তখন তারাপদর মনে পড়লো - ঠিক তো, ঠিক তো - বেশ কয়েক মাস আগে পাশের গাঁয়ে বড় মাঠে একটা জনসভা হয়েছিলো - লোক এসেছিলো প্রচুর । সরকারী বড় সাহেবরা সব এসেছিলেন - এম. এল. এ, মন্ত্রী, তারাও এসেছিলেন । তারাপদ অবশ্য সে সভায় যায়নি । পরে লোকের মুখে এসব কথাই শুনেছিলো - কারখানা হবে, লোকের চাকরি হবে, দেশগাঁয়ের উন্নতি হবে - তবে জমি লাগবে । কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে বাবুদের সামনে বসে, সে তার জমি দিয়ে দেবে এই ব্যাপারটাই ওর অসম্ভব আর অবাস্তব বলে মনে হোল । যেমন চাঁদ সূর্য ওঠে আর অস্ত যায়, বর্ষাকালে বৃষ্টি আর শীতকালে শীত হয় - তারাপদ ভোরবেলা ওর চাষের ক্ষেতে যাবে, সারাদিন সেখানে খাটবে, ফসল হলে তা কেটে ঘরে তুলবে - সেটাই তো স্বাভাবিক দৈনন্দিন ঘটনা । এর তো কোনো নড়চড় হওয়া সম্ভব নয় । এই শীতকালটায় সরষে ছাড়াও আরও কিছু সব্জীর চাষ করার ইচ্ছে আছে তারাপদর । টমেটো লাগালে হয় । সুন্দর লাল বড় বড় টমেটো - দামও ভালো পাওয়া যাবে - ফড়েকে না দিয়ে যদি সোজা বাজারে পৌঁছে দেওয়া যায় তাহলে লাভটা ভালো থাকে । কিন্তু তারাপদ তো বাজারে গিয়ে বসতে পারবে না - সে সময়ই বা ওর কোথায় - অসীমের কথায় ওর চমক ভাঙে । ছেলের মুখে একটু অপ্রস্তুত হাসি - বাবুদের বলছে - কাগজগুলো আমার কাছে থাক । দু এক দিনের মধ্যে বাবাকে দিয়ে সই করিয়ে আমি আপিসে পৌঁছে দেব ।

    তারাপদ ওঠে - হেঁটে হেঁটে এসে দাঁড়ায় জমির আর এক কোণে । অসীম তখন ছোট - ছয় কি সাত বছর বয়েস হবে । তারাপদ ওর ক্ষেতে আলু ফলিয়েছিলো । বীজতলাটা বানিয়েছিলো জমির এই কোণটায় । বীজতলাতে ছড়াবার জন্যে আলুর থেকে তার চোখগুলো উঠোনে বঁটি পেতে বসে কেটে কেটে ছাড়িয়েছিলো সুমতি । তা করতে গিয়ে বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা কেটে গিয়ে এক রক্তারক্তি কাণ্ড । বউটার স্বভাব ছিলো আশ্চর্যরকম ঠাণ্ডা - আঙুল থেকে রক্ত পড়ছে - তার মধ্যেও হেসে বলেছিল, ভূঁয়ে রক্ত দিলাম - দেখো ফলন ভালো হবে ।

    কাটা আঙুলে ন্যাকড়ার পটি বেঁধে তারাপদর সঙ্গে সঙ্গে বীজতলায় আলুর চোখ ছড়িয়েছিলো সুমতি । গাছের চারা যখন বেরোলো তখন বীজতলায় ছাই ছড়িয়ে সেগুলো ঢেকেছে - নইলে পাখিতে ঠুকরে শেষ করে দেবে । বীজতলা থেকে চারা তুলে এনে তারাপদ রয়েছে - তখনও সুমতি ছিলো ওর পেছনে পেছনে - হাতে হাতে চারা এগিয়ে দিয়েছে । ফলনও হয়েছিলো খুব ভালো । এক একটা গাছ তুলে মূলের সঙ্গে লেগে থাকা মাটি ঝেড়ে ফেলে আর বেরিয়ে পড়ে থোকা থোকা সুন্দর বড় বড় গোলালো দেখতে আলু । কিন্তু এই ভালো ফলনের জন্যেই মার খেয়ে গেলো তারাপদ । আলু সেবার হয়েছিলো প্রচুর - রাখার জায়গা নেই কোল্ড স্টোরেজে । ফড়েরা আলু কেনবার জন্যে জলের দর দিলো । তাতেই বেচল তারাপদ । কিন্তু তাতেও সব বিক্রি হলো না - প্রচুর পড়ে রইলো ছোট ছোট টিলার মত ঢিপি হয়ে । তারপর পচে গেলো । তারাপদ কেঁদেছিলো বাচ্চা ছেলের মতো । রাতে সান্ত্বনা দিয়েছিলো সুমতি । নিজের কাছে টেনে নিয়ে গায়ে পিঠে হাত বুলিয়েছিলো । তবে শান্ত হয়ে ঘুমিয়েছিলো তারাপদ ।

    ও মুখ তোলে, সামনে তাকায় । ওর মাঠকোঠার বাড়িটা এখন সামনে - যেন একতাল অন্ধকার ভুতুড়ে একটা ঢিবি । দোতলাটা তুলেছিলো অসীম - ওর বিয়ের ঠিক পরে । তারাপদ বাড়ির দোতলায় উঠেছে খুব কম - হয়তো হাতে গোনা কয়েকবার । ওর খাওয়া শোওয়া নাড়ির টান সবই ঐ একতলার ঘরটায় । যেদিন ওর বাড়িতে সরকারী বাবুরা এলো সেদিন অসীম সন্ধে সন্ধে ওর সঙ্গে এসে বসলো খেতে । এমনিতে তারাপদ একাই খায় - আরতি ওর খাবার সাজিয়ে রেখে চলে যায় । সেদিন দাঁড়িয়ে রইলো সামনে । খেতে খেতে অসীম নানা কথা বলছিলো - প্রথমে পঞ্চায়েত আপিসের কথা, তার থেকে চলে গেলো কারখানার কথায়, তারপর পরপর সব লোকের নাম বলতে লাগলো - কারা কারা জমি দিয়েছে, কত কত টাকা পেয়েছে আর সেই টাকা দিয়ে তারা কি কি করবে ঠিক করেছে । ভাতের গ্রাস মেখে ছেলে হাত দিয়ে মুখে তুলছিলো - তারাপদ দেখলো সেই হাত - গোলালো, মাংসল । এই হাত কলম ধরেছে, কোনোদিন চাষের লাঙল ধরবে না, মাটির বুক চিরে বার করে আনতে পারবে না তার রস, তার উর্বরশক্তি । আরতি একটা মাছের টক বানিয়েছে - সেটা দেবার জন্যে নিচু হলো । তারাপদর নজর পড়লো বউ এর মুখের ওপর - একটা চাপা রাগ অনুভব করলো । ও আরতিকে একবারে পছন্দ করে না - যদিও মুখে সেটা কখনো বলে না । ওদের মেয়ে - তারাপদর নাতনি টুবাইকে আরতি নিজের বাপ মায়ের কাছে রেখে দিয়েছে । মেয়েটা ওখানে থেকে ইস্কুলে পড়ে । আরতি আর বাচ্চা চায় না সেটা তারাপদ শুনেছে অসীমের থেকে । আরে বাবা, মেয়েদের বেশি বেশি করে না বিয়োলে চলে ? তারাপদ নিজে তো আরও ছেলেমেয়ে চেয়েছিলো - কিন্তু কপাল খারাপ । সুমতির পেট নষ্ট হয়ে যেত । তাছাড়াও তারাপদর আর একটা বড় কারণ আছে আরতিকে অপছন্দ করার । সুমতি মারা গিয়েছিলো ছেলের বিয়ের পরে পরেই । সেই থেকে এই রাগটা জমে রয়েছে তারাপদর মনে । সুমতিই আরতিকে পছন্দ করে ঘরে এনেছিলো । আরতির বাপের টাকা আছে । মহকুমা শহরে মণিহারী দোকান, মুদীর দোকান এসব আছে । চাষার ঘরে মেয়েকে দেয়ার কথা নয় ওর বাপের । কিন্তু অসীম লেখাপড়া শিখে সরকারী চাকরিতে ঢুকেছে । উপরি টুপরিও মন্দ নয় । আরতির রং ময়লা, মুখশ্রী আহামরি কিছু নয় । সামনের দুটো দাঁত অল্প হলেও উঁচু । কাজেই পাকেচক্রে আরতি এ ঘরে এলো অসীমের বউ হয়ে । ওর বাপ দেওয়া থোওয়া করেছিলো ভালো । তারাপদ সে সব ছোঁয়নি । সব আছে - অসীম, তার বউ, তাদের মেয়ের জন্যে ।

    অসীমের বিয়ের মাসখানেক পরে আরতি গিয়েছিলো বাপের বাড়ি । দুপুরবেলা তারাপদ তার ক্ষেতে আর অসীম তার আপিসে । কদিন ধরে সুমতি বলছিলো শরীরটা খারাপ লাগে - মাঠে তারাপদর খাবার দিতে যাচ্ছিলো না । ক্ষিদে জোর চাগাড় দিলে তারাপদই বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসছিলো । ওর তখন সুমতির দিকে তাকিয়ে দেখার সময় নেই । ধান চাষের কাজ জোর চলছে - নরম কাদার তালের মত মাটি - তাতে বীজতলা থেকে চারা তুলে এনে লাইনে লাইনে রোয়া হয়ে গেছে । মহাদেব হালদারের ডিজেল পাম্প ঘন্টা হিসেবে ভাড়া নিয়েছে - সেই পাম্প দিয়ে শ্যালো চালিয়ে জলে ভরিয়ে দিচ্ছে নিজের ক্ষেত । চারাগুলো তরতর করে বাড়ছে - হাওয়া দিলে তার তালে তালে মাথা দোলাচ্ছে । এমন সময় কিনা সুমতির হোল শরীর খারাপ - আর মাঠে এসে কাজ করা বন্ধ করে দিলো । যত্তসব ঝামেলা । সে দিনটায় মাঠে ভোর থেকে অসুরের মত খাটছিলো তারাপদ । ক্ষিদে তেষ্টা ভুলে । তারপর দুপুর গড়িয়ে রোদের তেজ যখন বেশ মরে এলো তখন ওর খেয়াল হোল পেটে কিছু দেয়া দরকার ।

    বিছানার ওপর হাত পা ছড়িয়ে অজ্ঞানের মত পড়ে আছে সুমতি - গায়ে জামা কাপড়ের ঠিক নেই - মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে । বড় যত্নে বউকে দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো তারাপদ । নগেনের ভ্যান রিকশা - তাতে চেপে হেলথ সেন্টার । এই ভ্যান রিকশাটা নতুন - চালায় নগেনের ছেলে বাপি । রিকশাতে চীনদেশে তৈরি একটা জল তোলার পাম্প লাগিয়ে নিয়েছে - আর পেডাল চালাতে হয় না - ভট ভট আওয়াজ করে রিকশা দৌড়য় পক্ষীরাজের মত । এবারে হেলথ সেন্টারে ডাক্তার পাওয়া গেল, কিন্তু চিকিত্সা হোল না । ডাক্তার বলল, জোরদার হার্ট অ্যাটাক । মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাও । হেলথ সেন্টারের বাইরে আনতে আনতেই সুমতি শেষ । তখন ওই ডাক্তারই মানুষ মরলে যে সব ডাক্তারের কাগজ লাগে তা লিখে দিলো ।

