• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৬ | অক্টোবর ২০০৫ | গল্প
    Share
  • গ্রাম্যগীতি : জয়শঙ্কর প্রসাদ
    translated from Hindi to Bengali by দোলনচাঁপা চক্রবর্তী

    শরৎ পূর্ণিমার রাত । কমলাপুর সংলগ্ন অঞ্চলের ভূ-খণ্ডকে গঙ্গা তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলে দুধের নদীর মতো বইছে । আমি আমার বন্ধু ঠাকুর জীবন সিংহের সঙ্গে ওঁর প্রাসাদের চূড়ায় বসে প্রকৃতিকে দেখতেই তন্ময় ছিলাম । সে তার নিজের উজ্জ্বল হাসিতে মগ্ন । নক্ষত্রের মালায় সেজে চারপাশের দিগন্তরেখা ঝলমলিয়ে উঠেছে । ধবলবিধু-বিম্বের কাছাকাছি একটা ছোট্ট তারা আকাশপথে চলে বেড়াচ্ছে ; যেন চাঁদকে ছঁংউয়ে ফেলতে চায় ; কিন্তু কিছুতেই ছঁংউতে পারছে না ।

    আমি জীবনকে জিজ্ঞাসা করলাম - বলতে পারো, ওটা কোন তারা ?

    রোহিণী হবে । -- জীবনের অনুমানের রকম দেখে, আর তার উত্তর শুনে হেসেই ফেলতাম ; সহসা শুনতে পেলাম --
           বরজোরি বসে হো নয়নওয়া মে --

    মর্মান্তিক যন্ত্রণাক্লিষ্ট সুরলহরী । হৃদয় নিংড়ানো কষ্ট ছিলো তাতে । আমার হাসি থেমে গেলো । গঙ্গার ও পারে শ্যামল বৃক্ষরাজির মধ্যে ওই যন্ত্রণার উত্সমুখ খোঁজার বৃথা চেষ্টা করছিলাম ; কিছুই দেখা গেলো না । স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম, সহসা আবারো শোনা গেলো --

    অপনে বাবা কি বারি দুলারি
    খেলত রহলী অঙ্গনওয়া মে,
    বরজোরি বসে হো--
    চুপ করে শুনতে লাগলাম, যেন কোন ভুলে যাওয়া কাহিনি । মনের মধ্যে উত্কন্ঠার সঙ্গে সঙ্গে নিবিঢ় কৌতূহল জমা হচ্ছিলো । আবার শুনতে পেলাম--

    ঈ কূল বঁতিয়া কবোঁ নাহি জানলি
    দেখলি কবোঁ না সপনওয়া মে
    বরজোরি বসে হো--
    মূর্খের মতো ভাবছি ওই গানের মানে কি হতে পারে । উঠোনে খেলে বেড়ানো বংশের প্রদীপ রে, কি সে কথা ? জানার জন্য মন দুরন্ত বালকের মতো চঞ্চল হয়ে উঠলো । অজানা কথার সেই রহস্যজালে বন্দী হয়ে মন মাছের মতো এই জ্যোত্স্না ভরা সমুদ্রে ছটফটিয়ে উঠছে ।

    আমি অধীর হয়ে বললাম, -ঠাকুর ! ওকে ডেকে পাঠাবে ?
    -- না । ও একটা পাগলী ।
    -- পাগলী ! কক্ষণো না ! যে এমন গাইতে পারে, সে কখনো পাগলী হতে পারে না । জীবন, ওকে ডেকে পাঠাও, অজুহাত দিও না ।
    -- তুমি বৃথা জেদ করছো - একটা দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে রাখতে রাখতে জীবন বললো ।

    আমার কৌতূহল আরো বাড়লো । বললাম- জেদ নয়, লড়তে হলেও রাজি আছি । ওকে ডেকে পাঠাতে চাইছো না কেন বলতো ?
    -- ও এই গাঁয়েরই ভাঁটের মেয়ে । কিছুদিন ধরে মাথার গোলমাল দেখা দিয়েছে । কখনো কখনো রাতভর গঙ্গার তীরে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে বেড়ায় ।
    -- তাতে কি হল ? ডেকে পাঠাও না !
    -- না, আমি ওকে ডেকে পাঠাতে পারবো না ।
    -- ঠিক আছে, তাহলে শুনি অন্তত: যে কেন ডাকতে পারবে না ।
    -- ও শুনে আর কি করবে ?
    -- শুনবো তো নিশ্চয়ই ঠাকুর ! তোমার জমিদারিতে এখন বসে আছি বলে ভেবো না যে ভয় পাবো । -- হেসে বললাম ।
    জীবনসিংহ বললো, ঠিক আছে, শোনো --

    তুমি তো জানো, গাঁ-ঘরে ভাঁড়দের প্রধান কাজ হোলো, উত্সবের সময় গ্রামের জমিদারের বাড়িতে প্রশস্তি-গীত গাওয়া । ওদের মেয়ে-বৌরা ঘরে ঘরে গান-বাজনা করে থাকে । নন্দনও সেই রকম আমার জমিদারীর আশ্রিত ভাঁট । ওর মেয়ে রোহিণী বিধবা হয়ে গেছিলো --

    আমি মাঝপথেই বাধা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি নাম বললে ?
    জীবন বললো, রোহিণী । সে বছরই ওর দ্বিরাগমন হওয়ার কথা ছিলো । নন্দন লোভী নয় । অন্য ভাঁড়দের মতো মন খুলে চাইতেও ওর সঙ্কোচ হয় । এখান থেকে অল্প দূরে গঙ্গার তীরে ওর কূটির । ওখানটা গাছে গাছে ঠাসা । একদিন ক্ষেত দেখে ঘোড়ায় চড়ে ফিরছি । প্রচণ্ড রোদ । নন্দনের কুটিরের কাছে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে পড়লাম । নন্দন আমাকে দেখতে পেয়ে, নিজের কূটিরে কম্বল পেতে বসালো । আমি লু' লাগতে পারে ভেবে ভয় পাচ্ছিলাম । তাই ওর ওখানেই কিছুক্ষণ বসার সিদ্ধান্ত নিই ।

    জীবনকে অজুহাত দিতে দেখে হেসে ফেললাম । কিন্তু সেটাকে আদৌ পাত্তা না দিয়ে জীবন অটল গাম্ভীর্যের সঙ্গে নিজের কাহিনি বলে চললো ।

    হঁযা তো-- নন্দন চেঁচিয়ে ডাকলো -- রোহিণী, এক ঘটি জল নিয়ে আয় মা, ইনি তো আমাদের মালিক, এঁর কাছে লজ্জা কিসের ?
    রোহিণী এলো । তার যৌবনের তখন সবে প্রভাত হয়েছে । কায়িক পরিশ্রমে ওর শরীরের এক-একটি শিরা আর মাংসপেশীগুলো সুদৃঢ় হয়ে উঠেছে । দেখলাম, ওর নত মুখে কাজল-কালো চোখের পাতা ছড়িয়ে পড়েছে , আর তা থেকে মায়া-মমতার এক অদৃশ্য সরস্বতী যেন অকূল প্রবাহে বইছে । আমার মন কেন জানি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো । বেশীক্ষণ আর ওখানে বসতে পারলাম না । বাড়ি ফিরে এলাম ।

    বিজয়া দশমীর উত্সব । বাড়িতে গান-বাজনা হচ্ছে । আমার স্ত্রী'র কাছে গিয়ে বসেছি । উনি বললেন, -- শুনছো ?
    বললাম, -- দু'খানা কান দিয়েই !
    স্ত্রী বললেন, রোহিণী আজকাল দারুণ গাইছে । আরো আশ্চর্যের কথা, গান বানায়, আর গায়ও । তোমার গাঁয়ের মেয়েরা তো বড়ো গুণবতী । হুঁ বলে উঠে বাইরে চলে আসছি ; দেখি, রোহিণী যবের ছড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । মাথা নামিয়ে দিলাম, যবের পাতলা পাতলা ধানী ছড়াগুলি আমার কানের দু'পাশে আটকে দেওয়া হোলো, ওকে কিছু না দিয়েই বাইরে চলে এলাম । পিছনে শুনতে পেলাম, এমন ধৃষ্টতা দেখানোর জন্য আমার মা' ওকে তারস্বরে বকছেন । সে দিন থেকেই মহলে ওর আসা বন্ধ হয়ে গেলো ।

    নন্দন খুব কষ্ট পেলো । সেও আসা বন্ধ করে দিলো । একদিন শুনি, ওর বান্ধবীরা আমার সঙ্গে ওর সম্বন্ধ নিয়ে ওকে ক্ষেপাচ্ছে । হঠাৎ ও তুমুল রেগে বলে উঠলো- তাতে তোমাদের কি ? আমি মরি নিজের জ্বালায়, ভালোবাসি ওঁংএঁক, তো তোমাদের এত গায়ের জ্বালা কিসের ?

