• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৩ | জুলাই ২০০৯ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • বোর্নিও ! : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    বোর্নিও ! গভীর, গহীন, অন্ধকার জঙ্গল । বোর্নিওর নামই এরকম গা ছমছম করার মতো । মনে করায় রহস্যময় প্রাচীন উপজাতি, আর প্রাগৈতিহাসিক জঙ্গল । পৃথিবীর তৃতীয় বিশাল দ্বীপটি এই একবিংশ শতাব্দীতেও তার অভ্যন্তরে কতো না না-জানা রহস্যকে লুকিয়ে রেখেছে ।

    ইদানীং আরো অনেক জায়গার মতো বোর্নিওরও নাম বদল হয়েছে । দ্বীপটির বেশিরভাগই ইন্দোনেশিয়ার অন্তর্গত -- তার নাম এখন কালিমান্টান । আমার কিন্তু বোর্নিও নামটাই ভালো লাগে । ইন্দোনেশিয়ার আঠারো-শ দ্বীপের মধ্যে এইটাই সবচেয়ে বড়ো এবং সবথেকে কম ট্যুরিস্ট অধ্যুষিত । দ্বীপটির মাঝখানের পুরোটা এখনো অনাবিষ্কৃত । জঙ্গলে ভর্তি ও দুর্গম । ম্যাপেও বিশেষ চিহ্ন দেখা যায় না । ভিতরে যাতায়াত করার জন্যে নদীনালায় নৌকা এবং গাইড হিসেবে স্থানীয় অধিবাসীদের উপরে নির্ভর করতে হয় । সে-রকম ট্রেকিং আমার সাধ্যের বাইরে । তাই শুধু আশেপাশের জঙ্গলেই যাবো ঠিক করেছিলাম ।

    বোর্নিওর উত্তর-পশ্চিম কোণটা মালয়েশিয়ার অন্তর্গত । যতো ছোটোখাটো শহর, গ্রাম. মানুষের বসতি, বন্দর ইত্যাদি দ্বীপটির বাইরের দিকেই । ভেতরটা বেশ অগম্য । আমি শুধু দ্বীপের দক্ষিণ তটের জঙ্গলে পদার্পণ করেছিলাম । সমুদ্রে পায়ের বুড়ো ডোবানোর মতো । কিন্তু তাতেই প্রত্যক্ষ করেছিলাম জঙ্গলের আদিম আকর্ষণ ।

    পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বোর্নিওর জঙ্গলও সাম্প্রতিক কালে মানুষের `সভ্যতার' বলি হতে চলেছে । উনিশ-শ' শতাব্দী হতেই ব্রিটিশ ও ডাচ উপনিবেশকরা এই দ্বীপে রবার ও পেট্রোলের সন্ধান পেয়েছিলো । তখন থেকেই মাটি খোঁড়া ও গাছ কাটা শুরু হয় । বিংশ শতাব্দীতে ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য জনবহুল দ্বীপ থেকে সরকার লোক সরবরাহ শুরু করে বোর্নিওতে । এরা সবাই জঙ্গল কেটে বসতি শুরু করে । গাছ কেটে কাগজ তৈরি, কৃষিভূমি বানানো ইত্যাদির জন্যে শুধু প্রাণীদেরই ক্ষতি নয়, স্থানীয় ডায়াক অধিবাসীদেরও উত্খাত করা হয়েছে । এখন তাদের জীবনযাত্রা বিপন্ন ।


    আমাদের গাইড আনং


    পুরোনো দিনের মতো উল্কি-কাটা, কান-ঝোলানো গয়না-পরা উলঙ্গ ডায়াকদের এখন আর দেখা যায় না । দেখা পেতে হলে আপনাকে গভীর জঙ্গলে যেতে হবে । কিন্তু শহরে গ্রামে আধা-ডায়াক লোকেরা প্রচুর । ডায়াক উপজাতির কিছু কিছু সভ্যতা তারা এখনো জিইয়ে রেখেছে ।

