• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৮ | জানুয়ারি ২০০৭ | প্রবন্ধ
    Share
  • একটি প্রতিবেদন : শান্তির স্বপক্ষে সৃজনশীল নারী সই মেলা বই মেলা ২০০৬ : নবনীতা দেবসেন

    শুভ হোক নতুন বচ্ছর । ভালো থাকুন সকলে । ২০০৭ হৈ হৈ করে এসে পড়েছে নানা জটিলতা পকেটে নিয়ে । নানা শুভ সংবাদও । কলকাতাতে আপাতত আদালত থেকে ময়দানে কলকাতা বইমেলা বন্ধ করা নিয়ে বেজায় ঝামেলা চলছে । কেউ কেউ বলছেন ময়দানেই বইমেলা হোক, না হলে না হোক । কেউ কেউ বলছেন বইমেলা হোক । যেখানে ঠাঁই মেলে সেখানেই হোক । থেমে থাকা চলবেনা । আমি এই দলে । আমি সদর্থক চিন্তায় বিশ্বাসী, সারা বছর ধরে যারা বইমেলার জন্যে বসে আছেন তারা ময়দানের জন্যে বসে নেই নিশ্চয়ই । কোনটা আগে ? মেলাটা, না মেলার ঠাঁইটা ? বড্ড বেশি করে ইগোফাইট শুরু হয়ে গিয়েছে এখানে । প্রথমে রাজায় রাজায় । দুই মহামান্য শক্তির লড়াইতে আদালত জিতে গেলেন, সরকার জিততে পারেননি । এখন প্রজাদের লড়াই চলেছে । মেলা আগে না মাঠ আগে ?

    আমরা সাধারণ মানুষেরা চাই মেলা হোক, কিন্তু সাধারণের পক্ষে সহজগম্য কোনো স্থানে হোক । যেখানে শুধু গাড়িওয়ালারা যেতে পারবেন, ট্রাম নেই, বাস নেই, মেট্রো নেই, তেমন জায়গাতে নয় । তা অগতির গতি ব্যবস্থা একটা হয়েছে আর পরিবহন মন্ত্রী বলেছেন স্পেশাল বাস দেবেন হাওড়া, শেয়ালদা, এস্প্লানেড থেকে । দৈনিক ট্রেনের যাত্রীরা যাতে আসতে পারেন, স্কুল কলেজের ও অফিসের লোকজনের যাতে আসা যাওয়া সম্ভব হয় ।

    আমি তো এতেই খুশি । আপাতত তো ২০০৭ এর বইমেলাটা হয়ে যাক ? লেখক হয়ে বইমেলা বয়কট মানে চোরের ওপরে রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া ।

    এক্ষুনি শুনলুম আরো খারাপ খবর । দুটো বইমেলা চলবে একই সঙ্গে । একটা সল্টলেকের ত্রক্রীড়াঙ্গনে, আরেকটা পার্ক সার্কাস ময়দানে । আমি বাবা দুটোতেই যাবো । আমার কোনো দল নেই । আমার দল আপনারা, আমার পাঠকেরা । বইমেলাতে না গেলে মফ:স্বলের পাঠকদের সঙ্গে দেখা হবে কোথায় ?

    হোক গে দুটো বইমেলার আকচা আকচি । ওতে আমি নেই ।

    এবারে থাকুক কলকাতা বইমেলার কথা । আমি বরং বলি যে অভিনব বইমেলাটি হয়ে গেলো, খুব সুন্দর করেই হয়ে গেলো, তার কথা । রবীন্দ্রসদনের প্রাঙ্গনে, নন্দনের গা ঘেঁষে হোলো চার দিনের দ্বিতীয় সই-মেলা বই-মেলা ।

    দেড় মাস হোলো সই মেলা বই মেলা শেষ হয়েছে, এখনো গায়ের ব্যথা মরেনি ! একটা রিপোর্ট দেওয়া আমার অবশ্য কর্তব্য । বিগত বছরের স্মৃতি চারণেই তো শুরু হয় নতুন বছরের স্বপ্নচারণ ।

    ওরে বাবা রে, নভেম্বর আর ডিসেম্বর কী পরিশ্রমটাই যে গেলো রে বাবা ! বেঁচে বর্তে যে রয়েছি এখনো সেটা কেবলমাত্র আপনাদেরই কল্যাণে । ভাগ্যিস আপনারা সবাই মিলে এসে আমাদের সই মেলা বই মেলাকে এমন দুর্দান্ত সাফল্য এনে দিলেন ! ভাবতেই পারিনি সত্যি সত্যি সত্যি এমনভাবে সাধারণের সহযোগিতা পাবো । কী অসামান্য সমাদর যে পেলুম আমরা এই চারটি দিনের সই মেলাতে । সই এর কথা অপনারা কেউ কেউ হয়তো এতদিনে জানেন, ঘংযঞ জংত্রভছৎ ঘধস্‌ংত্র ঘশঠঞংশ'য যিযধবঠছঞঠধত্র, আমাদের বয়েস সাত, আমরা এই নবীন সহস্রাব্দের সমবয়সী । আমাদের প্রথম চেষ্টা, সই মেলা বই মেলা ২০০৫ (মচ্‌ং ঘধস্‌ংত্র'য জধধূ যছঠশ, ২০০৫) হয়েছিলো বৈশাখ মাসে ।

    মেলা উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যপাল শ্রী গোপালকৃষ্ণ গান্ধি । প্রথম বারের সেই মেলাতে আশাতীত সাড়া পেয়েছিলুম ঠিকই, কিন্তু মেলার মাঠে অনাহূত হলেও প্রমত্ত কালবৈশাখীরও উত্সাহ ছিলো যোগ দেবার । তাই দুর্যোগের কারণে একটু অসুবিধায় পড়তে হয়েছিলো আমাদের । এবারে তাই মেলা শীতের শান্ত রোদ্দুরে ।

    এবারে আরো যেন বেশি করে যোগ দিয়েছেন পাঠকের দল । এবং প্রকাশকের দলও । এবারে হোলো দ্বিতীয়বারের সই মেলা বই মেলা । মেলার মাঠটা একই, কর্মকর্ত্রীরাও একই, কিন্তু এবারের মেলার আবহাওয়া ছিলো অন্য । উত্সাহ আজ, উত্সাহ চারিদিকে, উত্সাহ আজ ! বলে গান গাইতে ইচ্ছে করছিলো । সম্মানিত অতিথিদের এক কথায় আমাদের আমন্ত্রণে আসতে রাজি হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত তাঁদের কথা রাখা, এটাই তো এক দুর্দান্ত প্রাপ্তি । প্রকাশকেরা আনন্দের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ব্যবসার কথা না ভেবে, কিন্তু তাঁদের ব্যবসাপত্তর মন্দ হয়নি মোটের উপরে ।

    উদ্বোধনের দিন আমন্ত্রিত বড়রা সকলেই এসেছিলেন, মহাশ্বেতাদি বাদে । তিনি সিঙ্গুরের ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন । আর ইন্দিরা গোস্বামী জানিয়েছিলেন তাকে হঠাৎ আপার আসামে চলে যেতে হয়েছে সন্ত্রাসবাদ ও শান্তি বিষয়ক আলোচনার দায়িত্বে । লেখিকাদের অ্যাক্টিভিস্টের ভূমিকাতে দেখতে ভাল লাগছে । তবে আমাদের অ্যাকটিভিসম প্রধানত কলমে । মেধা-র মেটিরিয়াল তো সকলে নই ? আমাদের আদরের এবং শ্রদ্ধার মানুষগুলিকে এনেছিলাম কলাক্ষেত্রের বিভিন্ন পাড়া থেকে । শানু লাহিড়ি, অমলাশংকর, শোভা সেন, অপর্ণা সেন, শাঁওলি মিত্র প্রত্যেকেই সই-এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ও সই মেলার প্রশংসা করে অনেক সুন্দর কথা বললেন । শানুদি বললেন সৃজনশীল নারীদের একটি মিলিত মঞ্চ প্রয়োজন ছিলো, সবাই মিলে যাতে কলকাতার জন্যে করতে পারি । অপর্ণা খুব সুন্দর করে বললেন সই-এর মর্মকথা, মেয়েদের একসঙ্গে চলার কথা, সৃজনশীল মেয়েদের সিস্টার হুডের কথা । শাঁওলি মিত্র মনে করিয়ে দিলেন ১০ তারিখটা, মানবাধিকারের দিন । বঞ্চিত মানুষদের প্রতি আমাদের দায়িত্বের কথা । অপূর্ব লাগলো তাঁর কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি । কলকাতা ও যাদবপুরের দুই মানবী বিদ্যা চর্চার প্রতিষ্ঠাত্রী ছিলেন মঞ্চের দুই প্রান্ত আলো করে, ভারতী রায় ও যশোধরা বাগচি । দুজনেই অকুন্ঠ প্রশংসা করলেন আমাদের পরিকল্পিত ও পরিবেশিত সই মেলার । ছিলেন সই এর তিনজন উপ সভানেত্রী, কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায়, বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য । চাঁদের হাট আর কাকে বলে ?

    কিন্তু বাংলাতেই তো ফুরিয়ে যায়নি সেই উজ্জ্বল চন্দ্রমণ্ডল, স্টেজ আলো করে ছিলেন আমাদের বিশিষ্ট অতিথিরা, নাগাল্যাণ্ডের লেখিকা ড: টেমসুলা আও, ত্রিপুরার মীনাক্ষী সেন, গুয়াহাটির অঞ্জলি দাশ-লাহিড়ি আর ওড়িশার ড: প্রতিভা রায় । ১০ই সই-মেলা উদ্বোধনের শুভলগ্নে পূর্ব ভারতের এতগুলি কৃতী মহিলাকে এক সঙ্গে পাশাপাশি স্টেজে হাজির করতে পেরে সই খুবই পরিতৃপ্ত । কবি কৃষ্ণা বসু যাদের বললেন নারী নক্ষত্র !

    কলকাতা থেকে পাবলিশার্স এণ্ড বুকসেলার্স গিল্ড সমেত মেলায় এসেছিলেন কুড়ি জন প্রকাশক, তাদের মধ্যে কলকাতার দশটি প্রকাশনা সংস্থা নারী-পরিচালিত, আর দিল্লি থেকে আসা ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট পাবলিশার্স গ্রুপের প্রকাশকদের মধ্যে নজনই মহিলা । বাইশ বছর আগে ভারতের প্রথম মহিলা প্রকাশনা সংস্থা কালী ফর উইমেন শুরু করেছিলেন দুই বন্ধু ঋতু মেনন আর উর্বশী বুটালিয়া । এখন তারা আরো ছড়িয়ে পড়েছেন, উর্বশীর আছে জুবান, আর ঋতুর হয়েছে উইমেন আনলিমিটেড । দুজনেই সই মেলাতে অংশ নিয়েছিলেন, ঋতু এসেছিলেন নিজেও, উদ্বোধনের দিনে মহিলা প্রকাশকদের একটি আলোচনা সভা ছিলো, তাতে যোগ দিতে । দ্য লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদিকা ও প্রকাশিকা অন্তরা দেব সেনও এসেছিলেন ঐ একই উদ্দেশ্যে, তাঁদেরও দোকান ছিলো । আরো দোকান ছিলো তুলিকা-র, বুক রিভিউ-এর, দানিশ-এর, আর সোশ্যাল সায়েন্স প্রেসের । এরা সকলে দিল্লির ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট পাবলিশার্স গ্রুপ এর সদস্য । তাদের খরচ উঠে গিয়েছে শুনলুম । যাক আমাদের মুখ রক্ষা হয়েছে ওদের কাছে !

    যশোধরা বাগচি সঞ্চালনা করলেন দিল্লি ও কলকাতার মেয়েদের প্রকাশনার অভিজ্ঞতা নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা । দিল্লি থেকে ঋতু আর অন্তরা, কলকাতার থীমা থেকে কল্যাণী ঘোষ, স্ত্রী থেকে মন্দিরা সেন, আর পার্পল পীকক থেকে কেতকী দত্ত । অভিজ্ঞতায় খুব একটা ফারাক দেখলুম না । বোঝা গেল মেয়ে হয়ে প্রকাশক হওয়া রীতিমত কঠিন কর্ম । আরো একজন মেয়ে প্রকাশক এসেছিলেন দিল্লি থেকে শ্রীমতী চিরশ্রী বিশী চক্রবর্তী, শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক প্রমথ নাথ বিশীর কন্যা, দিল্লি থেকে প্রকাশিত তাঁর আন্তর্জাতিক বাংলা পত্রিকার নাম প্রতীচী । (প্রসঙ্গত, অমর্ত্য সেনের প্রতিষ্ঠিত প্রতীচী ট্রাস্টের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই ।) অন্যতম বক্তা হলেও তিনি আলোচনাতে থাকতে পারেননি । বিশেষ কাজে চলে যেতে হয়েছিলো । দিল্লি থেকে আরো একজন প্রকাশক শুধু হিন্দি ভাষায় মেয়েদের বই পাঠিয়ে ছিলেন, যিনি নারী নন, হিন্দির রাজকমল প্রকাশন । মহাশ্বেতা, নবনীতা, সুচিত্রা-র অনেকগুলি হিন্দিতে অনুবাদিত বই, এবং অ্যাকাডেমি পুরস্কার এবং আরো বহু সম্মান প্রাপ্ত ওড়িশার লেখিকা প্রতিভা রায়ের বইও ছিলো । শ্রীমতী প্রতিভা রায় এবারে আমাদের মেলার অন্যতমা প্রধান অতিথি ছিলেন । খুব সুন্দর ঊষ্ণ বক্তৃতা দিলেন ওড়িয়া ভাষাতে, শ্রোতারা পুরোপুরি বুঝে নিলেন, তাদের হৃদয় স্পর্শিত হোলো, তারা বাহবা দিলেন । ভাষা কোনো বাধাই ছিলো না সই মেলাতে ।




    ১১ই ভিক্টোরিয়াতে প্রতিভার হাতে উন্মোচিত হোলো পাঁচজন সই-এর গল্পসংগ্রহ পঞ্চকন্যা প্রতিভা বসু, মহাশ্বেতা, নবনীতা, বাণী, সুচিত্রার দশটি গল্প । প্রকাশক লালমাটি । ১৩ই নিরুপমাদির হাতে উন্মোচিত হোলো সই-এর তৃতীয় সংস্করণ । দুই বছরের মধ্যে তিনবার বেরুলো বইটি, আমাদের সই-এর সকলের গল্প সংগ্রহ ।

    প্রথম দিনের শেষ অনুষ্ঠান ছিলো পঞ্চাশের জাঁদরেল পুরুষ গল্পকারদের গল্প পাঠ । অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাপদ রায় ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এসেছিলেন । শীর্ষেন্দু অসুস্থ ছিলেন । রাত্রি হয়েছিলো, কিন্তু মুগ্ধ শ্রোতারা সবাই বসে ছিলেন, সোত্সাহে শুনেছিলেন গল্প । সই নিয়ম করে সই মেলার শুরুতে আর শেষে পুরুষ শিল্পীদের সমাদর করে ডাকে, যাতে এটা সকলে বোঝেন যে সই পুরুষ-বিরোধী কোনো মঞ্চ নয় । গত বছরেও এই ধারা অনুসৃত হয়েছিলো ।

    আমাদের চেষ্টা মেয়েদের সৃষ্টিশীলতার দিকে স্ত্রী পুরুষ সকল পাঠকের নজর টানা, আমরা পাঠক লেখক উভয়েরই পুরোনো বস্তাপচা নজরটা বদলাতে চাই, দৃষ্টির সমতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে চাই ।

    লেখকের ইউনিভার্সাল দৃষ্টি বলে যে কিছু হয়না, সেটাই যে এতকালের সর্বজন সম্মত পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টি, তাতে অভেদ নেই, এটুকুও এখনও আমরা না লেখকদের, না পাঠকদের, কাউকেই বুঝিয়ে উঠতে পারিনি । না, তার মানে নারীতন্ত্র নয়, পুরুষতন্ত্রও নয়, চাই মানুষের অভেদ । উইমেন্স রাইট্স আর হিউম্যান রাইট্স । এই টুকুই । আর তো কিছু নয় ।

    শেষের দিনে এসে পৌঁছেছিলেন অসমের শিল্প সংস্কৃতি জগতের পরম শ্রদ্ধেয়া দিদি শ্রীমতী নিরুপমা বরগোহাঁই, তাঁকেও আমরা সম্বর্ধনা দিলুম । তিনি কথা বললেন অসমীয়া আর বাংলা মিশিয়ে । শ্রোতাদের জিগেশ করলেন, বাংলাতে বলবো, না মাতৃভাষায় ? বাংলার মুখ উজ্জ্বল করে শ্রোতারা উত্তর দিলেন মাতৃভাষাতে বলুন । তারও সমস্ত কথাই কলকাতার শ্রোতাদের বোধগম্য হোলো, তারা সেটা সমস্বরে জানালেনও । সাহিত্য ক্ষেত্রের সর্বভারতীয়তা, অন্তত পূর্ব ভারতের মধ্যে যে ভাষাগত যোগটি আছে সেটি প্রমাণিত হয়ে গেলো । শ্রোতাদের এমন সহযোগিতায় আমি ধন্য হব না ? কি অসাধারণ শ্রোতা সবাই ? সমানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান শুনেছেন । সব চেয়ার ভর্তি ছিলো ।

    প্রতিদিনই কিছু না কিছু আলোচনা সভা ছিলো, প্রথমে মহিলা প্রকাশকেরা, তৃতীয় দিনে নাটকের নির্দেশনায় নারী । চতুর্থ দিনে চলচ্চিত্রের পরিচালনাতে নারী । এই দুদিনের আলোচনা একেবারে ফাটাফাটিই হোলো । অজস্র জরুরি প্রশ্ন এলো মাঠ থেকে মঞ্চে । অডিয়েন্স পারটিসিপেশন ছিলো দারুণ । প্রকাশনাতে বাইরের প্রশ্ন অতটা ছিলো না । বোধ হয় প্রথম দিন বলে ।

    দ্বিতীয় দিনের বই মেলাতে ছিলো অনামিকা সন্ধ্যা । গত বছরেই এটি চালু করেছি আমরা, মঞ্চ উন্মুক্ত ছিলো অনামিকা লেখিকাদের জন্য । যাঁরা কখনো মঞ্চে উঠে লেখা পড়েননি । এই বছরে সই জ্যোত্স্না কর্মকার তাদের জন্য দুটি পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন, তাঁর সদ্য প্রয়াতা জননীর স্মৃতিতে, একটি কবিতায়, একটি গদ্যে । মোট ত্রিশজন নারী সেদিন মঞ্চে উঠে নিজের রচনা পাঠ করেছেন, লেখা জমা দিয়ে গিয়েছেন । বাংলাতে, ইংরিজিতে এবং হিন্দিতে । অনামিকাদের এইভাবে মেলার মঞ্চে আসার সুযোগও সই মেলাই করে দিলো প্রথম । অনামিকা সন্ধ্যায় মেলার মঞ্চে দুবার নিজের আঁকা পটের ছবি দেখিয়ে গান শুনিয়েছিলেন আরেকজন, মেদিনীপুরের পিংলা গ্রামের শ্রীমতী করুণা চিত্রকর । সই এর স্টলে তাঁর ছবির জন্যে একটি টেবিল দিয়েছিলুম আমরা । বেশ বিক্রি হয়েছিলো তাঁর ।

    কথা ছিলো অনামিকা সন্ধ্যার প্রতিযোগিতার ফলাফল বেরুবে বই মেলা সই মেলা মঞ্চে, কলকাতা বইমেলা ২০০৭ এ । এখন তো শুনছি দুটি বইমেলা হবে, পার্ক সার্কাস ময়দানে একটি, আর যুবভারতী ত্রক্রীড়াঙ্গনে একটি । শুনে যার পর নাই বিষাদ গ্রস্ত হয়েছি । বইমেলাতেও বাদ বিসংবাদ, ভাগাভাগি, দলাদলি ? পার্ক সার্কাসের মেলাতে যাওয়া অনেক সুবিধে, ময়দানের বদলে ওখানেও তো হতে পারতো কলকাতা বইমেলা । আমি অবশ্য দুটোতেই যাবো, আমন্ত্রণের ধার ধারিনা । সুনীলের আহ্বানে সই ৩১শে ময়দানে গিয়েছিলো, বইমেলা চাই, এই আবেদন জানাতে । আমরা মাঠ নিয়ে মাথা ঘামাইনা, সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজগম্য একটি ঠাঁই হলেই হোলো । শুধু গাড়িওয়ালাদের জন্য মেলা হলে, সেটাতে যাবোনা । আমার পাঠকরা আসবেন কেমন করে ? তবে শুনছি ঐ বারোদিনে পরিবহন মন্ত্রী সর্বসাধারণের জন্য বাস দেবেন হাওড়া, শিয়ালদা, এস্প্লানেড থেকে সল্টলেকের জন্য ।

    মেলা একটাই হোক বা দুটিই হোক, কলকাতা বইমেলাতে সই মেলার অনুষ্ঠান সন্ধ্যা এবারে হবে কিনা জানিনা । কথা তো ছিলো কলকাতা বইমেলাতে এবারে সইদের প্রবল উপস্থিতি থাকবে পুরো বারো দিন । কেন না সইদের এবারে বারোয়ারী উপন্যাস বেরুচ্ছে যে ? একটা নয়, দু দুটো । একসঙ্গে দু-দুখানা বারোয়ারী উপন্যাস । একটি লিখছেন পাঁচজনে, আরেকটি বিশজনে মিলে । আজ্ঞে হ্যাঁ, কুড়ি জন সই মিলে একটি বই । করে দেখান না আর কেউ ? পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাসে এই প্রথম হাত ধরাধরি করে এক বাক্সো সই হাজির হবেন বই এর বাজারে । পুরো একটি সেট । শুধু কি উপন্যাস ? শুধু গদ্যে নয়, পদ্যেও আছি আমরা । সুশ্রী বর্ণাঢ্য বাক্সোর মধ্যে থাকবে মোট তিনটি বই, দুটি সই বারোয়ারি উপন্যাস, আর গত বছরে সই-এর মলাট করে দিয়েছিলেন আমাদের প্রিয় বন্ধু শ্রীমতী দীপালী ভট্টাচার্য । এবারে আমাদের তিনটি বই একত্রে প্রকাশিত হচ্ছে সই বারোয়ারী এক, দুই, তিন । সর্বজন শ্রদ্ধেয়া শিল্পী শ্রীমতী রেবা হোড় প্রথমে মলাটের জন্য আমাদের স্নেহ ভরে দুটি অসাধারণ ছবি এঁকে দিয়েছিলেন, আমরা খুবই গৌরবান্বিত সে জন্য । কিন্তু টেকনিক্যাল কারণে আমাদের প্রকাশক সেগুলি ব্যবহার করতে না পারায় আমরা অত্যন্ত দু:খ পেয়েছি ।

    কিন্তু একই সঙ্গে দুটি মেলা হলে আমাদের প্রকাশক কী করবেন, কোথায় বই প্রকাশ করবেন, সেটা তিনিই জানেন । সই বারোয়ারির প্রকাশকও পুষ্প, সেই যারা সই গল্প সংকলন বের করেছিলেন গত ২০০৫ এর বই মেলাতে । তিন মাসের মধ্যে, প্রথম সই মেলা-বই মেলাতে সই এর ২য় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছিলো ইন্দিরা গোস্বামীর হাতে । আর এই বছরে ২০০৬ এর ২য় সই মেলা-বই মেলাতে বেরুলো সই এর ৩য় মুদ্রণ, শ্রীমতী নিরুপমা বরগোহাইনের হাতে । আর মন্দার মুখোপাধ্যায়ের করা মির্জা গালিবের অনুবাদ গ্রন্থটিও সাহিত্য অকাদেমি থেকে বেরুলো সই মেলার মধ্যে, উদ্বোধন করলেন শ্রীমতী মার্থা নুসবম । সই এর মুখপত্র সই-সাবুদ এর অনুবাদ সংখ্যা বেরুলো এবার সই মেলাতে । সইরা অনুবাদ করেছেন শুধুই মেয়েদের রচনা । এই সংখ্যার সম্পাদনা করেছেন সই এষা দে । পঞ্চকন্যার কথা আগেই বলেছি, যেটি ওড়িশার প্রতিভা রায়ের হাতে উন্মোচিত হলো, সেটি আমাদের আদরের হেড সই প্রতিভা বসুর স্মৃতিতে উত্সর্গিত ।



    দ্বিতীয় দিনে যদিও মেলার মঞ্চে ছিলো অনামিকা সন্ধ্যা, কিন্তু সই এর নিজের অনুষ্ঠান ছিলো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ঐতিহাসিক সৌধে, পশ্চিম দালানের স্বপ্নময় অবস্থানে । বিষয় ঐ যে সেদিন বলেছি, শান্তির স্বপক্ষে সৃজনশীল নারী । উদ্বোধন করলেন শ্রীমতী ঊষা গাঙ্গুলি, তাঁর বিভিন্ন নাট্যাংশ থেকে অভিনয় করে । রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলেন দেবারতি সোম আর জনপ্রিয় একটি পুরনো গান শোনালেন ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় । লেখিকারা পাঠ করলেন কেউ গদ্য আর কেউ পদ্য । নাগাল্যাণ্ডের লেখিকা টেমসুলা আওকে সকলের খুব ভালো লেগেছে, তিনি কবিতা পড়লেন, গল্প বেশি দীর্ঘ বলে । তিনি লেখেন ইংরিজিতে । ত্রিপুরার মীনাক্ষী সেনের গল্প শুনে গায়ে কাঁটা দেয় । প্রতিভা গল্প পড়লেন ওড়িয়াতে । সকলেই বুঝলেন, কোনো অসুবিধাই হোলোনা । আসামের এক অশীতিপর বাঙালি লেখিকাও ছিলেন আমাদের সম্মানিত অতিথি, অঞ্জলি লাহিড়ি দাশ, যিনি একদা আসামে বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করেছিলেন, আবার তিনি খাসিয়া জনজাতির কাহিনি লেখেন বাংলায় । বাংলা-অসম বন্ধুতার জন্য তার এই চেষ্টা তিরিশ বছরের । সকলেরই গল্প কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিলো হিংসা ও শান্তি । তসলিমা নাসরিন পড়লেন হৃদয়স্পর্শী কয়েকটি কবিতা, বাণী বসু ও এষা দে গল্প, বিজয়া মুখোপাধ্যায় শেষ করলেন কবিতা পড়ে । কবি বিনয় মজুমদারের তিরোধানের জন্য মৌনতা পালন করে সেদিনের মত সই এর সভা শেষ হোলো । (ভিক্টোরিয়া খুব ভালো জলখাবার খাইয়েছিলেন কিন্তু !)

    তৃতীয় দিনের উত্সবে সইরা পড়লেন অনু-গল্প, সঞ্চালনাতে বাণী বসু । নাটকের নির্দেশনাতে নারী - এই আলোচনাতে ছিলেন শোভা সেন থেকে ঈশিতা মুখোপাধ্যায় । অসামান্য সঞ্চালনা করলেন শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত । নাটক পরিচালনার সুবিধা অসুবিধা খোলাখুলি আলোচনার পরে শর্মিষ্ঠার অনুরোধে এদের মধ্যে তিনজনে একটু একটু অভিনয় করে দেখালেন, ডলি বসু, সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত, আর শোভা সেন । ডলি বললেন ভালোবাসা কারে কয় থেকে এক ডায়ালগ, সুরঞ্জনা তিন পয়সার পালা থেকে দারুণ জমাটি গান করলেন । আর শোভাদি কিছু স্মৃতি চারণা এবং কিছু অভিনয় করলেন । একটু কল্লোল, একটু নবান্ন, একটু অঙ্গার থেকে । সারা মাঠ কেঁপে উঠলো । শোভাদি এখন পঁচাশি । উপস্থিত অনেকেরই ভাগ্যে এই প্রথম শোভা সেনের অভিনয় দেখা হোলো ।

    পরবর্তী অনুষ্ঠানে ছিলো সইদের কবিতা পাঠ । সইরা যখন কবিতা পড়লেন, সঞ্চালনাতে তখন সুচিত্রা ভট্টাচার্য । সুচিত্রা জানালেন তিনি জীবনে এই প্রথম সঞ্চালনা করছেন, তায় আবার কবি সম্মেলন । তার পরে হোলো সঙ্গীতের অনুষ্ঠান, বাংলা নাটকে মেয়েদের গান, ও নাটকের গানে মেয়েরা । গাইলেন ঋদ্ধি ও দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় । শ্রোতারা তাদের ছাড়তে চাইছিলেন না, আধঘন্টার প্রোগ্রাম এক ঘন্টা হোলো । সবার চেয়ে আশ্চর্য করেছে ওদের সন্তান, বছর ছয় কি সাত এর ফুটফুটে শিশু ঋদ্ধদেব । ঐ কচি হাতে একঘন্টা টানা সুকৌশলী তবলা সঙ্গত করেছেন তিনি বাবামায়ের সঙ্গে । এই ছেলের আন্তর্জাতিক ভবিষ্যৎ আমি মর্মদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি ।

    চতুর্থ দিনের আলোচনা দারুণ জমজমাট হোলো, চলচ্চিত্র পরিচালনাতে নারী । ঊর্মি চক্রবর্তী, অনন্যা চ্যাটার্জি, অনিন্দিতা সর্বাধিকারী, ও শতরূপা সান্যাল এসেছিলেন । বিবিসি লণ্ডনের মানসী বড়ুয়া ছিলেন সঞ্চালক । বড্ড সুন্দর পরিচালনা করেছেন । যেমন করেছিলেন নাটকের দিনে শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত । মেয়ে হয়ে সিনেমার জগতে ছড়ি ঘোরানোর কর্মটি যে কত কঠিন, সকলেই সেটি বললেন, এবং বিশেষত নারীবাদী বিষয় নিয়ে ছবি করতে টাকা পাওয়া যায়না । জনপ্রিয় হিন্দি টিভি সিরিয়ালের কাহিনির মত নারীই নারীর শত্রু টাইপের ছবির জন্যে অবশ্য সর্বদাই টাকা আছে । প্রযোজকেরা অচেনা তরুণ পুরুষদের ছবি বানাতে টাকা দেবেন, তবু অভিজ্ঞ নারী পরিচালককে দেবেন না । একঘন্টার বদলে দেড়ঘন্টা চলেছিলো আলোচনা । শেষ হোলো শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ও দর্শনের প্রোফেসর মার্থা নুসবম এসে পড়ার পরে ।

    মার্থার উপস্থিতি আমাদের মেলাকে অন্য একটা সম্মান এনে দিলো, বিশ্ববন্দিত নারীবাদী দার্শনিক তিনি, তা ছাড়া ভারতের মেয়েদের নিয়ে অনেক দিন ধরে কাজ করছেন । তার নতুন বইটি ভারতে গণতন্ত্র, হিংসা, ধর্ম, আর ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে, হার্ভার্ড থেকে বেরুবে । মার্থার কাজের বিষয়ে এখানে একটু বলতে পারলে ভালো হোতো কিন্তু বড্ড ঘুম নেমেছে চোখে, বড় বেশি কাজের চাপ ছিলো ক'দিন । আপনারা যদি জানতে চান, ংঔছশঞচ্ছ ব্ণ্ণযযঢছণ্ণস্‌, ঙচ্ঠবছভধ লত্রঠট. ইন্টারনেটে দেখে নেবেন দয়া করে । ওর কাজকর্মের ক্ষেত্র এত বিস্তৃত, এত উদার, দু কথায় বলে ফুরোনো যাবে না । এখানে আই ডি এস এ তার বক্তৃতা বাতিল হয়ে গেলো, প্লেন বহু দেরিতে এসে পৌঁছনোতে । তিনি বিশ্বভারতীতে একটি স্মারক বক্তৃতা দিতে চলেছেন । কিন্তু আমাদের অনুষ্ঠান যথাকালেই হোলো, এবং মার্থাকে অবাক করে দিয়ে । ঘুরে ঘুরে প্রতিটি স্টল দেখার পরে এত বড় উইমেন্স বুক ফেয়ার দেখে মার্থা তো একেবারে হতবাক । আশ্চর্য । আমেরিকাতে কোনো দিন কোথাওই এমন শুধুমাত্র মেয়েদের বইমেলা উনি দেখেননি বললেন । হ্যাঁ, শিকাগো বুক ফেয়ার হয়, সে আলাদা । একটা মাঠ জুড়ে খোলা আকাশের নিচে এমন করে শুধুমাত্র মেয়েদের বই নিয়ে, নারীবাদী নয়, নেহাৎ সাধারণ প্রকাশকদের এমন অপরূপ মেলা নয় সে । এ যে মেলাই ! মার্থা শান্তিনিকেতনের মেলা চেনেন । মার্থা কে আমরা যে সম্বর্ধনা দিলুম, তাতে ছিলো একটি মানপত্র, একটি কাঁথার কাজ করা গরম শাল, একটি সই থলি, সই স্মারক (এজ্ঞে হ্যাঁ এবারে আমরা সই থলি বানিয়েছি, খাতা কলম আঁকা সই স্মারকও । কলকাতা বই মেলাতে সই থলি বিক্রি হবে । এবারে শুধু আলোচকদের উপহার দিয়েছি, সই-স্মারকের সঙ্গে । কিছু বাদ নেই, ভিতরে প্যাড-পেনও আছে ! গোলাপ ফুল আছে, মিষ্টির বাক্সো আছে । সই সাবুদের ফ্রি কপি আছে । কী নেই ? অবিকল প্রোফেশনলদের মত !) মার্থা মুগ্ধ । তাঁর খু উ উ ব ভালো লেগেছে সই মেলা । সম্ভব হলে পরের বছরেও আসবেন বলেছেন । (কিন্তু পরের বছরে সইমেলা বাঁচলে হয় । এত ধকল, এত খাটুনি আমি কি আর পারবো ? সইমেলার পরে দু হপ্তা যে সিধে নার্সিংহোমে অক্সিজেনে আর ইন্জেকশনে ছিলুম !) হিন্দি প্রকাশনার স্টলে গীতেশজী ছিলেন, মার্থাকে বললেন, ভারতবর্ষে এমন কাণ্ড এই প্রথম, নবনীতাদিদি করলেন, পাগল বলেই ভাবতে পেরেছেন, ঘটাতেও পেরেছেন । মার্থা বললেন, ভারতবর্ষে কেন, আমি তো মনে করি সারা পৃথিবীতেই এটা প্রথম, আমি কোথাও এরকম মেলা দেখি নি । উইমেন্স কনফারেন্স গুলোতে এক রকমের উইমেন্স বুকস্টল বসে । কিন্তু তাকে উইমেন্স বুক ফেয়ার বলা যায় না । সেখানে বিষয়টা বই মেলা নয় । কনফারেন্সের সঙ্গে জড়িত নারী বিষয়ক বইপত্র ।

    সে জিনিষ আমিও দেখেছি দু একবার । এত বড় নয়, এমন মেলা মেলা নয় । অনেকটা প্রদর্শনীর মত আর কি । ফ্লোরেন্স হাও নিউ ইয়র্কে ফেমিনিস্ট প্রেসের পক্ষ থেকে উইমেন্স বুক ফেয়ার জাতীয় আয়োজন করেছিলেন একটি বিল্ডিং এর উপর তলার হলঘরে, সেখানে এম এল এ (মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যাসোসিয়েশন) এর কন্ফারেন্স হচ্ছিলো, তার অঙ্গ হিসেবে । আশির দশকের শেষে বা নব্বইয়ের গোড়াতে । সেখানে অনেক আন্তর্জাতিক মানের জেণ্ডার ইশুর বইপত্র ও নারীবাদী স্লোগান লেখা দ্রব্য, কফি মাগ, ডায়েরি, টি শার্ট, পোস্ট কার্ড, পোস্টার ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছিলো । আরেকবার, আরো আগে, আশির দশকের গোড়াতে, ডাবলিনের আন্তর্জাতিক উইমেন্স কনফারেন্সেও দেখেছিলাম কিছু নারীবাদী বইপত্র ছিলো । কিন্তু আমাদের মেলার সঙ্গে একেবারেই তুলনীয় নয় । আমাদের মেলা নারীর লেখালিখি নিয়ে, শুধু নারীবাদী লেখা নিয়ে নয় । তখনকার সেই যুদ্ধং দেহি মনোভাবেরও আর দরকার নেই । সময় পাল্টে গিয়েছে ।

    একুশের শতকে মেয়েদের লেখা, মেয়েদের প্রকাশিত এবং মেয়েদের সম্পাদিত যে কোনো বিষয়ের বই নিয়ে বইমেলা বসানো এক, আর তখনকার যুগে ফেমিনিস্ট বই নিয়ে কনফারেন্সের সামনে স্টল দেওয়া তো এক হোলো না । পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মনোভাব প্রকাশ করতে নয়, মেয়েদের সৃষ্টিশীলতার গুরুত্বের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই সই মেলা । এটি একটি সম্পূর্ণ সদর্থক মেলা ।

    কলকাতা থেকে যোগ দিয়েছিলেন মোট বিশজন, পশ্চিমবঙ্গ পাবলিশার্স এণ্ড বুকসেলার্স গিল্ড এর ব্যানারের বাইরেও নানা ধরনের প্রকাশনা সংস্থা । সই প্রত্যেকের কাছে আন্তরিক কৃতজ্ঞ । বিশেষ করে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অতুলনীয় সহযোগিতায় এটি এত সুন্দর করে করা সম্ভব হোলো ।

    আমাদের সঙ্গে ছিলেন যেমন পাবলিশার্স এণ্ড বুকসেলার্স গিল্ড, সাহিত্য অকাদেমি, বাংলা অকাদেমি, ওরিয়েন্ট লংমান, পুষ্প, লালমাটি, সাহিত্যম, থীমা, স্ত্রী, পার্পল পীকক এবং আলাপ, বিংশ শতাব্দী, যাদবপুর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যা চর্চার কেন্দ্র দুটি, ছিলেন উইমেন্স কমিশন, তেমনি ছিলেন সোনাগাছির দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি, সাফো ফর ইকোয়ালিটির লেসবিয়ান গ্রুপ, পথবালিকাদের নিয়ে এন জি ও সংলাপ, মেয়েদের দ্বারা সম্পাদিত পত্রিকা, মালিনী, অনুবাদ পত্রিকা ইত্যাদি । মেয়েদের দ্বারা সম্পাদিত আরো অজস্র ভালো বাংলা লিট্ল ম্যাগাজিন আছে আমাদের, বিশেষত কবিতা পত্রিকা, আমি সেগুলি হামেশা দেখতে পাই । সামনের বারে যদি সই মেলা ঘটে তাহলে তাদের জন্যে একটা ব্যবস্থা করবো ভেবেছি । যত্সামান্য মূল্যে যাতে তারা নিজেদের সই মেলার মাঠে উপস্থাপিত করতে পারেন ।

    শেষ দিনে ছিলো সত্তরের দামাল পুরুষ কবিদের কবিতাপাঠ । সঞ্চালনাতে কবি বিজয়া মুখোপাধ্যায় । তিনি হোমওয়ার্ক করে এসেছিলেন, প্রত্যেকের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে, তাদের লিটল ম্যাগাজিনের নাম উল্লেখ করে প্রত্যেককে অতি যত্নে মাইকে ডেকেছিলেন । মোট এক ডজন কবি এসেছিলেন, এদের কবিতা দিয়েই এবারের মত সই মেলা ভঙ্গ হোলো । প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে গানটি সই-সঙ্গীত, সেটি গাওয়া হোলো উপস্থিত সবাই মিলে, বেশ বেসুরে অবিশ্যি ।

    মেলার মঞ্চ থেকে নেমে দেখি শর্মিষ্ঠা গান শুরু করেছেন, ওলো সই । আর যাবে কোথায়, তক্ষুনি আমাদের এক গুচ্ছ সই মাঠের মধ্যে তার সঙ্গে যোগ দিয়ে তারার আলোয় গান ও নাচ শুরু করে দিলেন । সই মেলা সানন্দে সাঙ্গ হোলো ।

    মেলা জমে গিয়েছিলো এবারে । আমাদের সই মেলাতে ধুলো ছিলো না । কাদাও ছিলো না । এমনকি গরমও না, ঠাণ্ডাও না । আদর্শ আবহাওয়া । তাই রীতিমত ভীড় ছিলো । প্রথমত সময়টা হেমন্তের শেষ, শীতের শুরু, রোদ্দুরটাও মিষ্টি, ঠাণ্ডাটাও মিঠে । দুপুরেও ভালো লাগে সন্ধেটাও বেশ । হিম তেমন পড়ছে না এখনো । পাশেই নন্দন চত্বর ।

    না, খাবারের দোকান ছিলো না বটে, কিন্তু চা, কফি, লজেন্স ঘুরছিলো, বুড়ির চুল, চিনেবাদামও ছিলো, ছিলো মশলামুডি-ওলাও । (আর ছিলো সই-দের জন্যে সই এর স্টলে অনন্ত সিঙ্গাড়ার যোগান ।) বিক্রি বাটার কথা যা জানি, সব স্টলের রিপোর্ট সমান নয় । বইমেলা বলা বাহুল্য জমে গিয়েছিলো । আরো জমতো যদি দোকানীরা বুদ্ধি করে লেখিকাদের দিয়ে বই স্বাক্ষরের ঘোষণা করতেন । প্রচুর নামী লেখিকা ওখানে উপস্থিত ছিলেন সশরীরে, যাদের বই মেলায় বহু দোকানেই বিক্রি হচ্ছিলো । কিন্তু এরকম চেষ্টা বিক্রেতারা করেননি । একটি স্টল তো সাজানোর পর্যন্ত কোনো উত্সাহই নেননি মালিকেরা । যারা চেষ্টা করেছেন তাদের বিক্রিও হয়েছে । দিল্লির ইংরিজি প্রকাশিকাদের দলের আসা যাওয়ার খরচ উঠে গিয়ে লাভ হয়েছে । সই এর নিজের স্টলেরও খরচ উঠে গিয়েছে ।

    এবারে মেলার মধুরতম বাক্যগুলি শুনিয়ে, ক্ষান্ত দিই । স্টলে বসে আছি, একজন হাস্যমুখী মেয়ে এসে বললেন, দিদি আমি গতকাল সিয়াটল থেকে এসেছি, এখানে ভাগ্যিস এলাম সই মেলার খবর অন লাইনের পত্রিকাতে পড়ে । দেখে সত্যি সত্যি মুগ্ধ হয়েছি । শুনে আমি স্রেফ বাক্যহারা । পরের দিন আরো দুজন সুন্দরী এসে হাজির, আমরা ওয়াশিংটন ডিসি থেকে এসেছি ভীষণ ব্যস্ত, কিন্তু আজই তো ১৩ই, সই মেলার শেষ দিন, আই পত্রিকাতে জেনেছিলাম, তাই কোনো রকমে লেকটাউন থেকে দৌড়ে দৌড়ে এলাম, একটু দেখে যাই কী হচ্ছে । সেদিনই রাতের দিকে লণ্ডন প্রবাসী এক বাংলাদেশী ভদ্রলোক আলাপ করতে এলেন । তিনিও বাংলা লাইভে সই মেলার কথা পড়ে একটু দেখতে এসেছেন । দেখে শুনে আমি তো থ ! সই মেলা বই মেলা তো আন্তর্জাতিক হয়ে গেলো রে ! নেক্স্ট সই মেলাটা তো হনলুলুতে করতে হবে যা বুঝছি । আশা করি পরের বারে পরবাসেও সই মেলার অগ্রিম খবর দিতে পারবো ।

    সেক্ষেত্রে আমার তো পরবাসে একটা রিপোর্ট দেওয়াই উচিত সই মেলার পরে, আন্তর্জাতিক বাংলা বই বাজারে আপনারা সকলে জানুন কী কী হোলো । কেউ খুশি হবেন । কেউ বোর হবেন । কিন্তু ভারতবর্ষের গ্রন্থ জগতের এবং মানবীবিদ্যা জগতের একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডের আনুপুংখিক বর্ণনা কি না দিয়ে থাকা যায় ? সেটা কি অমার্জনীয় হত না ?

    শেষের কথা, কলকাতা বইমেলা যতগুলোই হোক, বঙ্গসন্তানদিগের অবস্থা দেখে লজ্জা দু:খু যাই হোক, আপনারা কিন্তু সই বারোয়ারির আশ্চর্য খবরটি ভুলবেন না ! একসঙ্গে বিশজন লেখিকা হাতে হাত মিলিয়ে একটি উপন্যাস লিখলেন । আরেকটি লিখলেন পাঁচজনে । ভালো মন্দের প্রশ্ন উঠছে পরে, আগে ভাবুন একসঙ্গে মিলে মিশে সৃজনশীল কাজ করার কথাটি ।

    মনে রাখবেন, ২০০৭ এ বাংলাভাষাতে বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস গড়লো সই ।

    গর্ব করবার মত কিছু তো হোলো ?


    (ফেব্রুয়ারি ৪, ২০০৭)

    (মুদ্রণযোগ্য `পিডিএফ' সংস্করণ)



    (পরবাস ৩৮, ফেব্রুয়ারি, ২০০৭)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)