সৌম্যেন্দ্রনাথ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র । তাঁর পিতা সাহিত্যিক সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা চারুবালা দেবী । প্রপিতামহ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নামকরণ করেন । সৌম্যেন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলা তথা ভারতের মহৎ সৃষ্টিশীল পরিবারটির সার্থক উত্তরসূরী -- বিশশতকের বাংলার বিশিষ্ট চিন্তাবিদ্ । দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, শিল্পকলা, ইতিহাস, দর্শন ও অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর লেখায়, বক্তৃতায় ও আলাপচারিতায় । দৈহিক সৌন্দর্যে অনুপম, মননশীলতায় অনন্য, অসাধারণ কন্ঠস্বর ও বাগ্মিতার অধিকারী । তাঁর কিছু ভাষণ আমার শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল -- প্রজ্ঞা, যুক্তিবাদিতা ও রসবোধের মিশ্রণে সেগুলি ছিল অনবদ্য । তাঁর রাজনৈতিক বক্তৃতাও সাহিত্যগুণে উজ্জ্বল হয়ে উঠত । বহু ভাষাতে তাঁর প্রগাঢ় দখল ছিল ও বিদেশী ভাষা থেকে অনুবাদও করেছেন বেশ কিছু রচনা । বিদেশী সাহিত্যে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি । এমনই এক বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারী সৌম্যেন্দ্রনাথ ।
আবার একই সঙ্গে তিনি ব্যতিক্রমী । তাঁর পরিবারের সাংস্কৃতিক ধারার বিপরীত পথে তিনি চলেছিলেন -- সক্রিয় রাজনীতি করেছিলেন আজীবন । তাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিস্থিতির বিচারে কাজটা খুব সহজ ছিল না হয়ত । তিনি একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন এই প্রসঙ্গে -- "সেখানে রবীন্দ্রনাথ, সেখানে দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ -- এনারা সব রয়েছেন । তার ভিতর থেকে আমি তখন ছিটকে বেরিয়ে চলে গেলুম একেবারে রাজনৈতিক জীবনেতে ।" কিন্তু উল্লেখযোগ্য এই যে এত সব কর্মকাণ্ডের মধ্যে থেকেও রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর সঙ্গী হয়ে থেকেছে জীবনের শেষ পর্যন্ত । তাঁর প্রাণে রবীন্দ্রনাথের গানের আসন "গভীর গোপন, মহা-আপন" । এই নিবন্ধে আমরা সৌম্যেন্দ্রনাথের এই বিশেষ দিকটি নিয়েই আলোচনা করব ।
দ্বিজেন্দ্রনাথের পরিবারে গান ছিল সহজাত । তিনি নিজে না গাইতে পারলেও অসামান্য সুরবোধ ছিল তাঁর এবং দ্বিজেন্দ্রনাথই বাংলা স্বরলিপির প্রথম উদ্ভাবক । সৌম্যেন্দ্রনাথের দিদি রমাদেবীর গান ছিল অতি মধুর এবং সে কারণে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ প্রিয়পাত্রী ছিলেন । তাঁর জ্যাঠতুতো দাদা দিনেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের সকল গানের কাণ্ডারী হিসেবে পরিচিত । এ হেন সাঙ্গিতীক পরিমণ্ডলে সৌম্যেন্দ্রনাথের জন্ম । বালক বয়স থেকে তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন । তাঁর স্মৃতিকথা "যাত্রী"তে লিখেছেন -- "খুব শিশুবয়স থেকে আমি গান গাইতে পারতুম । .... এক একদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে খাটে উঠে বসতেই মা আমাকে ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতে বলতেন । মশারির মধ্যে বসেই আমাকে গাইতে হত । আমার বয়স তখন পাঁচ বছর হবে, মনে পড়ে বাড়ির উঠোন ভরে গেছে লোকে, আমার দাদা দিনেন্দ্রনাথ মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, গায়ে আলখাল্লা, আমাকে তাঁর কাঁধে বসিয়ে তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে গান ধরেছেন, "সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি ।" একবার এগারোই মাঘে আমি অনেকগুলো গান গাইলুম । রবীন্দ্রনাথ আর আমি দুজনে "তুমি যত ভার দিয়েছ" এই কীর্তনটি গাই । তখন আমার বয়স সাত আট বছর হবে ।" ২৬শে জানুয়ারী ১৯০৯ সালে দ্য বেঙ্গলী পত্রিকা লিখেছিল (বঙ্গানুবাদ)-- "একটি শিশুকন্ঠ সংগীতে একটি অধিকন্তু মাত্রা যোগ করিয়াছিল । কন্ঠ ছিল শ্রীমান সৌম্য (সৌম্যেন্দ্রনাথ) ঠাকুরের । বালকের অসামান্য সুরসমন্বিত কন্ঠস্বর শ্রবণে উপস্থিত অতিথিবৃন্দ যত্পরোনাস্তি সন্তোষ লাভ করিয়াছিলেন । এমন আশা করা অন্যায় নহে যে পরিণত বয়সে এই বালক সংগীত জগতে দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ রূপে প্রতীয়মান হইবে ।" সৌম্যেন্দ্রনাথের সঙ্গীত প্রতিভার এই প্রথম বহি:প্রকাশ । আন্দাজ করা যায় অসাধারণ কন্ঠের গান বলেই ঐ সাত বছরের শিশুকে রবীন্দ্রনাথ নিজের সাথে গাইবার সুযোগ দিয়েছিলেন । রবীন্দ্রনাথের গানে এই তাঁর অবগাহনের শুরু, জীবনের শেষ অধ্যায় পর্যন্ত যা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে । তিনি লিখছেন, "এককালে রবীন্দ্রনাথের গানের বায়ুমণ্ডলে আমার প্রাণ সুরের নিশ্বাস নিয়েছে । প্রকৃতির আলোবাতাসের মতোই রবীন্দ্রনাথের গান সহজভাবে আমার জীবনকে ঘিরে ছিল সেদিন । গানের পর গান শুনেছি, গানের পর গান শিখেছি । শিখেছি গান রবীন্দ্রনাথের কাছে, শিখেছি দিনেন্দ্রনাথের কাছে ।"
১৯১৭ সালে মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি ও দিনেন্দ্রনাথ দ্বৈতকন্ঠে "দেশ দেশ নন্দিত করি" গানটি গেয়ে বিশেষ প্রশংসা লাভ করেছিলেন । এই বছরেই "ডাকঘর" নাটকের প্রথম অভিনয় হয় । এতে ঠাকুরদার ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং গেয়েছিলেন "গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ" -- তার সঙ্গে বাঁশি বাজিয়েছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ, তিনি হয়েছিলেন ঠাকুরদার চেলা । "গোড়ায় গলদ", "গান্ধারীর আবেদন", "বশীকরণ", "শকুন্তলা", "ফাল্গুনী" প্রভৃতিতেও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন । রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট সাংস্কৃতিক আড্ডা বিচিত্রায় তিনি ছিলেন নিয়মিত গায়ক । মুসলমান ওস্তাদের কাছে হিন্দুস্থানী গানের শিক্ষা করেছিলেন । তাঁর গলায় দরবারী সঙ্গীত শুনে রবীন্দ্রনাথ তার আদলে কয়েকটি গান বেঁধেছিলেন । ঐ গানগুলি থেকে সৌম্যেন্দ্রনাথের কন্ঠসম্পদের গভীরতার খানিকটা আন্দাজ পাওয়া যায় । গানগুলি -- "অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে", "কার বাঁশি নিশিভোরে বাজিল", "বন্ধু রহো রহো সাথে" । তিনটি গানই "শেষ বর্ষণের" জন্য রচিত । শেষ বর্ষণের প্রথম অনুষ্ঠানটি হয় ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৬ বিচিত্রাভবনে । এটি পরিচালনা করেছিলেন দিনেন্দ্রনাথ । অনুষ্ঠানের প্রধান গায়ক ছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ । দিনেন্দ্রনাথ থাকা সত্ত্বেও এই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচিত নতুন গান একে একে সৌম্যেন্দ্রনাথকে শিখিয়ে রাখছিলেন । এই প্রসঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্র (বুলা) মহলানবীশের একটি লেখা (কবিগুরু আয়োজিত সেকালের গানের আসর, অমৃত, ৩০শে জুন ১৯৭৮) থেকে উল্লেখ করি -- "ফাল্গুনীর অভিনয়ের গানের সঙ্গে কবির হুকুমে আমাকে বাঁশি বাজাতে হয়েছিল ... অথচ আমার চেয়ে অনেক ভাল বাঁশি বাজিয়ে কবির পরিবারেরই একজন ছিলেন ... তিনি হলেন কবির ভ্রাতুষ্পৌত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর । শুধু বাঁশি নয় -- রবীন্দ্রসঙ্গীতের রাজ্যে তখনকার দিনে সৌম্যেন্দ্রনাথের জুড়ি খুব কম ছিল । যেমন সুরেলা গলা আর তেমনি জোরদার । বিনা আয়াসে সৌম্যেন্দ্রনাথ যে কোনও গান নিজের গলায় তুলে নিতেন আর কোরাসে লিড্ নিয়ে গাইতেন । মহড়ায় সব সময় তাঁকে উঁচু পর্দায় গান গাইতে শুনতাম, কিন্তু আসল দিনে তিনি কোথায় সরে পড়তেন । রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের ভাণ্ডারের চাবিকাঠি দিয়েছিলেন বড় নাতি দিনেন্দ্রনাথকে আর চেয়েছিলেন সৌম্য দিনুবাবুর সহকারী হয়ে তাঁর গানের ডেপুটি কন্ট্রোলার হয়ে পড়ুন -- কিন্তু বিধিলিপি অন্য, সৌম্যেন্দ্রনাথ দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে গানের রাজ্য ছেড়ে কংগ্রেসের কাজে বেরিয়ে গেলেন । বহুদিন পর অবশ্য আবার সৌম্যেন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসরে দেখা গিয়েছিল, গাইয়ে বা মাস্টার হিসাবে না হলেও রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ হিসাবে তো নিশ্চয়ই ।"
পরবর্তী সময়ে সৌম্যেন্দ্রনাথ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে লাগলেন -- কিন্তু তাঁর রবিদাদার গান তখনও প্রাণে ও কন্ঠে । শেষ বর্ষণের প্রথম অভিনয়ের সময় কলকাতার কুখ্যাত পুলিশ কমিশনার টেগার্টকে হত্যার জন্য বোমা বানানো হচ্ছে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে সৌম্যেন্দ্রনাথের একতলার ঘরে, প্রতিদিন রাত্রে । এ সম্বন্ধে তিনি লিখছেন "যাত্রী"তে -- "আর প্রতিদিন নতুন গান তৈরী হচ্ছে । দিনের মধ্যে কতবার আসত তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) ভৃত্য বনমালী আমাকে তলব করতে । তাঁর কাছ থেকে গানগুলো শিখে অন্যদের শিখিয়ে দিতুম ।" এর থেকে বোঝা যায় তাঁর গীতিকুশলতার ওপর রবীন্দ্রনাথের কতখানি আস্থা ছিল যে সচরাচর যে-কাজটি দিনেন্দ্রনাথ করতেন, সেটিও সৌম্যেন্দ্রনাথ করছেন । রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যাপারে তাঁর অসামান্য দক্ষতা -- নিজে গাইতেন, তাছাড়াও অন্যদের শেখাতেন এবং সঙ্গীতের তত্ত্বচর্চা দ্বারা নিজের সঙ্গীতবোধকে উন্নত করে তুলেছিলেন । তিনি নিজেও বেশ কিছু নৃত্যগীতানুষ্ঠানের আয়োজন ও পরিচালনা করেছিলেন । শ্রমিক-কৃষক দলের সাহায্যের জন্য ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে সৌম্যেন্দ্রনাথ "ঋতুচক্র" অনুষ্ঠান আয়োজন করেন । তাঁরই উত্সাহে রেবা রায় নামক এক তরুণী সেই অনুষ্ঠানে অসামান্য নৃত্য পরিবেশন করেন । এই প্রথম বাঙালি ভদ্রপরিবারের রমণী প্রকাশ্য মঞ্চে নৃত্যে অংশ নিলেন । এর বেশ কিছুদিন পরে রবীন্দ্রনাথ "নটীর পূজা"র অভিনয়ে মেয়েদের যুক্ত করেন । ১৯২৫ এ সৌম্যেন্দ্রনাথ বিচিত্রাভবনে বর্ষার গানের অনুষ্ঠান করেন । তিনি ছিলেন এ সব অনুষ্ঠানের নিয়মিত গায়ক । রবীন্দ্রনাথ এই অনুষ্ঠানে যোগ দেন । পরের বছর (১৯২৬) `বর্ষামঙ্গল' এর আয়োজন হয় বিচিত্রাভবনে । ততদিনে সৌম্যেন্দ্রনাথ শ্রমিক-কৃষক দলের সম্পাদক । তাঁর রাজনীতি জীবনের দুই বন্ধু -- কাজী নজরুল ও নলিনীকান্ত সরকার -- দুজনেই গানের জগতের মানুষ । তিনি লিখছেন -- `কত জায়গায় নলিনীকান্ত, নজরুল ও আমি গান গেয়েছি ।' দলের অর্থসংকটের জন্য ১৯২৬ এ `বসন্ত উত্সব' আয়োজন করলেন অ্যালবার্ট হলে ।
এর পরে একটা সময়ে গানের সঙ্গে ত্রক্রমে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে গেল । প্রথম দিকে গান্ধিজীর কংগ্রেস, অরবিন্দর নীতি, তারপর নজরুল ইসলাম ও মুজাফ্ফর আহমেদের শ্রমিক-কৃষক রাজনীতি ও সবশেষে লেনিনের সাম্যবাদী সমাজনীতিতে তিনি সম্পূর্ণ ব্যপৃত হলেন । সৌম্যেন্দ্রনাথের রাজনৈতিক জীবনের এই বিবর্তনের কথা "যাত্রী"তে বিশদ ভাবে বর্ণিত আছে । জার্মানী, মস্কো ইত্যাদি জায়গায় তাঁকে যেতে হল দলের কাজে । তখনকার উদীয়মান সমাজদর্শনের প্রভাবে ত্রক্রমশ তাঁর ধারণা হল গান গাওয়া ইত্যাদি সুকুমার শিল্পের মধ্যে একধরনের ফাঁক আছে -- তাঁর নিজের কথায় -- "জীবনের চেয়ে গানকে বড়ো করাটা এসথেটিক ফাঁকি ।" কিন্তু সচেতনভাবে তিনি গানের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও অবচেতনে রবীন্দ্রনাথের গান তার অচল আসনে প্রতিষ্ঠিত রইল ।
মস্কো-তে রবীন্দ্রনাথ ও সৌম্যেন্দ্রনাথ |
সৌম্যেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন "গানের সঙ্গে আমার আড়ি হয়ে গেছে অনেক দিন । ... তবু আজও যে মাঝে মাঝে কক্ষচ্যুত হয়ে ছিটকে এসে পড়ি গানের মহলে, সেটা নিছক আমার অবুঝ রক্তের অপরাধে, আমার রক্তের পাগলামিতে ।" গান তার নীরব অপেক্ষা নিয়ে কোথায় যেন ছিল, ফিরিয়ে আনল তাকে আবার সেই জগতে ।
রবীন্দ্রনাথ নিজের গানগুলির প্রচারের ভার সৌম্যেন্দ্রনাথকে নিতে বলেছিলেন । কবির জীবিতকালে তিনি সে ভার নিতে পারেননি বলে সৌম্যেন্দ্রনাথ দু:খ প্রকাশ করেছেন । সেই ইচ্ছাকে রূপ দিতে সক্রিয়ভাবে রবীন্দ্রনাথের গানের জগতে ফিরে এলেন -- তাকে বিশুদ্ধ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নিলেন । ১৯৪৮ সালে মহর্ষিভবনে প্রতিষ্ঠা করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার সংস্থা "বৈতানিক" । ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী তা দেখে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন "তোমরা এই অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালালে ।" রবীন্দ্রনাথের গান শুধু গাওয়া নয়, তার প্রকৃত মর্ম উপলব্ধির আদর্শ নিয়ে সৌম্যেন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম আলোচনা সহযোগে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে একটি অনুষ্ঠান করে । রবীন্দ্রসঙ্গীতের অর্ন্তনিহিত তত্ত্বকে জনগণের মধ্যে প্রসারিত করার জন্য তিনি শুরু করলেন প্রতি বছর ২৫ শে বৈশাখ মহর্ষিভবনে আলোচনা সহযোগে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান । এ ধরনের অনুষ্ঠান সে সময় আলোড়ন তুলেছিল । তাঁর সঙ্গীতচেতনা কতটা গভীর ছিল, তা তাঁর আলোচিত বিষয়গুলি থেকেই বোঝা যায় । বিষয়গুলি -- সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ত্রক্রমবিকাশ, রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুরবৈচিত্র্য, রবীন্দ্রসঙ্গীতে দেশবিদেশের সুরের ধারা, রবীন্দ্রসঙ্গীতে তানের স্থান, রবীন্দ্রভৈরবী, রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুরের ছন্দ, রবীন্দ্রনাথের গান ও বাংলার লোকসঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথের ঋতুসঙ্গীত । তাঁর নিজস্ব অনন্য সাহিত্যচেতনা ও সঙ্গীতচেতনার সমন্বয় এই আলোচনাগুলি । সৈংআম্যেন্দ্রনাথের অসাধারণ বাক্ভঙ্গিতে এই আলোচনাগুলি সেদিন যাঁরা শুনেছিলেন, তাঁদের মনে নিশ্চয়ই তা অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে আছে । এই ন'টি প্রবন্ধ নিয়ে `রবীন্দ্রনাথের গান' নামে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দে । এই বইয়ের মধ্যে সৌম্যেন্দ্রনাথকে এমন ভাবে পাওয়া যায় যা তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ "ত্রয়ী", "যাত্রী", "রাশিয়ার কবিতা" ইত্যাদি থেকে স্বতন্ত্র ।
এতদিনের বহুচর্চার পর আজ আমরা রবীন্দ্রনাথের গান সম্বন্ধে যা চিন্তা করি বা জানতে আগ্রহী হই, তার অনেকাংশই সৌম্যেন্দ্রনাথ তাঁর গভীর রবীন্দ্রসঙ্গীত চেতনা নিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন । রবীন্দ্রনাথের গানের মর্মকথা তাঁর কাছে মূর্ত হয়েছিল, -- তিনি বলেছিলেন -- "রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানগুলিতে কখনো রাগের রূপ ফোটাবার আধার হিসেবে ব্যবহার করেননি .... কথা ও সুরের দ্বৈত প্রকাশের লীলাভূমি তাঁর গান ।" রবীন্দ্রনাথ কিভাবে মার্গসঙ্গীতের আশ্রয়ে থেকেও নিজের সুরসৃষ্টি করেছেন, তাঁর গানে বিভিন্ন রাগের মিশ্রণ, লোকসঙ্গীতের সুর ব্যবহার, বিদেশী সুরের গান সৃষ্টি ইত্যাদি বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁর অলোচনা চলেছে । তিনি অনুভব করেছেন যে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভারতীয় সঙ্গীতের স্রোতহীন বদ্ধ জলে নতুন সুরসৃষ্টির স্রোত । ভারতীয় দরবারি সঙ্গীতে গানের কথা ও সুরের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনও মিল ছিল না । সেই মিল ঘটালো রবীন্দ্রনাথের গান । তিনি আলোচনার মাধ্যমে বুঝিয়েছেন যে নতুন সুরসৃষ্টির জন্য কীভাবে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন রাগরাগিণীর মিশ্রণের চেষ্টা করেছেন -- তাতে মনে সবরকম অনুভূতি প্রকাশ সম্ভব হয়েছে । রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরবিকৃতি নিয়েও তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । এই প্রসঙ্গেই তাঁর "রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুরবদল" প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় "সমকালীন" পত্রিকায় ১৯৫৫ সালে ও যথারীতি সঙ্গীতজগতে আলোড়ন ওঠে । রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকাকালীন যে স্বরলিপি তৈরি হয়েছে, তা বজায় রাখার পক্ষে তিনি মত প্রকাশ করেন । এইভাবে রবীন্দ্রনাথের গানের বহু দিক নিয়ে সৌম্যেন্দ্রনাথ ভেবেছেন, অনেক ক্ষেত্রেই যুগের থেকে এগিয়ে থেকে । অনবদ্য ভঙ্গিতে তাঁর লেখনী এগিয়ে গেছে রবীন্দ্রনাথের গানের অপরূপ ব্যাখ্যায় । দরবারি, লোকসঙ্গীত, পাশ্চাত্য সুর ইত্যাদি সব কিছু নিয়ে তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা সৌম্যেন্দ্রনাথ অতি সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এই "রবীন্দ্রনাথের গান" বইটিতে । বাউল সুরের পরীক্ষা সম্বন্ধে অনুপম ভাষায় বলছেন, "খাঁটি রসের সৃষ্টি সূর্যমুখী ফুলের মত -- ফুটবে মাটিতে, পরিপুষ্ট হবে মাটির রসে, কিন্তু তাকিয়ে থাকবে আকাশের দিকে ।" বস্তুত: রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনের অজস্র কর্মপ্রয়াসের মধ্যে তাঁর সম্পূর্ণতার ইতিহাস গানেই সব থেকে বেশি পাওয়া যায় । এই সম্পূর্ণ মানুষটিকে খুঁজে নেবার কাজটি সৌম্যেন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন "রবীন্দ্রনাথের গান" বইটিতে ।
|
বৈতানিক ছাড়াও ১৯৬৫ সালে সৌম্যেন্দ্রনাথ টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপন করলেন । রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে চর্চা ও জনগণের মধ্যে তা পৌঁছে দেবার জন্য তাঁর এই প্রয়াস । তিনি নিজেও "পারানী" নামে দুখণ্ডের একটি গানের বই লেখেন । এই গ্রন্থের কিছু গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের ছায়া যেন পাওয়া যায় ; দেশী বিদেশী সুরের মিশ্রণও কিছু গানে আছে । নতুন দুনিয়ার গানও তিনি বেশ কিছু লিখেছিলেন, যাকে গণসঙ্গীত বলা যেতে পারে ।
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে নিরলস সাধনা ও তাকে পরিপূর্ণভাবে আত্মগত করার যে মহৎ কাজটি তিনি উপলব্ধি ও মননশীলতা দিয়ে করে গেছেন, তাতে সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথের সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে আমাদের মধ্যে রয়েছেন ।
(ছবিগুলি সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যাত্রী গ্রন্থ (বৈতানিক, ২০০৩) থেকে নেওয়া হয়েছে)
(পরবাস, মার্চ, ২০০৬)