আজ কপালে কি আছে কে জানে । হুলোর কথা শুনে কেন যে ইস্কুল থেকে পালালো । হুলো তাদের গ্রামের ছেলে তবে বন্ধুত্ব এই হালে হয়েছে । ক্লাস ফোরে ওঠার পরে । ভুলো তখন বেশ ছোট, হুলোদের একটা দল ছিলো । বিশুনদা, মনাদা, জ্যাঠাদা, খোকনদা প্রায় জন সাতেকের দল; দেশবন্ধু মাঠের কাছে পিট্টু, গজি, খেলতো । ভুলো, সতু বুদ্ধুদের পাত্তাই দিতো না । লুকোচুরি, ছোঁওয়াছুঁয়ি খেলায় ভুলোদের নিলেও ওরা দুধভাত । বিশুনদা, মনাদারা কবে ক্লাশ ফোর পেরিয়ে গেছে । ওরা দুমাইল দুরের কামড়াভাঙা হাইস্কুলে পড়তে যায় । আর এক ক্লাশে থাকতে থাকতে হুলোদা কেবল হুলো হয়ে গেলো । তা নিয়ে হুলোর মনে খুব একটা দু:খ নেই । প্রতি বছর রেজাল্ট বেরনোর দিনটাতে সে বেপাত্তা হয়ে যায় । ওর দিদি সারা দুপুর ধরে ওকে খুঁজে বেড়ায় । অন্ধকার বেশ গাঢ় হলে তবে ও বাড়ি ফেরে । হুলো একদিন চুপিচুপি তাকে বলে দিয়েছে লুকিয়ে থাকার জায়গাটা কোথায় আছে । হুলোর গুপ্ত আস্তানা সে ছাড়া আর কেউ জানে না এটা মনে করে বেশ গর্ব অনুভব করে সে । ছোটবেলায় খেলতে গেলে তাকে দুরছাই করার শোকটা এখন সে প্রায় ভুলেই গেছে । হুলোদের বাড়ির লোকজন আরেকটা কথাও জানে না যেটা ভুলো জানে । রোজ টিফিনের পর হুলো ইস্কুল থেকে পালিয়ে যায় । কায়দাটা খুব সোজা । রোজ টিফিনের আগে অঙ্কের স্যার দুলালবাবু, হুলোকে পাঁউরুটি আর ঘুগনি আনতে দেন । তাদের তিনকড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে মিনিট দশেক হাঁটলেই হাসানপুর বাস গুমটি । বাস গুমটির পাশেই তুলসীরামের চায়ের দোকান । তবে চা ছাড়াও সেখানে সকালে পুরি তরকারি, দুপুরে পাঁউরুটি ঘুগনি, সন্ধ্যায় তেলেভাজা মেলে । তাদের গ্রামের সবচেয়ে কাছাকাছি খাবারের দোকান বলতে তো ওটাই । প্রতিদিন দুপুরবেলায় গরম গরম টাটকা ঘুগনি বানানো হয় । একবার পিসির বাড়ি বেড়াতে যাবার পথে বাবা তাদের তিন ভাইবোনকে ঘুগনি খাইয়েছিলো । স্বাদটা এখনও জিভে লেগে আছে । ক্লাসে বসে মাঝে মাঝে খুব খিদে পেলে এখন ওর ঘুগনির কথা মনে আসে । দুলালবাবু টিফিনে রোজ পাঁউরুটি ঘুগনি খান । চায়ের দোকানের ছেলেটার সঙ্গে হুলো বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে । সেই খাতিরে দুটাকার ঘুগনিতে বড়ো. শালপাতার চোঙাটা ভরে যায় । হুলো সেই গরম পাঁউরুটি ঘুগনি স্যারকে খাইয়ে তার গা হাত পা টিপে দেয় । ততক্ষণে তাদের ক্লাস শুরু হয়ে যায় । কিন্তু হুলো ক্লাসে যায় না । খাওয়াদাওয়ার পর দুলালবাবু একটি টেবিলে দুপা তুলে চেয়ারে বসে ঢুলতে থাকেন । হাজার হোক হেডস্যার বলে কথা, সারাদিন কতো ছেলে সামলাতে হয় । একটু না জিরোলে চলে ? দুলালবাবু ঘুমিয়ে পড়লেই হুলো পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ধা হয়ে যায় । এই নিয়ে আগে খুব পিটুনি খেতো । কিন্তু এখন আর কেউ কিচ্ছু বলে না । সবাই জানে হেড স্যার হুলোকেই টিফিন আনতে দেবেন আর টিফিনের পর সে পালাবেই ।
নতুন ক্লাসে ওঠার পর থেকেই ভুলো ওর ন্যাওটা হয়ে গেলো । আসলে এতোদিন পর হুলোর কাছে পাও । পেয়ে সে যেন হাতে স্বর্গ পেয়েছিলো । ক্লাসে যতোই ফেল করুক না কেন হুলো এমন অনেক কিছু পারে যা অন্য কেউ ভাবতেও পারে না । যেমন আমগাছে সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়ে বসে থাকতে পারে, ব্যাঙবাজি খেলায় ওর ঢিল সবথেকে বেশি দূরে যায়, কোথায় কোন গাছে কি ধরেছে সব তার নখদর্পণে । কেবল ক্লাসের পড়াটাই যা করতে পারে না । হুলো বলে, `পড়াশুনাটা খুব সহজ কাজ, পড়লেই পাশ করা যায় কিন্তু এসব কাজে বেশ দম লাগে বুঝলি । কিন্তু দ্যাখ এটা কেউ বুঝতেই চায় না ।' কেউ না বুঝলেও ভুলো বোঝে । চাইলেই যে কেউ টপাটপ নতুন ক্লাসে উঠে যেতে পারে কিন্তু হুলোর মতো কজন হয় ? তাই সে ঠিক করেছে ওর কাছ থেকে সব শিখে নেবে । আজকেই তার হাতেখড়ি ছিলো ।
আসলে হয়েছে কি, গতকাল ইতিহাস-ভূগোলের বনমালী স্যার সবাই বলে দিয়েছিলেন যে আজ ক্লাসে পড়া ধরবেন । সেই কথাটা সে ভুলে গিয়েছিলো । ফলে যা হয় হলো, ভুলো স্যারের হাতে বেদম মার খেল । বনমালী স্যারের শাস্তি দেবার একটা অন্য কায়দা আছে । সব স্যারেরই আছে তবে বনমালী স্যারেরটা বেশি কষ্টকর । পড়া না পারলে তিনি হাতের ইশারায় কাছে ডাকেন । স্যারের বেতের নাম মধু । বেত হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, `আজ কতো তারিখ বলতো ?' যতো তারিখ ততোগুলো মার । মারের মাঝখানে যদি একবার হাত সরিয়ে জামায় ঘষ তবে আবার প্রথম থেকে শুরু হবে । তবে এক তারিখে যারা মার খায় তাদের ভাগ্য এমনকিছু ভালো নয় । ঐ একটা মারেই দুদিন আর ভাত খেতে হবে না । আজ বারো তারিখ ছিলো কিন্তু ভুলো একুশটা বেতের বাড়ি খেয়েছে । নয় নম্বরটা খেয়ে ভুল করে প্যান্টে হাত ঘষে ফেলেছিলো । মার খেয়ে মনটা বড়ো. খারাপ হয়ে গেলো । পরের ক্লাসটা অঙ্কের ছিলো । দুলালবাবু চারটে অঙ্ক কষতে দিয়েছিলেন, সবাই খাতা ভরিয়ে জমা দিল । এমনকি হুলোও । গোটা ক্লাসের মধ্যে সেই একমাত্র সাদা খাতা জমা দিয়েছে । আর যায় কোথায় বাইরের বারান্দায় বেলা চারটে অবধি একপায়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি হলো । শুধু টিফিনের সময়টাতে দুপায়ে দাঁড়িয়ে খাবে । তা দাঁড়িয়ে ছিলো সে । টিফিনের পর নীতিশিক্ষার ক্লাস । বিজনবাবু ক্লাসে ঢুকে গেছেন । ছেলেরা সব যে যার ক্লাসে ঢুকে গেছে । সেই কেবল গনগনে রোদে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে । হুলো কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, `চালসা পুকুরে যাবি তো চলে আয় ।' প্রথমটায় সে যেতে চায়নি বলেছিলো, `কাল যদি আবার পিটায় তা হলে ।' কথাটা শুনে হুলো মুখ বেঁকিয়েছিলো, `খেলে খাবি তারপর দুপুরবেলায় আবার পালাবি । একটু মার না খেলে কি হাত পা শক্ত হয় ! আমায় দেখতো ।' এই মোক্ষম কথার পর আর কথা চলে না । তাছাড়া এই রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে কাল সকালে এসে পিটানি খাওয়া অনেক কম কষ্টকর । হুলো আর একবার জিজ্ঞাসা করল, `কি রে যাবি না কি ।' কান থেকে হাত সরিয়ে বাঁ পা টা মাটিতে নামাল সে । ব্যস্ হুলোর পিছু পিছু চালসা পুকুর । হাঁটু জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে কতো আরাম । চারিধারে বড়ো. বড়ো. গাছ থাকার জন্য পুকুরের কাছটা কেমন ছায়া ছায়া । চুপচাপ বসে থাকতে ভারি ভালো লাগছিলো তার । কিন্তু হুলো একদম চুপচাপ বসে থাকতে পারে না । ঢিল তুলে ব্যাঙবাজি খেলতে শুরু করল । দেখাদেখি সেও ।
খেলতে খেলতে ভারি মজা পাচ্ছিলো সে । প্রথম দিকটায় ঢিলগুলো একটু এগিয়ে ভুস করে ডুবে যাচ্ছিলো । হুলো বলল, `অতো জোরে ছাড়লে ঢিল তো ডুববেই আস্তে করে বেঁকিয়ে ছাড় ।' প্রথমটায় পারেনি পরে বেশ হচ্ছিলো । তবে হুলোর মতো নয় । তবুও যা হচ্ছিলো তাতেই বেশ মজা । সব ঠিক ছিলো কিন্তু জনাইকাকা দেখে ফেলেই যতো গণ্ডগোল হলো । চালসাপুকুরের ধারে সরু রাস্তাটা ধরে সাইকেলে করে কোথায় যেন যাচ্ছিলো, ভুলোদের ঠিক দেখতে পেয়েছে । জনাইকাকা হলো বিশুনদার বাবা । গতবছর বৃত্তিপরীক্ষায় বিশুনদার নাম ওঠার পর থেকে জনাইকাকা তাদের দেখলেই পড়াশুনার কথা বলে । ভুলোর বাবা আজকাল প্রায়ই বলে, `মন দিয়ে পড়াশুনা কর । জনাইয়ের ছেলের মতো বৃত্তি না আনলে পড়া বন্ধ ।' হুলোর অবস্থা তো আরও খারাপ । সেদিন ও দু:খ করে বলছিলো, `বিশুনটার জন্য বাড়িতে রোজ ঠ্যাঙানি খেতে হয় ।' জনাইকাকা আর হুলোর বাবা দুজনে টালা খোলার কারখানায় কাজ করে । হুলোর সন্দেহ জনাইকাকা ওর বাবার কান ভারি করে । নাহলে প্রতিদিন এতোটা মার খাওয়ার কথা তার ছিলো না । তাদের দেখেই জনাইকাকু চেঁচিয়ে উঠল, `এই ভুলো ইস্কুলের জামা গায়ে ভর দুপুরে ব্যাঙবাজি খেলে বেড়াচ্ছিস । দাঁড়া তোর বাবাকে বলছি । এই হুলোর মতো বখাটে ছেলেটার সঙ্গে মিশে ইস্কুল পালাতেও শিখে গেছিস । দাঁড়া আজ তোদের হবে ।' জনাইকাকা চলে যেতেই ভয়টা চেপে বসেছিলো । ভয় পেলে পেটের ভিতরটা কেমন গুড়গুড় করে, গলার কাছে কি একটা পাকিয়ে ওঠে । হুলোকে জিজ্ঞাসা করল, `কি হবে ?' হুলো তখন জলে হাত ডুবিয়ে গুগলি শামুক ধরতে লেগে গেছে । বলল, `ধুস ছাড় তো যা করবে করুক । তুই শুনে রাখ ভুলো, আজ বাবার কাছে যদি মার খাই তবে ঐ জনাইয়ের অবস্থা আমি ঢিলে করে দেব ।' রেগে গেলেই হুলো সকলের নাম ধরে ডাকে । যাই হোক এরপর আর খেলাটা তেমন জমলো না । হুলো বলল, `চ কসাই বাগানে যাই । এতক্ষনে ইস্কুল ছুটি হয়ে গেছে, সবাই এসে যাবে হয়তো ।' ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে তারা কসাইবাগানে এসেছিলো । এই বাগানে অনেকগুলো বড়ো. বড়ো. মোটা মোটা গাছ আর একটা পুরনো ভাঙা মন্দির । অনেক বছর আগে এখানে পশুবলি দেওয়া হতো । ভুলোর জন্মের আরও অনেক আগে, মার কাছে এসব গল্প শুনেছে । তার জন্মের বহু আগেই শিবতলার মোড়ের মন্দিরটাতে পুজো শুরু হয় । এই ভাঙা মন্দিরে এখন কেউ একটা বিশেষ আসে না । তবে লুকোচুরি খেলার পক্ষে এটা একটা বেশ ভালো জায়গা । আজ এই কসাইবাগানে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে পুতুলের সঙ্গে তার ঝগড়া বাঁধলো ।
রাতের ব্যাপারটা থেকে বাঁচার জন্য একটা যুত্সই উপায় বের করতে হবে । মগজ হাতড়ে একটার পর একটা উপায় বের করার চেষ্টা করছিলো সে । কোনোটাই তেমন মনমতো হচ্ছে না । হুলোটা পাশে থাকলে ভালো হতো । একমনে পথ চলতে চলতে কখন যে দেশবন্ধু মাঠ ছাড়িয়ে শিমুলতলার রাস্তাটা ধরে ফেলেছে খেয়ালই করেনি । এদিকটায় দিনে দুপুরেও কেউ আসে না । চালসা পুকুর পর্যন্ত এসে ডাইনের রাস্তা ধরে শিবমন্দিরের পাশের রাস্তা দিয়ে গ্রামে ঢোকে । এখন প্রায় সন্ধ্যার মুখে বড়ো. গা ছমছমে লাগছে এই জায়গাটা । শিমুলতলায় এখন শিমুল কেন একটাও বড়ো. গাছ নেই । গোটা জায়গাটা আগাছায় ভরা । আগাছা পেরিয়ে একটু ভিতরে ঢুকলেই একটা ভাঙাচোরা মাটির বাড়ি । সেখানে কেউ থাকে না এমনিই পড়ে আছে । সে যেখানটায় চলে এসেছে সেখান থেকে ভাঙা বাড়িটা স্পষ্ট দেখা যায় । বাড়িটার দিকে তাকিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো সে । বাড়ির সামনে ভাঙাচোরা সিঁড়িটার কাছে ও কে বসে আছে ? বাবা না ! পাশ থেকে দেখে তো তাই মনে হচ্ছে । ভালোভাবে দেখার জন্য আরও খানিকটা এগিয়ে এলো সে । ঠিক ধরেছে । ভাঙা সিঁড়ির উপরে বসে থাকা লোকটা তার বাবাই বটে । গায়ে হাতকাটা গেঞ্জি আর চকরাবকরা লুঙ্গি । সকালে তো এটা পরেই হাটে যাবে বলে বেরিয়েছিলো । বাবা তাকে দেখতে পেয়েছে কি ! নাহ্ তা তো মনে হচ্ছে না । সিঁড়ির উপর কেমন যেন থম্ মেরে বসে আছে । মাঝে মাঝে লুঙ্গির কোঁচড়ে হাতো ঢুকিয়ে কি বের করে মুখে পুরছে । বাবাকে অমন ধারা বসে থাকতে দেখে কেমন একটা ভয় ভয় ভাব সাপটে ধরল তাকে । হুলো বলে এই শিমুলতলায় নাকি ভুত আছে । গাঁয়ের অনেকে ভরসন্ধ্যায় এ পথ ধরে চলার সময় নানাধরনের অদ্ভুত আওয়াজ শুনেছে । বাবাকে ভুতে পায়নি তো ! ভুলো সত্যি সত্যি বেজায় ভয় পেল । একবার ভাবলো পালিয়ে যায়, পরক্ষনেই মনে হলো বাবাকে এভাবে ফেলে পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না । সে চলে যাওয়ার পর যদি সত্যি সত্যি ভুত এসে বাবাকে টেনে নিয়ে যায় ? সবাই বলবে ছেলে হয়ে বাবাকে ভুতের আড্ডায় বসিয়ে রেখে পালিয়ে এলি ভুলো ! তা ছাড়া হাতে তারকেশ্বরের মাদুলি তো বাঁধাই, ভয় কি ? পা টিপে টিপে বাবার কাছটাতে এসে দাঁড়ালো সে । বাবা এখনও টের পায়নি । আলতো করে বাবার কাঁধ ছুঁয়ে আস্তে আস্তে ডাকল, `বাবা ও বাবা ।' ছেলের ডাকে যেন ঘোর কাটল সাধুচরণের । চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকালো । কিছুক্ষণ মুখ থেকে কোনও কথা বের হলো না । তারপর একটু মৃদু ধমকের সুরে বললো, `ভর সন্ধেয় এখেনে কি করতে এয়েচিস ?' বাবার ধমক শুনে ভুলো একটুও ঘাবড়ালো না । শান্ত স্বরে বলল, `আমি তো এ পথ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম । তোমায় দেখে এদিকটায় এলাম । তুমি এখানে বসে আছ কেন, আজ হাটে যাওনি ?' ছেলেকে দেখামাত্রই সাধুচরণ এই ভয়টাই পেয়েছিলো, ছেলেটা বেজায় বুদ্ধি ধরে । তাকে দেখে ঠিক ধরে ফেলেছে সে আজ হাটে যায়নি । এখন চট করে এ প্রশ্নের কি জবাব দেওয় যায় ? একটু আগে সাধুচরণের গলার স্বরে যে ঝাঁজ ছিলো, সেটা আর রইলো না । কেমন যেন মিয়ানো গলায় বলল, `আয় আমার পাশটাতে একটু বস্ ।' বাবার এই পরিবর্তনে ভুলো কিছুটা অবাক হলো । সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বাবা গা ঘেঁষে বসলো । সাধুচরণ তার কোঁচড় থেকে একমুঠো মুড়ি বের করে ছেলের দিকে এগিয়ে দিল, `নে খা ।' ভুলো তার ময়লা হাত দুটো পেতে মুড়ি কটা নিল তারপর একেবারে মুখে পুরলো । কিছুটা মুড়ি গাল হাতের ফাঁক দিয়ে সুড়ুত করে গলে মাটিতে পড়লো । ছেলের মুড়ি খাওয়ার সময়টাতে সাধুচরণ ভাবতে বসলো কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা । এ ছেলে খুব বুদ্ধিমান, মিথ্যে বললে ধরে ফেলতে পারে । তাছাড়া মাথাটাও কেমন যেন ফাঁকাফাঁকা হয়ে গেছে । কোন যুত্সই মিথ্যা গপ্পো মাথায় আসছে না । ভুলের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে যেন ফিসফিস করে কথাটা বলল সে, `বাড়ির কাউকে বলিস নি বাপ । আজ আমি হাটে যেতে পারিনি । বেলা করে বেরিয়েছিলাম । অতো বেলায় কেউ কাজ দেয় না । শিমুলতলার পথটা ধরে যেতে যেতে হঠাৎ এই ঘরটার দিকে চোখ পড়ল । মনটা কেমন যেন আকুর পাকুর করে উঠল রে বাপ । যখন তোর মতন ছোট্ট ছিলুম প্রতিদিন এখেনে আসতাম । আমার এক বন্ধু ছেলো এখেনে, বড়ো. পেরানের বন্ধু ছেলো রে । বড়ো. ভালবাসতো আমায় । আমার তো মা ছেল নি । তার মা নিজের ছেলের মতো করে দেখতো । একবার তার বড়ো. অসুখ করল । গেরামের হাসপাতালের ডাক্তার চিকিচ্ছে করতে পারল নি । তারা কলকাতায় চলে গেলো । তারপর তাদের আর কোন খপর নেই । সে চলে যাবার পর পথম পথম কতো কাঁদতাম, পরে আস্তে আস্তে ভুলে গেলুম । আজ এই ভাঙা ঘর দেখে হঠাৎ তার কথা খুব মনে হলো । কি যে হলো আমার । পায়ে পায়ে এখেনে চলে এলাম । সারাদিন মনে মনে কতো কথা কয়েচি তার সাথে । দুক্কুরবেলায় এই উঠোনের মেঝেতে একটু ঘুমিয়েও নিলাম । ঘুম ভাঙতে মনে হলো আরও খানিকটা বসে যাই । তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে তোর মা আবার সন্দ করবে । লক্ষ্মী বাপ আমার কারুকে বলিসনি ।' বাবার কথায় ভুলোর মনে খুশির ঝিলিক দেখা দিল । এতক্ষন ধরে যে উপায় খুঁজছিলো তা পেয়ে গেছে । জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, `কাউকে বলব না বাবা, তুমি দেখে নিও ।' সাধুচরণ খুশি হয়ে ছেলের মাথার তেলা চুলগুলো খানিক ঘেঁটে দিলো ।
কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে ভুলো আস্তে আস্তে বলল, `বাবা আজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তোমার ছোটবেলার গল্প শোনাবে ?' ছেলের কথায় সাধুচরণ হেসে ফেলল । এইটুকুন বয়সেই বেশ চালাক চতুর হয়েছে তো ছেলেটা । বাপের সঙ্গে বেশ কায়দা করে সওদা করছে তো । বলল, `আচ্ছা তবে কালকের পড়াটা করে রাখিস ।' বাবার কাছে সাহস পেয়ে ভুলো এবার আসল কথাটা পাডলো `বাবা জনাইকাকা যদি তোমায় কিচ্ছু বলে তবে তুমি রেগে যেও না ।' সাধুচরণ এবার গম্ভীর হলো, `কি বলবে জনাই ?' ভুলো ভয়ে ভয়ে বললো, `আজ আমি ইস্কুল থেকে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি । পুকুরধারে দাঁড়িয়েছিলাম জনাইকাকা দেখেছে । তোমার কাছে বলে দেবে বলেছে । আমি বললাম আর কোনোদিন করব না তবু শুনলো না ।' বলা বাহুল্য তার শেষের কথাটা সদ্য বানানো । ছেলের কথা শুনে সাধুচরণ রেগে উঠতে গিয়েও পারলো না । নিজের ছেলেবেলাটা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো । ক্লাস টুতে ওঠার পর ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করেছিলো । কিন্তু তার আগেও কি ইস্কুলের সবকটা ক্লাস করতে পারতো । টিফিনবেলা হলেই পালিয়ে আসতো সঙ্গে থাকতো তার পরম বন্ধু, এই বাড়ির ছেলে মাখন । সাধুচরণের মনে হলো প্রথমবারের জন্য ভুলো যা করেছে তার জন্য তাকে ক্ষমা করা যেতেই পারে । বাপের উড়ু উড়ু ভাবটা ছেলেও পেয়েছে । তবে এটা ভালো কথা নয় । গলার স্বরে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল, `আর কখনো এসব করিসনি ভুলো । লেখাপড়া না শিখলে পয়সার জন্য লোকের দোরে দোরে ঘুরে বেড়াতে হবে । সে বড়ো. কষ্টের রে । পড়াশুনাটা শেখ বাবা । আর কোনদিন অমন করিস না বুঝলি ।' খানিকক্ষন বাপ ছেলে চুপচাপ রইলো । তারপর সাধুচরণ ছেলেকে আলতো ঠেলা দিয়ে উঠে দাঁড়াল, `নে একন চ দেখি, আস্তে আস্তে পা চালিয়ে ঘরে যাই ।' ভুলো এতক্ষণ কি ভাবছিলো কে জানে । বাবার কথায় মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে তার পিছু পিছু চললো ।
(পরবাস ৩৮, ডিসেম্বর, ২০০৬)