• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৪ | ডিসেম্বর ২০০৯ | রম্যরচনা
    Share
  • বাত বিষয়ক বাতুলতা : মিহির সেনগুপ্ত


    ॥ এক ॥


    সম্প্রতি বেশ কয়েকমাস ধরিয়া ভুগিতেছি । এখন বয়সটা ভুগিবারই বয়স । যাঁহারা অদৃষ্ট বা নিয়তিবাদি, তাঁহারা বলিয়া থাকেন, ভোগা কপালে থাকিলে ভুগিতেই হইবে । ভোগার কোনো বয়স নাই । আমরা বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, কপাল, অদৃষ্ট ইত্যাদি জানিনা, `শরীরম্‌ ব্যাধি মন্দিরম্‌' ইত্যাদি জানিনা । বিজ্ঞান দ্রুত আগাইয়া চলিতেছে, বিশেষত চিকিত্সা বিজ্ঞানের তো কথাই নাই, সেখানে প্রতিক্ষণে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব বিপ্লব ঘটিতেছে, নতুন নতুন সব যুগান্তকারী আবিষ্কার, শল্য চিকিত্সার সূক্ষ্ম, স্থূল, দৈহিক, আসুরিক সব পদ্ধতির, মডার্ন টেক্নোলজির বোলবোলাও হইতেছে । এবং অবশ্যই মানুষ দীর্ঘায়ু হইতেছে । কিন্তু দীর্ঘায়ু হওয়া এক বস্তু আর ব্যাধিমুক্তি অন্য বস্তু । বরং বলিতে পারি, দীর্ঘায়ু হইয়া মানুষের ভোগান্তি বাড়িতেছে বই কমিতেছে না । নিত্য নতুন নতুন রোগের উদ্ভব হইতেছে । তাহাদের নামকরণ করিতে গিয়া ডাক্তার-বদ্যিদের ল্যাটিন অভিধান মুখস্থ করিতে প্রাণান্ত হইতেছে । কিন্তু আমরা রোগীসাধারণেরা সর্বস্বান্ত হইতেছি । তবে সব দিক দেখিলে চলেনা । সংসারের এটাই নিয়ম । ইঁদুরের পিছনে বেড়াল, বেড়ালের পিছনে কুকুর, কুকুরের পিছনে বাঘ এবং পুরুষের পিছনে নারী সদা ধাবমান । সেই রকমই মানুষের পিছনে রোগ এবং রোগের (বা রোগীর) পিছনে ক্লিনিক, নার্সিংহোম ডাক্তার হাসপাতাল এবং গোটা বাঙালি সমাজ তাঁহাদের যাবতীয় জ্ঞানগম্যি উপদেশাদি লইয়া উদ্যত-বাক্‌ হইয়া আছেন । কিন্তু রোগ যেন নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ ও মুক্ত আত্মার ন্যায় অধরাই থাকিয়া যাইতেছে । কিন্তু আমার এই ছাত্র পাঠেরও অযোগ্য রচনাটি রোগাদি বিষয়ক সামুহিক ক্ষেত্রের তত্ত্ব আলোচনায় যে যাইবে না এরকম একটা অভয় আমি প্রথমেই পাঠকদের দিয়া রাখিতেছি । আমার আলোচনা বর্তমানে যে রোগে আমি পর্যুদস্ত সেই বাত-ব্যাধি বিষয়ক । ইহা একটি ঘ্যানর ঘ্যানর জাতীয় রচনা, একই কথার পুনরাবৃত্তি ।

    আমাদের শৈশব কৈশোরে বৃদ্ধ যাঁহারা তাঁহারা রোগটিকে `বাত' বা বাতোব্যাধি বলিতেন । পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স হইলেই তাঁহারা গাওনা ধরিতেন, ইদানীং বয়স হইয়াছে, দেহে রসাধিক্য ঘটিয়াছে, ত্রক্রমশ বাতে পঙ্গু হইয়া পড়িতেছি । এই বেলা সাবধান না হইলে অচিরে অথর্ব হইয়া পড়িতে হইবে - ইত্যাদি । রোগটি প্রাচীন কালেও যেমন আজিও তেমনি মানুষকে বড়োই উদ্ব্যস্ত করে । আচার্য উদ্ধবকে অর্থশাস্ত্রে `মহাত্মা বাতব্যাধি' বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে, অস্যার্থ তিনি সুপণ্ডিত আচার্য হইয়াও বাতকে আমল না দিয়া পারেন নাই । বলা যাইতে পারে `বাত' জ্ঞানের দ্বারা প্রশমিত হইবার নহে ।

    অপ্রসঙ্গত, স্বভাবদোষে একটি ভিন্ন সংবাদ বলিয়া লই । বিভিন্ন রোগের রোগীকে রোগের নামে বিশেষিত করার একটি সাংস্কৃতিক ধারা প্রাচীন আর্য সমাজে যে ব্যাপক ছিল অর্থশাস্ত্রে তাহার যথেষ্ট উদাহরণ আছে । উপমহাদেশীয় ব্যাপক সংস্কৃতিতে এই ধারাটি এখন আর যথেষ্ট দৃষ্ট হয়না । বাঙালি আর্য কী না তাহা লইয়া অদ্যাপিও লগুড় মুগুড় এবং শব্দ-সায়ক ব্যবহার ব্যাপক বিদ্যমান । তথ্যচাতকদের নিমিত্ত জানাইয়া রাখি যে এই ক্ষেত্রে বরিশালি বাঙালেরা আর্যকৌলীন্য দাবি করিতে পারে । কারণ প্রাগুক্ত ধারাটি সেখানে আজিও সতেজে বিরাজমান । তবে তাহার ব্যবহার প্রকরণটি `খামার' বা গালিগালাজধর্মী । যেমন, ঝোলা, শীত্লা, কলেরা, কুরুকুষ্ঠি, বাতোবেয়াদিয়া, অতিসারইয়া ইত্যাদি । পাঠক, কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নাই । তথাপি, বারংবার এইসব শব্দের অর্থকরণ, উচ্চারণপদ্ধতি, আমি আপনাদিগকে শিখাইতে পারিব না । `ভাটিপুত্রর পত্র বাখোয়াজি' নামক গ্রন্থে এই সবের হদ্দমুদ্দ করা হইয়াছে । খুঁজিয়া পড়ুন । কিন্তু এই অপ্রসঙ্গতা এই পর্যন্তই । আমি এবার `বাতে' প্রত্যাবৃত্ত হইব ।

    বাতের ব্যাপারের চিকিত্সায় সেকালের, অর্থাৎ আমাদের শৈশবকালের চিকিত্সকদের নানান বিচিত্র রকম দেখিয়াছি । আজিও উত্তর এবং দক্ষিণ ভারত জুড়িয়া আয়ুর্বেদীয় চিকিত্সার নামে ইহার ঢালাও প্রচলন রহিয়াছে । সম্প্রতি দক্ষিণে আদিবাসী আয়ুর্বেদীয় একটি চিকিত্সা বিশেষ প্রসিদ্ধি পাইয়াছে । গোটা গ্রন্থেই বিশ্বাসী মানুষের অভাব নাই । সে যাউক, আমি বরিশালি একটি তৈলের সংবাদ দিতেছি । বরিশালের গুঠিয়া নামক গ্রামে এক চিকিত্সক পরিবার একটি তৈলের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জণ করিয়াছিল । সেই তৈল ব্যবহারে সায়েটিকা বাতের নাকি আরাম হইত । তাহা কিসের তৈল তাহা উক্ত পরিবারটির একজন বিশেষ উত্তরাধিকারি ছাড়া কেহ জানিত না, এইসব ব্যাপারে মন্ত্রগুপ্তি ঔষধের গুণ অথবা ব্যবসায়িক স্বার্থ নিয়ামক, কোন্‌ বিষয়ে প্রযোজ্য, তাহা বলিতে পারিনা, তবে বলা হইত এই গোপনীয়তা পাঁচকান হইলে ঔষধের গুণ নষ্ট হইয়া যাইবে । কিন্তু ইহাতেও রোগ নিরাময় হয় এরূপ লোক-বিশ্বাস । আমার পিতাঠাকুর এই রোগগ্রস্ত হইয়া দীর্ঘকাল নানান টোট্কা, মুষ্টিযোগ ইত্যাদিতে কিছুমাত্র আরোগ্য না হইয়া ঐ তৈল মালিশে ব্যথামুক্ত হইয়াছিলেন । ভাগ্যে তখনও বাজারে অস্থি-বিশেষজ্ঞ বা কোনোপ্রকার বিশেষজ্ঞের ঢালাও মাত্স্যন্যায় শুরু হয় নাই । আমরা পল্লীগ্রামের লোক, ডাক্তার বলিতে হাতুড়ে বা এল. এম. এফ এবং বড়ো ডাক্তার বলিতে গঞ্জ শহরের মোটাসোটা, টাকপড়া, ভূঁড়িওলা, কোট প্যান্ট পরা এম. বি ডাক্তারই বুঝিতাম । রোগের রকম অনুযায়ী আলাদা আলাদা, অর্থাৎ পেটের জন্য অমুক, বুকের জন্য অমুক, হাড়ের জন্য অমুক ইত্যাদি ইত্যাদি নানান অঙ্গের নানান বিশেষজ্ঞের বিষয় জানিতাম না । গোটাগঞ্জে একজন বা দুইজন এল. এম. এফ থাকিলে, তাঁহারাই বড়ো ডাক্তার বলিয়া খ্যাত হইতেন । ভিজিট দুই টাকা হইতে পাঁচটাকা । এম. বি হইলে দশটাকা ।

    সে যাহা হউক, ডাক্তার আক্রা হইলেও পল্লীগ্রামে কবিরাজ, হেকিম, রোজা, ফকিরের কিম্বা দ্রব্যগুণ বিশেষজ্ঞদের অপ্রতুলতা ছিল না । সর্বোপরি, যে কথার আগেই আভাস দিয়াছি, যুগানুযায়ী এবং স্থানানুযায়ী চিকিত্সা প্রজ্ঞায় বাঙালি বরাবরই প্রাজ্ঞ, বাঙালরা একটু বেশির দিকেই । দ্রব্যগুণ বিশেষজ্ঞরা তো বাঙালদেশ হইতে চিন, এমনকি সপ্তমহাদেশের আনাচ-কানাচের সর্বত্রই প্রবল প্রতাপে রোগী আতুরদের সেবা করিয়া যাইতেছেন । বিজ্ঞানে অন্ধবিশ্বাসীরা এবিষয়ে অবিশ্বাসী হইলে, ঔষধের দোকানে কামশক্তিবর্ধক বটিকা, বাতের তৈল ইত্যাদির সওদা সমীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন । নগরকেন্দ্রের বনেদি দোকানে বিজ্ঞানের পিতৃভূমিগুলি হইতে আগত পর্যটকদের ভিড় সেখানে আদৌ উপেক্ষনীয় নয় । দেশীয়গণের তুলনায় বরং সংখ্যাগুরু ।

    আবার ভিন্ন কথায় যাইয়া পড়িতেছি । আলোচনা চলিতেছিল বাত-বিষয়ক । বিশেষ, আমার নিজস্ব ভোগান্তি লইয়া, তাহাতে এতো কথার দরকার কী ? কিন্তু স্বভাব যাইবে কই ? একে বাঙাল, তদুপরি বাতের রোগী । বকবকানি চলিবেই ।

    গুঠিয়ার তৈল । গুঠিয়ার তৈল ব্যাতিরেকেও কবিরাজ, হেকিমরা নানান নামের তৈল মালিশের ব্যবস্থা সেকালে দিতেন । তাহাতে রোগ কতোটা আরাম হইত বলিতে পারিনা । তবে গুঠিয়ার তৈলে পিতাঠাকুর আরোগ্য হইয়াছিলেন এরকম একটা বিশ্বাস শিশুকাল হইতে আমার এবং তাঁহার ছিল । তবে তাঁহার রোগটি তৈলে আরাম হইয়াছিল নাকি অন্য মুষ্টিযোগে, কিম্বা সংসারের অন্যান্য অগণিত রোগের মতো অজ্ঞাত প্রাকৃতিক কারণে, তাহা বলিতে পারিব না । ব্যাপারটির মধ্যে একটা হোমিওপ্যাথিক প্যারাডক্যিকাল(??) রহস্যের কথাও আমার পরে মনে হইয়াছে । সেক্ষেত্রে একটা সিউডো ন্যায়াশ্রয়ী বিতর্ক অনেকটা এই রকম, -

    হোমিও প্যাথি ঔষধে রোগ সারে না ।
    যদি সারে, তবে কেন সারিল ?
    প্রশ্নটি উক্ত শাস্ত্রবিষয়ে হয়তো খানিক অশালীন, কিন্তু তাহার জন্য কু-তার্কিকেরা দায়ী । তবে প্রশ্নটি স্বাস্থ্য বিষয়ে ভীষণ শঙ্কা উদ্রেককারি । মহাত্মা হ্যানেমানের জন্য `হেবেন' অক্ষয় হউক, আমি উক্ত প্যাথীয় ঔষধে রোগ মুক্ত হই নাই, হইতে চাহিও না । তাহাতে নিরাপদও বোধ করিনা ।

    সেতো গেলো সেকালের কথা । কপালগুণে সেকালে জন্মগ্রহণ করিলেও সেই কপালদোষেই একালেও বাঁচিয়া আছি এবং কালবৈগুণ্যে বাতের প্রকোপেও পড়িয়াছি । সুতরাং এই বিষয়ে একালের কথাটিই সবিস্তারে বলিব বলিয়া এতসব আড়ম্বর করিলাম । মোদ্দা কথাটি বলিয়া ফেলিলে কথার `দক্‌' থাকিবে না বলিয়া ইনাইয়া বিনাইয়া বকিতেছি । নচেৎ এত আড়ম্বর করিবার মতো তো কিছু হয় নাই । যতোই লম্বা চওড়া ইংরাজি বা লাতিন নাম দিইনা কেন, শেষতক্‌ অস্যার্থ `বাতোব্বেয়াদি', অর্থাৎ বাত বইতো নয় । কতকগুলি রোগ আছে, সেসব প্রভূত ক্লেশদায়ক হইলেও, লোকে পাত্তা দিতে চাহেনা । যেমন, কী হইয়াছে, প্রশ্ন করিয়া কেহ যদি শোনেন যে সর্দিকাশি, গা-ম্যাজ্‌ ম্যাজ্‌, পেটের অসুখ, বাত পেটে বায়ু বা অনুরূপ কিছু হইয়াছে, তিনি বা তাঁহারা কিছু মাত্র যে গুরুত্ব দিবেন না, এ বিষয়ে নিশ্চয়ই আপনারা সহমত হইবেন । কিন্তু মনে করুন আপনাদের কেউ বাতের বা দাঁতের ব্যথায় কঁকাঁইতেছেন, কেহ কঁকাঁনির কারণ জ্ঞাত হইয়া, শুধু নাসিকাটি একটু কুঞ্চিত করিয়া ভাব প্রকাশ করিবেন, অঅঅ, তাই বল, আমি ভাবলাম কি না কী ! - যেন বাত না হইয়া ধনুষ্টঙ্কার হইলে তিনি বেশি আহ্লাদ বোধ করিতেন । যেন বাত একটা নিম্নবর্গীয় অসুখ, উচ্চবর্গীয় ভদ্দরলোকের হইলে একেবারে একটা ছ্যা ছ্যা ব্যাপার । সেকালের বড়োবড়ো জমিদার, উকিল ব্যারিষ্টার, থানার বড়ো দারোগা, তাঁহাদেরই যে এই ব্যারাম হইত, তাহা ইঁহারা জানেন না । ইঁহাদের বিশ্বাস পুরাতন বনেদি পরিবারের মোটাসোটা বিধবা পিসিমা, নিরাশ্রয়া কুমিদিনী দিদিমা বা সংসারের আশ্রিত নিস্কম্মার ঢেঁকিদেরই শুধুমাত্র এইসব রোগ হয় । আসলে রোগটি ঠিক শ্রেণিগত মর্যাদা পায় নাই ।

    বহুদিন হইতেই হাঁটু, কোমর, স্কন্ধ-দেশ ইত্যাদির সন্ধিস্থলগুলা শনৈ: শনৈ: জানান দিতেছিল, "হাড্ডি পিল্‌ পিলায় গয়া" । সুতরাং সাবধান হইবার যে সময় আসিয়াছে সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়াছিলাম, কিন্তু সাবধান হওয়া হইয়া ওঠে নাই । সাবধান হইয়াও কোনো প্রকার ব্যামোকে কেহ কোনোদিন প্রতিহত করিতে পারিয়াছে এমন খবর আমার জানা নাই । বিশেষ করিয়া এই রোগটির ক্ষেত্রে তো নয়ই । প্রসঙ্গত একটি সত্যাধিক ঘটনা বলি । মানুষ আজকাল বানানো গল্প শুনিতে চাহেনা ।

    আমাদের গ্রামের ডাক্তার-মশাই `জীবন মশাই' এর অবতার ছিলেন । চিকিত্সাশাস্ত্রে তাঁহার অধিগম্যতার খ্যাতি দশগ্রামে কিংবদন্তি তুল্য ছিল, যদিও কবিরাজি বা ডাক্তারি কোনোটাতেই তিনি পাশ করা চিকিত্সক ছিলেন না । তাঁহার স্বকপোলকল্পিত কিছু চিকিত্সা পদ্ধতি সেকালে বিশেষ খ্যাতি পাইয়াছিল । সেসকল যেমন দু:সাহসিক, তেমনই অভিনব । বাতের রোগীদের (যতদূর স্মরণ আছে বাতের রোগীদেরই) একটি অভূতপূর্ব চিকিত্সা তাঁহাকে করিতে দেখিয়াছি ।

    চিকিত্সাটি তিনি সাধারণত চাষি, মুনিষদের উপরেই প্রয়োগ করিতেন । শিক্ষিত, ভদ্র তথা উচ্চজাতীয় (?) রোগী এক্ষেত্রে একটিও দেখি নাই । চিকিত্সাটি সংক্ষিপ্ত । তাহার `রকমটি' পরে বলিতেছি । ইহাতে নাকী `বাত' নামক ব্যাধিটি একেবারে চিরতরে আরাম হইয়া যাইত । চিকিত্সক এবং রোগী উভয়েরই এবিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ থাকিত না । কিন্তু নগেন মশায়ের পুত্র স্বয়ং এই রোগের রোগী ছিলেন । কী কারণবশত তিনি এই চিকিত্সা বিধিটি পুত্রের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন নাই এবং পুত্র সারাজীবন পঙ্গু-প্রায় কাটাইয়াছেন, তাহার তাত্পর্য জানিতে পারি নাই । তবে `মশায়' মাঝে মাঝেই আফশোস করিতেন, ওতো বাতে পঙ্গু । যাহা হউক, তাহাতে চিকিত্সার সুনামে কিছু বিঘ্ন ঘটে নাই ।

    লোকপ্রসিদ্ধি এই যে নগেন ডাক্তার মশাই আসলেই ধন্বন্তরি । এবার চিকিত্সা পদ্ধতিটি বলি । একটি আধসেরি মাপের কাঁচের গেলাসের মধ্যে একটা জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি ফেলিয়া অতি দ্রুত গ্লাসটিকে রোগীর কাঁধের নীচে, অর্থাৎ পিঠের যে স্থানে ডানার শেষ প্রান্ত সেখানে চাপিয়া ধরিতেন । গ্লাসটি সেখানে আটকাইয়া থাকিত এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই স্থানটিতে একটি অর্ধগোলাকার মাংসপিণ্ডের সৃষ্টি হইতো । শরীরের সব বাত-রস নাকী এভাবেই ঐ স্থানটিতে পুঞ্জীভূত হইয়া বাকি শরীরকে এই অভদ্র ক্লেশদায়ক রস মুক্ত করিত । মনে আছে ব্যাপারটিকে আমরা নগেনজেঠার `দম্বল' বলিয়া আখ্যায়িত করিতাম । গ্লাসটি একসময় খসিয়া পড়িয়া যাইত, কিন্তু দম্বলটি থাকিত । রোগ সারিত কীনা, তাহা নিজেরা পরে আর খোঁজ খবর করি নাই । তিনি, গ্লাসটির পতন হইলেই রোগীকে বলিতেন, `যাও, তোমার রোগ সারাইয়া গেছে' । সেও উঠিয়া তাহার অবস্থা এবং স্বভাব অনুযায়ী কিছু পয়সা ডাক্তারের চিকিত্সার হিসাবে দিয়া বাড়ি যাইত ।

    অধুনা বাত বলিয়া কোনো রোগব্যাধির নাকী নামই নাই । ইহার কারণ অনুসন্ধান করিয়া বুঝিয়াছি যে আসলে দেশে কবিরাজ, হেকিম, বৈদ্য ইত্যাদির বংশ লোপ পাইয়াছে । লোপ পাইয়াছে ইহা বলা ঠিক হইল না । বস্তুত তাঁহাদের বংশপুরুষেরা প্রায় সকলেই পাশকরা ডাক্তার হইয়াছেন । ডাক্তারেরা বাত বলিয়া কোনো রোগকে দ্বীকার করিতে চাহেন না । তথাপি যতকাল তাঁহারা শুধুমাত্র এম. বি অথবা এম. বি. বি. এস ডাক্তার হিসাবে বড়ো ডাক্তার বলিয়া গণ্য হইতেন এবং মানুষের সর্ববিধ রোগের চিকিত্সা করিতেন, ততকাল তাঁহারা বাতকে বাতই বলিতেন । কাল হইয়াছে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণের আবির্ভাব হইয়া । কেহই আর গোটা মনুষ্যশরীর লইয়া নাড়া ঘাটা করিতে চাহেন না । কেহ পেটের পীড়ার বিশেষজ্ঞ, কেহ চামড়ার, কেহবা পিঠের, কেহবা বুকের ডান দিকের, কেহ বাঁ দিকের । যিনি অস্থি বিশেষজ্ঞ তিনি স্নায়ু লইয়া মাথা ঘামাইবেন না, সোজাসাপটা কোনো মতামতও দিবেন না, আবার যিনি স্নায়ুর বিশেষজ্ঞ, তিনি স্নায়ুর শল্য চিকিত্সার প্রয়োজন হইলে সংশ্লিষ্ট রোগীকে ঠেলিয়া গুঁতাইয়া স্নায়ুর শল্যবিদের নিকট পাঠাইয়া দিবেন । এইরূপ মনুষ্য অঙ্গের বিভিন্ন অংশের চিকিত্সার বন্দোবস্তো দাঁড়াইয়াছে । সে অনেক সব জ্ঞানের উন্নতির কথা, বলিয়া শেষ করা যাইবে না । আমরা শুধু বাত বিষয়ক বৃত্তান্ত বলিতে ছিলাম । মোটকথা তাঁহারা মনুষ্য শরীরটাকে ভাগাভাগি করিয়া লইয়াছেন ।

    আমার এক অস্থি বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক বন্ধুকে একদিন কথাচ্ছলে আলটপ্কা বলিয়া ফেলিয়াছিলাম যে সম্প্রতি বাতের বেদনার জন্য বড়ো কাতর আছি । তিনি জানাইলেন যে বাত বলিয়া ডাক্তারিশাস্ত্রে কোনো ব্যাধি নাই । এবং এ বিষয়ে ভূরি ভূরি যুক্তি ও জ্ঞানের তত্ত্ব তিনি আমার সামনে উপস্থিত করিয়া কহিলেন, তোমার বেদনা যদি স্কন্ধে বা কোমরে হইয়া থাকে, ডাক্তারি শাস্ত্রে তাহাকে স্পণ্ডিলোসিস বলা হইয়া থাকে । তাহার নানান রকমফের আছে । হাঁটুতে হইয়া থাকিলে উহাকে অস্টিও আর্থারাইটিসও (??) বলা হয় এবং তাহারও নানান রকমফের আছে । এইমত নানান নামের কথা তিনি বলিলেন, কিন্তু তাঁহার কোনো চিকিত্সায়ই আমার বেদনার উপশম হইল না । আমি অল্প শিক্ষিত, কারণ ইংরাজি প্রায় বুঝিই না । ডাক্তার বন্ধুর দৌলতে দুইটা ইংরাজি রোগের নাম শুনিয়া মনে রাখিবার জন্য নিজেই তাহার বাংলা করিয়া লইলাম । স্কন্ধে বেদনা হইলে তাহাকে স্কন্ধলাইটিস এবং কোমরের ব্যথাকে পোন্দোলাইটিস বলিয়া কাজ চালাইতে লাগিলাম । কোমর এবং ঐ অসভ্য স্থানটির কাছাকাছি অবস্থানের কারণেই ঐরূপ নামকরণ করিয়াছি, স্পর্শকাতর পাঠক, বিশেষত পাঠিকারা মার্জনা করবেন । অবশ্য শব্দ দুইটিই নিজস্ব ব্যক্তিগত গদ্যের শব্দ । আমজনতা ইহা ব্যবহারের আধিকারিক নহে ।

    সুতরাং বাত বলিয়া কিছু নাই । কারণ সাহেব চিকিত্সকেরা এই রোগটির নামায়নে বাত শব্দটি ব্যবহার করেন নাই । তবে যেহেতু এই জাতীয় বেদনাটি বহুকাল ধরিয়া কমবেশি আমাকে সঙ্গদান ও জ্বালাতন করিয়া আসিতেছে, সেকারণে প্রায় গণ্ডাতিনেক কী ততোধিক ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞের সকাশে আসার ও চিকিত্সীত হইবার দুর্ভাগ্য হইয়াছে এবং তাঁহাদের কেহ কেহ বাত শব্দটিও ব্যবহার করিয়াছেন । সম্ভবত তাঁহাদের পিতৃ পিতামহের মধ্যে যাঁহারা হেকিম, বৈদ্য, কবিরাজ ইত্যাদি ছিলেন, তাঁহাদের প্রভাববশত ঐরূপ হইয়া থাকিবে । সে যাহাই হউক, ডাক্তার এবং বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘকালের চিকিত্সায় আমার রোগ সারে নাই, ইহা খাস কথা । বেদনা কখনো সামান্য ইতর বিশেষ হইয়াছে মাত্র । এক সময়ে আর পাঁচজন ব্যথাকাতর মনুষ্যের মতন ইহাকে কপালের `লেখা পড়া' ধরিয়া লইয়া কাল কাটাইতে ছিলাম এবং একসময়, ব্যাপারটা `এরকমই হয়' এরকম মনে করিয়া ডাক্তার বিশেষজ্ঞদের সংশ্রব ত্যাগ করিতে মনস্থ করিলাম । কিন্তু তাঁহারা আমাকে ছাড়িলেন না ।

    কারণ, এই ব্যবস্থায় তাহাদের কিছু সাময়িক ক্ষতি হইলেও আমার খুব কম উপকার হইল না । দীর্ঘদিন কোমর বা কাঁধ লইয়া আর প্যান্প্যানানি করিলাম না, উপরন্তু পকেটটিও যত্পরোনাস্তি সুস্থ রহিল । তখন বয়স কম ছিল । বুঝি নাই যে ডাক্তার ও বিশেষজ্ঞরা এবং আমার এই `ব্যামো' ভবিষ্যৎ সুযোগের অপেক্ষায় ওৎ পাতিয়া বসিয়া আছেন ।

    পকেটের কথা, বিশেষ করিয়া ডাক্তারের বা বিশেষজ্ঞের অনুষঙ্গে পকেটের কথা উঠিল বলিয়া বিষয়ান্তরে প্রস্থান করা আবশ্যক হইল । এক্ষণে এই মর্মে অধমকে কিছু বলিতে হইবে । বিষয় ছিল বাত ও চিকিত্সক । এখন পকেটও তাহার অন্তর্ভূক্ত হইল । পাঠক হয়তো বিরক্ত হইতে পারেন । কিন্তু লেখক অধুনা বয়সে কিছু প্রাচীন, তদুপরি জাত হিসাবে দুর্জেয় বাঙাল, অর্থাৎ বরিশালি বাঙাল । সুতরাং অতিকথনগুণ বা দোষ, যাহাই বলুন অতিমাত্রায় বর্তমান । অতএব বিস্তারিত হইব ইহাতে আশ্চর্য কী ? বিশেষত পকেট বিষয়ে যখন কথা, তখন পকেট খালি করনেওয়ালারা ঈষৎ দু:খিত হইলেও, চিরদু:খী (তথা সদা ত্রক্রুদ্ধ) রোগজর্জর হতভাগ্যেরা তাহার রসাভাসি কথকতার পাঁচ কাহন শুনাইতে ছাড়িবে কেন ? সুতরাং একটু `লাছিয়া পাতিয়াই' অর্থাৎ ছড়াইয়া ছিটাইয়া প্যাচালটা পাড়ি ।

    সকলেই জানেন, যৌবনের শুরু হইতে (মত্সম মনুষ্যের অবশ্য বাল্যকাল হইতেই) পকেটের ধান্দা করা আমাদিগের প্রধান কর্তব্য । অস্যার্থ অর্থোপার্জন । যৌবনকালে অনেকেই বুঝিতে পারেন না কেন আমরা বিবিধ ক্লেশ ভোগ করিয়া এই অর্থ উপার্জনে তত্পর হই । সবাই ভাবেন, নহিলে খাইব কী ? কেহ চাকুরি করিয়া, কেহ ব্যবসা করিয়া, কেহ রাজনীতি করিয়া, কেহ টাউটগিরি বা জমি-বাড়ির দালালি করিয়া, এমন কি চুরি, ডাকাতি, বুদ্ধিজীবিগিরি ইত্যাদি করিয়াও আমরা অর্থোপার্জনে শরীর ক্ষয় করি । অবশ্যই গ্রাসাচ্ছদন এইসব কর্মের একটি প্রধান উদ্দেশ্য । কিন্তু সংসারের চাহিদা মিটাইয়া কায়ক্লেশে আমরা কিঞ্চিৎ কম বেশি সাধ্যানুসারে সঞ্চয়ও করিয়া থাকি । ইহার পশ্চাতে নানাবিধ সুখ কল্পনা থাকে । কী ? না, বুড়া হইলে যখন কর্মক্ষমতা লোপ পাইতে থাকিবে, তখন বসিয়া খাইব । প্রাচীন সমাজ বন্ধন আজিকালি আর নাই, সুতরাং পুত্র কন্যারা কর্মক্ষম হইলেও খাওয়াইবে, এমন প্রত্যাশা বলদের নিকট দুগ্ধ প্রত্যাশাবৎ । তাই নিজের গোয়ালে নিজেই ধোঁয়া দিব, কাহারও মুখাপেক্ষী হইয়া প্রত্যাশায় থাকিব না, এইরূপ একটি হিসাব মাথায় রাখিয়া আমরা সঞ্চয়ে যত্নশীল হই এবং যথাবয়সে যথোচিৎ ভোগাদি বর্জন করিয়া সেই সঞ্চয় যতটা সম্ভব স্ফীত করিতে চেষ্টা করি । আর এই সময় হইতেই `বাত' ইত্যাদি ব্যাধিরা এবং তাহাদের আপাত প্রতিকারী ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞরা উপযুক্ত সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করিতে থাকেন, কতদিনে আমাদের রক্ত ঠাণ্ডা হয় এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গাদি সহজ-কাতর হইয়া ব্যাধি প্রতিরোধহীন হইয়া পড়ে । সুতরাং এতক্ষণের প্যাচালের তরল গলিতার্থ এই যে আমরা ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ এবং তাঁহাদের নিত্য সহচর শকুনি - গৃধিনীতুল্য ঔষধাদি ব্যবসায়ীদের জন্যই শ্রমলব্ধ অর্থের সঞ্চয় করিয়া থাকি ।

    আমরা জাতির পিতা, মহাত্মা গাঁধির চেতাবনি কান দিয়া শুনিয়াছি বটে, হৃদয়ে গ্রহণ করি নাই । তিনি বলিয়াছিলেন, ডাক্তার ও উকিলের নিকট পারত পক্ষে না যাইতে । তিনি ছাগী দুগ্ধ পান করিয়া `পারত পক্ষটা' স্বপক্ষে পাইয়াছিলেন । আমাদের আমলে ছাগছাগীর অভাব আছে এমন কথা কেহই বোধহয় বলিবেন না, তবে দুগ্ধের অভাব প্রত্যক্ষ সত্য । এ আমলের ছাগীরা মহাত্মার আমলের ছাগীদের মত দুগ্ধ দেয়না । সুতরাং ঐ `পারত পক্ষটা' আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়না । একারণেই জাতির পিতার আদেশ পালন না করিতে আমরা বাধ্য হইয়াছি । অবস্থাটিও তাই ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, ঔষধ ব্যবসায়ী নামক শকুনি গৃধিনীদের সহায়ক হইয়াছে । যাহাই হউক আপনারা নিশ্চয়ই আমার অনুসিদ্ধান্তে সহমত যে আমাদের কষ্টার্জিত সঞ্চয় শুধুমাত্র ডাক্তার নামক শকুনি গৃধিনী তথা মদ্কুনিদের ভোগের জন্য । `মদ্কুনি' বলিতে ফিজিও থেরাপিস্ট নামক `ছারপোকা'দেরই ইঙ্গিত করিলাম ।


    ॥ দুই ॥


    কতকাল হইল হিসাব নাই, তবে বহুকাল হইল `মাজার দরদ' বা কোমরের ব্যথায় কষ্ট পাইতেছিলাম, তত্সহ `আড়ু কড্কডি' বা হাঁটুর বেদনা । ত্রক্রমশ হাঁটুর ব্যাপারটি আমার স্ত্রী আমার প্রতি প্রগাঢ় প্রণয়বশত `আপনাইয়া' লইয়াছেন । সুতরাং সেটিকে `পরোক্ষ' বলিতে দোষ নাই । আমার জন্য মাজার দরদই যথেষ্ট ।

    আমি শুধু বাঙালি নই ঘোর বাঙাল । সুতরাং পাঠককুল ধরিয়া লইতে পারেন যে মাজার দরদ আমাদের পর্যুদস্ত করিবে এমন সম্ভাবনা নাই । তাই শিশুকাল হইতে বাল্য, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ় এবং এই বার্ধক্যকালে পর্যন্ত মাজার দরদকে আদৌ মনুষ্য বলিয়া গণ্য করি নাই । বস্তুত, দরদ বা ব্যথা মনুষ্যের হয়, উহা স্বয়ং মনুষ্য নহে, এরকমই একটি বিশ্বাস ছিল এতকাল । কিন্তু সম্প্রতি সেই বিশ্বাস টাল খাইয়াছে । মনে হইতেছে উহা আসলে মনুষ্যই বটে । নচেৎ তাহার চরিত্র ইদৃশ `ত্যাদড়া' হওয়ার কোনো হেতু নাই । তাহা রোগমাত্র হইলে, ডাক্তার, বদ্যি, বিগত-যৌবনা বান্ধবী, কাহারও না কাহারও কথা শুনিত । কিন্তু এ কাহারও কথা শোনেনা । কোনো যুক্তিরও ধার ধারে না । তাহার স্বভাবটা যেন বর্তমানকালীন বিশেষ বিশেষ নেতা নেত্রীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের ন্যায় । নির্বিকার, যুক্তিরহিত এক নিরন্তর ঘ্যাতামি করিয়াই যেন তাহার আনন্দ ।

    তথাপি বাঙালের কোমর বা মাজা বলিয়া কথা । সে শুধুমাত্র একটু বেদনার্ত হইয়াছে বলিয়া বাঙাল লোক হাসাইবে, ইহা ভাবিলেও স্ব-সমাজে তাহার হুঁকো-কল্কে বন্ধ হওয়ার কথা, প্রকাশ করিয়া কহিলে তো কথাই নাই । মাজার দরদ নহে, উহার মূলীভূত কারণ নাকী মেরুদণ্ডের হাড্ডির জীর্ণতাজনিত পিল্পিলানি । শুনুন কথা । বাঙালের মেরুদণ্ড নাকী আবার জীর্ণ হয় । দেশভাগের কোঁত্কায় উহা আছে কী নাই তাহারই ঠিকানা পাওয়া যাইতেছে না । সুতরাং একটা `আছে কী নাই' বস্তুর আবার জীর্ণতা বা দৃঢ়তা কী ? শল্য-চিকিত্সকেরা ইহাকে বড়জোর মায়া-বেদনা (Phantom Pain) বা ভুতুড়ে ব্যথা বলিতে পারেন । তাঁহারা কোনো রোগীর কোনো প্রত্যঙ্গ যদি অস্ত্রোপচার করিয়া বাদ দেন, তখনও সেই রোগী ঐ ছেদিত প্রত্যঙ্গের জন্য বেদনা বোধ করিয়া থাকেন । বাঙালের মাজার দরদ ব্যাপারটাও বোধহয় তদ্রুপ । কিন্তু ইহা নিতান্তই বাঙালের আত্মসমালোচনা মাত্র । অধিক গুরুত্ব দিবার হেতু নাই ।

    একটি ভিন্ন মত শুনিয়া তাজ্জব বনিতে হইল । মতটি এক জন্মশত্তুর ঘটিপুত্রের । একথা সর্বজন বিদিত যে ঘটিরা বাঙালদের কোনো কিছুই ভাল দেখেও না, বলেও না । তথাপি এক্ষেত্রে তাহা ঘটিল । এই ব্যতিক্রমী ভদ্রসন্তান স্বয়ং একজন লেখক এবং বড় কথা এই যে তিনি একটি প্রখ্যাত সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পাক্ষিকের ডাকসাইটে সম্পাদক । আমার মাজার দরদ বিষয়ক নাকানি চোবানির কথা শুনিয়া তিনি কহিলেন, লোকের কথায় কান দিবেন না । বাঙালের কোমর বা মেরুদণ্ড কমজোরি ইহা আদৌ ইতিহাস সিদ্ধ নহে । বরং ইহার বিপরীতটাই সত্য । সবিস্ময়ে বলিলাম, মহাশয়, আপনি ঘটিপুত্র হইয়া ভাটিপুত্রদের এরূপ গুণকীর্তন করিতেছেন, ইহার পশ্চাতে কোনো প্রকার ব্যাজস্তুতিমূলক উদ্দেশ্য নাইতো ? তিনি কহিলেন, আমি অবশ্যই ঘটি, কিন্তু অন্য অন্যদের মত সাম্প্রদায়িক ঘটি নহি যে মিথ্যা গৌরব প্রচার করিয়া ইতিহাস বিকৃত করিব । আপনি জানেন, ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্ব, `হেঁদু - নেড়ের' সাম্প্রদায়িক বলদ-বৃত্তির চাইতেও সরেস, কিন্তু আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, আমার বক্তব্যে কোনো কৌটিল্য নাই । বাঙালেরা সত্যই বেশ পোক্ত শিরদাঁড়া এবং কোমরের অধিকারী ।

    আমি পুলকিতচিত্তে তাঁহার ব্যাখ্যা শুনিতে চাহিলাম । স্বজাতি প্রশংসায় একটি বিশেষ বাংলা সংবাদপত্র ছাড়া কেইবা বিতর্ক তোলে ? তিনি তাঁহার বক্তব্যে মোদ্দা যাহা জানাইলেন, দেখিলাম, তাহা সওয়া-ভরি বাস্তব, সুতরাং সত্য । তিনি কহিলেন, দেখুন একসময় বৃটিশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হইত না । কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বকোন্দলে তাঁহার মাজা ভাঙিলে ত্রক্রমশ এমন হইল যে সূর্য উদয় হইবার স্থানটুকুও আর তাহার নাই । পক্ষান্তরে দেশভাগে ছিন্নমূল বাঙালদের কলোনিগুলির ত্রক্রমবিকাশ লক্ষ্য করুন । খালিহাতে আসিয়া তাহারা যেসব কলোনি বা উপনিবেশের পত্তন করিয়া বর্তমানে ফুলিয়া ফাঁপিয়া ঢোল হইয়াছে, তাহাতে কী মনে হয় যাবচ্চন্দ্র দিবাকরে উহাদের আদৌ বিলয় ঘটিবে ? সুতরাং - ।

    কিন্তু সে যাহাই হউক, আমার বাঙাল শভিনিজম্‌ সেই ঘটিপ্রবরের সুড়সুড়ি প্রাপ্ত হইয়া যতই স্ফীত হউক না কেন, কোমর এবং শিরদাঁড়া তাহাতে কিছুমাত্র কর্ণপাত করিল না । ব্যথা লাগিয়াই রহিল এবং একসময় অস্থি-বিশেষজ্ঞ নামক হাড়ের হাতুড়েদের মানবিক এবং দানবিক নানান অভিচারকে অগ্রাহ্য করিয়া স্নায়ুতে আক্রমণ শানাইল । এক শীতকালীন প্রভাতে শয্যা ত্যাগ করিবার প্রাক্কালে অনুভব করিলাম আমার বামপদ মৃত্তিকা স্পর্শ করিতে তীব্র কাতরতা প্রকাশ করিতেছে । বলিতে লজ্জা হয়, তবু বলি, প্রত্যুষে মনুষ্যজাতি মাত্রেরই `হিসির বেগ' প্রবল হইয়া থাকে । কিন্তু ঐ সময়টায় আমার টয়লেটে যাইবার ক্ষমতা পর্যন্ত রহিত । নেহাতি শরীরে বাঙাল রক্ত অবিমিশ্র হওয়ায়, ঐ সময়টায় আমি মেজে(??) বা বিছানা ভাসাই নাই । ঘটিপ্রবর বলিয়াছিলেন যে অনুরূপ অবস্থায় কোনো ঘটি-গৃহের তিন ফারলং এর মধ্যে অ্যামোনিয়ার তীব্র গন্ধে মানুষতো দূরস্থান, ইঁদুর, আরশোলা পর্যন্ত গমনে ইতস্ততো করিত ।

    ইতিমধ্যে, অবস্থার ত্রক্রমানুসারে যেসব অস্থি-বিশেষজ্ঞদের নিকট যাতায়াত করি, তাঁহাদের বৃত্তান্তও জানাই । প্রথমে যাঁহার নিকট যাই তিনি আমার ভাগ্যক্রমে কানে কালা এবং স্বয়ংই নাকী বিগত বারো বত্সর যাবৎ নিজস্ব মাজার মাজাকিতে কাতর । চিকিত্সার নামে সপ্তাহ এবং পক্ষান্তরে দু একটা ট্যাবলেটের নাম উল্টাইয়া পাল্টাইয়া, ট্রায়াল এণ্ড এরর মেথডে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি এবং আমার অর্থহ্রাস করিতেছিলেন । কিছুদিন এই প্রক্রিয়া চালাইবার পর তিনি জানাইলেন, মাসখানেক ট্র্যাকশান চলুক । অথচ প্রথম দর্শনে দর্শনীটা পকেটস্থ করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন, এই অবস্থায় ট্র্যাক্শান চলিবে না ।

    সুতরাং ট্র্যাক্শান চালু হইল । তবে চালু হইবার কথাটি যত সহজে বলিলাম, প্রক্রিয়াটির তথাকরণ তত সহজ হইল না । হাড়হাড্ডি লইয়া যাহারা নিয়মিতভাবে সকাতরে কাত্রাইয়া মৃত্যু কামনা করিয়া থাকেন, তাঁহারা জানেন যে এই হাড়মুড়মুড়ি ব্যথাকে উপলক্ষ্য করিয়া শুধু অস্থিবিশেষজ্ঞ নহে, ব্যথা, গ্যাস, অম্বল এবং ভিটামিনের বড়ির কোম্পানিগুলি ছাড়াও আর আর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী আছে যাহাদের সাধারণ নাম `ফিজিও থেরাপিস্ট' । ইহারা আবার নিজেদের ঐ উপাধিটিতে সন্তুষ্ট নহে, তাই নামের আগে ডাক্তার শব্দটি ব্যবহার করিয়া থাকে । ডাক্তার আমাকে ট্র্যাকশান নিতে বলায়, সংশ্লিষ্ট ফিজিও থেরাপিস্ট তাঁহার প্রয়োগ বিধির সহিত সহমত না হইয়া নিজস্ব বিধি জারি করিতে চাহিল । সে খুব উদারভাবে নিজস্ব জ্ঞান-গরিমা, অভিজ্ঞতা, হাতযশ ইত্যাদি কীর্তন করিয়া এবং ডাক্তারদের অপরিমিত অর্থলোভ ও নিজের সম্পূর্ণ নি:স্বার্থপরতা এবং লোভহীনতার কথা বর্ণনা করিয়া যে বিধি সাব্যস্ত করিল তাহাতে আমার সর্বমোট হাজার দশেক টাকার মত শুধু ট্র্যাকশান নিতেই খরচ হইবার দাখিল হইল ।

    প্রথমেই সে আমার নির্বুদ্ধিতায় যত্পরোনাস্তি আক্ষেপ করিয়া কহিল, হাতের কাছে সে থাকিতে ডাক্তারের নিকট যাওয়াটা আমার একেবারেই `গু'খোরি হইয়াছে । ইহাতে যেমন সময় নষ্ট হইয়াছে তেমনই রোগও অন্য ধারায় চলিয়া গিয়াছে । ট্র্যাকশানের বিষয়ে ডাক্তার যে দিনে তিনটি করিয়া একমাস সিটিং এর ব্যবস্থা দিয়াছে, আমার এই বুড়ো হাড়ের পক্ষে তাহা সঠিক নহে । বরং দিনে একটি করিয়া নব্বই দিন সিটিং নিলে বেশি উপকার । ডাক্তার নির্দেশিত ওজনটিও সঠিক হয় নাই । অতএব, গোটা ব্যাপারটা হিসাবে দাঁড়াইলো নয় হাজার টাকা । কেননা, তাহার দৈনিক `ভিজিট' দেড়শত টাকা, তাহাতে নব্বই দিনে সাড়ে তের হাজার টাকা হয় । আমি পাড়ার লোক, তাই খাতির করিয়া সে দেড়শত না লইয়া একশত টাকা মাত্র দৈনিক ভিজিটে ট্র্যাকশান দিতে রাজি হইল ।

    আমি একজন সাধারণ শ্রেণির মুখচোরা ভদ্রলোক বলিয়া নিজেকে গণ্য করিলেও, লোকব্যবহারে, বিশেষত, অর্থাদির হিসাব নিকাশে আসলেই `মাটো' বলিয়া খ্যাতি আছে । সব কিছুই একটু বিলম্বে বুঝিয়া থাকি, তাহাও আমার স্ত্রী ধ্যাতাইয়া ধ্যাতাইয়া যতক্ষণ না ব্যাপারটা আমার মগজে পুরিয়া দেন ততক্ষণ নহে । ট্র্যাকশান ব্যাপারটির জন্য যে এই উপডাক্তারটির নিত্য আসিবার প্রয়োজন নাই এবং একদিন দেখাইয়া দিলেই চলে সেই কাণ্ডজ্ঞানটি হইতে আমার সাতদিন এবং গৃহিনীর মাত্র পাঁচ মিনিট লাগিয়াছিল । কিন্তু কথায় কথায় বলিয়া ফেলিয়াছিলাম যে, আগে এক সপ্তাহ দেখি, পরে দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা যাইবে । ভদ্দরলোকের এক কথা । সুতরাং বেমত্লব ট্র্যাকশানের ব্যাগ দুইটা (ওয়েট) ঝোলানো এবং সাধারণ কিছু সরঞ্জামের মজুরি ও মূল্য বাবদ অনধিক হাজারখানেক টাকা উপডাক্তার লইলেন । বেদনার উপশম কিছুই হইল না । আমি গৃহিনীর গঞ্জনা সহ তাঁহারই প্রচেষ্টায় দিন কুড়ি আরও ট্র্যাকশান লইলাম । কাজের কাজ এই সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করিলাম যে পুরুষ জাতিটাঅ ভাগ্যবান এবং একটা ক্ষেত্রে অন্তত বুদ্ধিমান যে তাহারা স্ত্রীজাতীয় মানুষদের গৃহিনী হিসাবে গ্রহণ করিয়া থাকে । দু:খের কথা এই যে তথাপি আমার ভদ্রলোক সুলভ `বোগদামি' সাতদিনের মধ্যে জয়লাভ করিয়াছিল । তত্সত্ত্বেও আমরা লোকটিকে যে সস্তায় খেদাইতে পারিয়াছি, ইহা ভাবিয়া প্রভূত আত্মশ্লাঘা লাভ হইল । মদীয় `কলত্র' আত্ম, কুটুম্ব তথা টেলিফোন-সাধ্য সর্বজনকে জাঁক করিয়া বলিতে লাগিলেন, ভাগ্যে আমাহেন জনের হাতে পড়িয়াছিল, নহিলে এই সংসার বারোভূতে লুটিয়া খাইত । বলিতে পারিতাম, ভূতের হাত হইতে না হয় রক্ষা পাইয়াছি, পেত্নির গতি কী হয় ? সাতপাঁচ ভাবিয়া কিছু বলিলাম না । সেটা আরেকটা মূর্খতাই হইত । এই ভাবেই তো মানুষ জ্ঞানী হয় ।


    ॥ তিন ॥


    মনুষ্যের অনেক অনেক কুসংস্কারের মত, একটি কুসংস্কার এই যে তাহার বিশ্বাস ডাক্তার কাহারো বন্ধু হয়না কখনোই । বিস্তারে না গিয়াও বলিতে পারি বিশ্বাসটি সম্পূর্ণ সঠিক নহে । সব কাক কালো নহে । অস্ট্রেলিয়ায় নাকী সাদা কাক দেখা গিয়াছে । আমার এমন একজন ডাক্তার আছেন যিনি প্রকৃতই ডাক্তার এবং প্রকৃতই বন্ধু । কথাটি যে অসত্য নয় তাহার প্রমাণ এই যে আমার পরিবারস্থ, কুটুম্বস্থ কয়েকজন গৃহবধু তাঁহাদের হৃদয়ের পরিচর্যার ভার আমাদের জ্ঞাতসারেই তাঁহাকে দিয়া বসিয়া আছেন । পাঠক, এক্ষেত্রে `হৃদয়' শব্দটি হৃদ্পিণ্ড হিসাবে জানিয়া অস্বস্তি দূর করিতে পারেন ।

    সংসারে যাঁহারা আমাহেন গ্রাম্য-স্বভাবের তাঁহাদের বদ্ধমূল ধারণা যে তাঁহাদের পরিচিত পুরাতন ডাক্তারটিকে না দেখাইলে আরোগ্য লাভ সম্ভব হইবে না, তা যে রোগই হউক না কেন । আমাদের রোগেরাও ডাক্তার চেনে । আলোচ্য ডাক্তারবাবুটি যুগধর্মবশত ত্রক্রমে `মেডিসিনের' ছড়ানো ক্ষেত্র হইতে নিজেকে গুটাইয়া লইয়া, হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ রূপে সঙ্কীর্ণ প্রতিষ্ঠা অর্জন করিয়াছেন । হৃদয়ের কারবারি হওয়া উত্তম এবং কালপ্রবাহে আমাদের হৃদিস্থিত হৃষিকেশও চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে এও সত্য, কিন্তু যেহেতু শারীরিক অন্যান্য আপদবর্গও সমান চঞ্চল, তাই আমরা ঘুরিয়া ফিরিয়া তাঁহার দ্বারস্থই হইতেছি । তিনি তাঁহার মৃদু স্বভাববশত যথোচিত পরামর্শও দিতেছেন । কিন্তু আমাদের গাঁইয়াভাব অদম্য । তাঁহার যথোচিত পরামর্শে আমাদের মন মানিতেছে না । অন্যদের কথা জানিনা, এই আমারই বর্তমান বাত বিষয়ক ব্যথা কাতরতার জন্য এই রোগ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের একের পর এক দেখাইয়া যখন বুঝিলাম যে তাঁহারা আমাকে বাঙাল চিনিয়া, ফাট্কি দিয়া পকেটের মাদারি খেল উপভোগ করিতেছে, তখন নিজস্ব ডাক্তার বাবুর নিকট যাওয়া ছাড়া উপায় রহিল না । প্রথমে নিম্নোক্ত সংলাপ হইল ।

    আমি -- ডাক্তার আমার এই কাগজপত্র গুলা একটু দেখিয়া দিলে ভাল হয় ।
    ডাক্তার -- আপনি যখন দরজা ঠেলিয়া চেম্বারে ঢুকিতে ছিলেন, তখনই বুঝিয়াছি আপনার ব্যায়রাম ঠ্যাঙের । কিন্তু মহাশয় আমিতো হৃদ্পিণ্ডের চিকিত্সা করিয়া থাকি । আপনার কাগজপত্র দেখিয়া বুঝিতেছি আপনার মেরুদণ্ডের হাড়ের কিছু সমস্যা আছে । আপনি ভালো অস্থিবিশেষজ্ঞ কাউকে দেখান ।
    আমি -- বিগত তিন মাসে তিনজন বিশেষজ্ঞ বাটিয়া খাইয়াছি, এখনো খাইয়া চলিয়াছি । কিন্তু ব্যথাবেদনা বাড়িতেছে বই কমিতেছে না । অবশেষে হতাশ হইয়া রোগীর শেষ অবলম্বন হোমিওপ্যাথিক সাবুদানা আর স্পিরিট খাইতেছি ।
    ডাক্তার -- কিন্তু আপনি তো হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাস করেন না ।
    আমি -- করি নাই তো । তাহার হাজারো কারণ দেখাইতেও পারি । আপাতত দুইটি কারণ বলিলেই সবটা বলা হইবে । প্রথম বাল্যকালে পিতৃদেবের পারিবারিক চিকিত্সার ঐসব ছাই পাঁশ বাক্সে যতটা ছিল সবটা চুরি করিয়া খাইয়াও কোনো ক্ষতি হয় নাই । যেটুকু ক্ষতি হইয়াছিল, তাহা পিতামহাশয়ের প্রহারে । সুতরাং যে ঔষধে ক্ষতি হয় না, তাহাতে উপকার হইবে কোন্‌ যুক্তিতে, এরকম একটা ধারণা আমার বদ্ধমূল । এই গেল প্রথম কারণ । দ্বিতীয়টা হইল, তথাপি যদি কখনো ঐ ঔষধে কোনো রোগ সারে, তবে কেন সারিল, সে বিষয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তা জাগে । কথাটা ভাবিয়া দেখিবেন, আমি ব্যাখ্যায় যাইব না ।
    ডাক্তার -- তবে এখন ঐ ঔষধ খাইতেছেন, ইহার কারণ কী ?
    আমি -- তাহার দুইটা কারণ । প্রথমত, এই ঔষধে আমার পেটের ব্যামো, গ্যাস, অম্বল ইত্যাদির উপদ্রব হয়না, যা অস্থি-বিশেষজ্ঞদের প্রদত্ত ব্যথা নিবারক ঔষধে অবধার্যরূপে হইয়া থাকে । দ্বিতীয়ত, এই হোমিও ডাক্তারটি আমার কোমর এবং শিরদাঁড়ায় কিছু অভিচার উপচার করিয়া থাকে, তাহা অনেকটা জামা-প্যান্ট ইস্তিরি করার মতো । ব্যাপারটা বেশ আরামদায়ক । সে কারণেই তাহার কাছে যাই ।
    ডাক্তার -- কিন্তু একমাত্র একটা এক্সরে করা ব্যাতিত কী আপনার অন্য কোনো পরীক্ষা নীরিক্ষা করার কথা কেহ বলে নাই ? এই ধরুন এম. আর. আই জাতীয় কিছু ?
    অমি -- আজ্ঞে না ।

    ডাক্তার তখন যেন নিতান্ত চিন্তিত হইয়া বলিলেন, আপনাকে আমি একজন অস্থিবিশেষজ্ঞের নিকট পাঠাইতেছি । তিনি শুধুমাত্র আপনার পরীক্ষা নীরিক্ষাটা করিবেন । প্রয়োজনে আমরা স্পাইন সার্জনের পরামর্শ লইব । আপনি এত দীর্ঘদিন ধরিয়া এই যন্ত্রণা ভোগ করিতেছেন, আর কোনো পরীক্ষাদি করানো হয়নাই, ইহা ভাল কথা নহে । আপনি সত্ত্বর এই ডাক্তারের নিকট যান । ও আমার ব্যাচ্‌-মেট্‌ এবং বন্ধু স্থানীয়, ডায়াগনাসিস্টা ভাল করিয়া থাকে । জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনার কী মনে হয়, রোগটাতে কী `ফুটিয়া' যাইবার মতো সম্ভাবনা আছে ? ডাক্তার ভ্রু-কুঞ্চিত করিয়া আমার দিকে একবার তাকাইলেন মাত্র । শুধু বলিলেন, যাহা বলিয়াছি তাহা করুন, বাজে বকিবেন না । ফুটিবার হইলে যথাসময়ে ফুটিবেন, তাহার ব্যস্ততা কী ? সেক্ষেত্রে তো ল্যাঠা চুকিয়াই যায় ।

    অতএব বন্ধুবরের কথা অনুসারে সেই অস্থি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম । শাস্ত্রে শত্রুর শত্রুকে বন্ধু বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে বটে, তবে বন্ধুর বন্ধুকে বন্ধু বলিয়া নিশ্চয় করা হইয়াছে এমন শুনি নাই । তথাপি আমরা আধুনিক ভদ্রতা এবং বিশেষ করিয়া স্বার্থপরবশ তাঁহাদিগকে কাজিন-ফ্রেণ্ড হিসাবে গণ্য করিয়া থাকি । কিন্তু তাহাও বন্ধ্যাগমনতূল্যই নিস্ফল । ডাক্তার-বন্ধুর এই বন্ধু ডাক্তারটি ভালমানুষ কী খারাপ মানুষ, ভাল ডাক্তার কী খারাপ ডাক্তার তাহা এখনই বলিবার সময় হয় নাই । ভদ্রলোক অতিশয় স্বল্পভাষী, কথা বলার চাইতে ব্যবস্থাপত্র লেখায় অধিক মনোযোগী । প্রথমদর্শনে অন্তত তেমনই দেখিলাম । প্রায় কিছুই বলিলেন না । ব্যবস্থাপত্রে কতগুলা রক্তপরীক্ষার ব্যাপার ছিল, সেইসব করাইয়া, ফলাফল তাঁহাকে জানাইলে, পরবর্তী ব্যবস্থাপত্র দিবেন বলিয়া বিদায় দিলেন । অবশ্য একটা বড়ো খাতিরদারি করিলেন এই যে রিপোর্ট লইয়া রোগীকে আর যাইতে হইবেনা, অন্য যে কেউ গেলেই চলিবে । আমার তখনকার কোমর এবং বামপদের বাত-বিধূরতায় তাহা বড়ো সামান্য সুসমাচার ছিল না । ব্যবস্থাপত্রে কিছু ঔষধাদি, ব্যায়াম এবং কোমরে পরিবার জন্য একটি বড়সড়ো শক্তপোক্ত খাঁচারও ব্যবস্থা ছিল । বিগত প্রায় বত্সরখানেক যাবৎ ব্যবস্থাটি চলিতেছে । নির্ধারিত সময়ে তাঁহার সমীপে হাজিরা দিয়া, তাঁহার নজরানাটা দিয়া আসিতে হয় ।

    প্রথমবার দেখাইবার সময় তিনি নানাবিধ রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা দিয়াছিলেন । বলিয়া দিয়াছিলেন, ফলাফল লোক মারফত পাঠাইলেও চলিবে । নিজের আসিতে হইবে না । যে ঔষধের ব্যবস্থা দেওয়া হইয়াছে তাহা চারি সপ্তাহ খাইতে হইবে, তত্সহ ব্যায়াম । রক্ত পরীক্ষা করিতে দেওয়ার পর হইতেই ঔষধ খাইতে হইবে । আগে খাওয়া চলিবেনা ।

    যথাসময়ে রক্তের রিপোর্ট সহ কন্যা ও জামাতাকে পাঠাইলাম । `যম, জামাই, ভাগ্না' বিষয়ে লোকপ্রবাদটা সবাই জানেন । কন্যাসন্তান বিষয়েও শাস্ত্রবাক্য চিত্তে পুলক জাগায় না । সোজা কথায় বলিলে, ইহারা কেহই মিত্র পর্যায়ে পড়েনা । তাহারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, অর্থাৎ বাকি সকলে অশিক্ষিত ইত্যর্থ । সুতরাং তাহাদের ধারণা অনুযায়ী তাহারা আমার সুস্থতা বিধান করিতে চাহে । তাহাদের উপদেশ, সমালোচনা এবং শাসন বাতের বেদনার চাইতে কিছুমাত্র কম যন্ত্রণাদায়ক নহে । তদুপরি ডাক্তার, যাঁহাকে মিত্রের মিত্র হিসাবে প্রথম দর্শনে মিত্রই ভাবিয়া ছিলাম, তাঁহার নির্দেশাবলি পাইয়া এক্ষনে প্রচ্ছন্ন দুশমন বলিয়া বোধ হইতে লাগিল । কন্যা-জামাতা আমার খাদ্যাখাদ্য বিষয়ে ঐ ডাক্তারের যে নিষেধাজ্ঞা বহন করিয়া আনিয়াছে তাহা এতই কুরুচিকর এবং অপমানজনক যে আমি তাঁহার রোগী না হইয়া উকিল হইলে একটা ফৌজদারি মামলা ঠুকিয়া দিতাম । সত্যিকথা বলিতে কী, সেই নির্দেশ পালন করার চাইতে উদ্বন্ধনে আত্মহত্যা করাও সুখকর ।

    পাঠক যদি আমার ন্যায় ষাট অতিক্রান্ত `হাব্ড়া' এবং `বেতো' হন তবেই আমার মর্মবেদনা সম্যক বুঝিবেন, কম বয়সী হইলে তো ডাক্তারকে `হার্মাদ' আখ্যা দিয়া ঐ `তাহাদের মতো'ই ঠেঙানি দিবেন । কিন্তু সে কথা যাউক, ষাট অতিক্রান্তরা জানেন যে এই বয়সটায় মনুষ্যের ষড়রিপুর সবকয়টা একত্র হইয়া `নোলায়' আসিয়া জড়ো হয় এবং তৃতীয় রিপুটাকে বেমতলব শক্তিশালি করিয়া তোলে । সেই সময়ে যদি এরূপ নিষেধাজ্ঞা পালন করিতে হয় তবে তাহার চাইতে কুত্সিৎ রসিকতা আর কী হইতে পারে ? এমনিতে ভিন্ন ভিন্ন রোগের কারণে `নোলাকে' যথেষ্ট শাসিত রাখা হইয়াছে, এখন ইউরিক এসিড না কী একটা যেন পদার্থ রক্তে কিঞ্চিৎ অধিক হইয়া, লক্ষণগণ্ডি পার হইবার আভাস দেওয়াতে নাকী ডাক্তার আমিষের মধ্যে চারাপোনা এবং নিরামিষের মধ্যে বেগুন, উচ্ছে জাতীয় দুএকটা সব্জি ছাড়া বাকি সব `ঢেঁডা' মারিয়া দিয়াছেন । শীতকালীন সব্জি আমার পক্ষে একেবারেই নাকী বিষতুল্য । একমাত্র মহাশয়-নির্ধারিত উচ্চমূল্যের ঔষধ বটিকাগুলিকে অমৃত বোধে গিলিয়া এবারের মতো ভবসাগর তরিতে হইবে । তা ঔষধে বেদনার উপশম হউক বা না হউক ।

    কন্যাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তবে যাহাদের ইউরিক এসিড বাড়তির দিকে, তাহারা কী হাওয়া এবং উপদেশ খাইয়া থাকিবে ? কন্যাও কহিল, রোগে কষ্ট পাওয়ার চাইতে আহারাদিতে সংযম রাখা ভাল । তাহা ছাড়া ঔষধগুলা কী গিলিতেছ না ? তাহা কী খাদ্য নহে ? আমার কন্যারত্নের সহমর্মিতা ব্যাপারটা তাহার জ্ঞান হইবার পর হইতে বহির্জগতে যতটা বিস্তৃতি লাভ করিয়াছে, তথাকথিত আত্মীয়জনের ক্ষেত্রে ততটা নাই । এ বিষয়ে তাহার হাজার একটা অকাট্য যুক্তিও আছে, তবে শরীরের বর্তমান অবস্থায় তাহা যেন হাড়ের ব্যথার উপর হাতুড়ির ঘা । যাহা হউক, জিজ্ঞাসা করিলাম, কী কী খাওয়া যাইবে না তাহা তো শুনিলাম, কী খাওয়া যাইবে তাহা ডাক্তার কিছু বলিয়াছে কী ? সে ঝাঁঝি মারিয়া বলিল, সেসব কথা জিজ্ঞাসা করি নাই । ডাক্তার চেয়ারে বসিয়া ঝিমাইতেছিল, বিতাং কথা কহিবার অবকাশ পাই নাই ।

    জামাতা বাবাজীও দেখিলাম ডাক্তারের বিষয়ে বিরক্ত । তাঁহারা শুধু তাঁহার নিষেধাজ্ঞায়ই মুগ্ধ হইয়াছিল । প্রথমে ভাবিয়াছিলাম, জামাইটা পরের ব্যাটা, সুযোগ বুঝিয়া শ্বশুরকে কায়দা করিতেছে । পরে দেখিলাম, সে যদিও পুরুষবিধায়, শ্রেণিস্বার্থে যাও দু একটা উপকরণ বাঁচাইয়া রাখিয়াছিল, কন্যা সেগুলিও ঝেঁটাইয়া বাদ দিয়া দিয়াছে । ভাবিলাম, হায়, `এই কী কালের গতি এই কী নিয়তি ?' এই হতচ্ছাড়িকে নিজের `নোলা' সংযত রাখিয়া কত চর্ব্য, চোষ্য ইত্যাদি গেলাইবার জন্য যত্ন করিয়াছি, আর এখন সে আমার `রেডমীট' খাওয়া বন্ধ হইয়াছে বলিয়া আহ্লাদে নৃত্য করিতেছে । শুধু তাহাই নহে, কিছুটা সহানুভূতিশীল পরের ব্যাটা জামাইটাকে পর্যন্ত দলে টানিয়া নাচাইতেছে । জন্মান্তর মানিবার কাল হইলে শাসাইয়া দিতাম, দাঁড়া, সামনের জন্মে তোর ছেলে বা মেয়ে হইয়া জন্মাইয়া তোর হাড় ভাজা ভাজা করিব । কিন্তু তাহা বলিবার আর জো নাই । জন্মান্তরে বিশ্বাস ব্যাপারটাই আজ ভোঁ-কাট্টা হইয়া গিয়াছে । তাহাতে বাপেরও বিশ্বাস নাই, বেটিরও না । বেটির আবার প্রজন্মান্তরেও বিশ্বাস নাই । সুতরাং কোনো ভাবেই যে তাহার উপরে কায়দা করিব এমন আশা নাই ।

    কন্যার শ্মশ্রুমাতা এখনো ষেটের কোলে চড়েননি । তবে নিতান্ত তরুণীটিও নহেন । স্বাভাবিক নিয়মনিষ্ঠ, স্বাস্থ্যসচেতন, স্বল্পাহারী মানুষ । তবে স্বল্পাহারী হইলেও টক্টুকুন, দুধটুকুন, ঘি-মাখন-ক্ষীর ইত্যাদি না হইলে তাঁহার চলেনা । হতচ্ছাড়ি বৌয়ের কুমন্ত্রণায় সোনার টুক্রা ছেলেটা কোন্‌ এক উচ্পাঁজুরে ছোকরা ডাক্তারের সঙ্গে ষড় করিয়া তাঁহাকেও খাওয়ার ব্যাপারে `এটানা ওটানা' এর চক্করে ফেলিয়া খাবি খাওয়াইতেছে । অথচ নিজেরা বাহিরে, বন্ধুগৃহে, যত্রতত্র গরু, শোর, খাসি-মুরগির ছেরাদ্দ করিতেছে । সে ব্যাপারে তাহাদের কোনো আত্মগ্লানি নাই । কিছু বলিলে, উত্তর প্রস্তুত, তোমাদের এখন বয়স হইয়াছে, আমাদের বয়স কম । যেন তাহাদের কোনোদিন বয়স হইবে না । দেখিব, তখন তোদের কেমন লাগে । দেখিব, `নোলা' কতটা বাগ মানাইতে পরিস । কিন্তু দেখিব কী করিয়া ? ততদিনে কী আমাদের দেখিবার পালা সাঙ্গ হইবে না ?

    কিন্তু মহিলা মানুষ ভাল । সাতে চড়িয়া রা নাই । তদুপরি বয়সটা আমাদের তুলনায় কাঁচা । ঠাকুরের কৃপায় তাঁহার এমন কিছু রোগ ব্যাধি নাই যে কারণে তাহার এই বয়সেই আহারাদিতে কৃচ্ছ্রতা সাধন করিতে হইবে । সব দেখিয়া শুনিয়া মদীয় গৃহিণী গোপনে আমার নিকট আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছেন, মানুষটাকে বুঝি না খাইতে দিয়া মারিয়াই ফেলিবে । তবে জামাইএর উপরে তাঁহার ষোল আনা ভরসা আছে । সে বড় মাতৃ-অন্ত প্রাণ । সংসারে আর দশজন শ্বাশুড়ির মতই তিনি দশমুখে তাহার সুখ্যাত করেন । তুলনায় মেয়ের বিষয়টা - কিন্তু তাহা বলার প্রয়োজন করেনা । এ ব্যাপারে সংসারে কতকগুলি প্রথা নারীসমাজ নিজেরাই তৈয়ারি করিয়া রাখিয়াছে, তিনিও তাহার বাইরে নন । নিজেরটির চাইতে পরেরটিকে তাঁহারা সর্বদাই ভাল দেখেন । কিন্তু সেক্ষেত্রে একটু ভিন্নাচার থাকে, যেমন মেয়ে নচ্ছার জামাই ভাল, কিন্তু বৌ অবশ্যই নচ্ছারতমা এবং ছেলে সোনার টুকরা । মানসিকতাটা আবহমান কালের । কিন্তু এবিষয়ে বিস্তারিত হওয়ার ঢের বিপদ আছে ।

    কিন্তু রোগের কথাটা ছিল মূলকথা । তাহা ছাড়িয়া ভিন্ন কথায় যাওয়া উচিত হইতেছে না । বিশেষ, নারী বিষয়ে নাড়ীজ্ঞান আমার যথেষ্ট প্রশংসনীয় নহে । সে নিজের নারীই হউক কিম্বা পরনারী । পরনারী চর্চায় তো আবার সামান্য ইতর বিশেষে আইন-আদালতও হইতে পারে । বরং বাতকাতুরে এবং বাত হাতুড়ে মুখপোড়াদের বৃত্তান্ত বলিয়াই এই প্যাচাল শেষ করি । বিচার করিয়া দেখিয়াছি আমাদের ন্যায় বানপ্রস্থ উপযোগী `হাবড়াদের' এইসব বৃত্তান্ত লইয়া আলোচনা করাই নিরাপদ । কারণ, ঐসব মুখপোড়ারা আমাদের যে পর্যন্ত মারে, উহার অধিক মরিবার আর হেতু নাই ।

    কথিত আছে বঙ্গে নাকী সকলেই ডাক্তার । সেকারণেই বোধকরি সর্বার্থ-সাধক ডাক্তারের বদলে বিশেষজ্ঞদের প্রাদুর্ভাব বাড়িয়াছে । যাহা হউক, এই পাশ করা এবং অ জন্মসূত্রে ডাক্তারদের চক্রব্যুহ ভেদ করিয়া এক্ষণে আমার প্রাগূক্ত ডাক্তার বন্ধুর বন্ধু ডাক্তারের স্বত্ত্বাধীনে আছি । পরবর্তী দর্শনীর সময় হইয়াছে । সম্ভবত আবার গুচ্ছের রক্ত পরীক্ষার নির্দেশ দিবেন এবং এই জামাইকেই সেই রিপোর্ট লইয়া তাঁহার সকাশে যাইতে হইবে । এক্ষেত্রেও অবশ্যই সে একা যাইবে না । কন্যা সঙ্গে যাইবে । বর্তমানে যা দুএকটা খাদ্যবস্তু `নোলা' শান্ত রাখিতেছে, বোধহয় বিশেষজ্ঞ তাহারও `তেইল' মারিয়া, শুধু উচ্ছে বা নিম পাতার ব্যবস্থা দিবেন । তিনি না দিলেও আবাগীদের বেটা-বিটিরা নিজেদের জ্ঞানগম্যির সাহায্যে একটি অনুপম ডায়েট-চার্ট তৈয়ারি করিয়া আনিয়া বিশেষজ্ঞের বকলমায় চালাইয়া দিবে । এইসব কারণে প্রকাশ্যে এই বিশেষজ্ঞের নির্দেশমত চলিলেও, তলেতলে আমি একটু ভিন্ন পথে চলিতেছি । সেই গুপ্ততথ্য বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করিয়া এই পাপ-প্রসঙ্গ শেষ করিব ।


    ॥ চার ॥


    পাঠক, কন্যাজামাতার কর্মকাণ্ডে হয়তো আপনাদের মনে হইতে পারে যে আমাদের যাহাতে খাদ্য ঔষধাদিতে অধিক অর্থ অপচয় না হয়, এইজন্যই তাহাদের এইরূপ প্রচেষ্টা । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি আদৌ তাহা নহে । কারণ, এইভাবে আমাদের সঞ্চয় ভাণ্ডার স্ফীত হইলেও, তাহাদের পরিষ্কার ঘোষণা যে আমাদের `ফুটিয়া' যাওয়ার পর বা এখনও এই অর্থের উপর তাহাদের লোভ নাই । তাহারা এ পর্যন্ত ঘোষণা করিয়াছে যে আমাদের পয়সায় তাহারা নিষ্ঠিবনাদি, এমন কী তদপেক্ষা ঘৃণ্য বর্জ্যাদি পর্যন্ত ত্যাগ করে । সুতরাং তাহারা যে অতি নির্লোভ জাতক - এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হইল ।

    আমরাও স্থির করিয়াছি, আমাদের সঞ্চিত অর্থ আমরা `বাতের' নামেই খরচ করিব । প্রয়োজন হইলে `বাতের' নামে একটি বড়সড়ো শহীদবেদি প্রস্তুত করাইব এবং বামপন্থী কাহাকেও দিয়া তাহা উদঘাটন করাইব না । তাহারা সবকিছু লইয়া বড় রাজনীতি করিয়া থাকে ।

    কিন্তু আমার মস্তিষ্কে একটি ভিন্ন চিন্তারও উদয় হইয়াছে । হয়তো তাহা এই রোগেরই প্রলাপ বলিয়া বোধ হইতে পারে । এই চিন্তাটিও পরস্ত্রীবিষয়ক মূলত, তাই সাবধানেই বলিতেছি । ইহারা, অর্থাৎ কন্যা জামাতা আমাদিগকে লইয়া, খাওয়াইয়া বা না খাওয়াইয়া যাহা ইচ্ছা হয় করুক, দু:খ নাই । কিন্তু একজন সুস্থ-সবল, নির্দোষ মহিলা চটক-পক্ষীর আহারে অকালে ঝরিয়া যাইবেন, ইহা বড়ই পরিতাপের কথা । পাঠক, বিশ্বাস করুন, আমার এই `ক্লেশ' নিতান্তই মানবিক ধর্মসঞ্জাত, কেহ ইহার অর্থান্তর খুঁজিবেন না । আমার গৃহিণী পর্যন্ত এই বিষয়ে আমার সহিত সহমত । অবশ্য এই সহমত ব্যাপারটা তাঁহার অভ্যস্ত স্বভাবধর্ম নয় বলিয়া কিঞ্চিৎ স্বস্তির অভাবও বোধ করিতেছি । কোথা হইতে কী হইবে বলাতো যায় না । যাঁহার গর্ভজাতা কন্যা মাতা-পিতৃ ধন বিষয়ে এতটা বৈরাগি, তাহার মাতার নিজ স্বামী বিষয়ে বৈরাগ্য উদয় হইবে, ইহাতে আশ্চর্য কী ? বিশেষত বিগত বত্সরকাল ধরিয়া তাঁহার স্বামী বাতের অজুহাতে যে ভাবে সকলকে বাত্যাহত করিয়া নাস্তানাবুদ করিতেছে, তাহাতে বৈরাগ্য তো ভদ্র মানসিকতা, গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলার ইচ্ছা হইলেও এমন কিছু বাড়াবাড়ি হয়না । এখনো যে মারে নাই তাহা নিতান্তই লোকলজ্জার খাতিরে ।

    এইসব চিন্তা এখন আমার মাথায় অহর্নিশি কিলবিল করিতেছে । সব অবস্থার কথা ডাক্তারকে বলিবারও নয়, ফুরসতো পাইনা । তাই মন খুলিয়া দুই চারিটি কথা বলিবার জন্য ফোনযোগে সর্বপ্রথম যে অস্থি-বিশেষজ্ঞকে দেখাইয়াছিলাম, তাঁহাকে বাড়িতে আমন্ত্রণ করিলাম । ইনি আমার পরম আত্মীয় । আমার এক ডাক্তার দিদির স্বামী । ইনিই বলিয়াছিলেন, ডাক্তারি শাস্ত্রে `বাত' বলিয়া কোনো রোগের কথা নাই । ইনি রোগ সারাইতে না পারিলেও, ইঁহাকে লইয়া সুবিধা এই যে ভিজিটের টাকা সেক্ষেত্রে খরচ হয়না । উপরন্তু তাঁহার সহিত এন্তের আড্ডা মারা যায় ।

    আশ্চর্যের বিষয় তিনি আসিয়া তাঁহার ও তাঁহার পত্নীর অর্থাৎ আমাদের দিদির কোমর ও হাঁটুর সমস্যা বিষয়ে বিস্তর কথা ফাঁদিয়া বসিলেন । কোথায় আমাদের `ব্যায়রামের' কথা তাঁহাদের কাছে বলিব, উল্টা তাঁহারা তাঁহাদের `কেত্তন' শুনাইতে বসিলেন । আগে বলি নাই, বাতের ব্যথাটা শুধু আমার নহে, আমার গৃহিণীরও হাঁটুকে তাহা প্রবল বিক্রমেই আছে । পুরুষদের এই একটা মস্ত দোষ, নিজেরটাই বড় করিয়া দেখে । যাই হউক, কোনোক্রমে আমার এলোমেলো চিন্তার কথা তাঁহাকে বলিলাম । আশ্চর্য, তিনি বলিলেন, তাঁহারও নাকী এইরূপই হয়, ইহা `বাতেরই' প্রকাশ ।

    অবাক কাণ্ড, তিনি বাতকে বাত বলিয়াই উল্লেখ করিলেন । কহিলাম, তাহা হইলে স্বীকার করিতেছেন বাত বলিয়া একটা জিনিস আছে ? তিনি ঝটিতি গাত্রোথ্থান করিয়া, ঝাঁঝি মারিয়া বলিলেন । এই জন্যেই তোমার সহিত কথা বলিয়া সুখ পাইনা । সব সময়ই তোমার কথায় কিছু খোঁচা থাকে । তোমার কী ধারণা আমি বাত লইয়া `বাতোকি বাত্‌' করিতেছি ? বাত বলিব না তো কী সারাজীবন একজন কোমর বাঁকাইয়া, অন্যজন হাঁটু দুমড়াইয়া চলিব ? - এই বলিয়া তিনি সবেগে প্রস্থানোদ্যত হইয়া বেমক্কা কোমরে মোচড় খাইয়া পুনরায় বসিয়া পড়িতে বাধ্য হইলেন । সহমর্মিতা দেখাইয়া কোমল স্বরে তাঁহাকে কহিলাম, সম্প্রতি আপনাদের এই হাড়-বিশেষজ্ঞদের বেকার বড়িগুলা গিলিয়া ক্লান্ত হইয়া এই আয়ুর্বেদিক তৈলটি আনাইয়াছি । ইহার নাম গুঠিয়ার তৈল । গুঠিয়া বরিশালের একটি বিখ্যাত গ্রাম । বস্তুত, এই তৈলের জন্যই তাহার এত নাম যশ । বরিশালবাসীদের যে দুর্দমনীয় কোমর বা মাজার জোরের কথা শোনা যায়, তাহার গোপন কথা এই তেল । যদি অনুমতি করেন, একটা পাত্রে খানিক ঢালিয়া দিই, মালিশ করিয়া দেখিতে পারেন । শীতের মিঠা রোদ্দুরে, বাড়ির নির্জন ছাতে বসিয়া আপনি দিদির পায়ে এবং `আড়ুতে' (হাঁটুতে) এবং তিনি আপনার `মাজা' বা কোমরে একটু সপ্রেমে মালিশ করিলে খুব মন্দ লাগিবে না । আপনারতো আবার একটা নিখাদ পূণ্য লাভেরও সম্ভাবনা । পদসেবার এমন সুযোগ সচরাচর পাওয়া যায়না । তাহা ছাড়া আপনারা পরস্পর অতি নিকট আত্মীয় এবং একে অপরের বাতের ব্যথিক । শুধু নিজস্ব চিকিত্সা ব্যবসায়ের স্বার্থে তৈলের মন্ত্রগুপ্তিটা রোগীদের গোচরে না আনিলেই হইল । ব্যবসা নষ্ট করিয়া রোগীর সেবা কোনো কাজের কথা নহে । আমি আপনার এই অবৈজ্ঞানিক আচরণের কথা কাহাকেও বলিব না ।

    মহাশয় আমার কথা শুনিয়া আমার দিকে একটা ত্রক্রুদ্ধ চাউনি দিয়া উঠিয়া পড়িলেন এবং দিদিকে ডাকিয়া দ্রুত কক্ষ ত্যাগ করিলেন । অবশ্য যাইবার কালে তৈলের পুরা শিশিটাই হস্তগত করিতে ভুলিলেন না ।

    (পরবাস-৪৪, ডিসেম্বর, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments