• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৬ | অক্টোবর ২০০৫ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • বাংলাভাষায় আফ্রিকার সাহিত্য : স্বপন সেন

    [ আফ্রিকার সাহিত্য সংকলন ; সম্পাদক : বিষ্ণু বসু ; বৈশাখী ; ২০০৫ ; ৩৭/১ আগরওয়াল গার্ডেন রোড, কলকাতা ৭০০০৩৪ ; পৃষ্ঠা ৪১৬]

    নেলসন মাণ্ডেলার আবির্ভাবের আগে পর্যন্ত বাঙালির আফ্রিকা-চেতনা রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় কেন্দ্রীভূত ছিল বলা যায় । উচ্চভাব এবং আবৃত্তিযোগ্যতার বিশিষ্টতায় রবীন্দ্রের "আফ্রিকা" কবিতাটি বাঙালি মানসে স্থায়িত্ব পেয়েছিল । এই কবিতার প্রকাশ ১৯৩৫ সালে । শিক্ষামূলক ভ্রমণে পশ্চিম আফ্রিকা সফর সূত্রে আফ্রিকার মানুষ, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিকতার সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় হয় । তাই এবারের বইমেলায় বৈশাখী প্রকাশিত "আফ্রিকার সাহিত্য সংকলন" (২০০৫) গ্রন্থটি হাতে পেয়ে উল্লসিত হয়েছিলাম ।

    ঔপনিবেশিক উত্পীড়ন বাঙালির সুপরিচিত । আফ্রিকার ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দাসত্বের যন্ত্রণা ও বর্ণবৈষম্যের অবিচার । আফ্রিকার সাহিত্য তাই মূলত প্রতিবাদী সাহিত্য যার সঙ্গে বাঙালি একাত্ম হতে পারে । সাধারণভাবে আফ্রিকার মৌখিক সাহিত্যরীতির সঙ্গে ভারতীয় সাহিত্যের কথ্যরীতির কিছু মিল আছে । বাংলাভাষা তার ব্যতিক্রম নয় । এছাড়া ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে পাশ্চাত্য প্রভাব দুয়ের সাহিত্যেই প্রকট । আফ্রিকার সাহিত্য বিষয়ে বাঙালির আগ্রহ তাই স্বাভাবিক এবং ব্যাপক । এটা কিছু বিস্ময়কর নয় যে বৈশাখী প্রণীত "আফ্রিকার সাহিত্য সংকলন" বাংলাভাষায় আফ্রিকার সাহিত্যের প্রথম প্রকাশ নয় । এমনকি বর্তমান গ্রন্থটি বৈশাখীরই পূর্ব-প্রকাশিত "আফ্রিকা সংখ্যার" পরিবর্ধন ।

    দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ("আফ্রিকার শ্রেষ্ঠ গল্প", ১৯৮৯) এবং শঙ্খ ঘোষের ("ছায়াচ্ছন্ন হে আফ্রিকা", ১৯৯৩) সংকলনে যে প্রচেষ্টার সূত্রপাত, বর্তমান প্রকাশনাটি সেই প্রচেষ্টাকে সমৃদ্ধ করেছে । ইতিমধ্যে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৯২) গল্প এবং সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ("ভিন্ন দেশে নিজের মুখ", ২০০৪) কবিতার অনুবাদ সংকলন প্রকাশ করেছেন । বরুণ চক্রবর্তী ও সুনির্মল চক্রবর্তী প্রকাশ করেছেন আফ্রিকার লোকগাথা । মৌলিক রচনাও হয়েছে কিছু, যেমন ধ্রুব গুপ্তের "আফ্রিকার চলচ্চিত্র" (১৯৯৬) পূর্ব প্রকাশিত সংকলনগুলি এক-একটি বিষয়ে স্বতন্ত্র্য প্রকাশনা, বৈশাখীর সংকলনে একত্রে স্থান পেয়েছে গল্প-কবিতা-উপন্যাস-লোকগাথা এবং নাটক । এইরূপ সমাহার অভিনব ।

    সম্পাদক বিষ্ণু বসু সেনঘর রচিত "চাকা" এবং সোয়িংকা রচিত "ক্যামউড অন দ্য লীভস্‌" এই দুটি নাটকের অনুবাদ করেছেন । সেনেগলের সেন্ঘর প্যারিস নিবাসী, ফরাসী ভাষার লেখক এবং "নেগ্রিচুডে"র "তিন পিতার" অন্যতম । নেগ্রিচুড পাশ্চাত্যের অমানবতার বিরুদ্ধে, কালোর গরিমার স্বপক্ষে, বাস্তববাদী সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে । চাকার কন্ঠে শুনুন রবীন্দ্রের প্রতিধ্বনি -

    চাকা ॥ তাদের চামড়া সাদা, চোখগুলো হাল্কা নীল
    তাদের বুলি উলঙ্গ এবং
    তাদের মুখগুলো সরু
    এবং বজ্র নিক্ষিপ্ত হয়েছিল তাদের জাহাজ থেকে ।

    রবীন্দ্রনাথ ॥ এল ওরা লোহার হাতকড়ি নিয়ে
    নখ যাদের তীক্ষণ তোমার নেকড়ের চেয়ে
    এল মানুষ ধরার দল
    গর্বে যারা অন্ধ, তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে ।
    নাইজেরিয়ান ওলে সোয়িংকা নেগ্রিচুডের ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন কেবল চামড়ার রং-নির্ভর গর্ব কালো মানুষকে আত্মরক্ষা সচেতন করে তুলবে ভেবে । তাঁর ইংরেজি নাটকটিতে ইওরোবা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘর্ষ এবং খ্রিষ্টধর্ম ও আফ্রিকার পেগান ধর্মগুলির দ্বন্দ্ব রূপ পেয়েছে । কিন্তু অবশেষে সব ছাপিয়ে উঠেছে মানুষের কথা ।

    সংকলনটিতে ছোটগল্প রয়েছে পাঁচটি । চারটি এসেছে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে । নোবেল বিজয়িনী নাদিন গোর্ডিমারের দুটি । নাদিন আফ্রিকাজাত শ্বেত রমণী, তার গল্প ক্ষুরধার । অনুবাদ সে ভাবটি ধরে রেখেছে, কিন্তু ফলে পাঠ হয়েছে কঠিন । পক্ষান্তরে আচেবের গল্পটি স্বচ্ছন্দ ও সরেস ভঙ্গিতে পরিবেশন করেছেন বসু ।

    সংকলনে গৃহীত দুটি উপন্যাসেরই মূল রচনা আরবী ভাষায় । মিশরের নাগিব মেহফুজ (নোবেল পুরস্কার, ১৯৮৮) এবং সুদানের তায়েব সাশিহ্‌ দুজনেই জনপ্রিয় এবং খ্যাতনামা । তাদের উপন্যাস বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যে সম্পাদককে ধন্যবাদ । বিশেষ করে আরবী সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ এবং কাইরো ট্রিলজির লেখক মেহফুজের উপন্যাসটি সুনির্বাচিত । পাশিহ্‌ মূলত গল্পকার এবং বাঙালি পাঠকের কাছে পূর্ব পরিচিত ।

    বাঙালির সাহিত্য আকর্ষণ কবিতার প্রতি সমধিক । এই গ্রন্থে আছে চব্বিশটি কবিতা । তার মধ্যে পাঁচটি বাংলায় পূর্ব প্রকাশিত । কবিদের মধ্যে নেতো, এগভিরিন্হা, দাঁদি, দিওপ এবং দীপাকো অন্যতম । আফ্রিকার বিখ্যাত কবিদের বেশিরভাগই প্যারিস-লণ্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন এবং কবিতা লিখেছেন ইংরেজি-ফরাসী ভাষায় । কবিতা ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী, জাতীয়তাবাদী কিংবা নেগ্রিচ্যুডের সমর্থনে রচিত । উত্তর-ঔপনিবেশিক কবিতাও অন্তর্ভূক্ত হয়েছে । (মালাঙ্গে, ব্রু, মাপাঞ্জে প্রমুখ)। গ্রন্থের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ ও কালিদাস নাগ রচিত "আফ্রিকা" কবিতা দুটি যুক্ত করা সুবুদ্ধির পরিচায়ক । বিশেষত: ১৯৩৬ সালে রচিত দক্ষিণ আফ্রিকাবাসি কালিদাস নাগের কবিতাটি তত সুপরিচিত নয় এবং দুষ্প্রাপ্য । দুটি কবিতাতেই আফ্রিকার সাংস্কৃতিক মাহাত্ম্য বর্ণনা করে দাসত্ব ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানান হয়েছে ।

    অনুবাদ এসেছে প্রধানত ইংরেজি ভাষা থেকে । মুষ্টিমেয় ক্ষেত্রে ফরাসী থেকে । বেশ কিছু কাজ অনুবাদেরও অনুবাদ । কবিতার অনুবাদক অনেকেই সুকবি, কিন্তু আফ্রিকার ভাষা, মানুষ ও ভৌগোলিকতার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় রহিত । মূল রচনার জটিলতাও অনেক সময় প্রতিকূলতা বাড়িয়ে তুলেছে । ঘানার কবি ওয়েসি ব্রু'র কয়েকটি দুরূহ পঙ্ক্তি অনুবাদক অলোক সেন নিপুণভাবে সামলেছেন :

    আসলে যা নতুন, চিরদিন তা পুরোন
    এবং নতুনই চিরদিন
    একদা যা ছিল - আজ অন্যরকম
    শেষ পর্যন্ত, সবসময়ই তা একইরকম ।

    গ্রন্থারম্ভে আফ্রিকার সাহিত্যের ভূমিকা ও প্রেক্ষিত পর্যালোচনা করে প্রবন্ধ যোগ করার ধারণাও সুসম্পাদনার লক্ষণ । ঈপ্সিতা চন্দ এবং উজ্জ্বল সিংহের রচনাদুটি সমৃদ্ধ । লেখক-পরিচিতি যুক্ত হয়েছে গ্রন্থশেষে । এই পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দায়সারা ভাবে নিষ্পন্ন হয়েছে । ৩৯ জনের মধ্যে ১৯ জনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে , কারও জন্যে বরাদ্দ আধ পৃষ্ঠা, কারও এক-লাইন । দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের বইটিতে পরিচয় লিপিবদ্ধ রয়েছে প্রতিটি গল্পের শুরুতে, মোটামুটি সমমাত্রায়, এবং তথ্যসমৃদ্ধতায় । ছাপার ভুল রয়েছে অজস্র । এমনকী মলাটে বইয়ের শিরোনামটিও ছাপার ভুলের হাত থেকে রেহাই পায়নি । সম্পাদনার ত্রুটি কবিতার ক্ষেত্রেই প্রকট । ভূমিকার প্রবন্ধগুলিতে যেসব লেখক এবং রচনাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে নির্দেশ করা হয়েছে, সংকলনের নির্বাচন তার সঙ্গে যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ নয় । মূল রচনা হাতে পাওয়ার সমস্যা, স্থানাভাব ইত্যাদি সত্য । কিন্তু একজন কবির পাঁচটি কবিতার অন্তর্ভুক্তি এবং পাঁচটি কবিতার পুন:প্রকাশ আফ্রিকার সাহিত্যের বিশালতার প্রতি সুবিচার করে না, বিশেষত বাংলায় অনুবাদ যখন সদ্য শুরু হয়েছে ।

    জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধের অনুবাদে মূলরচনার সঙ্গে ংএ পুঙ্খানুপুঙ্খ সঙ্গতিরক্ষার প্রয়োজন হয় । কাব্য-সাহিত্য অনুবাদের ক্ষেত্রে সে প্রয়োজন একটু কম । এখানে মূল রচনার ভাবটি যথার্থ ধরতে পারলে দু-একটি শব্দ চয়নে অল্প স্বাধীনতা নেওয়া চলতে পারে । অনেক সময় যথার্থ শব্দটি দু'ভাষাতেই মেলে না বিশেষত: শব্দটি যদি হয় সংস্কৃতি সাপেক্ষ এবং সেই কারণে বিশেষ দ্যোতনা বহনকারী । একাধিক অনুবাদক বিশেষ বিশেষ শব্দ নিয়ে তাদের সমস্যার কথা আমাকে জানিয়েছেন । সম্পাদকের তরফে এবিষয়ে কোনো প্রতিবেদন রাখা হয়নি, বা মূল রচনার সূত্র পেশ করা হয়নি । অনুবাদের পদ্ধতি নিয়েও কোনও আলোকসম্পাত নেই ।

    আরেকটি দৃষ্টিকটু সমস্যা হল নামের বানানের যথেচ্ছাচার । নাদিন হয়েছেন নাদিম, আচেবে হয়েছেন আচিবি, নিজের হয়েছে নাইজার ইত্যাদি ।

    গোপা মজুমদার পরবাসে লিখে জানিয়েছেন তিনি যখন সত্যজিৎ রায়ের গল্পের অনুবাদে হাত দেন, কেমন করে তার সম্পাদক সত্যজিতের অনুমতি সংগ্রহ করেন, কেমন করে তিনি প্রয়োজনে তাকে চিঠি লিখে ব্যাখ্যা জানতে চান, এমনকি সত্যজিতের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেন । কলকাতার অনুবাদক আফ্রিকার লেখকের সঙ্গে এমত যোগাযোগ করবেন তা হয়ত আশা করা যায় না, কিন্তু মনে কি হয় না যে তেমন হওয়াই যথার্থ ? আফ্রিকার সাহিত্য সংকলন পথিকৃৎ না হলেও অগ্রণী । তার প্রকাশক সম্পাদক এবিষয়ে মান স্থির করতে সক্ষম । অন্তত `আফ্রিকী', `আফ্রিকীয়', নাকি সাদামাটা `আফ্রিকার' এটা তারা সাব্যস্ত করতে পারতেন । ংঈংইশঠূছ নাকি ংঈংইশঠবছ -এ অনিশ্চয়তা জিইয়ে রাখাও অপ্রয়োজনীয় ।

    এইসব ছোটখাট ব্যাপার বাদ দিলে আফ্রিকার সাহিত্য সংকলনে আছে বহু মণিমুক্তো । বৈশাখী এবং বিষ্ণু বসুকে অভিনন্দন তারা একটি দুরূহ কর্ম সুসম্পন্ন করেছেন বলে । বাঙালি পাঠক সদ্য আফ্রিকার সাহিত্যের স্বাদ পেতে শুরু করেছেন, নানা রচনার সমৃদ্ধ সম্ভার তারা উপস্থিত করেছেন । তাঁদের সাধুপ্রচেষ্টাকে ধন্যবাদ ।


    [বর্তমান প্রবন্ধে বাংলাদেশ থেকে সম্ভাব্য প্রকাশনার কোন উল্লেখ নেই পর্যালোচকের অজ্ঞানতা হেতু ]

    (পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments