কিছুক্ষণ বাদে বাদেই ডান হাতের মুঠো ভর্তি করে তুলে নেয় রগরগে ধুলো । বাঁ হাতে সযত্নে বেছে ফেলে ইটের টুকরো বা কাঁকর । সেগুলো এক এক করে পকেটে পোরে । তারপর হেসে তুড়ি দিতে দিতে ফু: .. ফুঁ:... ফুঁ ..., এভাবে সারা দিনে তার মুখে ধুলোর কতটা পুরু আস্তরণ জমে ওঠে, হিসেব রাখে না কেউ ।
বয়স তার হতে পারে চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশ কিংবা ষাট । একটা চোখে ছানি পড়েছে । মুখের বলিরেখায় পূর্বজীবনের টানাপোড়েন । মাথার চুলে বারোমেসে চোতপাবন । শতচ্ছিন্ন জামা, তাপ্পিমারা প্যান্ট । কিন্তু কোমরের বেল্টটি ভারি চকচকে !
এ শহরতলিতে এটাই একমাত্র পার্ক । অবিশ্যি এখানে ছোটরা আসে না তেমন । বেশ কিছু ঝাঁকড়া গাছ নির্বিঘ্নে শেকড় চারিয়ে দেবার সুবাদে এটা এলাকার যুবক-যুবতীদের জন্যই ত্রক্রমে ত্রক্রমে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে । তাতে লোকটার সুবিধে হয়েছে - এমনটা বলা যায় । বাচ্চাদের ঢিল খেতে হয় না তাকে । উপরন্তু উদ্ভিন্নযৌবন সব প্রণয়ীযুগল সাময়িক ঔদার্যে তাকে ঝালমুড়ি, বাদামভাজা ইত্যাদি উপহার দিয়ে ফেলে । দান-ধ্যানের পুণ্য খেজুরে প্রেমের বুনিয়াদ পোক্ত করুক, না-করুক লোকটার প্রাণরক্ষা হয়ে যায় কোনমতে । হতেই হয় কারণ এ তল্লাটে আসা ইস্তক তাকে পার্কের বাইরে রাস্তায় পা বাড়াতে দেখা যায় না ।
পার্কের এককোণে একটা কৃত্রিম জলাশয় । সেখানে নানা বয়সের কালো-সাদা-খয়েরি হাঁসের আস্তানা । লোকটা সারাদিনে বারকয়েক জল খায় সেখানে । কিন্তু গায়ে জল দিতে তাকে কেউ দেখে না । হাঁসগুলো কখনো সখনো তার পায়ে ঠোক্কর মারে । তবে তাতে রক্তপাত হয় না । এদেরই সৌজন্যে কপোত কপোতীদের কাছে এটা অতি আদরের হাঁসপুকুর - সেখানে অনেকে স্বেচ্ছায় হাঁস ফাঁস করতে আসে !
- তুই কোথা ?
- আমি হাঁস । তুই ?
- আমিও হাঁস ।
এরকম পথচলতি ধার করা সংলাপে মাঝে মাঝেই প্রবীর-বিজনের সন্ধে মিলিত হয় । হাঁসপুকুরের পাড়ে বেঞ্চে বসে অন্নচিন্তা ছেড়ে তারা বাংলা কবিতার মানচিত্র পালটে দেওয়ার দৃপ্ত জেহাদ ঘোষণা করে বসে ।
লোকটা আপনমনে ধুলো ওড়ায়- I> প্রবীর বলে ওঠে একদিন ।
বাকিরা অগর্হিত কাজ করে যায়- I> জের টানে বিজন ।
-কীভাবে লাইনগুলো মাথায় চলে আসে বলতো ?
- আমি কি মস্তিষ্কবিজ্ঞানী ?
এলোমেলো সংলাপ পরিধি ছেড়ে অজান্তেই অমোঘ কেন্দ্রের দিকে সরে আসে ।
-হ্যাঁ রে, ব্যাণ্ডের গান ছিল না - সব পাগলের পাগলী চাই ?
-ছিল বুঝি ? জুটে যাবে ঠিক ...
- বলছিস ?
-আলবাত । এই একগলা বাতাসে দাঁড়িয়ে বলছি । কবিবাক্য কভু মিথ্যা যায় না ।
আঁ... আঁ... আঁ...
ধুকতে ধুঁকতেই আবারো নিজের অস্তিত্ব জানান দিল সে । স্বাভাবিক নিয়মেই প্রবীর- বিজনের একপেশে চোখ পড়লো - চিমসে মাটিমুখো দু'দলা মাংসের আভাস !
- ধুস, এর মধ্যে কাব্যি নেই ।
- আমাদের উনি কোথায় রে ?
- উল্টোদিকের কোণে দাঁড়িয়ে ধুলোপড়া দিচ্ছে । চ, এটার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দি ।
- উঁহু, আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে উনিই সে পর্ব ঠিক সময়ে সেরে ফেলবেন । কিন্তু মালটা চোখ বুজে কী করছে বলতো ?
লোকটা দুচোখ বুজে তাকিয়ে থাকে - বিজন তেরছা চোখে তাকালো ।
যেখানে কথা হারায় মনের বাঁকে - প্রবীরের মুখে নিমেষে বিজয়ীর হাসি ।
এসব মুহূর্তে ভাববাদ বস্তুবাদ দশ মাইল দূরে গলা জড়াজড়ি করে কুঁকড়ে পড়ে থাকে । কেউ ভ্রুক্ষেপ করে না ।
আঁ...আঁ...আঁ...
চিত্কারের তীব্রতায় সকলে চমকে উঠলো ।
- এ তো ভারি আপদ !
- ধ্যাত্, কী বলছিস যা তা ! পিঠের ঘা খানা দ্যাখ । একবার ডাক্তার দেখানো যায় না ?
এই সব আলগা পরিকল্পনার ফাঁকে নিয়মমাফিক চাঁদ ওঠে । নীলচে-কালো আকাশটার গা খেয়ে অক্লেশে পিছলে পিছলে যায় । রাতচরা পাখিগুলো ক্যাঁচোর ম্যাচোর শব্দে খাদ্যের অভ্যেস করে । - জ্যোত্স্নার ফ্যাকাশে হলুদটা কী রকম পুঁজের মতো না ?
- চল, ওকে একটা পাঁউরুটি কিনে দি ।
হারিয়ে জন্ম নিতে বক্র হাসে
হেসেও অদৃশ্য হয় কপট ত্রাসে
যেন তার শেকড়গুলো টানছে শুধু
পেছনে, বিতৃষ্ণ মাঠ সামনে ধূ ধূ
লোকটা বারেক করে জল সিঞ্চন
শুকনো মাঠের পরে ধুলোর বসন
এই তো শহরতলির একটা পুঁচকে পার্কের মাঠ । তারও চারপাশের পাঁচিলটা কাব্যের দৌরাত্ম্যে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো এবার । চেনা মাঠটা ছড়িয়ে গেল চোখের চৌহদ্দি পেরিয়ে অন্য গ্রহে ? তাহলে তো লোকটাও নেহাৎ পাগল থাকে না আর !
প্রবীর বিজন আলোচনা করে । তবে এ নিয়ে বেশি ভাবতে গেলে মাথা ধরে আসে । ঘুম পায় । পৃথিবীর সব মাথা যদিও একসঙ্গে ঘুমোয় না । তাই হিজিবিজি আঁচড় পড়তেই থাকে - খাতায় কিংবা মনে । সেসব আঁচড় প্রায়শই কোন সফল পরিণতি পায় না - কি কাব্যে - কি বিজ্ঞানে । তবু প্রচেষ্টার একগুঁয়েমি জগৎ জীবনকে চালিয়ে নিয়ে যায় ।
প্রবীর বিজন অগত্যা নিজস্ব এক সহস্র পাগলীর মুখ কল্পনায় আনে, স্খলিত হয় আর বংশানুক্রমিক অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে অতি বৃদ্ধ পিতামহদের মুণ্ডুপাত করে ।
লোকটা তার নৈশ রাজত্বে দু'চারটে কুকুর ছাড়া আর কারুর অনুপ্রবেশ পছন্দ করে না । তাই নি:শব্দে মেয়েটার পেছনে এসে ক্যাঁৎ করে পিঠে একটা লাথি মারে । ঘা থেকে কিছুটা পুঁজ ছিটকে এসে পায়ে লাগে । মেয়েটা দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে উঠে একটা ঢিল ছুঁড়ে মারে তার কাঁধে ।
এই বেআদপি তাকে আরো ত্রক্রুদ্ধ করে । সে সজোরে ধাক্কা মেরে একটানে মেয়েটার ঊর্ধ্বাঙ্গের গামছা খুলে নিয়ে ছুট লাগায় ।
পেছন পেছন খানিক দূর তাকে ব্যর্থ আক্রোশে তাড়া করে আসে আঁ... আঁ... আঁ... ।
- কী করে বুঝলি ? কোন্ যুক্তিতে ?
- যুক্তি নয় বাছা, জীবনে অনুভূতি আর কর্মই যে প্রধান !
- কিয়ের্কেগার্দের দর্শন ফলানো হচ্ছে ? মারবো পেছনে এক থাপ্পড় !
পাঁচমিশেলি জল্পনা দিনভর তরঙ্গ তোলে, মিলিয়েও যায় আবার ।
চাঁদ ওঠে, মেয়েটার খেঁকুরে মুখ, শুকনো বুক আর ঘেয়ো পিঠের দিকে চোখ পড়তেই সে মুখ লুকোয় মেঘের ফাঁকে । বাতাসের ঠেলায় বেরোয় কিছুক্ষণ পর । ফের মুখ ঢাকে । এমনটা চলতেই থাকে ।
লজ্জা হয় দু'কারণে । এক, অবিচারজনিত রাগে বা ঘেন্নায় - অসহায়তার ঢাল হিসেবে । দুই, সঙ্কোচ-ভালোবাসার গায়ে গয়নার লেপন দিতে । প্রথমটা যখন সমাজসচেতন মানুষকে আত্মধিক্কারে উন্মন করে দ্বিতীয়টা তখনো সমান সক্রিয়তায় লিখিয়ে নেয় -
সাদরে আড়াল রাখে কথার ঝাঁপি;
কথারা লাজুক, তেমন নয় আলাপী
সে লোক নাছোড়বান্দা, কলম দিয়ে
অঝোরে রক্ত ঝরায় বুক খুঁচিয়ে
এই দ্বন্দ্বময়তা কারুর ভালো না লাগতেই পারে । কিন্তু একে অস্বীকার করাও যায় না আজীবন ।
শারীরিক রক্তপাতে মারা গেলে তো ল্যাঠা চুকেই গেল । কিন্তু অহর্নিশ যে মানসিক রক্তক্ষরণ - প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির, পাপবোধ-পাপমোচনের - কীসে তার শুশ্রুষা ? কিছু শব্দ উগরে দেওয়ায় ? অবশ্য সে রাস্তাও নয় সবার ।
শব্দ পড়ে কেউ সৎ হয় না, শব্দ লিখে কেউ সৎ হয় না । শব্দসহবাস বড় জোর জ্ঞানপাপী মানুষকে শান্তি দেয় দু'চার দণ্ড । শান্তি না গোপনে পাপস্বীকারের নিরাপদ শ্লাঘা ?
যে কোন সৃষ্টির মূলে থাকে যে বেদনাবোধ, বিপন্নতা, থাকে যে নির্মমতা, নির্মোহতা, শিশ্নোদরপরায়ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কোন অকৃতজ্ঞ সমীকরণে সমাধান পাবে তার ? প্রাণের ধ্বংস অবধি চলবে এমতো কূটতর্ক ।
তর্কে-বিতর্কে ক্লান্ত হয়ে কেউ কেউ জিরোতে বসবে পার্কে । দেখবে পাগলীটা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে । মুখের অদূরে কুকুরের পুরীষ । পিঠের ঘা-টা নিরাময়হীন আরো বীভত্স ভাবে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে পিঠ ছাড়িয়ে তাবৎ পেটে বুকে মাথায় । আধবোজা লালচে চোখদুটো এসবই শ্রান্তিভরে দেখে যায় খালি । বলতে চায় না কিছুই । মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে আঁ... আঁ... আঁ... ।
মাঝরাতের নিশুতিতে পাগলটা ফিরে এসে বোধ করি মুক্তি দিতে চায় তাকে । ভারি পাথর দিয়ে বেশ করে থেঁতলে দেয় মাথাটা । চিল চিত্কারে কারুর টনক নড়ে না । ফলে দিব্যি ভেংচি কেটে বলতে পারে সে অ্যাঁ... অ্যাঁ... অ্যাঁ... ।
আর পরক্ষণে আশ্চর্য শান্তভাবে নিজের ছেঁড়া জামাটা খুলে ঢেকে দেয় পাগলীটার অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গ । কোমরের বেল্ট খুলে মাথার ওপর ঘোরাতে থাকে ।
দু'জোড়া নেশাতুর চোখ পুরো ঘটনার সাক্ষী থেকে যায় ।
রক্তে ছবি ফোটায় শব্দগুলো
লোকটা নির্বিকারে ওড়ায় ধুলো
সে পরোয়া করে না । হাঁসপুকুরে মুখ ডুবিয়ে জল খায় এক পেট । তারপরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে । চাঁদ মুখ বাড়ায় । মুখ ঢাকে । মুখ বাড়ায় । মুখ ঢাকে । আর বয়সিনী হয় ।
তার তলায় প্রশস্ত মাটিতে অকাতরে ঘটতে থাকে । হত্যা, মুক্তি, সর্জন ।
কে অপরাধী ? কী বিচার ?
এ সমস্তই পুনর্বিবেচনার বিষয় ।
(পরবাস, অক্টোবর, ২০০৫)