এই শিল্পটার আসল ব্যাপারটা খুব সোজা । একটা ক্যাজুয়াল ক্যাজুয়াল ভাব সারাক্ষণ রেখে যাওয়া আর জীবনের ছুঁড়ে দেওয়া ঘটনাগুলোকে ডজ করে করে, কাটিয়ে কাটিয়ে যাওয়া । সম্পূর্ণ কমিটমেন্টহীন, না কোন মহান হারজিতের ভিতরে তুমি নেই, চাঁদু । ভুলেও ভেব না যে আছো ।
যেমন এক্ষুনি একটা মিটিং-এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল যে ইনার ছেলে বমি করেছে । প্রথমেই তার যেটা বিদ্যুতের স্পিডে মনে এল, সেটা হচ্ছে, এই মিটিংটা বেশি জরুরি, রিকের বমির থেকে । না: কিছুতেই ঢিলে হয়ে যেতে দেওয়া যাবে না ঘটনার রশি, এই ডিসকাশনটা প্রায় তার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, আর একটুক্ষনের মধ্যেই ডিল পাকা, ইউনিয়ন রফা করতে রাজি হয়েছে । এখন তার মুখে বিন্দুমাত্র বেদনা ফুটলেই গুবলেট । অলরেডি রতন সরকারের চোখের কোণে একটা আশার আলো আর সূক্ষ্ম হাসি ধিক ধিক করছে, যতক্ষণ সে ফোনটা নিচ্ছিল ততক্ষণ ওরা কান খাড়া করে শুনছে সব কথা । ব্যাস একবার ম্যাডামকে পেড়ে ফেলতে পারলে তো পোয়াবারো, কারণ পারিবারিক জগত এমন এক ভয়াল জায়গা যে হেন ম্যাডাম নেই যে পারটার্বড হয় না । এই নিয়ে কম ম্যাডাম ঠ্যাঙাল নাকি রতন সরকার ?
ইনা খুব কুল আর ক্যাজুয়ালি বলেছে প্রবীরকে, ওকে সেভেন পয়েনট ফাইভ মিলিলিটার অনডেম দিয়ে দাও । একেবারেই হৃদয়হীন পাষণ্ড মা হয়ে যেতে পেরেছে সে । কারণ এতবার রিক অসুস্থ হয়, বমি করে, এতবার এই নিয়ে এমার্জেন্সী ডিক্লেয়ার হয়েছে তাদের বাড়িতে, রিককে নিয়ে যে ওটা আর এমার্জেন্সী নেই । ডালভাত হয়ে গেছে । সবকিছু মুখস্ত এখন । হয় অনডেমে কাজ হবে নয় হবে না । না-হলে হয় জ্বর আসবে নয় আসবে না । জ্বর এলে জ্বর হয় বাড়বে নয় বাড়বে না । বাড়লে রাতে ডাক্তারকে ফোন করবে, করবেই ইনা । কিন্তু ডাক্তার কী বলবে জানে ইনা, কি ওষুধ দেবে তাও জানে । ইন ফ্যাক্ট একটা নতুন আস্ত ওষুধের ফাইল তার ফ্রিজে সবসময় মজুদ থাকে যাতে অত রাতে কাউকে ওষুধের দোকানে না ছুটতে হয় । সেই তো অ্যান্টিবায়োটিক, আজকালকার যেকোন মা এই নামটা জানে । এই সবকিছুর পরেও প্রবীরের গলায় একটা চিন্তিত ভাব, দেখে হাসি পেয়ে যায় । এবং মনে শুধু একটা বিপদের কথাই আসে ইনার । অফিসের পরে স্ট্রেট বাড়ি ফিরতে বলবে নাকি প্রবীর আবার ? যেটা নাকি কোনো দরকারই নেই । ওষুধগুলো ঠিক ঠিক অ্যাডমিনিস্টার করে গেলেই তো হয় । সেজন্য রিকের ঠাকুমা এবং কাজের লোক মাধবী তো আছেই । ইনার কোনো প্রয়োজন নেই । আজ বিকেলে একটা কাজ আছে, সেটা কোন সুখের কাজ নয়, কিন্তু জরুরি কাজ । ইনার গানের প্রোগ্রামের মহড়া । সেটা না ভ্যাস্তালেই হল ।
বিপদটাকে সাময়িকভাবে অনডেম দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে পেরে গেলে, আর যদি এযাত্রায় জ্বরটর না আসে তবে বিকেলটা বেঁচে গেল ইনার । বাকিটুকু ম্যানেজ দেওয়া শুধু । ফোনটা রেখে রতন সরকারের চোখের দিকে তাকিয়ে বাছা একটা অস্ত্র ছুঁড়ে দিল ইনা, কারণ সে জানে, এই মুহূর্তটাই ভীষণ ইম্পর্টেন্ট । এই মুহূর্তটাকে একটুও ঝুলতে দেওয়া যায় না । বাড়ির কথা ওরা এখন তুলে ফেলতে চাইবে, সরল কাঁচুমাচু মুখ করে বলবে - বাড়িতে কিছু হয়েছে নাকি ম্যাডাম ? ওই ফাঁকটুকু ওদের না দিয়ে, ঝটিতি ইনা পুরনো, ফোন তোলার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে, বলে দেয়, তাহলে দুজন ক্যাজুয়ালকে আমরা কোনো অ্যাসুওরেন্স দিচ্ছি না, বিকজ দে আর গেটিং ওয়েস্ট বেঙ্গল রেট, তাই তো ?
মিটিং ভালোয় ভালোয় শেষ হলে সে পর পর কয়েকটা ফোন করতে থাকে । কারণ বাইরে না দেখালেও তার চিন্তা হচ্ছে ভেতরে ভেতরে । নাকি, কেবল রিকের জন্য চিন্তা নয় । নিজের অসুবিধেটাকে ভুলে থাকতে এই রুটিনের মত ফোন করে যাওয়া । রিকের ডাক্তারকে ইনফর্ম করে রাখা । বাড়িতে ফোন করে আবার খবর নেওয়া রিকের আবার বমি হয়েছে কিনা । হয়নি, কিন্তু প্রবীরের কাজ বাধা পড়েছে বলে যে মেজাজ খারাপটা সেটাকে এখন সে অন্যভাবে চালাচ্ছে । গতকাল কী খেয়েছিল সন্ধেবেলা ? বাইরের খাবার কিছু খেয়েছিল না ? এগুলো তো দেখতে হবে ।
গলাটা চেনা । কেউ কাউকে একটু পেড়ে ফেলতে পারলেই আজকাল এই গলাটা ব্যবহার করে । এই টোনটা । রতন সরকারও করে । প্রবীরও করে । ইনার চেনাজানা সবাই করে । এমনকি ইনা নিজেও । ইনা এটার নাম দিয়েছে `অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া গলা ।' কাজের মহিলারা এই গলাটা প্রয়োগ করে সকালে শুনিয়ে দেয়, বাসন মাজার সাবান শেষ । শাশুড়ি এই গলাটা ব্যবহার করে জানান, রিকের জুতোটা ছোট হয়ে গেছে । কলিগরা পরস্পরকে প্রতিটি উইকেণ্ড শেষে উপদেশ দেয়, আইনক্সে নতুন রিলিজ হওয়া ছবিটা দেখে আসতে, ঠিক এইরকম একটা গলায় । ইনা জানে, এই গলাটা উল্টোদিকের লোকটিকে রিসিভিং এণ্ডে রাখতে চায় । খেলাটা হল, এই গলাটা শুনলেই রিসিভিং এণ্ড থেকে ফস্কে সরে যাওয়া । সে যে উপায়েই হোক । যেমন এখন । ইনা বলল, ইয়েস । এবার থেকে মাকে বলবে ওকে যেন গাদাগাদা ম্যাগি না করে দেয় । আর সেদিন কুড়কুড়ে কিনে দিয়েছিল ছোড়দি ...
প্রবীরকে প্রবীরের দিকের লোকেদের নামে কিছু একটা লাগিয়ে দিলেই ও ঠাণ্ডা । কারণ ওর মুরোদ নেই ওদের সঙ্গে লাগার । লাগবেই বা কি করে ? বউটা চাকুরে হওয়ায় মা, বোন, এদের উপরে ওকে নির্ভরশীল থাকতে হয় না, রিকের ব্যাপারে ? প্রবীরের অফিস বাড়িতেই, আর সে অফিসে নিয়মিত চা, খাবার এবং অন্যান্য জিনিস সাপ্লাই করতে হয় তো ওদেরকেই ।
এই খেলাটার নিয়ম হল, অফেন্স ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স । অন্য কেউ তোমার মুখ ম্লান করে দিতে চাইলেই তুমিও তার মুখ ম্লান করে দেবার মত একটা কিছু বলবে । বিষে বিষক্ষয় ।
এই মুহূর্তে বাইরে একটা গুম গুম আওয়াজ পাচ্ছে, যেটা সম্ভবত মেঘের ডাক । কিন্তু ভেনিশিয়ান ব্লাইণ্ড সরিয়ে আকাশকে দেখার আগেই ঘরে ঢুকে পড়েছে একটা অদ্ভুত লোক । ডেফিনিটলি কিছু চাইতে এসেছে, এক কলিগের রেফারেন্স নিয়ে এসেছে । কিন্তু আসার আগে ইনা জানত না কি জন্য আগমন, ইন ফ্যাক্ট এখনো জানে না । লোকটা কথা বলে যাচ্ছে । ভীষণ ভালো ভালো কথা । যা দিয়ে চিড়ে ভিজে যায় । তার বাবার কথা, মায়ের কথা । তার কলেজের কথা, তার মামাবাড়ির কথা । লোকটা সমস্ত খবর সংগ্রহ করে এসেছে দেখা যাচ্ছে ।
কিন্তু আসলে তো কিছু চাইতে এসেছে । কি চাইতে এসেছে লোকটা, একজ্যাক্টলি ? ইনা আবার খেলতে শুরু করে । গেসিং গেম । লোকটা কি ধরনের সাহায্য চাইবে ? ওকে দিয়ে কোনো সার্টিফিকেট লিখিয়ে নেবার মতলব নাকি ? পাসপোর্ট করাবে ? না ওর সংস্থার বিজ্ঞাপন চাইবে ? অথবা নিছক অর্থসাহায্যও চাইতে পারে । অথবা কিছু বিক্রি করতে চায় । গত কয়েকদিনে অন্তত তিনজন লোক বাড়িতে এসেছে, শনি বা রবিবারে । একজন বলেছে, কিছু বিক্রি করতে আসিনি কিন্তু । বলে, অভয় দিয়ে, কতগুলো ধুনোর প্যাকেট (আজকাল ধূপের প্যাকেট বলে কেউ অপদস্থ হয় না, যদি গন্ধ নেই বলে তাড়িয়ে দেয় কেউ ? ধুনোতে তো গন্ধের ঝামেলা নেই) বার করে `সাহায্য করুন, তিরিশ টাকায় একটা চশমা হয়ে যাবে প্রতিবন্ধীর । আমি নিজেও প্রতিবন্ধী ।' বলে জিনিসটা গছিয়ে গেছে । আর একজন এসে বলেছে `সাহায্য চাইতে আসিনি কিন্তু, টাকা চাইতে আসিনি ।' বলে আবার অভয় দিয়ে ঝুলি থেকে বেড়াল বের করেছে; হাসপাতালে যাচ্ছি, অপারেশন, পরার কাপড় নেই, যদি একটা পুরনো কাপড় বলে আবার নিজের দু:খময় আত্মজীবনী শুরু করতেই জাস্ট সেটাকে থামানোর জন্য খুব পুরনো নয় এমন একটা শাড়ি বার করে দিয়ে দিয়েছে তাকে, ইনা । তখনি সে ভোল পাল্টে ওই, তদেব গলায় বলতে লেগেছে : `ছি ছি বউদি, এত ভালো শাড়ি দিয়ে দিতে নেই ।' জ্ঞান শুনে ইনা বলেছে : `তোমার সঙ্গে কথা বলার আমার কোন সময় নেই, এবার কেটে পড়ো ।' না, কোনো দয়ামায়া নেই, দয়ামায়া বলে কিচু হয় না । বেজায় বিরক্তি থেকে ভিখিরিদের পয়সা দেয় আজকার সবাই, কারণ ওই দৃশ্যদূষণটা চোখের সামনে থেকে হটানোর জন্য এক মুহূর্তও আর অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই কারুর ।
এই দূষণটার এখন কি করা যায় ? লোকটা বকে চলেছে তো বকেই চলেছে । `আপনার দাদু তো প্রাত:স্মরণীয় ব্যক্তি । আহা, ওনার কথা আমি আমার ১০১ জীবনী বইটিতে লিখেছি । বইটা একদিন এসে দেখিয়ে যাব আপনাকে ।'
কি চায় এই লোক ? ইনা চা অফার করে ওকে, কারণ লোকটির পরণে পরিষ্কার ধুতি পাঞ্জাবি, এবং মাথায় একটি পরিষ্কার টাক । মুখে একটু লিভার স্পটস আছে, কিন্তু অভদ্র তো আর হওয়া যায় না । `আমার নাম প্রিয়ব্রত ঘটক' । লোকটার নাম প্রেমাংকুর আতর্থী বললেও আশ্চর্য হত না ইনা । এরকম ফর্সাপানা মুখচ্ছবি আর কাঁচাপাকা চুলের লোকেরা ভীষণ ডেকেডেন্ট হয়, ইনা অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে ।
`আপনার নামটা আমার ভারি চেনা লাগছিল, তারপরেই বুঝলাম এ তো সেই বিখ্যাত গায়িকা ইনা চক্রবর্তী, ইশ, ভাবা যায় না, এতো বাচ্চা মেয়ে ! (সেই পুরনো ট্যাকটিকস, শুনলেই একটা থাবড়া মারতে ইচ্ছে করে) আপনার নতুন ক্যাসেট কিছু বেরলো ?'
`না না, আমি তেমন কিছু গাইয়ে নই'।
`আপনার মা-ও তো বিরাট গাইয়ে । কি, অবাক হচ্ছেন না ? আমি সব জানি (কাকু, কি করে আপনি জানবেন যে ইনা এখন কিছুতেই আর অবাক হয় না ?) এককালে স্বপন শাসমলদের বাড়ির ছাতে, বালিগঞ্জে, কত ইভনিং গান শুনেছি । সিক্সটি টু সিক্সটি-থ্রীর কথা হবে, তকন বোধহয় আপনার জন্ম হয়নি । জানেন তো, আপনার মায়ের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ রাখি । সব খবর পাই । তবে আপনার মায়ের গলাটা রিসেন্টলি একটু খারাপ হয়ে গেছে ...'
`কই না তো । আমার মায়ের তো কালই একটা গানের অনুষ্ঠান হয়ে গেল । গলা তো বেশ ভালোই আছে ।'
`কত যেন বয়েস হল ওনার ?'
সেকি, নিজের বান্ধবীরও বয়স মনে রাখেননি ? এই লোকটি তো দেখছি একজিবিট নাম্বার ওয়ান । আর না বকে এবার পথে এসো বাপু । কত খসাবে আমার ?
ধীরে ধীরে এবার বইটা বার করছেন ভদ্রলোক । এই বইটা এবারের বইমেলায় বেরিয়েছে । একটি আপনি রাখবেন, আমি আশাই করতে পারি । কি, পারি তো ? হাসি-হাসি মুখে লোকটি চেয়ে আছে ইনার দিকে । ইনা এখন কি করবে ? সেই অ্যামওয়ে বিক্রেতা পাড়াতুতো পিশের মত, লোলুপ ও করুণ মুখে, টুথপেস্টের বদলে বই বাগিয়ে ধরে আছে । এটা ট্রাশ বই, হাতে নেবার আগেই বুঝতে পেরে গেছে ইনা । হাতে তবু নিতেই হল, এবং শেষ অবধি কিনতেও হল । লোকটা আর একটা বিয়েবাড়িতে দেওয়ার মত ট্রাশ বাড়িতে জমা করাল । তবু টুথপেস্টটা দাঁতে মাখা যায় । এটা তো গুড ফর নাথিং । এবার বিদেয় হও বাপু । মনে মনে বলল । আবিশ্যি পয়সা পাবার পর আর এক মুহূর্তও দেরি করেনি উঠতে । স্বঘোষিত মামা । হুঁ: ।
এবার ইনা তাকিয়ে দেখল । পর্দা ফাঁক হতেই ঘরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে এল অন্ধকার । আলোর মত অন্ধকারও যে এইভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, ভাবা যায় না । একটা স্লেট রঙের আকাশ, দেখলে মনে হয় কোনো ভালোবাসার লোক । এই যেন এখুনি ঘামস্নাত, উঠল প্রেমের পর পর । অবিশ্যি সত্যি করে এরকম ভালোবাসার লোক পাওয়া যায় না, কারণ ওই কাল্পনিক জিনিসগুলো মেলে না বলেই এত দু:খু দু:খু ভাব, এত কবিতা ফবিতা । এগুলোতে দু:খু করে কোনো লাভ আছে ? বরঞ্চ ফ্যান্টাসিকে ফ্যান্টাসির জায়গাতেই থাকতে দেওয়া যাক । সেখানে যেনে উঁকি না মারে কোনো আসল প্রেমিকের মুখ । তাহলেই থট প্রসেস ভেস্তে যাবে ।
প্রবীরকে ভালোবেসে একটা ঢোলক কিনে দিয়েছিল ইনা, কারণ প্রবীরের তাল জ্ঞান খুব ভালো, একদা তবলা বাজাত, এসব জানা ছিল ওর । অন্যদিকে, নিজের চিরদিন ভালো লাগত লোকসংগীত, ক্ল্যাসিকালের পরেই । একবার, তখন স্টুডেন্ট, ওরা একটা দল করে অনেকগুলো লোকসংগীত গেয়েছিল । রিহার্সালের দিনগুলো আসল ফাংসনের থেকে বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে । সেই মায়াময়, ক্ষ্যাপাটে, উত্তেজিত দিনগুলো । পাঁচ ছটা ছেলেমেয়ে কয়েকটা লোকগানের সঙ্গে কেমন কয়েকদিনের জন্য জড়িয়ে গেছিল । `পদ্মা নদীর ইছলা মাআআআছ চেঙা দিয়া সে ধরে, হায় হায় চেঙা দিয়া সে ধরে .... তার গুটেক মা চিংড়ি ত্যালে নুনে আন্ধে গ ....'।
এগুলো স্বত:সিদ্ধ, এই ভালো লাগাগুলোও বেসিকালি নষ্ট হবার জন্যই আসে । যেদিন প্রথম ঢোলকটা আমদানি হল, আনল একটা অচেনা ছেলে, কি যেন নাম, সেটাও আর মনে নেই, ওদের গানগুলো তখন অলরেডি তবলার সঙ্গে প্র্যাকটিস হচ্ছে, বেশ ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছে, সেই ছেলেটা এসে ঢোলকে কয়েকটা চাঁটা দিতেই ভোল পাল্টে গেল গানগুলোর । ওরা প্রত্যেকে একভাবে চেগে গেছিল, হৈ হৈ করে উঠেছিল সবাই মিলে । লোক গানের সঙ্গে ঢোলক ফোলক জাস্ট টু মাচ ভালো যায়, ভাবা যায় না । সেই থেকে ওর ঢোল বাজানোর ব্যাপারে দুর্বলতা । পরে অবিশ্যি জানা গেল সে ছেলেটা অনেকটা চাঁদার ফাণ্ড মেরে দিয়ে ভেগে গেছে কিন্তু ঢোলকটা কি ভালো বাজিয়েছিল !
