• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৩ | জুলাই ২০০৯ | গল্প
    Share
  • কামাখ্যা (`বিজুদা সিরিজ'-এর চতুর্থ গল্প) : ভবভূতি ভট্টাচার্য


    ॥ ১ ॥


    ॥১॥

    প্রচণ্ড দাবদাহে ফুটছে উত্তর ভারত । ভরা মে মাস । সপ্তাহান্তের সন্ধ্যায় আমরা ক'টি পরিবার তাই ছাদে উঠে এসেছি । গল্পগাছা চলছে । আজকের আড্ডার সুরটা একটু উঁচু পর্দায় বাঁধা ছিল --- কামু-কাফকা-স্তরের । শ্যামল সম্প্রতি সপরিবার ঘুরে এসেছে তার মামাবাড়ি রায়পুর থেকে । সেখানকার প্রবাসী বেঙ্গলি ক্লাব এবারের বাঙলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে এক অসাধারণ নাটক নামিয়েছে --- 'পোকা'--- কাফকার 'মেটামর্ফোসিস' অবলম্বনে । কথা হচ্ছিল , আমরা এখানে কেন এমন নাটক নামাতে পারি না ? আড্ডায় যেমন হয় , এ'কথা থেকে কথা ঘুরে গেল রূপান্তরের দিকে । মানুষ থেকে পোকা হয়ে যাওয়া , বা মানুষ থেকে বাঁদর (এটা তো আমরা সর্বত্র প্রায়ই দেখতে অভ্যস্ত ) । সুমি বলল খগম এর কথা । নীতিন শোনাতে যাচ্ছিল ওদের রাজস্থানের সিকর জেলার কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের এক প্রাচীন গল্প , এমন সময় আমাদের ছেলেমেয়ের দল নিচ থেকে খেলা ফেলে হৈ হৈ করতে করতে ছাদে উঠে এল , "জেঠু এসেছে , জেঠু এসেছে"।

    জেঠু, মানে বিজুদা ? বহু কষ্টে ওদের এতোদিনে বিজুদাকে কাকু থেকে জেঠু বলাতে পারা গেছে । তা , বিজুদা তো এমন বিন্‌-নোটিশে হুট বলতে আসেন না ! কী ব্যাপার ? আমরা পরস্পর মুখ তাকাতাকি করছি , এমন সময় সিঁড়িতে বিজুদার ভারি বুটের শব্দ শোনা গেল , "কী রে তোরা সব ক'টাতে এখানে জুটেছিস ? দেখো সুমি , কেমন গন্ধে গন্ধে এসে পড়েছি । আজ তোমার হাতের সেই ডিমের বড়াটা খেয়ে যাবো ।"

    আমি জিজ্ঞেস করি , "দাদা , আপনি জার্মানি থেকে ফিরলেন কবে ? আমি ও কলকাতায় গিয়েছিলুম ।"

    "আরে রাখ্‌ তোর জার্মানি । কী শ্যামল বাবু , আপনার সেই কেওড়া দেওয়া শরবত তো কই আর খাওয়ালেন না ? একদিন খাইয়েই হয়ে গেল? শ্যামলের পিছনে লাগা দিয়ে যখন শুরু করলেন , বুঝতে পারলুম , বিজুদা আজ বেশ মুডে আছেন । শ্যামল স্মিত হেসে মুখে কপট গাম্ভীর্য টেনে বলল , "আমরা এখন একটু উচ্চস্তরের আলোচনায় ব্যপৃত আছি । কাফকার মেটামরফসিস । এক মানুষের পোকায় রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া........."।

    বলা শেষ হল না , বিজুদা গালে হাত দিয়ে মস্ত এক "বা---ব্বা:" বলে ধপ্‌ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন : "বলিস কী রে নুটুবিহারী , তোর মাথায় হঠাৎ কাফকা কিল্বিল্‌ করে উঠল কেন রে ?" নীতিনের দিকে তাকিয়ে বললেন বিজুদা । নীতিনের সেই রাজস্থানের গ্রামের মানুষ থেকে নেকড়ে হয়ে যাওয়ার গল্পটায় বাধা পড়ে গিয়েছিল । এখন বিজুদার উপস্থিতিতে সে-বেচারি আর মুখ খুলতেও ভরসা পাচ্ছে না । কারণ ইতোমধ্যেই অয়ন-রূপা-গুগ্গুলের দল গুটি গুটি চেয়ারগুলো গোল গোল করে এনেছে বিজুদার চারিভিতে । অনুরোধ টা স্পষ্ট , "জেঠু, একটা গল্প বল ।"

    আজ আবার ওদের এক নতুন বন্ধুও এসে হাজির হয়েছে । বিজুদা তাদের দিকে এক আস্কারা দেওয়া হাসি ছঁংউড়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে পুরোনো কথার খেই ধরে বললেন , "কেন , আমাদের দেশেই , আসামের কামরূপ-কামাখ্যায় তান্ত্রিকরা মানুষকে ধরে ধরে ভেড়া বানিয়ে রেখে দিত , তা জানিস না ? দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রখ্যাত শৈবসাধক গোরক্ষনাথের গুরু মত্স্যেন্দ্রনাথকে তারা ধরে তোতাপাখি বনিয়ে রেখেদিয়েছিল । শিষ্য গোরক্ষনাথ সেখানে গিয়ে যোগবলে তাঁকে উদ্ধার করে . জানিস না সে গল্প ?"

    এই বুঝি বিজুদা প্রাচীন সাধু-সন্ন্যেসী নিয়ে কোনো গল্প ফাঁদেন , আমরা একটু ত্রস্ত । কারণ আমাদের আজকের আলোচনাটা য়ুরোপীয় সাহিত্যের দিকে ঝঁংউকছিল । শ্যামল তর্ক করতে ছাড়ে না , "দাদা , সে সব আমাদের এই প্রাচীন দেশ ভারতবর্ষের প্রত্যন্তস্থানে হতে পারে , তা বলে কাফকা কী বলে সভ্য জার্মানিতে বসে মেটামরফসিসের রূপক...."

    শ্যামলের কথা মাঝপথে থামিয়ে বিজুদা একটু সিরিয়াস গলায় বলে উঠলেন , "তোদের কী ধারণা , ছেলেভুলোনো ভূত-পেত্নী-ব্রহ্মদৈত্যির কথা না-হয় ছেড়েই দিলুম , নানান ব্যাখ্যাতীত ঘটনা , বিভিন্ন প্রাচীনবিদ্যা আজকের বিজ্ঞানে যার যুক্তি মেলা ভার , সে-সবের ডিপো হল আমাদের এই প্রাচীন দেশ ভারতবর্ষই আর য়ুরোপ-আমেরিকা সব নব্য বৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারণার আখড়া ?"

    একটা গল্পের মুখড়া তৈরি হচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি , কিন্তু বললুম না কিছুই , কারণ বিজুদার কাছ থেকে গল্প শুনতে পাওয়ার টেকনিকটা আমরা এতো দিনে ধরতে পেরে গেছি । কেবল শুরুয়াত্টা করে দিয়ে ওঁনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকো , তাহলেই গল্প বেরোতে থাকবে । শুধু দুটো শর্ত আছে , " মাঝে মাঝে একবার করে অর্গ্যানিক চা-এর কাপখানি তাঁর মুখের কাছে ধরা চাই । দ্বিতীয় শর্তখানি অবশ্য আরও কড়া । নিজ নিজ মোবাইল ফোনখানি অফ্‌ রাখিতে হইবে । কারণ গল্পের মাঝে মোবাইল ফোন বেজে উঠলে বিজুদার মুড এক্কেবারে ধ্বসে যায় ।

    পুরনো কথার খেই ধরে বলে চলেন বিজুদা , "এই হোলিয়ার দ্যান দাউ এয টিচুডটা বৃটিশ প্রভুদের ছিল । থাকতেই হবে কারণ তাঁরা হলেন প্রভু , শাসক , বস্‌ । বস্‌ ইজ নেভার রঙ , কী বল রে মুকুন্দ ? (এবারের হাসিটি আমার দিকে ফিরে ) । তা ছাড়া , য়ুরোপীয়রাও এক বিরাট জ্ঞান- বিজ্ঞান দর্শনের জোরেই পৃথিবী জয় করতে বেরিয়েছিল । সেই তেজেই কালা-হলুদ বিশ্বের সব কিছুকেই তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল তারা । কিন্তু তারপর এই য়ুরোপীয়দের হাত ধরেই জন্ম নিল ইণ্ডোলজি , ভারতবিদ্যা । স্যর উইলিয়ম জোন্স , টমাস কোলব্রুক , মনীষি ম্যাক্স মূলার ! কার্ল মার্ক্স বৃটিশ লাইব্রেরিতে বসে গোগ্রাসে গিলে চলেছেন ভারত-ইতিহাস ! নানা ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ধারার নিয়মিত চর্চা শুরু হল । যা হোক্‌ , আজ তো আর আমরা ইণ্ডোলজির আলোচনা করতে বসিনি , আজ আমরা শুনবো একটা ভূতের গল্প , নিদেন একটা অদ্ভুতুড়ে গল্প , কী বল অয়নবাবু ? তা, তোমাদের এই নতুন বন্ধুটির সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিলে না তো ? কী নাম গো তোমার ?"

    " রন , রন বন্দ্যোপাধ্যায় ।" বন্ধুর হয়ে আমার পুত্রই জবাব দেয় ।

    "রণ , শুধুই রণ ? রণজিত বা রণদেব নয় ?"

    " না , আমার নাম রন , রন বন্দ্যোপাধ্যায় । " ছেলেটি বেশ গম্ভীরভাবে বলল ।

    "আচ্ছা ,রণ , তোমার নামটি কে রেখেছেন বলত , তোমার মা না বাবা ?"

    "আমার মা ।"

    " বেশ বেশ । তোমার মায়ের সঙ্গে তো একটিবার আলাপ করতে হচ্ছে।"

    তারপর প্রায় স্বগোতোক্তির ঢং-এ বললেন বিজুদা ," রণ , তাই তো । সমর যদি কারোর নাম হতে পারে , রণ-ই বা হবে না কেন ?"

    এই বালকটিকে আমি আজই প্রথম দেখলুম । পুত্রের বন্ধু । অয়নদের ক্লাসে নতুন ভর্তি হয়েছে এসে । আমাদের হাউজিং কমপ্লেক্সেই থাকে । সম্প্রতি এর বাবা কলকাতা থেকে বদলি হয়ে এসেছেন, শুনেছি । আমাদের সঙ্গে আলাপ হয়নি এখনও । ছোটদের মধ্যে বন্ধুত্ব তাড়াতাড়ি হয় । অসম্ভব ফরসা ছেলেটি , প্রায় সাহেবদের মত । পরশুদিন রাতে খেতে বসে অয়ন ওর মাকে বলছিল শুনছিলুম , "জানো মা , রনের মা না ওর বাবার চেয়ে বয়সে অনেক বড় , বুড়ি মত । মাথার চুল সব সাদা ।" গিন্নি ধমকেছেন ," তাতে কী ? হতেই পারে । পরচর্চা করো না , অয়ন ।"

    " মা , পরচর্চা মানে কী ? "

    সেই ছেলেটি একটু আগেই আমাদের বীরপুরুষ কবিতা খানি আবৃত্তি করে শুনিয়েছে । বহুদিন পরে শুনলুম কবিতাখানি । আমাদের বাল্যকালে গুরুদেবের এই কবিতাটি শিশুরা খুব আবৃত্তি করত ।

    যাহোক্‌ , আজকে বিজুদার গল্পের তোড়টি ভালোই এসেছে । বিজুদা বলে চলেন , " শিবপুর থেকে পাশ করে আমি কিছুদিন জার্মানিতে ছিলুম , জানিস কী ? না , তখনও আমি আই.টি-তে আসিনি , আমার আদত লাইনেই ছিলুম , মেটালার্জি । ধাতু বিদ্যা ।"

    চেক-জার্মান সীমান্তে ড্রেসডেন শহরের কাছে এক ছোট্ট শহর আছে , শেমনিত্জ । আমাদের কালে নাম ছিল কার্ল মার্ক্স স্ট্যাড্‌ । স্ট্যাড্‌ মানে শহর । কার্ল মার্ক্স স্ট্যাড-কে এক বিশ্ববিদ্যালয় শহর বলা চলত । হঁযা গো , তোমরা নিশ্চয়ই জানো বিশ্ববিদ্যালয় শহর কাকে বলে ? হঁযা , কোন বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে যে শহর গড়ে ওঠে তাকেই বিশ্ববিদ্যালয় শহর বলে , যেমন কেম্ব্রিজ বা অক্সফোর্ড , প্রাচীন ভারতের নালন্দা বা তক্ষশীলা , আজকের ভারতের আলিগড় । হঁযা রে , আমাদের শিবপুর কে কি বিশ্ববিদ্যালয় শহর বলা চলে ?

    যা হোক্‌ , আমাদের এই কার্ল মার্ক্স স্ট্যাডে সারা বিশ্ব থেকে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসত । আর আমি আদতে মেটালার্জির ছেলে বলে আমার বাড়তি আকর্ষণ ছিল এই যে ষোড়শ শতাব্দীতে এই শেমনিত্জ শহরের পত্তন করেন জর্জ এযগ্রিকোল , যাঁকে আধুনিক ধাতুবিদ্যার জনক বলা হয় । তাই চেষ্টাচরিত্র করে এক স্কলারশিপ বাগিয়ে আমি ঠেলে গিয়ে উঠলুম সেই কার্ল মার্ক্স স্ট্যাডে । হঁযা , ঠিক ধরেছ তোমরা , এফ. আর.জি নয় , আমি পূবে সাবেক জার্মান ডিমক্রাটিক রিপাবলিকে পড়তে গিয়েছিলুম । দ্যাখ্‌ , ইতিহাসের কী লীলা ! সে-যুগে কেউ ভাবতে পারত , যে এক দিন বার্লিন-প্রাচীর ভেঙ্গে পড়বে , দুই জার্মানি ফের এক হয়ে যাবে ? আর আজ এই শিশুদের জানাতে হচ্ছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূর্বে ছিল কম্যুনিস্ট অধ্যুষিত জার্মান ডিমক্রাটিক রিপাব্লিক , আর পশ্চিমে ঝাঁ-চকচকে ফ্রাঙ্কফুট-মুঞ্চেন-হাম্বুর্গের ফেডারেল রিপাব্লিক অব জার্মানি । তেমন অয়ন রূপা রণেরাও দেখবি একদিন তাদের নাতিপুতিদের গল্প করবে যে এক কালে বাঙলাও ছিল দ্বিখণ্ডিত দুটি দেশ !

    যা হোক্‌ , আমার বৌবাজার-হাওড়া করা চোখে তখন পূর্ব জার্মানির শান ও কিছু কম ছিল না । সেই আমার প্রথম বিদেশযাত্রা । বড্ড ভালো লেগে গিয়েছিল আমার সেই ছোট্ট শহরটিকে । ছবির মত সুন্দর শহর । ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তা । ধোঁয়াদূষণবিহীন রং-বেরঙের ট্র্যমকার চলেছে । রাস্তায় ভিড়ভাট্টা বড্ড কম । আমাদের কলকাতার লোকেদের ভারি অস্বস্তি হয় তাতে । আমাদের মধ্যকলকাতার লোকসংখ্যা সারা কার্ল মার্ক্স স্ট্যাডের লোকসংখ্যার চেয়ে বেশি হবে । শহরের অনতিদূরেই শুরু হয়ে গেছে হাল্‌ কা পাহাড়ি জঙ্গল । তারপরেই আকরিক পর্বতমালা আর্জক্রুসেনরি , যেটা চেক-জার্মান সীমান্ত নির্ধারণ করছে । তার ওপারে , একটু পশ্চিমে প্রখ্যাত চেক শহর কার্লোভি ভ্যারি , যেখানকার ফিল্ম-ফেস্টিভ্যাল জগতবিখ্যাত । তবে না , সে সময় আমাদেরপক্ষে সেখানে যাবার ভিসা পাওয়া অসম্ভব ছিল । কিছু পরেই প্রথম যে শীতকালটা পেলুম , পাথর-চটানো ঠাণ্ডা কাকে বল , হাড়ে হাড়ে মালুম হল । অপার তুষার পাত , দূর থেকে আসা আল্পাইন হাওয়া !

    গা-গরম করতে যেতুম জিমে । জিমনাসিয়ম । একটা দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা যে অত ত্রক্রীড়াপ্রেমী হতে পারে , সাবেক পূর্ব জার্মানি না গেলে জানতেই পারতুম না । বুড়ি-বুড়ি মহিলা আমার চেয়ে বেশি ডিব্স্‌ ফেলতে পারে , মানে বুকডন দেয় , দেখে তো আমার হীনমন্যতা জেগে উঠল । আর , কোন্‌ খেলা নেই ? জিমনাস্টিক্স , এথলেটিকস , সাঁতার , ভলিবল থেকে বক্সিং ফেন্সিং---কী নেই ? কেবল ওদের ফুটবলটা আমার চোখে একটু শিল্পসুষমাবর্জিত , বেশি গা-জোয়ারির খেলা বলে মনে হত । তবে , মোট কথা , আমাদের সেই ছোট শহরের য়ুনিভার্সিটি জিমনাসিয়মে যা যা খেলার আয়োজন ছিল , আজও আমাদের দেশে বড় কোনো স্পোর্টস কমপ্লেক্সে তা মেলা ভার হবে ।

    এই জিমেই হয়ে গেল এক দল বন্ধুবান্ধব । ফ্রান্জ্‌ , নাতাশা , সাদাত , হেলম্যুট , ক্লারা , গুস্তভ , বরিস , হেইডি । আমাদের দলে সাদাত আর লরেন্স আফ্রিকার ছেলে । আলি থাইল্যাণ্ডের । আমাদের তখন প্রথম তিন মাসের ইনটেনসিভ ভাষাশিক্ষার ক্লাস চলছে । এদের সঙ্গে কথা বলে , গল্প করে করে ভাষাটা আরও রপ্ত করে নেওয়া গেল । এদের মধ্যে গুস্তভ আর নাতাশা শিল্ডারের সঙ্গেই বেশি বন্ধুত্ব গড়ে উঠল আমার , কারণ এরা দু'জনে আমার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত । গুস্তভ সওয়া ছ' ফিট লম্বা লাল-চুল লাল-গোঁপের এক পাক্কা প্রাশান । ফিস্ফিসে শুনতে পেলুম , সে নাকি কোন্‌ প্রাচীন প্রাশান অভিজাতের বংশধর । হঁযা , সে-কালের কম্যুনিস্ট জার্মানিতে এটা একটা লুকিয়ে রাখার মত পরিচয় ছিল বটে । গুস্তভ স্বভাবতই গম্ভীর , যদিও তাতে বন্ধুত্ব আটকায় না । দারুণ ভালো জ্যাভেলিন ছোঁড়ে । একবার ওলিম্পিক ক্যাম্পেও ডাক পেয়েছিল । এখনও ওলিম্পিকে যাবার আশা ছাড়েনি , ধঁংউয়াধার প্রাকটিস চালিয়ে যাচ্ছে । গুস্তভের খুব উত্সাহ ভারত সম্বন্ধে । বলে , ভারতীয় যোগবলে বাহুর জোর বাড়িয়ে আরও জোর জ্যাভেলিন ছঁংউড়বে । আমি বললুম , যোগবল-টলের দরকার নেই । তুমি ভারতীয় নাগরিক হয়ে যাও , তোমার যা লেভেল তাতে এমনি তেই জাতীয় চাম্পিয়ন হয়ে যাবে । তখন ভারতের নাগরিক হয়ে ওলিম্পিক কমপিট করতে এসো গে । তাই শুনে গুস্তভ এমন খঁযা খঁযা করে হাসল !

    তো বুঝলি , প্রায়ই বেড়াতে বেরনো হতো । বেশির ভাগই ছোট ছোট সাপ্তাহান্তিক আউটিং । স্যাক্সন প্রদেশের মধ্যেই , পাহাড়ের ঢালে সেই চেক সীমান্ত পর্যন্ত , বা ছোট কোনো গ্রামে । আমি বাঙলাদেশের ছেলে , সবুজ দেখতে অভ্যস্ত --- নদী নালা জলরাশি । কিন্তু জার্মানির পাহাড়ে ছাড়া ছাড়া হাল্কা পাইনবন , পাতলা বরফের আচ্ছাদন । সন্ধ্যে হতেই এক-আকাশ চাঁদ উঠলো , কন্কনে শীতের হাওয়া --- সে এক সুখকর অভিজ্ঞতা ! আসলে , প্রকৃতি তার অঢেল ভাণ্ডার নিয়ে সারা বিশ্বকে যে যে রূপে সাজিয়েছে , তার তো হিসেব হয় না রে ! কুরোসাওয়ার দেরসু উজালা ছবিতে এ'হেন বরফ সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায় । আবার পাকিস্তানের হিংলাজ তীর্থে চলেছে পূণ্যার্থীর দল বালুমরু ডিঙিয়ে । সেখানে ও প্রকৃতির আরেক রূপভাণ্ডার দেখা যাবে ।

    রোনাল্ড হারঅসেন বলে আমাদের আরেক বন্ধু ছিল । আমাদের সহপাঠী নয় , আমাদের চেয়ে বয়সে সামান্য ছোট । ছেলেটি শিল্পী । জলরঙে ভারি সুন্দর ছবি আঁংএক রোনাল্ড । শহরের একপ্রান্তে রোনাল্ডের লাল শেড দেওয়া ছোট্ট বাড়ি । তার মা আর সে থাকে । রোনাল্ডের মা প্রায় দৃষ্টিহীন । আমরা বেশ কয়েকবার গেছি তার বাড়ি । বড়ই স্নেহশীলা মহিলা রোনাল্ডের মা । মায়েরা সব জাতেই এক হয় রে !

    রোনাল্ডের সঙ্গে আমাদের পরিচয় আমাদের সহপাঠিনী নাতাশা শিল্ডারের সূত্রে , এক ছবির প্রদর্শনীতে । শিল্ডারেরও ছবি আঁকার শখ । শিল্ডার ও জল রং ব্যবহার করে । রোনাল্ডের সঙ্গে দোস্তি পাতিয়ে , শিখে , নিজের ছবি আঁকার হাতটাকে আরো শানিয়ে নিতে চায় সে । আমি বলতুম , "শিল্ডি , তুমি তো শিল্পী । এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছিলে কেন ?" মিষ্টি মেয়ে শিল্ডি হেসে বলত , "নৈলে তোমার সঙ্গে আলাপ হত কী করে ?"

