ট্যাক্সিস্ট্যাণ্ডে মিলল খবরজবর - আরিটার টানা যেতে হলে হয় গোটা গাড়ি ভাড়া, নয় অ-নে-ক-ক্ষণ দাঁড়া । তার চে' চল পানসি রংপো । শেয়ার গাড়ির পো নামিয়ে দিলো রংপোতে । এর পরের গাড়িতে রেনক -তক । অগত্যা । চেপে তো বসলুম, কিন্তু গাড়িবাবাজী যে নড়ে না ! পেটভরা মোমো কপ্পুর । শেষে লঙ্কাঠাসা হয়ে যাত্রা নতুন পথে । পথ বটে একখানা - যেমনি সুন্দর, তেমনি রোমাঞ্চে ঠাসা । নদীর উজানে টাটকা আর তত টাটকা নয় ধস সারানো পথে উঠে নেমে ধুলো মেখে নাচতে নাচতে গাড়ি রোরাথাংয়ের পুল পেরিয়ে প্যাকিয়ংকে এড়িয়ে রংলিকে জংলি পথে সরিয়ে গমগমে রেনকে এসে দম ছাড়ল ।
রেনকে যত না লোক, তার চেয়ে বেশি গাড়ি । তারা কোথায় না দিচ্ছে পাড়ি ! রংপো, প্যাকিয়ং, গ্যাংটক পেডং এমনকী কালিমপং ! লেকিন আরিটারকা গাড়ি কাঁহা ? খুঁজে খুঁজে দুজনে হাল্লাক । `লামপোখারি দালাপচেন'-য়ের গাড়িই নাকি আরিটার পাড়ি দেবে, কিন্তু ড্রাইভারসাব যে কোথায় খোদায় মালুম । আরে ! ঐ তো `আরিটার' লেখা গাড়ি ! ও বাবা ! এ তো তুলোঠাসার চেয়েও বেশি ঠাসা । এতে সেঁধোতে গেলে তো সূক্ষ্মদেহ ধারণ করতে হবে ।
অবশেষে পতিতোদ্ধারে এগিয়ে এলো এক `পবননন্দন' চালক; অবশ্য দু-শো কথার পর দু-শো টাকার কড়ারে । সুন্দর পথে চড়চড়িয়ে চড়ে এসে গেলুম আরিটার । তারপরই গাড়ি গোঁত্তা মেরে ঢুকল দালাপচেনে । গাড়ি থেকে নামার আগেই মনমজানি দালাপচেন তার প্রাণদোলানো রূপে আর আকাশবাতাসভরা শান্তিতে দিলমে মার দিয়া চাক্কু - দু-জনেই তার প্রেমে হাবুডুবু ।
সবুজে মোড়া দালাপচেনে এখন যতজন স্থায়ী বাসিন্দা প্রায় ততজনই টুরিস্ট । সব মিলিয়ে জনা তিরিশেক মেরেকেটে । তার মধ্যে কচিকাঁচারাও আছে, দু-দলেই । সূয্যিমামা বিদায় নেবার পর আঁধার আরিটারের পথে এখন এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে আলোর টুকরোরা ছিটকে এসে হেথায় হোথায় চুপটি করে বসে আলস্যে হিম মাখছে । হু-ই টংয়ে গুম্বার আলো সতর্ক নজর রাখছে - শান্তি না ভঙ্গ হয় । আকাশের তারারা মুখ ঢেকেছে মেঘে । রাত আটটা মাঝরাতকে লজ্জা দিচ্ছে । আরিটার জুড়ে এখন ঝিঁঝির ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক, হেথা হোথা আলোর ছিটে - বাকি সব কালো । অপরূপ এই রূপহীনতা, শব্দহীনতা । শান্তি বোধহয় একেই বলে । শহুরে চোখ-কানের আরাম, প্রাণের আরাম - শান্তিনিকেতন আরিটার দালাপচেনে । পনেরোর ভোরে মেঘের ছেঁড়া কাঁথা মুড়ি দেওয়া আকাশ । অবাধ অরণ্যে পাখিদের কলকাকলির অগ্রদূত কিন্তু সেই কলমলানো মোরগবাবু । পাখির দল `কথা কয় রে, দেখা দেয় না' । খানিক পরেই অবশ্য দু-দুজন দাঁড়কাক দেখা দিলেন সশব্দে - দিতেই থাকলেন । দুই নীরব ভৌ ভৌ সন্ন্যাসী প্রাতভ্রমণ সেরে ফিরলেন । লজস্থ পরিব্রাজক দল হ্রদ সন্দর্শনে নির্গত হলেন; আমরা সঙ্গী করলুম লজমালিক তোপদেন ভুটিয়া এবং তার লাল টুকটুকে গাড়িটাকে । প্রথমে নামতি পথে গড়িয়ে, বন পেরিয়ে, সবুজ ক্ষেতে ঘেরা হেলিপ্যাড । দৃষ্টি সেখানে উড়তে উড়তে চলে যায় দিগন্তে, যেখানে মেঘের আড়ালে পর্দানশীন কাঞ্চনজঙ্ঘা । নানারকম সবুজ উঠে নেমে নানান আকারের থমকে যাওয়া ঢেউ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে ।
এবার ফিরতিপথে দালাপচেনকে টা-টা করে এঁকেবেঁকে রেনকগুম্বা । তিনশো বছর ধরে সে জপে চলেছে ওঁ মণিপদ্মে হুঁ । সাতপুরু শ্যাওলামাখা পাথরেরা জানাল সেই লামার কথা, যিনি না শুয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনটা । বনের পশুপাখি সরীসৃপ নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে তাঁর কোলে পিঠে চড়ত । তাঁর কথা শুনতে শুনতে আরিটারকে আড়ি জানিয়ে দে ছুট । গাড়ি এবার রেনক ছাড়িয়ে রংলিমুখী জংলীপথে পাড়ি দিল । রংলিখোলা নিচ দিয়ে সঙ্গী হলো নাচতে নাচতে, লুকোচুরি খেলতে খেলতে ।
থামলাম এসে নির্জন নির্বান্ধব এক প্রপাতের কাছে পুল ঘেঁষে । কালীখোলা `একাকী প্রপাত' হয়ে ঝাঁপিয়ে ঝরে পড়ছে ঝরঝরিয়ে । তার নীরব ব্যথার সমব্যথী হয়ে ভালোবেসে ফেলি তাকে । ভারি মন নিয়ে ফিরি কুলায়ে । তবে তা শুধুই `উপবাস ভঙ্গের' জন্য ।
সময় এখানে নিশ্চলপ্রায় । সময়ের গড়ানো টের পাওয়া গেল পেটের আন্দোলনে । সেই আন্দোলন থামতেই সময় আবার অনন্ত । তবু একসময় বিকেল হলো, পর্যটকের দল দালাপচেন পর্যটনে বেরোলো । ভারি তো দু-শো মিটার পথ - ফলে পর্যটনের বদলে ঘন ঘন পরিক্রমা । আঁধার নামতেই `মন চলো নিজনিকেতনে' । আরিটার হঠাৎ আঁধারমানিক, বেচারি মোম পুড়ল খানিক । তার পরেই আলো ঝলমলালো । যথাসময়ে দু-চোখে, থুড়ি, চার চোখে ঘুম নেমে এলো । কাল এই নিঝ্ঝুম স্বর্গ থেকে আবার গ্যাংটকের গণ্ডগোলে - হায় ।
(পরবাস-৪১, মে, ২০০৮)