    ওর সখীরা বললো, -- বাপ রে ! এর অহঙ্কার দ্যাখো ! ও আরো উত্তেজিত হয়ে উঠছিলো । ওরা রোহিণীকে এত দূর পর্যন্ত ক্ষেপালো যে সে আপন মনে বকতে আরম্ভ করলো । সে দিন থেকেই ওর ওই বকুনি বন্ধ হয় নি ।

    জীবনসিংহ নিজের কথা শেষ করে চুপ করে ছিলো, আর আমি নিজের কল্পনায় সেই গান আবারো শুনতে পাচ্ছিলাম -

    বরজোরি বসে হো নয়নওয়া মে ।
    সত্যিই গানটা যেন ত্রক্রমশ: কাছে আসছিলো । এবার শুনলাম ......
    মুরি মুসুকেয়াই পঢ়ো কছু টোনা,
    গারী দিয়ো কিধো মনবা মে,
    বরজোরি বসে হো--
    ওই গ্রামীণ ভাঁড় ভাষায় পাগলীর হৃদয়ের সরল কথা - মর্মস্থল থেকে উঠে আসা ব্যথা ছিলো । তন্ময় হয়ে যাচ্ছিলাম ।

    জীবনসিংহ কি কারণে যেন চঞ্চল হয়ে পায়চারি করতে শুরু করেছে । ছাতের নিচে গান শোনা গেলো । আকুলতা ভরা সেই তান কেঁপে উঠে হৃদয়ে ঘা দিচ্ছিলো । বললাম- জীবন, ওকে ডেকে আনো, একবার অন্তত: এই প্রেমযোগিনীর দর্শন করি ।

    হঠাৎ সিঁড়িতে ধমধম শব্দ শোনা গেলো, পাগলী রোহিণী এসে জীবনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো । পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে সেপাই এসেছিলো । সে বললো- বেরো পাগলী ।

    জীবন আর আমি নিশ্চুপ ছিলাম । সে একবার ঘুরে সেপাইয়ের দিকে তাকাতে সেপাই যেন খানিকটা পিছু হটলো । পাগলী রোহিণী আবার গেয়ে উঠলো--
    ঢিঠ ! বিসারে বিসরত নাহি
    ক্যায়সে বসু যায় বনওয়াঁ মে
    বরজোরি বসে হো......
    হঠাৎ সেপাই কর্কশ স্বরে আবার চেঁচিয়ে উঠলো । ও ভয় পেয়ে পালাতে গেলো, না পিছনে সরে গেলো, তা আর মনে নেই । কেবল ছাতের নিচে গঙ্গার চন্দ্রালোকিত বক্ষে ঝপাস করে একটা শব্দ হল । জীবন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেই থাকলো । আমি ওপরে আকাশে সেই অনন্ত প্রচেষ্টার দিকে তাকিয়ে ছিলাম । রোহিণী চাঁদের পিছনে ছুটে চলেছে, আর নিচে গঙ্গার বুকে ওই ঝাঁপ থেকে জন্ম নেওয়া অগণ্য বুদবুদের মধ্যে প্রতিবিম্বিত রোহিণীর আলো মিলিয়ে যাচ্ছিলো ।




    জয়শঙ্কর প্রসাদ হিন্দী সাহিত্যের ইতিহাসে শ্রী জয়শঙ্কর প্রসাদ (১৮৮৯-১৯৩৭) একটি সুপরিচিত এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় নাম । আধুনিক হিন্দী সাহিত্যের পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে । বারাণসীর অত্যন্ত সমৃদ্ধ বণিক পরিবারের সন্তান জয়শঙ্কর প্রসাদ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর স্কুল ছেড়ে বাড়িতেই পড়াশুনা আরম্ভ করেন । ধর্মীয় এবং সাংষ্কৃতিক পারিবারিক আবহে বেড়ে ওঠার কারণে তিনি ভারতীয় ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, এবং পুরাণ অধ্যয়নে ব্রতী হন । ইংরেজি ছাড়াও তিনি সংষ্কৃত, পালি এবং প্রাকৃত ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন । কবিতা, ছোট গল্প, ঊপন্যাস, নাটক, এবং প্রবন্ধ - সাহিত্যের সবক'টি ধারাতেই তাঁর বিচরণ ছিলো সাবলীল । প্রসিদ্ধ ছায়াবাদী ধারার কবি শ্রী প্রসাদ রচিত `কামায়নী' হিন্দী সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বোত্কৃষ্ট বলে পরিগণিত । রামচরিতমানসের পরেই এর স্থান স্বীকৃত হয়েছে । ছায়া, আকাশ-দীপ, আঁংইধ, এবং ইন্দ্রজাল তাঁর প্রসিদ্ধ ছোট গল্প সংকলন । প্রবন্ধগুলির মধ্যে `কাব্য ঔর কলা', `রহস্যবাদ', `যথার্থবাদ ঔর ছায়াবাদ' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । নাটক রচনায় প্রথমদিকে সংস্কৃতের ভাবানুসারী হলেও পরবর্তীকালে তাঁর নাটকে বাংলা এবং পারস্যদেশীয় নাটকের প্রভাব পড়ে । স্কন্দগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত, এবং ধ্রূবস্বামিনী অধিক খ্যাতিলাভ করলেও জয়শঙ্কর প্রসাদ বিরচিত আরো দশটি নাটক হিন্দী সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে ।

    (পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments