খারাপ ব্যাপার হলো কোলকাতায় আমার সফরের সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে ডেভিড বেকহ্যামের ট্রান্সফার, রিয়েল মাদ্রিদে, এবং পূর্ব এশিয়ায় তাঁর একটা মধ্যবর্তী সফর একসঙ্গে ঘটে যায় । ফলে আজকাল নিরুপায় ছিল । পরপর চারদিন ধরে, তারা বেকহ্যামের ছবি কভারে ছেপেছে, রঙিন এবং মারমারকাটকাট । বোঝাই যাচ্ছে যে আমি খুবই খুশি হয়েছি যে বেকহ্যাম তাঁর সফরতালিকা থেকে ভারতকে বাইরে রেখেছেন । পরে এ নিয়ে দিলীপ সামন্তের সঙ্গে কথা বলতে গেলে - তিনি একজন তত্পর বন্ধু আমার, ক্ষুদে ব্যবসায়ী এবং কবি, মিডিয়ায় প্রায় অচেনা - টের পেলাম তাঁর হতাশা : "সবগুলো বদমাশ ! আপনি জানেন এবারের মার্কিন হামলার সময় এরা ক্রিকেট নিউজ কাভার করেছে ?" "আচ্ছা ! না জানি না তো ! কিন্তু ভারত তো বিশ্বকাপের একটা সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন দল ছিল ।" আমি বেফাঁস ধরনের উত্তর করি । তাতেও তিনি খুশি হলেন না এবং বর্ণনা করতে থাকলেন কিভাবে ভারতীয় প্রেস হাবিজাবি ভরে দেয় কাগজে, বিশেষত যখন ভারতীয় কূটনীতি একটু বেচক্করে থাকে । আমি বেশ নরমস্বরে জিজ্ঞেস করলাম "গণশক্তির কী অবস্থা ?" "হ্যাঁ ! ওরা অবশ্য ক্রিকেটকে দুই নম্বর জায়গা দিয়েছিল । কিন্তু সরকারী প্রেস তো আপনি জানেনই । আর আমাদের পাবলিকের অবস্থা দেখুন । গণশক্তির রেগুলার পাঠকরাও তখন অন্য পত্রিকায় হুমড়ি খায় বিশ্বকাপের খবর পাবার জন্য, সৌরভ আর শচীনকে কভারে দেখবে বলে ।" দিলীপ একেবারে ক্ষিপ্ত হয়েছিল, এবং অবশ্যই অনেকখানি কোলকাতাবাসীদের ওপর ।
ইরাকে সাম্প্রতিক মার্কিন হামলায় কোলকাতার সাধারণ প্রতিক্রিয়া কী সেটা জানতে আমি আসলেই কৌতূহলী ছিলাম । বামফ্রন্টের সমালোচকীয় অবস্থান এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সভাসমিতি সম্পর্কে আমি ইতোমধ্যেই ওয়াকিবহাল । ভাবলাম দেবপ্রিয় এবং মৌ-এর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করতে হবে । দুজনেই কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়ায়, সবসময়ে লেখাপড়া করছে, আলাপ করছে কিভাবে দেরিদার সাম্প্রতিক সাক্ষাত্কার-বই কিংবা স্পিভ্যাকের সাম্প্রতিক রচনা তাদেরকে ভীষণ আলোড়িত করেছে । ছিমছাম সাজানো, মাঝারি মৌ-এর ফ্লাট । তাদের ক্ষুদে চার বছরের বাচ্চা এখন স্কুলে যায়, কথা প্রায় বলেই না, বললে ইংরেজি । মেজবান হিসেবে সামলানো খুব শক্ত । গতবার সে কেবল কয়েকটা শব্দ বলত, বাক্য বলত না, ফলে আমার বেশ আরাম হয়েছিল । কিন্তু যাহোক ওদের দুই সাবেক ছাত্রকে বাসায় পেয়ে আমি খুশি হয়ে গেলাম, দুজনেই ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর পড়ছে, একজন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে, অন্যজন বিখ্যাত জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে । কিছু কুশল বিনিময়ের পরই, আমি আমার আগ্রহের প্রসঙ্গে হামলে পড়ি, ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কিংবা সংগঠনের হাল কী । অনিরুদ্ধ বরং আগ্রহী ছিল কিভাবে প্রথম বছরে জে এন ইউ তে ওর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে, কিংবা খাবার-দাবার নিয়ে সমস্যা হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আলাপ করতে । বিশেষত বন্ধুত্বের অভাব ওকে ভোগায় । এতে অবশ্য আমি আগ্রহ পেলাম । সেটা কীরকম ?" সে পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা দিল : বিজেপি সমর্থিত শিক্ষার্থী সংগঠন সবসময়ে দরজায় টোকা দিয়ে যাচ্ছে, সভাসমিতিতে যাবার জন্য চাপ দিচ্ছে এবং সর্বদাই হিন্দু ঐক্যের ব্যাপারে জোর দিচ্ছে, কংগ্রেস সমর্থিতরা এখন একটু কোণঠাসা, তবে তারা `সেক্যুলার' । আমি খুব একটা বুঝিনি ঠিক কী বোঝাল ও কিন্তু এটাও কৌতূহল ছিল যে, সে আদৌ কোন দলের সঙ্গে আছে কিনা, বিশেষত সে যেহেতু বামফ্রন্ট সমর্থিত এস এফ আই-এর বিরোধী । "তাদের পার্টিতে তো অন্তত বাঙালি ছেলেমেয়েরা আছে, অধিকাংশ কোলকাতার ছাত্রছাত্রীই তাদের সঙ্গে, এমনকি সবাই ঠিক তাদের সমর্থকও না ।" আমি অনিরুদ্ধর সংশ্রব নিয়ে ভাবছিলাম, আর উত্তর-পূর্ব ভারতের শিক্ষার্থীদের নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম । অনিরুদ্ধ আক্ষরিকভাবেই ক্ষেপে গেল । "আপনি ওদের সম্পর্কে জানেন ? ওরা নিজেদেরকে ভারতীয় পর্যন্ত মানতে চায় না । এমনভাবে কথাবার্তা বলে না ওরা ... `তোমরা ভারতীয়রা' ... ওরা দরজা-টরজা বন্ধ করে মিটিং করে ... ভীষণ হিংস্র ওরা, বিশেষত নাগারা ..." এবং আরো অনেক কিছু সে বলে গেল । সম্ভবত আমি একটু নিস্পৃহ হয়ে পড়লাম । কিন্তু আবার শুধোলাম : "অধিকাংশ বিজেপি সমর্থকরাই উত্তর-ভারতের না ?" "হ্যাঁ !" "এবং আপনারা এস এফ আই সমর্থকেরা মূলত বাংলা থেকে, অল্প কিছু কেরালা থেকে ।" "ঠিকই ।" "তাহলে তাদের যে নিজস্ব রাজনৈতিক গোষ্ঠী থাকবে এটাকে আপনারা নিতে পারেন না কেন ?" অনিরুদ্ধ একেবারে পরিষ্কার । "দেখুন ! আমাদের মধ্যে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন সবাই আমরা ইণ্ডিয়ান আইডেন্টিটি নিয়ে কমিটেড । ওরা তা না । আপনার কি মনে হয় ওদের ছেড়ে দিলে ওরা নিজেদের সরকার চালাতে পারবে ? ওরা তো নিজেরা নিজেরাই মারামারি করছে । এমনকি এসএফআইও ওদেরকে বিশ্বস্ত মনে করে না, ওদের ক্যাপাসিটি ট্রাস্ট করে না । আপনি জানেন ?" "জানি ।" অনিরুদ্ধ এসএফআইয়ের ব্যাপারে আমার আস্থা অনুমান করে নিয়েছে । আমি চুপ মেরে গেলাম । মৌ এবং দেবপ্রিয় আমার চেহারা এড়িয়ে গেল না । আলোচনাটা ওরাই এগিয়ে নিয়ে গেল যতক্ষণ না শুভায়ন, অন্যজন, যাদবপুরের, মানতে শুরু করল । পরিস্থিতিটা আমিও এড়াতে পারলাম না । সন্দেহ নেই যে পরিশেষে ওই সন্ধ্যা বেশ হাস্যমুখর ছিল, যখন সাহিত্যের ছাত্র দুজন বিদায় নিচ্ছে । কিন্তু আমি যে মনে মনে গজরাচ্ছিলাম সেটা টের পেলাম পরের সকালে ঘুম থেকে উঠে । সপ্তাহখানেক পর নাগাল্যাণ্ড-ভারত সম্পর্কের ব্যাপারে কিছু কাগজ দেখলাম, দিলীপ সামন্ত আগেই দিয়েছিলেন, সেগুলোকে ফোটোকপি করে মৌয়ের হাতে পৌঁছে দিয়ে আসি, বলাই বাহুল্য অনিরুদ্ধর জন্য ।
মৌদের বাসা কোলকাতার অন্যপ্রান্তে । আমার যেহেতু রাস্তাঘাট সম্বন্ধে কোন ধারণাই পাকা হয়নি, মেট্রোই আমার ভরসা ছিল । বেশ হাস্যকর এতটা রাস্তা মেট্রোতে গিয়ে আবার একটা বাসে চেপে ওদের ওখানে যাওয়া, কারণ একটা সোজাসুজি রাস্তা বাসেই আছে । তারপরও আমি খুব খুশি । মেট্রো দারুণ । অন্যকিছু বাদ দিলেও কেউ সারাটা দিন মার্বেল পাথরের প্লাটফর্মে কাটিয়ে দিতে পারে, ভূগর্ভস্থ এবং বেশ ফিটফাট করে রাখা । আরেকবার মেট্রোতে চড়ার হাতছানি উপেক্ষা করে পরের সকালে আমি সিএসএসএসসি-তে যাই । খুবই কাছে ওখান থেকে । কোন রকম যোগাযোগ আগে করিনি । কিন্তু ব্যস্ত বিদ্যাকর্মী অঞ্জন ঘোষ কিছু মনে করেননি, বরং আমাকে দুপুরে খাওয়াতে চাইলেন । খেয়াল করলাম মাথায় আমার অজস্র প্রসঙ্গের বুদ্বুদানি, বিশেষত উঁচুতলার একটা বিদ্যায়তনিক অফিসে বসে । পরে যখন তিনি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রকাশনা এবং কোলকাতায় সেগুলোর দুষ্প্রাপ্যতা বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমি সুযোগ পেয়ে গেলাম । "আমাদের সংহতি তো পশ্চিমবঙ্গের উত্কর্ষের ধারণার উপর দাঁড়ানো, ফলে বাংলাদেশের প্রকাশনা আপনাদের হাতে পৌঁছায় কেবল আমরা যদি দেগুলো এনে দিই ।" একটু খসখসে উত্তর না দিয়ে আমি পারলাম না । তবে আমরা এর পরে, এমনকি সিপিআই(এম) এর শাসনামলে, পশ্চিমবঙ্গের এবং এর আশপাশের অন্যান্য জাতির কথা যদি ছেড়েও দিই, অন্তত বাংলাভাষী দুই অঞ্চলের অসমতা বিষয়ে খানিক আলাপ-সালাপ করতে পারলাম । এ বিষয়ে প্রথিতযশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ভাবনা জানার একটা উদগ্র বাসনা আমার ছিল, কিন্তু ক্যাফেতে যখন দেখা হ'ল আমি আর সে পথে গেলাম না । বরং মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম তাঁরা কী নিয়ে আলাপ করছেন - মৌলবাদ নিয়ে আনন্দ পট্টবর্ধন এর সাম্প্রতিক একটা ছবি, অমিতাভ ঘোষের বই, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক নেপাল সফর, এবং দুষ্টুমিতে ভরা উষ্ণ সব আলাপ - বিশেষ এক লাইফস্টাইল খণ্ডচিত্র, বিদ্যাজাগতিক এবং তার থেকেও বেশিকিছু । নতুন বানানো বাইপাস সড়ক কোলকাতার প্রান্ত এঁকে দিয়েছে । সিএসএসএসসি এর বাইরে পড়েছে, দূরবর্তী এবং শান্ত । মনে হয় যেন অন্য গ্রহে, চারপাশে নির্মাণাধীন পোড়ো জমি, অন্যান্য সরকারী দপ্তর, আর প্রোমোটারের বিশালাকায় অট্টালিকা । সবথেকে আলাদা করে ক্যাফেটাই নজর কাড়ে, ছাদওয়ালা গোলাকার একটা খোলা জায়গা, চোখজুড়ানো ।
তাহলে এই হচ্ছে কোলকাতা ! উপনিবেশের বানানো সর্ববৃহৎ শহর । হাজারে হাজারে বাংলাভাষী মধ্যবিত্ত এবং তাদের কসমোপলিটান আকাঙ্ক্ষা, সদানব ভারতীয় সত্তা - রাস্তায়, ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলে, দানবাকার শপিং মলে, পাবে ; কিংবা যখন তারা টেলিভিশনের সামনে, ক্রিকেট গ্যালারিতে, বা মন্দিরে । প্রত্যেকটা জিনিস মহাভোগবাদের একেকটা স্যুভেনির । কিসে কোলকাতা এত স্বতন্ত্র তা ভেবে আমার অবাক লাগল । সিপিআই(এম) -এর মত একটা কাগজে-কলমে মার্কসবাদী দলের উপস্থিতি আমি উপেক্ষা করতে পারছিলাম না । কিন্তু ভারতের অপরাপর বিরাট শহরের সঙ্গে আসলেই কোন পার্থক্য আছে - মুম্বাই, চেন্নাই, বাঙ্গালোর কিংবা দিল্লির সঙ্গে ? বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কি এখানে একই কর্মগতি এবং উদ্দীপনা নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে না ? কোলকাতা কি গ্লোবেলাইজড মেট্রোপলিটানের একটা প্রকাশ নয় ? একটা জরুরী জিজ্ঞাসা আমার জন্য, বাংলাদেশের একজন হিন্দু যার অভিজ্ঞতায় রয়েছে বিস্তর আত্মীয়স্বজনের পশ্চিমবাংলায় দেশান্তর, বিশেষত কোলকাতায় । এক চাচা, অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক যিনি ১৯৭১-এ পাড়ি দিয়েছেন, খুব কড়া কিছু বললেন : "শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে কারা মেরেছে ? তোমার কি মনে হয় খুব সোজা ব্যাপার ? তিনিই ছিলেন পুববাংলার লোকেদের সত্যিকার বন্ধু । আর তাঁর সরাসরি শত্রু ছিল কংগ্রেস (আই) ।" এ ব্যাপারে আমার জ্ঞানগম্যি খুবই কম তবুও বিষয়টাতে আমি তলিয়ে গেলাম । ফুটপাতের দোকানে আর ভিড়ে, তাদের মধ্যে বিরাট একটা অংশ বাংলাদেশ থেকে, বিষয়টা আমাকে ভাবাতেই থাকল । থামলাম যখন লাউডস্পীকারের বক্তৃতা কানে ভেসে এল । মাইকে যখন গান চলছিল তখন একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, চলছিল কৃষ্ণকথা, পুরোনো কোলকাতায় আকছার হয়, সম্ভবত ব্রজবুলি ভাষায় । বক্তৃতাতে কিছু একটা বলা হচ্ছিল বাংলাদেশী (হিন্দু) দেশান্তরীদের নিয়ে । মাথামুণ্ডু কিছু ধরতে পারছিলাম না । আন্দাজ করলাম বিশাল আলোকিত বাড়িটার ছাদে যে হরিনাম হচ্ছে সেখানে সমাগতদের বড় একটা অংশ পূর্ববঙ্গীয় ।
যাকগে ! আর যাই হোক, পত্রিকার গতিপ্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রে আমি বেশ দুর্বল ছিলাম । আদভানি অচিরেই বেকহ্যামের জায়গা নিলেন । তাঁর তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেবার কথা । অফিসিয়াল অনুষ্ঠান, রাজ্য সরকারকে মহাব্যতিব্যস্ত করে ফেলল ; কথা যেহেতু আদভানিকে নিয়ে হচ্ছে, এবং বাবরি মসজিদের মামলা চলছে তখন । এবং কদিন আগেই গুজরাটের আদালত কুখ্যাত `বেকারি হত্যা' মামলা খারিজ করে দিয়েছে । তপনের দোকানে ফিরতি পথে একটু ঢুঁ মারলাম, জিজ্ঞেস করলাম ওর কি মনে হয় যে আদভানির ওপর কোন হামলা হবার সম্ভাবনা আছে । তপনই প্রথম যাকে আমি বাংলাদেশে হিন্দুদের পরিস্থিতি নিয়ে বলেছি । আসলে বলিওনি, বরং একটা তুলনা টেনেছি, সেটাই বারংবার লোকজনকে বলেছি । "আমার মনে হয় গুজরাট নিয়েই এখন ভাবা দরকার ।" সেদিন তপন বেশ ধাক্কা খেল । ফলে এদিন সে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল পাড়ার সৌরভ গাঙ্গুলী এভিনিউয়ের দিকে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পর এরকম রাস্তা নিশ্চয়ই আরো আছে । "দেখুন দাদা ! আপনি যাই ভাবেন না কেন, আমরা বাঙালিরা এখনো সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে । বিজেপিকে আমরা আগেও ঠেকিয়েছি, পরের বারও ঠেকাব, শেষবিন্দু রক্ত পর্যন্ত আমরা করব । বাংলাতেই আদভানির সবচাইতে ভয় ।" বলাই বাহুল্য, আমি সম্ভাব্য কোন ভীতির খুব একটা কারণ দেখিনি । পরের সকালে আদভানির বক্তব্য পাওয়া গেল, রাজ্য সরকারকে নসিহৎ করছে যাতে তারা আরো সহনশীল হয় । জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান সিপিআই(এম) বয়কট করেছিল । তাদের নৈতিক অবস্থান হচ্ছে শ্যামাপ্রসাদের রাস্তা বর্জন ।
তখন আমি অপেক্ষা করছি আর দুটো জিনিসের জন্য : কলেজ স্ট্রীটে একবার ঢুকে ছোট কাগজ খুঁজে দেখা; এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমার দরিদ্র পূর্বসূরীদের দেখতে ক্যানিং-এ যাবার মানসিক প্রস্তুতি অর্জন, যাঁরা সুন্দরবনের ধারে গিয়ে বসত গেড়েছেন । সারাটা দিন আমি নোটবইয়ের পর নোটবই দেখতে দেখতে কলেজ স্ট্রীটে হাঁপিয়ে উঠছিলাম । কয়েকটা মাত্র দোকানে মূল বই বিক্রি হয় । বাংলা ক্লাসিকস সেখানে ছিল বটে । কিন্তু কোন ছোটকাগজ নাই । দয়ালু এক পথচারী আমাকে পাতিরামের দোকান দেখিয়ে দিলেন । সেখানে পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচের পর্যন্ত ছোটকাগজ আছে, তবে সবই প্রায় সাম্প্রতিক সংখ্যা । আমার মাথায় কোলকাতার যে ছবি ছিল, বিশেষত কলেজ স্ট্রীটের, তা হচ্ছে ছোটকাগজের একটা মেলা বোধকরি । খুবই বোকাটে ভাবনা ! ইরাকের ওপর দুতিনটে সংকলন পাওয়া গেল । বোধগম্য । কিন্তু ক্যানিং-এ যাবার ব্যাপারে দিনকে দিন আমি উত্তেজিত হয়ে উঠি । প্রান্তিক হিন্দু দেশান্তরীদের জায়গা । অনেক বেশি ক্ষোভ সেখানে, অনেক ঘৃণা, ফেলে আসা এক পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলমানদের প্রতি । দেখলাম যখন ক্যানিং এবং অন্যান্য দক্ষিণী অঞ্চলের ট্রেনগুলো অন্য একটা প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে, তখন ক্যানিং যাবার চিন্তা প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিলাম । দ্বিধাগ্রস্তভাবে শেয়ালদহ মূল টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ টার্মিনালে গেলাম । পরিহাস ! দক্ষিণের টার্মিনাল, ঘিঞ্জি এবং ভিড,. খেটে খাওয়া মানুষে বোঝাই । পরের ট্রেনের এখনো দেড় ঘন্টা বাকি । বারবার আমার মনে হ'ল মূল টার্মিনালে গিয়ে কিছু বই কিনি, বিরাট কয়েকটা বইয়ের দোকান সেখানে । অথচ আমি প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে আঠার মত লেগে থাকলাম, দক্ষিণে যাবার শয়ে শয়ে যাত্রীদের সঙ্গে । ভেলপুরিওয়ালা আমার দিকে তাকিয়েই ছিল, আমার মুখের দাড়ির জন্য মোটামুটি নিয়মিতই এটা ঘটে । তার ওপর, এমনকি আমার সাদাসিদে পাজামা-পাঞ্জাবিও দক্ষিণ টার্মিনালের অপেক্ষমান যাত্রীদের মধ্যে বেমানান রকমের খান্দান । একটা ভেলপুরি নিলাম । দোকানি ১ টাকা দাম চাইল । তার গলা পরিষ্কার ছিল কিন্তু আমি সংশয়ে আবার জানতে চাই । মাটির কাপে চায়ে চুমুক দিতে দিতে, চাচার মুখশ্রী মনে করার চেষ্টা করি, আশির ওপরে এখন বয়স হবে, গলায় তুলসীর মালা, ক্যানিং প্ল্যাটফর্মে চাউল বেচাকেনা করছেন । শেষবার তাঁকে দেখেছিলাম ১৯৭৯ সালে । ট্রেনের তখনো দেরি, অথচ আমি, মেঝেতে গাবের আঠার মত সেঁটে, আশা করে যাচ্ছি ট্রেনটা যাতে আরো দেরি করে ...
(চলবে)
(পরবাস ৩৮, ডিসেম্বর, ২০০৬)