• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৩ | জুলাই ২০০৯ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • গ্রন্থসমালোচনা: বাংলার জলার গাছ , অনির্বাণ রায় : ভবভূতি ভট্টাচার্য


    ॥ হিঞ্চে শুস্নি কল্মি ব্রাহ্মী স্নিগ্ধ ও নির্মল ॥


    বাংলার জলার গাছ , অনির্বাণ রায় ; পশ্চিমবঙ্গ জীব বৈচিত্র পর্ষদ ; কলকাতা । প্রথম প্রকাশ: ২০০৭ । ISBN: নেই







    "চোখ মেললেই কতরকমের গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, কত জাতের ফল-শস্য । আর সে-সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার । দেখেও দেখিনা, খোঁজও রাখিনা । অথচ, বিজ্ঞানীরা বলেন, এ'সবই মানুষের সবথেকে দামী সম্পদ । এরা হারিয়ে যেতে বসেছে । এদের টিকিয়ে রাখতেই হবে । আসুন, তাই এদের চোখে মেলে দেখি, চিনি, জেনে নিই তাদের হাল-হকিকত্‌, সংরক্ষণের জোরদার ব্যবস্থা গড়ে তুলি । টিকিয়ে রাখতেই হবে আমাদের এই সম্পদকে । "

    সেক্সটোডেসিমোর চেয়েও ছোটসাইজের মাত্র ১৪৭ পৃষ্ঠার বইকে সাধারণত: পুস্তিকার গোত্রে ফেলে দেওয়া হয় । কিন্তু বর্তমান বইটিকে শিল্প-সুষমা ও তথ্যের নিরিখে এক মহাগ্রন্থ আখ্যা দিলে অত্যুক্তি হবে না । কারণ, এ'হেন ছোট্ট সাইজের একখানি বই যে কত সুন্দর, কত স্নিগ্ধ হতে পারে, হাতে না নিলে, পাতা না উল্টোলে বোঝা যাবে না । বস্তুত:, এই বিষয়ে যে আদৌ একখানি সাধারণপাঠ্য বই করা যেতে পারে, সে-ভাবনাটাই মহৎ । এর রস পেতে উদ্ভিদবিজ্ঞানী হবার দরকার নেই । অনুসন্ধিত্সু মন আর চারপাশের পরিবেশটার জন্য একটু টান থাকলেই এ' গ্রন্থ ভালো লাগবে, ভালো লাগতেই হবে । হাইকু যাঁর ভালো লাগে, লিমেরিক যাঁর ভালো লাগে, বনসাই বা চিহুয়াহুয়ার সৌন্দর্য যাঁকে টানে, এ' বই তাঁর ভালো লাগবে ।

    কৃশকলেবর এ'গ্রন্থের তরুণ লেখক বৈজ্ঞানিক কূট-কচালি বাদ দিয়ে সুন্দর সাবলীল বোধযোগ্যভাষায় বাংলার ৫৭ টি জলার গাছের সন্ধান দিয়েছেন ও পরম মমতায় পরিচয় করে দিয়েছেন পাঠকের সঙ্গে ।

    প্রতি বাম পৃষ্ঠায় শিল্পী শর্মিষ্ঠা সাহাকৃত গাছটির অনবদ্য পেন্সিল-স্কেচ --- অপূর্ব শিল্প-সুষমার পাশাপাশি তাতে বৈজ্ঞানিক ছোঁয়াও দেওয়া হয়েছে স্কেলের মাপ ফেলে ফেলে । তাঁর কাজে বোঝা যায়, শুধু শিল্পীপনা নয় সত্যিসত্যিই গাছপালাকে ভালো না বাসলে এমন অনবদ্য চিত্র ফোটানো যায় না ।

    আর প্রতি ডান পাতায় পাতায় লেখককৃত গাছখানির পরিচয় । তাতে চারটি ভাগ রাখা হয়েছে :

    ১. বৈজ্ঞানিক নাম
    ২. চেনার উপায়
    ৩. কোথায় হয়
    ৪. তার ব্যবহার ( ওষধি, আহার্য --- এ'রকম ) ।

    কিছু কিছু গাছের তো অতীব সুন্দর ব্যবহার আছে, যেমন, পানশিউলি বা চাঁদমালা (পৃ : ৫১ ) : "বিভিন্ন গ্রামের বাচ্চারা এই গাছের পাতাগুলোকে গরমকালে পেটের ওপর ও কপালে লেপ্টে রাখে --- বেশ ঠাণ্ডা লাগে বলে " । বেশ মজার, না ?

    বা, ভঁংউইওকড়া হাঁটুর ব্যথা উপশম করে, বা, মদরঙ্গা শাক মেদিনী পুরের বিভিন্ন জায়গায় রায়তা করে খাওয়া হয় ইত্যাদি ইত্যাদি নানান না-জানা নতুন তথ্য । জলাগাছ বা শাকের কত রকম ব্যবহারই যে জানতাম না --- যেমন, কানসিড়া গাইগরুকে কঁংউড়ার সাথে খাওয়ালে বেশি দুধ হয়, বা, দাঁতব্যথার উপশমে পানিমরিচ বা নুখার ব্যবহার বড়ই ফলপ্রদ, বা টোকাপানার কান ব্যথা প্রতিষেধন ক্ষমতা, বা গোলামেথি গাছের ময়লা শোধনের উপযোগিতা । কিছু কিছু জলাগাছের নাম তো কবিতার মত --- ডুবিলতা, জলপালক, টিপ পানা, পাপ্পাটিচিয়া, সুখদর্শন !

    খুব যত্ন করে লেখক সূচিপত্র টি কে ৫টি ভাগে ভাগ করেছেন :

    ১। ডুবিগাছ
    ২। পুরো-ভাসা গাছ
    ৩। ডুবি-ভাসা গাছ
    ৪। আধ-ডুবি খাড়া গাছ, ও
    ৫। জলকাদার গাছ ।

    শেষের ছোট্ট ছোট্ট পরিশিষ্ট তিনটিও চমত্কার :

    ১। কি কি খোঁজখবর নেওয়া দরকার
    ২। অচেনা গাছ দেখলে
    ৩। যে সব বই / ওয়েবসাইট থেকে এই গাছেদের আরও খোঁজ মিলবে ।

    কয়েকটি পাতার ছবি সঙ্গে দেবার লোভ সামলাতে পারছি না (জানি না, এতে কপি রাইট আইন ভঙ্গ হয় কিনা) । শেষের বত্রিশটি রঙিন ফোটো চমত্কার, যদিও না-দিলেও ক্ষতি ছিল না । সাদাকালো ছবিরই তো নিজস্ব এক মাধুর্য আছে ।

    বইটির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দ্বিধা হয় --- কোন্‌ দিকের পাতাটি বেশি আকর্ষণীয়, বাম দিকের স্কেচ, না ডান দিকের তথ্য । উত্তর পাঠিকা দিন । প্রচ্ছদের কালোসাদা স্কেচখানিও সমান আকর্ষণীয় (শ্রীহিরণ মিত্রকৃত) । পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র পর্ষদ বলে কোনো সংস্থার অস্তিত্ব সম্বন্ধেই অজ্ঞ ছিলাম বলে লজ্জিত হচ্ছি, তার পরেই সেলাম জানাচ্ছি, এ' বইটি আমাদের হাতে তুলে দেবার জন্য । অনেক বড়-নামী প্রকাশনা-হাউজের শিক্ষা নেবার আছে এই বইটি থেকে ।

    প্রণম্য গোপাল ভটচাজ্যি মশায়ের পরে প্রকৃতিবিজ্ঞানের এমন মানের বাঙলা বই চোখে পড়েনি । হায় রে, ফরাসি ফেবারসাহেব, জার্মান টিনবার্গেনসাহেবের অত নাম, আর আমাদের বাঙলার প্রকৃতিবিজ্ঞানী কল্কে পাননা ।

    কোনো বাঙলামুদ্রণ প্রমাদ চোখে পড়েনি এই বইটিতে । যদিও ইংরিজি নামের ক্ষেত্রে Hygrophila schulli কে sculii (কুলেখাড়া) লেখা হয়েছে । তবে, এ' বইতে মূলত: দক্ষিণবঙ্গ ও মেদিনীপুর জেলায় প্রাপ্ত জলার গাছকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে । উত্তর ও পুববাঙলাকে নিয়ে এ'রকম আরও দু'-একখানি বই হাতে পেলে কৃতার্থ হব ।




    ॥ "এই পথেই যে চলে যেতেন নূর নবী হজরত" ॥


    চলতি ইসলামি শব্দকোষ , মিলন দত্ত । গাঙচিল, কলকাতা ২০০৮ ISBN: 81-89834-35-5


    "হাজার বছর ধরে এক জন মুসলমান তার হিন্দু প্রতিবেশীকে বলে যাচ্ছেন আসসালামুআলাইকুম ", আর হাজার বছর ধরেই হিন্দু বাঙালির দিক থেকে প্রতি-সম্ভাষণ নেই কোনও । ব্যবধান মুসলিম বাঙালির ধর্মীয় কারণে ব্যবহৃত আরবি ফারসির ব্যবহার । এই বই দুই প্রতিবেশীর ভাষা ব্যবধান ঘোচানোর জন্যই । "

    চমত্কার প্রচ্ছদ চিত্রটি দেখব, না চতুর্থ কভারের এই ব্লার্বটি পড়ব ? আবার পটকথা-য় মিলনবাবু লিখেছেন, "জানাই যদি না থাকে, তা হলে আর বোঝাবুঝি হবে কোথা থেকে ? আর এই অপরিচয়ের শুকনো খসখসে জমিতে আগুন জ্বলতে অসুবিধে কোথায় ! "

    স্বভাবত:ই, পাঠকের প্রত্যাশার পারদ চড়ে ।

    এবং ২৬৩ পৃষ্ঠার এ' কোষ গ্রন্থখানি পুঙ্খানু পড়ে এই প্রতীতিই জন্মায় যে এ'পার ও'পার বাঙলা মিলে এ'হেন গ্রন্থ পূর্বে হয়নি, এক বাংলা একাডেমী, ঢাকা প্রকাশিত রফিকুল হক সাহেব সম্পাদিত অভিধানখানি ছাড়া । তাই এই ২৬৩ পৃষ্ঠার বই লিখতে লেখকের "দীর্ঘ" তিন বছরের পরিশ্রম সফল, নি:সন্দেহে ।

    শব্দকোষের নিয়ম মেনে বর্ণানুক্রমে ইসলামী শব্দগুলির চয়ন ও পরিচয় করিয়েছেন লেখক । তাতে যেমন হজ, রমজান, নামাজের মত পরিচিত ইসলামী শব্দ রয়েছে, তেমনি জিজিয়া, তালাক বা কাফেরের মত প্রবিষ্টি ( entry )ও রয়েছে, যেখানে লেখক অবলীলায় তথ্যানুগ উপস্থাপনা রেখেছেন । যেমন, নবী সাহেবের (স:) মোট স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ১৩, বা নিজের পুত্রবধূর পাণিগ্রহণ করেছিলেন নবী সাহেব (স:), বা তাঁর রূপ বর্ণনা (নাক সরল, দাড়ি ঘন, গোঁফ ছাঁটা)--- এ'সবই তথ্যানুগ, কিন্তু কিছু ধর্মান্ধের রোষ জাগাতে পারে । জাগাক্‌, এ' নির্ভীকতা না থাকলে শব্দকোষ গাঁথা চলে না ।

    গ্রন্থখানির গুণ এর সারল্য ও সাবলীলতা, এবং এর ব্যাপক প্রবিষ্টি সংখ্যা । অলিমা (বিয়েতে বর পক্ষের দেওয়া প্রীতিভোজ) বা ওলি (দরবেশ) বা কুলখানি (`শ্রাদ্ধ') -- এমন যে যে কোনো কম-প্রচলিত ইসলামী শব্দ ভাবুন, এতে তার ভুক্তি (entry) আছে । দুই মলাটের মধ্যে এ'এক মস্ত প্রাপ্তি ।

    এবং বড় প্রাপ্তি পরিশিষ্টের মুসলিম ব্যক্তিনামের (পুং ও স্ত্রী ) উপক্রমণিকা ও তালিকা দুইটি । এটা না থাকলে কী করে জানতাম যে আবু বকর মানে `শিশু উটের পিতা', বা, আফজল অর্থ `উন্নততর', বা, আল হেলাল মানে `নতুন চাঁদ' ? আলিমা মানে `ইচ্ছা', কিন্তু আলিমাহ্‌ -র অর্থ `নৃত্যগীত পটিয়সী' । শমিম নাম মুসলিম ছেলে মেয়ে উভয়েরই হয় ; অর্থ `সুগন্ধ' । `ভ্রমণকালীন তারকা' ( সাইয়ারা ), `তূলাদণ্ড' ( মিজান ), `কথা' ( কালাম ), `আপনভোলা' ( জাহিদ ), `ছোটনদী' ( জাফর ), `শুকতারা' ( তারিক ), `সুবাতাস' ( নাসিম ), `রাতের সফর' ( আসরা )বা `ঝিনুক' ( সাদাফ )--- এমন এমন অর্থবহ মুসলমান ব্যক্তিনামও যে চলে, তাও তো জানা ছিল না, যদিও নামগুলি যথেষ্টই চালু । বন্ধুবর জাফর ইকবালকে তার নামের অর্থ জিজ্ঞেস করাতে বলতে পারলো না । তার বোনের নাম আসরা, তার অর্থ যে রাতের সফর, তা জানাতে বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল । জাফর উচ্চ সরকারী কর্মচারী, তার বোন এম. এ. পাশ । এমনই তথ্যবহুল গ্রন্থ এ'খানি । পরিশিষ্টের গ্রন্থপঞ্জীখানিও তথ্যবহুল, যদিও তার বহু বইই কলেজ স্ট্রিট রাখে না ।

    প্রশংসার পর্ব তো গেল, কিছু ত্রুটি না দেখালেই নয় :

    ১। অনেকেরই ধারণা আছে সারা বিশ্বেই মুসলমানগণের ব্যক্তিনাম আরবি ভাষা-উদ্ভূত হয়ে থাকে (পৃ ২৪৩) । ভুল । চীন, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়াতে সে-সে-দেশী নাম দেবার চল ভালোই রয়েছে । হুই লিয়াংগিউ, চিনের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ধর্মে মুসলিম, নামটি কিন্তু চিনেভাষাতেই । ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী । সংস্কৃতভাষা-উদ্ভূত নাম । ধর্মে মুসলিম । কেরলের মোপলা বিদ্রোহীদের অনেকের নামই মালয়ালি ছিল । আর ইদানীংকালে পাণিনি মুরশিদ, অমিতাভ সিরাজ, অনল আবেদিন --- এ'রকম নাম তো বাংলাতেই পাচ্ছি আমরা ।

    ২। বস্তুত:, `ইসলামী শব্দকোষে'র ইসলামী শব্দখানিতেই আপত্তি আছে যে ! কোনো ভাষার সঙ্গে এক ধর্মকে সরাসরি জুড়ে দেওয়া কেন ? এতে ভাষা ও ধর্ম উভয়েরই গণ্ডি টেনে দেওয়া হয় । তাছাড়া এ'গুলো সবই তো আরবি না হয় ফার্সি ভাষার শব্দ । ফার্সি-উর্দু-হিন্দুস্তানী শব্দমণ্ডলে (মানে, এখানে যাদের ইসলামি শব্দ বলা হয়েছে) কিছু হিন্দী/সংস্কৃত ভাষা-উদ্ভূত শব্দও ঢুকে গেছে, যেমন আণ্ডা (ডিম), সংস্কৃত অণ্ড থেকে । বহু আরবি শব্দ তো প্রাক-ইসলামিক । যেমন, আদম, সুন্নত্‌, কাবা ।

    ৩। একটা ভুল অনেকেই করেন, লেখকও অনবধানে করেছেন । তালিবান বহুবাচিক শব্দ । একবচনে তালিব (ছাত্র) । যেমন, সাহিব (মহাশয়) থেকে বহুবচনে সাহিবান --- উর্দু-হিন্দুস্তানির এক পরিচিত শব্দ । তাই তালিবানরা লেখা অশুদ্ধ (পৃ ১৩২)। পরবর্তী সংস্করণে এ' ভুলের সংশোধন দেখবার আশা রাখি ।

    ৪। সারা বিশ্ব থেকে মক্কায় হজ করতে ধর্মপ্রাণ মুসলমান রমজান মাসে গিয়ে থাকেন (পৃ ১৭১) ? ভারত থেকে তো তার পরের সওয়াল মাসে যান বলে স্মরণে আসছে । তথ্যটি একবার যাচাই করে নেওয়া দরকার ।

    ৫। বাঙলায় ইসলামের প্রসারের আলোচনায় (পৃ ৬৩) লেখক ত্রয়োদশ শতাব্দীর সেন-পরবর্তী তুর্কীহানার প্রসঙ্গ টেনেছেন, ও বৌদ্ধগণের দলে দলে ইসলামধর্ম নেওয়ার কথা বলেছেন । এই নাকি বাংলায় মুসলিম সংখ্যাধিক্যের কারণ । কিন্তু প্রখ্যাত জনসংখ্যাবিদ্‌ অশোক মিত্র (আই. সি. এস.) মহাশয় যে পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৃটিশ রাজত্বেই বাঙলায় মুসলিম জনসংখ্যার সর্বাধিক বৃদ্ধি ঘটেছিল ? অতএব, বিষয়টি রাজনৈতিক, ধর্মীয় নয় । বিতর্কিত বিষয় ।

    বিতর্ক থাক, কারণ এমন বিষয়ের কোষগ্রন্থ লিখেছেন দত্ত-মশায় যে বিতর্ক পিছু ছাড়ে না । বিতর্ক তুললে আরও অনেক ভুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করা যায়, যা অভিপ্রেত নয় । এতে সুন্দর বইখানির ঘ্রাণ ক্ষুণ্ণ হবে ।

    গাঙচিলের প্রকাশনা, তাই উপস্থাপনা উচ্চ মানের । তিনটি মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েছে : ংউসলিম (পৃ ৮), অগ্রাহ্য (পৃ ১৩১), আর প্রথম হাদিস (পৃ ২৩৬) ।

    নিন্দা-বিতর্ক থাক্‌, কারণ এ' বইয়ের মূল সুরখানিই বড় প্রশংসার, `হারমনি'র, `দিবে-আর-নিবে'র, পরস্পরকে জানা-শোনার । তাই না কাজী সাহেবের এই গানের পদখানি মনে এলো । নূর-নবী-হজরতসাহেব গণ এই মিলনপথের গানই তো গেয়ে গেছেন ।

    মাভৈ : ।


    ॥ উড়ো খৈ ইতিহাসায় নম: ॥


    সংসদ ইতিহাস অভিধান (প্রথম খণ্ড) ; সুভাষ ভট্টাচার্য, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা ২০০৬ ISBN: 81-7955-094-X


    মাত্র চারশো পৃষ্ঠার মধ্যে ভারত ছাড়া সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসকে এক কোষগ্রন্থে বেঁধে ফেলা এক দু:সাহসিক প্রচেষ্টা, তাও আবার কালের পরিধিতে প্রাচীনকাল থেকে বিংশশতাব্দীর শেষাবধি ! এ'হেন প্রচেষ্টায় এক সুনির্দিষ্ট দিশানির্দেশ অত্যন্ত জরুরী ছিল, আরও জরুরী ছিল এক টিমওয়ার্কের । এ' দুটোই হয়নি বলে গ্রন্থখানি ব্যর্থ । বুক সেল্ফের শোভাবৃদ্ধি করা ছাড়া এ'বই আসল কোনো কাজে আসবে না গবেষক-পাঠকের কাছে ।

    তিনটি ভাগে আলোচনার ইচ্ছে রাখি, কেন এ'গ্রন্থ আশাপূরণে সমর্থ হল না :

    ১। পরিধি ও চয়ন
    ২। প্রামাণিকতা ও গুরুত্ব
    ৩। বানান ও উচ্চারণ ।

    ১। পরিধি ও চয়ন : স্থান ও কালের নিরিখে এতো পরিব্যপ্ত বলেই প্রথমেই একটা ঘোষিত নীতি আশা করেছিলাম যাতে পরিষ্কার বলা থাকবে কোন্‌ কোন্‌ কষ্টিপাথর ডিঙিয়ে কোন্‌ কোন্‌ প্রবিষ্টি (entry) ঠাঁই পাবে এ'গ্রন্থে । তেমন কোনো নীতি নেই বলে অরাজকতা চলেছে । দিশাহীনভাবে ভৌগোলিক স্থান নামের মধ্যে বুলগেরিয়া রুমানিয়া র মত বর্তমান দেশের প্রবিষ্টি থাকলেও বর্তমান দেশ ইংল্যাণ্ড ফ্রান্স চিনে র নাম নেই । ইতিহাসের ইংল্যাণ্ড ফ্রান্স চিনের গুরুত্ব বুলগেরিয়া রুমানিয়ার চেয়ে কম কী ? অথচ অধুনালুপ্ত দেশ প্রাশিয়া র নাম নেই । প্রাচীনকাল থেকে শুরু জেনে আদি ফরাসী চিত্রগুহা লাস্কঅ বা স্পেনের আলতামিরা গুহাচিত্রের ভুক্তি (entry) খঁংউজেছিলাম । পাইনি । জানা গেল, এঁংএদর দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিতব্য শুধু ভারত-ইতিহাস নিয়ে । বেশ । সেখানে বাগগুহা র ভুক্তিও কি তাহলে থাকবে না ?

    এটা কোনো বৈজ্ঞানিক অভিধান নয়, তবু আইনস্টাইন, নীলস বোর আছেন । বেশ, এঁরা তো অতি বিখ্যাত প্রণম্য বিজ্ঞানী । কিন্তু এঁংএদর সম্বন্ধে জানতে পাঠক এক ইতিহাস-অভিধান ঘাঁটবেন কেন ? কোনো বৈজ্ঞানিক অভিধান খঁংউজবেন । কিন্তু নীলস বোর থাকলে এনরিকো ফার্মি নেই কেন ? ম্যাক্স প্লাঙ্ক নেই কেন ? এঁরা কি বোরসাহেবের চেয়ে কম প্রণম্য বিজ্ঞানী ছিলেন ? আবার ইতিহাসের সঙ্গে বিস্মৃতির একটা আলগা সম্বন্ধ আছে বলে দিনেমার পদার্থবিজ্ঞানী ওলে রোমারে র নাম খঁংউজছিলাম, ১৬৭৬-'এ আবিষ্কৃত যাঁর আলোকের গতিবেগ সংক্রান্ত তত্ত্ব আজও অভ্রান্ত প্রমাণিত । পাইনি ।

    শিল্প-সাহিত্যের জগতের শেক্সপীয়র বোদলেয়র আছেন, চ্যাপলিন কুরোসাওয়া নেই । এঁনাদের প্রকাশিতব্য দ্বিতীয় খণ্ডে (ভারত ইতিহাস) কালিদাস রবীন্দ্রনাথে র পাশাপাশি সত্যজিৎ রায় কে বাদ দিতে পারবেন কি এঁনারা ? আবার ইতিহাস সর্বদাই প্রথমকে প্রণিপাত করেছে (তাই তো এতোজন এভারেস্ট শীর্ষে চড়লেও হিলারি-তেনজিং আজও স্মর্তব্য), তাই বিশ্বের প্রথম উপন্যাসের (গেন্জি মোনোগাতারি) জাপানী হেরিয়ান যুগের লেখিকা মুরাসাকি শিকিবু র নাম খঁংউজেছি । নেই ।

    আবার ত্রক্রীড়াজগত এখানে সম্পূর্ণই অনুপস্থিত । ওয়েন্স-পুসকাস-ব্রাডম্যানে র নাম-ও-নিশান নেই । ইতিহাস যেমন শুধু মাত্র রাজারাজড়া যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনীমাত্র নয়, মানুষের জ্ঞান-গরিমা-শিল্প-বিজ্ঞান যেমন তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তেমনই ত্রক্রীড়াও নয় কী ? তবে ? তাই তো বলি, এ' কোষগ্রন্থ বড় দিশাহারা ।

    আবার যুদ্ধবিগ্রহের ভুক্তিই কি যথেষ্ট আছে ? কার্ল ফন ক্লজউইট্জের নাম খঁংউজছিলাম, যাঁর "On War" -কে সমরেতিহাসের বেদ মানা হয় । নেই । বিশ্ব-ইতিহাসের মোড় ঘোরানো ঘোরানো নানান যুদ্ধেরও কোন একক একক প্রবিষ্টি নেই : যেমন, ৭৩২খৃ:-র পোয়েতিয়ের যুদ্ধ, যে যুদ্ধ স্পেনীয় মূরনায়ক আমির আবদার রাহমান জিতলে য়ুরোপ খৃষ্টান না হয়ে মুসলিম অধ্যুষিত হতে পারত ; বা ১৪৫৩-র কনস্ট্যানটিনোপলের যুদ্ধ, যাতে য়ুরোপ প্রথম বারুদের স্বাদ জেনেছিল আর তাতে পূর্ব রোমান বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ও মুসলিম অটোমান সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটেছিল (যা টিকেছিল পৌনে পাঁচশ' বছর, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ডিঙিয়ে) । ১৯৪২-এর যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় মিডওয়ের যুদ্ধ জিতে আমেরিকা পার্ল হারবারের বদলা নিয়েছিল ও অক্ষশক্তির শেষ-পতন ঘনিয়ে এসেছিল, কই সুভাষবাবুর এ'কোষে তারও তো কোনো প্রবিষ্টি নেই ।

    কোনো ব্যক্তি বা কাজ ইতিহাসে ঘৃণ্য বলে চিহ্নিত হতে পারে, তা বলে তা অনৈতিহাসিক কী ? নৈলে, বিশ্বে জলদস্যুতার যে অত বড় ইতিহাস, তার কোনো একটা প্রবিষ্টিও (প্রাইভেটিয়ার, বাকানিয়ার বা এডওয়ার্ড টিচ) নেই কেন ? আজকের ইদি আমিন, পল পট, চেচেস্কু নেই । এ'সব ব্যক্তি সম্বন্ধে জানতে বাঙালি পাঠক তাই কোন্‌ অভিধান খঁংউজবে ? না-প্রাপ্তির এ' তালিকা আর দীর্ঘ করে লাভ নেই, তাতে হতাশা বাড়বে ।

    ২। প্রামাণিকতা ও গুরুত্ব : কোষগ্রন্থ রচনার এ' এক প্রতিষ্ঠিত নিয়ম যে প্রতি ভুক্তির সঙ্গে সঙ্গে তার প্রামাণ্যসূত্র দেওয়া থাকে । এই প্রকাশনালয়েরই প্রখ্যাত বাঙালী চরিতাভিধান বা অন্য কোষগ্রন্থে এ'রীতি মানা হয়েছে । কিন্তু, এ'হেন এক ব্যাপ্ত ইতিহাস অভিধানে, যেখানে এই প্রামাণ্যসূত্রের আরও বিশেষ করে প্রয়োজন ছিল, সেখানে তা নেই । কেন ? যেমন, চেজারে বর্জা কে পোপ দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডারের অবৈধ সন্তান লেখা হয়েছে । বেশ । কিন্তু আমার যে একবার গ্রন্থসুত্রটি দেখে নিতে ইচ্ছে করছিল । নেই ।

    প্রতিষ্ঠিত অভ্যেসমত, ইতালীয় আমেরিগো ভেস্পুচি কে বেমালুম আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কর্তা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, রিচার্ড আমেরিকা র নাম গন্ধ নেই, যাঁর অর্থানুকুল্যে ১৪৯৭-এ' বৃটিশ নাবিক জন কেবটের নিউ ফাউণ্ডল্যাণ্ড অভিযান, ভেস্পুচির তিন বত্সর পুর্বেই । মহাদেশের নাম আমেরিকা তো প্রথম জানা গেল জার্মান কার্টোগ্রাফার ভাল্ডসীমূলারের মানচিত্রে, ১৫০৭ খৃ. । উত্সাহী পাঠক রডনি ব্রুমের বইটি দেখে নিতে পারেন ।

    প্রবিষ্টিরাজির আপেক্ষিক গুরুত্ব আরেক হতাশার কারণ । যে জেঙ্গিস খানের সাম্রাজ্য ভৌগোলিক মাপে বিশ্বের বৃহত্তম ছিল তার জন্য তিনটি বাক্য বরাদ্দ, আর আমেরিকান ডগলাস স্টিফেনে র জন্য তিরিশ লাইন ব্যয় করেছেন সুভাষবাবু ! বস্তুত:, এ'গ্রন্থে য়ুরোপ-আমেরিকা যত গুরুত্ব নিয়ে স্থান পেয়েছে, এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন-আমেরিকা বা ইসলামের ইতিহাস ততটা কল্কে পায়নি । নৈলে মক্কা মদিনা বা হিজরি র কোনো একক প্রবিষ্টি থাকেনা ? থাকে না দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রাচীন হিন্দুসাম্রাজ্য স্থাপনকারী শৈলেন্দ্র রাজবংশে র নাম ? তৈমুর লং বা সান -ইয়াত্‌-সেন কোষগ্রন্থে ঠাঁই পাবার যোগ্য নন ? স্পেনের আল-হামরা স্থাপত্য ঠাঁই পাবে না ?

    এ'ছাড়া বহু ক্ষেত্রেই সুভাষবাবু কোষগ্রন্থকারের নৈর্ব্যক্তিকতা ছেড়ে সাহিত্যগন্ধী ভাসা-ভাসা বাক্যগঠন ও শব্দচয়ন করেছেন (উদা. "সাইমন বলিভার বারদুয়েক নির্বাসিত হন" বা "বক্তব্য ও মেজাজ দিয়েই চার্টিস্ট আন্দোলনের গুরুত্ব বুঝতে হবে" বা "দক্ষিণ আফ্রিকায় ওলন্দাজ উপনিবেশ স্থাপিত হয়েছিল দীর্ঘকাল আগে" ইত্যাদি) ।

    ৩। বানান ও উচ্চারণ : এ'সম্বন্ধে একটি ছোট উপক্রমণিকা থাকলেও কোনো সঠিক নীতি পালন না করায় নৈরাজ্য চলেছে । বাঙালি পাঠকের চোখ হান্নিবল, মঁতেসকিয়্যু, রম্মেল, এক্স-লা-শ্যাপল, হূ --- এমন এমন বানানে হোঁচট খায় । এককালে সদ্য ফ্রান্স-ফেরৎ তরুণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় "কবি হ্রাঁবো"-- এমন বানান লিখে বহুভাষাবিদ্‌ লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের কাছে ধমক খেয়েছিলেন । চোখ-সওয়া র্যাঁবো বানানই তাই চলল । সুভাষবাবু এখানে বাঙালিকে নতুন উচ্চারণ করা শিখিয়েছেন ।

    শেষে বলি, যে যে ব্যক্তির সঠিক জন্ম মৃত্যু দিন পাওয়া সম্ভব তা নেই কেন ? দারায়ুসের সঠিক জন্ম ও মৃত্যু দিন জানার ইচ্ছে সাধারণ পাঠক করে না, কিন্তু দস্তয়ভস্কির বা নেপলিয়নের করে । নেই ।

    মোটের ওপর দেড় শ' টাকার অপ্রাপ্তির বই খানি নিয়ে কী করি ? নামী প্রকাশনালয়টির উচিত এর একখানি পরিমার্জিত সংস্করণ ক্রেতাকে ফিরি দেওয়া ।


    ॥ অথ ট্রাভেলগ অথবা মাওনামা অথবা নিছক আদিখ্যেতা ॥


    চীনে ১৬ দিনে , অশোক দাশগুপ্ত । আজকাল, কলকাতা । প্রথম প্রকাশ, ২০০৬ Code No.: 81-7990-0568-8


    কী সমাপতন !

    বহুদিন পরে তাকে থেকে ধুলো ঝেড়ে নমস্য ডাক্তার নর্মান বেথুনের The Scalpel, The Sword বইখানির পুন:পাঠ শুরু করতেই আলোচ্য কেতাবখানি হাতে এসে পড়ল । বেথুন সেই মানুষ যিনি ডাক্তার হিসেবে মাও-এর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাগ নিয়ে ১৯৩৯-এ' হেবেই রণাঙ্গনে প্রাণ দেন । এডগার স্নোর মত আরেক পশ্চিমি যাঁকে মাও-সে-তুং স্বয়ং সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা করতেন । এ'ধরনের মানুষ দু'দিন মহান চীনদেশ ঘুরে এসে "আহা কী দেখিলাম, জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলিব না" করার মানুষ নন । তাই আজও শ্রদ্ধেয় ড. বেথুন ।

    হাতে কলম আছে, পেশায় সাংবাদিক, (থুড়ি, স্বয়ং সম্পাদক), আর ঘুরতে গেছি চিন-হেন কম্যুনিস্ট দেশে । অতএব ফিরে এসে জ্ঞানগর্ভ তাত্ত্বিকতা-চটকানো একখান্‌ কেতাব লিখব না ? তারপর যখন তিনি স্বঘোষিত বামপন্থী, ও প্রবল প্রতাপান্বিত মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে "মাও মাও মাও" মন্ত্র দিয়ে চিনে পাঠিয়েছেন ।

    চিনদেশ ঘুরতে গেছেন, বেশ করেছেন, --- মাও এর ছবি ছাপা আইস্ক্রিম খাইলাম, চিনের প্রাচীরে জগিং করিলাম --মার্কা ভ্রমণকাহিনী লিখলে এ'-সমালোচনার দরকার ছিল না । কিন্তু আমাদের দেশের কোনো কোনো লেখকদের চীন-কিউবা ঘুরে এলেই মাও-কাস্ত্রো বন্দনা-গাথা লিখতে হবেই (যার বারোআনাই মিথ্যা --- সেই মনোজ বসু - মৈত্রেয়ী দেবীর কাল থেকে এ'ধারা অব্যাহত)--- আপত্তিটা এখানেই । মাত্র দু'সপ্তাহে চিনের কিছুই দেখা হয় না, সেটা অন্ধের হস্তীদর্শনের মত হয়ে পড়ে -- এ'সব সাফাই গাইবার পরেও সমাজতান্ত্রিকধনতন্ত্রের সোনারপাথরবাটির বন্দনা --- এ' দ্বিচারিতার স্থান ইতিহাসের আস্তাকুড়ে হওয়া দরকার ।

    কয়েকটি লাইন তুলে দিই :

    ১। চীনের কম্যুনিস্ট পার্টি ও অধুনা-ধনী ব্যবসায়ীশ্রেণীর সহাবস্থান প্রসঙ্গে :

    "বড়লোক হওয়াটা গ্লানিকর নয় । কোনো অসুবিধাই যখন হচ্ছে না, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পাল্টাবার দরকার কী ? " পৃ ৪৪

    ২। শিল্পের জন্য কৃষি জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে, পৃ ৪৫ :

    কোনো বহুজাতিক ইলেকট্রনিক কোম্পানি চিনে জমি নিচ্ছিল কারখানার জন্য । যথার্থ ক্ষতি পূরণ দেওয়া হয়নি । স্থানীয় কিছু লোকের সই নিয়ে, নিশ্চয়ই আড়ালে অর্থ দিয়ে, জমি দখল করতে গিয়েছিল কোম্পানির লোকেরা । প্রতিরোধ সংঘর্ষে তিন স্থানীয় কৃষকের মৃত্যু হয় । এতে চৈনিক কম্যুনিস্ট মন্ত্রীমহোদয় কৃষকদের সমর্থন করে বাহবা কুড়োলেন, আর লেখক এই মহান গণতান্ত্রিক নজিরের প্রশংসা করে পাঠকের নিষ্ঠীবন । কারণ, পাঠক চিনে রাখুন, এই সম্পাদকই সিঙ্গুরে বলপূর্বক কৃষিজমি অধিগ্রহণ ও নন্দীগ্রামে কৃষকনিধন সমর্থন করে টন টন নিউজ প্রিন্ট ধ্বংস করেছেন ; ৯/১১-র ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার হানার সমর্থন করেছেন তা ধনতন্ত্রের ওপর আঘাত বলে ! প্রপাগাণ্ডা-প্রিয় গোয়েবল্সপন্থীরা চিরকাল এমনই হয় ।

    ৩। পৃ ২৩ । কোনো চীনা তরুণী লেখককে জানিয়েছে : "আমার বাবা অধ্যাপনা করতেন । সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় তাঁকে পাঠানো হল রাস্ট্রীয় খামারে কাজ করতে । বয়স তাঁর তখন পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে । এক বছরে শরীর ভেঙে পড়ল । তবুও তিনি এখনও খাঁটি মাও ভক্ত ।" ইত্যাদি ইত্যাদি ।

    হরি হে, "রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম, চোখে পড়ছে না যদিও, তবু আছে, অন্তত: থাকাটা কিছু অসম্ভব নয় "।

    আর এই ভাবেই আজ-চীনের সর্বত্র মাওকে ছড়িয়ে থাকতে দেখে এসেছেন রঙিন চশমা-চোখো লেখক । পঞ্চাশ বছর আগে (মানে মাও -এর জমানায়) যাঁরা আধবেলা পেটপুরে খেতে পেত না, আজ (মানে দেং ও দেং-উত্তর চীনে) তারা দিনে আড়াইপেটা খাচ্ছে । তবু দেং নয়, মাও-ই আছেন, থাকবেন, এই-ই লেখকের ঘোষণা ।

    এত মাও-মাও করছেন লেখক, তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারে কামান দেগে ছাত্র আন্দোলন দমন প্রসঙ্গটা তাই খঁংউজছিলাম । নেই । কারণ এতে এ'সব আর্মচেয়ার কম্যুনিস্টদের কোনো সাফাই চলে না । শুধু এক তরুণী লেখককে বলেছেন, মাও বেঁচে থাকলে জল এতো দূর গড়াতে দিতেন না, বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজের ব্যক্তিত্বের প্রভাব খাটিয়ে সামলে নিতেন । বেশ ।

    পুছি, মা, গোড়াটা কেটে আগায় জল দিলে গাছ বাঁচে ?

    লেখক ত্রক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্র থেকে উঠে এসেছেন বলে আশা ছিল খেলাধুলায় আধুনিক চীনের এই বিশ্বশ্রেষ্ঠত্বের কারণ কিছু অনুসন্ধান করবেন । ওলিম্পিক পদকে তো আর জল মেশানো চলে না । না, তেমন কোনো প্রয়াস করেননি লেখক । সেদিন এক ছাত্র ভাবের ঘরে চুরি প্রবাদটির অর্থ জানতে চাইছিল । তাকে এই বইটি পড়তে দিলে হয় ।

    আজকালের প্রকাশনা মান তো ভালোই । মুদ্রণ প্রমাদও চোখে পড়েনি । ছাপা ছবির রঙ বড় ক্যাট্ক্যাটে, চোখে লাগে ।

    পুন: : এই লেখাটির শিরোনাম "রাজা, তোর কাপড় কোথায় ?"-ও হতে পারত ।

    (পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • কীভাবে লেখা পাঠাবেন তা জানতে এখানে ক্লিক করুন | "পরবাস"-এ প্রকাশিত রচনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রচনাকারের/রচনাকারদের। "পরবাস"-এ বেরোনো কোনো লেখার মধ্যে দিয়ে যে মত প্রকাশ করা হয়েছে তা লেখকের/লেখকদের নিজস্ব। তজ্জনিত কোন ক্ষয়ক্ষতির জন্য "পরবাস"-এর প্রকাশক ও সম্পাদকরা দায়ী নন। | Email: parabaas@parabaas.com | Sign up for Parabaas updates | © 1997-2022 Parabaas Inc. All rights reserved. | About Us