আমেরিকায় ইদানীং দিনকাল যে ভালো নয় সেটা বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না । এই বাজারে কারো চাকরি যাচ্ছে, কারো বাড়ি নিলাম হয়ে যাচ্ছে, কেউ যুদ্ধে গিয়ে মরছে তো কেউ বেমক্কা স্কুলকলেজে গিয়ে বন্দুকবাজি করছে । যাদের খেটে খেতে হয় তাদের সবারই পকেট হালকা আর মুখ ব্যাজার । আমার বন্ধু ডাক্তার জন পিটারসনের তাতে কিছু এসে যাওয়ার কথা নয় কারণ এই শহরে ওর ফাটাফাটি প্র্যাকটিস, অঢেল পয়সা, মার্সিডিস স্পোর্টস কার এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ । সেদিন শুনলাম ও নাকি পাকাপাকিভাবে ডাক্তারি ছেড়ে দিচ্ছে । ওর মতে আমেরিকার চলতি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঘোরতর ব্যবসাভিত্তিক, অনৈতিক এবং বৈষম্যমূলক । এভাবে চলতে থাকলে আমেরিকা তো বটেই বাকি দুনিয়াও আস্তে আস্তে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্যসংকটের দিকে চলে যাবে । বিবেকের ছিটেফোঁটা থাকলেও নাকি এভাবে ডাক্তারি করা অসম্ভব তাই ও অবস্থাটা বদলানোর চেষ্টা করতে চায় । ওর কথাবার্তা শুনে হঠাৎ করেই আমার অপচিকিত্সা কথাটা মনে পড়ে গেল । কথাটা প্রথম শুনেছিলাম কুণালদার মুখে । ওহায়োর ছোঁয়াচে রোগ বিশেষজ্ঞ ড: কুণাল সাহা, যার সাথে কলকাতার পাঠকদের হয়ত কিছুটা পরিচয় আছে । দশ বছর আগে এই অনাবাসী ডাক্তারের স্ত্রী কলকাতায় অসুস্থ হয়ে মারা যান । তাঁর চিকিত্সা সম্পূর্ণ ভুল হয়েছিল এবং সেই ভুলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও নাকি ডা: সাহা সুবিচার পাননি । বহুদিন লড়াই চালানোর পরে গতবছর ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ডা: সাহার পক্ষে রায় দেন এবং ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অঙ্কের ক্ষতিপূরণ, প্রায় দেড় বিলিয়ন টাকা মঞ্জুর করেন । কলকাতা হাইকোর্ট নাকি মিসেস সাহার চিকিত্সা সংক্রান্ত কাগজপত্র এর আগে মামলার কাজে ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকার করেছিলেন কেননা ডা: সাহা আমেরিকার নাগরিক । আইনের দিক দিয়ে এ আপত্তি হাস্যকরভাবে অগ্রাহ্য । এই চক্করে দেশের `রাইট অফ ইনফর্মেশন অ্যাক্ট' সম্প্রতি বদলানো হয়েছে যার ফলে যেকোনো রোগীই তাঁর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নথিপত্র উদ্ধার করতে পারবেন । ড: সাহা `পিপল ফর বেটার ট্রিটমেন্ট' নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে দেশের তথাকথিত অপচিকিত্সকদের বিরুদ্ধে জেহাদ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সম্প্রতি এইডস পরীক্ষার জন্য দুনম্বরি কিট ব্যবহারের দায়ে ন্যাশন্যাল এইডস কন্ট্রোল অরগানাইজেশনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন । মোদ্দা কথা উন্নত দেশগুলোতে যেসব পেশাদারি নিয়মকানুন, দায়বদ্ধতা চালু আছে, দেশের ডাক্তারবাবুদের কুণাল সেগুলো ঘাড় ধরে শেখাতে চান । এর পিছনে ওঁর ব্যক্তিগত বেদনার ইতিহাস নিশ্চয় রয়েছে কিন্তু তা হলেও এতখানি পথ চড়াই-উত্রাই ভাঙতে হলে দম থাকা চাই । ইতিহাসে দু-একটা লোক থাকে যারা ঝুড়ি আর গাঁইতি নিয়ে পাহাড় ভাঙতে যায় । আবার আমাদের মত কিছু সংখ্যক লোক আছে যারা পাহাড়টাকে হাড়ে হাড়ে চেনে কিন্তু গাঁইতি তোলার নামে পিছিয়ে যায়, কারণ তারা ভিতু অথবা আলসে । বাকি লোকেদের কথা না বলাই ভালো । জন বা কুণালের মত লোকেরা একটা প্রাতিষ্ঠানিক পাহাড় ভাঙার চেষ্টা করছে কিন্তু দুজনে উলটো দুদিক দিয়ে । কলকাতার ডাক্তারি জগতে পেশাদারিত্ব এবং দায়বদ্ধতা এই দুটো বস্তুর যে খামতি রয়েছে এ ব্যাপারে কুণালবাবুর সঙ্গে অনেকেই একমত । আমেরিকার মতো নিয়মকানুন আমাদের দেশেও অন্তত: কিছুটা চালু হওয়া উচিত বিশেষত যেখানে `ফি ফর সার্ভিস' মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে । হক কথা ; কিন্তু মজা এইখানে যে খোদ আমেরিকাতে এখন উলটোরথের হাওয়া বইছে । জনের মত বহু আমেরিকান ডাক্তারের মতে একদিকে বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণ আর সরকারি বিধিনিষেধ অন্যদিকে যান্ত্রিক পেশাদারিত্ব আর অতিরিক্ত সাবধানতার মাঝখানে পড়ে ডাক্তারি শাস্ত্র নাকি খাবি খাচ্ছে । জুল ভার্নের সেই ভুতুড়ে গল্পের মত ডাক্তার ব্যাটা শেষকালে নিজের হাতে নিজে মারা না যায় । চিকিত্সাবিজ্ঞানের এই উভয়সংকট কেমন ভাবে তৈরি হল তার দিকে একবার তাকিয়ে দেখা যাক ।
সেই হিপোক্রেটিসের আমল থেকেই ডাক্তারির সঙ্গে সম্মান, শোভনতা এবং সুনীতির যেমন একটা স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় ছিল, তেমনটাই ছিল রহস্যময়তার । বিশ শতকের আগে অবধি ওষুধপত্র দেওয়া, রোগনির্ণয় বা সার্জারি সবটাই এত সহজ সরল ছিল যে ডাক্তার এবং তাঁর কম্পাউণ্ডার মিলে পুরো কাজটা দিব্যি চালিয়ে দিতেন । সমাজে ডাক্তার-রোগী সম্পর্কটাকে ধরা হত পিতা-সন্তানের সম্পর্কের মত । ডাক্তার রোগীর কাছ থেকে সোজাসুজি ফি পেতেন যেটাকে বলা হয় `ফি ফর সার্ভিস' মডেল । বেশিরভাগ রোগেরই তেমন কোনো চিকিত্সা ছিল না, প্রসূতি এবং শিশুমৃত্যুর হার ছিল আকাশছোঁয়া । ১৯০০ সাল নাগাদ গড় বাঁচার মেয়াদ বা `লাইফ এক্সপেক্টেনসি' আমেরিকায় ছিল ৪৭ বছর । এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৭৫ বছর এবং আরো বাড়তে চলেছে, পশ্চিম ইউরোপে ওটা এখনই আশি । আমাদের দেশে ১৯৫০ সালেও গড় বাঁচার মেয়াদ ছিল মাত্র ৩২ বছর এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ৬৪ বছরে । বোঝাই যায় সে আমলে ডাক্তারদের ভাবমূর্তি ছিল কিছুটা আধিভৌতিক, দেবদূত এবং যমদূতের মাঝামাঝি । রোগী মরলে ভগবানের মার, বাঁচলে ডাক্তারের হাতযশ । ডাক্তারবাবুরা পেশার প্রয়োজনেই কিছুটা উচ্চস্তরে বিরাজ করতেন, তাঁদের কাণ্ডকারখানায় কিছুটা রহস্য মাখানো থাকত, যাতে তাঁদের দেখলেই রোগী অন্তত: কিছুটা ভরসা পেত । পাবলিক তাঁদের মড়া-কাটা গুপ্তবিদ্যার কোনো খোঁজখবর রাখবে এটা ডাক্তাররা আশা করতেন না, কোনরকম কৈফিয়ৎ দেবারও প্রশ্ন ছিল না । সেই পিতৃতান্ত্রিক দুনিয়ায় ডাক্তারের একটা বেশ সুবিধাজনক অবস্থান ছিল------- তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা বা গণধোলাই দেবার কথা কেউ ভাবতেও পারত না । সেযুগেও কিন্তু নানা ক্ষেত্রে রোগীর অসহায়তার ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ বা বার্নাড শ'র মত মরমী লেখকদের চোখ এড়ায়নি ।
এই অবস্থাটা বদলে গেল বিশ শতকে, পশ্চিম দুনিয়ায় যখন আলো অন্ধকারের এক অদ্ভুত ঝড় উঠেছে । সেই বাজারে যুদ্ধবিগ্রহ আর অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নতি হতে লাগল বিজ্ঞান আর প্রকৌশলের । অ্যান্টিবায়োটিক থেকে ক্যান্সার কেমোথেরাপি, এক্সরে থেকে ক্যাথিটেরাইজেশন, সবকিছু কয়েক দশকের মধ্যে হই হই করে আসরে নেমে পড়ল । তারপর যুদ্ধ শেষ হতে না হতে ১৯৫০-৫৫ সালের মধ্যে প্রোটিন এবং ডি-এন-এ'র আনুবীক্ষণিক চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে উঠল, জন্ম হল বায়োটেকনোলজির । তখন থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে এই বিশাল পরিমাণ তথ্য এবং প্রশিক্ষণ কোনো একজন লোকের পক্ষে হজম করা সম্ভব নয় । এর জন্য দরকার একটা গোটা বিভাগ, একাধিক সংগঠন আর নানারকম যন্ত্রপাতি । ব্যক্তিগত হাতযশ, পুরিয়া আর মিক্সচারের জায়গা নিল সংগঠন আর টিমওয়ার্ক এবং তার খরচাও বেড়ে গেল হু হু করে । আমাদের মনে রাখা দরকার যে শুধু প্রকৃতিবিজ্ঞান নয় সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সে সময়টা বৈপ্লবিক । প্রশ্ন উঠল যে নাগরিকদের স্বাস্থ্যরক্ষা করাটা সরকারের দায়িত্বের ভিতর পড়ে কিনা । এইসব চিন্তাভাবনার ফলে ১৯৪৬ সালে ইংল্যাণ্ডের লেবার পার্টির হেলথ সেক্রেটারি মি: বেভান ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস অ্যাক্ট নামক ঐতিহাসিক আইন পাশ করালেন, ৫ই জুলাই ১৯৪৮ এই পরিষেবা চালু হল । ব্রিটিশ সরকার স্বীকার করলেন যে নাগরিকদের স্বাস্থ্যরক্ষা সরকারের দায়িত্বগুলোর মধ্যে পড়ে । পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা মোটামুটি এন-এইচ-এস মডেলে গড়া । কিন্তু শীগগিরই বোঝা গেল যে এন-এইচ-এসের ঘোষিত আদর্শ `টোটাল কেয়ার ফ্রম ক্রেডল টু গ্রেভ' অনুসরণ করা খুব একটা সহজ কাজ নয় । যবে থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠল যে চিকিত্সা ব্যাপারটা শুধুমাত্র ব্যক্তিবিশেষের কেরদানি আর বত্রিশ টাকা ফি'র মামলা নেই, এখানে বিনিয়োগ এবং মুনাফার অবাধ সুযোগ, তবে থেকে ডাক্তারির খোলনলচে বদলে গেল । বাজারের রাঘব-বোয়ালরা খেলায় নেমে পড়লেন, বিরাট বিরাট কোম্পানি গড়ে উঠল, যাদের বাজেট এক একটা ছোটখাটো দেশের সমান । বায়োমেডিক্যাল টেকনোলজির জন্ম হল, বাজারে ছাড়া হল নতুন পরীক্ষা, নতুন ওষুধপত্র, রোগনির্ণয়ের মহা মহা যন্ত্রপাতি । আমেরিকা এবং ইউরোপের হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি এই বিরাট লগ্নী করে প্রকৌশলের প্রতিটি বিভাগ থেকে নানা অত্যাধুনিক চমক ডাক্তারিতে আমদানি করলেন । প্রথম দিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বলতেও কিছু ছিল না, ১৯৫৭-৬০ সালে প্রেগনেন্ট অবস্থায় থ্যালিডোমাইড ব্যবহারের জন্য কয়েক হাজার বিকলাঙ্গ শিশু জন্মানোর পর সরকারের কিছু টনক নড়ল । কিন্তু ততদিনে ডাক্তারির সাবেক ফরমূলা পুরোপুরি জাহান্নামে গেছে, তৈরি হয়েছে আনকোরা নতুন মডেল । এই মডেলে ডাক্তার ভগবান নয়, সে শুধুমাত্র `প্রভাইডার', সে এক্টা প্রকৌশলের বিক্রেতা মাত্র, রোগী তার ক্রেতা বা `কনজিউমার', বীমা কোম্পানি তার চৌকিদার এবং উকিলবাবু তার যম । সে কথায় পরে আসছি, আগে দেশি অপচিকিত্সার গল্পটা শেষ করি । কুণাল সাহা যেসব অপচিকিত্সকদের জব্দ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা আমাদের আগের প্রজন্ম, অনেকেই মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আমাদের মাস্টারমশাই শ্রেণির ছিলেন । তাঁরা এবং তাঁদের গুরুরা প্রায় সবাই ক্লাসিক্যাল ব্রিটিশ মডেলের ট্রেনিং পেয়েছেন এবং সেই সময়ের ব্রিটিশ ডাক্তারদের যাবতীয় মুদ্রাদোষ পরম নিষ্ঠায় নকল করেছেন । এজন্য তাদের দোষ দেওয়া অনুচিত কারণ আটল্যান্টিকের ওপারে কি কাণ্ড ঘটছে সে ব্যাপারে তাঁদের সেই প্রাক-ইন্টারনেট যুগে বিশেষ কিছু ধারণা ছিল বলে মনে হয় না । ব্রিটিশরা রক্ষণশীল জাত, তাঁরা নতুন জ্ঞানবিজ্ঞান কাজে লাগালেন বটে কিন্তু ডাক্তারির সাবেক চালটা বজায় রেখে দিলেন । ডাক্তার বলতে যে ইমেজ তাঁরা পয়দা করলেন তা খানিক দূরত্ব, খানিক রহস্য, খানিক বৈদগ্ধ্যে জড়ান এক পিতৃপ্রতিম ব্যক্তিত্ব । সাধারণ লোককে তাঁরা একটু কৃপার চোখেই দেখতেন, তাঁদের গাম্ভীর্য বেশ সুবিধাজনক ছিল, আমাদের মত রুগীর সাথে বকবক করে মুখে ফেনা তোলার প্রশ্নই উঠত না । ইংল্যাণ্ডের লোকজন সাধারণভাবে নিয়ম-ট্র্যাডিশন মেনে চলতে ভালোবাসে, কিছুদিন আগে অবধি তারা যেকোন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিই অতিশয় শ্রদ্ধাশীল ছিল । সম্প্রতি টনি ব্লেয়ারের আমল থেকে সেটা কিছু বদলেছে । এন-এইচ-এস তাদের শরীর স্বাস্থ্যের দেখভাল করছে এব্যাপারে কারো বিশেষ কোন নালিশ ছিল না, তার জন্য ট্যাক্স দিতেও কারো আপত্তি হয়নি । সরকার ধীরে ধীরে সবকিছু বদলেছে, নতুন যন্ত্রপাতি বা ওষুধপত্র সবই এসেছে স্বাস্থ্যদপ্তরের পেশাদারি নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে । মুশকিল হল যখন ওঁদের কাছে ডাক্তারি এবং হাবভাব দুটোই ভালভাবে রপ্ত করার পর আমাদের মাস্টারমশাইরা দেশে ফিরতে শুরু করলেন । একদিকে তাঁরা সাহেব, কলকাতার বিচ্ছিরি গরমেও স্যুট টাই পরেন, অন্যদিকে যে পরিবেশে তাঁরা শিক্ষা নিয়েছেন দেশে তার চিহ্নও নেই । আমরা ব্রিটিশ মডেল নিয়েছি বটে কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যদপ্তরের বাজেটে এন-এইচ-এসের ঝাড়ুদারের মাইনেও হয় না । বাধ্য হয়ে তাঁরা প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে নামলেন । সেখানেও পেশাদারিত্ব কথাটাই অজানা, পাবলিক শিক্ষার চেয়ে চালবাজি দেখে বেশি মুগ্ধ হয় । আশির দশকে আমরা যখন ডাক্তারি পড়তে গেলাম ডাক্তারি জগতে তখন তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব চলছে অথচ কলকাতায় আমাদের সে সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ ধারণা ছিল না । দিনের মধ্যে আমাদের এতবার স্যার বলতে হত আর আমাদের স্যুট পরিহিত মাস্টারমশাইদের আমরা এতটাই সুপারম্যান মনে করতাম যে বাকি দুনিয়ার হালহকিকৎ সেখানে অবান্তর ছিল । এখন মনে হয় ওনাদের যে রোগটা ধরেছিল তার নাম `এনটাইটেলমেন্ট' বাংলায় কি বলে জানি না । গোটা সমাজেই তখন কুয়োর ব্যাঙ অথবা বাক্সের কাঁকড়াদের রাজত্ব, সেখানে বসে সত্তর বছর আগেকার ডাক্তারি আদর্শ ওঁদের কাছে ঠিকঠাক লেগেছিল এতে অবাক হবার কিছু নেই । সেই আদর্শ অনুযায়ী ওঁরা অভিজ্ঞতা আর মতামতের যতটা দাম দিতেন, তথ্য ও প্রমাণের ততটা নয় । আধুনিক চিকিত্সার যে বীজমন্ত্র - এভিডেনস বেসড মেডিসিন বা প্রমাণনির্ভর চিকিত্সা- সেই ব্যাপারটাই ওঁদের অজানা ছিল ।
সোজা কথায় স্বাধীনতার পরে আমরা গড়ে তুলেছিলাম দুনিয়ার সবচেয়ে অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা । মজার কথা এই যে শিখণ্ডীর মত সরকারি স্বাস্থ্যদপ্তর সবসময় আমাদের সামনে খাড়া ছিল । তার পাশাপাশি আমরা অজস্র ওষুধ কোম্পানি, নার্সিং হোম আর ডায়াগনোস্টিক ল্যাবরেটরি খাড়া করে ফেললাম যারা ইচ্ছামত ব্যবসা করতে লাগল । পশ্চিম দুনিয়ায় প্রতিটি অসুখের জন্য চিকিত্সার মান বা `স্ট্যাণ্ডার্ড' অফ কেয়ার' বলে একটা হিসাব আছে, যেটা না মিললে ডাক্তারকে দোষী ধরা হয় । আমাদের দেশে এক অদ্ভুত সমান্তরাল ব্যবস্থা চালু হল । একদিকে সরকারি চিকিত্সাকে খয়রাতি ধরা হয় তাই প্রত্যাশা কম হবে সরকার যেন এটাই আশা করেন । অন্যদিকে বেসরকারি চিকিত্সা নগদ টাকার বিনিময়ে হচ্ছে কিন্তু সেখানে দায়বদ্ধতা কিংবা `কোয়ালিটি কন্ট্রোল' বলে কোনো বস্তুই নেই । কপাল ভাল হলে খুবই ভাল চিকিত্সা হতে পারে, কপাল খারাপ হলে গঙ্গাপ্রাপ্তি । সেক্ষেত্রে পাবলিক অনেক সময় ডাক্তার পিটোয় কিন্তু তাতে অবস্থা আরো খারাপই হয়ে চলে । আতঙ্কগ্রস্থ ডাক্তার ওঝার থেকেও খারাপ, পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক গড়ে ওঠে না যার অভাবে সফল চিকিত্সা অসম্ভব । মোদ্দা কথা দেশের ডাক্তারি ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার একান্ত অভাব, ডাবল স্ট্যাণ্ডার্ড নিয়মে পরিণত হয়েছে আর যেটাকে নিয়ন্ত্রণ বা `ওভারসাইট' বলে সেটার অস্তিত্ব নেই । রোগী হয় সামান্য অসুখের জন্য সাতদিন নার্সিংংএহামে ভর্তি থাকে নয়ত হার্ট অ্যাটাক নিয়ে বারান্দায় রাত কাটায় । ডাক্তার হয় ভগবান নয়ত রক্তচোষা, হয় তিনি রোগীর সঙ্গে ধমক দিয়ে ছাড়া কথা বলেন না, নয়ত রোগীরা তাঁকে হেনস্থা করে । এই বিরাট সমস্যার মাত্র একটা অংশকেই সম্প্রতি অপচিকিত্সা নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে তবে মামলা করে এর নিষ্পত্তি হবে বলে মনে হয় না । অসুখটা শুধু ডাক্তারের নয়, যে সমাজ ডাক্তারকে তৈরি করেছে তারও বটে । শুধু ডাক্তারের কাছে সামাজিক দায়বদ্ধতা আশা করা হয়ত ঠিক নয় ।
এ তো গেল দেশি অপচিকিত্সার কথা । তথাকথিত উন্নত দুনিয়া, যাদের পালের গোদা ইউ-এস-এ, তাদের অবস্থাটা কি ? অনেকের মতে এখানেও ঘোরতর অপচিকিত্সা চলছে । এমনভাবে চলতে থাকলে ডাক্তারির সংজ্ঞাটাই বদলে যাবে, মানুষের বদলে রোবট ডাক্তারি করবে, সমাজের একটা বড় অংশ আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞানের কোনো সুবিধাই পাবে না । ইংল্যাণ্ডে আমরা যে সরকারকেন্দ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা বলেছি, আমেরিকার যুক্তিটা ঠিক তার উলটো । এদের মতে ডাক্তারি বিদ্যার যে তিনটে প্রধান বিভাগ- ওষুধপত্র বা ফার্মাসিউটিক্যালস, রোগনির্ণয় বা ডায়াগনোস্টিকস এবং গবেষণা বা রিসার্চ অ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট- এগুলোর অবাধ বিকাশ বেসরকারি বিনিয়োগ ছাড়া সম্ভব নয় । যেহেতু বেসরকারি পুঁজি মুনাফা না হলে ভগবানের দিকেও ফিরে তাকায় না তাই এমন ব্যবস্থা করা দরকার যে স্বাস্থ্য পরিষেবা বেশ একটা লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠতে পারে । কট্টর বাজারপন্থীদের মতে এটাই একমাত্র উপায় কারণ মুনাফা না হলে প্রগতিও বন্ধ হয়ে যাবে, যেসব দেশে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আছে তারাও তখন পস্তানোর পথ পাবে না । অর্থাৎ আমেরিকা আছে বলেই খোলাবাজার আছে, ইউরোপ বা জাপানের বাড়বাড়ন্ত সেখান থেকেই । এই ফরমুলা অনুসারে ১৯৫০ থেকে এখন অবধি বায়োমেডিক্যাল গবেষণায় যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে তা এক কথায় অমানুষিক । সরকারি বিনিয়োগ বছরে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার যার কর্ণধার ন্যাশন্যাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ, বেসরকারি বিনিয়োগ কম করে তার পাঁচগুণ । এর ফলে যে লক্ষ লক্ষ প্যাটেন্ট বেরিয়েছে সেগুলো ঘষেমেজে লাভজনক দামে বাজারে ছাড়া হয়েছে । তার সঙ্গে থেকেছে চটকদার বিজ্ঞাপন- আপনার ডাক্তারকে বলুন আমাদের ওষুধ লিখতে, তাহলেই আপনি সাতদিনে খেঁকুড়ে বুড়ো থেকে সুপারম্যান বনে যাবেন । এর ফলে পাবলিক পেয়ে বসেছে, ডাক্তারের কাছে শুধু আরোগ্য নয়, ম্যাজিক দাবি করতে শিখেছে, শুধু সুস্বাস্থ্য নয় তার সঙ্গে অনন্ত যৌবন চাইছে । কিন্তু এই পর্বতপ্রমাণ খরচের বোঝা ব্যক্তি তো দূরস্থান, কোনো সরকারের পক্ষেও বহন করা সম্ভব নয় । তখন খেলায় নামলেন বাজার অর্থনীতির আর এক দুঁদে প্রতিষ্ঠান- ইন্সিওরেন্স বা বীমা কোম্পানি । তাঁরা বলে দিলেন কুছ পরোয়া নেই যতখুশি খরচ করে যাও, আমরা আছি, সরকারকে নাক গলাতে দিও না । আর এত খরচ করে যদি মনের মত চিকিত্সা না পাও তবে ওই যে উকিলবাবুরা ওঁত পেতে আছেন, তোমার পয়সা দশগুনো হয়ে ফেরত আসবে । তখন সমঝোতা দাঁড়াল এরকম- সরকার একটা সাধারণ ট্যাক্স নিয়ে তার বদলে, বয়স্ক, রিটায়ার্ড এবং হতদরিদ্রদের ইন্সিওরেন্স দেবে (যার পোষাকি নাম মেডিকেয়ার এবং মেডিকেইড), যার চাকরি আছে সে সেখান থেকে ইন্সিওরেন্স পাবে, যে ব্যবসা করে সে বাজার থেকে কিনবে । যেভাবেই হোক না কেন সরকার নিজে কোন সোজাসুজি দায়িত্ব নেবে না, স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকবে পুরোপুরি ব্যবসায়িক । এর ফলে সারা দুনিয়ার মধ্যে আমেরিকায় স্বাস্থ্যখাতে খরচ হয় সবচেয়ে বেশি, ২০০৭ সালে প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার, মাথাপিছু ৭৪৩৯ ডলার । অথচ দেশটার স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান উদ্ভট রকম পরস্পরবিরোধী । দেখা যাচ্ছে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকার স্থান বেশ তলার দিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খরচ এবং দ্রুত চিকিত্সার ক্ষেত্রে দুনিয়ায় এক নম্বর কিন্তু চিকিত্সার ফলাফল এবং নাগরিকদের স্বাস্থ্যের দিক থেকে যথাক্রমে ৩৭ এবং ৭২ নম্বর । পরিসংখ্যানটা ভেঙে ফেললে দেখা যাবে টিপিক্যাল সাদারা, শহরাঞ্চলের ব্যবসায়ী এবং চাকুরিজীবিরা কিন্তু অতটা খারাপ নেই । সবচেয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা হল সংখ্যালঘু, গরীব এবং বহিরাগত (ইমিগ্রান্ট) লোকেদের, অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর থেকেও খারাপ । চল্লিশ বছর ধরে নতুন নতুন চিকিত্সা আমদানি করা হয়েছে যার উদ্দেশ্য যতটা আরোগ্য তার চেয়ে ঢের বেশি মুনাফা । মৃতপ্রায় রোগীর চিকিত্সায় ব্যয় করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ ডলার । জীবনের মেয়াদ বাড়াতে গিয়ে নজর দেওয়া হয়নি যে দশজনকে আধমরা অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে বিশজনকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কিনা । বরং যতদিন সম্ভব নানা ছুতোয় টাকা কামিয়ে নেবার দিকেই বুঝি ডাক্তার-হাসপাতাল সকলের নজর । আবার কোথাও ভুলচুক হলে ম্যালপ্রাক্টিস ইনসিওরেন্সের লক্ষ লক্ষ ডলার কেমন করে গালে চড় মেরে আদায় করা যায় উকিলের নজর সেদিকে । সবচেয়ে বড় সর্বনাশের কথা যে সবাই নিয়ম বাঁচিয়ে মুনাফার কথা ভাবছে, রোগীর কথা কেউ ভাবছে না । উকিলরা রক্তের স্বাদ পেয়ে হিংস্র হয়ে উঠেছে তারা অ্যাম্বুলেন্সের পিছনে ছোটে, সোজাসুজি হাসপাতালে গিয়ে রোগীকে মামলা করার পরামর্শ দেয় । বাচ্চা হবার দশ বছর পরেও গায়নিকোলজিস্টের পিছু ছাড়ে না । নিজেদের পিঠ বাঁচাতে বাঁচাতে বিরক্ত ডাক্তাররা রোগীর দিকে তাকিয়ে চিকিত্সার আগে মামলা হবার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে । বীমা কোম্পানি সর্বদা ধান্ধায় থাকে কি করে কম টাকা দেওয়া যায়, ডাক্তার নানাভাবে ফাঁপিয়ে বিল দেয় । কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, সরকার, আমলা, বীমা কোম্পানি, চিকিত্সক এবং উকিল, তাই পাহাড়প্রমাণ হয়ে ওঠে শুধু নথিপত্র । এর মধ্যে চিকিত্সা ব্যাপারটা যান্ত্রিক হয়ে যায় তার মধ্যে সেবা- সহমর্মিতা-ভালবাসার কোনো জায়গা থাকে না । ইদানীং কোম্পানির খরচা বাঁচাতে কর্মচারীদের স্বাস্থ্যবীমা কমিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে সারা দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছেই । দেশের শতকরা ১৬জন বা ৪৬ মিলিয়ন লোকের আজ কোন স্বাস্থ্যবীমাই নেই । এদিকে সরকার বাহাদুর পাইকারি হারে বোমা বন্দুক বানিয়ে দেউলিয়া, এত লোকের চিকিত্সার খরচা আর যুগিয়ে উঠতে পারছে না । ফলে আমেরিকাতেও আজ অন্যরকম এক অপচিকিত্সার আবহাওয়া । পরিচালক মাইকেল মুর তাঁর `সিকো' তথ্যচিত্রে এই হৃদয়হীন, মুনাফাবাজ ব্যবস্থাকে তুলোধোনা করেছেন । তাঁর মতে `সোসিয়ালাইজড' বা সর্বজনীন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়া সাধারণ মানুষের ঠিকমত চিকিত্সা পাবার আশা নেই । বিদঘুটে ব্যাপার এটাই যে ইংল্যাণ্ড সমেত যেসব দেশে এই চমত্কার ব্যবস্থা কায়েম আছে সেখানকার ডাক্তার বা বিজ্ঞানীরা কিন্তু সুযোগ পেলেই আমেরিকা পাড়ি দেয়, তাই ডাক্তারের অভাব সেখানে একটা ত্রক্রনিক সমস্যা । বিজ্ঞানের কাছে মানুষের আশার শেষ নেই কিন্তু মুনাফা না হলে সে ম্যাজিক দেখাতে নারাজ ।
আমার কেমন যেন মনে হয় জন আর কুণাল হাত মিলিয়ে পাহাড়টার একদিক থেকে খুঁড়তে শুরু করলে পারত । কিন্তু ভাবুক লোকের বেকার ভাবনায় কবে আর কি এসেছে গেছে । জন পিটারসন ঠিক করেছে সে ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে সমাজকর্মী হবে, আমেরিকায় যাতে ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার চালু হয় তাব জন্য লড়বে । আপাতত ও রয়েছে আমেরিকার নতুন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা সেনেটর বরাক ওবামার সঙ্গে । ওদের দেখে আমারও মনটা ফিনিক্স পাখির মত ডানা ঝটপটিয়ে ওঠে । আমি পুরোনো কবিতাগুলো মনে করার চেষ্টা করি, পুরোনো স্বপ্নগুলোর উপর থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলি । আমার বিশ্বাস করতে সাধ যায় যে হয়ত মানুষ মুনাফা ছাড়াও অন্য কিছু কখনো চাইতে পারে, হয়ত প্রগতি সত্যিই বাজারের দাঁড়িপাল্লা ধরে ঝুলন্ত নয় ।
(ডিসেম্বর, ২০০৮; পরবাস-৪২)