    বোর্নিও বা কালিমান্টানে যেতে হলে প্লেনে জাকার্তা বা বালি (ডেনপাসার) থেকে প্যাংকালা বুন নামে ছোট্ট শহরে যেতে হয় । তারপর ক্লটক বা মোটর লাগানো ডিঙি নৌকা চড়ে দ্বীপের অভ্যন্তরে যাওয়া যায় । ভেতরে রাস্তাঘাট নেই । নদীই এদের হাইওয়ে । নদীতে বর্ষায় জল উঠলে অনেকদূর যাওয়া যায় । জল কম থাকলে ? -- হন্টন ।

    প্লেন আমরা নিয়েছিলাম ডেনপাসার থেকে । এতো ছোটো প্লেন যে দশ কেজি-র বেশি লাগেজ নিতে দেয় না । তাছাড়াও প্রত্যেক যাত্রীকে ওজন করা হয় । বেশি মোটা হলে হয়তো কোনো লাগেজই তাকে নিতে দেবে না । প্লেম ছাড়েও যখন ইচ্ছে । আমাদের হাতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত টিকেট ছিলো না । যদি বা টিকেট পেলাম, তাতে তারিখ লেখা কিন্তু সময় নয় । যখন প্লেম ভর্তি হবে তখন ছাড়বে । সেই ভারতীয় জনতা বাসের মতোই । ফেরৎ আসার সময়ও তাই । কেউ কিন্তু কোনো প্রতিবাদ করলো না । কারুরই তাড়া নেই । সব গয়ংগচ্ছ ভাব । আমেরিকা থেকে সদ্য আসা আমরা গিয়ার শিফট করলাম মনে মনে ।


    ত্যানজুং পুটিং ন্যাশনাল পার্ক


    জাভা, বালি ইত্যাদির তুলনায় বোর্নিওতে ইংরেজির চল খুব কম । তাই গাইড না হলে মুশকিল । তারপর আমরা যাচ্ছিলাম বোর্নিওর সবথেকে বিখ্যাত ন্যাশনাল পার্কে -- ওখানে এক লক্ষ একর জঙ্গল । গাইড না হলে প্রাণ সংশয় । প্যাংকালা বুন থেকে আমরা নিখ্যাত ত্যানজুং পুটিং ন্যাশনাল পার্কে যাচ্ছিলাম । পাংকালান বুন থেকে ট্যাক্সি করে কুমাই শহরে--ছোট্ট শহর কুমাই নদীর তীরে । বেশিরভাগ লোকের কাজ মাছ ধরা, ট্যুর চালানো, অথবা স্থানীয় খনিতে চাকরি । পার্কের খুব কাছে অনেকখানি জমি খুঁডে সোনার খোঁজ হয়েছে । সেটা পরিষ্কার করে বের করতে পারদ লাগে--কাজ শেষ হলে সেই পারদ নদীতে ঢেলে দেওয়া হয় । আশে পাশে সব নদীতে পারদ ভর্তি--জল খাওয়া ইত্যদি সব মানা । মাছেও পারদের মাত্রা প্রচুর । সোনা বিশেষ পাওয়া গেলো না কিন্তু পারদের বিষ বয়ে গেলো জলে ও মাটিতে । সরকারী নিষেধ সত্ত্বেও দুর্গম অরণ্যে লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে । সবাই ঘুষ নিয়ে চোখ ফিরিয়ে রাখে ।

    কুমাইয়ে আমরা প্রথম দেখলাম ক্লটক -- ছয়-বাই-দুই মিটার লম্বা নৌকা ; ওপরে পাটাতনে ছাউনি দেওয়া, নীচে গাইড ও রাঁধুনির থাকা খাওয়ার জায়গা, পেছনে একটা ছোট্ট বাথরুম । ব্যস । একটা আউটবোর্ড মোটর লাগানো । তাই নিয়েই ঘুট ঘুট করে চলে । এটাই স্থানীয় সবার যাত্রীবাহী যান ।

    ক্লটকে ওঠাটাও বেশ মজার । কুমাই শহরে তেমন বাঁধানো ঘাট কম । নৌকাগুলি সব একজোট হয়ে নোঙর ফেলে থাকে । আমাদের নৌকায় ওঠার জন্যে আমাদের সাতটি নৌকায় চড়ে, নেমে তারপরে আমাদেরটা পেলাম । প্যারালেল পার্কিং সাত গুন ।

    আমাদের গাইড আনাং (অনঙ্গ ?) ছিলো আধা ডায়াক -- মা ডায়াক, বাবা জাভার লোক । আনাং অল্পবয়সী, খুব আমুদে, চটপটে আর খোলা মন । সে-ই ছিলো আমাদের সর্ব কর্মকর্তা ।

    নদীতে ডিসেম্বরে প্রচুর জল । তখন ওদেশে বর্ষা (অক্টোবর - এপ্রিল) শুরু হয়ে গেছে । রোজ দু-তিন পশলা মৌসুমী বৃষ্টি হয়ে যায় -- মেঘ টেঘ ডাকিয়ে, মহা সমারোহে । দেশের কথা মনে পড়ায় -- বর্ষাকাল আমার খুব প্রিয় সময়, যদি না আফিস কাছারি করতে হয় অথবা ঘরকন্না সামলাতে হয় । তাদের পক্ষে বর্ষাকাল খুব অসুবিধার কিন্তু ভ্রমণকারীর পক্ষে কিংবা ছোটো ছেলেমেয়েদের কাছে অথবা ঘরে বসে থাকা অলস, ধনী, কবির পক্ষে বর্ষাকাল সবথেকে ভালো সময়--অলসতার কাব্য করবার, গল্প পড়বার, লিখবার, শোনাবার ও শুনবার এবং গরম খিচুড়ি সহযোগে বেগুনি খাওয়ার । তাই বোর্নিওতে বর্ষা পেয়ে আমি তো আহ্লাদে আটখানা । এ যেন না চাইতেই উপরি পাওয়া ।


    রিমবা লজ


    কুমাই নদীটি এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে বোর্নিওর অভ্যন্তরে । কুমাই শহর থেকে আমাদের ক্যাম্প নদীতে তিনঘন্টার রাস্তা । দু'ধারে ঘন জঙ্গল, নদীর ঠিক পাড়েই নলবাঁশ, সুন্দরী গাছের ঝোপ আর অনেকটা তালপাতার (`অয়েল পাম্‌') মতো বেঁটে গাছ যার ফলগুলো বাঁদরদের খুব প্রিয় । তার পরেই শুরু হয় উঁচু গাছ যাদের আমি নামও জানি না । তাদের গায়ে নানারকমের অর্কিড আর ব্রোমেলিয়াড । বেশিরভাগই নদীতে জোয়ার এলে ডুবে যায় ।

    পারদ ছাড়াও জলে আছে কুমীর । একজন ব্রিটিশ ট্যুরিস্ট নদীতে চান করতে গিয়ে মারা গেছে কয়েক বছর আগে ; তাই নদীতে নামা নিষেধ ।

    নদীর ধারেই একটা স্থানীয় থানায় আমাদের পাসপোর্টের জমা দিতে ও নামধাম সব জানাতে হলো । এমনকী উত্তরাধিকার্রীর নাম-ঠিকানাও । যদি বেঁচে না ফিরি তো কাউকে খবর দিতে হবে তো !

    সোনার খনন যদিও আরে হয় না, তার জায়গায় বেআইনী সিলিকা (বালি) খোঁড়া এবং পাম অয়েলের ব্যবসা করার খুব চল হয়েছে । এসব খনিগুলি ন্যাশনাল পার্কের কাছেই -- স্পীডবোটে হুস হুস করে কর্মীরা যাতায়াত করে -- দেখলেই বোঝা যায় এরা মেছুনী নয়, ট্যুরিস্টও নয় । গাছ কাটা তো চলছেই । এখন বোর্নিওর অভ্যন্তরেও গাছ পড়ছে, কাগজ, টয়লেট-পেপার আর চপস্টিকের আগ্রাসী চাহিদা মেটাতে । বেআইনী খনির কর্মীরা ট্যুরিস্টদের খুব ভালো চোখে দেখে না । তাই আমরা যথাসম্ভব ওদের এড়িয়েই চলছিলাম ।