    খেতে খেতে অসীম নিজের মতলবটা খোলসা করে বাপকে বলছিলো - সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আরতি । সবার আগে মহকুমা শহরে একটা থাকার জায়গা ভাড়া নিতে হবে । সেটা কোনো শক্ত ব্যাপার নয় । ওর শ্বশুর তিনদিনে সেরকম একটা কিছু ঠিক করে দিতে পারবে । অবশ্যি শহর বাজারের ঘর - জায়গা ছোটো হবে । সে একটু মানিয়ে নিতে হবে আর কি । আর অসীম নিজের চাকরির সাথে সাথে একটা ব্যবসাও ফাঁদবে । কারখানার ঠিক বাইরে একটা খাওয়ার দোকান চালাবে । সুদেব রায় দুঁদে শ্রমিকনেতা । এই কারখানার প্রায় হাজারখানেক শ্রমিকের সাপ্লাই তার হাত দিয়েই হবে । তাকে ধরেছে অসীম । হাজার পঞ্চাশ তাকে দিতে হবে । ব্যস, আর কোন চিন্তা নেই । ওর ব্যবসায় আর কোনো ঝামেলা আসবে না । কারখানায় তিন শিফটে কাজ হবে - তার মানে চব্বিশ ঘন্টাই খাওয়া দাওয়া চলবে । চা, ঘুগনী, আলুর দম থেকে শুরু করে ডিম, মুরগীর কারি, রাইস । উত্তেজিতভাবে মাথা আর এঁটো হাত নেড়ে নেড়ে অসীম বাপকে বলছিল, বুঝলে বাবা, দিনে অন্তত চার-পাঁচ হাজার টাকার বিক্রী হবেই । হেসে খেলে মাসে লাভ চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকা । আমার আপিসের এক বন্ধু পার্টনার হবে । ও লাগাবে পঞ্চাশ, আমি দেব পঞ্চাশ । সুদেব ব্যাটাকে যা টাকা দেব তা দুমাসে উঠে আসবে ।

    একটু থামলো অসীম । তারপর বলল, খেয়ে উঠে সইগুলো করে দাও - কেমন ?

    কিন্তু তখন তারাপদর চোখের সামনে ভাসছে সরষে গাছের সারি আর তার হলদে ফুল । ও মাছের টকের বাটিটা দূরে ঠেলে দিয়ে উঠে পড়লো । ছেলের কথার কোন জবাব দিলো না ।

    একটু থতমত খেয়ে গেলো অসীম । বউ এর সাথে একবার চোখাচোখি হোল । তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে দুষ্টু ছেলেকে বোঝাবার ভঙ্গিতে বললো - শোন বাবা, একটু ভেবে দেখো । চাষের কাজে নানান হ্যাপা । আর রোজগারই বা কত ? তাছাড়া তোমার বয়েস হয়েছে - কদ্দিন আর পাওয়ার টিলার ঠেলা পোষাবে ? আর সবাই যখন জমি ছেড়ে দিচ্ছে আমরা তো আর জমি না দিয়ে আলাদা হয়ে থাকতে পারব না । আমি যা ধান্দা ভেবেছি তাতে অনেক বেশি রোজগার হবে - তাছাড়াও আমাদের হাতে জমি বেচার টাকা থাকবে । তাই বলছি কাগজগুলো সই করে দাও ।

    তারাপদ এবারেও কোন উত্তর দিলো না - ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ।

    শুরু হোল ছেলে আর তার বউয়ের অসহযোগ । অসীম রাগ রাগ চোখে তাকায় - আরতি ওপরের ঘরে বসে শাপশাপান্ত করে - ব্যাটা বদমাস বুড়ো । মরলেও তো পারে - বউটাতো গেছে - তার পেছনে গেলেই তো হয় ।

