• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৭ | মার্চ ২০০৬ | প্রবন্ধ
    Share
  • জলে ও জঙ্গলে বাঘ-সুমারি : সুচেতা ঘোষ

    আজ আঠেরোই সেপ্টেম্বর । গত বছরের ঠিক এই দিনটিতে প্রথমবার সুন্দরবন যাত্রা শুরু করেছিলুম । সুন্দরবনের প্রসঙ্গ উঠলেই যার কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে, সেই রাজকীয় ব্যাঘ্রকুল গণনার কাজের সূত্র ধরেই যাওয়া ।

    তখন ছিল ঘোরবর্ষা । সময় দ্বিপ্রহরের আশে পাশে । আকাশের মুখ ভার । কেবল যাত্রা শুরুর সময় ক্যানিঙে রোদের হাসিমুখ নজরে এসেছিল । তারপর থেকেই আকাশ উঠল গুমরে, আর বৃষ্টি শুরু করল খেলা -- কখনো সে তার উতল-ধারা নিয়ে চলে যায় অনেক দূরে -- কখনো বা এত কাছে এসে পড়ে যে ভয় হয় এই বুঝি ঢুকে পড়তে হল লঞ্চের পেটের ভিতর । দূরে তখন গাঁ গঞ্জ প্রায় অস্পষ্ট -- কেবল দেখছি ঐ প্রবল বৃষ্টির মধ্যে জীবন কেমন করে বয়ে চলেছে নদীর পাশটি ধরে, ঐ উঁচু পাঁচিলের মত প্রান্তিক বাঁধের উপর দিয়ে -- ইস্কুলের পড়োরা চলেছে খালি পায়ে, হাতে জুতো ধরে, প্যান্ট গুটিয়ে, শাড়ির কুঁচি উঁচিয়ে -- মানুষ চলেছে হাটে-গঞ্জে, কাজে, ছাতামাথায়, টোকা মাথায়, এমনকী ভিজে ভিজে । ধন্য এইসব মানুষের, সেই কোন গঙ্গারিডি সভ্যতার কাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রকৃতির শত প্রতিকূলতাকে সহ্য করে বসবাস করে চলেছেন এই দেশে -- ধন্য সেই হ্যামিলটন সাহেব, যিনি কাণ্ডারি হয়ে গড়ে তুলেছিলেন নতুন আবাদ, নতুন সমাজ, একদা এই জল-জঙ্গলের রাজত্বে -- আর ধন্য এই দেশ, যে দেশে হিন্দু-মুসলিম একত্রিত হল বনবিবি-গাজিপীরের পায়ের তলায় ।

    একের পর এক গাঁয়ের পরে গঞ্জ এলো, আবার এলো গ্রাম -- নদীর দুধার ধরে এলো সোনাখালি, গোসাবা, পূর্বদুলকি, আমলামোতি -- আরো কত অমন চেনা না-চেনা নামের বসতি । মাতলা ছাড়িয়ে, দূর্গাদোয়ানিয়া দিয়ে, গুম্রি হয়ে বেয়ে পড়লুম বিদ্যে নদীতে । এখানকার নদনদী বড় চওড়া -- এমনকী কখনো কখনো কোনো খাল এতো বেশি চওড়া হয়ে আসে যে নদী বলে ভ্রম হতে পারে অতি সহজেই -- যেমনটি হয়েছে এই দূর্গাদোয়ানি খালের ক্ষেত্রে । মূলত: দুই ধরনের খাল এখানে, দোয়ানি আর ভারানি । দোয়ানি অর্থাৎ যে খালের দুটি মুখ, আর ভারানি হল দুটি বড়খাল বা নদীর সংযোগকারী খাল -- ইংরেজিতে যাকে বলে শর্টকাট, যা বেশিরভাগ সময়ই ভাঁটায় যায় শুকিয়ে । ঠিক সেই কারণেই সব ভারানি দোয়ানি নয়, কিন্তু সব দোয়ানিই ভারানি ।

    এতো গেল খালের তত্ত্বকথা । এবার একটু ভিন্ন তত্ত্বের সন্ধানে যাওয়া যাক । আমাদের প্রথম বনবাস ছিল দিন চারেকের -- লঞ্চেই বাসা বেঁধে একটু এদিক সেদিক যাওয়া -- উদ্দেশ্য, ব্যাঘ্র-পদনখ-চিহ্নরেখাশ্রেণী খুঁজে বার করা -- এবং তার পরে দেখে শুনে প্লাস্টার অব্‌ প্যারির সাহায্যে তার কয়েকটি ছাপ তুলে নিয়ে আসা । ভারতবর্ষে এইভাবে পদচিহ্ন সংগ্রহ করে তার থেকে বাঘ সুমারির কাজ করা হয় বহুদিন আগে থেকে । কিছুদিন হল এই প্রচলিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে কিছু বিদ্বত্জন সরব হয়েছেন -- এঁদের মধ্যে উল্লাস করন্থ মশাই অগ্রগণ্য -- এ পদ্ধতি ব্যবহারের অনেক ত্রুটি খুঁজে পেয়েছেন তিনি -- তাইতো এই পদ্ধতি বাতিল করে এক নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা বলতে চেয়েছেন । এইসব বিতর্কের কারণেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগ ইণ্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনষ্টিটিউটকে নিয়োগ করেন পুরো পদ্ধতিটি খতিয়ে দেখে পথ বাতলাবার জন্য । তাই আই.এস.আই- এর তরফে আমাদের এই বনগমন ।

    দূর্গাদোয়ানিয়া ছেড়ে গুমরি নদীতে পা দিতেই পাওয়া গেল বনের দেখা । তখন এ পাড়ে সোনাগাঁ আর ও পাড়ে দূরে ঘন জঙ্গল । দূরদৃষ্টির জন্য দূরবীনের প্রয়োগ করতে হচ্ছে প্রায়শই ।

    ঘন বনের মাঝে মাঝে খালের মুখগুলি জেগে আছে । আমাদের দলের সকলেই খুব উত্তেজিত -- বনের কাছাকাছি আসা গেছে, এবার কিছু না কিছু দেখতে পাবোই । বাঘ না হোক নিদেনপক্ষে একটা কুমীরেরও তো দেখা মিলতে পারে । মিললো-ও -- আমাদের সারেঙ মশাই হঠাতি বলে উঠলেন `হরিণ' । আমরাও সমস্বরে বললুম `কই কোথায় ?' তিনি বললেন `ঐ যে হোতায়' । ঐ `হোতায়'টা যে ঠিক কোথায় তা বুঝতে গিয়ে দেখা গেল অন্তত: কিলোমিটার-খানেক দূরে দুটি বিন্দু এদিক থেকে ওদিক ঘোরাফেরা করছে, অতি ধীর গতিতে । পরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এই জঙ্গলে এ এক অতি সাধারণ দৃশ্য -- কেওড়া গাছের তলায় যেখানে ঘন হয়ে আছে বর্শার ফলার মত শ্বাসমূল, বাঘও যেখানে আসতে ভয় পায়, সেখানে হরিণ নির্ভয়ে কেওড়া ফল খাচ্ছে ঘুরে ফিরে -- কখনো বা নদীর ধারের কোনো চরে একমনে খেয়ে চলেছে কচি ধানিঘাস । তবে লঞ্চ কাছে নিয়ে যাবার চেষ্টা সাধারণত বৃথা -- জঙ্গলের ওরা শোরগোল মোটেই পছন্দ করে না -- আর আমাদের বাহন, সে লঞ্চই হোক বা ভটভটিই হোক, বড়ই শব্দ তুলে চলাফেরা করে ।

    আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল পীরখালির জঙ্গল । সঙ্গে আছেন ক্যানিং বনদপ্তরের দুখিরামবাবু, দুখিরাম দাস । প্রথমেই বাধ সাধলেন তিনি -- ছাপ তুলতে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া চলবে না --`জঙ্গলে কখন যে বাঘ এসে কার ঘেঁটি ধরে নিয়ে যায় তার কি কোনো ঠিক আছে ? তখন বাঘ সামলাবো না মেয়ে সামলাবো' -- দলের মেয়েরা যার-পর-নাই বিক্ষুব্ধ, তবে আমাদের দলপতি দেবাশিসদা যে সেকথায় বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হননি তা বোঝা গেছিল কাজের সময়ে । সুতরাং সে রাত্রে সুযোগ পেয়ে দুখিরামবাবুকে ঘিরে ধরা হল, `এতই সহজ ! দেখেছেন নাকি কখনো মানুষকে বাঘে তুলে নিয়ে যেতে ?' -- `চোখের সামনে দিয়ে তুলে নিয়ে গেছে এমনটি না হলেও, তুলে নিয়ে যাওয়া মানুষদের দেখেছি বিস্তর । ওরা সাধারণত পিছন থেকে ঝাঁপ দেয় মানুষের উপর । প্রথমেই তার বড় দাঁতখানি (উনি বাঘের কৃন্তক দাঁতের কথা বলছিলেন) ঢুকিয়ে দেয় শিকারের শ্বাসনালীতে তারপর চাপ দিয়ে ঘাড়ের কাছে শিরদাঁড়াটি ভেঙে দেয় -- শেষে মুখে করে হেলায় গোটা শরীরটা তুলে নিয়ে চলে যায় গভীর জঙ্গলে ।' আবার প্রশ্ন এলো, `দেখেছেন কখনো বাঘের মুখ থেকে ফিরে আসতে ?' এবার সারেঙমশাই বলে উঠলেন, `একবার, মাত্র একবার -- এই ক'বছর আগে মধু সংগ্রহের সময় ঘটেছিল ঘটনাটা । বনে সেদিন একদল মউলি মধু খুঁজতে বেরিয়েছে -- সঙ্গে রক্ষক হিসেবে একজন মাত্র, তার হাতে দা-লাঠি, আগুন-পটকা বা ঐ ধরনের কিছু অস্ত্রশস্ত্র । মউলিরা ওপর দিকে চেয়ে বনের পথে হাঁটে -- গাছের ডালে মৌমাছির চাক খোঁজে তারা -- এম্নি সময় এদের একজনকে আক্রমণ করেছে বাঘে । রক্ষক চিত্কার করে উঠতেই অন্যরাও হইহই করে উঠেছে -- বাঘটা বোধহয় চমকে গিয়েই লোকটার গলায় ভুল জায়গায় কামড়ে ফেলেছে -- তাই লোকটা তো নিকেশ হয়ইনি উল্টে দলের অন্যদের হাতে দেদার মার খেয়ে বনে পালাতে হয়েছে বাঘটাকে । এদিকে লোকটির ক্ষতস্থান দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়ছে, গলার ক্ষতটি বেশ গভীর -- খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছনো দরকার তাই তাকে বনদপ্তরের লঞ্চে তোলা হল -- লঞ্চের চেয়ারে বসেই বললে সে "একটা বিড়ি দ্যান কত্তা ।" দেওয়া হল একখানি বিড়ি, জ্বালিয়ে । ধূমপানের সাথে সাথে গলার সেই ক্ষতটা দিয়ে ধোঁয়া বেরুতে লাগলো গল্গল্‌ করে ।'

    --`তা সে লোক কি বেঁচেছিল ?' --`বাঁচবে না কেন ? দিব্যি বেঁচে আছে -- আর ফি-বছর মধু-মোম নিতে আসে -- সে বলে এই জঙ্গলটা হল নেশার মত, এখানে না এসে বাঁচা যায় না ।

    সেবার বৃষ্টির জন্য আমাদের কাজের বেশ অসুবিধা হয়েছিল । একে ব্যাঘ্রকুল শীতকাল ভিন্ন অন্য ঋতুতে তুলনামূলকভাবে নড়াচড়া করে কম, তাই পায়ের ছাপ পাবার আশা বেশ কমের দিকেই, তায় আবার যেটুকু পাবার সেটুকুও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই বর্ষাশেষের বর্ষণে আর জোয়ারের জলের তোড়ে । তো, সেদিন সকালে পীরখালিতে বড়বাবু একটু মৃদুরকম নিন্দাবাদ কুড়োলেন । সে ছিল আমাদের কাজের প্রথম দিন । দুখিরামবাবু পরপর কতগুলো নষ্ট হওয়া ছাপ দেখে বড়বাবুকে বললেন `এঁরা সব কলকাতা থেকে এত কষ্ট করে এলেন, আর আপনি একটাও টাটকা ছাপ জোগাড় করতে পারলেন না ? তাও আবার পীরখালির এই ঘন জঙ্গলে ?' বাইরের লোকজনের সামনে এই সব কথাবার্তা বোধহয় যথেষ্ট পরিমাণে গায়ে লেগেছিল বড়বাবুর -- অন্তত: পরবর্তী ঘটনাবলী তাই বলে । যারা নিয়মিত বনে টহল দেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে, সাজো সাজো রব তুলে পাড়ি দেওয়া গেল খানিক দূরের জঙ্গলে । পীরখালির মধ্যে সুধন্যখালির একটু ভিতরের দিকের জঙ্গল এটি । বনদপ্তরের একটি টহলদার দল ঐ খালের মুখে তাদের বোট নিয়ে অপেক্ষা করছিল -- তাদের এই বোট হল ছইবিহীন ছোট জেলে নৌকো, যা যন্ত্রে চালিত ।

    যেতে হবে খালের একটু ভিতর দিকে -- লঞ্চ সেখানে ঢুকতে পারবে না বলে বোটে চেপে খালে ঢুকলুম আমরা । যেতে যেতে শুনলুম, কিছু আগে এক জোড়া বাঘ -- বাঘ ও বাঘিনী, খাল পার হয়ে ঢুকে গেছে বনে । সরু খাল ত্রক্রমে আরো সরু হল । মৃত্যুর নিস্তব্ধতা যেন উপত্যকায় -- আমরা সকলে চুপচাপ -- কথা না বলা জঙ্গলের প্রাথমিক শর্ত, বড়বাবু বলেছেন । বাঁদিকে একটা ছোট্ট বাঁক ঘুরে থামল নৌকো । ছোট ছোট বাইন গাছের ডালপালা যেন লম্বা লম্বা হাত ছড়িয়ে প্রায় ঢাকা দিয়ে রেখেছে জায়গাটাকে ।

    তখন জোয়ারের সময় -- হু হু করে জল বাড়ছিল । সবার প্রথমে বড়বাবু নামলেন ডাঙায়, তাঁর পিছনে এক বন্দুকধারী, তারপর সুবিধেমত অন্য সবাই, সবার পিছনে আরেক বন্দুকধারী বসে রইলেন নৌকোতেই, উল্টোদিকের বনের দিকে বন্দুকখানা বাগিয়ে ধরে ।

    নিয়ম আছে, বাঘের পায়ের চাপ তোলবার আগে তার গতিপথটি দেখা প্রয়োজন -- অর্থাৎ কিনা যদি এপাড় থেকে ওপাড়ে যায় তবে তার গতিপথের উল্টোদিকে এই পাড় থেকে ছাপ সংগ্রহ করতে হবে । সেদিন কিন্তু নিয়ম ভেঙেছিলুম আমরা ভালো কিছু ছাপ পাবার আশায় ।

    আমরা তিন চার জন তখনো নৌকোর উপরে -- ঠিক জলের ধারে পড়া পায়ের ছাপ থেকে হাতে কলমে শিক্ষা চলছে -- চারপাশ একদম নিস্তব্ধ -- একটা পাখি পর্যন্ত ডাকছে না -- শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক -- এর মধ্যে একজন প্রায় ফিস্ফিস্‌ করে বলছেন বাঘের বাঁ-পা আর ডান পায়ের তফাত্‌, কেমন করে ছাপটিকে চারচৌকো ফ্রেমে ঘিরে তাতে প্লাস্টার অব্‌ প্যারির জলে-গোলা মিশ্রণ ঢেলে দিতে হয়, কি করে সামনের আর পিছনের পায়ের ছাপের তফাৎ বোঝা যায় -- শুনতে শুনতে সক্কলে নিমগ্ন -- হঠাৎ দড়াম্‌ করে একটা শব্দ -- সম্বিৎ ফিরলে দেখলুম আমি নৌকোর একটা পচা পাটাতন ভেঙে সোজা খোলের মধ্যে প্রায় পাতাল প্রবেশ করেছি -- আর মুহূর্তে দুটি বন্দুক এদিকেই স্থির -- ভাগ্যি ভালো যে গুলি ছোটেনি । পরে জানা গেল, দলের অন্যরা সকলেই লক্ষ করে ওটিকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন, কেবল আমি বাদে ।

    বাঘ গণনার সময়ে বনকর্মীরা কোনো বাঘের একটি ট্রেইল থেকে পিছনের বাম পায়ের সেরা যে ছাপটি তার প্লাস্টারের ছাপ তুলে নেন -- কিন্তু আমাদের কাজের জন্য একাধিক ছাপের প্রয়োজন ছিল । তাই ঠিক হল জঙ্গলের একটু ভিতরে ঢোকা হবে । এবারও বড়বাবু রইলেন সবচাইতে আগে, এক বন্দুকধারীকে নিয়ে -- সবার শেষে রইলেন আরেক বন্দুকধারী । প্রায় গুঁড়ি মেরে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে হচ্ছিল -- এত নীচু নীচু গাছ । একটু এগোনোর পরই সামনে থেকে নির্দেশ এলো, নৌকায় ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি -- তখন যেন তাঁরা খানিকটা ত্রস্ত -- চোখের দৃষ্টিতে, মুখের ভঙ্গিমায় যেন আতঙ্কের ছাপ । প্রায় নিমেষের মধ্যে বোটের এঞ্জিন চালু করে ফিরে চললুম আমরা ।

    ফিরে যেতে যেতে যা বললেন বড়বাবু তার মর্মার্থ হল এই যে, জঙ্গলের মধ্যে এগোতে এগোতে তিনি একটা সর্‌ সর্‌ শব্দ শুনতে পান, এবং সতর্ক হন, কারণ এই নিস্তব্ধ জঙ্গলে এইরকম শব্দ ভালো নয় । তখন হঠাতি তাঁর নজরে পড়ে একটি আধখাওয়া বুনো শুয়োর -- অর্থাৎ কিনা দ্বিপ্রাহরিক ভোজন চলছিল -- মা বনবিবির অনেক কৃপা যে তিনি আমাদের আক্রমণ করেননি নইলে খাওয়ার সময় ব্যাঘাত কোনো খাইয়েই বিশেষ পছন্দ করেন না ।

    রতনলালবাবু, ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞ রতনলাল ব্রহ্মচারী এই গল্প শুনে মন্তব্য করেছিলেন, `তিনি সম্ভবত: আগেই তোমাদের দেখেছিলেন । তোমরা দলে অতজন ছিলে এবং একসঙ্গে ছিলে বলেই আক্রমণ করেনি সে -- অন্যত্র সরে গিয়ে আড়াল থেকে লক্ষ করেছে গতিবিধি । সে ধৈর্য ধরে -- ধৈর্য ধরে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না দলের মধ্যে কোনো একজনকে তার পছন্দ হয় আর সেই একজন একটু আলাদা হয়ে যায় দলথেকে -- তখনি সে গুঁড়ি মেরে এবং নি:শব্দে ত্রক্রমশ: এগিয়ে আসে শিকারের দিকে । তারপর বাগে পেলে ঝাঁপ দেয় শিকারের উপর ।'

    সেদিনের সেই ঘটনা থেকে বড়বাবু কি শিখেছেন বলতে পারি না -- তবে আমার শিক্ষাটি ছিল মোক্ষম -- `বনদপ্তরের বোটে সদাসর্বদা দেখিয়া শুনিয়া পদবিক্ষেপ করিবে ।' এরপরে কতবার যে এই শিক্ষাবাণী আমায় আশুপতনের হাত থেকে রক্ষা করেছে তার ইয়ত্তা নেই ।

    সেদিন ভোরে পায়ের তলার মাটি যেন দুলছিল । ঠিক তখুনি হুঁশ এল -- আরে ! এতো লঞ্চ নয় নিজের বাড়িতে এখন । গত তিন রাত্রে লঞ্চে সেই ত্রক্রমাগত দুলুনির স্মৃতি যে কি পরিমাণ ছাপ রেখে গেছে অবচেতনে তখন বুঝলুম । কিন্তু সেতো হিমশৈলের চূড়া কেবল । আর সেই তো শুরু । তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সে প্রকৃতি একটু একটু করে প্রবেশ করে চলেছে এই অন্তরমহলে, আর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে সে বনের রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে ।

    প্রথমবার বনে যাওয়া ছিল যেন প্রকৃতি দিদিমণির কাছে প্রথম পাঠ । সে পাঠ শুরুতেই বলে বনে আসার এবং নৌকো ছেড়ে বনে নামার প্রথম দুটি শর্ত হল সাহস এবং শারীরিক সক্ষমতা বা কুশলতা -- ঐ ইংরেজিতে যাকে বডি ফিট্নেস বলে । একটু অন্যমনস্কতা একটু আলগা চলাফেরা যে কতমানুষের জীবনে বিপদ ডেকে এনেছে তার শেষ নেই ।

    মাননীয় মন্ত্রীমশাই আসছেন সুন্দরবন পরিদর্শনে । মন্ত্রীর বড়ো জলযান ক্যাম্পের পলকা জেটিতে বাঁধা যাবে না ; তাই তাকে আরো বড়ো ও মজবুত করা হচ্ছে । এই সময়ে কিছু কাঠ কম পড়াতে অজিত মণ্ডল এক পায়ে খাড়া, বললেন, "আমি যাচ্ছি ; এই তো স্পীডবোট নিয়ে যাবো আর নদীর পার থেকে ক'টা গাছ কেটে নিয়ে চলে আসবো -- এই যাবো আর এই আসবো ।" কিন্তু আর কোনোদিনই ফেরেননি তিনি । যেখানে থেমেছিলেন ডাল কাটার উদ্দেশ্যে সেই হেঁতাল বনেই ওঁত পেতে ছিল হিংস্র শ্বাপদ । শিকারকে তুলে নিয়ে গভীর বনে চলে যেতে কোনো ভুল করেনি সে ।

    সেদিন ক্যানিং থেকে জলপথে সুন্দরবনের দোবাঁকিতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে । এখানে সামনের চারদিনের জন্য মিষ্টি জল ভরে নেওয়া হবে । সেই সুযোগে দৌড়ে দৌড়ে একটু ক্যানোপি-ওয়াক-এ যাওয়া গেল । বনদপ্তরের এই ব্যবস্থা পর্যটকদের জন্য । অঞ্চলের বুড়ির-ডাবরিতেও দেখেছি এমনতরো ব্যবস্থা । তারের খাঁচার মধ্যে দিয়ে জঙ্গলের অল্প কিছুটা ভিতরে ঘুরে আসা । তখন একপাল হরিণ দাঁড়িয়ে অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়েছিল । আর ইতস্তত পড়েছিল ঝরে পড়া বেশকিছু হরিণের শিং । এখানেই জেনেছিলুম চিতল হরিণের শিংগুলি বাড়ে, শক্ত হয় তার পর ঝরে যায়, আবারো গজায় ।

    জঙ্গল তখন প্রায় নিস্তব্ধ কেবল দূরে বনের মধ্যে একটা নাইটজার পাখি ডাকছিল -- তার সেই ধাতব শব্দ যেন বনের সে নিস্তব্ধতার ঘনত্ব আরো বাড়িয়ে তুলছিল । হঠাতি কাছাকাছির মধ্যে চাপা গলায় শব্দ হল `আউম' । বেশ চমকেছিলুম -- বনের মহারাজা এলেন নাকি ? এখনই তো তাঁর শিকারে বার হবার আদর্শ সময় -- এর পরেই ঠাওর করলুম -- অনিরুদ্ধদা, আমাদেরই দলের একজন, মজা করছিলেন ।

    সেদিন রাত্রে থাকা হল ন'বাঁকিতে -- অর্থাৎ কিনা ন'মাথার মোড়ে । ঐ নিশ্ছিদ্র অন্ধকারেও গোপালবাবু কেমন করে জানি দিশা দেখাচ্ছিলেন নবীন সারেঙমশাইকে । জিজ্ঞাসা করতে হেসে বললেন, `এই সুন্দরবনের সমস্ত বাঁক আমার চেনা ।'

    গোপালবাবু, মানে শ্রী গোপাল তাঁতি, পশ্চিমবঙ্গ বনবিভাগের এক উজ্জ্বল কর্মী । বনের ব্যাপারে যাঁর জানার উত্সাহ এখনো প্রায় বালকের মতই সজীব ।

    সেদিন রাতে জোর তর্ক হয়েছিল এক তরফ এবং বহু তরফে । বিষয় : সুন্দরবনের নিয়ম, যা কিনা মা বনবিবির প্রণীত, বনে মেয়েদের পদার্পণ নিষিদ্ধ -- আগামী কল্য কাজের সময় তা মানা হবে কি না । সংখ্যালঘু পক্ষে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল রতনলালবাবুর একটি উক্তি `বাঘেরা কাঁটা বেছে খাবার মত, বেছে বেছে মেয়েদের খায় না -- লোকে বাজার থেকে ঠিক যে বিবেচনা নিয়ে মুরগী কিনে আনে, বাঘও একই বিবেচনা নিয়ে শিকার ধরে, অর্থাৎ কিনা মাংসটা কোথায় বেশি হবে তাই দেখে ।' যদিও পরের সকালে বেশ স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছিলো যে যুদ্ধটা ছিল সংখ্যাগুরুর তরফে সাজানো বাগ্যুদ্ধ ।

    পরদিন সকালে অনেকক্ষণ কুয়াশা রইল জমাট হয়ে । গোপালবাবু বললেন -- `এমন কুয়াশা থাকলে জঙ্গলে নামা যাবে না -- বড়ে মিঞার আক্রমণের আশঙ্কা আছে ।' দেখা যাক কি হয় -- এই ভেবে ন'বাঁকি থেকে নেতিধোপানি অঞ্চলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হল । নেতিধোপানিতে ঢুকতে না ঢুকতেই কাজের আহ্বান । ভরা পৌষের ঠাণ্ডায় হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় এক হাঁটু কাদায় নেমে কাজ করা গেল বেশ ভালোকরেই । এরপরে পশুপতির নৌকোয় চেপে ঐ অঞ্চল প্রায় চষে ফেললুম আমরা -- প্রায় প্রতিটি খাল আর খাঁড়ি, জলের উপর দিয়ে যতদূর যাওয়া যায়, গেলুম । গতবারের অভিজ্ঞতা বলেছিল বড় লঞ্চ কাজের উপযোগী বড় একটা নয়, তাই একটা জেলে নৌকো বিদ্যা ক্যাম্পের কাছ থেকে ভাড়া করা হয়েছিল -- পশুপতি সেই নৌকোর মাঝি ।

    এই নেতিধোপানি অঞ্চলে কয়েকটি পুরোনো মন্দিরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে । নেতিধোপানি ক্যাম্পের অনতিদূরে বনের মধ্যে একটি মন্দিরের কথা তো প্রায় সবাই জানেন । সে মন্দির এখন অবশ্যই পরিত্যক্ত এবং বাঘের গুহায় পরিণত । বনকর্মীরা এই মন্দিরে যান পাঁচ-দশ বছরে একবার -- কাছাকাছি ক্যাম্প আছে তাই চারিদিক একটু সাফ করা, এই আর কি ! ওখানে গেছেন এমন একজন বললেন যে মন্দিরটি দোতলা -- আরও প্রশ্ন করে যা মনে হয়েছে মন্দিরের গড়ন সম্ভবত: দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার জটার দেউলের গড়নের সঙ্গে কিছুটা মেলে । লোকমুখে প্রচারিত যে এটি আদতে মনসামঙ্গল কাব্যের সেই মনসা মন্দির -- বেহুলার ভেলা এখানেই কোথাও মা মনসার সহচরী নেতা-ধোপানী বা নেতিধোপানির ঘাটে এসে ভিড়েছিল ।

    সেদিন বেলা পর্যন্ত আর কোনো কাজই হল না । উল্টে গোপালবাবুকে ক্যানিং হেডঅফিস থেকে জরুরী তলব করা হল । তিনি চলে গেলেন । যাওয়ার আগে নেতিধোপানি ক্যাম্পে নেমে পঞ্চাননবাবু, পঞ্চানন মণ্ডল কে বলে গেলেন আমাদের সাহায্য করতে । ঠিক হল বিকেলের আগে নেতিধোপানিরই ষ্টোরখালি (সুন্দরবনের ভাষায় "এস্টোরখালি") খালটি ঘুরে দেখা হবে ।

    সুন্দরবনের মজা হল এই যে কোনো বদ্বীপের নাম রাখা হয় তার পাশ ধরে বয়ে চলা খাল বা নদীর নামে -- যেমনটি হয়েছে এই ষ্টোরখালির ক্ষেত্রে -- ষ্টোরখালি নামে খালের পাশে বলে এই নাম ঐ জায়গার । কিন্তু খালটাকে এই নামে ডাকার যে কি কারণ তখন বুঝতে পারিনি । তবে এই খাল যে সার্থকনামা আমরা তার হাতেনাতে প্রমাণ পেয়েছিলুম সেদিনই ।

    দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে পঞ্চাননবাবুর তত্ত্বাবধানে পশুপতির নৌকোয় চড়ে রওনা হওয়া গেল । মাতলা নদী ধরে খানিকটা দক্ষিণে গিয়ে বাঁ দিকে সামান্য বাঁক নিতেই পৌঁছনো গেল জায়গাটায় । একটু ইতিউতি খুঁজে খালের মধ্যে ঢোকা হল । খালটা মোটেই চওড়া নয় । খালের দুপাশে উঁচু উঁচু পাড়, নৌকো থেকে পাড়ের উপরটা কিছুই দেখা যাচ্ছে না । এই দুই পাড়ের মধ্যে দূরত্বও কমই, পনের হাতের মধ্যে । আমরা ত্রক্রমান্বয়ে একবার এপাড়ে আরেকবার ওপাড়ে নজর রেখেছি । বড়েমিঞা যদি কাছাকাছির মধ্যে থেকেও থাকেন তবু এতগুলো সচকিত লোকজন দেখে চট করে ঝাঁপাবে বলে মনে হয় না ।

    নৌকোর একদিকে লগি ঠেলছে পশুপতি, কারণ জল এখানে কম তাই বৈঠা চালিয়ে বাওয়া যাচ্ছে না । নৌকোর অন্যদিকে বন্দুক বাগিয়ে বসে আছেন পঞ্চাননদা । কিছুদূর এগিয়েও আমাদের কোনো লাভ হল না । এদিকে পশুপতির পক্ষে আর এগোনো সম্ভব হচ্ছিল না, নৌকোর তলায় মাটি ঠেকে যাচ্ছিল । সুতরাং একটা সরু খালের সংযোগ স্থলে নৌকো ঘুরিয়ে খাল থেকে বের হওয়ার তোড়জোড় আরম্ভ হল ।

    এবার খালের মুখে ফিরে যাবার পালা । হঠাৎ পশুপতি পঞ্চাননদাকে লক্ষ করে বলে উঠল, `কাকা ! কি যেন দেখছি ।' `কি বল্তো ?' পঞ্চাননদা বললেন । তারপরই কিছু একটা আঁচ করে নির্দেশ দিলেন `এগো, এগিয়ে চ'তো ।' অসুবিধা সত্ত্বেও পশুপতি আবার খালের ভিতরে ঢুকতে আরম্ভ করল । যেতে যেতে দেখলুম পাড়ে এক জায়গায় প্রচুর কাঠ কেটে জড়ো করে রাখা আছে । খানিকটা যাওয়ার পর একটা মোড়ে আবার কিছু কাঠ । এবার বাঁক ঘুরতেই দেখা গেল আমাদের নৌকোর চাইতেও বড় একটা নৌকো -- নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে -- আর সে নৌকোর উপর অবাক চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে একটা লোক । `বসে পড়ুন নৌকোয়, বসে পড়ুন আপনারা' প্রায় ফিস্ফিস্‌ করে বললেন পঞ্চাননদা -- আর নৌকোর লোকটার উদ্দেশ্যে উঁচু গলায় বললেন, `এই হাত তোল্‌, তোল্‌ হাত, কোতথেকে এসেছিস ? কি করছিস এখানে ? ক'জন আছিস তোরা ?' লোকটা বোধহয় প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল -- তারপর একটু লাজুক হয়ে যেন হাত ঠোঁটের উপরে রেখে পঞ্চাননদাকে চিত্কার করতে বারণ করল, তারপরে ইশারায় দেখালো নৌকোর উপরেই তোলা উনুনে ভাত ফুটছে, তা-ই নামিয়ে নেবে উনুন থেকে । এই সুযোগে লোকটাকে ভালো করে দেখার সুযোগ হল -- একটা কালো-কোলো লুঙ্গি ফতুয়া পরা মানুষ, মাথাভর্তি কোঁচকানো চুল আর মুখভর্তি লম্বা কুঁচকুচে দাড়ি, যেমনটি আমাদের গাঁয়ের মুসলিমদের থাকে আর কি ! লোকটার বিশেষত্ব ছিল তার দুটি জ্বলজ্বলে চোখ ।

    খুব ধীরেসুস্থে ভাতের ডেকচি নামালো সে -- নামিয়ে নিয়েই মুখের কাছে হাত রেখে জোরে একবার `কুউউ' বলে ডাক দিল -- সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাননদা চিত্কার করে উঠলেন `অ্যাই, কু -ডাক দিলি কেন, কে-ন ডাক দিলি বল ? আমার একটা কথারও এদিকে উত্তর দিলি না -- কোথাকার লোক তোরা বল্‌, কাকে সাবধান করলি এখন ?' এবার আস্তে করে বলল সে, `আজ্ঞে কৈখালির দিকের ।' `আয়, নৌকো নিয়ে বেরিয়ে আয় আমার পিছু পিছু' -- এই বলে পঞ্চাননদা ইশারা করলেন পশুপতিকে নৌকো নিয়ে খাল থেকে বার হয়ে আসতে । ফিরে আসতে আসতে একবার পিছন ফিরে দেখলুম লোকটা আমাদেরই দিকে চেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । পঞ্চাননদা ফিরতে ফিরতে একবার খালি বললেন `এখান থেকে কাঠ কাটা বেআইনি -- এগুলো কাঠচোর -- ওই ব্যাটা সঙ্গীদের সজাগ করে দিয়েছে -- আমার কাছে এই একখানা বন্দুক, আবার আপনারা আছেন -- কি করে রিস্ক নিই বলুন দেখি ?'

    ষ্টোরখালির মুখে আমাদের লঞ্চ রাখা ছিল । আমরা এখানে দু'দলে ভাগ হয়ে গেলাম -- অনিরুদ্ধদা, স্নেহাশিস, আমি লঞ্চে রওনা দিলুম নেতিধোপানি ক্যাম্পের দিকে খবর দিতে আর অন্যরা থানা গেড়ে রইলেন পশুপতির নৌকোয়, খালের মুখে । পঞ্চাননদা বলেছিলেন, ওটা ভারানি খাল নয়, তাই নৌকো নিয়ে বার হলে এই মুখ দিয়েই বার হতে হবে ।

    নৌকো থেকে লঞ্চে ওঠবার সময় শুনলুম পিনাকদা প্রশ্ন করছেন পঞ্চাননদাকে `আপনার এই বন্দুকটা দিয়ে যথাসময়ে গুলি বার হয় তো ?' একটু গরম হয়ে পঞ্চাননদা বললেন `কেন, বার হবে না কেন ? কেবল গুলি ছোঁড়বার আগে এইভাবে দুবার ঠুকে নিতে হয়' বলে হাতেকলমে দেখিয়েও দিলেন তিনি । শুনতে পেলুম আস্তে করে পিনাকদা বললেন `বোঝো ।'

    বনকর্মীদের বন্দুক নিয়ে যথেষ্ট সমীক্ষা চালিয়েছিলেন আমাদের দলের পিনাকদা । গতবার বনবাসের সময় পীরখালিতে একজন তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি সঠিক জানেন না ছুঁড়লেই বন্দুক থেকে গুলি বার হবে কিনা, কারণ প্রায় বছর দেড়েক তিনি তাঁর বন্দুক থেকে কোনো গুলিই ছোঁড়েননি । এমনকী একজন একথাও বলেছিলেন যে বন্দুকটা একবার জলে পড়ে যাওয়ার পর থেকে আর চলে না -- তবু সঙ্গে রাখেন কারণ সরকারি নিয়ম, তাছাড়া বাঘ এলে ওটা তুলে দু'ঘা মারাও তো যেতে পারে ।

    ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা হবার কিছু পরেই দেখা গেল ক্যাম্পের বড়বাবু এবং আরেকজন স্পীডবোট নিয়ে টহলে বেরিয়েছেন । ওঁদের কাছে গিয়ে সবকিছু বলতেই ওঁরা তাড়াতাড়ি ষ্টোরখালির দিকে চলে গেলেন । আমাদের লঞ্চও পিছু নিল তার । আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলুম `এদের এত সাহস হয় কি করে ? ধরে নেওয়া গেল নয়, নিয়মিত টহল দেয় না বনকর্মীরা -- তা, বাঘের ভয়ও কি নেই ?' সারেঙসাহেব শেষ প্রশ্নটি শুনে আর চুপ থাকতে পারলেন না যেন, বললেন `ওরা গুনিন্‌ নিয়ে বনে আসে । বনে যেকোনো কাজের আগেই মা বনবিবির পুজো করে এরা, তা সে জেলেই হোক, মউলিই হোক বা চোরই হোক । গুনিন্‌ দুটি কাঠ কেটে নেয় সুন্দরী গাছের ডাল থেকে -- সমস্ত লক্ষণ মিলিয়ে নিয়ে । একটা কাঠকে বলে "আস্কান" । গায়ের মন্ত্র পড়ে সেই `আস্কান' পুঁতে দেয় নদীর চরে, আর সঙ্গে রাখে আরেকটা মন্ত্র:পুত কাঠ, যাকে বলে "আশাবরী" । এত কিছু করেও যদি বাঘের সামনাসামনি পড়ে, তবে গুনিন্‌ মন্ত্র পড়ে মুখ বন্ধ রাখে বাঘের ।' অনিরুদ্ধদা নীচুস্বরে বললেন `এই সব গুনিন্রা আসলে বনটাকে অসম্ভব ভালো করে চেনে -- এমনকী কোনো দ্বীপে পা দিয়েই বুঝতে পারে সেখানে বাঘ আছে কি নেই ।' অনিরুদ্ধদা এককালে বহুদিন ধরে সুন্দরবনের জীবন নিয়ে গবেষণা করেছিলেন । পরে আমরাও লক্ষ করেছি যে বনে পড়ে থাকতে থাকতে কিছু মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অত্যন্ত প্রখর হয়ে ওঠে ।

    সেদিন শেষপর্যন্ত কিন্তু সে দলটিকে আর ধরা যায়নি । স্পীডবোটটি যথেষ্ট তাড়াতাড়ি অকুস্থলে পৌঁছেছিল, জুটিয়ে নিয়েছিল নদীচলতি কিছু জেলে নৌকো । সকলে মিলে ষ্টোরখালির মধ্যে ঢুকে দেখেছিল যে নৌকোটা পড়ে আছে আর পড়ে আছে তাদের কাটা কাঠগুলো । সেগুলো বাজেয়াপ্ত হয়েছিল । আমাদের লাভ হয়েছিল শক্ত কিছু লাঠি । গুনিন্‌ সমেত কাঠচোরেরা পালিয়েছিল বনের মধ্যে দিয়ে । সন্ধের মুখে বনের মধ্যে পদব্রজে পলায়ন ! সাহস বলিহারি এদের !

    এইসব রহস্য-রোমাঞ্চকর ঘটনার পর সন্ধেটা কাটলো একটু মনমরা হয়েই কারণ কাজ এগোচ্ছে না মোটেই । প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে প্রকৃতি যেন বাধার প্রাচীর তুলে রেখেছে । এখানে আসার আগেই ঘটল সুনামির মতো অমন ব্যাপক এক ঘটনা -- তাতে বন্ধ হল আমাদের সাঁইমারির চরে গিয়ে বালির ওপর কাজ, কারণ আবহাওয়াবিদদের সতর্কতা ।

    সেদিন সন্ধেটা কাটলো ক্যাম্পে । ক্যাম্পে যাওয়া হয়েছিল সন্ধের আর-টি (রেডিও ট্র্যান্সমিশন)-এ সুনামির জন্য সতর্কতা এখনো আছে কিনা তা জানার জন্য -- নইলে সাঁইমারির উদ্দেশ্যে এখনো রওনা হওয়া যায় ।

    সুন্দরবনে বনদপ্তরের ক্যাম্প মানে এক শক্ত জাতের ঘেরা জায়গা যেখানে সাধারণত থাকে একটি ওয়াচ টাওয়ার, একটি বনবিবি-দক্ষিণরায়ের মন্দির, একটি আপিস-কাম-বাসাবড়ি । এই বাড়িটি মাটি থেকে একটু উঁচুতে থাকে, থামের উপরে তৈরি করা হয় ঘরগুলি --সাধারণত শক্ত গ্রীলে মোড়া । নেতিধোপানিতে এই বাড়িতে মাত্র দুখানি ঘর, একটিতে অফিস অন্যটিতে গাদাগাদি করে থাকেন বনকর্মীরা । অনিরুদ্ধদা সটান ঢুকে গেলেন ওঁদের ঘরে -- আমারই একটু অস্বস্তি হল -- কি জানি ওঁরা কেউ আমার উপস্থিতিতে অস্বস্তি অনুভব করতে পারেন -- তাই বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলুম । তখন সকলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আর-টিতে রোল-কল-এর মত নাম ডাকা চলছে । সেই কন্ঠস্বরে সমস্ত বনের জমাট সেই নিস্তব্ধতা যেন কেটে কেটে যাচ্ছে । কত প্রয়োজনীয় খবর কানে আসছে, আরো কত বনকর্মীর বাড়ির দৈনন্দিন প্রয়োজনের কথাও শুনতে পাচ্ছি এর মধ্যে । সাধারণত মাসখানেকের জন্য টানা থাকতে হয় কোনো কোনো বনকর্মীকে । কোনো ছুটি নেই এর মাঝে -- কারো বাড়িতে ছেলের হঠাৎ অসুখ হলে বা মেয়ের বিয়ের ঠিক হলেও ঐ আর-টিই ভরসা -- তাই একজন বনকর্মী বলেছিলেন -- `এ হল আমাদের বিরাট সংসার, আমরা সবাই সবার সব খবর রাখি ।'

    `বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন এই হিমের মধ্যে ? আসুন ভিতরে আসুন, আমাদের পর্ণকুটির দেখে যান' -- এই রকম একটি আন্তরিক ডাকে আশ্বস্ত হয়ে নির্দ্বিধায় ওঁদের ঘরে গিয়ে ঢুকলুম । তখন সে ঘরের কোণে একটি ছোটো সাদা কালো টিভিতে খবর চলছিল, ঘরে পাঁচ-ছটা তক্তাপোষ পাশাপাশি জুড়ে পাতা, আর যতটা সম্ভব অগোছালো একটি ঘর -- কিন্তু সে ঘরের মানুষগুলি বড় আলাপী, বড় সহৃদয়, আর নিজের হৃদয় অতিথির কাছে মেলে ধরতে যেন উন্মুখ । প্রায় সমস্ত সুন্দরবন ঘুরেছি, কত যে বনকর্মীর সাহায্যে কাজ করেছি তার ইয়ত্তা নেই -- আজ এইসব নানা রঙের মুখগুলির কোনোটি খুব স্পষ্ট, কোনোটি বা বড় ধূসর -- কিন্তু এই বনে এই একটি জায়গায় এঁরা সকলেই এক -- তাইতো দুখিরামবাবুর শক্ত মুখখানি কোমল হয়ে ওঠে তাঁর নাতির কথা বলতে গিয়ে, রঞ্জিতবাবু তাঁর স্বাভাবিক গাম্ভীর্য সরিয়ে রেখে অনর্গল শোনাতে পারেন বনবিবির পালা, এমনি আরো কত ম্যাজিক হয়ে চলে প্রতিনিয়ত এই বনের আবহাওয়ায়, প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ।

    পরদিন ভোরবেলা ক্যাম্পের সামনে প্রচুর ডাকাডাকির পর একজন খু-উব বিরক্ত মুখে দরজা খুলে দিয়ে বললেন, `আসুন আপনারা ক্যাম্পের ভিতরে । কিন্তু এখন আমরা কেউ পুকুরধারে যেতে পারবো না । বাঘের ডাক শোনেননি আপনারা ? কাছে পিঠেই আছে ওটা ।' কি আর করা, দেবশিসদার পিছু পিছু ওঠা গেল ওয়াচ টাওয়ারে । পুবদিকের বড় জানলায় দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখি সামনের ফাঁকা জায়গাটি পেরিয়ে জঙ্গলের রাজা (নাকি রানি) ঢুকে যাচ্ছেন জঙ্গলে । আহা ! আজও চোখ বুজলে ঐ চলার ভঙ্গিমাটি দেখতে পাই -- দূরে তখনো বেশ কুয়াশা -- হাঁড়ির মতো মাথাটি একটু নুইয়ে যেন আন্মনা হেঁটে চলেছেন -- চলার মধ্যে কি দার্ঢ্য, যেন কাউকেই তোয়াক্কা নেই তাঁর -- ল্যাজ খানি বেশ লম্বা, আগাটি সামান্য বাঁকিয়ে মাটির থেকে একটু তুলে রাখা -- যেন রাজার সে উত্তরীয়-প্রান্ত খানি । তখন আর দ্বিমত রইল না মনে যে আলিপুর চিড়িয়াখানায় খাঁচার আড়ালে যাঁকে দেখেছি, তিনি এঁর তুলনায় মোটাসোটা হতে পারেন, আসলে কিন্তু তিনি প্রায় ভিখারি, জঙ্গলের এই স্বাধীন বাঘটির কাছে । সেদিন নেতিধোপানিতে, সেই মিষ্টি জলের পুকুরের ধারে, কাজের শুরুটা হল বেশ ভালোই ।

    তারপরই পঞ্চাননদাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হওয়া গেল পঞ্চমুখানির দিকে । প্রায় সময়ই নদীর পাড় ধরে হেঁটে, কখনো বা উঁচু চটকে (একটু উঁচু জমি যার চারিদিকে ইতস্তত ছড়ানো ছিটোনো গাছপালা, একেই স্থানীয় ভাষায় চটক্‌ বলে) গিয়ে খোঁজাখঁংউজির পালা আরম্ভ হল । প্রাতরাশের পর থেকে শুরু করে প্রায় তিনটে পর্যন্ত একই ভাবে অনেক চেষ্টা করেও কন্তু তাঁর পদার্পণের আর কানো খোঁজ মিলল না । মাঝখান থেকে হল আরেক মোক্ষম শিক্ষা ।

    এক চর থেকে নদীর অন্য চরে যাওয়া হবে তাই পশুপতির নৌকোর সামনে ছোটোখাটো ড়ি । আমি রয়েছি ংইংএড়র শেষ প্রান্তে । লক্ষ করছি ত্রক্রমশ কাদায় ডুবছে পা দুটো -- অত গ্রাহ্য করছি না কারণ সর্বত্রই তো একই চিত্র -- এই কাদার নীচে পায়ের তলায় শক্ত মাটি পাবোই, তাছাড়া হাতে প্রায় দেড় মানুষ সমান শক্ত একটি লাঠি -- এতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে কতক্ষণ -- কিন্তু ত্রক্রমশ যখন প্রায় উরু পর্যন্ত কাদা চলে এলো তখন একটু ভয় হল -- এ আবার কি ! চোরাবালি, চোরা বরফের কথা শুনেছি -- একি চোরাকাদার মধ্যে পড়লুম ? তখন তো আর নষ্‌ ংঔধত্রঞভধস্‌ংশষ্‌ -র নৃংত্ৎ ধী ঞচ্‌ং মঠভংশ পড়িনি -- নইলে জানতুম সুন্দরবনের চোরা কাদার রাক্ষুসে হাঁ কেমন করে একটা আস্ত লঞ্চকে সম্পূর্ণ গিলে খেয়েছিল কয়েক মিনিটে । প্রথমে চেষ্টা করলুম লাঠিতে ভর দিয়ে উঠতে । লাঠিটা এত বেশি ডুবে গেল যে হাতখানেক মাত্র বার হয়ে রইল কাদা থেকে । শেষপর্যন্ত জিনিসপত্রকে যেমন করে ক্রেন দিয়ে তোলে লাঠির সাহায্যে প্রায় তেমনি করে উদ্ধার করা হয়েছিল আমায় । বন্ধুবর সঞ্জিৎ পরে এই দুর্দশার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলেছিল `ঝুরো-গুঁড়ো বরফে যেমন করে হাঁটে মানুষ তেমনি করে হাঁটতে হয় এই সুন্দরবনের কাদায় -- এ কি আর যে সে কাদা, একে বলে প্রেম-কাদা, একবার ধরলে ছাড়ে না চট করে ।' সেই সাধের বাইন কাঠের লাঠিখানির কথা এখনো মনে হয় -- যখন আমরা চলে আসি চর ছেড়ে, সে তখনও বিঘৎ দুয়েক বার হয়ে আছে -- যদিও ফেরবার সময় আর দেখতে পাইনি তাকে ।

    লব্ধ বস্তুর খোঁজ পেলুম দিনের শেষে, তারাখালির হেঁতাল জঙ্গলের ধারে । ততক্ষণে দুই ফিরতি পথের জেলের দল যোগ দিয়েছে আমাদের সঙ্গে । এদেরই এক দলে ছিল রুইতন নামের সেই ছেলেটি -- যেখানে ঘন জঙ্গলের মধ্যে কাঁটার মত শ্বাসমূলের জন্য আমাদের প্রত্যেকের গতি শ্লথ -- সেখানে সে চোখের নিমেষে কেবল একটা দা হাতে নিয়ে আরো গভীরে গিয়ে ফিরে এসে বলছে `এখানে কিছু নেই ।' সে ঐ তারাখালির হেঁতাল জঙ্গলে একটু উঁকি দিয়েই বললে `তাড়াতাড়ি কাজ সারুন, কাছেই আছে -- আর বেশি শব্দ করবেন না ।' তা, সতর্কতা বোধহয় একটু বেশিই ছিল -- স্নেহাশিস এমন প্ল্যাষ্টার অব্‌ প্যারি তৈরি করল যে তাতে ছাপ তোলাই গেল না, নতুন করে তৈরি করতে হল -- আর আমার কাছে এসে দেবাশিসদা যখন একটা পেন চাইলেন পেনটা পকেটে এমনি আট্কে গেল আর বারই হল না । আজ মনে হয়, সবচাইতে বিপদজনক পরিস্থিতি ছিল সেদিন । সারাদিনের কাজের শেষে যখন আমরা পরিশ্রান্ত ও বিধ্বস্ত, তখন সে যদি ইচ্ছে করত তো খুব সহজেই তার শিকারের ঘাড়টি ধরে জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে চলে যেতে পারতো কোনো প্রতিবাদের আগেই ।

    পরদিন চরাগাজিখালির বদলে গাজিখালির চরে কাজ করি আমরা -- এও পীরখালির অন্তর্গত একটি অঞ্চল -- বলা ভালো, ব্যাঘ্র অধ্যুষিত ভয়ংকর সুন্দর অঞ্চল । এককালে এ অঞ্চল ছিল গাজীপীরের শাসনে, এই গাজীপীরকে বড়্খান গাজীও বলা হয় । তবে এখনো জানি না এই গাজীপীরই ক্যানিঙের নিকটবর্তী ঘুটিয়ারি শরিফের পীর মোবারক গাজী কি না । অবিশ্যি পীরখালিতে মন্দিরে দেখেছি বনবিবি-শাজংলি-দক্ষিণরায়ের সঙ্গে গাজীপীরের-ও পুজো হচ্ছে । তাঁর সারা জীবন ধরে তিনি এই অঞ্চল দাপটের সঙ্গে শাসন করেছেন । তাঁর অনুগত যে কাউকে তিনি বাঘ, ডাকাত বা যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা করতেন । এই অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করার সময় অনুগতরা তাঁর নির্দেশ মতো নৌকোয় লাগিয়ে নিত লালকাপড় -- যা ছিল গাজীপীরের প্রতি অনুগতির চিহ্ন । `সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে' -- আজও লাল কাপড় বাঁধা হয় লঞ্চের মাস্তুলে ।

    প্রতিদিন সন্ধের সময় পাখিরা যখন সারা দিনের গপ্পো করতে করতে বাসায় ফিরতো -- নদীর জল যখন পুকুরের মত শান্ত হয়ে যেত -- একটু একটু শীতল আমেজ ছড়িয়ে পড়ত বাতাসে -- চতুর্দিক ভরে যেত লালচে আভায় -- তখন আমাদের লঞ্চের নিতাই বা মঙ্গল সামনের এক চিলতে ডেকটা ধুয়ে দিত বালতির জল দিয়ে, তারপর কটিমাত্র বাস পরে ধূপ জ্বালিয়ে পুজো করত মাস্তুলের কাছে গিয়ে । সারাদিনের ব্যস্ততার শেষে ঐ ক্ষণটি বড় মধুর বলে মনে হত -- সমস্ত প্রকৃতির রঙে রঙ মিলিয়ে তারই মত চুপ হয়ে যেতে ইচ্ছে করত । তারপর ত্রক্রমে সন্ধে এগিয়ে যেতো রাত্রির দিকে -- তখন ঝিঁঝিঁর ডাক, জলে ঢেউয়ের মৃদু শব্দ, রাতচরা পাখির ডাক বনের নি:সঙ্গতাকে প্রকট করত যেন । যেন এটিই ছিল অসহ ধৈর্যের অন্তহীন কাল । অন্ধকারের চরম প্রকাশটির জন্য এই অপেক্ষা -- যেমন করে প্রেমিক মন ধৈর্য ধরে তার বঁধুয়ার অন্ত:স্থলের সম্পূর্ণ প্রকাশটির জন্য ।

    ধীরে ধীরে রাত যত গভীর হত এই জঙ্গল যেন আরো নিবিড় মায়াময়তায় জেগে উঠত এক বিশাল আকাশের অজস্র তারার প্রেক্ষাপটে । সার্চলাইটের আলোয় জ্বলে ওঠা একপাল হরিণের চোখ -- জলের ঢেউয়ে আলোর ফুল্কি -- হরিণের কুপ্‌ কুপ্‌ শব্দে ডেকে ওঠা, বা গভীর রাত্রে বীণার রণনে বনবিড়ালের ডাক, কিংবা হিমজ্যোত্স্নার কুয়াশায় সমস্ত বনের অলৌকিক উদ্দামতা -- এই সবকিছুই এক প্রচণ্ড প্রাণময়তায় ক্ষণে ক্ষণে প্রকাশ পেতো ।

    সেবার ফেরবার পথে হল আরেক কাণ্ড । আমরা তখন বিদ্যায় -- হঠাৎ দেখা গেল লঞ্চের আশেপাশে বেশ বড় মত একটা মাছ খাবি খাচ্ছে । লঞ্চটা ওটার যতটা সম্ভব কাছে নেওয়া হল । পশুপতি যেন পাঁজাকোলা করে তুলে নিল মাছটাকে জল থেকে । কাতলা মাছের মত বড় একটা মাছ, মুখের কাছটা রাঙাপানা, পেটের কাছটা একটু ফোলা । পঞ্চাননদা বললেন `পানখাকি মাছ -- উল্টোপাল্টা কিছু খেয়ে পেটে গ্যাস হয়েছে -- অ্যাই ভিতর থেকে একটা ছুরি নিয়ে আয় তো ।' বেশ কৌতুহল হল, দেখিতো কি করে মাছের অসুখ সারানো হয় -- ওমা কোথায় কি ! দেখলুম মাছটার পেট চিরে হাওয়া বার করে, পরে টুকরো করে রান্নার জন্য তৈরি করা হল । সেদিন এই `তথাকথিত' সুস্বাদু মাছটির স্বাদ না পেলেও একথা অনস্বীকার্য যে এত ধরনের মাছ খেয়েছি এই সুন্দরবনে তা কোলকাতায় দেখা তো দূরে থাক, নাম শুনিনি পর্যন্ত । এদের মধ্যে সবচাইতে চর্চিত মাছ হল কানমাগুর মাছ -- যার মাথার পাশে কাঁটা থাকে, যে কাঁটায় থাকে সাপের বিষের তুল্য বিষ । মাছ কোটার সময় সে কাঁটাটি বাদ দিয়ে রান্না করলে পরে পরম সুস্বাদু এই মাছ । তবে এই মত্স্য সংগ্রহের ধারাটি অনেক সময়ই বিশেষ সাদাসিধে ছিল না ।

    জঙ্গলের যেসব অঞ্চলে মাছ ধরা নিষিদ্ধ এমন জায়গায় জেলে নৌকোকে মাছ বা কাঁকড়া ধরতে দেখলেই প্রথমে তার পারমিটটি দেখা হত । আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে হয় এইসব জেলেদের পারমিট থাকে না, নয় পারমিটটি অন্য কারুর নামে -- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা মহাজনের কাছ থেকে পারমিট, নৌকো, জাল সবই ভাড়ায় নিয়ে আসে । এই জেলেদের প্রথমে প্রচুর বকুনি দিয়ে "ফাইন করব" বলে ভয় দেখানো হত -- তারপর এরা যখন কাকুতি-মিনতি করত টাকা নেই বলে, তখন কিছু মাছ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত । এই এক ঘটনাকেই আমরা দুটি পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছি -- প্রথমত যদি বনরক্ষক উত্পীড়কের মত আচরণ করে, তখন পুরো ব্যাপারটাই নিন্দার্হ বলে মনে হয় -- নিজের চোখে দেখেছি জেলেদের দৃষ্টিতে পীড়কের প্রতি জ্বলন্ত সে ঘৃণা -- কিন্তু এও তো সমানভাবে সত্য যে জেলেদের অবৈধ অনুপ্রবেশ জঙ্গলের ক্ষতি করে এবং তার শাসন জরুরি -- অথচ এইসব গরিব মানুষ টাকা দেবে কোথা থেকে ? তাই জেলের অবস্থা বুঝে বিনিময়ে কিছু মাছ নেওয়া যেতে পারে । সুতরাং পুরো ব্যাপারটাই শাসকের মানসিকতার উপরে নির্ভর করে । একবার মেছুয়ার চরের কাছাকাছি, বাঘমারা অঞ্চলে দু-তিনটে অমন জেলে নৌকো ধরা পড়ল -- সেবার আমাদের সঙ্গে ছিলেন রঞ্জিত্বাবু, রঞ্জিৎ মণ্ডল । প্রচণ্ড রাগারাগি করলেন তিনি পারমিট দেখার পরে ।

    --`তোমাদের তো সাগরে থাকার কথা -- কেন ঢুকেছ এই জঙ্গলের মধ্যে ? ফাইন দাও এবারে ।' তারা ভয়ে ভয়ে বলল `টাকা কোথায় পাবো ? মাছ পাইনি যে কিছু ।' `কিছুই কি পাওনি ? একটা-দুটো হলেও দিয়ে তবে যাও ।' তখন তারা একটা কানমাগুর মাছ বার করে দিলে । আবার জিজ্ঞাসা করলেন রঞ্জিত্বাবু `সাগরের কাছাকাছি আছো, কিছুই মাছ পাওনি বলতে চাও ?' তখন তারা উত্তর দিলে, `আপনি এসে দেখেন এই পাটাতনের নীচে, খোলের মধ্যে সব ফাঁকা -- যা কিছু ছিলো আজ্ঞে কাল রাত্রে বাংলাদেশের দিক থেকে চার-পাঁচটা নৌকোর একটা দল এসে কেড়েকুড়ে নিয়ে গেল, মায় নুন তেল মশলাগুলো অব্দি ।' `সেকি ! তবে তোমরা এবার খাবে কি ?' এই বলে আমাদের লঞ্চের ভাঁড়ার থেকে জিনিষপত্রের ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি । পরে বলেছিলেন আমাদের, `হামেশাই বর্ডার এলাকায় ঘটে এসব ; তবে এরাও যে ধোয়া তুলসিপাতা তা নয় -- সংখ্যাতে যদি এরা বেশি হত তবে উল্টোরকম কিছু ঘটতেই পারত ।'

    সেবার মেছুয়াতে কাজ সেরে ফিরেছিলুম ঝড়খালির কাছ দিয়ে -- পথে দোবাঁকিতে একটা জেলে নৌকোর দেখা পাওয়া গেল -- খুব সন্দেহজনকভাবে নৌকাটি তীরে ভেড়ানো আছে -- এরা অনেকসময় এইভাবে বন থেকে বেআইনি কাঠ কেটে নেয় । লঞ্চটাকে নৌকোর কাছে নিয়ে গিয়ে দেখা গেল নৌকোয় দুটি লোক -- কাকা আর ভাইপো । কাকা জ্বরে কাবু হয়ে ছইয়ের তলায় শুয়ে, আর ভাইপো বললে যে গত দুদিনে তারা একটি মাছও ধরতে পারেনি, এদিকে দানাপানি সব গেছে ফুরিয়ে, তাই গত দুদিন ধরে খাবার জোটেনি তাদের -- একা নৌকো বাইতে পারছে না সে আর -- তাই তীরে নোঙর ফেলেছিল । তা, লোকটি যে অভুক্ত তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল তার চোখমুখ দেখে । এরপর সেদিন সে নৌকো লঞ্চের সঙ্গে বেঁধে তাদের গ্রাম ঝড়খালি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল ।

    তাই সামগ্রিকভাবে দেখলে বলাই যায় বনকর্মী আর জেলে-মউলিদের মধ্যে একটা মিথোজীবী সম্পর্ক গড়ে উঠেছে । এইজন্যেই হয়তো সুন্দরবন একটি অন্য পৃথিবী, যেখানে খাদ্য ও খাদক, শাসক ও শাসিত পরস্পরের যথার্থ পরিপূরক হয়ে ওঠে -- যার কোনো একটি উপাদানকে সরিয়ে নিলেই এর তাল যায় কেটে -- বনের পুরোটা আর দেখা হয়ে ওঠে না । এর মধ্যে কোন্‌ উপাদানটি বা কোন্‌ ছবিটি দিয়ে সুন্দরবনকে সবচাইতে ভালো প্রতিভাত করা যায় তার চুলচেরা বিচারটাই অসম্ভব বলে মনে হয় -- বোধহয় এ সব কিছুরই কোলাজে সুন্দরবনকে চেনা যায়, জানা যায় । আর যে সমস্ত মানুষজন বনে বার বার ফিরে আসে তাদের সমস্ত জীবনচেতনায় এই বন এক অপূর্ব শৈলির জন্ম দেয়, যা তাদের উত্তরপুরুষের হাত ধরে এগিয়ে চলে । আজও চোখবুজলে দেখতে পাই পুরন্দরের সেই বিশাল বক্ষের মাঝখানে জাল পেতে ছোট ছোট নৌকোর অবস্থিতি -- বড় বড় ঢেউয়ের তালে তালে তাদের ওঠাপড়া -- তারই মাঝে একখানি নৌকোর আড়পাশে ঘুমিয়ে আছে এক মানুষ, শীতের সে রোদ্দুরে, টান্‌ টান্‌ হয়ে -- আহা ! আমিও যদি অম্নি করে নদীর কোলে ঘুমিয়ে নিতে পারতুম !



    (পরবাস, মার্চ, ২০০৬)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)