    ক্লটক নৌকাগুলো বেশ আরামের । ধীরে ধীরে পাড় ঘেঁসে চললে অনেকরকম পাখি. বাঁদর, কুমীর ইত্যাদির দেখা তো মেলেই ; আর ট্রেকিং-এর হাড়ভাঙা খাটুনির থেকেও বাঁচা যায় । আমার বেশিরভাগ বনদর্শনই হয়েছে এই নৌকায় চেপে । বনের অভ্যন্তরের পাখি দেখার জন্যে একদিন চেষ্টা করেছিলাম--ভোর বেলা উঠে গাইডের সঙ্গে চলেছি, কিন্তু তখনই গরম ও আর্দ্রতা এতো বেশি যে পাঁচ-মিনিটেই এমন ঘেমে গেলাম যেন নদীতে ডুব দিয়ে উঠেছি । রাস্তা সরু ও পিচ্ছিল । কতোবার যে পা পিছলে আর হোঁচট খেয়ে পড়লাম ! ঘামের গন্ধে খুদে খুদে মশারা ছেঁকে ধরেছে -- চোখে, নাকে কানে ঢুকে যায় } পাখি দেখবো কি, নিজেকে সামলাতেই ব্যস্ত । গভীর বন বলে নীচে এতোটুকু হাওয়া নেই । আশেপাশে হাজার পাখির ডাক শুনছি কিন্তু তাদের দেখা পাওয়া দু:সাধ্য । বোর্নিওর জঙ্গল সত্যি গভীর ; ভীষণ কঠিন জায়গা -- আমার মনে হয় আমাজনের থেকেও ।

    তাই ঠিক করলাম আমার মতো অলস ট্যুরিস্টের জন্য নৌকাই ভালো । আমরা খাওয়া -দাওয়াও নৌকাতেই করতাম । অত ছোট্ট জায়গায় কি করে যে এমন সুস্বাদু ফ্রায়েড নুডল্‌, ভাজা মাছ (হয়তো পারদ-ভরা, কিন্তু দারুণ স্বাদ) আর নানারকমের ফল -- কয়েকটা, যেমন রুমবুটান, প্যাশনফ্রুট, ম্যাঙ্গোস্টিন আমি আগে কখনো খাইনি । অবশ্য সঙ্গে পুরোনো বন্ধুর মতো দেখে পেয়েছিলাম আম. আতা, কাঁঠাল, ডাব, নারকোল, পেয়ারা ও আরো কতো কিছুর । আর কেনা শব্জীরও কতো রকমফের -- এক বেগুনেরই ছয় রকম রূপ -- ছোট্ট খুদে আঙুলের মতো সাইজ, গোল সাদা রঙের, মোটা, সরু ইত্যাদি । খেয়ে সত্যিই মজা ওদেশে ।


    তাম্বারু


    অ্যালকহলের চল নেই । কারণ মুসলমান দেশ } হিন্দু বালি ছাড়া আর কোনো দ্বীপেই রেসট্যুরান্ট-এ বিয়ার পাওয়া যাবে না । আমরাও গা করিনি । আরেকটা অদ্ভুত ফল নদীর ধারে ধারে ফলে থাকতে দেখালাম--তাম্বারু তার স্থানীয় নাম । বিরাট তালের সাইজ--প্রায় তিরিশ-চল্লিশটা ছোটো ছোটো ফল একত্র করে হয়েছে । ভারীও খুব । ভেঙে ভেতরে তালশাঁসের মতো নরম সুস্বাদু ফল পাওয়া যায় । রমজানের সময় বিকেলে ওইটা নাকি স্থানীয় লোকেদের প্রিয় খাবার । আনং নৌকা দিয়ে গুঁতিয়ে কয়েকটা পেড়ে আনলো আমাদের জন্যে । ভারী মিষ্টি ও নরম । খোসাগুলো বাঁদরদের প্রিয় । এই জঙ্গলে কিছুই যায় না ফেলা ।


    আমাদের ঘরটিতে জুলিয়া রবার্টস-এর পদার্পণ হয়েছিলো


    কুমাই থেকে তিনঘন্টা উত্তর-পশ্চিমে নদীর পাড় ঘেঁসে ইন্দোনেশিয়ার গর্বের ন্যাশনাল পার্ক -- তানজুং পুতিং । সেখানে থাকার জন্য সরকার `ইকো-লজ্‌' বানিয়েছে । কাঠের পাটাতনের ওপর ছোটো ছোটো কেবিন --সবটাই জলার ওপর । বোর্ডওয়াক দিয়ে হাঁটা-চলা করতে হয় । চারিদিকের ঘন জঙ্গল পর্দার কাজকরে । কয়েকটা ঘর এয়ার-কণ্ডিশণ্ড, পাখাও আছে । আর আছে সবথেকে জরুরী--মশারি । অ্যাটাচড বাথ আছে । একেবারে পাঁচতারা ব্যবস্থা -- সুদূর জঙ্গলে । খাওয়ার ঘরে তিনবেলা খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে, কিন্তু আমরা ভাড়া নৌকাতেই খাওয়াটা সেরে নিতাম । লজের নাম রিমবা লজ্‌ (রিমবা মানে জঙ্গল) । আরামে বসে জঙ্গলের রূপ দেখার পক্ষে রিমবা লজের তুলনা হয় না । ওরাং উটাং দেখার জন্য এই লজই সবচেয়ে প্রশস্ত । তাই সব নামকরা লোকেরা এখানেই ওঠে । আমাদের ঘরটিতে জুলিয়া রবার্টস-এর পদার্পণ হয়েছিলো । ওই খাটে এবং ওই মশারির নীচেই যে ভদ্রমহিলা শুয়ে গেছেন সেটা কর্মচারীরা বেশ ফলাও করে জানিয়ে দিলো ।


    বুনো শুয়োর


    ইন্দোনেশিয়া বিষুবরেখার দুপাশে তিন হাজার মাইল ছড়ানো বিশাল দেশ । এদেশে নাকি ছোটো বড়ো মিলিয়ে ১৮,০০০ দ্বীপ আছে -- সঠিক নম্বর কেউ জানে না কারণ ভাঁটার সময় আরো দ্বীপ নজরে পড়ে । দেশটার মাঝামাঝি একটা উত্তর-দক্ষিণ দাঁড়ি টানলে সেটাকে `ওয়ালেস' লাইন বলা যায় । বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়ালেস-- ডারউইনের সমসাময়িক -- একই সময়ে আলাদা আলদা ভাবে `ইভল্যুশন' বা বিবর্তনবাদ আবিষ্কার করেন । ডারউইনের ল্যাবরেটরি ছিলো পশ্চিম গোলার্ধে গালাপাগোস দ্বীপ আর ওয়ালেস পূর্ব গোলার্ধে সুমাত্রা আর বোর্নিওর জন্তু, পাখি, গাছপালা নিয়ে গবেষণা করেন । `ওয়ালেস লাইন'এর পশ্চিমে বেশিরভাগ পশুপাখি ও গাছপালা এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো আর লাইনের পূব-দিকের প্রকৃতি অস্ট্রেলিয়ার মতো । এই এক অপূর্ব দেশ যেখানে দুই মহাদেশের সম্মিলন হয়েছে ।

    এক বোর্নিওতেই তিন-চারশ' রকমের গাছপালা ও পশুপাখি আছে । অনেক নতুন জাতিও আবিষ্কার হচ্ছে । সপ্রতি একটা এইডস্‌-বিরোধী ওষুধেরও খোঁজ পাওয়া গেছে এই জঙ্গলে । কিন্তু জঙ্গল-সাফের সঙ্গে সঙ্গে এসবও দ্রুত সাফ হয়ে যাচ্ছে -- আমরা ভালো করে জানবার, চেনবার আগেই ।


    প্রবসিস বানর


    বোর্নিওর সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ -- ওরাং উটাং । পৃথিবীর এই একটি দেশেই এদের দেখা যায় এবং আফ্রিকার বাইরে বড়ো `এপ' বলতে এই একটাই । জঙ্গলে কিন্তু ওরাং-উটাং (স্থানীয় ভাষায় `জঙ্গলের মানুষ') ছাড়াও আরো আট রকমের বাঁদর আছে । নদীর তীর থেকে দুটো সবসময়ে দেখা যায় -- একটা আমাদের পরিচিত ম্যাকাক আর দ্বিতীয়টা প্রবসিস ( Proboscis ) বানর । আর অভ্যন্তরে দেখা যায় বেশ বড়ো সাইজের গিবন । প্রবসিস বাঁদরের নাকটি বিরাট, লাল, এবং ঠোঁট অবধি ঝুলে থাকে । লাল নাক বলে স্থানীয় লোকেরা তাদের ট্যুরিস্ট বাঁদরও বলে । গরমে সাদা চামড়ার লোকেদের নাক লাল হয়ে যায়, এই তথ্যের সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণে ঠাট্টার সংমিশ্রণে প্রবসিস-এর এই স্থানীয় নামকরণ । প্রবসিস বাঁদররা খুব চালাক । জলে কুমীর বলে নদী সাঁতরে পার হতে হলে ওরা স্পীডবোটের জন্য অপেক্ষা করে । কুমীররা স্পীডবোটের কাছে আসে না । যদি আশে পাশে বোট না থাকে তাহলে ওরা দলের একজনকে প্রথমে নামায় --সে নিরাপদে পার হতে পারলে বাকি বাঁদররা জলে নামে । ওই অভাগাকে কি করে যে বেছে নেওয়া হয় সেটা কিন্তু জানি না ।

    জঙ্গলের ভেতর বুনো শুয়োর আর নানারকম সাপ-- কেউটে, ক্রেট-এর মতো বিষাক্ত এবং পাইথনের মতো বিশাল । এছাড়া হরেক রকম পোকামাকড়ের তো কথাই নেই । আর অছে বিরাট বিরাট সুন্দর রঙের প্রজাপতি -- উড়লে অন্ধকার জঙ্গল আলো হয়ে যায় ।


    কালো হর্নবিল


    আর পাখির সমারোহ ! আমার ভীষণ পাখি দেখার শখ । ছুতো পেলেই বাইনোকুলার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি । থাইল্যাণ্ড, জাভা, ও বালিতে আমায় হতাশ হতে হয়েছে -- পাখি খুব কম -- দু'একটা ঘুঘু আর সোয়ালো ছাড়া শহরে, শহরতলিতে, ধানের মাঠে, বাড়ির বাগানে কোথাও পাখি দেখিনি । এর সঠিক কারণও আমার জানা নেই ।


    কুকাল পাখি


    বোর্নিওর জঙ্গলে এসে আমার সব ক্ষোভ মুছে গেলো । চারিদিকে অজস্র পাখির কলরব । মুশকিল হলো ঘন জঙ্গল ভেদ করে তাদের দেখা । কিন্তু নদীর ধারে ফাঁকা বলে দেখা পাওয়া সহজ । এইভাবেই আমরা দেখেছি কুকাল পাখি--পোড়া ইঁটের মতো গায়ের রঙ । দেখেছি হরেক রঙের মাছরাঙা, ডলার বার্ড, জংলী ময়না (ভারতীয় ময়নার থেকে আলাদা), ঘুঘু, আর কালো হর্নবিল--লোকেরা যাকে শুভচিহ্ন মনে করে ।


    ক্যাম্প লিকী

    তানজুং পুতিং হচ্ছে ওরাং-উটাং দেখবার পক্ষে সবচেয়ে প্রশস্ত জায়গা । নদী দিয়ে যেতে যেতে নিপা গাছের ডালের ফাঁকে লালচুলের ঝিলিক দেখা যায় । এই পার্কে আছে পৃথিবী-বিখ্যাত ক্যাম্প লিকী--কেনিয়ার সেই প্রসিদ্ধ জীববিজ্ঞানী লুই লিকীর ছাত্রী বিরুতে গালদিকাস ১৯৭০ সালে এই জঙ্গলে ওরাং-উটাংদের সুরক্ষার জন্য একটা নিবাস গড়ে তুলেছিলেন । দেখাশোনা ছাড়াও এই বিরাট জন্তুগুলির আচরণ, ব্যবহার, জীবনযাত্রা সম্বন্ধে গবেষণা করাও তাঁর লক্ষ্য ছিলো । এখন এই ক্যাম্পে সারা পৃথিবী থেকে বিজ্ঞানী ও ট্যুরিস্টরা (জুলিয়া রবার্টস পর্যন্ত) এসে থাকে । ক্যাম্পে কোনো জন্তু খাঁচায় বন্দী নেই । সবাই জঙ্গলে ছাড়া বন্য পশু ।