    তারাপদ ভেতরে ভেতরে রাগে । কিন্তু আরতিকে কিছু বলার সাহস করে না । পয়সাওলা শহুরে বেয়াই থানা পুলিশ করে দেবে । কিন্তু মনে মনে গজরায় । আরে মাগী, তোর বাপ তো বেনে - মাল কেনে আর মাল বেচে - তাতে পয়সা করে । জমি, মাটি - সে হোল মানুষের মা - তার যে নাড়ির টান সেটা তুই কি বুঝবি ? অসীমের ওপরও চটে । হতচ্ছাড়া আঁটকুড়ির ব্যাটা - মাগের ভ্যাড়া হয়েছে - বাপ পিতেমোর যে জমি তাকে আদর করতে শেখেনি । এ জমি কি আজকের ? দুখীরামের ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার বাপ মহাদেব মণ্ডল - সে পেয়েছিলো জমি । জমিদারের লেঠেল ছিলো - লাঠির চোটে মানুষের মাথা ফাটিয়ে দিয়ে পুঁতে দিত মাটিতে । মনিব খুশি ছিলো তার ওপর । তারপর পেছনে লাগলো গোরাদের আইন - ছাড়তে হোল ডাকাতি, খুন জখম । তখন মনিবের কাছ থেকে পেয়েছিলো জমি । তার থেকে আজ পর্যন্ত বেঁচে বর্তে আছে এই একর পাঁচেক - সেটাও এখন তারাপদর গুণধর ছেলে বেচে খাবে । ছেলেকে মনে মনে গাল দেয় তারাপদ - শালার ব্যাটা শালা - হারামজাদা ।

    সন্ধেবেলা তারাপদ ক্ষেত থেকে ফিরলে পরে অসীম কাছে এসে বসে । বিরক্তি চেপে রেখে বাপকে বোঝাবার চেষ্টা করে । এত বছর ধরে হাল চালিয়ে তারাপদর ঘাড় খুব শক্ত - সহজে নোয়ানো যায় না । চুপ করে থাকে - অসীম আন্দাজ করতে পারে না বাবা কি ভাবছে । শালা হারামজাদা উল্লুক - মতলব করেছে আমাকে নিয়ে তুলবে একটুকরো শান বাঁধানো খুপরীতে - সেখানে গেলে তোর বাপ দম ফেটে মরে যাবে - কাগজে তোর বাপের সই আর দরকার হবে না ।

    রাতে শুয়ে তারাপদর ঘুম আসে না । আগে এরকম হত না । সারাদিন মাঠে খেটে এসে রাতে শুলে সঙ্গে সঙ্গে ঘুম । আজকাল মাথায় চিন্তা ঘোরে । ছেলে, ছেলের বউয়ের ওপর রাগে, আবার ছেলের ওপর অভিমানও করে । ছেলেটা আর বুড়ো বাপের কথা ভাবে না - কি করে নিজে পয়সা করবে খালি সেই চিন্তা ।

    তারাপদ পাশ ফেরে । পুরোনো দড়ির খাটিয়া ক্যাঁচকোচ করে ওঠে । ঘরের এককোণে খানিকটা জমাট অন্ধকার । ওটা কি সুমতি ? হতে পারে - হতেও তো পারে । তারাপদ উঠে বসে । বিড় বিড় করে বউয়ের কাছে ফরিয়াদ করে । এ জায়গা ছাড়লে আমি মরে যাবো রে বউ । অসীম তো জানে না ওর বাপ যখন এই মাটির ওপর দিয়ে হাঁটে ওর সারা শরীর পায়ের পাতা দিয়ে মাটির রস শুষে নেয় । হাল চালিয়ে ওর বাপ যখন ঘামে এই মাটির ওপর থেকে ওঠা হাওয়া ওর বাপের ঘাম জুড়িয়ে দেয় । বউ, তুই তোর ছেলেকে বোঝা । তুই ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছিস - এই জমির থেকে ওর নাড়ি কেটে দিয়েছিস - তুইই ওকে বুঝিয়ে বল ।

    তারাপদ কোনো জবাব পায় না । ও বিছানা ছেড়ে এক পা এগিয়ে যায় - হাত বাড়িয়ে বউকে ধরার চেষ্টা করে । শুধুই অন্ধকার - সেখানে ওর হাত ঘুরে আসে - সুমতি নেই ।

    কদিন পরে নাতনিটা বাড়ি এলো । চার পাঁচ বছরের অস্থির চঞ্চল মেয়ে, দু-চোখে দুষ্টুমি মাখানো । সন্ধেবেলা ক্ষেত থেকে ফিরে হাত পায়ের মাটি ধুয়ে একটা বড় অ্যালুমিনিয়ামের গেলাসে চা খাচ্ছিলো তারাপদ । প্রচুর দুধ আর চিনির মিশেল দেওয়া কড়া চা । বাচ্চাটা দৌড়ে এসে কোলে বসে পড়লো । সুমতির মুখের সঙ্গে স্পষ্ট মিল - কপাল, মুখের ডৌল, নাক - সব একেবারে তারাপদর মরা বউ এর মত । দুষ্টু দুষ্টু হাসিটা তো একেবারে এক । নাতনির মাথায় পিঠে আদরের হাত বোলাচ্ছিলো তারাপদ । তখন বাচ্চাটা ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলতে লাগল, অ্যাই বোকাদাদু, বোকাদাদু ।

    বুকের ভেতর একটা ধাক্কা খেলো তারাপদ । রাতে সুমতি এসেছিলো । ও ও কি একই কথা বলে গেলো ?

    ময়লা, মাটিমাখা কাপড় দিয়ে চোখের কোন মুছে ফেললো তারাপদ । নাতনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো । নাতনির হাত ধরে বলল, চল্‌ দাদু ওপরে যাই ।

    ভয় দেখাবার ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করলো বাচ্চাটা । বলল, ওপরে যেও না দাদু । মা বলেছে তোমাকে বিষ খেতে দেবে ।

    তারাপদ হাসবার চেষ্টা করে । ওর মুখে কয়েকটা বাঁকাচোরা ভাঁজ পড়ে । খুব আস্তে আস্তে বুজে যাওয়া গলায় বলে - না দাদু, তোমার মা আর আমাকে বিষ দেবে না ।

    এতক্ষণে চাঁদ উঠেছে । সরু একফালি চাঁদ - তাও আবার মেঘের টুকরো এসে ঢেকে ঢেকে দিচ্ছে । আলো হয়েছে আবছা, মলিন । তারাপদ উঠে দাঁড়ালো । কেউ কি পা টেনে ধরছে ? একটা আওয়াজ এলো না পেছন থেকে ? সুমতির গলার আওয়াজ নয় ? চট করে পেছনে ঘুরলো তারাপদ । চারদিক খাঁ খাঁ খালি । আলো আবার প্রায় মুছে গেছে - একটা বড় সড় মেঘের টুকরো চাঁদকে আড়াল করে ফেলেছে । একটা জোরালো হাওয়া উঠেছে । তারাপদর মাঠকোঠার পাশের বেলগাছের পাতায় পাতায় সোঁ সোঁ শব্দ । একটা রাতজাগা পাখির ডানার ঝাপটায় হাওয়াতে হায় হায় শব্দ । কিন্তু আসলে আওয়াজ আসছে পায়ের নিচে মাটির থেকে - তারাপদ সেটা বুঝতে পারে - এই মাটি ওর সঙ্গে কথা বলছে - অনেক কথা - অনেক অনেক জমে থাকা কথা । তারাপদ বসে পড়ে ঐ মাটির ওপর - এখন কথাগুলো পরিষ্কার হয়ে ওর কানে আসছে । তারাপদ তা মন দিয়ে শোনে - শুনতে থাকে ।

    (ডিসেম্বর, ২০০৯; পরবাস-৪৪)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments