বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে বনপোড়া একটি হরিণীকিংবা
ছোট দিগ্বিদিক, তীব্র তৃষ্ণায় কাতর, জলাশয়ে মুখ রেখে
মরুর দুরন্ত দাহ মেখে নেয় বুকে...
( বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে, `বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে')
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,এই হাসিমুখের সুদর্শন মানুষটাই কি লিখেছেন এগুলো ? আমি যে-শহরে বাস করি, সেই শহরের নাগরিক ভাবনা ফুটে উঠেছে তার কবিতায়, কিন্তু মনে হয় তিনি যেন পারিপার্শ্বিকের বাইরেও দেখতে পান । আমি গোগ্রাসে গিলে চলি...
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কত দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
( তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা , `বন্দী শিবির থেকে')
মধ্য রাতে ঢাকা, বড়ো একা বড়ো ফাঁকা হয়ে যায়,কবির জীবনের অনেকটাই কেটেছে পুরনো ঢাকাতে । কবিতায় তাই এসেছে তার ব্যাপক প্রভাব । উঠে এসেছে মহুত্তুলি, হারনি-সাহেবের দালান, ঘোড়ার আস্তাবল, বাতিঅলা । বাংলা কবিতায় কিছু কিছু উর্দু/ফার্সি শব্দ উঁকিঝুঁকি মেরেছে মাঝে মাঝে ।
অতিকায় টেলিফোন নেমে আসে গহন রাস্তায় জনহীন
          দীর্ঘ ফুটপাথ
ছেয়ে যায় উঁচু উঁচু ঘাসে সাইনবোর্ডের বর্ণমালা
( পারিপার্শ্বিকের আড়ালে , `শূন্যতায় তুমি শোকসভা')
পরে এক সাক্ষাত্কারে কবি বলেছেন, এই মিশেল তার পদ্যকে সমৃদ্ধ করেছে । এই বিতর্কে যাব না কিন্তু অনস্বীকার্য যে মুসলমান বাঙালিরা প্রায় সবাই মা এবং বাবাকে আব্বা আম্মা বলে থাকেন, তবু কেন জানি না আমাদের কবিতায়, গানে এই সম্বোধনগুলো অব্যবহৃত । শামসুর রাহমান অবলীলাক্রমে ব্যবহার করেছেন আমাদের মুখের ভাষা এবং কালচার --
এই ঈদে জননীকে করলাম সালাম যখন,কবিতার সঙ্গে ছিল তার গেরোস্থালি । খুব শৈশবে পেযেছিলেন রবি ঠাকুরের চয়নিকা, কিন্তু কিছু বোঝার আগেই বইটি তিনি হারিয়ে ফেলেন, রবীন্দ্রনাথের সাথে তার সত্যিকার পরিচয় হয় কৈশোরে যখন প্রথম উপহার পেলেন সঞ্চয়িতা । কিন্তু যৌবনে অনেকটাই নিরাসক্ত হয়ে পড়েন রবি ঠাকুরের ব্যাপারে... "মধ্য পথে কেড়েছে মন, রবীন্দ্র ঠাকুর নন সম্মিলিত তিরিশের কবি" ।
অনেক বছর পরে আম্মা কী খেয়ালে অকস্মাৎ
দিলেন আমার হাতে দশ টাকার একটি নোট,
স্বপ্নদেখা পাখির পালক যেন, আর
তক্ষুনি এল সে ফিরে অমল শৈশব
( দশ টাকার নোট এবং শৈশব , `যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে')
কিন্তু পরিণত বয়সে আবার যেন রবি ঠাকুরকেই নতুন করে আবিষ্কার ... "যেন ভীষণ রুক্ষ নির্বাসন থেকে প্রত্যাবর্তন করেছি নিজ বাসভূমে" । কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা কল্লোল যুগ, কোনওটাই স্পর্শ করেনি তার নিজস্ব স্টাইল । শামসুর রাহমান তাই হয়ে উঠেছেন বাঙলার মাটি ও মানুষের কবি ।
মধ্যবয়সে কি মৃত্যুভাবনা মাঝে মাঝে তাকে নাড়া দিত ? যখন তিনি মৃত্যু থেকে বহু দূরে, তখন লিখেছেন
যেদিন মরব আমি, সেদিন কি বার হবে, বলা মুস্কিলঅথবা
শুক্রবার ? বুধবার ? শনিবার ? নাকি রবিবার ?
       যে বার-ই হোক
সেদিন বর্ষায় যেন না ভেজে শহর, যেন ঘিন-ঘিনে কাদা
    না জমে গলির মোড়ে । সেদিন ভাসলে পথ ঘাট,
পুণ্যবান শবানুগামীরা বড় বিরক্ত হবেন ।
(বিবেচনা)
   ..... দ্যাখো, এখন মুখোশহীন আমি ;বহু দিন চলে গেছে, চলে এসেছি কবিতা থেকে দূরে, প্রিয় শহর থেকে দূরে । কবিতার জন্য সময় নেই আমার, মনেও পড়ে না ভালো করে সেই আশ্চর্য সময়, সেই স্বপ্নের শহর । "আমি বড় ব্যস্ত ... আমার সময় প্রতিদিন সুমিষ্ট পিঠের মত ভাগ করে নিয়মিত খাচ্ছে হে সবাই" ।
পুরোনো মুখোশ, যার চাপে
আমৃত্যু ছিলাম আমি অস্বস্তিকর ক্লিষ্ট ত্রক্রীড়নক,
খসে গ্যাছে এক লহমায় । দোহাই তোমরা আর
দিও না আমার মুখে সেঁটে
       অন্য কোনো দুর্বহ মুখোশ ।
( মুখোশ , `যে অন্ধ সুন্দরী কাঁদে')
এরই মধ্যে টিভিতে একদিন দেখলাম তিনি গুরুতর অসুস্থ । শুয়ে আছেন হসপিটালের বেডে, নিথর । তাকে বাঁচানোর সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি চলে গেলেন, মুখোশহীন, যার চাপে আমরা সবাই থাকি আমৃত্যু "ক্লিষ্ট ত্রক্রীড়নক" ।
না, সেদিন বৃষ্টি হয়নি । গলির মুখে বা রাজপথে জমেনি কাদাপানি । দেখলাম টিভির পর্দায়, লাখো মানুষের ঢল নেমেছে তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য । এদের অনেকেই হয়ত তার কবিতার সাথে পরিচিত নন, তবুও এই নাগরিক কবি তাদের কাছের মানুষ ।
ভালোই করেছে রাষ্ট্র তাকে মরণোত্তর সম্মাননা না দিয়ে । সেটা হত আরেক প্রস্থ মুখোশ পরানো । তিনি চলে গেলেন সাধারণ মানুষের মত, অসাধারণ কিছু পঙ্ক্তিমালা রেখে ।
আর বহু বছর পর বৃষ্টির আড়াল থেকে উঠে এল তার কবিতা আমার কাছে, প্রাক্তন অভিমানী প্রেমিকের মত !!!
(পরবাস-৩৮, ডিসেম্বর, ২০০৬)