ওইখানেই মুশকিল, কারণ দুর্বলতা ব্যাপারটাই এই কারেন্ট শিল্পকলাটায় নেই । জাস্ট হয় না । কি করে হবে ? তোমার দুর্বলতা তোমার পার্সোনাল ম্যাটার । তার ভেতরে তুমি অন্যদের ইনক্লুড করো কোন সাহসে ? অন্যদের কাছে কোনকিছু এক্সপেক্ট করলেই তো তোমার আউটার শেল চটকে ফর্দাফাঁই হয়ে যাবে । সব ব্যাপারে ক্যাজুয়াল ক্যাজুয়াল ভাবটা আর থাকবে না । কেউ তোমার সাবজেক্টিভ ইচ্ছা অনিচ্ছায় নাচবে না, ইনা, বরং প্রত্যেকে চাইবে পরস্পরকে কনট্রোল করতে । এবার কে কত দ্রুত এই অপরের কনট্রোলের বলয় থেকে ছিটকে যেতে পারে সেটাই খেলাটার আসল পরীক্ষা ।
ফলে, প্রবীর কোনদিন ওই ঢোলকটা ছুঁয়েও দেখেনি । ইনার কোনো গানের সঙ্গে কখনো তবলাও বাজায়নি । ইন ফ্যাক্ট তারপর থেকে ওর গানের জগতে আর কোন ইন্টারেস্ট নেই । কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, ওটা আমার গিন্নির ডিপার্টমেন্ট । এটা বেসিকালি ওর সঙ্গে রিলেট না করার এক পুরুষ-ইগো । ল প্র্যাকটিস ছাড়া আর কোন কাজে ওর এখন মন নেই । ঢোলকটা বড় দেওয়াল আলমারির উপরের তাকে তোলা আছে ।
তাতে ইনার কিছু এসে যায় না । কারণ কিছু না এসে যাওয়াটাই মোর সফিস্টিকেটেড আর স্মার্ট । ইনার গান সম্বন্ধে প্রবীরের কোন ভিউপয়েন্ট নেই । যেমন নেই চাকরিটা সম্বন্ধে । ইনার প্রবীরের কাজের ব্যাপারে কোনো তাপ উত্তাপ নেই, কারণ ও জানে, কোনো কেসের ব্যাপারে প্রবীরের মুখ খেলানো বেজায় কঠিন, আর এগুলো সলিলকির মত নিজে প্রবীর যখন বলতে চায়, তখন ওকে বলতে দেওয়াই ভালো ।
দিদা কোনদিন মায়ের মত অত আত্মকেন্দ্রিক ছিল না । মে বি শি কুড নট অ্যাফোর্ড টু বি লাইক দ্যাট । ছটা ছেলে মেয়ে । ভাবতেই পারে না ইনা । যে দিদা তার এত কাছের, নিজের সম্পত্তির মত একটা ব্যাপার, তারো তো ইনার শরীরের মতই একটা শরীর ছিল । জাস্ট লাইক দ্যাট সেই শরীরের মধ্যে দিয়ে সাতবার (একটা বাচ্চা স্টিলবর্ন) রিক জন্মানোর ওই পুরো প্রসেসটা ঘটে গেছে । আনিম্যাজিনেবল । প্রতিটা প্রেগনেন্সি দিদাকে আরো আরো সহনশীল, সবার জন্য আরো আরো চিন্তাময়ী করে গেছে । তার মধ্যেই, প্রেগনেন্ট অবস্থায়, দিদা সমানে বাড়ির কাজকর্ম করেছে । রান্না করেছে, কাপড় কেচেছে, বাসন মেজেছে । দাদুর রোজগার আর কি ছিল, অধ্যাপকদের তখন কি আর রোজগার হত । নিজের শাড়ি কেটে মেয়ের জন্য ফ্রক আর জানালার পর্দা বানাতো দিদা এত কাজের পরেও হাত মেশিনে । বড়ি দিত । আমসত্ব বানাত রেগুলার । কেনা আমসত্বের সঙ্গে ওই আমসত্বের কোনো তুলনাই হয় না । প্রতিটি আমসত্বে লেগে থাকত তেলমাখানো বেতের কুলো বা টুকরির ছাপ । ডিজাইন হয়ে যেত । একটা কাজের লোক ছিল ঠিকই । গ্রাম থেকে আসা একটা শোষণযোগ্য কেউ । দিদা নিজেও খাটত, তাকে খাটাত । অথচ তাদের কোনো অ্যালিয়েনেশন ছিল না । অত খাটলেও, তাদেরকে কখনো মনে হয়নি শোষিত দুটি জন্তু । এখন মনে হয়, কারণ শ্রমের সাথে শ্রম-মাধ্যমের সাথে ইনারই সম্পর্ক পাল্টে গেছে । এখন ভাবলে দিদাকে ও সেই তরুদাকে মনে হয় খাটিয়ে পিটিয়ে দুটি নীরব পশুর মত । শনিবার নেই রবিবার নেই সকাল নেই বিকেল নেই খেটে চলেছে । সবাইকে আনন্দ আর সুখ জোগাচ্ছে । অথচ ইনা খুব হাড়ে হাড়ে কোথায় যেন টের পায়, এই মুহূর্তেই পাচ্ছে, দিদা তার থেকে কত বেশি করে মানুষ ছিল । কারণ দিদার মনটা, মনটাকেই মনে পড়ে শুধু । ভাবলেই মনটার স্নিগ্ধ, নরম আঁচ মনে পড়ে । দিদার বলা গল্প । দিদার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া । পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া । শুড়শুড়ি দিয়ে ঘুম পাড়ানো । মা গানের জন্য রেওয়াজে বসত, দিদা হালুয়া আর রুটি দিয়ে রাত্তিরের খাওয়া খাইয়ে দিত । মা বকত, দিদা আদর দিত । মা পড়াতে বসে ধৈর্য হারিয়ে চাঁটাত, দিদা গল্পচ্ছলে কত ছড়া শিখিয়ে দিতে পারত, কত গান কাঁপা কাঁপা গলায় ওকে তুলিয়ে দিত । দিদাদের ছোট বেলায় রবি ঠাকুরের নতুন নতুন গান লেখা হচ্ছিল, ঢাকায় বসে কলের গানে সেগুলো শুনত দিদা । যা শুনত সব মুখস্ত হয়ে যেত । শুধু শরীর, শুধু জন্তুর মত খাটনি খাটা একটা শরীর, শুধু সন্তানের জন্ম দিতে দিতে ক্লান্ত আর লালন পালনে ব্যস্ত একটা মেয়েশরীর কখনো এইসব পারে নাকি ? সাদা কাগজের মত পরিষ্কার, খোলা, উন্মুখ আর ইচ্ছুক একটা মন না থাকলে ? দিদুর চিন্তার জগত এত ভিড়ে ভিড় ছিল না । অনেকটা জায়গা ছিল ওই মনে । দিদু গ্রহিষ্ণু ছিল প্রায় দশগুণ ।
আর মা ছিল অধৈর্য । ক্লান্ত । মায়ের বিবাহিত জীবন ভালো ছিল না । অসুখী ছিল মা । সেইজন্য সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ত ইনার উপর । ভাই প্রথমটা ইনার পরে অনেক গ্যাপে জন্মানো ছেলে বলে অতিরিক্ত আহ্লাদে বাঁদর হয়ে গেছিল, তারপর ঠ্যাঙানি শুরু হল । বাবা সারাদিন নিজের কাজে বাইরে ঘুরত, রাত্তিরে বাড়ি ফিরে হয় মায়ের উপর গজরাতো, চোখ গরম করত, নয় বাচ্চাদের পেটাত । তবে বাবা মদটদ খেত না । এমনিই, কাজের চাপে, সংসার চালানোর মত পয়সা রোজগার করতে না পেরে, হাইপার টেনশনে, সবসময় তিরিক্ষি হয়ে থাকত । তারপর মা আবার নিজেকে শিল্পী ভাবে । শুধু গৃহবধূ নয় । ভাবে তার আলাদা ট্রিটমেন্ট প্রাপ্য । বাড়িতে, স্বামীর কাছে, কোন শিল্পী মহিলাই বা আতুপুতু পায় ? মায়ের রান্না ভালো ছিল না । রোজ বাবা খাওয়া নিয়ে খোঁচাত । দিনের শেষে বিরস মুখে নুনকাটা তরকারি আর গোল করে না-বেলা রুটি খেতে বাবার ঘেন্না হত, তখন সব রাগ গিয়ে পড়ত মায়ের গানের উপরে । মায়ের গান শুনে অন্যেরা আহা উহু করত । বাবা রেগে যেত । সবাইকে সন্দেহ করত । এমনকি মায়ের তবলচি বিনুকাকুকেও । ইনাকে এখন আর রান্না করতে হয় না । রান্নার লোক ছাড়া একদিনও চলে না । মায়ের তো গ্যাসও ছিল না । মা স্টোভে রান্না করত । গুণগুণ গান গাইতে গাইতে । মা কি অসুবিধে করে ওই টালিগঞ্জের খাপরার ঘরে থাকত । খাওয়া নিয়ে কোনদিন গাঁইগুঁই করার সাহস ছিল না ইনার । বাবা আর ভাইকে মা কিছু বলত না । পুরুষ তো । তেতোমুখ করে সব মেনে নিত । কিন্তু ইনা এমনকি মুখ বেজার করলেও চড়িয়ে গাল ফাটিয়ে দিত । একটা বয়সের পর থেকে মেয়েরাও নিজেদের অজান্তেই মায়ের এইসব নিন্দার অংশভাক হয়ে যায় । তখন ইনার কাজ ছিল মাকে প্রোটেক্ট করা । কোনোদিন রান্না ভালো হলে সাতকাহন করে রান্নার প্রশংসা করত । বাবার সঙ্গে ঝগড়া করত । এমনকি, বছর চোদ্দ বয়সে, মায়ের শরীর একটু খারাপের সময়, নিজে ভাতে-ভাত করে সবাইকে খেতে দিয়েছে যখন, ভাই `ভাজা নেই কেন, ভাজা করিসনি ?' বলায়, মা যা কোনদিন পারেনি, সেটি করেছে ইনা । ঝর্ণা ঘিয়ের শিশি এগিয়ে দিয়ে বলেছে, যা জুটছে খাও, না ভালো লাগলে উঠে যাও ।
প্রবীর প্রায়ই বলে ইনা নাকি সজারু বা ক্যাকটাসের বংশধর । সেটা এতদিন একটা নিন্দা ছিল । ইনা জানে, এযুগে এটা কমপ্লিমেন্ট । মায়ের সাজগোজ করতে চাওয়া দেখেছে ইনা, সংসারের সমাজের ভয়ে করতে পারেনি । লোকে কি বলবে ? একে তো গায়িকা হয়েই জড়োসড়ো থাকতে হয় তাকে । রেডিওর রেকডিং-এর দিন, বা কোনও ঘরোয়া সভায় যাবার দিন, মা কত সযত্নে পুরনো কাচা শাড়ি পরেছে, রেডিমেড ব্লাউজ কিনতে গেছে কাটরায় ইনাকে নিয়ে আগের সন্ধেতে । ইনা সুচসুতোয় সন্ধেবেলা বসে মায়ের মাপমত ভিতরে মুড়ে সেলাই করে দিয়েছে । মায়ের মেনোপজের সময় মাকে কত চিন্তা করে চলতে হত, কত ভয় । যখন তখন পিরিয়ড হয়ে যাবে । কখন দাগ লেগে যায় হালকা রঙের শাড়িতে । মায়ের যেমন রান্নার গ্যাস ছিল না, মায়ের যেমন ফ্রিজ ছিল না, মায়ের যেমন চার পাঁচটার বেশি বাইরে পরার শাড়ি ছিল না, তেমনি যেটা ছিল না সেটা হল স্যানিটারি ন্যাপকিনের সুরক্ষা । ইনা এখন এটা ভাবলে বুঝতে পারে, তিরিশ বছর সময়টা খুব বেশি সময় । সব পাল্টে গেছে, সব কনজিউমারিস্ট হয়ে গেছে, সুতরাং বাজে হয়েছে সব .... এগুলো ভাবতে গেলে, ইনা বুঝতে পারে, এইসব পরিবর্তনে মানুষ মধুর সম্পর্ক হারিয়েছে কিন্তু টেলিফোন পেয়েছে । মেয়েরা সফটনেস হারিয়েছে, প্রেম ভালোবাসা স্নেহ মমতা হ্যানোত্যানো অনেককিছুর সহজ অ্যাকসেস হারিয়েছে, দুপুর বেলার আড্ডা আর সখিভাব হারিয়েছে, বদলে স্যানিটারি ন্যাপকিন পেয়েছে । ইনা, এখন জাস্ট একজন কনজিউমার, মানুষ না । কিন্তু ইনাকে বাচ্চাদের পেটাতে হয় না । আগুনের আঁচে লাল হয়ে যাওয়া প্রতিমার মত চকচকে ঘামতেল মাখানো মুখ মনে পড়ে দিদার, অনেক স্নেহ আর সংবেদন লেগে থাকত তাতে । আর মায়ের অতৃপ্ত, ক্ষুব্ধ, বিরক্ত মুখও । এ যুগের রেওয়াজ অনুযায়ী ইনার ঠোঁট এখন চর্চিত, চুল হাইলাইটেড, ভুরুতে শেপিং করা । বিন্দুমাত্র অনুভূতি বেরিয়ে যেতে অ্যালাউ করে না ইনা কোন ফাঁকফোকর দিয়ে । মুখকে মনের আয়না করে লাভটা কি ? মাই অনুভূতি ইজ মাই পারসোনাল প্রপার্টি । তোমাদের দেখাতে যাব কেন হে ?
অন্তত বারোবার রিং হবার পরে মা ফোন ধরে । এটাই দস্তুর । ইনা অবাক হয় না । বাবার ডেথ গ্র্যাচুইটি দিয়ে একটি ফ্ল্যাট কেনা হয়েছিল সন্তোষপুরে । সেই একমাত্র ফ্ল্যাটের একমাত্র অধিকারিণী, চির যৌবনকাল কেরোসিনের ধোঁয়া ঝুল আর গরমে ছোট্ট দুটো ঘরে সংসার সামলে এখন সত্তর বছর বয়সের অসুস্থ একাকিত্ব যাপন করছেন । ছেলে বিদেশে চলে গিয়ে দেশকে মুক্তি দিয়ে নিজে মুক্তি পেয়েছে । ইনা বিবাহিত জীবনে সুস্থির হয়ে বসেছে । থাকো তোমরা নিজের নিজের স্বস্থানে । আমাকে আর বিরক্ত করো না । আমার গানবাজনা নিয়ে আমাকে থাকতে দাও । ইত্যাদি ইত্যাদি ।
পরবর্তী স্তরে ইনার প্রাপ্য শুধুই গিল্ট । কারণ সত্তর বছর বয়সে কেউ অমিত স্বাস্থ্যের অধিকারী থাকতে পারে না । মা প্রায় সারাক্ষণ অসুস্থ থাকে । এইভাবে মা তার যৌবনকালের যাবতীয় অভাব, অর্থ থেকে বাবার মনোযোগ থেকে সামাজিক স্বীকৃতির অভাব পর্যন্ত সব অভাবের প্রতিশোধ নিতে চায় । নিতেই থাকে । হাতের কাছে কাউকে পায় না । রণির কোনও অপরাধবোধ নেই । নিজের অপরাধবোধ সে দান করে দিয়ে গেছে তার দিদিকে । ফলত মায়ের নাগালের মধ্যে একমাত্র ইনাই থেকে যায় । উপরন্তু ইনা মায়ের মত স্ট্রাগল করে জীবন কাটায় না । তার জীবন নিশ্চিন্ত, সুখের, ত্রক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন । চাকরি করা মেয়েরা তো ভীষণ সুখে থাকে, দুই পৃথিবীর সুযোগ নেয় তারা, বাড়িতে কুটোটি নাড়ে না উল্টে শাড়ি গয়না বিলাস ব্যসন কোনও দ্রব্যের অভাব নেই ... ইনার মা ও শাশুড়ির মধ্যে এই এক বিষয়ে দ্বিমত নেই । একদিকে রিকের দায়িত্ব পালন না করার অপরাধ অন্যদিকে বয়স্ক বিধবা মাকে না দেখার অপরাধ । কেয়া বাত হ্যায় ।
------- কি করছিলে ?
------- কি আবার করব ? রান্নাঘরে ছিলাম । এমন অসময়ে যে কেন ফোন করিস ?
------- খাওনি এখনো ?
------- একা একা খেতে ভাল্লাগে না আমার তোকে তো কতবার বলেছি । নিজের জন্য রাঁধোবাড়ো, আবার সেই খাবার গোছাও ... ও শোন ফ্রিজটা সারাতে দিতে হবে ... একদম ঠাণ্ডা হচ্ছে না ...
সেই গলা । মুখ ম্লান করা গলা । আবার একটা কাজ । মায়ের দিক থেকে কাজের তালিকা কখনো সম্পূর্ণ হয় না । ইনা জানে । এই খেলাটার ওটাও একটা পার্ট । সেইজন্য মায়ের কোনও কাজ কখনো পুরো শেষ করতে নেই । নিশ্চিন্তি হওয়া মানেই আর একটা কাজের সূত্রপাত হবে । কারণ নিশ্চিন্তি মা পছন্দ করে না । সবচেয়ে ফেভারিট বিষয় হল শরীর । তাই সেটা উথ্থাপন করে অন্যান্য খুচরো ব্যাপারগুলো মিটিয়ে ফেলতে হবে ।
------- ঠিকাছে ঠিকাছে । ক্যালকাটা ইলেকট্রিকসে একটা ফোন করে দিচ্ছি, ওরা চলে যাবে একদিন দেখতে । তোমার পিঠের ব্যাথা কমেছে নতুন ওষুধটা খেয়ে ?
গতকাল মায়ের ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে একটা ওষুধ পাল্টে আনা হয়েছে । সেটা কিনে মাকে বাড়িতে দিয়ে এসেছে ইনা ।
------- আরে আমি এখনও খেয়েই উঠতে পারিনি । এত কাজ...
সঠিক ধরেছে ইনা । গুড শট, সাবাশ ইনা ! মা যখন ওষুধটা পাল্টানো হয়নি তখন পাগল করে দিচ্ছিল, যেন ওষুধটা পাল্টে এনে এক্ষুনি না খেয়ে ফেললে প্রাণটাই চলে যাবে । এখন ফেলে রাখবে, নিয়ম মত খাবে না, জানাই কথা । নিয়মমত খেলে অসুখটাই যে আর থাকবে না । তখন ইনাকে বার বার ডেকে এ ডাক্তার ও ডাক্তার এ দোকান ও দোকানে ছোটানো যাবে কেমন করে ? মায়ের এই পুরনো দানটা ইনা চেনে, তাই সেও খেলায় চালু হয়ে গেছে । এখন আর কোনও প্রত্যাশা নেই কোনও দায়িত্ববোধও নয় । কেউ কারো নয়, শুধু কর্ম করে যাও, কর্মে অবহেলা হলেই বা কি ? এনজয় লাইফ ।
------- তাহলে আর খেতে হবে না, আলমারিতে সাজিয়ে রেখে দাও । ও শোনো, প্রিয়ব্রত ঘটক বলে কাউকে চিনতে ?
------- কে প্রিয়ব্রত ঘটক ?
------- এক ভদ্রলোক একটু আগে এসে একটা জঘন্য বই গছিয়ে গেলেন, শাশ্বত শতাব্দী বলে নাম, পড়ে দেখছি বাংলা একটা বাক্যেরও মানেই হচ্ছে না । পুরো ট্র্যাশ । আমাদের চোদ্দপুরুষের তত্বতালাশ দিয়ে গেলেন । তুমি, দাদু-দিদা, মামা, তোমাদের বাড়ি, তোমার আগেকার গানের গলা, গানের অনুষ্ঠান, সব কিছু জানেন ভদ্রলোক । আবার এইসব তথ্য দিয়ে বলছে, অবাক হচ্ছেন না ?
------- এবার মনে পড়েছে । ভীষণ ডেনজারাস লোক, ইনা ! খুব সাবধান । তুই ভাগিয়ে দিলি না কেন ? এনটারটেন করতে গেলি কেন ?
------- আরে, তোমার নাম বলছে, বলছে আমি খুব ঘনিষ্ঠ !
------- আমাকে একসময় খুব জ্বালিয়েছে । টাকা চাইত । ন্যাকা লোক । আমাকে প্রেম নিবেদন করার মতলবে ছিল । আমারো তো তখন যেমন গলা তেমনি চেহারা, চারিদিকে অনেক ভ্রমর ঘুরত । আজকে নয় আমার শরীর ভেঙে গেছে, চেহারা খারাপ হয়ে গেছে । তখন অন্য ব্যাপার । তোর বাবা কত রাগ করত দেখিসনি ? ভুলটা কী করত বল ? যে কোনও হাজবেণ্ড করবে । সেই কোন বয়স থেকেই আমার এই একই ঝামেলা । গানের মাস্টারমশাই আমাকে কত স্নেহ করতেন : তোর বাবার তো সেটাও সহ্য হয়নি কোনোদিন । আর এইসব কতগুলো বখা টাইপের ছেলে গায়ে সেন্ট মেখে ঘুর ঘুর করত । একবার তো সহাস মুখোপাধ্যায়ও আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, লোকে বলল, যেও না, গান শেখানোর ছলে কোলে বসিয়ে নেবে । আমি আর যাব কি, তোর বাবাই তো বেঁকে বসল । প্রিয়ব্রত ঘটক, তারপর ওই সুরেশ লাহিড়ী, এরা সব ওই গানের জলসাগুলোতে আসত । স্বপন শাসমল বলে একজন ইনডাসট্রিয়ালিস্ট আছে, তার ছাতের উপর ইভনিং পার্টি হত, গানের জলসা । অনেক গেয়েছি ...
(ও:, মায়ের সম্পূর্ণ জীবনেতিহাস এখন আবার শুনতে হবে, নাকি ? কাট ইট শর্ট, মা !) হ্যাঁ সেইরকমই তো কি কি যেন বলছিল, যাকগে বাদ দাও...
------- এখন আমি কোথায় থাকি বলিসনি তো ?
------- ও তো জানে দেখলাম । বলল, মাকে বলো সন্তোষপুরে একদিন যাব । তুমি কিন্তু ওকে ঢুকতে দেবে না মা !
------- আমি বয়স্ক মানুষ, একা থাকি । আই হোল দিয়ে দেখে নেব । অচেনা লোক হলে তো ঢুকতেই দিই না কাউকে ।
------- ঠিক আছে, আমার এখন আবার একটা মিটিং আছে । তোমার খবরটা নিলাম । রাখি মা ।
------- শোন আমার ইলেকট্রিক বিল জমা দিয়েছিলি ?
------- দিয়েছি বাবা দিয়েছি । রিকের বমি হচ্ছে খুব, ভীষণ চিন্তায় আছি । রাখছি ।
শেষ অংশটা আফটার থট । মায়ের মনে একটা পাপবোধের খোঁচা ঢুকিয়ে দিয়ে কথোপকথন সমাপ্ত না করলে খেলাটা ঠিক পুরো হয় না । আশ্চর্য, যতক্ষণ কথা বলল, কেবল নিজের কথাই বলে গেল । নাতি কেমন আছে একবার জানতেও তো চাইতে পারে । মিটিং-এর কথাটা অবিশ্যি বানানো, যেমন রিকের এখনো বমি হয়ে চলাটা । এগুলো ইনা শিখে নিয়েছে ধীরে ধীরে । ইউ শ্যাল নেভার বি অ্যাট দ্য রিসিভিং এণ্ড, ইনা ।
এনকোয়ারি করতে দাশকাকু এসেছিল । বাড়ি করতে পারেনি বাবা । এটা একটা প্লাস পয়েন্ট, কমপ্যাসনেট পাবার জন্য । কিন্তু একি কাণ্ড করে রেখেছে বাবা ? গাদাগুচ্ছের এল আই সি, গাদা টাকা জিপিএফ-এ জমানো । দাশকাকু হেসে বলেছিল, এত সেভিংস থাকলে জেনেরালি কমপ্যাসনেট রিফ্যুজ হবার কথা । যাহোক, আমরা দেখছি চেষ্টা করে । আপনার কিছু জানতেনই না ? স্ট্রেঞ্জ তো ! চক্কোত্তিদা চিরকাল বলত ঘাড়ের উপর মেয়েটা রয়েছে । ওর একটা গতি করতে হবে । বিয়ে দেব বড়লোকের সঙ্গে । টাকা জমানো ছাড়া আমার আর কোনও এইম নেই জীবনে, দাশদা । বাড়িতে জঞ্জাল জমা হয়ে রয়েছে ।
ইনার বোধহয় সেটাই লাস্ট খড়কুটো । বাবা যে এরকম করবে, মরার পরে এরকম একটা ডিচ দেবে, ভাবতে পারেনি ইনা । কলেজের বন্ধু পরিতোষের ডিচও এর কাছে কিছুই না । পরিতোষকে শুধু কয়েকটা চুমু দিয়েছিল ইনা । আর বাবাকে, গোটা মেয়েজীবন । মা, একমাত্র মায়ের প্রতিই শুধু আর দায়বদ্ধতা থেকে গেল তার । বাবা যে মাকে অত্যাচার করেছে, অপমান করেছে, মদ না খেয়েও, অন্য মেয়েমানুষের কাছে না গিয়েও, গায়ে হাত না তুলেও বাবা যে মাকে সমূহ কষ্ট দিয়েছে সেটা আর কখনো অবিশ্বাস করবে না ইনা । কারণ বাবা তাকে জঞ্জাল ভাবত । জাস্ট একটাই কারণে, যে সে মেয়ে । তাকে আগে বিয়ে দিতে হবে । ইনার ভাবলে এখনো তেতো কান্না উঠে আসে গলা দিয়ে । বেঁচে থাকা কালে ইনাকে, রণিকে, মাকে, নিজেকে, সবাইকে সর্বরকমের সুখ থেকে বঞ্চিত করে, নিজেকে দগ্ধে দগ্ধে টাকা জমিয়েছে, রক্ত জল করা টাকা শুধু মেয়ের বিবাহযজ্ঞে মেয়ের সাথে সাথে অগ্নিতে আহুতি দেবে বলে । হাউ অ্যাবসার্ড, হাউ ফানি, হাউ স্যাড । যেসময়ে মেয়ে রেস্টুরেন্টে বসে বন্ধুদের সাথে চিকেন কাটলেট খাচ্ছে নিজের টিউশানির পয়সায়, সে সময়ে বাবা মুড়ি চিবোচ্ছে, হার্টের অসুখ সবার থেকে লুকাচ্ছে, ট্রামের পাদানিতে ঝুলে অফিস যাচ্ছে । এই ইনজাস্টিস কোনদিন মেনে নিতে পারবে না ইনা । আই হেট ইউ, বাবা ।
প্রবীরের সঙ্গে বিয়ের সময়ে বাড়ি থেকে একটা পয়সাও নেয়নি ইনা । নিজে জিপিএফ অ্যাডভান্স নিয়ে বিয়ের খাওয়াদাওয়া, বাড়িভাড়া সব করেছে । ও ক্যাকটাসের বাচ্চা হবে না তো কে হবে । অহংকার ওর একমাত্র ওয়েপন । প্রবীর যাই বলুক ।
প্রবীর এখন কিছুই বলে না । কিন্তু এককালে ফাটিয়ে ঝগড়া করেছে তারা । আসলে বিয়েটাও একটা লপসাইডেড অ্যাফেয়ার ছিল । প্রবীর আগ্রহী কিন্তু ইনা মাথা ঠাণ্ডা করে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছিল । তারপর মায়ের রেজিস্টেনস । প্রবীর ক্লিয়ারকাট বলেই দেয় ইদানীং : তোমার মেন্টাল মেকাপে বিয়েটা যায় না । এত পুরুষবিদ্বেষী তুমি, এত বিবাহবিদ্বেষী । সেটা একেবারেই মানতে পারে না ইনা । ওগুলো পুরুষদের বাঁধা ঝুলি । তুমি যদি সবকিছু মিনমিন করে মেনে নাও, তাহলেই ওদের কাছে তুমি ভালো । একটু প্রতিবাদ করলেই নারীবাদী । আর ইনা ক্যান নেভার টেক থিংস লাইং ডাউন । প্রতি সময়ে মেয়েদের জীবনের ছকটা এত পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে । এখনকার বিয়ে এরকমই । অন্য কলিগদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছে, উনিশ বিশের তফাৎ । কেউ কেউ একটু বেশি কমপ্রোমাইজিং । জাস্ট ওটুকুই তফাৎ ।
প্রবীরের নিজের প্র্যাকটিস । ট্যাক্স ল দেখে । ওর কাজের নেচার আর ইনার কাজের নেচার খুব এক না হলেও খুব আলাদাও নয় । ইনার নটা-ছটা, প্রবীরের বাড়িতে চেম্বার । বাকিটুকু খুব পৃথক নয় । অথচ এর থেকে অনেক বেশি কনট্রাস্ট করা কাপল ওর অফিসের নবনীতা । বর ফ্রিল্যান্সার, বউ সরকারি চাকুরে । লাইফস্টাইল সমস্যাগুলো প্রায় সব এক । এগুলো ইনার মায়েদের জীবনে কখনো ঘটেছে ? তাদের ঠিক উল্টো গল্প, মায়েরা বাড়িতে থাকার স্বত:সিদ্ধতাটা কখনো বিষময় হলেও, অনেক ক্ষেত্রে ওদের হেল্পই করেছে । দে ওয়্যার মোর রিল্যাকসড । ওদের অশান্তিগুলো অন্যরকম ছিল । এত স্ট্রেস ছিল না মায়েদের ।
বিকেলে আর এক দফা ফোন চলে ইনার বাড়িতে । এবার কনফার্ম হয়, রিকের শরীর ঠিক আছে । খেলা করছে । কিন্তু মাকে বলে দিয়েছে মা যেন খেলনা নিয়ে আসে । খেলনাও বলে না রিক, বলে `গিফফফ্ট' । মা বাড়ি ফিরলেই ব্যাগ হাতড়ায় । পড়াশুনো, কাজকর্ম খাওয়াদাওয়া, সবেতেই কণ্ডিশন লাগায় । কিনে দেবে । কী যে কিনে দেওয়ার কথা বলছে ও নিজেই জানে না । শুধু কিনে দেওয়া, কেনা, কিনতে যাওয়ার কথা । পৃথিবীর একমাত্র সত্য দোকান বাজার । একমাত্র বেড়াতে যাবার জায়গা । চিড়িয়াখানা নয়, যাদুঘর নয়, পার্ক, পিকনিক নয় । শপিং মলে গিয়ে ঘোরা । এখনি, এই বয়সেই রিক শপিং জ্বরে আক্রান্ত ।
ফোনে ইনা কোন কমিটমেন্ট করেনি, প্রবীরকে চেয়েছে । ------- বাবাকে দাও, সোনা । বাবা ফোনে এসেছে, ও বলেছে, আজকে তুমি রিককে হোমোয়ার্ক করাবে ।
-------কেন ? তুমি ফিরছ না ?
-------আমি কি করে ফিরব বল ? গুরুজির বাড়ি যাওয়া আছে যে ।
-------আজকে বাদ দাও না । সারা সকাল আমার একটু কাজ হয়নি । বমি করল । সন্ধেবেলাটা একটু কাজ করব । -------প্লিজ আজকের দিনটা কর । কাল আমি করব ।
-------সরি, আমি পারব না । একদিন হোম ওয়ার্ক না করলে কিছু হয়না । স্পষ্টত বিরক্ত গলায় প্রবীর ফোন রাখিরাখি করতেই ইনার মনে পড়ে গেল, রিকের জন্য কাল সকালে অ্যামিটি স্কুলে গিয়ে ফর্ম তুলতে হবে । সঙ্গে সঙ্গে ইনা ওটাকে একটা ওয়েপন করে দেয় ।
-------ওরকম যখন তখন বললে হয়না, বুঝেছ । কে যায় রিকের জন্য ভালো স্কুলগুলোর দোরে দোরে ঘুরতে ? সেই তো আমি । অফিস কাট মেরে কাল আমাকে অ্যামিটি যেতে হচ্ছে না ? আর একদিন তোমাকে হোম ওয়ার্ক করাতে বললাম বলে দোষ হয়ে গেল ?
ফোন রাখার প্রেরোগেটিভটা সর্বদা নিজের হাতে রেখে দেয় ইনা । শেষ কথাটা সেই বলবে । প্রবীর এটা বুঝতে পারে । আর এজন্যই তিক্ততা জমছে । জমতে জমতে পাথর হচ্ছে । একদিন প্রবীর আর ইনা দুজনেই দুটো রক হয়ে যাবে । প্রবীর মনে মনে গায়, আই অ্যাম আ রক । তার একটা ফিলিং হয়, ইনার কাছে এলে, আজকাল । একটা বরফের বিরাট চাঙড় জল কেটে প্রবীরের পাশ দিয়ে ভেসে গেল । কোল্ড-ওয়েভ বয়ে গেল একটা । গা শিরশির করে । হেট্রেড আর ঠাণ্ডা লাগায় কুঁকড়ে যায় প্রবীর । সেদিন একটা সিনেমায় দেখল একটা ডিভোর্সি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে উঠে ছেলেটা বলছে আমার মনে হচ্ছে আমি একটা অন্ধকার অতল ঠাণ্ডা গহ্বরে তলিয়ে গেলাম । ছেলেটা বলছে মেয়েটাকে, তোমার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকা মানে একটা ইগলুর ভিতরে গিয়ে ঢোকা । মেয়েটা প্রেম করার সময় মেটা ল্যাংগুয়েজ করছে : আমি তোমাকে ভালোবাসি কথাটা সবাই বলে । কথাটা কত পুরনো, কিন্তু একদম পুরনো হয় না, না ? উ: পারি না বাবা । এই আঁতেল মেয়েগুলো এরকম হরিবল হয় কেন ? এত ডেড, এত ফ্রিজিড ? কতদিন প্রেম করা হচ্ছে না ইনার সঙ্গে । একদিন ইনা সঙ্গমের সময় ফট করে বলে দিল, কেয়ারফুল, প্রবীর, আই ডোন্ট ওয়ান্ট আ সেকেণ্ড কনসেপশন । ব্যাস, প্রবীরের প্রেম করার আকাঙ্ক্ষার পুটকি মেরে দিয়েছে ইনা । কী বীভত্স কঠিন মুখ করে কথাটা বলেছিল ইনা, প্রবীর সেই এক্সপ্রেশন ভুলতে পারে না । সেই শরীরটাকে আর ভালোবাসা যায় ? তার ভেতরে আর ঢোকা যায় ? ঢুকে সুখ পাওয়া যায় ? ওর হৃদয় আর যোনি আর মন আর শরীর, সবকিছুতেই তালা পড়ে গেছে বলে মনে হয় প্রবীরের । যেন ও নিজে কোন সম্পর্কের ভেতর নেই । কোন দ্বৈততা নেই এই রিলেশনে । একটা ফরেন কানট্রি আর একটা ফরেন কানট্রিকে বলে দিচ্ছে, দেখো বাপু, তুমি কোনওভাবে আমার সীমা লঙ্ঘন করবে না, কাঁটাতারের ওপাশে থাকো । ইট ইজ মাই বডি, আযাণ্ড আই ডিসাইড ওয়াট টু ডু উইথ মাই বডি ।
হাই তুলে সঞ্চিতা বলল, ও, কিনলি কিছু ? দেখি, এবার আবার দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করতে হবে । একগাদা ফাইল বাকি ।
চাপান আর উতোর । এর কোনও শেষ নেই । একদিন সঞ্চিতা ইনার উপরে আপার হ্যাণ্ড পাবে । একদিন ইনা সঞ্চিতার উপর । এ একটা সিনেমা বেশি দেখে নেবে । ও একটা শাড়ি বেশি কিনে নেবে । মিটিং-এ পরস্পরের শাড়ি টেরিয়ে দেখবে । কে কত মাল্টি-টাস্কিং করে নিল সেটার হিসেব নেবে । বসের সঙ্গে টক্কর দেবে, সাবর্ডিনেটের সঙ্গে টক্কর দেবে । হিসাবের অঙ্ক মেলানোটা কে আগে পারে, ইউ ডি সি প্রতিম আগে, না ম্যাডাম ইনা আগে ? তিমি তিমিঙ্গিলের মত, বস, বিগার বসকে আগে তেল দিয়ে কার্যোদ্ধার করবে, না ইনা টপকে গিয়ে ফাইল বার করে নিয়ে বেরিয়ে যাবে । ইত্যাদি । এর মধ্যে নলেজ ইজ পাওয়ার, হেনতেন, আগাম ইনফর্মেশন সংগ্রহের দক্ষতা, হেন তেন ।
সন্ধেতে গুরুজির ওখানে খানিকক্ষণ শিল্পের কাছে থেকে সুখ পেয়েছিল ইনা । সন্ধেটা যতক্ষণ রেওয়াজে, গুরুজির তাকিয়া, ফরাস, পানের ডিবা, আজ ফিস্ট ছিল ছাত্রদের, পরোটা কাবাব খাওয়া, এইসব, যতক্ষণ, ততক্ষণ ভুলে গেছিল রিকের গিফট বা মায়ের ফ্রিজ । একটা বয়স অতিক্রমী ব্যাপার ঘটতে থাকে গুরুজির বাড়িতে । যেন তার কোনো আয়ু নেই । একটা সময় অতিক্রমী কিছু । হাসিতামাসা, গুরুজির সালেঁ সালেঁ করে গালাগাল দেওয়া, গানের জগত নিয়ে চুটকি আদানপ্রদান । লবঙ্গ খাওয়া । সুখ । ধান্ধাবাজিটা তাকে তুলে রাখতে পেরেছিল । ইন ফ্যাক্ট ইনার গুরুজি এতটাই অন্য জগতের মানুষ যে ধান্ধাবাজিটা বিশেষ করতে হয় না ওঁকে । এমনিতেই উনি দেদার মানুষের ভালোবাসা পান । খ্যাতি, সম্মান এসবে লালচ নেই, পানওনি তেমন । তাতে ওনার কচু । উনি বাগেশ্রী আর দরবারী করে যাচ্ছেন । কয়েকটা ছাত্র অন্য গুরু ধরে রেডিও প্রোগ্রাম, এই ওই জলসা ম্যানেজ করছে । গুরুজি তৃপ্ত, আত্মসুখী । শান্তি সে রহো বেটা । ওই লোকটার সামনে গেলে কেউ আমির নয় । সবাই ওঁর কাছে মাথা নিচু করবে । উনিও তার কাছে মাথা নিচু করে আদাব করবেন, আবার ভুলেও যাবেন কে এসে ওঁকে কি বলল ।
ইনা জানে, এখানেই কিছু ছাত্র আছে যারা মুখের এক্সপ্রেশনে একটা টেনশন চাপতে পারে না । আগেই অ্যাসেস করতে চায়, এই গুরুর কাছে কতটা পাওয়া যাবে । আশে পাশে তাকায়, দেখতে চায় কে কতটা মই ধরে এগিয়ে গেছে । ইনাকে টেরিয়ে দেখে অনেক নতুনরা । এই মেয়েটা এতদিন ধরে গুরুজির সাথে লেপ্টে রয়েছে কেন ? কী পাচ্ছে ? ইনা কিছু বলে না । গুরুজিকে ও আপাতত খেলাটার বাইরে রেখেছে । গান নিয়েও তার কোন খেলা নেই । গান ইনাকে উজ্জীবিত করে । একটা পলায়ন, একটু আধটু রিচার্জ নিয়ে নেওয়া ব্যাটারিতে, যদিও গুরুভাই স্মরজিতের ঈষৎ ঢলানি তাকানো তাকে একটু উত্তেজিত করলেও (কারণ লোকটা বেশ পপুলার, অনেক মেয়ে ওর পেছনে ঘোরে, ওর একটা ক্ষমতাবলয় আছে, এসব লোকটা পাত্তা দিলে ইনারও এমপাওয়ারমেন্ট হয়, ভ্যালু বাড়ে লোকের চোখে, ব্যাপারটায় একটা সূক্ষ্ম দেওয়া নেওয়া আছে) ওর পাঠান গদ গদ একটু অশ্লীল একটু রাবীন্দ্রিক এস এম এস গুলো বেশ ইরিটেটিং । শুরুর দিকে ইনা উত্তর দিত, পরে আর দেয় না । কারণ উত্তরে এই সব অদৃশ্য লোকান্তরাল ভার্চুয়াল প্রেমভাব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায় । এটা একটা নেশা কিন্তু এর থেকে শাড়ি কেনার নেশাটা বেটার । অন্তত শাড়িগুলো গায়ে চড়িয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় । ডিলিট করে দিতে হয় না কিছুদিন পর পর ।
বেরিয়ে ঠিক গাড়িতে উঠতে যাবে, স্মরজিৎ সঙ্গ ধরল তার ।
------- আপনার সঙ্গে খান্না পর্যন্ত আসতে পারি ?
------- অবশ্যই পারেন । ইনা উল্টোডাঙ্গা আর ও মৌলালি । ইনার আপত্তি নেই । তাছাড়া আপত্তি থাকলেও সেটা প্রকাশ করার মধ্যে একরকমের ক্যাজুয়াল ক্যাজুয়াল ভাবের বিরোধী হেরো ব্যাপার আছে । খেলায় থাকুন, খেলায় বাঁচুন ।
লোকটা সেন্ট মাখে । চমকের মধ্যে মনে পড়ল, প্রিয়ব্রত ঘটক । আরে, স্মরজিতো তো ঘটক । আত্মীয় নয় তো ? গানটানের জগতে ঘোরে ।
------- তারপর, কীরকম চলছে আপনার গানবাজনা ?
------- সময় কোথায়, বলুন ? এই টুকটাক চলছে আর কি ।
------- সাময়িকী-র ফাংসনে গাইছেন না আপনি ?
------- না:, আমার মই নেই । মই করতেও চাই না ।
------- সে কি, আমি বলে দেব ওদের । আমি ওদের সঙ্গে কিছুটা যুক্ত আছি ।
ইনার সংশয় হয়, তবে কি ওর গলায় কোনো সুপ্ত ইচ্ছা ও চাপা বেদনা জাতীয় ন্যাকা জিনিস খুঁজে পেল লোকটা ? অনেকে অবিশ্যি মরীচিকাদর্শন করে ।
------- সরি, ওটা যে সময়ে হচ্ছে সে সময়ে আমার ট্যুর আছে ।
------- খুব ট্যুরে যেতে হয়, না, আপনাদের চাকরিতে ?
ট্যুরের গপ্পোটা বানানো, সেটা বুঝে গেছে নাকি লোকটা ? যাচ্চলে ।
------- তা তো হয়ই । আমরা ওয়েস্ট বেঙ্গলে একটা মডেল প্রজেক্ট বানিয়েছি আরবান ডেভেলাপমেন্টের । ওটাই ব্যাঙ্গালোরে প্রেজেন্ট করতে যাব ।
------- ও বাবা, ব্যাঙ্গালোরের লোকরা আপনাদের থেকে শিখবে নাকি ? হা হা হা । মহা বিরক্তিকর । খান্নাটা কখন আসবে ?
------- আমার রবীন্দ্রজয়ন্তীর এস এম এসটা পেয়েছিলেন ?
------- কোনটা বলুন তো ? ইনা মনেই করতে পারছে না ।
গলা নামিয়ে বেশ ঢুলু ঢুলু হয়ে স্মরজিৎ বলেন, ওই যে রাত্রি যখন দিনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে ...
------- সরি, পড়তে পারিনি, এক লাইনের পরেই দেখি সাম টেক্সটস মিসিং । পরে আবার পাঠিয়ে দেবেন তো ।
ঠিক এই গলাতেই ইনা আজ এক প্রার্থীকে ফিরিয়েছে । আপনার অ্যাপ্লিকেশন পাইনি । পরে আবার পাঠিয়ে দেবেন তো ।
-------উ: ভীষণ টায়ার্ড । রিক চটপট ব্রাশটা কর । শুয়ে পড়ব ।
-------এবার রেকর্ডটা চেঞ্জ করো, ইনা । এক গান তো বহুদিন শোনাচ্ছো ।
তার মানে আজ ঝগড়া হবে ।
------- রিককে আর অনডেম খেতে হবে ? শোবার আগে ? প্রবীর এটা ওকে করতে বলছে, মনে করিয়ে দিচ্ছে, ইনডাইরেক্টলি কইয়া দ্যালাম স্টাইলে ।
স্তূপীকৃত কাগজ আর ক্রেয়ন শুদ্ধু বিছানার চাদরটাকে গুটিয়ে নিয়ে ঘরের কোনে ফেলে দেয় ইনা ।
------- মাধবী আজ মশারি টাঙিয়ে রেখে যায়নি কেন ? বলোনি ওকে ?
------- আমার বলার কথা ? রোজ যেটা করছে ....
------- হরিবল হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা দিনে দিনে । আর পারি না রে বাপু । বিছানায় আড়াআড়ি ধপাস করে শুয়ে পড়ে ইনা ।
------- তোমার কাছে তো সবাইই হরিবল । মাধবী, অফিসের বস, আমি, আমার মা । রিকও কদিন পরেই দেখবে হরিবল হয়ে যাবে । এখন চকলেট চাইছে এর পর যখন কমপিউটার চাইবে, মোবাইল চাইবে, বাইক চাইবে ..
-------উহ্ প্রবীর, দিনের শেষে কি তোমার একটা ভালো কথা মনে পড়ে না ?
------- ভালো কথা আবার কী ? আজ আকাশ জুড়ে মেঘ করেছিল, তোমার কথা মনে পড়েছিল, সোনা, এইসব ?
------- নাহয় ওইসবই বলতে ?
------- তুমিই ননসেন্স বলতে । আর তোমার সারাদিনে মনে পড়ে আমার কথা ? নাচতে নাচতে তো ওই ক্যারেকটারলেস লোকগুলোর সাথে গান প্র্যাকটিস করতে যাও । এবার ফর্মালি খেলা বন্ধ করে, ক্যাজুয়াল ক্যাজুয়াল ভাবে ঝাঁপ ফেলে দিয়ে, সিরিয়াস, দিনের একমাত্র ম্যাটার করে এমন ঝগড়াটা হবে । ইনা প্রস্তুত হয় ।
------- আর একটা কথা বললে তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব ।
------- আমাকে তুই বললে তোর চুল উপড়ে নেব ।
রিক কাঁদবে, না ঝগড়াটা একটু ঝড় তুলেই পাস করে যাবে, সেটা তীক্ষণ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে বিচার করছে । তারপর দু কানে হাত দিয়ে ওদের থেকেও গলা তুলে বলছে: বাবা, থামো । মা, থামো । এক্ষুনি থামো । থামো বলছি ।
ইনা ভাবছে, এই এক গল্প রোজ । দূর, শুধু এইটুকুই ওদের দাম্পত্যের রিয়েল স্পর্শ । কনট্যাক্ট পয়েন্ট ? এর থেকে একটা এক্সট্রা ম্যারিট্যালও ভালো ছিল । যাও, প্রবীর, গলা নামিয়ে হিংস্র মুখ করে সে বলে, অন্য মেয়ের সঙ্গে থাকো ।
তুমি থাকো গিয়ে অন্য ছেলে নিয়ে । আমার ঘেন্না ধরে গেছে । মেয়েদের দেখলে আমার এখন রিপালসন হয় । মনে হয় সবকটার চুলে উকুন । মুখে গন্ধ । সবকটা কিলার মাংকির বংশধর ।
ভেজা ভেজা, অন্ধকার একটা সিঁড়ির তল, একটা সবুজ রং করা বিরাট বড় পুরনো দরজা, ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ হয় । মা ভেতরে, অনেক দূরে । সিঁড়িতে শ্যাওলা, ইচ্ছা করলেও খুব তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাওয়া যাবে না । দরজা খুলতেই একটা রোগা চিমশে লোক ঢুকে ইনার গাল টিপে দিয়ে বলল, খুকি, মা বাড়িতে আছেন ? মাকে ডাকো না একবারটি । লক্ষ্মী মেয়ে । গাল ছুঁয়ে, ইনার সদ্য জন্মানো বুক ছুঁয়ে, হিলহিলে হয়ে লোকটার হাতটা নিচে নেমে গেল । ইনা শিউরে উঠল । কিছু বলতে পারল না ।
রান্নাঘর থেকে মা চেঁচাল : কে এল রে, ইনা ? কে এসেছে ? উ:, এই এক ভ্যাবলা মেয়ে হয়েছে আমার । লোকের সঙ্গে কথাটা পর্যন্ত বলতে পারে না ।
ছোটবেলা থেকে ইনা ভীষণ ভ্যাবলা ছিল । প্রিয়ব্রতর মত আরো কত লোক ওকে লঙ্ঘন করে, অযাচিত স্পর্শ করে, নোংরাভাবে ছুঁয়ে গেছে ।
ও কিচ্ছু বলতে পারেনি । মুখটা যেন কেউ সিমেন্ট দিয়ে বুজিয়ে দিয়ে গেছে । শুধু রাত্রে রাগে বিছানায় হিসি করে ফেলা । আর স্বপ্ন দেখে ঘুঙিয়ে ঘুঙিয়ে কাঁদা ।
যেমন এখন । ঘুমের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে প্রবীর বলল, কি হল কি ? গোঙাচ্ছ কেন ? ইনা প্রবীরের হাতটা টাইট করে চেপে ধরে থাকল অনেকক্ষণ । তারপর জেগে ওঠার মুহূর্তটায়, নিছকই কন্ট্রোলহীন দুর্বলতায়, গলায় আর্জেন্সি নিয়ে, ভ্যাবলাতম একটা কথা বলল ।
আমাকে ছেড়ে চলে যেও না প্লিজ ।
(পরবাস-৩৮, জানুয়ারি, ২০০৭)