একটু বেলা হলেই শুরু হয়ে গেল পাখিদের মজলিশ । প্রথম আসরে আসবে অনেকগুলো চড়ুই আর ছোট্ট একটা চন্দনা । শুরু হবে পুটুরানির সঙ্গে রুমির সারাদিনের দস্যিপনার গপ্প । পুটুরানি হলো একটা ছোট্ট চড়ুই, যার ঘাড়ের ওপর একটা ছোট্ট সাদা দাগ । তোমরা চিনবে না, রুমি ঠিক চেনে ! পুটুরানি কুটুস কুটুস দানা খাবে, কিচ কিচ করবে আর ঘাড় তুলে তুলে রুমিকে দেখবে । ছোটোদের এই আসর শেষ হলে আসবে একটা মিশকালো কাক । সে তো আর চাল খাবে না, তার জন্য সকালবেলার জলখাবারের থেকে রুটির টুকরো রাখা চাই । রুটি কিম্বা দানায় যদি কম পড়ে, তাহলেই হূলস্থূল কাণ্ড । রুমি নাক ফুলিয়ে বলবে `তোমরা আমার খাওয়ার বেলা জোর করো আর পাখিদের বুঝি খিদে পায় না' !
বেলা হলেই শুরু হয়ে গেল স্নানপর্ব । পাড়ার যত কুচোকাঁচা মিলে পুকুরে এন্তার ঝাঁপাইঝোড়া । আর তার সঙ্গে চলবে খুচরো ঝগড়া । `এই পটলা তুই আমার গায়ে জল ছুঁড়লি কেন রে ?' `বারে ! তুই আমার পায়ের দিকে গেলি কেন ?' খানিকপরে রুমির মা রান্নাঘর থেকে হাঁক দেবেন `রুমি অনেক হলো, এবার উঠে আয় মা' । অতএব স্নানপর্ব সমাপ্ত ।
ঘোর দুপুরবেলা দেখো মায়ের পাশে লক্ষ্মীমেয়ের মতো শুয়ে আছে রুমি । আসলে কিন্তু ওটা ঘুমের ভান ! যেই একটু মা চোখের পাতা বুজল, ব্যস রুমিকে আর পায় কে ! চললো পুকুরঘাটে । সারা দুপুর মাছেদের সঙ্গে গল্প । এক একটা মাছের এক এক নাম । কেউ শালুকপরী কেউ পদ্মপরী । রুমি বলে `এরা তো আসলে সবাই জলপরী কিন্তু মাছের রূপে আসে । তোমরা চিনবে কেমন করে ?' চেনে কেবল রুমি । সকালবেলা জলখাবারের ময়দা থেকে চুরি করা লেই আছে জামার পকেটে । বা: ! মাছেদের বুঝি খিদে পায় না ! যতক্ষণ না রুমি খাবার দেবে ততক্ষণ মাছেদেরও অন্য কোনো খাবারেই মন ভরে না যে !
সকালবেলা ছোট্কার সঙ্গে মাঠে গরু বাঁধতে গিয়ে হঠাৎ করে রুমির আজ মনে হয়েছে ওই যে অনেক দূরে যেখানে আকাশটা মাঠের একেবারে গায়ের কাছে নেমে এসেছে সেখানে পৌঁছতে পারলেই নাকি আকাশটা সে ছুঁতে পারবে । কথাটা ছোট্কাকে বলতেই ছোট্কা একখানা তির্যক হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলো যে রুমির কথাটা নাকি অবাস্তব । তখন রুমি সোজা হাজির হলো তার দাদুর কাছে । দাদুর ঘরে গিয়ে ঘুরঘুর করে কিন্তু কিছু বলে না । দাদু জিজ্ঞেস করলেন, `আমার ঘটিবুড়ি যে বড়ো চুপচাপ, হলো কি ?' অনেক সাধ্যসাধনা করে জানা গেলো ঘটিবুড়ি ওরফে রুমি আকাশ ছুঁতে চায় । বোঝো কাণ্ড ! দাদুর তো মাথায় হাত । মেয়ের কথা শুনে মায়ের চোখ ছলছল করে ওঠে । ঠাকুমা কপালে করাঘাত করে বলেন, `এ মেয়ের কপালে দু:খু আছে নির্ঘাত্' । দাদু রুমির হাত ধরে বললেন, `চলো ঘটিবুড়ি আমরা মাঠে যাই, দেখি কোথায় আকাশ ছোঁয়া যায় ।'
দাদুর কথা শোনা মাত্রই রুমি তাঁর গলা জড়িয়ে ধরল । তারপর দাদুর কড়েআঙুল ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলল মাঠের দিকে । ধানকাটা শেষ । রক্ষেকালিতলাটা পেরিয়েই আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠ চোখের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল । রুমি দূরের দিকে আঙুল তুলে দেখালো যেখানে আকাশ এসে মাটিকে ছুঁয়েছে । পরমুহূর্তে দাদুর আঙুল ছেড়ে আলপথ ধরে রুমি দৌড়তে শুরু করল আকাশ ছোঁবে বলে । দাদু অবাক হয়ে দেখলেন একটি সবুজ পরী হাওয়ার মধ্যে দুলতে দুলতে রুমির পাশে পাশে চলেছে । হাইস্কুলের হেডমাস্টার মুখুজ্জে মশাই পরী দেখে লজ্জা পেলেন, চোখ রগড়ে আবার দেখলেন । এবার যা দেখলেন তাতে তিনি আঁত্কে উঠলেন । আদরের ঘটিবুড়ি একা একা অনেক দূরে গিয়ে পড়েছে, এখনো ছুটছে আকাশ ছোঁবে বলে ।
মাঠের পাশেই কানাইচাষির বাড়ি । তিনি তাড়াতাড়ি গিয়ে হাজির হলেন সেখানে । কত্তামশাইকে দেখেই কানাই একটা শীতলপাটি পাততে যায় । কিন্তু মুখুজ্জেমশাই তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে মাঠের মধ্যে নিয়ে এসে আঙুল তুলে দেখান যেদিকে রুমি ছুটছে । বললেন, `শিগগির যা রুমিকে ফিরিয়ে নিয়ে আয় ।' শুনেই কানাই সেদিকে ছুটতে শুরু করল । খানিক ছুটেও কিন্তু সে সামনে কিছু দেখতে পেলে না । তবু ছুটতে থাকল রোদ্দুর মাথায় করে । শেষে দেখল খানিকদূরে আলের পাশে মাঠের মধ্যে কী যেন পড়ে আছে । তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে দেখল খুকি পড়ে আছে অচৈতন্য হয়ে । মাথার ওপর গনগনে রোদ, গলদঘর্ম কানাই এক মুহুর্ত দেরি না করে তাকে কোলে নিয়ে আবার উল্টোদিকে ছুটতে শুরু করল । খানিকটা আসার পর সে আর কত্তামশাই-এর দিকে না গিয়ে নিজের বাড়ির দিকেই ছুটতে লাগল । তাকে ওদিকে যেতে দেখে রুমির দাদুও ওদিকেই চললেন । বাড়ি পৌঁছে খুকিকে দাওয়ায় শুইয়ে দিয়ে কানাই ওর চোখেমুখে জলের ঝাপটা দেয় । ঠোঁট ফাঁক করে একটু জল ঢালে মুখের মধ্যে । খানিক পরে লাল চোখ মেলে তাকায় রুমি । কিছু বুঝতে পারে না । সবাই তাকে ঘিরে আছে দেখে সে জিজ্ঞেস করে, `আমি কোথায়, আমার কি হয়েছে ?' দাদু বলেন, `তুমি অচিনপুরে গিয়েছিলে, এবার বাড়ি যাবো' । তারপর রুমিকে কোলে নিয়ে দাদু উঠে দাঁড়ালেন । কানাই কত্তামশাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে বলল, `কত্তা দোষ লিবেন নাই, আজ খুকিকে আমার ঘরের জল খাওয়াইছি । ক্ষমাঘেন্না করি দিবেন ।' মুখুজ্জেমশাই কানাইর মাথায় হাত দিয়ে অস্ফুটে কি বললেন বোঝা গেল না । তিনি রুমিকে কোলে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন । ক্লান্ত রুমি দাদুর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল । মুখুজ্জে মশাই ঝাপসা চোখে পথ চলতে চলতে ভাবতে লাগলেন আজ যদি ওই অচ্ছুৎ কানাইটা না থাকত তবে হয়ত ঘটিবুড়িকে অচিনপুরেই রেখে আসতে হতো বরাবরের জন্য ।
(পরবাস ৩৮, ডিসেম্বর, ২০০৬)