    দিন যায় , শিল্ডার দেখি পড়াশুনো ভুলে দিন-কে-দিন আরও বেশি করে ছবি আঁকার দিকে ঝঁংউকে পড়েছে । সারাদিন ছবি নিয়েই থাকে । ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে থাকে রোনাল্ডের বাড়িতে । ছবি আঁকা শেখে আরও ভালো করে । এর মধ্যে শিল্ডির আঁকার হাত আরও খুলেছে । ওর নতুন নতুন আঁকা ছবি দেখায় আমাদের , আমরা তারিফ করি । তখনও কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারিনি বা সন্দেহ করিনি ।

    এবার ঠিক হল , এই গ্রীষ্মে আমরা গুস্তভের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাবো । এখান থেকে বেশি দূরে নয় , প্রায়-পাশের থুরিঙ্গিয়া প্রদেশে । তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য নাকি অসাধারণ ! সে প্রদেশে আছে থুরিঙ্গেনভাল্ড পর্বতমালা ---ঘন জঙ্গল আর পর্বতের সমাহার ! আর থুরিঙ্গিয়া হল মধ্যযুগীয় দুর্গ আর প্রাসাদের পীঠস্থল । সে রকম কোনো এক প্রাসাদেই নাকি গুস্তভের আদি বাড়ি !

    থুরিঙ্গিয়া ! আমি তো এক কথায় নেচে উঠলুম --- এযটিলা দ্য হুন মনে পড়ে গেল । কিন্তু মুশকিল হল , সে কালে আমার মত এক বিদেশির পক্ষে পূর্ব জার্মানির এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাওয়া অত সহজ ছিল না , বিশেষ পারমিট লাগত । শুনে আমি দমে গেলুম । হায় রে , যায় বুঝি এমন এক চমত্কার ভ্রমণের সুযোগ হাত ছাড়া হইয়া ! কিন্তু না , বরিস অভয় দিলো , তার বাবা সেখানকার পার্টির এক কর্তাব্যাক্তি । সে চেষ্টা করবে আমার ট্যুর পারমিটের জন্য । কয়েকদিন টেনশনে ছিলুম । তখন বুঝিনি , আমার থুরিঙ্গেন ভ্রমণ খোদানির্দেশিত ছিল রে , নৈলে তোদের আজ এ' গল্প শোনাতুম কোথ্থেকে , আর আমার জীবনের এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতাই বা জড়ো হত কী করে ?

    এবার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিজুদা বললেন , "কৈ দাও গো সুমি আর এক কাপ চা । গলাটা বড্ড শুকিয়ে এসেছে ।"

    আমাদের উত্কন্ঠার সমুদ্রে ডুবিয়ে রেখে বিজুদা এবার তাঁর প্রিয় অরগ্যানিক চায়ের কাপে এক লম্বা চুমুক দিলেন।

    ॥২॥

    চায়ের কাপটি নামিয়ে আবার শুরু করেন বিজুদা ।

    আমাদের বেড়াতে যাবার প্রস্তুতি চলেছে , ছুটি পড়লেই বেরিয়ে পড়ব । এর মধ্যে হঠাতি যেন অনুভব করতে শুরু করলুম যে গুস্তভের নিজেরই উত্সাহে যেন ভাঁটা পড়তে শুরু করেছে । যে উত্সাহ নিয়ে সে তোড়জোড় শুরু করে ছিল , আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিল , তা যেন অনেকটাই কমে এসেছে । আমরা সকলে দল বেঁধে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই সেটা যেন সে আর চাইছে না তেমনভাবে । শুধু আমি নই আমার অন্য বন্ধুরাও সেটা বেশ বুঝতে পেরেছে । বড়ই আত্মসম্মানবোধ জার্মানজাতের , অনাদর বুঝতে অসুবিধে হয় না । ত্রক্রমে ত্রক্রমে তাই খসে পড়তে লাগলো এক এক জন করে বন্ধু---এ'-ও'-সে নানা অজুহাত দেখিয়ে । শেষে শিল্ডারও যেদিন কাটানোর চেষ্টা করল , গুস্তভ প্রকৃতই আহত হল , "সে কি , তুমি যাবে না ? তুমিও না ? প্লিজ তুমি না করো না , তুমি চলো প্লিজ ।"

    আমার অত ফালতু প্রেস্টিজজ্ঞান নেই । আমার উত্সাহ, গোঠা শহর দেখতে পাবো , যা জার্মান শ্রমিকআন্দোলনের পীঠস্থান । সূঊল শহর দেখতে পাবো---ধাতুঢালাই শিল্পের মক্কা , যেখানকার অস্ত্রকারখানা জগৎ বিখ্যাত । তাছাড়া আমার ট্যুর পারমিটও হয়ে গেছে । শেষমেষ শিল্ডার আর আমাতে এসে ঠেকল । আমরা দু'জনেই চললুম গুস্তভের সঙ্গে তার গ্রামের প্রাচীন বাড়িতে ছুটি কাটাতে ।

    আমি ট্রেনে চলেছি মশগুল হয়ে , দু-পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে । মাঝেমাঝে ফাঁক পেলে ঝোলা থেকে বের করে আমার প্রিয় আড় বাঁশিটিতে ফঁংউ দিচ্ছি । গুস্তভ শিল্ডারের সঙ্গে সমানে গল্প করে চলেছে , ও আমি কথা বললে বিরক্ত হচ্ছে । আমার মনে হতে লাগল , আচ্ছা , গুস্তভ কি শুধুমাত্র শিল্ডারকেই আনতে চেয়েছিল, তাই আমি আসাতে অখুশি হচ্ছে ? অন্য বন্ধুদের আনতে চাওয়াটাও কি তাহলে বাহানা মাত্র ছিল ? তা , আগে বললেই পারতিস বাপু , কী দরকার ছিল আমার কবাব মেঁ হাডিড হবার ? বুঝি না বাপু এ'দেশের রীতিনীতি । যদিও পরে বুঝেছিলুম , শিল্ডারেরও বিশেষ ইচ্ছে ছিল না গুস্তভের বাড়ি আসবার । ও' কেবল এসেছে থুরিঙ্গিয়া প্রদেশের অসাধারণ নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে ছবি আঁকবে বলে ।

    য়ুনিভার্সিটিতে সেদিন এক ভলিবল খেলার ফাইনাল ছিল । আমাদের তাই বেরোতে বেরোতে বেলা হয়ে গিয়েছিল । সূঊল শহর পেরিয়ে গুস্তভ দের গ্রামের বাড়িতে যখন ঢুকছি , সন্ধ্যে হয়ে গেছে । দিব্যি ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে , বেশ উপভোগ্য আবহাওয়া । চাঁদের আলোয় দূরে অনুচ্চ গ্রোসারবিয়রবার্গ শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে । সব মিলিয়ে বেশ মোহময় পরিবেশ , যাকে বলে।

    অবশ্য এই মোহময় আবেশ হোঁচট খেল গুস্তভদের বাড়িতে প্রবেশ করতে না করতেই । এটি আক্ষরিক অর্থেই এক অট্টালিকা । বাড়ির চারিভিতে বিরাট বাগান । হাল্কা ঠেলা দিতেই লোহার প্রধান ফটকটি ঠিক বিলিতি হরর্‌ ছবির মত কঁযা---চ শব্দ করে খুলে গেল । সেই শব্দেই জেগে উঠে দু'টো ভয়ঙ্কর দর্শন কুকুর ঘেউ ঘেউ করে বিকট ডাকতে ডাকতে ছুটে এলো । জার্মান শেফার্ড । ব্রিডটাই হল পাহারাদারের । মেষপাল পাহারা দিত , তাই এদের নাম হয়েছে শেফার্ড ডগ । কুকুর দুটো দেখলুম গুস্তভের বড়ই নেওটা । "মাইকেল" , বলে একটু ঝঁংউকে পিঠ থাবড়ে হাল্কা গলায় ধমক নয় , যেন বাড়ির অনুগত ভৃত্যকে কিছু বলছে এমন সুরে কী একটা বলতেই কুকুর দু'টো দু'পাশে সরে গিয়ে আমাদের পথ করে দিল , আর কড়া নজর রাখতে লাগল আমাদের প্রতি । কুকুর দু'টোর গলায় সারা শরীর ঢাকা রোব পরানো রয়েছে । যখন চলছে , সারা শরীর , মায় পা পর্যন্ত দেখা যায় না , মাটিতে লুটোচ্ছে সেই রোব ।

    ধ্রুপদী য়ুরোপীয় বাড়ি যেমন হয় , এ'ও তেমন এক প্রাচীন অট্টালিকা । বিরাট উঁচু উঁচু শিলিং , মোমবাতিদান । যদিও এখন আর তাতে মোমবাতি নয় , হে বাল্ব জ্বলছে , ভোল্টেজ কম । ফায়ার প্লেস । পুরু গদি দেওয়া সোফা । এ' বাড়িতে এখন গুস্তভের বৃদ্ধ ঠাকুর্দা ছাড়া আর কেউ থাকেন না । আর প্রাণী বলতে দুটো পোষা কুকুর--- জার্মান শেফার্ড ডগ ! ভয়ং কর দর্শন ! তাহলে বুড়োর পরিচর্যা করে কে ? রান্নাবান্না ? কিন্তু , এ'সব প্রশ্ন তো আর বাড়ি ঢুকেই করা যায় না ।

    বৃদ্ধ প্রাশান অভিজাত পুরুষ ! প্রাশানরা নিজেদের একটু বেশি অভিজাত বলে মনে করে, আমাদের দেশের ক্ষত্রিয়রা বা আজকের ঠাকুরেরা যেমন নিজেদের একটু বেশি বীর বা ক্ষমতাশালী বলে মনে করে , তেমন । সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ডিনার হয়ে যায় হের হাইনরাইখ ব্রৌনের । গুস্তভ তাঁর অতি প্রিয় পৌত্র । আমরা তার বন্ধু বলে সেই রাতেই তিনি কৃপা করে একবার দেখা দিলেন আমাদের ।

    কী বলব তোদের , বিজুদা বলে চলেন , কোনো মানুষকে প্রথম দেখলেই শিউরে উঠতে হয় , এমন অভিজ্ঞতা তোদের কারও হয়েছে কখনও ? এই নয় যে তিনি বিকট দর্শন , মূলোর মত দাঁত , ভাঁটার মত চোখ --- তা নয় । রোগা শিড়িঙ্গে বুড়ো মানুষ । গড় জার্মানদের তুলনায় বেশ বেঁটে । দিব্যি কোট-প্যান্টুল পরা । কিন্তু কী বলব তোদের , ওঁর চোখের দিকে তাকালেই গা-টা কেমন যেন ঘিন্ঘিন্‌ করে ওঠে । যেন মরা মাছের চোখ , কোনো দৃষ্টি নেই তাতে । গায়ের রঙ ফ্যাকাশে সাদা । সামনের টেবিলের ওপর হাত দুটো আঙুলের খাঁজে খাঁজে রেখে বসেছেন । আমরা তিনজনে টেবিলের ওধারে । বিন্বিন্‌ করে মৃদু স্বরে কী যেন বলে চলেছেন --- স্বাগত ভাষণ-টাষণ হবে বোধ হয় । তার এক বর্ণও বুঝলুম না , যদিও তদ্দিনে জার্মান ভাষাটা আমার মন্দ রপ্ত হয়নি। ঘরে ফিরতে ফিরতে শিল্ডার বলেছিল , ওটা খাঁটি প্রাশান উচ্চারণে বলা জার্মান ভাষা ।

    অভিজাত জার্মানরা প্রাচীন দেমাক সহজে ভুলতে পারে না ।

    পরের দিনের রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে গতরাতের ওই ঘোলাটে ভাব কেটে গিয়ে মনটা বেশ চন্মন্‌ করে উঠল । মস্ত প্রাচীন অট্টালিকার সামনে-পেছনে ঢালাও বাগান , বা বন বলা উচিত , অন্তত: পেছনের দিকটাকে । বাড়ির সামনে টেবিল-চেয়ার পেতে প্রাত:রাশের ব্যবস্থা করা হয়েছে । আমরা তিনজনে বসে হের ব্রৌনের প্রতীক্ষা করছি । ও মা , কে বলে বাড়িতে অন্য কোনো মনিষ্যি থাকে না ? দিব্যি দু'-জন জোয়ান পরিচারক দাদুর দুই বগলে হাত গঁংউজে তাঁকে হাঁটিয়ে এনে চেয়ারে বসিয়ে দিলে । হের ব্রৌন যত না বেঁটে , তার চেয়ে বেশি বয়সভারে ন্ব্যুজ । দেখি , পরিচারকদ্বয়ের অঙ্গে শার্ট-প্যান্ট নয় , গলায় ফিতে বাঁধা কালো সিল্কের রোব , যেমন কাল কুকুর দুটোর অঙ্গে দেখেছিলুম । বা: বেশ তো , এ'বাড়ির কুকুর আর ভৃত্যের একই পোশাক কেনা হয় নাকি ? কুকুর দুটো গেল কোথায় , দেখছি না তো ? আমরা উঠে দাঁড়িয়ে ঝঁংউকে অভিবাদন জানালুম দাদুকে । শুনলুম , উনি গাউটে পঙ্গু । প্রাত:রাশ শুরুর আগে ফের ওঁনার সেই মৃদুস্বরে সৌজন্যমূলক বক্তৃতা শুরু হল । দুটো লাইন বলতেই গুস্তভ এবার সেই তেমন আধ-চেনা জার্মানে ওঁনাকে কী যেন বলে উঠল , আর উনিও এবার আমার দিকে ফিরে আমার পরিচিত জার্মান উচ্চারণে বলে উঠলেন , "ভারত ?! তুমি ভারতীয় ? থুরিঙ্গিয়া প্রদেশে তোমাকে স্বাগত জানাই ! " তার পর প্রাত: রাশ করব কি , ঝাড়া একটিঘন্টা শুনে যেতে হল ওঁনার ভারত-সম্বন্ধীয় লেকচার । কী নেই তাতে ? বৌদ্ধধর্ম ও তন্ত্র থেকে অজন্তা-ইলোরা মায় ইণ্ডিয়ান কারির গল্প পর্যন্ত ।

    প্রাত: রাশের পর পেছনের বাগানে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান হল । কিন্তু শিল্ডির অনুত্সাহে বেরনো হলনা । সে চায় বাগানে বসে দূর পাহাড়ের স্কেচ করতে । গুস্তভও তাকে ছেড়ে নড়বে না । অতএব , আমি একাই হাঁটতে বেরোলুম বাড়ির পিছনদিকপানে ।

    বাড়ির সামনের দিকটা যেমন সাজানো গোছানো তকতকে , পেছনের দিকটা কিন্তু অগোছালো , গাছগাছড়ার জঙ্গল হয়ে আছে । নানান জাতের গাছ দেখতে পেলুম । তার মধ্যে বেশ কিছু গাছ নিশ্চয়ই কেউ বাইরে থেকে এনে সযত্নে লাগিয়েছে , কারণ য়ুরোপের মাটিতে এ'সব গাছ তো আপনা-আপনিই হয়না । যেমন , একটা বড় হরিতকি গাছ দেখে অবাক হলুম । এতো গাছ থাকতে হরিতকি গাছ এনে কেন লাগিয়েছিল গুস্তভের কোন্‌ পূর্ব পুরুষ ? পেছনে খস্খস্‌ শব্দ শুনে দেখি একটা বড়সড় হরিণ । শিংওলা । একটু দূরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । এ'ও তো জার্মানিতে এমনি এমনি চরে বেড়ায়না , নিশ্চয়ই এনে পোষা হয়েছে । আবার একটু এগিয়ে গেছি , দেখি দিব্যি একটা মেষশাবক । চাষের নয় , একটি । নিশ্চয়ই পোষা । গুস্তভের দাদু বাড়িটাকে এক চিড়িয়াখানা করতে চেয়েছিলেন না কি ?

    যা হোক্‌ , হাল্কা হাওয়ায় রোদ্দুরে বেশ বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি । চমৎ কার লাগছে । আপন মনে গুণগুণ করে এক তারানা ভাঁজতে ভাঁজতে বাগানের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি । এ'দিকটায় জঙ্গল শেষ হয়ে এসেছে । একটু এগিয়ে একটা বাঁক ঘুরে দেখি মস্ত এক দীঘি ! জার্মানিতে এসে আমাদের বাঙলাদেশের মত মিষ্টিজলের বড় পুকুর দেখতে পাবো , ভাবিনি । বেশ টলটলে জল । চারিদিকে ঘন গাছের প্রহরা বলে চট্‌ করে দেখা যায় না পুকুরটাকে । পুকুর দেখেই সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করল , খঁংউজছি ঘাটটা কোথায় ? হঠাৎ চোখে পড়ল কিনারায় চারপাঁচজন শ্বেতাঙ্গিনী নিরাভরণ স্নান করছেন পুকুর জলে !!

    আমি ভয়ানক লজ্জা পেয়ে পিছিয়ে এলুম । ভীষণ অবাক হয়েছি ! জার্মানির এক প্রত্যন্ত গ্রামের পুকুরঘাটায় আমাদের বাঙলাদেশের মত বৌঝিরা নাইছে ? এখানেও এমন রীতি আছে নাকি ? জানতুম না তো ! এই গাছের আড়াল থেকেও শুনতে পাচ্ছি অপরিচিত ভাষায় তাঁদের খলর বলর হাসিঠাট্টা --- এ'ওর গায়ে জল ছিটিয়ে যেমন করে । আমার এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত , কারণ মহিলার দল এবার হয়ত স্নান সেরে উঠবেন । মুখোমুখি হয়ে পড়লে ওঁনারা কী মনে করবেন ?! গুস্তভ জানতে পারলে তার কী ধারণা হবে আমার প্রতি ?! লজ্জায় মাথা কাটা যাবে আমার । কিন্তু কোন্‌ পথ দিয়ে পালাবো ভাবছি --- ওঁনাদের মুখোমুখি না হতে হয় । ভাবতে ভাবতে কখন শুনি পুকুরের দিক থেকে মহিলাদের কোলাহল একেবারে থেমে গেছে । নিশ্চুপ ! কোনো সাড়া শব্দ নেই আর । অবাক হলুম । সে কি , ওঁনারা কি তবে ও'দিকের কোনো ঘাট দিয়ে উঠে চলে গেলেন ? সঙ্কোচ ঝেড়ে কৌতুহলে আমি গুটিগুটি ফিরে এলুম পুকুরধারে । অবাক কাণ্ড ! কৈ , কেউ তো নেই কোথ্থাও , কেবল চারপাঁচটা রাজহাঁস জলকেলি করছে । মানুষজনের চিহ্ন মাত্র নেই ! আশ্চর্য , ঠিক দু'মিনিট আগেই একঝলক দেখেছি মহিলার দলকে , তাদের কলকাকলি নিজকানে শুনেছি , জলে লাফন-ঝাঁপনের শব্দও শুনেছি বেশ কিছুক্ষণ ধরে । এই সামান্য সময়ের মধ্যে পাঁচ জন মহিলা কোথায় উবে যাবেন ? আমি একেবারে জলের কিনারায় এসে ঝঁংউকে দেখলুম । বিরাট পুষ্করিণী , ছোটখাট হ্রদ বলা চলে । তার চারিধারে কোনো ঘাটই বাঁধানো নেই । মানুষের পক্ষে তাই ওঠানামা করাই মুশকিল । ওঁনারা নামলেন কোথা দিয়ে , আর উঠে চলে গেলেনই বা কোন্‌ পথে ? সাঁতার কেটে যে অন্য দিক দিয়ে চলে যাবেন , তাতেও তো সময় লাগবে । মনটা খঁংউতখঁংউত করতে লাগল । আমাদের দেশ ভারতবর্ষ নয় যে "ঠিক দুক্কুর বেলা , ভূতে মারে ঢেলা " । রীতিমত কম্যুনিস্ট দেশ , এখানে এমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটে কী করে ? কী বলেন , শ্যামল বাবু ?

    শ্যামলের দিকে ফিরে এক ঠেস-দেওয়া হাসি ছুড়ে দেন বিজুদা , আর বলে চলেন :

    আমার আর বেড়ানো হল না, ফিরে এলুম বাড়ির সামনের লনে , যেখানে গুস্তভ ও শিল্ডারকে গল্প করতে দেখে গেছি।

    এখন দেখি শিল্ডার একা বসে আছে উদাসচোখে । সামনের ক্যানভাস শাদা , কোনো স্কেচ করেনি তাতে সে । বসলুম সামনের চেয়ারটায় ।

    কী হয়েছে ? কিন্তু স্বাভাবিক ভদ্রতায় প্রশ্ন করা যায় না বান্ধবীকেও , সে নিজে থেকে কিছু না বললে । ওকে আর বিরক্ত না করে উঠে আসতে যাচ্ছি , শিল্ডি বলল স্বগতোক্তির ঢং-এ , "আমার আসা উচিত হয়নি , আগে নিশ্চিত হলে আমি আসতাম না ।"

    কী হয়েছে ?

    চুপ করে থাকে শিল্ডার ।

    এবার আমি নিশ্চিত হলুম , গুস্তভ আর শিল্ডারের মধ্যে নিশ্চয়ই একটা মান অভিমানের পর্ব চলেছে । কিন্তু আমার চোখে আগে অত সিরিয়াস ভাবে কিছু ধরা পড়েনি। এখানে একটা কথা বলি , শিল্ডার যদিও আমার সমবয়সী সহপাঠিনী , গোড়া থেকেই কিন্তু ওকে দেখে আমার নিজের ছোট বোন মিনির কথা মনে হত । তার কারণ , মিনিও শিল্ডারের মত জল রং এ চমত্কার ছবি আঁকে । আর শিল্ডারও গড় জার্মানের মত লম্বা-চওড়া দশাসই নয় , লাফান-ঝাঁপান কম করে । একটু ঠাণ্ডা-ঠুণ্ডি নরমভাব আছে ওর মধ্যে । চোখে পুরু পাওয়ারের চশমা । রিল্কের কবিতা পড়তে ভালবাসে ।

    "গুস্তভ চায় না আমি রোনাল্ডের কাছে যাই , ছবি আঁকা শিখি "--- অন্য দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল শিল্ডার ।

    "সে কি ?" অবাক হলুম আমি , " তোমাদের মধ্যে কি.........? সরি শিল্ডি , আমি বুঝতে পারিনি । সেক্ষেত্রে আমারই উচিত হয়নি তোমাদের সঙ্গে আসা ।" কথাটা বলে ফের আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়তে যাই ।

    "বসো , বিজু বসো । তুমি আমার শুভানুধ্যায়ী বন্ধু । বসো তুমি ।" শিল্ডি বলল ।

    আমি বসে গেলুম ।

    শিল্ডার আপন মনে বলে চলে , "দেখ , আমার দিক থেকে কোনো সাড়াই নেই । আমি কখনওই গুস্তভকে আমার এক সহপাঠী বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবিনি , অন্যচোখে দেখিনি । কিন্তু গুস্তভ দিন-কে-দিন ভীষণ পজেসিভ হয়ে পড়ছে । ও' নিজের মনে মনে কত কী ভেবে নিয়েছে , কত দূর এগিয়েছে , জানিনা । আমার এখানে বেড়াতে আসাটাকে ও' আমার সম্মতি বলে ভেবে নিয়েছিল । সে-ভুলটা আজ ভাঙ্গাতে বাধ্য হলাম ।" দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে শিল্ডার ।

    " যাই হোক্‌ , শিল্ডি " , বলি আমি , " তোমরা দু'জনেই প্রাপ্তবয়স্ক যুবক-যুবতী , জার্মান । নিজেদের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যথেষ্টই সক্ষম তোমরা । এই বিষয়ে তাই আমা-হেন এক বিদেশির নাক গলাতে যাওয়াটা বাতুলতা হবে ।"

    "না , প্রাশানরা সর্বদাই নিজেদের একটু উঁচু জাত বলে মনে করে । ওদের চোখে আমি আদত জার্মান নই । আমরা ছিলাম শরণার্থী । কারণ , আমার পূর্বপুরুষ এসেছিলেন পোল্যাণ্ড-লিথুয়ানিয়া সীমান্ত থেকে রূরের কয়লাখনিতে কাজ করতে । এরা আমার সে-পরিচয় কোনো দিনই ভুলতে পারবে না । এরা প্রচণ্ড বর্ণসচেতন জাত ! "

    এ' সব আমার কাছে নতুন তথ্য বটে । যা হোক্‌ , শিল্ডি আমাকে ভরোসা করে বলেছে বটে , তবে এ'নিয়ে আর বেশি কথা কচলানো উচিত হবে না । তখনও কি জানি রে সীমা , এর পরের ঘটনাই এমন দিকে মোড় নেবে যে আমাদের থুরিঙ্গিয়া বেড়াতে আসার অভিজ্ঞতাটাই অনন্য হয়ে থাকবে আমার জীবনে ? " এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এবার সীমার বাড়ানো চায়ের কাপখানি টেনে নেন বিজুদা । সঙ্গে আমরাও ভাগ পাই এবার ।

    ॥৩॥

    গুস্তভ দের এক তলার মস্ত হল ঘরটায় এক অর্গ্যান রাখা আছে । দুপুর গুস্তভ বাজাচ্ছিল । আমি পাশে বসে শুনছিলুম । একটু ঢুলুঢুলু লেগেছে , হঠাৎ ওপর থেকে একটা প্রবল চীত্কার শোনা গেল ! শিল্ডারের গলা ! চমকে উঠলুম । গুস্তভের হাত থেমে গেছে । আমরা দু'জনেই দৌড়লুম সিঁড়ি বেয়ে । ওদের মস্ত জার্মান শেফার্ডের একটা দৌড়ে নিচে নেমে গেল আমাদের পাশ দিয়ে । সেকি , কুকুরটা শিল্ডারকে কামড়ালো নাকি ? দৌড়ে শিল্ডির ঘরে ঢুকে দেখি প্রায় তাই !

    "কী হয়েছে , শিল্ডি , চেঁচিয়ে উঠলে কেন ? কী হয়েছে ? " ভয়ে থর থর কাঁপছে সেই জার্মানকন্যা । আমরা ধরাধরি করে ওকে এনে বসালুম সোফায় । সে তখনও কাঁপছে । গুস্তভ দৌড়ে বেরিয়ে গেল । পরক্ষণেই একটা ছোট্ট গ্লাস হাতে নিয়ে ফিরে এলো।

    "ব্র্যণ্ডি"।

    শিল্ডার তা ও নিচ্ছে না গুস্তভের হাত থেকে । কাঁপছে । সন্দিগ্ধ চোখে তাকাচ্ছে গুস্তভের দিকে । আমি ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললুম , "কী হয়েছে , শিল্ডি ? ব্র্যণ্ডি । এটুকু খেয়ে নাও । চাঙ্গা হয়ে উঠবে ।" এবার ব্র্যণ্ডিটুকু গলাধ:করণ করে শিল্ডার । একটু ধাতস্থ হয়েছে এবার । আমি আবার নরম গলায় পুছি , "কী হয়েছিল , শিল্ডি ? চেঁচিয়ে উঠেছিলে কেন ? ভয় পেয়েছ কোনো কারণে ? কী হয়েছিল আমায় বলবে না ? "

    "কুকুরটা.........ওই কুকুরটা........" । আঙুল তুলে দরজার দিকে দেখায় শিল্ডার ।

    "কী করছে ওই কুকুরটা ? কামড়াতে এসেছিল তোমায় ? "

    এবার চুপ করে গেল নাতাশা শিল্ডার । কেমন এক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল গুস্তভের দিকে । তার পর ঘাড় নেড়ে বলল , "হঁযা" ।

    বাড়ির পোষা ঐ মস্ত জার্মান শেফার্ড কুকুরটা কামড়াতে গিয়েছিল শিল্ডার কে ? কেন ? আমার যেন বিশ্বাস হল না । কেবল মনে হতে লাগল , কিছু যেন চেপে গেল শিল্ডার ।

    ***

    বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছিলুম আমরা তিনজনে । গ্রামটা ছোট । পায়ে হেঁটে দেড় ঘন্টায় ঘুরে আসা যায় । গ্রামের বাইরে দিয়েই অবশ্য পাহাড়ে ট্রেকিং-এর জন্য পথ কাটা আছে । ও'দিকে শীতকালে স্কি করা হয় । "আর জানো , কাছেই আছে ওয়াইমার গ্রাম , যেখানে জার্মানির দুই দিকপাল কবি গ্যেটে আর শিলারের ভিটে । আছে প্রখ্যাত আইসেনাক গ্রাম --- যোহান সিবেস্তিয়ান বাখের জন্মস্থান ! সব ঘুরে দেখাব তোমাদের ।" আমি অবাক হই , বলি , "সেকি গুস্তভ , তোমাদের এই অঞ্চল এতো মণিমাণিক্যে ভরা , কৈ আগে বলোনি তো ? চলো , কাল আইসেনাক ঘুরে আসি ।"

    "আমি কাল হস্টেলে ফিরব "--- শিল্ডারের শীতল ঘোষণা ! এবং ওর গলায় এমন একটা দৃঢ়তা ছিল যে গুস্তভ আর কথাই বাড়াতে পারলো না , থমথমে হয়ে গেল আবহাওয়াটা । বাড়ির দিকে ফিরতি হাঁটা দিলুম আমরা । খানিকপরে হাঁটতে হাঁটতে গুস্তভ বলল , "সত্যি , আমাদের গ্রামে এসে তোমরা বেশ বোরড্‌ হচ্ছ , না ? চলো , একটা ম্যাজিক শো'র আয়োজন করা যাক্‌ , ম্যাজিক দেখতে ভালো লাগে তোমাদের ? দেখবে তোমরা একটা ম্যাজিক শো ?"

    ম্যাজিকের নামে আমি চন্‌ মন্‌ করে উঠলুম , বিজুদা বলে চলেন , "এই দ্যাখ্‌ , ম্যাজিকের নাম শুনে এই রণ-রূপা-গুগ্গুলের দল যেমন করে উঠল । হঁযা গো , ঠিক বলেছ , তোমাদের মত ম্যাজিক দেখতে আমারও ভারি ভালো লাগে । আমি মহাউত্সাহে বলে উঠেছিলুম , 'দারুণ হয় তাহলে গুস্তভ । কখন দেখাবে ? তুমি ম্যাজিক করতেও জানো না কি ?"

    "যাক্‌ , এটা তাহলে তোমাদের মন:পূত হয়েছে । না, আমি না , আমার দাদু ভালো ম্যাজিক দেখাতে জানেন , ওনাকে রাজি করাবো , উনিই দেখাবেন ।"

    দাদু ? ওই গাউটে পঙ্গু বাহাত্তুরে বৃদ্ধ ম্যাজিক দেখাবেন ? কোনো তাসের ম্যাজিক-ট্যাজিক হবে বোধহয় , ভাবি আমি । আঙুল চলে ওঁনার ? যাহোক্‌ , এখন পা-চালিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে । আবহাওয়াটা হঠাৎ খারাপ হয়ে পড়েছে । আকাশে অকালের মেঘ , বিদ্যুতো চমকাচ্ছে । যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে ।

    কিন্তু রাত দশটা নাগাদ গুস্তভ যখন শিল্ডার ও আমাকে ম্যাজিক দেখাবার জন্য ডেকে নিয়ে গেল তাদের সেই মস্ত অট্টালিকার ভূগর্ভস্থ এক প্রকোষ্ঠে , তখন , সত্যি বলতে কি , বুকটা একটু দুরু দুরু করছিল বটে । কী এমন ম্যাজিক শো রে বাপু , যা মাটির তলায় সেঁদিয়ে দেখতে হয় ? কিন্তু পাছে বন্ধুরা ভীতু-ভারতীয় ভাবে , তাই মুখে কিছু বললুম না , চললুম গট্গট করে গুস্তভের পিছুপিছু । শিল্ডির দিকে তাকিয়ে দেখলুম , সে-ও মুখে কিছু বলছে না বটে , কিন্তু মুখটা বেশ ফ্যাকাশে লাগছে তার । যাহোক্‌ , তখন আর ফেরার উপায় নেই । গুস্তভ অট্টালিকার ঘরের পর ঘর , অলিন্দের পর অলিন্দ পরিয়ে হাতে এক বড় মোমবাতি ধরে সামনে সামনে চলেছে আমাদের পথ দেখিয়ে দেখিয়ে , কারণ সন্ধ্যেয় ঝড়-বৃষ্টি শুরু হওয়া থেকে গ্রামে বিদ্যুত্‌-সরবরাহ নেই (এ' দিক দিয়ে আমাদের দেশের সঙ্গে সেকালের কম্যুনিস্ট জার্মানির বিশেষ তফাৎ ছিল না --- অবশ্য , সে-কথা বলতে বাধা ) । শিল্ডির হাত আমার মুঠোয় , আর ও' যেমন জোরে চেপে ধরে আছে আমার হাতটা , হাতে ঘাম , তাতে ভয় যে সে-জার্মানকন্যেটিও বিলক্ষণ পেয়েছে , তাতে সন্দেহ নেই । কিন্তু ওই যে বললুম , বন্ধুদের সামনে ভীতু প্রতিপন্ন হবার সঙ্কোচ , তাই মুখে কোনো বাক্যি নেই কারো । সোঁ-সোঁ হাওয়া দিচ্ছে খুব , সঙ্গে বৃষ্টিও অবিরাম চলেছে , আর আমরা হেঁটে চলেছি সেই আণ্ডার গ্রাউণ্ড হলের দিকে ।

    সেই ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করে বুকটা আর ও ঢিপ্ঢিপ করতে লাগল । এ'কোথায় এলুম রে বাবা ! ঘরটা কত বড় দেখা যায় না প্রায়ান্ধকারে । একটা গোল টেবিলের ওপর একটা মোমবাতি জ্বলছে । পাশে একটা ছোট তামার পাত্রে এক চামচ ডোবানো রয়েছে , জলটল আছে বোধহয় তাতে । টেবিলের দুপাশে দু'টো চেয়ার । একটিতে বসে আছেন গুস্তভের ঠাকুর্দা হ্যের হাইনরাইখ ব্রৌন । তাঁর সামনের অপর চেয়ারটি শূন্য । টেবিলের অনতিদূরে এক লম্বা বেঞ্চিও রাখা ছিল , প্রথমটায় চোখে পড়েনি অন্ধকারে । কারণ এই কক্ষে ঢুকেই গুস্তভ তার হাতের মোমবাতি খানি ফঁংউ দিয়ে নিবিয়ে দিয়েছে ।

    আমরা তিনজনে গিয়ে সেই বেঞ্চিটিতে বসলুম । কালক্ষেপ না করে হ্যের ব্রৌন বলতে শুরু করে দিলেন , "মাননীয় অতিথিগণ , হাইডেন ম্যানরে আপনাদের স্বাগত" , বলে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে যে-হাসিটি দিলেন , দেখলে কেমন জানি অজানিত ভয়ভয় করে । শিল্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখি তার মুখও ফ্যাকাশ । এই দাদু লোকটিকে প্রথম দর্শনেই অপছন্দ হয়েছিল আমার । এখন তার এই ভণিতা শুনে গা জ্বালা করে উঠল । মাথার ভেতর দপ্দপ্‌ করছে আমার । গুস্তভের ওপর রাগ হচ্ছে । সে দেখি নির্বিকার বসে আছে । এ'হেন ম্যাজিক বোধহয় সে অনেক দেখেছে দাদুর কাছে । আমার গোঁ চড়ছে । দেখি , ভালোয় ভালোয় ম্যাজিক দেখিয়ে ছেড়ে দাও তো ভালো , কঁযাচাল কিছু করেছ কি আমিও কলকাত্তাইয়া কাপ্তান । হয়ে যাবে একটা এস্পার কি ওস্পার । দেখে নেব তোমার ওলিম্পিক জ্যাভেলিন ছোঁড়ার তেজ কত !

    হের ব্রৌন বলে চলেছেন , "আজ যে ম্যাজিক তোমাদের দেখাতে চলেছি , সে এক প্রাচীনবিদ্যা , কোনো মামুলি স্টেজ শো নয় । যে-কারোর সৌভাগ্য হয়না এ'ম্যাজিক দেখবার । তুমি এসে বসো আমার সামনের এই খালি চেয়ারটায় "। কার দিকে আঙুল দেখিয়ে বুড়ো বলল কথাটা মালুম হল না , আমি গট্গট্‌ করে হেঁটে গিয়ে ধপ্‌ করে বসে পড়লুম দাদুর সামনের রাখা সেই চেয়ারটায় ।

    আমার এই চট্‌ জলদি সিদ্ধান্তে উনি বেশ একটু থতমত খেয়ে গেলেন , মনে হল । চুপ করে গেলেন । গুস্তভ এবার এগিয়ে এসে দাদুর কানের কাছে কী যেন গুজগুজ করে বলতে লাগল । তারপর আমার দিকে ফিরে বলল , "বিজু , তুমি ওঁনার চেয়ে লম্বা । তোমাকে দিয়ে হবে না । তুমি উঠে এসো । শিল্ডার বসুক এসে ।"

    আমার বেজায় রাগ হচ্ছিল । এই দাদু-নাতি মিলে কিছু একটা অপকর্ম করার চেষ্টা করছে নাকি ? তেমন কিছু বিগড়োতে দেখলে হোস্ট বলে রেয়াত করবনা , এখনই বলে রাখলুম , হঁযা , মনে মনে গজরাই আমি । শিল্ডির মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল তারও বিশেষ ইচ্ছে নয় , উপরোধে ঢেঁকি গিলছে । আমি বললুম , "গুস্তভ , বাদ দাও এ'সব ম্যাজিক-ট্যাজিক । অনেক রাত হয়েছে । আবহাওয়াও এত খারাপ । চল তাড়াতাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ি । কাল ফিরে যাবো আমরা ।"

    "কেন ? কেন ? ", বেশ চমকে উঠল গুস্তভ , "তোমরা বললে , আমি ওঁনাকে কত করে বলে আয়োজন করলাম । এখন তোমরা উঠে গেলে কী মনে করবেন উনি ?"

    "কী আর মনে করবেন ? আমাদের দেখতে ভালো লাগছে না , দেখব না , ব্যস্‌ । এতে অত মনে করাকরির কী আছে ?" , আমি ততক্ষণে পাক্কা বুঝে গেছি যে এই দাদু-নাতির কোনো দুরভিসন্ধি আছে , যদিও সেটা ঠিক কী , সেটা ঠাহর করে উঠতে পারছি না ।

    "ঠিক আছে । সামান্য ব্যাপার । আমি বসছি গিয়ে চেয়ারে ।" , ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে বেরিয়ে যেতেই বোধহয় শিল্ডি উঠে দাঁড়ালো । সে-ও জার্মান মেয়ে । নিজেকে ভীতু প্রতিপন্ন করতে কে চায় ? আমি বললুম , "না শিল্ডি , দরকার নেই আমাদের ম্যাজিক দেখে । চল, আমরা ফিরে যাই ।" শিল্ডার দ্বিধাগ্রস্ত । গুস্তভ আগ বাড়িয়ে বলে উঠল , "এই তো শিল্ডি রেডি । তুমি উঠে এসো বিজু । শিল্ডারকে বসতে দাও ওই চেয়ারটায় "।

    অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি উঠে এসে গুস্তভের পাশে গিয়ে বসলুম বেঞ্চি টায় । চোখকান অসম্ভব সজাগ রেখেছি । মন বলছে , খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে ।

    শিল্ডার তাঁর সামনে গিয়ে বসতেই হ্যের ব্রৌন তাঁর কোটের পকেট থেকে ছোট একটা নোট বই গোছের বের করে একঘেয়ে সুরে কী যেন পড়ে যেতে লাগলেন , ভাষা আমার অজানা । মিনিট দশেক কেটে গেছে , পাঠ চলছে । আমার সজাগতা একটু শিথিল হতে শুরু করেছে । এমন সম্য হের ব্রৌনের কন্ঠে স্পষ্ট সংস্কৃত উচ্চারণে মন্ত্রপাঠ শুনে চাবুক খেয়ে উঠে বসলুম :

    "ঔঁ ক্লীং কালী কৈবল্য ধারিণী.........ওঁ নমো কট্‌ বিকট্‌ ঘোর রূপিণী স্বাহা , ওঁ চামুণ্ডে জয় জয় স্তম্ভয় স্তম্ভয় মোহয় মোহয়...........ওঁ হ: হ: বিশ্বদয়িতে শিল্ডিং মে বশমানায় ঠং ঠ: ঠ:...........শৃগালশ্বনমেষাজবদনে ব্যাপয়েৎ পৃথক..........." ইত্যাদি ইত্যাদি ।

    আমার দেহের প্রতিটি বিন্দু সজাগ হয়ে উঠেছে । এ'মন্ত্র তো আমার চেনা , ভীষণ চেনা । কিন্তু কোথায় কবে শুনেছি এক্ষুণি মনে করে উঠতে পারছি না । ভীষণ চেষ্টা করছি মনে করতে , মনে করতে পারছি না । ছেলে বেলা বহু বার শুনেছি এ'মন্ত্র...........কোথায় , কবে ? কিন্তু , সবচেয়ে আশ্চর্য হল এই যে কম্যুনিস্ট জার্মানির মাটিতে বসে এই পরিস্থিতিতে এক জার্মান বুড়োর মুখ থেকে এ'-সংস্কৃত মন্ত্রপাঠ যে আমায় কোনোদিন শুনতে হবে , তাই কী কোনোদিন ভেবেছিলুম আমি ? মিনিট পাঁচেক একাদিক্রমে চলতে লাগল সে-মন্ত্র পাঠ । আমি হাতড়ে চলেছি আমার স্মৃতি । হঠাৎ দেখি ঐ ছোট পাত্রে ডোবানো চামচটি করে সামান্য একটু জল নিয়ে নিয়ে সামনে বসা শিল্ডারের গায়ে ছিটিয়ে দিতে লাগলেন সেই বৃদ্ধ ! একবার দু'বার তিনবার । আমি এবার চেঁচিয়ে উঠলুম , "এটা কী হচ্ছে , গুস্তভ ? "

    "শ্‌ শ্‌ শ্‌ চুপ্‌ , এক্কেবারে চুপ ।" হিশিসিয়ে উঠল কার্ল গুস্তভ ব্রৌন , প্রাচীন প্রাশান রাজরক্ত বইছে যার ধমনীতে !

    এইবার আমার মনে পড়ে গেছে , সব মনে পড়ে গেছে আমার বাল্য স্মৃতি । দাঁড়াও এর বিহিত আমি করছি ।

    বৃদ্ধ এবার বড়ই ক্লান্ত হয়ে সামনের ঐ গোল টেবিলটাতে দু'হাতের মাঝে মাথা রেখে দেহ এলিয়ে দিয়েছেন ।

    "কী হল ? ম্যাজিক হল কৈ ?" চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি আমি ।

    "দেখছ না , উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ? আজকে আর কিছু হবে না । চল আমরা ফিরে যাই " , পরম নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলল গুস্তভ , গলায় তার কার্যসিদ্ধির সুর ! আমি শুনলুম , যেন সে বলছে , ম্যাজিক আর দেখলে কোথায় , ম্যাজিক তো এবার শুরু হবে ! ও: , আচ্ছা , এই কথা ? দাঁড়াও বাছাধন, এবার আমার খেল দেখ । হঠাৎ দম্কা হাওয়া না কিছু না টেবিলে রাখা মোমবাতিটা ফুৎ করে নিভে গেল দেখে আমরা সবাই ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলুম । আমি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে শিল্ডারের হাতটা ধরেছি । হাল্কা চাপ দিয়ে বলতে চাইলুম , আমি আছি , ভয় নেই ।

    গুস্তভ আরেকটা বাতি জ্বাললো । আর কথা না বাড়িয়ে সেই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে পালাতে উন্মুখ আমরা অতি ক্লান্ত পদক্ষেপে নিচের সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে ওপরে একতলায় উঠে এলুম । তারপর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় । শিল্ডারকে যখন ওর শোবার ঘরের দোরে ছাড়ছি , গুস্তভ যেন শুনতে না পায় এমন চাপা গলায় বললুম , "রাতে ঘরের দরোজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করবে না । আর তোমার চশমাটা আমায় দাও ।" এরপর নিজের ঘরে ফিরে এসে একটি ঘন্টা আমি সময় নিয়েছি নিজের কর্তব্য স্থির করতে ।

    ॥৪॥

    পরের দিন প্রত্যুষে সেই থুরিঙ্গিয়া প্রদেশের ছোট্ট গ্রাম খানি পেছনে ফেলে শিল্ডার আর আমি যখন বাসে করে চলেছি গোঠা শহরের উদ্দেশ্যে হস্টেলে ফেরার ট্রেন ধরতে , শিল্ডি কেবল কেঁদেই চলেছে আর বলছে , "বিজু , আমি মরেই যেতাম । তুমি আমায় বাঁচিয়েছ ।" । আমি চারপাশটা দেখছি , বাসের মুষ্টিমেয় লোক-ক'জনই বা কী ভাবছে ?

    পরে যখন ট্রেনে উঠেছি দু'জনে , অনেকটা ধাতস্থ হয়েছে শিল্ডার । বলল , "এ'দুদিনে কী ঘটে গেল আমায় একটু বুঝিয়ে বলবে ? আমার মাথায় তো কিচ্ছু ঢুকছে না , তার ওপর কাল রাত্তিরের ওই প্রবল মাথা যন্ত্রণা । এ'দিকে চশমা ছাড়াও দেখি না কিছুই "।

    আমি বললুম , "বাছা , তাহলে তো তোমাকে চলে যেতে হবে সুদূর ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্তে আসামপ্রদেশ , যেখান কার কামরূপ-কামাখ্যা অঞ্চল হল তন্ত্র সাধনার পীঠ স্থান ।"

    "তন্ত্র ? সেটা আবার কী বস্তু ?" নাতাশা শিল্ডারের প্রশ্ন ।

    "তাহলে তোমাকে সব গোড়া থেকে ই বলি , শোনো ।

    "সৃষ্টির আদি কাল থেকে ই মানুষের চাওয়ার আর শেষ নেই । মানুষ চাইছে , চেয়েই চলেছে । প্রথমে খেতে-পরতে হবে , সেটা চাই । সেটা হল । মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই । হল । এতেই থেমে গেলে তো গল্পই খতম । মানুষের সব কিছুই চাই --- টাকা-পয়সা , ধনদৌলত , মান-যশ-প্রেম-ভালোবাসা । পুব-পশ্চিমের প্রাচীন মুনি ঋষিগণ বলিলেন , এ'সব হল ঠুন্কো , আসল হল ঈশ্বর । অতএব তাঁকেও আমার চাই । তাঁকে পাবার উপায় কী ? কঠোর সাধনা , তপস্যা । একদল বলল , এ'তো অনেক দীর্ঘ , কঠিন পথ । আর , এতে সাফল্য যে আসবেই তার স্থিরতা কী ? অতএব , কেজো পথ বাতলাও --- যাতে আমার আরাধ্য কে পাবো , আমার কাম্যবস্তু , কাম্যজনকে পাবো । শুরু হল তন্ত্র সাধনা । বৌদ্ধ ধর্মের মতই , বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিবাদী আন্দোলন হিসেবেই প্রথম তন্ত্র সাধনার শুরু হয় , সম্ভবত: খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে , উত্তর ভারতে । বৌদ্ধধর্মে ও তান্ত্রিক আচারের এক দীর্ঘধারা আছে তিব্বতে । সপ্তম শতাব্দী থেকে পূর্ব ভারতে তন্ত্রের চর্চা বেড়ে যায় । আসামের কামরূপ-কামাখ্যা অঞ্চল হয়ে ওঠে তার পীঠস্থান ।

    ভারতে বৃটিশ শাসনের সময় থেকে 'ইণ্ডোলজি' বা 'ভারতবিদ্যা'-র চর্চা শুরু হয় । প্রাচীন ভারতের যা যা জ্ঞান-বিদ্যা ছিল , তা আহরণ করতে লাগল য়ুরোপ । সংস্কৃত থেকে উপনিষদের প্রথম অনুবাদ করলেন জার্মান পণ্ডিত মহামতি ম্যাক্সমূলার । ভালোর সঙ্গে সঙ্গে মন্দটাও এলো--- মন্ত্র-তন্ত্রের মাধ্যমে চট্‌ করে কাম্যবস্তু লাভের প্রয়াস -- তাও এসে উঠল য়ুরোপে । গুস্তভের পিতামহ হাইনরাইখ ব্রৌনকে দেখে প্রথম থেকেই আমার এক কুটিল তান্ত্রিক বলে মনে হয়েছিল ।

    আমার দাদামহাশয় , মায়ের বাবা , ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদের মানুষ ছিলেন । পেশায় এল. এম. এফ. ডাক্তার , কিন্তু নানান নতুন নতুন বিষয়ে ঔত্সুক্য ছিল তাঁর । কামরূপ-কামাখ্যায় নাকি মানুষের গায়ে মন্ত্রপূত বারি সিঞ্চন করে ভেড়া-হরিণ-শুয়োর বানিয়ে রেখে দেয় , এ'গল্প শুনে যৌবনে এক গুরু ধরে কামাখ্যায় গিয়ে ওঠেন । কয়েক বত্সর ছিলেন সেখানে । পরে ঘৃণায় এ'পথ ত্যাগ করে ঘরে ফিরে আসেন । কিন্তু তাঁর অটুট চরিত্র বলে আকৃষ্ট হয়ে সে-অঞ্চলের বেশ কিছু মানুষ বহুদিন অবধি তাঁর সান্নিধ্য করতে আসত । তার মধ্যে তাঁর সবচেয়ে নেওটা ছিল এক কালীসাধক , কৈবল্যনাথ নাম তার--- রোগা , ক্ষয়াটে ,চ্যাপ্টা নেকো এক আধ পাগ্লা । তার নাকি অপার তান্ত্রিক ক্ষমতা ছিল । যদিও তখন তাকে নিয়ে আমার মামাবাড়িতে ঠাট্ট-এয়ার্কি কম হত না , তখন কী জানি , শিল্ডি , যে ওই ক্ষ্যাপাটে কৈবল্য নাথের কাছে জানা বিদ্যেতেই সুদূর জার্মানিতে এক দিন তোমার প্রাণ বাঁচবে ?

    দাদা মহাশয়ের দেহত্যাগের পরেও বহু বত্সর যাবৎ সেই কৈবল্যনাথ প্রতি জ্যৈষ্ঠ মাসে একবার করে ঠিক আসত আমার মামাবাড়ির দেশে , হুগলি জেলার সেই গ্রামে । দাদুর জন্মদিনে তাঁর ছবির সামনে পূজা-হোম করত । আমার দিদিমা বেঁচে ছিলেন দাদা মশায়ের প্রয়াণের পরও প্রায় ত্রিশ বছর । তাঁকে 'মা'-বলে সত্যিসত্যিই তাঁর পদধূলি লেহন করতে দেখেছি আমরা । শেষবার বলে গেলেন , আর আসবেন না , তাঁর শরীর ছাড়ার সময় হয়েছে । আর আসেনওনি ।

    মামারা গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে আসবার আগে পর্যন্ত আমাদের শৈশবে গ্রীষ্মাবকাশে মামাবাড়ির গ্রামে বেড়াতে যাবার একটা চল ছিল । সেখানে ঐ কালীসাধকের মুখে এই বশীকরণ ও উচ্চাটন মন্ত্র বহুবার শুনেছি আমি , যা ফের বহু বচ্ছর পরে কাল শুনলুম হের ব্রৌনের মুখে । কাল তাই ঐ সংস্কৃত শ্লোক শুনে চমকে উঠেছিলুম , মনে করতে চেষ্টা করছিলুম কোথায় কবে শুনেছি এ'-শ্লোক । পরে যখন মনে পড়ে গেল তখন তো প্রাঞ্জল । কারণ মা-দিদিমার বকুনি এড়িয়ে আমরা ভাইবোনেরা এই সব মন্ত্র আউড়ে "তান্ত্রিক-তান্ত্রিক" খেলতুম ছেলেবেলায় । ছেলেবেলায় শেখা কত ছোট খাট চিজ্‌ যে অবলীলায় মনে থেকে যায় !

    মনে পড়ে গেল , এক বিকেলে দালানের সিঁড়িতে দিদিমার পদতলে বসে কৈবল্যনাথ বলছে আর আমরা মা-মামা-মামাতো ভাই বোনেরা সব গোল হয়ে বসে শুনছি : "বুঝলে কাকা , এই মন্তর যদি মূল শোলোকের শেষে বল , তো সে ভেড়া হয়ে তোমার পায়ে পায়ে ঘুরবে । আর আজ যে আমি মূল শোলোকের আগে বলে দিলুম তোমাদের ভিটেয় , --- মুক্ত হয়ে গেল গো , সে মুক্ত হয়ে গেল । ওঁ শান্তি । ওঁ শান্তি ॥।" বলতে বলতে হটাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল সেই ভাবপাগ্লা তান্ত্রিক কৈবল্য নাথ ।

    এই বার দিদিমা উঠে গেলেন , কৈবল্য নাথ বিড়ি ধরাবে বলে ।

    "বুঝলে দা'ঠাউর , যত্তবড় মন্ত্রপূত: বারিই হউক , হত্তুকিটি যদি ত্রুটি যুক্ত হয়েছে , পচাগলা , তো সে-বারির গুণই যাবে উল্টে । মজা দেখ , এই হত্তুকি হল মন্ত্রবারির অঙ্গ , ইটি ছাড়া মন্ত্রবারি তৈরিই হবে না , আবার এই হত্তুকিই যদি একটু ত্রুটিযুক্ত হয়েছে , তো সেই বারিই উল্টো ফল দেবে । আর যদি সেই কাপালিকটাকে ই ফাঁসাতে চাও তো সকলের অজান্তে কমণ্ডলুতে এক স্ফটিকখণ্ড ডুবিয়ে রেখে দিও । সে-ই বেটা ভেড়া-কুকুর বনে ঘুরবে । এই যা: শ্লা বলে ফেললুম গো । ডাক্তারবাবু পই পই করে বলে গেসলেন , ক্যাবলা , ও'সব তন্তোর-ফন্তোর ছাড়্‌ । প্রকৃত সাধনা কর । ফেঁসে গেছি গো নাথ , বড্ড ফেঁসে গেছি । এ'জন্মে আর হল না গো দাদা , আর জন্মে ফের এক বার........." আবার কোন্‌ ভাবঘোরে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল সেই পাগল কৈবল্য নাথ ।

    ॥৫॥

    ট্রেন কোনো একটা স্টেশনে ঢুকছে । আমার ক্ষিদে পেয়ে গেছে বড্ড । শিল্ডারের ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই । সে গোগ্রাসে গিলে চলেছে আমার গল্প । আমি থামতেই অধৈর্য হয়ে বলল , "কী হল , বিজু ? থামলে কেন ? বল ? " আমি হাসি । কীরে দুর্ধর্ষ জার্মানজাত , তৃতীয় বিশ্বের এক বুজরুকি গল্পে এতো উত্সাহ কেন ? বলি , "শিল্ডি , তুমি না-চাইলেও গুস্তভ চেয়েছিল তুমি তার হও , তার বশ হও । যখন আবেদন-নিবেদনে কিছু হল না , তোমাকে তার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ফলতে চাইল । তার দাদুর এ'হেন তান্ত্রিক ক্ষমতা সম্বন্ধে পূর্ণওয়াকি বহাল ছিল গুস্তভ --- বাড়িতে অত কুকুর-হরিণ-ভেড়া ঘুরছে কি এমনি এমনি ? তুমি একা যেতে চাইবে না আন্দাজ করে সকলকে নিয়ে প্রথমটায় দল পাকালো গুস্তভ , পরে তাদেরই আস্তেআস্তে ঝেড়ে ফেলে দল ছোট করল , কারণ তার লক্ষ্য শুধু তুমি । আর আমাহেন বিদেশীকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি গুস্তভ । কিন্তু তন্ত্র যে আসল একটা ভারতীয় বিদ্যা , আর আমার এ'সম্বন্ধে সামান্য ধারণা আছে --- এ' কথা গুস্তভ আগে জানলে কদাচ আমায় দলে নিত না সে , আর তাহলে আজ তার প্ল্যান এমন ভাবে বানচালও হয়ে যেত না ।

    গোড়ার দিকটায় আমি কিছু বুঝিনি । প্রথম সন্দেহ হয় পুকুরে সেই রাঁজহাঁসের পাল দেখে । এই দেখলুম একদল স্নানরতা নারী , পরমুহূর্তে দেখি হাঁসের দল । মন্ত্রবলে এই যে 'মেটামরফসিস' করে দেওয়া হয় , তা থাকতে চায় না । ফাঁক পেলেই পুরনো রূপে ফিরে আসতে চায় প্রাণী"

