• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৭ | মার্চ ২০০৬ | প্রবন্ধ
    Share
  • মুক্ত বাক্‌, মুক্ত প্রাণ : নবনীতা দেবসেন

    ॥১॥

    সময়টাই ছিল অন্য । প্রতিবাদে ঝলমলে উজ্জ্বল যৌবনের দিন - তখনও যৌবন স্বপ্ন দেখতো এক মুক্ত বাক্‌, মুক্ত পৃথিবীর - যেখানে সাম্য আছে সুবিচার আছে, শান্তি আছে । কি কবিতায়, কি সঙ্গীতে, কি ছাত্র রাজনীতিতে সর্বত্র মুক্তির ডাক, সাম্যের হাঁক উঠেছিল । যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল পশ্চিমের তারুণ্য, কি ইয়োরোপে, কি আমেরিকায় । সেটা ছিল ষাটের দশক । ভিয়েত্নামের সেই ভয়ংকর সময় তখন - তরুণদের মধ্যে সাড়া পড়েছে - প্রশ্ন তুলেছে তারা অকারণে আমরা বিদেশে উজিয়ে গিয়ে অপরিচিত মানুষদের খুন করবো কেন ? নিজেরাই বা মেরে মরে উচ্ছন্ন হয়ে যাবো কেন ? জগতের কোন উপকার সাধিত হচ্ছে এই যুদ্ধে ? যুদ্ধে কবে মানুষের কী উপকার হয়েছে ? তখন কিউবাতে বিপ্লবী স্বাধীন সরকার সদ্যোজাত । এই শুভসময়ের গোড়া থেকেই আমি মার্কিন দেশে ছাত্রী ছিলুম - আস্তে আস্তে রং বদলাতে দেখেছি । এখন ভাবলেও রোমাঞ্চিত লাগে, সাক্ষী ছিলুম বটে কিছু অসামান্য মহার্ঘ্য মুহূর্তের । পৃথিবীর ইতিহাসে যে মুহূর্তগুলি কোনোদিনও মুছে যাবার নয় ।

    পশ্চিমগোলার্ধের সেটাই ছিল হয়তো যুদ্ধপরবর্তী বিশ শতকের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সময় - মৃত্যুর বিরুদ্ধে, অপ্রেমের বিরুদ্ধে যৌবনের প্রতিবাদের । পঞ্চাশ দশকের মার্কিন দেশে ছিল ম্যাকার্থির রাজত্ব । বাক্‌-এর ঘোরতর বন্দিদশা । কী বললে যে তুমি হঠাৎ ণধণ্ণযং ধী লত্রছস্‌ংশঠবছত্র বিঞঠটঠঞঠংয -এর কুনজরে পড়বেনা - তোমার পাশের বাড়ির অমায়িক মানুষটিই যে তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করবেনা, - তা তুমি জানো না । কী করলে, কী বললে যে হঠাৎ তোমার চাকরি যাবে, তোমাকে হয় জেলে পুরে দেবে, নয়তো দেশ থেকে বিতাড়ন করবে, তা তোমার জানা নেই । সর্বত্র একটা সন্দেহের, বাধার, নিষেধের অন্ধকার তমশ্ছায়া । তারই বিরুদ্ধে বেঁকে দাঁড়ালো মার্কিনী যৌবন ষাটের দশকে, কেনেডির মুক্ত আলোয় । ওদিকে ফ্লাওয়ার চিলড্রেনদের গানে-কবিতায়, নেশা-ভাঙে, ও স্বপ্ন দিয়ে অস্ত্রের বিরোধিতা শুরু হলো - এদিকে জেগে উঠেছে কালোমানুষ ।

    "ঝী ষ্ধণ্ণ স্ঠযয স্‌ং ছঞ ঞচ্‌ং ঢছবূ ধী ঞচ্‌ং ঢণ্ণয ঠী ষ্ধণ্ণ ংঈঠত্ররু স্‌ং ত্রধগচ্‌ংশং" -গাইছেন ডিক গ্রেগরি - তখনও কালোমানুষদের জন্য দক্ষিণের অঞ্চলে বাসের পিছনদিকের আসনগুলি নির্দিষ্ট ছিল - আমাকে পিছনে খুঁজে না পেলে বাসের সামনের দিকে যাও - "হৃধণ্ণ'ত্ৎ ংঈঠত্ররু স্‌ং যঠঞঞঠত্র' শঠভচ্ঞ ঞচ্‌ংশং!" --অসামান্য সেই গান ।

    তখনই আলাবামাতে এক কালো যাজক মার্টিন লুথার কিং বক্তৃতা দিয়ে স্বপ্ন বিলোচ্ছেন -- ঝ চ্ছটং ছ রুশংছস্‌... এবং সেই স্বপ্ন সত্যে পরিণত করছেন । শুধু কালোমানুষ নয়, জেগে উঠেছে মেয়েরাও । যত নিপীড়িত, বঞ্চিত, অপমানিত মানুষরা তখন নতুন করে নিজের কথা ভাবতে শুরু করেছে । শুরু হয়েছে পশ্চিমের পৃথিবী জুড়ে ষাটের দশকের মুক্তিযুদ্ধ । আদর্শের জন্য মানবতার জন্য সচেতনতার লড়াই । পশ্চিমী যন্ত্রসভ্যতার দানবিক লোভের, পৈশাচিক উত্পীড়নের হাত থেকে মুক্তির লড়াই । সিভিল রাইটস মুভমেন্ট । সেই লড়াই অবশ্য থামেনি । সেই উত্পীড়নও থামেনি । কিন্তু সে তো অন্য কথা । তখন কালোদের পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েরা ।

    বেটি ফ্রীডনের কন্ঠে নারীমুক্তির ধ্বনি শোনা যাচ্ছে । আমার কপালগুণে, আমিও এই আশ্চর্য ব্যাকুল স্বপ্নময় প্রতিবাদী যৌবনের সামিল হতে পেরেছিলুম, ইংলণ্ডেও, আমেরিকাতেও । ইংলণ্ডে তখন বার্ট্রাণ্ড রাসেল স্বয়ং ঙবী(ঙছস্‌ংঋছঠভত্র ংঈধশ ব্ণ্ণবত্‌ংছশ ঈঠযছশস্ছস্‌ংত্রঞ) -এর সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দেন । - অলডারমাস্টন বলে একটি জায়গায় ব্রিটিশ সরকারের পারমাণবিক বোমা প্রস্তুতির গবেষণাকেন্দ্র ছিল, সেখানেই মিছিল করে যেতেন তিনি প্রতিবছর । ছাত্র, অধ্যাপক, কবি, শিল্পী সবধরনের শান্তিপ্রিয় মানুষেরা তাতে যোগ দিতেন, সারা ইংলণ্ড থেকে জড়ো হয়ে বেরুতো সেই বামপন্থী মিছিল, শান্তিবাদী মিছিল -- ত্‌ংইরুংশস্ছযঞধত্র ংঔছশবচ্‌ ব্রিটিশ যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম নাম । আমিও তাতে হেঁটেছিলুম আমার সিংহলী বন্ধু কুমারী জয়বর্ধনের সঙ্গে -- কিন্তু তিনদিন ধরে নয় । একদিনই । সারাদিন । তিনদিন ধরে হেঁটে মিছিল লণ্ডন থেকে অলডারমাস্টনে গিয়ে পৌঁছে, "ঘেরাও" করতো, "ধর্না" দিতো, সারাদিন স্লোগান দিতো, প্রতিবাদ জানাতো ।

    ১৯৬৩-তে ঝত্রঞংশত্রছঞঠধত্রছৎ মংযঞ জছত্র মশংংঞষ্‌ সই হল । ঙবী র প্রভাব বিশ্ব রাজনীতিতে প্রমাণিত হল । আমাদের অত হাঁটাহাঁটিতে কাজ হল । কাজ কি হল ? অলডারমাস্টনে তো এখনও মার্চ চলছে - প্রতিবছর । এখন যায় প্রধানত ইউনিয়নগুলো থেকে শ্রমিকরা । আর নাতিনাতনীর প্র্যাম ঠেলে সেই ষাটের দশকের দাদু ঠাকুমারা । নবীনযৌবনের কোনও আগ্রহ নেই । প্রতিবাদী ছেলেমানুষীতে সময় নষ্ট না করে তারা দু'পয়সা বেশি রোজগার করে নেবে । ১৯৬০-৬৩ তে ১০০,০০০ মানুষের ভিড় অলডারমাস্টনে হাঁটতো । আনবিক অস্ত্রের গবেষণাকেন্দ্রটি এখনও বন্ধ হয়নি । "জছত্র-ঞচ্‌ং-জধস্ঢ!" স্লোগান আমাদেরই সময়ের স্লোগান । এ তো ইংলণ্ডের কাহিনী । ঙবী র গল্প ।

    আজ বলতে বসেছি বার্কলের কথা - ১৯৬৪ তে সেখানে যে ছাত্রবিপ্লব হয়েছিল যনৌ বলে প্রখ্যাত সেই যশংং নৃংংবচ্‌ ংঔধটংস্‌ংত্রঞ -এরও সামিল হবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার । ১৯৬৪-৬৫ আমি বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ধৈযঞ ঈধবঞধশছৎ যংত্ত্ধগ ছিলুম । প্রত্যেকদিন ক্লাসিক্স্‌ বিভাগের লাইব্রেরিতে নিজের কাজ করি -- ঠিক তখনই ঘটেছিল সেই অবিশ্বাস্য ঘটনা -- "মুক্ত করো বাক্‌" বলে ছাত্র এবং অধ্যাপকদের মিলিত প্রতিবাদ -- ছবছরুংস্ঠব ংঈশংংরুধস্‌ এর অধিকার চেয়ে । মাসটা ছিল ডিসেম্বর -- ডিসেম্বরের তিনটে উত্তাল দিনের ঘটনা, ২রা থেকে ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৬৪, বার্কলেতে ফ্রী স্পিচ মুভমেন্টের ইতিহাস রচিত হয়েছিল । আমি কফি খেতে গেছি দেখি ছাত্রদের "নঠঞ-ঠত্র" চলছে । "মংছবচ্‌-ঠত্র" চলছিল বটে টীচারদের । পাশের চত্বরে -- কিন্তু এটা হচ্ছে নৃশধণ্ণৎ ণছত্ৎ এর সামনে । আমাদেরই বন্ধু ংঔছশঠধ নছশঠধ, ঁংশশষ্‌ ওণ্ণঢঠত্র, জংঞঞঠত্রছ ংঋংইঞংংঊছশ আর ত্রিত্র ষ্ণধত্রুঢংশভ বক্তৃতা দিচ্ছে । কলকাতার কাছেও তা রীতিমতো "জ্বালাময়ী" ভাষা । ছাত্রদের ক্যাম্পাসে রাজনীতি করা চলবেনা - এই হুকুম জারি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ-- সেই হুকুমেরই প্রতিবাদ । দ্বিতীয়ত, ভিয়েত্নামযুদ্ধে ছাত্রছাত্রীরা কেন যোগ দেবে ? তৃতীয়ত, কিউবা থেকে মার্কিনী হাত হটিয়ে নাও ! - প্রধানত যদিও ফ্রী স্পিচ মুভমেন্ট চ্যান্সেলরের অন্যায় কানুন জারি করার বিরুদ্ধে, কিন্তু শুধু সেখানেই থেমে ছিলনা -- ক্যাম্পাস পলিটিক্স থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বে -- মার্কিন বিদেশনীতির বিপক্ষে । আমারই বন্ধুরা বামপন্থী ছাত্রনেতা, তারাই বক্তৃতা দিচ্ছে, আমি স্বভাবতই তাদের দলে ঢুকে গেলুম চিন্তাভাবনা না করেই । অত্যন্ত ন্যায্য কারণে ছাত্ররা প্রতিবাদ জানাচ্ছে -- ক্যাম্পাসে রাজনীতির আলোচনা চলবে না মানে ? ব্ছঞচ্ছত্র ষ্ণত্ছজ়্‌ংশ, ঁধচ্ত্র নংছশত্‌ং ইত্যাদি অধ্যাপকরাও মাঠে নেমে পড়লেন - কেউ বিপক্ষে কেউ সপক্ষে বক্তৃতা দিতে লাগলেন । আমার উত্তেজনা, আনন্দ, সীমাহীন । এতবছরের দেখা মার্কিন ছাত্রজগৎ কখনও এমনভাবে জেগে ওঠেনি । আমার মনে পড়ে ১৯৬০-এ জছষ্‌ ধী ঠৈভয ঘটনার পরে আমি উত্তেজিত হয়ে হার্ভার্ডের ইয়ার্ডে ঘুরছি, কোথাও কোনও উত্তেজনা নেই । কোথাও কোনও মীটিং হচ্ছে না, ছাত্ররা পড়াশুনোয় ব্যস্ত । কী আশ্চর্য দেশ রে বাবা ? হঠাৎ দেখি রাজপথে ছাত্রদের মিছিল বেরিয়েছে । যাক্‌ - প্রতিবাদ ক্যাম্পাসে না হোক, রাজপথে তো আরোই ভালো ! আমি দৌড়ে মিছিলে যাই - ওমা ? এ কী ? এদের সঙ্গে যে জছত্রত্রংশ আছে -- তাতে লেখা, "আমরা ল্যাটিন ভাষাতেই আমাদের গ্রাজুয়েশন সার্টিফিকেট চাই -- ইংরিজিতে লেখা সংশাপত্র নেব না !" এ একটা প্রতিবাদী বিষয় হোলো ? যে ল্যাটিনে এতকাল ঙছত্ঠভশছৃচ্ষ্‌ করত সে মারা গেছে তাই ইংরিজিতে সার্টিফিকেট লেখা হচ্ছে ! এই তো এদের সচেতনতা ।

    নৃশধণ্ণৎ ণছত্ৎ হলো প্রধান রুংইস্ঠত্রযঞশছঞঠটং জণ্ণঠত্রুঠত্রভ । কেমন করে যেন আমরা সবাই ত্রক্রমশ তার মধ্যে প্রবেশ করে সেটিকে দখল করে বসলুম -- এটাই হলো আমাদের প্রতিবাদের ভাষা -- সেখানে বারান্দা থেকে মাইকে বক্তৃতা দিচ্ছে মারিও আর ওদিকে ঁধছত্র জছংজ়্‌ গীটার বুকে গান করছেন "ষংংংঋ ভণ্ণত্র ংষ্‌ং ধত্র ঞচ্‌ং ংঋশঠজ়্‌ং ... ণধত্রু ধত্র !" গায়ে কাঁটা দেওয়া সব সঙ্গীত মুহূর্ত -- কলকাতাতে এখন পচে-যাওয়া, কিণ্ডারগার্টেন ইস্কুলের প্রার্থনাসভার গান-- "ঘং যচ্ছত্ৎ ধটংশবধস্‌ং" গাইছেন । -সেই গান তখন রাজা-গান ! সেই গান গেয়েই মার্টিন লুথার কিং তাঁর ওয়াশিংটন মার্চ করেছিলেন । প্রচণ্ড উত্তেজনা -- কেননা সশস্ত্র পুলিশ আমাদের ঘেরাও করেছে । ওদেশে সর্বদাই ঙছস্‌ংঋণ্ণয ধৈত্ঠবং বলে একজাতের পুলিশ থাকে ! এখনও থাকে কিনা জানিনা, তখন তো থাকতো - (সত্তরের দশকে ষংত্রঞ এ ৪জন ছাত্রছাত্রীকে তারাই মেরেছিল) কোমরে বন্দুক ঝুলিয়ে । একসময়ে শুনছি ঘোষণা হচ্ছে -- "পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করতে এসেছে -- খবরদার তোমরা কেউ শক্তি প্রয়োগ করে বাধা দিওনা - আমাদের প্রতিবাদ হিংসার বিরুদ্ধে, অহিংস প্রতিবাদ -- কিন্তু তোমরা একেবারে গা এলিয়ে দেবে -- ওরা আমাদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাক -- হেঁটে হেঁটে ওদের পিছু পিছুও যাবনা আমরা -"

    আমি ভাবছি অমর্ত্য তো তাঁর দোর-আঁটা অফিসে বসে লেখালিখি করছেন, তিনি কিছুই জানবেন না আমাকে ধরে যদি । ইতিমধ্যে আবার ঘোষণা -- "যত বিদেশী ছাত্রছাত্রী আছো আমাদের সঙ্গে -- তোমরা বেরিয়ে যাও -- খবরদার গ্রেপ্তার হোয়োনা, তাহলে তোমাদের ভিসাও যাবে, জলপানিটাও যাবে, হয় তো ডিপোর্ট করে দেবে -- তোমরা বিলডিংয়ের বাইরে থেকেই আমাদের শক্তি যোগাও এবং ধন্যবাদ জোন বায়েজকে, তুমিও বাইরে থেকে আমাদের উত্সাহ দান করো -" এই ঘোষণা শুনে আমরা জনা কুড়ি ছাত্রছাত্রী -- একলা আমিই ভারতীয় মেয়ে -- বেরিয়ে এলুম । এবং সঙ্গে জোন বায়েজও । পুলিশের প্রতিবাদ ভয়ংকর চেহারা নিল এরপর । সেদিন রাত্রে মোট ৮০৬ জন ছাত্রছাত্রী গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গিয়েছিল, বাক্‌ স্বাধীনতার জন্য যুঝতে ।

    ইতিহাস তৈরি হয়ে গেল । ছাত্র রাজনীতিতে আমেরিকায় এত বড় প্রতিবাদ কোনোদিনই হয়নি ।

    অনেক বছর পরে আমাদের "ভালোবাসা" বাড়িতে একদিন এসেছিল, ঁংশশষ্‌ ওণ্ণঢঠত্র -- সেদিনকার অন্যতম বিপ্লবী ছাত্রনেতা ংঔছশঠধ, জংঞঞঠত্রছ, ষছশত্‌, শিঞ -দের বন্ধু । তার মুখে শুনেছিলুম প্রত্যেকের জীবন ভিন্নপথে মোড় ঘুরেছে । বেশিরভাগই মাষ্টারি করছে - জেরি নিজে নাকি ব্যবসায়ী হয়ে গিয়েছিল এবং অসাধুও । জেরি আর মারিও এই দুজনের অকাল মৃত্যুর দু:সংবাদ কলকাতায় পৌঁছেছিল, বিভিন্ন সময়ে । খুব মনকেমন করেছিল তখন । ওদের অবশ্য কেউ ভুলবে না । ছাত্র ইতিহাসে কিংবদন্তি ঘটনা যশংং নৃংংবচ্‌ ংঔধটংস্‌ংত্রঞ এর সঙ্গে মিশে গিয়েছে ওদের নামগুলি চিরদিনের মতো ।

    ॥২॥





    নাম অবশ্য বেশিদিন মনে রাখেনা মানুষ । এই তো সেদিন কাগজে পড়লুম রোজা পার্কসের মৃত্যুর খবর । তিনি যে এতদিন জীবিত ছিলেন তাই জানা ছিল না । অথচ আমার তরুণ বয়সের অন্যতম হিরোয়িন ছিলেন রোজা পার্কস । পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে আমি আমেরিকাতে ছাত্রী হয়ে গিয়েছিলুম -- তখন রোজা পার্কসের নাম বামপন্থী হৃদয়ে সূর্যোদয় ঘটাচ্ছে -- একটি অসীম সাহসী আত্মবিশ্বাসী কালো মেয়ের প্রথম পদক্ষেপে কেঁপে উঠেছিল শ্বেতাঙ্গ বে-আইনের নড়বড়ে খাঁচাটা । বাসের শেষদিকের সীটে বসাই ছিলো কালোদের নির্ধারিত নিয়ম -- আমেরিকার দক্ষিণভাগে তুলোচাষীদের কালো ত্রক্রীতদাস দাসীদের তখনও এই সামান্য গণতান্ত্রিক অধিকারটুকুও ছিলনা যে তারা যেকোনও আসনে বসতে পারবে । অথচ আইনের হিসেবে ত্রক্রীতদাসপ্রথা উঠে গেছে । আমেরিকার গণতান্ত্রিক সরকার চালু । একদিন সামনের আসন ভরে গিয়েছিল বলে এক শ্বেতাঙ্গ বাসের পিছনের দিকে বসতে গেলেন । কিন্তু কালোদের পাশে গিয়ে তো বসা যায় না ? তাই কালোদের তিনি বললেন উঠে যেতে । উঠে গেলও তারা -- কেবল একটি কালো মেয়ে উঠল না । সে অবাক হয়ে বললো সাদা যাত্রীটিকে : "কেন ? ওই তো কত খালি সীট আছে পিছনদিকের । আমার এই আসন আমি কেন ছাড়ব ? আপনি বসুন না ।" রোজাকে জোর করে নামানো হল । তাকে ১৮ ডলার জরিমানা করা হল । তখনকার দিনে সেটা প্রচণ্ড ধাক্কা । ক্ষেপে উঠল মার্কিন দেশের কালোমানুষ । মন্টগোমারির একজন তরুণ কালো ধর্মযাজক -- মার্টিন লুথার কিং রোজা পার্কসের পক্ষ নিয়ে লড়তে রাস্তায় নামলেন । শুরু হল অহিংস প্রতিবাদ -- কালো মানুষরা ঐ রুটের বাসে ওঠাই বন্ধ করে দিলেন । পুরো একবছর ধরে বাস বয়কট চলবার পরে টনক নড়লো আদালতের । ধ্বসে পড়ল নোংরা বর্ণবিদ্বেষের বালির পাঁচিল । শেষ পর্যন্ত বদল হল মার্কিন দেশের বিদঘুটে অসাম্যের আইন । কৃষ্ণাঙ্গদের বাসের পিছনের সীটে বসানোর অন্যায় আব্দার উঠে গেল । এবার বাস সকলের ।

    একটি মেয়ে `না' বলে উঠেছিল ।
    একটি মেয়ে তার আসন ছাড়েনি ।
    সমগ্র মার্কিন দেশ তারই সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠল `না' । বলে উঠল, গণতান্ত্রিক অধিকারের কোনও সাদাকালো নেই ।

    আমি যখন ছাত্রী, তখন ওদেশে নানাদিক থেকে জানলা দরজা খুলে যাচ্ছে, খোলা হাওয়া ঢুকছে -- যদিও ণধণ্ণযং ধী লত্রস্‌ংংইশঠবছত্র বিঞঠটঠঞঠংয তখনও সক্রিয় । আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে স্‌ংংইশঠবছত্র ঙঠটঠৎ ত্ঠঢংশঞঠংয লত্রঠধত্র ---রোজা পার্কসের নাম তখন আমাদের মুখে মুখে । সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল । নব্বই পার হয়ে, ভিমরতি ধরেছিল তাঁর । রোজা পার্কস নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন । জনতার চোখের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে । এতদিন যে তিনি জীবিত ছিলেন সেটাই খেয়াল ছিল না কারুর । এবার তিনি মরিয়া প্রমাণ করলেন যে তিনি মরেন নাই । খবরটা পড়ে অনেক কিছু মনে পড়ে গেল ।

    রোজা পার্কসের গল্প আমাকে বলেছিল ইনডিয়ানাতে, একটি কালোমেয়ে । আমার বন্ধু, আমার হস্টেলেই থাকত সে -- জেন । জেন মুসলমান হয়ে গিয়েছিল । ম্যালকম এক্স-এর একজন মন্ত্রশিষ্যা । - আর তার ছোটভাই জুলিয়ান হয়েছিল প্রথমসারির সক্রিয় বামপন্থী রাজনীতিক । ইলেকশনে জিতে ওয়াশিংটনে থাকতো, কালোদের জন্য নিয়ত সংগ্রাম করতো । জেন ইসলামী নিয়মে রোজা পালন করত । ওর কাছেই আমি দুটি বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞানলাভ করেছিলুম । এক, মার্কিনি কৃষ্ণাঙ্গদের সমস্যা বিষয়ে, আর দুই, ইসলাম ধর্মের আচার বিচার বিষয়ে । এবং জেন, আমার অ্যালবামে আমাদের `ভালো-বাসা' বাড়ির ছবি দেখে সত্যি সত্যি অবাক হয়ে বলেছিল, "ইনডিয়াতে এরকম তিনচার তলা বাড়ি আছে ? তোমার বাবা কি রাজা ? আমি তো ভাবতাম ওখানে সবাই গাছের ওপর বাসা বেঁধে থাকে !" কিন্তু ওর চেয়েও অবাক আমি হয়েছিলুম ওর ইনডিয়া বিষয়ে এত গভীর অজ্ঞতা দেখে । তারপরে দেখলুম জেন মোটেই ব্যতিক্রমী নয়, জেনই সাধারণের প্রতিনিধি, যখন আমার আরেক বন্ধু, নেওমি আমার নতুন দক্ষিণী সিল্কের শাড়িতে হাত বুলিয়ে মুগ্ধকন্ঠে বলেছিল, "ঈশ তোমরা কত দ্রুত প্রগতির পথে এগিয়েছো -- এই তো সেদিনই মহাত্মা গান্ধী তোমাদের সুতো কাটতে শেখালেন এরই মধ্যে এরকম সিল্ক বানিয়ে ফেলেছো ?" এদের সাধারণ জ্ঞানের বহর দেখে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল । পরে ভেবে দেখেছি এদের তো দরকার হয়নি ভারতবর্ষ বিষয়ে জানবার -- এরা জানে শুধু ইয়োরোপকে । কতো ক্ষুদ্র ছিল ওদের জগৎ সংসার । কতো অপুষ্ট । অপূর্ণ ।

    এখন বরং অনেক বেশি জানে মার্কিন দেশের মানুষরা ভারতবর্ষের কথা । ভারতীয় খাবার, ভারতীয় পোশাক, ভারতীয় সঙ্গীত, ভারতীয় সিনেমা, ভারতীয় "ইংরিজি" সাহিত্য - স-ব ! মার্কিন দেশে এখন বোঝ ভারতীয় বাসিন্দাদের সংখ্যা তো অল্প নেই আর ? তাদের সন্তান-রাও ব্রিলিয়ান্ট হয়ে উঠছে । সত্তর দশক থেকেই দৃশ্যপট পাল্টে গেছে -- পুরোনো দিনের প্রবাসী ভারতীয়দের জীবন, তাদের বিশ্বাস, তাদের স্বপ্ন, সবই ছিল একেবারে আলাদা । বছর বছর দেশে আসা যেতনা তখন, তাই মনপ্রাণটা হয়ে থাকতো দেশে ভরপুর । এখন যাহা কলকাতা তাহাই নিউজার্সি । যাহা নিউজার্সি, তাহাই বাঙ্গালোর । তাই অত মনকেমনের বালাই নেই আর । তবু, রোজা পার্কসের খবরে বার্কলির জন্য মনকেমন করে উঠলো ।

    (পরবাস, মার্চ, ২০০৬)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)