• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৫ | মে ২০০৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • একটি তারকার জন্ম : মীজান রহমান

    আমার একটা দুর্নাম আছে যে আমি খুব নিয়ম মেনে চলি । যারা নিয়ম মেনে চলে তাদের দ্বারা সংসারে বড় কিছু হয় না সেটা সর্বজনবিদিত । সেদিক থেকে দুর্নামটি আমার সাথে মিলে যায় । নিয়মানুবর্তী মানুষ একটু বোকা বোকা হয়, নীরস হয়, লোককে আকর্ষণ করার পরিবর্তে বিকর্ষণই করে বরং । সবই খাপ খায় আমার চরিত্রের সঙ্গে । তবে কতগুলো ব্যাপারে আমি নিজেকে নিয়মবহির্ভূত বলেই মনে করি । যেমন আমার কোন হিরো নেই, ভক্তিগদগদ চিত্তে কোনও পূজনীয় ব্যক্তির পদচুম্বন করার মনোবৃত্তি কখনো অর্জন করিনি । আসলে কোন রক্তমাংসের মানুষকেই আমি পূজনীয় মনে করি না, অন্যদের কাছে তিনি যত পূজনীয়ই হোন না কেন । আমি পীর মানি না, প্রচলিত `সত্য'কে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করি না, `মহাজ্ঞানী মহাজন যেপথে করেছে গমন' ছড়াটি শ্রবণমাত্র আমি সেপথ ধরে হাঁটতে শুরু করি না । ছোটবেলায় আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর বাবা ছিলেন ঢাকার এক বিখ্যাত পীর । আমার বাবাও ছিলেন এক পীরের মুরিদ, যদিও ওই পীরের প্রধান পেশা ছিল আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনা, পীরত্ব নয় । সৌভাগ্যবশত সেই পীরসংকুল পরিবেশের প্রভাব থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রাখতে পেরেছিলাম ।

    তবে আমি মনুষের মহত্বকে বিশ্বাস করি, সম্মান করি । কিন্তু এটা বিশ্বাস করি না যে কেউ জন্ম থেকেই মহত্ব নিয়ে আসে, বা আসমান থেকে মহত্ব বর্ষিত হয় কারো ওপর । মহত্ব মানুষকে অর্জন করতে হয় কর্ম, সাধনা ও নিষ্ঠা দিয়ে । স্কুলে পড়াকালে আমারও হিরো ছিল, একাধিক হিরো । আমার হিরোদের কেউ রণাঙ্গনের বীর সেনানী ছিলেন না, মহাবিক্রমের সাথে অগণিত শত্রু নিধন করে রাজ্য বিস্তার করেননি তাঁরা । আমার হিরো ছিলেন মহত্বের মহিমায় অসাধারণ হয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষ । আমার হিরো ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যাঁর কিংবদন্তীয় মাতৃভক্তি ও জ্ঞানপিপাসা দারুণ প্রভাব বিস্তার করেছিল আমার কিশোর মনের ওপর, যিনি হিন্দু বিধবাদের হাজার বছরের চাপা ত্রক্রন্দন শুনতে পেরেছিলেন তাঁর প্রাণের মাঝে । আমার হিরো ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, গৌতম বুদ্ধ, জগদীশচন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, হাজী মোহাম্মদ মহসীন ও বেগম রোকেয়া । হাজী মোহাম্মদ মহসীন ছিলেন তত্কালীন ভারতীয় মুসলিম সমাজের এমন এক ব্যতিক্রমী দানবীর যিনি তাঁর বিশাল ধনসম্পদ মসজিদ আর মাজারের ইটপাথরে ব্যয় না করে নিয়োগ করেছিলেন বাংলার বহুসহস্র দরিদ্র মুসলমান কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষার সহায়তায় । তাঁর দানধন্য স্বাপ্নিক কিশোরদের অন্যতম প্রাপক আমি নিজেই । আমার স্কুলজীবন ছিল চল্লিশের সেই উথালপাথাল রাজনৈতিক-সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সময়টাতে । বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আর উত্কন্ঠা ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী । হিন্দু পাড়ায় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, মুসলমান পাড়ায় ভণ্ড সন্ন্যাসী । হিন্দু পাড়ায় জিন্নাহ ছিলেন বিচ্ছেদবাদী ম্লেচ্ছ শয়তান, মুসলমানদের কাছে ছিলেন অসাধারণ ধীশক্তি ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মুসলিম অধিনায়ক । সেসময় অখণ্ড ভারতের অধিকাংশ মুসলিম তরুণের চোখে জিন্নাহ ছিলেন এক দৈবপ্রেরিত ত্রাণকর্তা -- ক্ষণজন্মা হিরো ।