    "হঁযা হঁযা , ঠিক বলেছ , ঠিক বলেছ তুমি বিজু । আমি কী দেখেছিলাম , কেন কাল দুপুরে অমন চীত্কার করে উঠেছিলাম জানো ? " মহোত্সাহে সব প্রকাশ করে শিল্ডার , " কাল দুপুরে ঘরে একটু রেস্ট নিচ্ছি , আব্ছা ঘুমের মত এসেছে । নিচে গুস্তভের অর্গান বাজনা শুনতে পাচ্ছি । হঠাৎ সেই ষণ্ডা কুকুরের একটা কখন ঘরের দরোজা ফাঁক পেয়ে এসে ঢুকেছে । আমি উঠে বসতে যেতেই ,--- এই দেখ বিজু , আমার হাতের রোমগুলো খাড়া হয়ে উঠছে , দেখি , সেই কুকুরটা হঠাৎ সামনের দু'পা তুলে দাঁড়িয়ে উঠল আর একটা মানুষের রূপ ধরে নিল । সেই পরিচারক দু'টোর একটা , যে সকালে গুস্তভের দাদুকে বগল ধরে হাঁটিয়ে এনে প্রাত:রাশে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। আমি এত হতচকিত হয়ে গিয়েছি যে চীত্কার করতে ও ভুলে গিয়েছিলাম । তারপর সে যখন দু'হাত দিয়ে গায়ের রোবটি খুলে নিরাবরণ এগিয়ে এলো আমার দিকে , তখন আমি সম্বিৎ ফিরে পেয়ে প্রচণ্ড জোরে চীত্কার করে উঠি । চম্কে সে-ও ফের কুকুরের রূপ ধারণ করে পালালো , আর তোমরাও ঘরে এসে ঢুকলে ।"

    আমি ঘাড় নাড়ি । হঁযা । বলে চলি , "ঠিক্‌ । এই ঘটনার পরে তুমি আর এ'বাড়িতে থাকতে চাইবে না অনুমান করে গুস্তভ তড়িঘড়ি ম্যাজিক দেখেনোর ছল করে আমাদের ডেকে নিল । মাহেন্দ্রক্ষণ সমুপস্থিত । আমি এদের ভাব-ভড়ং দেখে কিছুটা আন্দাজ করেছিলুম , কারণ ছোটবেলা থেকে এ'সব গল্প আমি অনেক শুনেছি । আমি তাই লাফ মেরে প্রথমেই বসি গিয়ে শয়তানটার সামনের চেয়ারে । কর্‌ বেটা করে দ্যাখা তোর কত ক্ষ্যাম্তা । আমাকে ভেড়া বানাবি ? ঈশ্বর সন্মথনাথের রক্ত বইছে রে আমার ধমনীতে । আমি জানি ওরা তা করবে না । কারণ ওদের টার্গেট আমি নই , শিল্ডি, তুমি ।"

    এইবার কাঁদোকাঁদো শিল্ডার বলে উঠল , "বিজু , কী বলে তুমি সব জেনে ও আমাকে বসতে দিলে ঐ শয়তানটার সামনের চেয়ারে ? সত্যিই যদি সে আমাকে গুস্তভের ভেড়া বানিয়ে রেখে দিত চিরকালের জন্য ? জানো , কাল রাতে সত্যি সত্যি ই আমার মাথায়......"

    "আরে বাবা , ওই জন্যই তো কাল রাতে তোমার ঘরের দরোজাটা খুলে রাখতে বলেছিলুম । এই মন্ত্রের পুরো এফেক্ট পেতে চারঘন্টা লাগে । জানি , তার আগেই আমাকে কাজ হাসিল করতে হবে । বিপরীত মন্ত্রবারি তোমার অঙ্গে ছিটোলেই তুমি পুনরায় মনুষ্যরূপে ফিরে আসবে । শুধু ভয় ছিল ওই ডালকুত্তো দুটো কে নিয়ে । রাতে বাগানে একলা পেয়ে যদি আমার টঁংউটি ছিঁড়ে নেয় ? মায়ের নাম করে বেরিয়ে পড়েছিলুম।"

    "তুমি ওই প্রবল বর্ষণের মধ্যে রাতে বাগানে গিয়েছিলে , বিজু ? কেন ? " আঁতকে ওঠে শিল্ডার ।

    "বা রে , পচা হত্তুকি কুড়িয়ে আনতে হবে না ? গাছতলা থেকে পচা হত্তুকি হাতড়ে হাতেড়ে. কুড়িয়ে , তা আবার কামড়ে-টামড়ে অশুদ্ধু করে তবেই না ডুবিয়েছি সেই মন্ত্রবারিতে । সেই অশুদ্ধ মন্ত্র বারির সঙ্গে বিপরীত মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে তোমার গায়ে ছিটোতেই তো তুমি ফের ..............."হাসি আমি , "তা হে ফ্রলাইন নাতাশা শিল্ডার , সেই মাঝরাতে দুই নয় , চার হাত পায়ে মাটিতে হামাগুড়ি দিচ্ছিলে কেন গো ? গলার স্বরটাও কি আর মানুষের মত ছিল ? ততক্ষণে মেটামরফসিস প্রক্রিয়া পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে যে ।" বলি আমি ।

    করুণ হাসে শিল্ডার , " এখন হাসছ তুমি , বিজু ? মনে আমার সব কিছুই আছে । কাল রাত্তিরের ঘটনা আমি সারাজীবন ভুলতে পারবো না । তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ , বিজন । কিন্তু একটা কথা আমায় বলবে , ঐ মন্ত্রবারি তুমি মাঝরাতে পেলে কোথ্থেকে ? আনতে ফের নিচে নেমেছিলে নাকি ঐ ঘরে ?"

    "না , রাখতে ", আমার গম্ভীর ঘোষণা ।

    "রাখতে ? তার মানে ?"

    "এই সামান্য বিষয়টুকু বুঝলে না হে সরল নারী ? সেই জলভরা পাত্তরটি এনেছিলুম তো তখনই আমার কাঁধের ঝোলার মধ্যে ভরে । নৈলে কাল রাতে শো'র শেষে মোমবাতিটাই বা হঠাৎ নিভলো কী করে , আর আমিই বা তখন টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলুম কী করতে ?"

    "বাব্বা: , তুমি তো হাত-সাফাই য়ে ওস্তাদ দেখছি , বিজু । তাহলে আবার কী রাখতে মাঝরাত্তিরে সেলারে নেমেছিলে ? "

    "শিল্ডি , তোমার চোখে চশমা নেই কেন ?"

    "ও: এবার বুঝেছি", পারিপার্শ্বিক ভুলে লাফ মেরে প্রবল চীত্কার করে ওঠে শিল্ডার । আমার কাঁধে প্রচণ্ড এক চাপড় মেরে বলে , "ওই চশমার কাঁচ মন্ত্রপূত বারির মধ্যে লুকিয়ে ডুবিয়ে রেখে এসেছ তুমি । এখন যদি সেই শয়তান সেই জল ছোঁয়.........."

    "হঁযা হোক্‌ হতভাগা একটা ধেড়ে মোষ বা শুয়োর , আমার আর কোনো উত্সাহ নেই তাতে । আমার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে । আমি এখন বড় বড় দুটো স্যাণ্ডুইচ খাবো ...........ংআকি সুমি রাত তো দশটা বাজতে চলল , তোমার হাতের ডিমের বড়াটাই খেয়ে যাবো নাকি গো ? "

    ***

    আমরা সব্বাই চুপ্‌ । গল্পের ঘোরে কোথায় হারিয়ে গেছি কোন্‌ সে থুরিঙ্গেন পাহাড়ে । অয়ন-রূপা-গুগ্গুলের দল যে গল্প শেষ হলেই হাততালি দিয়ে আরেকটার জন্য ফরমায়েস করে , আজ তাও নেই ।

    কিন্তু কাফকান কনফ্যুশনটুকু তখনও বাকি ছিল যে ! এবার আমাদের সক্কলকে চুপ্সে দিয়ে পুত্রের সেই নতুন বন্ধুটি হঠাৎ গম্ভীর ভাবে ঘোষণা করল , " এ' গল্প টা তো নকল । আমি শুনেছি আগে ।"

    ভাগ্যিস বিজুদার কানে যায় নি । উনি ততক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করে দিয়েছেন ।

    ॥৬॥

    রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে । আমরা সকলে নিচে নেমে এসেছি বিজন দাকে সি-অফ করতে । উনি গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছেন । এমন সময় হুস করে একটা নীল রঙের মারুতি জেন ঠিক আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো । রনের বাবা-মা ফিরছেন । ছেলে কে নিয়ে যাবেন । ভালো-ই হল । আলাপ হয়ে যাবে আজ ওঁনাদের সঙ্গে । ওঁরা দু'জনে গাড়ির দু'পাশ দিয়ে নেমে এলেন । রনের বাবা মাঝ-তিরেশের পাতলা গড়ন চশমা পরা এক ভদ্রলোক । মা শ্বেতকায়া বিদেশিনী । পৃথুলা । সোনালী চুলের বয়স্কা মহিলা । বিজুদার চোখ ঠিক পড়েছে । উনি গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছেন । রনের মা-ও দেখেছেন ।

    "ওয়ের ? বিজু ! বিজন !" বলতে বলতে দৌড়ে এলেন উনি । বিজুদা ও "ও: শিল্ডি , নাতাশা ! " বলতে বলতে গাড়ি থেকে নেমে এসে প্রায় জড়িয়ে ধরেছেন ওঁনাকে । তার পরের মিনিট পাঁচ-সাত দু'জনের মধ্যে বিজাতীয় ভাষায় যা ফোয়ারা ছুটল , তা আমাদের বোধগম্যির বাইরে । আমরা হতভম্ব ! কী সমাপতন ! এঁনার গল্পই এতোক্ষণ ধরে শুনছিলুম আমরা ?!

    তারপর ঘটনার আকস্মিকতা থিতিয়ে এলে রনের মা স্পষ্ট বাঙলায় বললেন , " না বিজু , আমি আর ফ্রলাইন নাতাশা শিল্ডার নই , রীতিমত শ্রীমতি নাতাশা বন্দ্যোপাধ্যায় । বারো বছর হল এ'দেশে আছি । হলদিয়ায় ছিলাম । গতমাসে দিল্লি এসেছি । ইনি আমার স্বামী শ্রীপার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় ।"

    "এই বার বুঝলুম , তোর ছেলের নাম রন কী করে হল । জার্মানদের যেমন রোনাল্ড থেকে রন হয় , তাই না ? আমি রণ ভেবে শুধু শুধু কাতর হচ্ছিলুম ।"

    "হঁযা , আমি তাই ভাবলুম ছেলের পদবীটা যখন বাঙালী হচ্ছে , নামটা মায়ের দিকেরই থাক্‌" , হেসে বলেন উনি।

    "তা বেশ বেশ । তোর মুখে বাঙলাভাষা শুনব , তাই কী আর কোনো দিন ভেবেছিলুম রে ভোঁদাবালা ? "

    "কী ? কী নামে ডাকলে আমাকে ?" কপট রাগে ফঁংউসে ওঠেন ভদ্রমহিলা ।

    "ভোঁদাবালা । ভেবে দেখলুম , এই নামটাই তোকে সব থেকে ভালো মানায় "।

    ॥সমাপ্ত॥



    (পরবাস-৪২,জুলাই , ২০০৯)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)