রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে শামসুর রাহমান এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথের মহিমা অনুধাবন করতে হলে অগাধ পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই, আমাদের অভিজ্ঞতা আর বোধ থেকে আমরা বাঙালির জাতীয় জীবনে তাঁর বিপুল দানের কথা কবিসার্বভৌমের বিষয়ে কোনও গ্রন্থ পাঠ না করেও বলতে পারি--.... আমাদের জীবনে তার উপস্থিতি নিসর্গের মতোই ব্যাপক এবং অনিবার্য ।" শামসুর রাহমানও সেরকমভাবেই স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার উপস্থিতি প্রকৃতির মতোই সর্বময় করে তুলেছিলেন । আমরা যারা জন্মেছি অস্থির রাষ্ট্রব্যবস্থার কোলে, ইতিহাসের অশ্লীল, খণ্ডিত অংশ যখন ভরে তুলেছে আমাদের প্রচারমাধ্যম--কবি বিশ্বস্ততার সঙ্গে গেয়েছেন স্বাধীনতার জন্মকথা । তার কবিতায় আমরা শুনেছি -- "আমাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা"--উনসত্তরের সেই উত্তাল গণঅভ্যুথ্থানের কথা ; একাত্তরের সেই বজ্রকঠিন সংকল্পের প্রতিধ্বনি--"নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক/এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে দ্বাধীনতা ।" সামরিক শাসকের বুটের তলায় স্বাধীন কবিতাও যখন পিষ্ট, প্রতিবাদ-মিছিলের সর্বাগ্রে তিনি জ্বালিয়েছেন মশাল, লিখেছেন "উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ" । গণতন্ত্রের অপেক্ষায় নিজ বুকে-পিঠে পৃথিবীর সুন্দরতম কবিতা লিখেছিলো যে যুবক, সেই নুর হোসেনের বুলেটরঞ্জিত `স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক' শব্দগুচ্ছকে তিনি দেখেছেন "বাংলাদেশের হৃদয়" রূপে । একাত্তরের পরাজিত শক্তি যখন ধর্মপ্রচার আর দেশভক্তির নামে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখন তরুণ প্রজন্মের দিশারী শহীদজননী জাহানারা ইমামকে পাশ থেকে সাহস জুগিয়েছেন, পথ বাতলেছেন কবি, দেখেছেন জননীর "উত্তাল হাতে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল" করছে বাংলার ভবিষ্যৎ ।
আমার কাছে, আমার মতো লক্ষ বাংলাদেশির যৌবনে তাই শামসুর রাহমান মিশে আছেন বিশুদ্ধ বায়ুর মতো । স্বাধীনতা আমাদের কাছে তার যেমন ইচ্ছে লেখার কবিতার খাতা : প্রিয়জনকে ভালোবাসার প্রথম বার্তা আমরা পৌঁছে দিই তারই লেখা গানের পঙ্ক্তিতে, "তারায় তারায় রটিয়ে" দিতে চাই প্রেমের দুরন্ত আহ্বান । বুঝতে শেখার পর থেকে যেকোনো প্রগতিশীল সভায়, বাঙালিয়ানা উদ্যাপনে আর কূপমণ্ডুক ধর্মীয় লেবাসের প্রতিবাদ-সমাবেশে তাঁকে দেখেছি । এতো নম্র আর মৃদু-উচ্চারণে কী করে তুলতেন সমালোচনার এমন কঠিন দেয়াল !
অগাস্ট্তের শুরু থেকেই শামসুর রাহমান ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন । কিছুদিন পরই আমার ঢাকায় যাবার কথা । প্রার্থনা করছিলাম যেন আর একবার দেখতে পারি তাকে । যে কথা দেয়া ছিলো, যেন রাখতে পারি । ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেখা হয়েছিলো । সানফ্রান্সিসকো বে-এরিয়ায় বসবাসকারী প্রবাসীদের জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান `আগামী' নিয়ে তার অনুভূতির কথা ক্যামেরাবন্দী করার উদ্দেশ্য ছিলো আমার । কবির সঙ্গে যোগসূত্র -- `আগামী'-প্রতিষ্ঠাতা বাবু রহমানের পিতা, কানাডা-বাসী লেখক মীজান রহমান । টেলিফোনে সময় দিলেন কবির পুত্রবধূ টিয়া রাহমান । থাকেন ঢাকার শ্যামলীতে, আমার বাড়ি থেকে রিকশায় দশ-মিনিটেরও কম পথ । জীবন্ত এই কিংবদন্তীর দেখা পেতে যেদিন বাবার হাত ধরে রওনা দিলাম, সেদিন দু'জনাই আবেগে প্রায় কাঁপছিলাম । শান্ত দুইতলা বাড়িটির সামনে প্রথমেই জেরার মুখে পড়তে হলো । কে আমরা, কী চাই কবির কাছে ? এমনটা আগে ছিলো না । যেকোনো সময়েই কবির দরজা উন্মুক্ত ছিলো সকলের জন্য । নব্বই দশকের শেষভাগে দুই মধ্যযুগীয় বর্বর কবির উপর কুঠার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর থেকে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছিলো । উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতেই কবির ঘরে যাবার অনুমতি মিললো । দোতলায় কবির লেখালেখি করার টেবিল যে-ঘরে, সেটিকে লাইব্রেরি বলাই ভালো । দেয়ালে, মেঝেতে, গাদাগাদি শুধু বই আর বই । বাংলার কোন লেখকের স্বাক্ষর নেই সে ঘরে ? আর রয়েছে কবির অসংখ্য পারিবারিক ছবি । সব দেখা শেষ না-হতেই তিনি ঘরে ঢুকলেন । শরীর ভেঙে পড়েছে একেবারে, কন্ঠের স্পষ্টতাও আগের মতো আর নেই । তবু চিরপরিচিতের হাসি দূর করে দিলো সকল সীমাবদ্ধতা । ওই মুখ আমাদের চিরচেনা । গায়ের রঙ ইয়োরোপিয়ানদের মতো, কাঁধ অবধি লম্বা চুল বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কাশফুলের রঙ ধারণ করেছে, কমেনি তেমন ; উচ্চতায় তিনি গড়পড়তা বাঙালিদের চেয়ে অনেকটাই ছোটো । সুদর্শন বলে চিরদিন `রমণীমোহন' হবার খ্যাতি জুটেছিলো তাঁর । আরো একবার কবির বর্ষীয়ান সৌম্য সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম । চোখের দীপ্তি মনে করিয়ে দিলো তাঁর কবিতায় অনন্ত তারুণ্যের কথা । তিনি আমাদের কাছে ধরা দিলেন সমুদ্রের মতো গভীর আর বিশাল হয়ে--যে বিশালতা মানুষকে আপন করে নেয়, দূরে ঠেলে দেয় না । প্রাসঙ্গিক, অপ্রাসঙ্গিক, কতো কথাই হলো তাঁর সঙ্গে । কবির পুত্রবধূ চায়ের আয়োজন করলেন । হুমায়ুন আজাদের উপর বর্বর আক্রমণের কথা তুলে কবি দু:খ করলেন ; বললেন, "আমাকে যারা আঘাত করেছিলো, আজও তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা যায়নি ।" `আগামী'র জন্য আরেকদিন সময় চেয়ে নিয়ে আমরা বিদায় নিলাম । বিনয়ী কবি এগিয়ে দিতে এলেন সিঁড়ি পর্যন্ত । বিদায়ের সময় তার হাতদুটো ছুঁয়ে দেবার লোভ সামলাতে পারলাম না । বাবাও তুলে নিলেন তার হাত দুটো । দুজনে হৃদয়ে অমৃতস্পর্শ নিয়ে রওয়ানা দিলাম ।
এরপরে আরো একদিন কবির কাছে গিয়েছি ও ক্যামেরায় `আগামী'র উদ্দেশ্যে তাঁর শুভাশিসকে ধরে রেখেছি । (ক্যালিফোর্নিয়ায় `আগামী'র বার্ষিক সংগ্রহের জন্য তার প্রদর্শনীও হয়ে গেছে ।) সেদিন কথা বলার সুযোগ ছিলো না তেমন, শেষদিকে কবির উপর বিস্মৃতি ভর করেছিলো । এক কথা বলছিলেন কয়েকবার । আমরা কয়েকজনে মিলে কবির সঙ্গে কিছু ছবি তুললাম । বের হবার মুখে কবি বললেন, "আমাকে ক'টা ছবি দিয়ে যাবেন কিন্তু ।" -- "নিশ্চয়ই," আরেকবার কবির সঙ্গে দেখা করবার এই আমন্ত্রণ নিতান্তই সৌভাগ্যের । দোতলা থেকে নামতে নামতে দেয়ালে অসংখ্য ছবি দেখে ভাবলাম, হয়তো আমাদের তোলা ছবিও এখানে স্থান পাবে ! কিন্তু সময়ের অভাবে ছবি সংগ্রহ করাই হলো না সেবার ; ঠিক করলাম পরের বার এসে দিয়ে যাবো । সেই ছবি আর দেয়া হয়নি তাঁকে । ঢাকা যাবার কয়দিন আগেই দেখলাম শহীদ মিনারে কবির অন্তিম শয়ান ।
চলে গেলেন আমাদের স্বাধীনতার কবি, ভালোবাসার কবি শামসুর রাহমান । সারা জীবন কাটিয়েছেন ঢাকা শহরে, ভালোবেসেছেন এই শহরকে । আরো ভালোবেসেছেন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষকে । আমরা যারা স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মেছি ; দারিদ্র, দুর্নীতি আর সন্ত্রাসে আমাদের যে-জীবন আজ দুর্বিষহ--তার মতো বলতে গেলে -- "আমার ছেলেবেলার কিংবা আমার যৌবনে কিংবা এখন এমন কিছু ঘটেনি যা ঝট করে বলা যায় । খুব সাধারণ একটা জীবন এবং এতে কোন চমকও নেই, কোন রংও নেই..." । আমরা অন্তত একটি বিষয়ে তৃপ্তির স্বাদ পেতে পারি--পরের প্রজন্মকে বলতে পারবো -- শামসুর রাহমান বেঁচে ছিলেন আমাদের সময়ে ।
(পরবাস-৩৮, ডিসেম্বর, ২০০৬)