    প্রধান ক্যাম্প ছাড়া দুটি ছোটো শাখা-ক্যাম্প আছে । সবগুলিই দু'-তিনটি কাঠের কামরা শুধু । তাইতে দু'তিনজন করে স্থানীয় কর্মচারীরা থাকে -- এরা জঙ্গলের সব ওরাং-ওটাংদের চেনে ও নাম দিয়েছে । ইদানীং সিনেমার তারকার নাম দেওয়া চল হয়েছে । বলিউডের হিন্দী সিনেমা সারা দেশে খুব জনপ্রিয় । তাই আগামী ওরাং-উটাংয়ের নাম দেবে শাহরুখ কিংবা ঐশ্বর্য ! কল্পনা করুন বোর্নিওর জঙ্গলে বলিউডের তারকা । (কিন্তু জুলিয়া রবার্টসের নাম কেউ চাইলো না !)

    রিম্বা লজ্‌ থেকে ক্যাম্প লিকী নৌকা করে ঘন্টাখানেকের রাস্তা । তারপর দুর্গম জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে হয় কিছুটা । সেইটুকুতেই বৃষ্টিতে ভিজে, ঘামে নেয়ে, কাদা মেখে, মশার কামড় খেয়ে ভূত হয়ে যাই সবাই ।


    খাওয়ানো হচ্ছে

    সারা পার্কে প্রায় দেড়শ ওরাং আছে-- বেশিরভাগই অন্য জায়গা থেকে আনা । যখন জঙ্গল কাটা হয় অনেক পশু মারা যায়--কয়েকটা বাঁচানো যায়, কয়েকটা পাচার হয়ে যায়, আর কিছু অনাথ হয়ে ঘোরে । এদের যত সম্ভব একটা নিরাপদ জায়গায় বদলি করা হয়-- এটাই হলো ক্যাম্প লিকী । এরা জঙ্গলেই খায় দায় । কিন্তু একটু বাড়তি সাহায্যের জন্য কর্মচারীরা দিনে একবার--সকাল কিংবা দুপুরে--তিনটি ক্যাম্পে ভোজ দেয় । দুধ আর কলা--তাই খেতে ঠিক সময়ে দলে দলে ওরাং এসে হাজির হয় । তখনই এদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া যায় । শুধু ওরাংই নয়--মাগনা খাওয়ার লোভে আসে গিবন, বুনো শুয়োর, জংলী পাখি, ইত্যাদিও ।


    ভীষণ অ্যাক্রোব্যাটিক

    ওরাং-উটাংরা অবিশ্বাস্য রকম ভাবে মানুষের মতো । তাদের চোখ, মুখ, মুখের ভাব, বসার ধরন, আচার-আচরণ আপনাকে কোনো চেনা মহিলা বা পুরুষের কথা মনে পড়িয়ে দেবেই । ভীষণ অ্যাক্রোব্যাটিক । সার্কাসের যে-কোনো ট্রাপিজ খেলোয়াড়কে হার মানাবে । পুরুষ ওরাং সাইজে অনেক বড়ো এবং গালের দুপাশে চামড়ার থলি যা ফুলিয়ে ভয় দেখানো আওয়াজ করে । একজন পুরুষের পরিবার হিসেবে চার পাঁচ জন মেয়ে ও ডজন খানেক বাচ্চা ওরাং । সবাই পুরুষের মেজাজ মেনে চলে ও পুরুষের সামনে মেয়েরা তটস্থ হয়ে থাকে অথবা বাচ্চা সঙ্গে থাকলে আড়ালে পালায় । এমনিতে এরা মানুষকে আক্রমণ করে না কিন্তু খুব শক্তিশালী বলে চড়-চাপড় লাগাতে পারে । গলায় ঝোলানো ক্যামেরা ইত্যাদিতে টান মারতে পারে -- টিনএজ ওরাংরা মানুষের মতোই দুষ্টু ও কৌতূহলী ।


