• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৮ | জানুয়ারি ২০০৭ | গল্প
    Share
  • অজাতক : নন্দন দত্ত

    ॥ ১ ॥

    -- তাহলে কবে ?

    -- বলছি তো এখন নয়, এই প্রজেক্টটা টূ ইম্পর্টযান্ট, আমিই ইন চার্জ । আই কান্ট লেট অ্যালেক্স ডাউন ।

    -- কতদিন চলবে তোমার প্রজেক্ট, ...এইটা ?

    -- অনেকগুলো ফেজ আছে । প্রথমটা ঠিকঠাক ডেলিভার করতে পারলে ক্লায়েন্ট আরো কাজ দেবে, টিম সাইজ বাড়বে, স্কেড্যুল এক্সটেণ্ড করবে প্রজেক্টের ।

    -- কর ডেলিভার, তোমার প্রজেক্ট ...।

    -- সুমন ডোন্ট বি অ্যাবসার্ড, য়ু নো হোয়াট দিস্‌ মীন্স্‌ টু মি, দিস্‌ প্রজেক্ট, এই বয়সে কতবড় ব্রেক এটা একটা । ইউ কান্ট বি সার্কাস্টিক অ্যাবাউট ইট ।

    -- মিতা তোমায় বিদ্রুপ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, করছিও না আমি । কিন্তু তোমার হয়ত মনে নেই, আমাদের একটা কমিট্মেন্ট আছে টু ইচ্‌ আদার  ।

    -- আই অ্যাম নট্‌ সেইং নো । কিন্তু এখন অসম্ভব, এই প্রজেক্টটা ইজ্‌ অ্যা ওয়াটারশেড্‌ ..., ইমেন্স স্কোপ ফর গ্রোথ । এদিকে খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে তারপরে ধীরে সুস্থে ....।

    -- এই তো শুনে আসছি ইয়ার্স নাও ...., এখন নয় পরে, আই ওয়ান্ট অ্যা ডিসিশন দিস টাইম, ওয়ান্স অ্যাণ্ড ফর অল ।

    -- এখন আমায় ওয়ান্স অ্যাণ্ড ফর অল দেখাচ্ছো, তোমার মনে নেই, বিফোর দিস্‌ অ্যাসাইনমেন্ট, আই ওয়াজ রেডি, অ্যালেক্সকে বলেওছিলাম, হি ওয়াজ ওকে, তোমার অ্যাকুইজিশন নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলে না তুমি ? ভুলে গেছো ? আমি মাকেও বলেছিলাম টিকিট কাটতে । ইউ হ্যাভ অল্সো গন ব্যাক ইন দ্য পাস্ট .....।

    -- আমি এখন ছাড়ছি মিতা, মিটিং আছে ।




    ॥ ২ ॥

    এই হেঁয়ালিক বিতণ্ডা খানিক খোলসা করা যাক । নামগুলো ছিটকে এসেছে ইতিমধ্যেই, সুমন আর মিতা । ওরা অনেকদিন থেকে ঠিক করে রেখেছে, ছেলে হলে নাম হবে সুমিত, মেয়ে হলে সুমিতা । অবশ্য মেয়েই বেশি ইচ্ছা সুমনের, মিতারও ।

    সুমন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কার, খোদ ম্যানহ্যাটনে বসে, তবে ভ্রামণিক কাজ, ধেয়ে বেড়াতে হয় ধরার এধার ওধার । ইনেভস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং ব্যাপারটা আমি ভাল বুঝি না, তবে এটুকু বুঝি যে জাঁদরেল ব্যাপার । ছঁংউচের আগার মত বোধি নিয়ে কাজ করতে হয়, একটু এদিক ওদিক হলেই ক্ষতি অযুত-নিযুত টাকার, থুড়ি ডলারের । তবে এদিক ওদিক না হলে, এবং সুমনের হয়ও না, মাস গেলে মেলে সূচাগ্রপরিমাণ ভূমির খানিক বেশিই । অতএব লড়ে যাওয়া যায় ।

    মিতা সফ্টওঅ্যারে আছে । রিশেসনের উজান বেয়ে এখন আবার সফ্টওঅ্যারের দর ও আদর দুই বাড়ছে শুনছি । তবে মিতার পজিশন এমনই যে মন্দার আঁচ ওর গায়েই লাগেনি । ওর কোম্পানির তিন অক্ষরের নাম, মানে তিন শব্দের আদ্যক্ষর নিয়ে রণিনি উপনাম । এবং এতই ওজনদার যে ভেঙে বলার দরকার হয় না । মিতা এখন আর আঙুল ক্ষয়ানো কোডিং করে না, এতদিনে সে অনেক দায়িত্ববান কাজী । ওর প্রধান কাজ ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে প্রোজেক্ট আনা । মিতার প্রেজেন্টেশনে মক্কেলদের ঝানু মুত্সুদ্দিরাও কাবু হন, হয়ে বলেন, ওয়েল দিস্‌ লুক্স গুড । অ্যালেক্সের, অর্থাৎ অ্যালেক্জ্যাণ্ডার পি জেম্স'এর অগাধ আস্থা মিতার ওপর ; ওদের স্যান-হোসে ব্রাঞ্চের উঁচুর দিকে এই অ্যালেক্স । ডিপার্টমেন্টে ওঁর খ্যাতি, হি ক্যান স্পট দেম ইয়ং । অ্যালেক্স পঞ্চাশোর্ধ ।

    ও: হঁযা, প্রথমে বছর-খানেক ব্যাঙ্গালোরে রগড়ে মিতা প্রায় পাকাপাকি এদিকেই এখন । প্রাথমিক সহকর্মীরা অবশ্য অনেকেই আঙুল চুষছেন এখনও । ওদিকে ।

    ওদের দেখা হয়েছিল প্লেনে, সুমন আর মিতার । মিতা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফ্লোরিডা যাচ্ছিল, সুমনও ট্যাম্পা গামী নিউ-ইয়র্ক থেকে । অ্যাটলান্টায় শুভযোগ, ব্যাপারটা কাকতালীয়, সুমন বলেছিল প্রি-অর্ডেইন্ড । অবশ্য লবিতে মিতাকে দেখে বোর্ডিং পাসটা মনোমত ম্যানেজের উদ্যোগটা ওর'ই ছিল । চমত্কার ফ্লাইটটা, সুমন আগেও ঠেঙিয়েছে এই একই আকাশপথ অনেকবার, এত ভাল কখনও লাগেনি । মিতারও । খালি সুমনের ল্যাপটপটা মুষড়ে ছিল ; উড়ানে অদ্যাবধি অনেক খাতির পেয়ে ওটার খাঁই বেড়েছিল । আর মিতার মোবাইল'ও কয়েকবার বাজতে গিয়ে হেঁচকি তুলে হেরে গিয়েছিল ।

    তারপর যা হয় আর কি । ইমেল, চ্যাট, টেলিফোনের গাঢ় সন্নিবেশ । তারপর গ্রাণ্ড ক্যানিয়ন যাওয়া একসাথে, কনে দেখা আলোয়ে সুমিত-সুমিতার প্রসঙ্গ, ইত্যাদি ।

    অসীমা বললেন,
    -- ওমা ! এ কি গো, কোন বেজাত কুজাতের ছেলের সঙ্গে .....,

    -- যদি পারিজাত হয় ?

    বললেন আর্যশেখর । উনি রসিক মানুষ । রিটায়ার করে রস বেড়েছে আরও ।

    -- থামো তুমি ! ওনার আর কি, কাব্যি ঝাড়ছেন ! সব দায় তো আমার । মেয়েকে বিদূষী বানিয়েছেন ...., যত সব বিলেতের কুশিক্ষা, কার না কার সঙ্গে ....। ছি: ছি:, পাঁচকান হলে... ।

    আর্যশেখর খবর রাখছিলেন সবই । পারিজাত সাধে বলেননি । সব শুনে অসীমা বললেন,
    -- বাপ-মার স্ট্যাণ্ডার্ড ? মানে আমাদের সঙ্গে ঠিক ম্যাচ না করলে তো....।

    তারপর শোনা গেল বাপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়েই ছেড়েছেন এই সেদিন ; মা রোটারির হয়ে সোস্যাল ওয়ার্ক করেন; সল্টলেকে এমনি বাড়ি, জোকাতে বাগান; মেজমামার তিনটে পেট্রোল পাম্প; এবং সুমন একই ছেলে ।  অসীমা বললেন,
    -- মেয়ের আমার নজর ভাল ।

    আর বললেন নন্দিনীকে,
    -- সুমন বড় ভাল ছেলে, আজকালকার দিনে এমনটি পাওয়া ! ওদের জোড়টা..... সবই ঠাকুরের দয়া । আমার তো চিন্তায় ঘুমই হত না ।

    নন্দিনী বললেন,
    -- দিদি, তোমার মেয়েও ভারি মিষ্টি ।

    সুপ্রকাশ অবসর নিয়ে একটু লেদিয়ে যাচ্ছিলেন, এসব উপক্রমে চাঙ্গা হয়ে বললেন,
    -- মুখার্জি সাহেব, আসুন একটু বসা যাক ।

    -- চলুন দাদা, এসব কি আর মনের মত লোক না পেলে... ।

    গত বছর চারেকে বার আড়াই ঘুরে গেছে ওরা দেশে ; যেবার শুধু সুমন এসেছিল, মিতা ছুটি পায়নি, সেটাকে আধবার ধরলে । আহ্লাদ, আদিখ্যেতা, তাজ বেঙ্গল, হ্যাণ্ডিক্যাম একটু ম্যাড়মেড়ে হয়ে আসছে যেন এবার । গতবার তো সোদপুরের মামীমা বাত-ফাথ কি সব বলে এলেনই না গেট-টুগেদারে । অবশ্য সুমন-মিতার টান টনটনে বাড়ির প্রতি । মিতা প্রায়ই সল্টলেকে ফোন করে বাপীর খবর আর মামণির নারকোল-সুক্তোর রেসিপি নেয় । সুমনও কোলিগের হাত দিয়ে অসীমার আর্থ্রাইটিসের জন্য ত্রক্রীম পাঠিয়েছিল । ব্যাথা কমানোর । সম্প্রতি সুপ্রকাশের হার্টটা একটু বিষম খেয়েছিল । ব্যস্তবাগিশ মামাতো ভাই খবরটা দেয় সুমনকে । সুমন ইমেলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তার কাছে । বাইপাশের ধারে নতুন হার্ট ইন্স্টিট্যুটে থরো চেক-আপের কথা বলেছে, দরকার হলে যেন ভেলোর-মুম্বইতেও নেওয়া হয় ।

    থ্যাঙ্কস্গিভিং বা মেমোরিয়াল ডে'র সাথে ছুটি জুড়ে জুটি বেঁধে ঝোড়ো গতিতে ব্যাট চলে ওদের; দাম্পত্যের রান রেট কব্জায় থাকে । তবে আস্কিং রেট বলেও একটা ব্যাপার আছে । সেটা গায়ে পড়া বান্ধবী বা বাচাল মাসিটাসিরা মনে করিয়ে দেন, মাঝে মাঝেই । সেদিন তো ফুলপিসীমা বলেই ফেললেন,
    -- তা তো কম দিন হল না বৌদি, বয়সও তো মিতার থেমে নেই, অবশ্য ওরা তো মডার্ন মেয়ে, আমরা তো আর বুঝি না মতি গতি ।

    চলে যেতে বললেন অসীমা,
    -- ঠাকুরঝির তো গা জ্বলবেই, নিজের মেয়েটাকে তো একটা কেরানির গলায় ঝুলিয়ে এক গণ্ডা বাচ্চা নিয়ে এখন চোখের জলে নাকের জলে.... ঐ তো ছিরি মুন্নিটার, মাধ্যমিক পেরোতে ঘেমে গেল, আবার মিতার ব্যাপারে কাঠি দেওয়া ।
    ইত্যাদি ।

    আর্যশেখর বললেন,
    -- বাদ দাও ।

    অসীমা বললেন,
    -- বাদই তো দিয়ে আসছি এতদিন, চিরকালই তো তোমাদের রাবণের গুষ্টির মুখনাড়া খাচ্ছি । আর্যশেখর শেয়ারের দরে ডুব দিলেন, দুর্যোধনের দ্বৈপায়নের মত ।

    মিতার পরের ফোনে এ কথা সে কথার পর অসীমা পাড়লেন,
    -- তোরা এবার কিছু ভাবছিস-টাবছিস নাকি .... ।

    -- সেটা আমরা দেখছি ।

    -- না মানে আমি এমনিই .... ।




    ॥ ৩ ॥

    -- বাট উই মাস্ট ফোকাস পাস্ট দিস্‌ রিসেশন, ওয়েন অপর্ট্যুনিটিস্‌ আর শিওর টু ওপেন আপ এগেইন । স্টিল, দ্য কোয়েশ্চন রিমেন্স .......,
    ইঅ্যাঙ্কি ডুড্ল কাম্স টু টাউন'এর সুরে বেজে উঠল সুমনের মোবাইল । এমনিতে বক্তৃতা থাকলে মোবাইলটা ভাইব্রেশন মোডে দিয়ে রাখে, কিন্তু আজকে মিটিঙে ও'র বলার কথা ছিল না । হঠাত্‌'ই ভিপি বলে বসলেন, ওয়াট ডু ইউ সে চাক ? সুমন চক্রবর্তী এখন অফিস মহলে মুখরোচক চাক, লঘু-গুরু নির্বিশেষে, এ দেশের যা রেওয়াজ । সুমন তৈরিই ছিল, যেমন থাকে সব মিটিঙেই, বা এমনিও । ওর আগের বস্‌ বলতেন দূরদর্শিতাই সব, উই মাস্ট বি অ্যাহেড অফ দ্য গেম ! উনি, মানে আগের বস এখন স্ব-চাকরে ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট, সাম্প্রতিক ঝাড়ের পরেও নেট ওয়ার্থ কয়েক মিলিয়ন ।

    যাইহোক, মন্দার বিহনে কি হতে পারে তার ভাষ্যে একটুও না চলকিয়ে বাঁ হাতে কলটা থামালো সুমন । তারপার মেসেজিং'এ গিয়ে লিখল, বি-এন-সি-এইচ-এ-টি, এবং পাঠাল মিতাকে । অর্থাৎ বিজি নাও, কল হোম আফ্টার টেন । ওদের দাম্পত্যে এমন সাংকেতিক বার্তা বয় মূহুর্মূহু । ইমেল, চ্যাট, এস-এম-এস, মোবাইল ; এখন সংযোগে এমন দ্রুতি যে বয়ানে ভণিতা পোষায় না । কথা হয়, শর্ট শার্প অ্যাণ্ড টু দ্য পয়েন্ট, মিতার প্রেজেন্টেশনের মত ।

    অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেই গান চালিয়ে দেয় সুমন । কলকাতা থেকে গতবারের আনা সিডিগুলোর সবকটার প্যাক ছেঁড়েনি এখনও । যদিও দশটার পর করবে মিতা, ন'টা পঁয়তিরিশেই ঢুকল আজ সুমন । শান্তিদেব প্রাণ ঢেলে গাইছেন, দু:খরাতে নাথ কে ডাকিলে । বহু বাঁকের নদীর মতো সুর চলেছে সাগরের দিকে । সাগ্নিক বলেছিল না একবার, এটা নাকি মৃণালিনীর মৃত্যুর পর লেখা । বেশ আছে সাগ্নিকটা, সোনারপুর স্কুলের অঙ্ক-মাস্টার আর লিট্ল ম্যাগাজিনের কবি ।

    গানের শেষে আলো হওয়ার সাথেই মন ভাল হয়ে গেল সুমনের । তাছাড়া এমনিই আজ মনটা খুশি খুশি ; মিতা এক্ষুনি করবে । এই উইকেণ্ডে আসবেও হয়ত ।

    দশটা একেই করল মিতা ।  ফোন ।

    -- এযাই জানো, প্রজেক্টটা ডেফার্ড হয়েছে ।

    -- তাই নাকি ? কেন ? ক্লায়েন্ট ব্যাক আউট করল ?

    -- ধ্যাত, শোনোই না, নেক্স্ট ইয়ারের সেকেণ্ড কোয়ার্টারে শুরু, প্রথম কয়েকমাস অ্যানালিসিসের লাইট কাজ, মানে সব নিয়ে মাস দশেকের জন্য টেনশন কম ।

    -- তো ?

    -- ন্যাকা, বোঝো না যেন ! উই ক্যান প্ল্যান নাও হানি ! আবার ওসব অ্যাকুইজিসন-ফিসন বললে কিন্তু ডিভোর্স দিয়ে দেব ।

    -- তারপর ? দশ মাসের পর হাও উইল ইউ, মানে, হাও ডু উই ম্যানেজ ?

    -- মা'কে আসতে বলব, মামণিকেও । দে ক্যান কাম উইথ সাম ওভারল্যাপ । বছর দেড়েক পর থেকেই তো ডে-কেয়ার, তদ্দিন ওরা কেউ থাকলেই হয়ে গেল । মাই প্ল্যান ইজ ফুল প্রুফ ।

    -- না, মানে ব্যাপারটা থিঙ্ক থ্রু না করে..... ।

    -- উফ্ফ, তুমি থামবে ? বুড়োদের মত কোরো না তো ....., অফিসে বল, সামনের সোমবার অফ নাও । আমি লাস ভেগাসে বুক করেছি প্লেনের টিকিট । আর কি জানো ?

    -- কি ?

    -- হানিমুন স্যুইট, আমাদের এক ক্লায়েন্টের স্কীমে ।

    -- বা: ভালোতো, কিন্তু... আই হোপ মিতা উই, আই মীন ইউ হ্যাভ ওয়ে'ড দ্য প্রোস অ্যাণ্ড কন্স......।

    -- ও: সুমন ! তুমি কবে বদলাবে ! নিজের বৌকেও জ্ঞান দিচ্ছো, ঐ সব প্রোস অ্যাণ্ড কন্স তোমার ভিপিকে শুনিও ...। সুমিতটা যেন তোমার এইটা না পায় ।

    -- কেন, সুমিতা বললে না ?

    -- তাই তো বললাম, তুমিই তো আ'টা শোনোনি । ছেলের সখ কি আমি বুঝি না, শ্যভিনিস্ট কোথাকার ! অ্যাই জানো, সকালে প্রজেক্টের মেল'টা পেয়ে থেকেই না, আই অ্যাম গ্লোয়িং । তিনটে ফোন করতেই সব ঠিক হয়ে গেল ।

    -- অ্যালেক্স কি বলল ?

    -- ওটা আবার কি বলবে ? ফ্যামিলির কি বোঝে ! দুটো ডিভোর্স হয়ে গেছে, লেটেস্ট গার্ল-ফ্রেণ্ড'ও ল্যাঙ মেরেছে শুনলাম রিসেন্টলি । হী কেম টু মাই টার্মস, ওটা শুরু হলে আই উইল লীড, এখন আই উইল হ্যাভ দ্য বি-টি-এল অ্যাকাউন্ট আণ্ডার মী ।

    -- গ্রেট !

    -- জানো সুমন, ভীষণ মনে হচ্ছে ঐ কবিতাটা সারাদিন, দিদিয়া বলত, সেই কোথায় তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে, ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে না কি, তোমার তো নিশ্চয়ই মনে আছে পুরোটা, কি গো ?

    সেদিন শুতে শুতে রাতই হয়ে গেল । মিতার কলকলানি ছোঁয়াচে, সুমনও গা ভাসাল অজান্তেই । এত অকাজের কথা হয়নি বহুদিন । দারুণ লাগল ।

    বাতি নিবিয়ে সুমনের মনে হল, মিতা কি জানে গানটা, আকাশ আমায় ভরল আলোয়ে ? নন্দিনী গাইতেন পিয়ানোয়, সুমনকে কোলে নিয়ে !




    ॥ ৪ ॥

    সোমবার অফ পেতে বেশ বেগই পেতে হল । সোমবার ব্যাপারটাই একটু ক্রিটিক্যাল থাকে সব সময়, য়ুইকেণ্ডের আমেজটা চুরমার হয়ে যায় সকালের প্রথম ঘন্টাতেই । তাছাড়া একটা জরুরি মিটিঙেরও কথা হচ্ছিল । ব্রেকরুমের মেশিনটার সামনে দাঁড়িয়ে দুজন, সুমন আর ভিপি । কফিপ্রপাতের গোঙানির ওপর কথাটা পাড়ল সুমন । ভিপি কফিতে চুমুক দিলেন । দিয়ে বললেন, আওয়ার সেকেণ্ড লার্জেস্ট ক্লায়েন্ট, মেবি ফার্স্ট নেক্স্ট ইয়ার, ইফ উই ট্রাই । এই উই'টা যে আসলে ইউ, সামান্য দুই স্বরবর্ণের এফোঁড় ওফোঁড় তা বোঝার মত মেধা ও মনন সুমনের ছিল । তাই সুমন বুঝল, এবং বুঝে চুপ করে গেল । তবে ভিপি'ই বললেন তারপর, বাট দ্য কল ইজ নট কনফামর্ড ইয়েট, মানডেজ্‌ । লেট্স ওয়েট টিল ফ্রাইডে, ইফ দে ডু নট কাম ব্যাক দেন, ইউ ক্যান গো অ্যাহেড.. ইউ টু ডিজার্ভ অ্যা ব্রেক চাক ! শেষ কথাটায় সুমনকে গলিয়ে ও দুলিয়ে দিয়ে ভিপি তারপরে গেলেন ন্যাস্ড্যাকের স্বৈরিতার দিকে ।

    মিতা বলল সব শুনে,
    -- ম্যানেজ করতেই হবে, চন্স অফ অ্যা লাইফটাইম ! তুমি একটু দেখো না ।

    সুমন বলল,
    -- দেখছি তো সোনা ।

    তবে মন্দ লাগছিল না ওদের, এই ঝুলন দিনের দোলন । অনিশ্চয়তা যেন মরিচ ছড়াচ্ছিল প্রত্যাশায় । একটা করে দিন কাটে একটু একটু করে; রোজই ফোন একাধিকবার, চ্যাট'ও । নানা ব্যবস্থার অলোচনা, সব যে এক্ষুনির তা নয়, সামনের সময়টা আঁজলায় টেনে আনতে বড় সুখ । কলকাতায় এখনই কিছু জানানোর দরকার নেই, আরেকটু এগোক ; জানানো তো দু সেকেণ্ড ।

    সারা সপ্তাহ মেল'এ মেল'এ জর্জরিত করে ফেলল সুমন ক্লায়েন্টকে । সবই সম্ভাব্য নানা সমস্যার সমাধান; ক্লায়েন্টকে বোঝানো যে তারা প্রিপেয়ার্ড ফর অল পসিব্ল কেস সিনারিওজ্‌ । শেষে লিখল সুমন, উই ক্যান টক ইট ওভার অন মান্ডে । সিসি করল ভিপিকে । সঙ্গে অ্যাটাচ করল একটা বিরাট পিপিটি ফাইল । আর আশা করল এতটা জাবর ক্লায়েন্টের কাটতে সোমবার পেরোবে ।

    শুক্রবার পাঁচটায় ভিপি বললেন,
    -- ইট লুক্স ইয়োর ডে ।

    তারপর চোখ টিপে,
    -- রাদার, ইওর নাইট !

    তখনো উত্তর আসেনি ক্লায়েন্টের, এলে উচিত ছিল ইতিমধ্যেই; অতএব সোমবার নিস্তার ! সাড়ে সাতটায় ফ্লাইট, এখন আবার কড়াকড়ি বেড়েছে, সেই আগের মত হ্যাফপ্যান্ট পরে দু মিনিট আগে চড়ে পড়ার জো নেই ।

    সুমন বলল,
    -- সো আই গেস ।

    ভিপি বললেন,
    -- এনজয় !

    ডাউনটাউনে অফিস থেকে বেরিয়ে এয়ার্পোর্ট আধঘন্টাখানেক লাগে । কার পার্কের পাকদণ্ডিতে গাড়ি ভিড়িয়ে সুমন যখন স্ট্রলি ঠেলে ঢুকল বন্দরে, তখনও হাঁক-ডাক লাগেনি ।

    মিতার ফ্লাইট নটা, ওর সময়ে, ইতিমধ্যে হয়ত ও'ও এয়ারপোর্টে । মোবাইল টিপতেই,
    -- তুমি কোথায় ?

    -- এয়ারর্পোট লাউঞ্জে । তুমি ?

    -- আমিও, বোর্ডিং আর মিনিট কুড়ির মধ্যেই । জানো, ভীষণ এক্সাইটেড লাগছে....., কখন যে পৌঁছব ।

    -- দাঁড়াও আমি একটু ম্যাক থেকে আসছি, ভীষণ খিদে পেয়েছে, এসে করছি তোমায় ফোন ।

    -- ও: আবার লাঞ্চ স্কিপ করেছিল, তোমাকে নিয়ে না আর..., যাও । বোর্ডিং এর আগে জানিও আমায় ।

    ফিলে-ও-ফিস'এ কামড় দিতেই মোবাইলটা আবার বেজে উঠল । কুহুস্বরে । মিতা'র তর সয় না যেন, ঐ যে বাহিরে বাজিল বাঁশি ! তারপর `বল কি করি'টা ভাঁজতে গিয়েই ভুরু কোঁচকালো সুমনের । ইনকামিং নাম্বার জ্বলজ্বলে, ভিপি'র ।

    -- চাক, আর ইউ অন বোর্ড ?

    -- নো, নট ইয়েট স্যাম, এনি প্রব্লেম ?

    নিমেষে গলায় পেশাদারি কনসার্ন । আনল সুমন ।
    -- থ্যাঙ্ক গড, আই ওয়াজ রিয়েল স্কেয়ার্ড ! দোজ্‌ পার্টিঙটন পিপ্ল জাস্ট সেন্ট অ্যা মেল । সেজ ইওর ইন্পুটস আর গ্রেট । ওয়ান্ট অ্যা প্রেজেন্টেশন অন মান্ডে নাইন, ইটি । ইট লুক্স, আই অ্যাম সরি চাক.....। ক্যান ইউ, মেবি....। উই নীড টু ওয়ার্ক দিস আউট টুগেদার, দ্য প্রোপোসাল ।

    -- মিতা, আমি কি করব বল, আই ডিড মাই বেস্ট, দিস মান্ডে ওয়াজ অলওয়েজ টাইট...., এই ক্লায়েন্টকে না ধরতে পারলে স্যাম উড বি ইন অ্যা স্যুপ, সো উইল আই । তুমি চলে যাও আজকে, দেখি আমি কাল সকালে ম্যানেজ করতে পারি কিনা, তারপর সানডে ফ্লাই ব্যাক করব, অন্তত একটা দিন তো....।

    -- ঠিক আছে সুমন, ইট'স জাস্ট আওয়ার লাক । আমার'ও প্রজেক্টটা আবার এগিয়ে এসেছে, কাল বলল অ্যালেক্স । তোমায় বলিনি, ভাবছিলাম আইদার ওয়ে উই উইল গো অ্যাহেড, প্রজেক্টটা না হয়ে সেকেণ্ড ফেজ'এই জয়েন করতাম । এখন আবার বলব অ্যালেক্স'কে, আই অ্যাম ও'কে উইথ দ্য অরিজিন্যাল প্ল্যান, হী উইল বি হ্যাপি । চল, তাহলে এমনিই একটা ছোট ভেকেশন নেওয়া যাক । তুমি তাহলে.....,

    -- থাক মিতা, ছেড়ে দাও ।

    -- কি হল সুমন, তুমিই তো বলছিলে একদিনের জন্য.....,

    -- এখন থাক, পরে হবে আবার, প্ল্যান-ট্যান করে, সন্তর্পণে আপদ বাঁচিয়ে, আমাদের যেমন..., আমরা যেমন যাই জেনের্যালি......,

    -- সন্তর্পণে মানে..., সুমন তুমি, তুমি আমাকে...., একটা অস্ফুট ধ্বনি আসে মিতার দিক থেকে, সেটা কান্নাও হতে পারে, ক্রোধও হতে পারে ।

    -- মিতা, ভিপি ওয়েট করছেন, অফিসে ফিরছি এখন, রাত্রে কথা হবে ।

    ডাইনটাউনের কতগুলো পেল্লায় বাড়ি শ্রীকৃষ্ণের আলোয়ানের মত সূর্যটা ঢেকে দিচ্ছে, সন্ধে হয়ে এসেছে এমনিও বোধহয় । ট্র্যাফিক বেড়েছে, সবাই ঘরমুখো, দাঁড়াতে হচ্ছে বার বার । একটা সিগন্যালে ব্রেক পেডাল মাটিতে মিশিয়ে দাঁড়াল সুমন । গাড়ির চাবির রিঙটার সরল দোলনগতি চোখ টানল । বহুবার দেখেছে রিঙটা, আঙটায় ঝুলছে কালো-সাদায় বোনা ফিতে । ন্যাথানিয়েলের । সেই সেবার কন্কর্ডে থোরোর কুটির দেখতে গিয়েছিল সুমন গেব্লার দম্পতির অতিথি হয়ে, তখন । ন্যাথানিয়েলের চকচকে মুখে খুশির ঝিলিক সর্বদাই, চলে আসার সময় নিজের হাতে বুনে দিয়েছিল চাবির রিঙের ফিতেটা । ন্যাথানিয়েল গেব্লারদের কৃষ্ণপুত্র । অ্যালাবামার একটা আধা-শহরে বেড়াতে গিয়ে, ক্যাথি গেব্লার বলেছিলেন, উই ফাউণ্ড ন্যাথানিয়েল । অ্যাণ্ড হি ওয়াজ ফর কীপ্স !

    হঠাৎ মনে হল সুমনের, এবার ফোর্থ জুলাইয়ের ছুটিটা শুক্রবার না, লঙ-য়ুইকেণ্ড ?

    (পরবাস ৩৮, ডিসেম্বর, ২০০৬)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)