আচ্ছা, এটা কার হতে পারে - আমি ভাবলাম । যদিও গাড়িটা তিনকড়িদার পার্কিং স্পটে পার্ক করা আছে, ওদের বাড়িতে তো কোন লোকজন আসতে পারে - তাদের হতে পারে । কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ভাবনার অবসান ঘটিয়ে তিনকড়িদা এসে হাজির । উনি খুব সাবধানে চাবি দিয়ে দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে বসলেন অল্প কিছুক্ষণ । তার পরেই বেরিয়ে এসে উনি গাড়ির চারিদিকে আস্তে-আস্তে ঘুরপাক খেতে লাগলেন, গাড়িটার ওপরে একেবারে নিবিষ্ট মনোযোগ রেখে । মাঝে মাঝে ঝুঁকে পড়ে ন্যাপকিন দিয়ে গাড়ির গা থেকে ধুলো মুছে দেওয়া, বা হাব-ক্যাপ পালিশ করে দেওয়া এসবও চলতে লাগল সমান তালে, প্রায় ছন্দ মিলিয়ে । বেশ কয়েকবার ঘুরপাক খাওয়ার পর তিনকড়িদা সাবধানে গাড়িটায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালেন । বেশ মৌজ করে ধুমপান চলল - আস্তে আস্তে লম্বা লম্বা টান দিয়ে । শেষ সুখটানটা দেওয়ার পর তিনকড়িদা রাস্তায় ঘষে আগুন নিভিয়ে ফেলে দুই আঙুলের এক অদ্ভুত কায়দায় সিগারেটের বাট্টা দূরে ছুঁড়ে ফেললেন । তারপর অতি সাবধানে গাড়ি লক্ করে বিল্ডিং-এর ভেতরে চলে গেলেন । তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে এটা তিনকড়িদার নতুন গাড়ি । ওরা লটারি জিতল নাকি ! আমি মনে মনে ভাবলাম ।
তিনকড়িদা ও ওঁনার বৌ বাণীদি ছিলেন আমাদের ওয়ালডেন স্কোয়ার অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিবেশী । ওরা থাকতেন সাত তলায়, আর আমি ও আমার স্ত্রী রত্না থাকতাম দশে । আমার মতোই তারা দুজনে স্থানীয় ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট ডক্টরাল ট্রেনির কাজ করতেন । ওয়ালডেন স্কোয়ার ছিল রেন্ট-কনট্রোলড অ্যাপার্টমেন্ট, নিতান্তই অল্প আয়ের লোকেদের বাসস্থান । তাই এখানে থেকে নতুন গাড়ি কেনা ছিল একেবারে অভাবনীয় । কিন্তু তিনকড়িদার ব্যাপারটা ছিল একটু অন্যরকম । আমার ও আমার বন্ধু-বান্ধবদের, যারা সত্তরের দশকে এদেশে এসেছি, নতুন হোক, পুরনো হোক - গাড়ি সম্বন্ধে উত্সাহ ছিল বেশ কম । এখান থেকে ওখানে যেতে পারলেই হল, এর বেশি আবার কি । কিন্তু অ্যামেরিকানদের মত তিনকড়িদার ছিল `লাভ অ্যাফেয়ার উইথ অটোমোবিল' । কতদিন আমি তিনকড়িদাকে দেখেছি ওঁনার ভাঙাচোরা নীল রঙের হণ্ডা অ্যাকর্ডের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে । এটা ছিল লেট সেভেনটিস মডেল । কিন্তু তিনকড়িদা একটা নতুন গাড়ির মতো এটাকে যত্ন করতেন । নিয়মিত এর পরিচর্যা চলত, কখনও ধোয়া, কখনও ভেতর পরিষ্কার করা, কখনও ক্রোম ট্রিম পালিশ করা । মনে হত যেন উনি অসীম মমতা দিয়ে নিজের ছেলেপিলের যত্ন করছেন । তিনকড়িদার প্রথম ভালোবাসা ছিল সিগারেট খাওয়া, তার সাথে দ্বিতীয়টা এসে জুটল ।
তিনকড়িদা ছিলেন ভারী আমুদে লোক । যখনই আমাদের দেখা হয়েছে, আমাদের কথাবার্তা মোটামুটি এই ধারায় এগিয়েছে ।
নাও, একটা সিগারেট খাও । একমুখ খুশি নিয়ে তিনকড়িদা বলেছেন ।
না, না, একটু আগেই খেয়েছি । আমার উত্তর ।
আরে খাও, খাও, আর একটা খেলে কিছু হবে না ।
এই বলে উনি প্যান্টের পকেট থেকে বেনসন এযাণ্ড হেজেসের একটা সোনালী রঙের প্যাকেট বার করে তার থেকে একটা সিগারেট অর্ধেক বার করে আমার সামনে হাত মেলে ধরবেন, যেন ঠাকুরকে ফল-মূল উত্সর্গ করছেন । আমি সেই সিগারেটটা সাবধানে তুলে নিয়ে আমার ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরবো, আর তিনকড়িদা সাবধানে একটা লাইটার বার করে আমার সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দেবেন অত্যন্ত মমতার সঙ্গে । তারপর আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য উনি নিজে একটা নতুন সিগারেট ধরাবেন । প্রথম সুখটানটা দিয়েই উনি বলে উঠবেন - এই তো জীবন কালিদা, কি বলো ! আমি মাথা ঝেঁকে সম্মতি জানাবো, এই ছিল আমাদের রুটিন ।
একদিন বিল্ডিং-এর একতলায় দাঁড়িয়ে আছি, এলিভেটরে ওপরে যাব বলে, তিনকড়িদার সাথে দেখা ।
চললে কোথায় ?
কোথায় আর যাব । ঘরে যাচ্ছি ।
চলো, একটু ঘুরে আসা যাক ।
আজ রোববারের দুপুর, কাল থেকে আবার কাজ আরম্ভ, তার গোছগাছ করতে হবে তো । আমি মৃদুভাবে বললাম ।
আরে কাজ করে তো তুমি বড়লোক হবে । চলো একটু ছোট্ট করে ঘুরে আসা যাক ।
এরপর কথা বলার কোন মানেই হয় না । আমি আর তিনকড়িদা পার্কিং লটের দিকে এগোলাম । গাড়িটা দেখেই আমি বলে উঠলাম -
তিনকড়িদা, জব্বর গাড়িটা কিনেছেন ।
ঠিক বলছ ?
উনি যে গাড়িটা সম্বন্ধে আমায় প্রশ্ন করছিলেন এ মনে করার কোন কারণ নেই । আসলে ওঁনার অনেক কষ্টার্জিত টাকা ঠিকমত খরচ হল কিনা, সেটা জানাই ওঁনার উদ্দেশ্য । আমি ঠাট্টা করে বললাম -
বাণীদি নিশ্চয়ই খুব চটেছেন । আপনার গাড়িটার প্রতি যা ভালোবাসা ।
সিগারেট প্রথম, তবে গাড়িটা খুব ক্লোজ সেকেণ্ড ।
আরে, কি যে বলেন ।
না, সত্যি । আমি যে কোনদিন এ রকম এক সুন্দরীর সঙ্গ পাবো, তা ভাবি নি ।
এই বলে উনি চাবি ঘুরিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নিজে ড্রাইভারের সিটে বসলেন । প্যাসেঞ্জারের দিকের দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে আসতেই একটা গন্ধ আমায় ঘিরে ধরল, নতুন গাড়ির গন্ধ । তিনকড়িদার পুরনো গাড়িতে ঢুকলেই সিগারেটের তীব্র অথচ বাসি গন্ধ নাকে এসে লাগতো । উনি গাড়ি পরিষ্কার রাখতেন বটে, কিন্তু গাড়ির মধ্যে সিগারেট খেতে দু'বার ভাবতেন না । কিন্তু মনে হল যে নতুন গাড়ি কেনার পর উনি অভ্যেস পাল্টেছেন । আমরা দুজনে লোভীর মত নাক দিয়ে টেনে নিতে লাগলাম নতুন গাড়ির গন্ধ । গন্ধটা একটু অদ্ভূত ধরনের - মিষ্টি নয়, ভালও নয় । টাট্কা রং, ভাইনাইল আর প্লাস্টিক মেশানো গন্ধ । এই গন্ধটা আমায় অনেক দিন আগে কেনা একটা সস্তা পারফিউমের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল । সেই পারফিউমের গন্ধ ছিল নেহাতই খেলো, কিন্তু এই গাড়ির গন্ধটা কিভাবে যেন একটা বড়লোকি বড়লোকি ভাবের আভাস দিচ্ছিল । এতক্ষণে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম কেন তিনকড়িদা গাড়িটার প্রেমে পড়েছেন । এই গাড়িটা হল তিনকড়িদা ও বাণীদির পৃথিবীর কাছে একটা সগর্ব ঘোষণার মতো - এই ল্যাণ্ড ওফ প্লেন্টিতে দরিদ্র হয়ে জীবন কাটানো, দিন নেই রাত নেই অল্প মাইনেয় অন্তহীন বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে যাওয়া, অল্প ভাড়ায় আরশোলা-ভরা অ্যাপার্টমেন্টে থাকা, আর সর্বোপরি এই ধনী দেশে অনিশ্চয়তার জীবন কাটানোর দিন শেষ হয়ে এসেছে ।
ঢশ
এইতো জীবন কালিদা, কি বলো !
তারপর আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে রাস্তার ধারে একটা ফার্ম স্ট্যাণ্ডের গায়ে গাড়ি দাঁড় করে দিলেন । আর সপ্তাহখানেক বাদেই হ্যালোইন । তাই সেই ফার্ম স্ট্যাণ্ড হলুদ আর কমলালেবু রঙের নানা আকৃতি আর পরিমাপের কুমড়োয় একেবারে ভরা । কাঠের বাকেটে ছোট ছোট কুমড়ো আর নানারকম গৌর্ড সাজানো রয়েছে সুদৃশ্য লাল, হলুদ, সোনালী রঙের ঝরা পাতার সাথে । মাঝারি আকারের কুমড়োর গায়ে গর্ত করে চোখ-নাক করা হয়েছে । তারা ছড়িয়ে রয়েছে এদিক ওদিক । বিশাল আকৃতির কয়েকটা কুমড়ো অলসের মতো বসে রয়েছে মোটাসোটা মানুষের মতো । তার পেছনেই একটা ছোট্ট পুকুরে ফল ফোলিয়েজের রং টলটল করছে । কোন এক অজানা কারণে সারা পরিবেশে জীবনের জন্ম-মৃত্যুর চিরকালীন চক্রের সুস্পষ্ট উপস্থিতি । কিছুদিনের মধ্যেই সব পাতা ঝরিয়ে ওল্ড ম্যান উইনটার এসে হাজির হবে, শন্শনে উত্তুরে হাওয়া আর ঘন বরফের চাদরে চারিদিক ঢেকে যাবে । আবার সেই পরের বছরের এপ্রিল-মে তখন আবার নতুন করে গাছের পাতা, থোকা-থোকা ফুল নিয়ে প্রাণের স্পন্দন দেখা দেবে । আমরা দোকানের এক পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে খরিদ্দারদের যাওয়া-আসা দেখছিলাম । হঠাৎ তিনকড়িদা নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন -
তোমাকে একটা কথা বলবো বলবো করে বলা হয়ে ওঠেনি । আমি ফিলাডেলফিয়ায় একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি । আর সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আমাদের এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলে চলে যাবো ।
একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন - তোমাদের মতো বন্ধুদের ফেলে যেতে খুব খারাপ লাগবে ।
আমি কেমন করে জানি বুঝতে পেরেছিলাম যে এটা ঘটতে যাচ্ছে । কিন্তু ব্যাপারটা যে এতো তাড়াতাড়ি হবে তা বুঝতে পারিনি ।
আরে, এ যে মস্ত খবর । কনগ্রাচুলেশনস্, কনগ্রাচুলেশনস্ । আমি উত্তেজিত ভাবে বলে উঠলাম ।
খুব খুব খুশি হয়েছি । কিন্তু আপনাকে খুবই মিস করবো ।
আমিও । তিনকড়িদা আস্তে আস্তে বললেন ।
আপনার কোম্পানী কি গ্রীন কার্ডের জন্য স্পনসর করবে ?
প্রথমে ওরা ছ'মাস অপেক্ষা করবে, তারপর আমার জন্য অ্যাপ্লিকেশন ফাইল করবে । এর চেয়ে বেশি আমি ওদের কাছ থেকে আদায় করতে পারিনি । তবে সুখবর যে বাণীর কাছেপিঠে আরেকটা কোম্পানীতে চাকরি পাওয়ার বেশ ভালো সম্ভাবনা আছে ।
আমি প্রায় লাফিয়ে উঠেছি । আরে বলেন কি ! আপনাদের তাহলে তো একেবারে সব পাকা । একেই বলে একসাথে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা প্রাপ্তি ! না, এখন আপনার সিগারেট একটা দিন । সেলিব্রেট করা যায় ।
চুপচাপ সিগারেট খেয়ে আমরা বাড়ি চলে এলাম ।
আমরা কিন্তু সেই ওয়ালডেন স্কোয়্যারেই আটকে পড়েছি কলে পড়া ইঁদুরের মত । আমি তখনও এম-আই-টি তে পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ নিয়ে ঘষড়ে যাচ্ছি । তার থেকেও উদ্বেগের কথা যে আমার ভিসাও শেষ হওয়ার মুখে । কেউ আমাকে গ্রীন কার্ডের জন্য স্পনসর না করলে অ্যামেরিকা থাকার এখানেই ইতি হবে । এর হাত থেকে বাঁচতে সবচেয়ে আগে দরকার একটা চাকরি । কিন্তু অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও আমার কপালে কিছুই জুটছিল না । শেষে একদিন প্রায় মরিয়া হয়ে এম-আই-টি তে আমার অ্যাডভাইসরের অফিসে গিয়ে হাজির - আমাকে কি গ্রীন কার্ডের জন্য স্পনসর করবেন । আশ্চর্যজনকভাবে উনি আমার কথা আদৌ ফেললেন না । তার বদলে আমার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ইত্যাদি কতগুলো মামুলি প্রশ্ন করার পর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি এর পরের তিন বছরের জন্য ওঁনার ল্যাবের সুপারভাইসর হিসাবে কাজ করতে রাজি আছি কি না । তাহলে উনি আমার গ্রীন কার্ডের জন্য চেষ্টা করবেন । আমাকে তখন পায় কে ! এত প্রায় মেঘ না চাইতে জলের মতো ব্যাপার ! এর প্রায় মাস ছয়েক বাদে পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি ভিসার চিঠি এসে হাজির । বেশ কিছুটা কাকতালীয় ভাবে সেইদিনই আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম ।
গ্রীন কার্ড হাতে পাওয়ার পর ওয়ালডেন স্কোয়ার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আমাদের অন্য জায়গায় উঠে যাওয়ার পালা এসে গেল । কিন্তু বস্টনের আশেপাশে ছোটখাট একটা বাড়ি খুঁজতে গিয়ে দেখি সবই প্রায় আমাদের নাগালের বাইরে । আমাদের এক ধনী বন্ধু বিজ্ঞের মতো বললেন - বুঝলে, বাড়ি কিনতে গেলে একটা কথাই মনে রাখবে লোকেশন - লোকেশন - লোকেশন । তা তো জানি, কিন্তু আমার আর রত্নার মাইনে যোগ করলেও ভালো লোকেশনে একটা ঘর পর্যন্ত কেনা যাবে না । শেষ পর্যন্ত অনেক ঝামেলা, প্রচুর হতাশা ও অনেক লেসন ইন রিয়ালিটির পর আমরা বস্টনের উত্তরে এক ছোট শহরে একটা টু-বেডরুম কণ্ডো কিনে ফেললাম ।
আমি ভাড়া গাড়ির এঞ্জিনে চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিলাম । নতুন গাড়ির গন্ধ আর একবার নাকে টেনে নিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলাম ।
(পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯)