পরমা থেকে পারু । আশ্চয .র্! কোন যুক্তিতে পরমা রূপ পায় পারুতে বোঝা দায় । কিন্তু সংসার সমস্ত রূপারূপ
বোঝাবুঝির ধার ধারে কই ! পরমা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কোনো অপরূপ তরুণী মূর্তি ।
কিন্তু একে তো গেরস্তঘরে তরুণী বড় বালাই । তার ওপর যদি রূপের সঙ্গে অপ জুড়ে দেওয়া হয় তাহলেই কেলেঙ্কারির
একশেষ । তাই যদ্দিন পারা যায় তরুণীকে কেটে ছেঁটে ছোট করে রাখা ।
অবশ্য আমাদের পরমা এখনও ছোটই আছে । আট কি নয়, হয় কি না হয় । রাত্তিরে সক্কলের পয়লা পাত পড়ে পারু হারু আর পট্লার । হারু হল গিয়ে হরেনচন্দ্র মুখুজ্যে । পারুর ছোট্কা । পারুর থেকে খুব জোর বছরদুয়েকের বড় হবে । আর পট্লা অর্থে হারুর খুড়তুতো ভাই, সুমিতচন্দ্র, ওরফে পটল । সম্ভবত নিটোল পটলের মত চেহারাখানাই তার নামকরণের চাবিকাঠি । সেই যে গপ্প আছে না,
দাদা আপনার কাঁধের মাপ কত ? ছাব্বিশ ইঞ্চি ।
ছাতি ? ছাব্বিশ ইঞ্চি ।
কোমর ? ছাব্বিশ ইঞ্চি ।
আপনি কি শুয়োর ?
তবে এই পট্লা এখনও ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে ওঠেনি । কিন্তু গড়নখানা যেন ওই দিকেই যাচ্ছে । এখনও বয়সটা যে পারুর কাছাকাছিই আছে, বছরখানেকের ছোটবড় হবে । তবে কিনা কাকা ভাইঝি সম্পর্ক । সুতরাং পারুর কাছে মাঝে মাঝেই বেশ ভারিক্কি ভাব ধারণ করে । এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কাকা ভাইঝিরা সব এক মাপের হয় কী করে ? আজকের মলিকিউলার ফ্যামিলির যুগে একটু কষ্টকল্পনা হলেও আমরা যদি টাইম মেশিনে চড়ে গোটা তিরিশেক বছর পিছিয়ে যেতে পারি তবে আকছার দেখতে পাব বড় পুত্রবধূ এবং তস্য শশ্রুমাতার একই সঙ্গে পা ভারী হয়েছে । লুকিয়ে তেঁতুলের হাঁড়ি.তে হাত ঢোকাতে গিয়ে শাঁখা-পলা পরা দুটো চিকন হাতে ঠোকাঠুকি লেগেছে ।
ফিসফিস ফিসফিস ফিসফিস । তিনমূর্তির শলাপরামর্শ চলছে । রাতের খাওয়ার পর নতুন রকের এক্কেবারে পশ্চিমদিকের কোণে পা ঝুলিয়ে বসে পারুর নিশ্চিৎ নির্দেশ শোনা যায়,
--ছোট্কা কাল ভোরবেলা তৈরি থেকো কিন্তু । আমি দালানের দিকের জানলায় টোকা দিলেই বেরিয়ে এসো, বুঝলে ?
পারুর ছোট্কা একটু ভালোমানুষ টাইপ । পারুর কথা বেশ শোনে সে । সমস্তরকমের পরিকল্পনাগুলো কেমন সুচারু রূপে গড়ে তুলতে পারে পারু । তাই মাঝে মধ্যে হীনমন্যতায় ভোগে সে । তবে কিনা হীনমন্যতার মত ভারী শব্দগুচ্ছে নাগাল পায় না সে । শুধু ওই মাঝে মধ্যে মনটা যেন কেমন উদাস উদাস হয়ে পড়ে । ভাবে, ওইগুলো আমার মাথায় আসে না কেন ? ভগবান বড় একচোখো । কেবলই সব বুদ্ধি পারুর মাথায় গজাতে হবে ? ভারী আশ্চর্য !
এদিকে ছোট্কার ব্যবস্থা সেরেই পারু পট্লাকে নিয়ে পড়ে,
--পটলকা, তুই উঠতে পারবি তো ?
--তোর সন্দেহ আছে নাকি ?
--না, মানে আজ ভাতের পরিমাণটা যেরকম দেখলুম তাতে সন্দেহ একটু থেকেই যায় বইকি !
আঁতে ঘা লাগে পট্লার । ভাত বিশেষত: পান্তাটা সে একটু বেশিই খেয়ে ফেলে ।
তাই বলে পারুটা তাকে কাকার মর্যাদা দেবে না ! এমন তাচ্ছিল্য করে যেন সে পট্লার গার্জেন ।
রাগে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে ওঠে । গম্ভীর হয়ে বলে,
--দেখ পারু, খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিবি তো খেলব না যা ।
তা খেলার কথা হচ্ছিল না বটে ! তবে কিনা পট্লার ওই ব্রহ্মতালু জ্বলে ওঠার ঝাঁজটার নির্গমন এই
পথেই হয়ে থাকে । বেচারি কিছুতেই তার চেয়ে বয়সে ছোট পারুকে ডিঙিয়ে যেতে পারেনা ।
এমনকি ক্লাসের পরীক্ষাতেও পারু তাকে পিছনে ফেলে যায় । এই তো সেদিন ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হল পারু ।
যদিও বট্ঠাকুমা তাঁর তূণের সমস্তরকমের বাণ নিক্ষেপ করেছিলেন পারু নামক মেয়ে শিশুটির বিরুদ্ধে,
--বলিহারি তোমার আক্কেল বউমা ! মেয়েমানুষ আবার ইস্কুলে যাবে কি ? ন্যাকাপড়া শিখে বেধবা হলে তখন
দায় নেবে কে ?
কিন্তু বিস্তর বাকবিতণ্ডা শেষে দেখা গেল বট্ঠাকুমার সমস্ত ওজর-আপত্তি নস্যাৎ করে হেডমাস্টার বড়দাদুর সহায়তায় পারু স্কুলের চৌকাঠে পা দিযেছে । পট্লা তখন ক্লাস টু । সারাদিন টোটো খেলাধুলো আর দস্যিপনার মাঝেমধ্যে কখনোসখনো পড়াশোনাও চলে । কিন্তু হলে কী হবে, গজেন মাস্টারমশাই এমন একচোখো যে কিছুতেই পট্লাকে নম্বর দিতে চান না । কী এমন দোষ করেছে সে ? পরীক্ষায় স্কুলের নাম লিখতে দিয়েছিল । তা পট্লা তার নিজের মত করে তাদের ভেলুলাল দাস প্রাইমারি স্কুল পুরো নামটাই লিখেছিল । কিন্তু লিখলে কী হবে, গজেন মাস্টারের শ্যেনচক্ষু আবিষ্কার করল "ভেলুলাল" এর জায়গায় "ভেলিগুড়" ! এই মাত্র অপরাধ । তাতেই নাকি ক্ষেপে গিয়ে তার পুরো খাতায় একটা পেল্লায় রসগোল্লা বসিয়ে দিয়েছেন । তা ভেলিগুড়ের প্রতি টানটা পট্লার সেই হামাগুড়ির বয়স থেকেই । কাঁচের বড় বয়ামে পারুর ছোট্ঠাকুমা ভেলিগুড় রাখতেন । সেই ভেলিগুড় দেখেই একদিন পট্লা হঠাৎ হামাগুড়িতে ইস্তফা দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল । আর বয়াম ধরে মারল কষে টান । কাঁচের বয়াম ভেঙে টুকরো টুকরো । ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভেলিগুড় খাওয়া মুলতুবি রেখে ভেউ ভেউ কান্না জুড়লো শেষে । পারু তখন কোথায় ? সে গপ্প শুনেছে ছোট্ঠাকুমার কাছে । তিনি যখন আদরের পট্লার ছেলেবেলার গপ্প জোড়েন, তখন এই ভেলিগুড়ের গপ্পটা এমন রসিয়ে করেন যে মনে হয় ভেলি সব জল হয়ে মনটা যেন কাদা কাদা হয়ে গেল । তো সেই কেলাস টু আর পেরোনো হল না । পারু টুক করে পাস করে ধরে ফেলল পট্লাকে । পরের বছর পারু থ্রি আর পট্লা যেখানে ছিল সেখানেই । তারপরও দু:খুর কাহিনী আর কত বলি ।
পট্লার বাবা মলয়চন্দ্র মুখুজ্যে, পুরোহিত । গ্রামের যত বাড়িতে পূজোপার্বণ হবে সব ওই মলয়চন্দ্র । দিব্যি সংস্কৃত জ্ঞান । কিন্তু হলে কী হবে, ছেলের পড়াশোনা দেখার কোনো অবকাশ নেই । তবে কিনা ওই অবকাশে যদি আপনি আবার সময়ের হিসেব কষেন তবেই চিত্তির । পূজোটূজো করেও সময় তো অঢেল । তবে কিনা হুঁকো হাতে সেনবাড়ির দাওয়ায় বসে আড্ডা বা টোয়েন্টিনাইনে ওই সময়টুকু বয়ে যায় আর কি ! আর পট্লার মা ব্রজসুন্দরী, মানে পারুর ছোট্ঠাকুমা তো ছেলের সঙ্গে সঙ্গে ফেরেন । ছেলে ফেল করার সমস্ত দায়টুকু ওই একেচাখো গজেন মাস্টারের ওপর ছেড়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত । কিছু বললেই উত্তর হল,
--অমন ম্যাস্টরের মুখে আগুন । ছেলেকে আমার দুচোক্ষে দেখতে পারে না গো । না হলে ছেলে আমার খাতা ভর্তি লিখে এল, আর ম্যাস্টর কিনা তাতে রসগোল্লা আঁকতে বসল !
তো সেই মুখুজ্যে বাড়ির ছেলেটা একেবারে গণ্ডমূখ্যু হবে, সেটা তো আর মেনে নেওয়া যায় না ।
অগত্যা জ্যাঠামশাই রাখালচন্দ্রকেই দায় নিতে হয় । দ্বিতীয়বার কেলাস টুতেই গাড্ডু খেলে উঠেপড়ে লাগলেন তিনি ।
পট্লার আত্মসম্মানে ঘা দিতে তাকে ডেকে বললেন,
--শোন পট্লা, এবার থেকে পারুর কাছে পড়া দেখে নিবি, বুঝলি ?
শোনো কথা ! কাকা হয়ে ভাইঝির কাছে পড়া দেখতে হবে ! শুধু ইস্কুলের জেলখানাই নয়, বাড়ির লোকগুলো পর্যন্ত পট্লার শত্রু । না হলে এমন আদেশ কেউ দেয় !
যাক সে সব দু:খুবেলার সাতপাঁচালি । সেই ভোরবেলার অভিযানের দিনক্ষণ ঠিক করে ওরা তো ঘুমোতে গেল । ঘোর ঘোর ভোরবেলায় যখন কাকপক্ষীও জাগেনি, তখন ঘুম ভেঙে গেল পারুর । ছোট্কাকে ডেকে নিয়ে তারা পট্লার ঘরের কাছে গিয়ে দেখল তখনো সে দিব্যি নাক ডাকছে । যথারীতি ভোরের পাখিরা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে গেলেও পট্লার ঘুম ভাঙার কোনো সম্ভাবনাই নেই । এটা অবশ্য পারুর হিসেবের মধ্যে, তাই সে তৈরিই ছিল । জানলার ঠিক নিচেই পট্লার মাথাটা । উঠোন পেরিয়ে এদিকে আসার সময়ই সে সংগ্রহ করেছিল একটা ধানের শীষ । সেটা দিয়ে সাবধানে তার নাকে একটু সুড়সুড়ি দিতেই আর যায় কোথা ! হেঁচে কেশে অস্থির । পাশে শুয়েছিলেন তার মা, ব্রজসুন্দরী । তিনি ঘুমন্তই ষাট ষাট বলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ।
পারু চুপি চুপি ডাকল,
--পট্লকা চলে আয় শিগ্গির, খিচুড়ি শেষ হয়ে যাবে ।
সম্ভবত: ওই খিচুড়ি শব্দটাতেই যেটুকু ঘুম চোখে লেগেছিল, সেটুকু উধাও হতে একমিনিটও লাগল না । তিনজনে গা-ছম-ছম রাস্তা ধরে অবশেষে পৌঁছে গেল রক্ষেকালীতলায় । সেখানে তখন দক্ষযক্ষ । সারারাত পূজোর শেষে ভোগবিতরণ পর্ব শুরু হয়েছে । কলাপাতা পড়ে গেছে । পাতার কোণে নুন পর্যন্ত এসে গেছে । শুধু খিচুড়ি ঢালা বাকি । তাই প্রবল বেগে ক্যালরব্যালর শুরু হয়ে গেছে ।
কালীতলার লাগোয়া শ্যামপুকুরের পাড় কলাগাছে ভর্তি । সেখান থেকে পট্লা চটপট তিনটে পাতা কেটে এনে বসে পড়ল কোণের দিকে একটা জায়গা একটু খালি দেখে । মাটির ওপর একটু জলের ছড়া দিয়ে কলাপাতা পেতে মাটিতেই বসে পড়া ।
আ: ! কি আরাম ! বছরের এই দিনটির অভিযানের জন্য কি প্রতীক্ষাটাই না করতে হয় ত্রিমূর্তিকে । হয়ত সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গোপন অভিযান বলেই এত উত্তেজনা ।
এদিকে খিচুড়ির জন্য প্রবল হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে,
--ও মশাই, আর কত দেরি হবে ? রাত যে ভোর হয়ে এল ।
কর্মকর্তারা একে রাত জেগে পূজোআচ্চা করে ক্লান্ত । তায় এই ক্যালরব্যালর ।
মাথা ঠিক রাখাই দায় । একজন খেঁকুড়ে গোছের কর্তা অশ্বথ্থামা হত ইতি গজ স্টাইলে হুমকে ওঠে,
--সময় হলেই আসবে, যত্তসব হাভাতেগুলো জোটে এখেনে
তা সত্যি বটে ! গ্রামের এবং গ্রামের বাইরেও যত গরিবগুরবো, আর যতরাজ্যের ভিখিরি সব জোটে এই রক্ষেকালীতলায় । অবশেষে অনেক প্রতীক্ষার খিচুড়ি এল । পাতে দিতেই দেখা যায় তার টান মাটির দিকে । কলাপাতা ছেড়ে সে যেন গা এলিয়ে দেয় ভেজা মাটির টানে । এদিকে বাঁধ দিতে গেলে গরম আগুন খিচুড়িতে হাত পুড়ে যায় । তবে পট্লার ওসবে কিচ্ছু আসে যায় না । সে সপাসপ শুরু করে দিয়েছে । চোখের কোণ দিয়ে পারুর দুরবস্থা দেখে মনে মনে একটু হেসে নেয় । তারপর তার দিকে একটা কৃপাদৃষ্টি হেনে বলে,
--বড্ড গরম না রে ? কলাপাতার কোণটা আলতো করে ধরে থাক । নাহলে সবটাই গড়িয়ে যাবে ।
--তুই চুপ মার দিকি
--ভালো কথা বললুম কিনা
--তোকে আর ভালো করতে হবে না যা । যেমন গিলছিস গেল্ ।
ওদিকে হারু গরম আগুন খিচুড়ির নিম্নগামীতার দিকে উদাস নয়নে চেয়ে কি যেন ভাবছে ।
পারু একটা রামচিমটি দেয় সজোরে,
--উফ্
--এখন বাড়ির কথা না ভেবে আগে খেয়ে নাও । যা হবার সে তো হবেই ।
--আজ আবার বড়দাও থাকবেন বাড়িতে
--থাকুকগে
পারুটা মেয়ে হয়ে এতো সাহস পায় কোথা ভেবে পায় না হারু । তার তো খিচুড়ির পানে চেয়ে চেয়ে পিঠের ছালচামড়ার জন্য মায়া হতে শুরু করেছে । বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ ।
আসল ব্যাপারটি বড়ই গুরুতর । গুরুতর না হলেও নিদেনপক্ষে গরুতর তো বটেই । ওই সেবা যেমন পট্লা গরুর ওপর রচনা লিখতে গিয়ে লিখে এল, গরু অতি গরুতর প্রাণী । বোঝো কাণ্ড ! আবার পট্লাকে নিয়ে টানাটানি কেন ? মুখুজ্যেবাড়ির এই এক মস্ত অসুখ । একটু নরম মাটি পেল তো উঠতে বসতে তাকে নিয়ে বেইজ্জতি । সর্বঘটে তাকে নিয়ে টানাহিঁচড়ে !
যাই হোক কথা হচ্ছিল গিয়ে ওই রক্ষেকালীতলার ভোগ খাওয়া নিয়ে । ওইখানে ভোগ খেতে গেলেই নাকি মুখুজ্যেবাড়ির মান-ইজ্জত খোয় যায় । মান-ইজ্জত কি সোনার মাকড়ি না আঙুলের বেঠিক আংটি, একটু এধারওধার হলেই খোয়া যায় ! আর খোয়া যায় তো ঠিক কোনখান দিয়ে যায়, এটা পারুসম্প্রদায় এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি । তাই প্রতিবছরই লুকিয়ে চুরিয়ে ওই কুস্থানে হাজির হওয়ার ধুম পড়ে । উদ্দেশ্য খুবই সরল । মান-ইজ্জত সম্পর্কে বিশদ জানার চেষ্টা । ব্যাটা দেখতে কেমন ? মুখুজ্যেবাড়ির কোন কানাচে তার বাস ? ঠিক কোন পন্থায় সে খোয়া যায় ? কোন বাহনে চড়ে তার আগমন ও প্রত্যাগমন... ইত্যাদি ইত্যাদি ।
জানার ইচ্ছে, তো ভালো কথা । পারুর বড়দাদু তো প্রায়ই বলেন, ছোটদের জানার ইচ্ছে অদম্য । তাকে কখনও বাধা দিতে নেই, দমিয়ে রাখতে নেই । খোয়া যেতে গিয়ে সে ব্যাটা যদি হাতেনাতে ধরাই পড়ে, তো পারুসম্প্রদায় কি মেনে নেবে না তার খোয়া যাওয়ার ইতিবৃত্তান্ত ! ছোট বলে কি তারা মানুষ নয় ! এবংবিধ নানা যুক্তির জাল বিছানো থাকে পারুদের কোঁচড়ে ।
বড়দাদু যেদিন বললেন, মানুষ হল মান আর হুঁশ, এ দুয়ের সন্ধি । সন্ধিবিচ্ছেদ করেছ কি অমানুষ
হতে আর এক মুহূর্ত সময় লাগবে না । সেদিন এই কথাটা শুনে পারু খানিক গালে হাত দিয়ে বসে রইল, তারপর
পট্লার দিকে ফিরে বলল,
--হুঁ ! মান আর হুঁশ, দুটো তো মাত্র শব্দ, এমনই কি ভারী !
তা বটে ! জীবনের স্বর্ণযুগ তো এই ছেলেবেলাটাই । যখন পৃথিবীর কোনো বিষয়ই ভারী নয় । সবই হালকা পলকা, রঙিন ঘুড়ির মত হাওয়ার টানে আপনিই ওড়ে আকাশপানে । কেবল লাটাইটুকু ঠিকমত ধরে রাখা । ব্যস, তাহলেই হল ।
রক্ষেকালীতলার খিচুড়িভোগ পেটের মধ্যে সেঁধিয়েছে কি সেঁধোয়নি, পড়ি কি মরি করে দৌড়ে বাড়ি ফিরল ত্রিমূর্তি । বড়দের ঘুম ভাঙার আগেই যে যার বিছানায় ঢুকে পড়তে পারলেই কেল্লা ফতে । বড়দের চোখে ধুলো দেবার জন্য কিচ্ছুক্ষণ ঘুমের ভাণ করে তারপর আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে উঠে পড়লেই হল । বড়দের বোকা বানানোর সমস্ত রকম কৌশল পারুসম্প্রদায়ের নখদর্পণে ।
আজ কিন্তু কপাল বড়ই মন্দ । সন্তপর্ণে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোতে যাবে সামনে সাক্ষাৎ রক্ষেকালী । গোবরজলের ছড়া দিচ্ছেন স্বয়ং বট্ঠাকুমা । রক্ষেকালীর সঙ্গে তফাৎ শুধু গায়ের রঙে । দেখেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল ।
সক্কালবেলা তেমাথা একত্রে দেখে গলা তুললেন বট্ঠাকুমা,
--বলি সাতসকালে কোন চুলোয় যাওয়া হয়েছিল ?
একে খিচুড়ির গরম তখনও পেটের ভেতর বাষ্প ওড়াচ্ছে, তায় বট্ঠাকুমার খ্যাঁকানি শুনে পট্লার ঘাম ছুটেছে দিগ্বিদিক আর হারুর লম্বা রোগা ঠ্যাং দুখানার কাঁপন ভূমিকম্পকেও হার মানায় । পারুর গলাটা যে একটুও শুকোয়নি তা নয়, তবু হারু আর পট্লার অবস্থা দেখে সাহসে বুক বেঁধে তাদের দুজনকে পেছনে সরিয়ে এগিয়ে আসে,
--ওই একটু শ্যামপুকুরের দিকে মর্নিংওয়াক করতে গেছিলাম
--দেখ পারু , সক্কাল সক্কাল বমি পাওয়ার মত ওয়াক ওয়াক করবি তো থাবড়া খাবি । যা বলার সিধে বল । কোন চুলোয় গেছিলি ?
এবার ভণিতা ছেড়ে সিধে হয় পারু । শিরদাঁড়া সোজা করে উত্তর দেয়
--রক্ষেকালীতলায়
--কি ? কালীতলায় ?
--হ্যাঁ
--আবার ওই ভিখিরিদের সঙ্গে বসে ভোগ খেতে গেছিস ? পাজি নচ্ছার গেছো মেয়ে ।
ন্যাকাপড়া করে সাপের পাঁচ পা দেখেছিস ? মুখুজ্যেবাড়ির মান-ইজ্জত সব ধুলোয় লুটিয়ে দিলে গো ।
--সেটাই তো পরখ করতে গেছিলাম । ওই হাভাতেগুলো রোগাপটকা হাতে মুখুজ্যেবাড়ির মান-ইজ্জতের নাগাল পায় কী করে ?
সোরগোলে বাড়ির অনেকেরই ঘুম ভেঙে যায় । আর যথারীতি তারা ঘিরে ধরে আসামীর দল ও ফরিয়াদিকে ।
সেই দলে পারুর মাকে দেখতে পেয়ে বট্ঠাকুমা আরো একটু গলা তোলেন, নিজের কপালে করাঘাত করে বলে ওঠেন,
--কি সব্বোনেশে মেয়ে পেটে ধরেছ বৌমা । এই আমি বাসিমুখে বলে দিলুম, এ মেয়ের কপালে দু:খু আছে নির্ঘাৎ ।
সে দু:খের উজান বেয়ে আজও চলেছে সেই সর্বনেশে পারু । অনেকগুলো পাস দিলেও কাজ পায়না ।
কেউ কাজ দিতে চাইলে জিজ্ঞেস করে,
--এ কাজ করলে কি পৃথিবীতে আর কেউ দু:খী থাকবে না ? দু মুঠো ভাতের জন্য হাত পাতবে না ?
ভিখিরি বিশেষণে কারো মানের ঘরে সিঁধ কাটবে না ?
(পরবাস-৪৩, জুলাই , ২০০৯)