    ওরাং-উটাংরা অবিশ্বাস্য রকম ভাবে মানুষের মতো

    পুরুষ ওরাংদের থেকে আমরা কিছুটা দূরত্ব রাখতাম কিন্তু মেয়ে ওরাংরা বেশ শান্ত । একটা কলা এগিয়ে দিলে বেশ দু-হাত বাড়িয়ে নেয় আর খোসা ছাড়িয়ে ঠিক মানুষের মতো পরিষ্কার করে খায় । আমার হাত থেকে সহজেই কলা নিত কিন্তু আমার স্বামী কলা বাড়িয়ে দিলেই লজ্জায় নোতুন বউএর মতো মুখ লুকাতো । পরে জানলাম সব পোচাররাই পুরুষ তাই হয়তো পুরুষ মাত্রেই ওরা ভয় করে ।


    মা ও সন্তান

    ওদের চোখের দৃষ্টি এতো গভীর ও বাঙ্ময় যে তাকালে চমকে উঠতে হয় । ইচ্ছা করে জিজ্ঞেস করি কী ভাবছো ? কেমন এই জীবন ? অনেক সময়ে আমি চুপ করে বসে এই বিশাল অথচ অসহায় প্রাণীগুলিকে দেখেছি-- একটি মা তার বাচ্চা নিয়ে বসে । মা মাটির ফাঁকে কিছু খুঁড়বার চেষ্টা করছে অলসভাবে । শিশুটি এদিক ওদিক ছুটছে । পাতা বা ডাল নিয়ে খেলছে, দোল খাচ্ছে । মাঝে মাঝে ছুটে আসছে মার কোলে । মা অন্যমনস্কভাবে একটু আদর কারে থাপড়ে দিলো । আবার বাচ্চাটা খেলতে চললো । মার কিন্তু নজর আছে-- বাচ্চাটা জলের ধারে গেলেই নড়া ধরে টেনে নিয়ে আসে । একটা চাপড় লাগায় । ব্যস, শাসন হয়ে গেলো । বাচ্চাটি আর ওদিকে যাবে না ।

    উরসুলা বলে একটি মেয়ে বাঁদরকে আমি দেখেছিলাম । উরসুলা বেশ বয়স্ক এবং বুদ্ধিমতী -- তালাচাবি খুলতে পারে--ছিটকিনি খুলে ভেতরে এসে কলার ঝুড়ি সাবাড় করে যায় । কেউ বাধা দিলে দু'তিনটে চড়-চাপড় দিলেই কাজ হয় ।


    উরসুলা

    সেদিন খাবার দেওয়ার সময় তুমুলধারে বৃষ্টি শুরু হলো । টিনের চালে ঝমাঝম বাজনা । মুহূর্তের মধ্যে সামনের উঠোনটা একেবারে পুকুর । কর্মচারীরা ঠিক করলো আজ আর খাবার দেবে না--বৃষ্টি না-থামা পর্যন্ত ।

    কিন্তু খবরটা ওরাংদের মন:পূত হয়নি-- বিশেষ করে উরসুলার-- সে লম্বা লম্বা পায়ে ক্যাম্পের দিকে চললো । কর্মচারীরা অমাদের বললো ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রাখতে-- ডাবল তালা দিয়ে । উরসুলা জানলার বাইরে বসে তারের ফুটোর মধ্যে আঙুল গলিয়ে ছিঁড়বার চেষ্টা করছে, আর ভেতরে বন্দী আমরা ক'টি মানুষ । আমার হঠাৎ মনে হলো এ-যেন ঠিক উলটো চিড়িয়াখানা ! মানুষরা খাঁচায় আর জানোয়ারেরা বাইরে থেকে উঁকি মারছে ।

    বোর্নিওতে কয়েকটা দিন খুব আনন্দে কেটেছিলো । দু:খ হয় যেভাবে জঙ্গল কেটে বসতি হচ্ছে তার কথা ভাবলে । কিন্তু কী আর করা । জনসংখ্যা বাড়ছে--মানুষ আগে না জঙ্গল ? সভ্যতার অগ্রগতি কে রুখতে পারে । তবু আশা করি তানজুং পুতিং-এর মতো সুরক্ষিত বনগুলি অন্তত অক্ষত থাকবে -- তাদের গহীন অরণ্য ও রহস্যময় পশুপ্রাণিদের নিয়ে । আগামী প্রজন্মদের জন্য অন্তত এইটুকু রাখা দরকার ।



    (পরবাস-৪৩, অগস্ট, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)