    বয়স এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে মানুষের চোখ খোলে, মন খোলে (বন্ধও হয়ে যায় অনেক সময়), মানুষ পরীক্ষা করতে শেখে পুরনো তত্ত্বকে, প্রশ্ন করতে শেখে প্রতিষ্ঠিত `সত্য'কে । পুরনো হিরোদের কেউ কেউ তখন আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, অনেকেই জ্যোতি হারিয়ে মৃত তারকার মত বিলীন হয়ে যায় আকাশ থেকে । কখনো নতুন তারার সৃষ্টি হয়, কখনো হয় না । বাঙালি মুসলিমদের কাছে জিন্নার মোহ কেটে গেছে অনেক আগেই, বরং গান্ধীই জেগে উঠেছেন নতুন আলোতে । বাংলাদেশ হওয়ার আগে স্বাধীনতা নিয়ে যে-স্বপ্ন ছিল আমার, এবং আমার মত আরো অজস্র বাঙালির তার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে আজ । একাত্তরের যেসব নায়ক একসময় ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলতেন আমাদের চিন্তার আকাশে তাদের অনেকেই সেই জ্যোতিটুকু হারিয়ে ফেলেছেন । আজকে আমাদের হিরো কারা তার উত্তর চট্‌ করে চলে আসে না মনে । আজকে স্কুলের কচিকাঁচা শিক্ষার্থীরা কোন্‌ হিরোদের কথা পড়ে পাঠ্যবইতে জানি না । বিএনপি-জামাত জোটের শাসনকালে হয়ত পড়ে জিয়াউর রহমানের কথা । তারপর আওয়ামী লীগ এলে সেই একই ছেলেমেয়েরা পড়বে শেখ মুজিবুর রহমানের কথা । আজকে আমাদের আকাশ কেবলই মেঘাচ্ছন্ন, তারারা চলে গেছে তারার দেশে । আমাদের হিরোদের আমরা সমাহিত করেছি চত্রিশ বছরের অবজ্ঞা আর অবমাননা দিয়ে । আজ বাংলাদেশের কোথাও আমি বৃহৎ তারকা দেখি না, এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খদ্যোতের সাক্ষাৎ পাওয়াও ভার, শুধু দেখি অগণিত কীটপতঙ্গ অন্ধকার ডোবার বদ্ধজলে পরস্পরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে খাচ্ছে ।

    এই বিপুল হতাশার মাঝে সেদিন একটি প্রদীপশিখার আভাস পেলাম । বিলেতের মানী পত্রিকা `দ্য গার্ডিয়ান উইকলি'র প্রথম পাতায় একটি বাঙালি তরুণীর চশমার কাচ-ভেদ-করা দুটি জ্বলন্ত চোখের জ্যোতিতে যেন ভরে গেল বিশ্বলোক । সুমি খান, মেয়েটির নাম । নির্ভুলভাবে বাঙালি, নি:সন্দেহে মুসলিম বংশোদ্ভূত । তার ছবির নিচে বড় বড় নীল অক্ষরে লেখা : "খুনী দুর্বৃত্তদের আমি ভয় পাইনি, বরং আমাকেই ভয় পেয়েছিল তারা ।" কে এই দু:সাহসী নারী ? অদম্য কৌতূহল নিয়ে তক্ষুণি গলাধ:করণ করে ফেললাম গোটা গল্পটা ।

    সুমি খান একজন সাংবাদিক । বাংলাদেশের মত অনুন্নত, মুসলিমপ্রধান দেশে সাংবাদিকতা খুব একটা নিরাপদ পেশা নয় । সরকারি দলের নেতানেত্রীরা ক্ষমতা দখলের সময় যে সাংবাদিকদের পায়ে তেল দিয়ে মন জয় করার চেষ্টা করেন, ক্ষমতা কায়েম হবার অনতিকাল পর সে-সাংবাদিকদেরই মুণ্ডপাত করার জন্য তত্পর হয়ে ওঠেন । সত্য কথা বলার অপরাধে বেশ কিছু সাংবাদিককে দেশত্যাগী হতে হয়েছে, অনেকে নানারকম যাতনা-লাঙ্ছনার শিকার হয়েছেন, কেউ কেউ প্রাণও হারিয়েছেন । সে-অবস্থায় মেয়ে-সাংবাদিক হওয়া যে কতখানি ঝুঁকিপূর্ণ তা আমার কল্পনার বাইরে । সুমি শুধু সাংবাদিকই নন, তিনি `সাপ্তাহিক ২০০০' পত্রিকার নিয়মিত ত্রক্রাইম রিপোর্টার, অর্থাৎ অপরাধ আর সন্ত্রাসের ভয়াবহরকম অন্ধকার জগতে তাঁর নিত্য আনাগোনা ও অনুসন্ধান । সাধারণ মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারের মেয়ে হয়ে তিনি যে কেন এপথ বেছে নিলেন সে এক রহস্য বটে । তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছোটকাল থেকেই । ন'বছর বয়সের একটি ঘটনা তাঁর এখনো মনে আছে । চাচাতো মামাতো ভাইবোন সবাই মিলে টেলিভিশনে খবর দেখছে । সুমির বয়স হয়ত ছিল সবচেয়ে কম, কিন্তু মনোযোগটা ছিল তারই সবচেয়ে বেশি । এমনই গভীর সেই মনোযোগ যে একেবারে টেলিভিশনের গায়ে গাল চেপে মায়ের-দেরাজ-থেকে-আনা কাগজে খবরগুলো সব লিখে রাখলেন । সেটা দেখে ভাইবোনেরা জিজ্ঞেস করে : `কিরে তুই সাংবাদিক হবি নাকি ?' সুমি জবাব দেননি, কিন্তু তখন থেকেই মনে মনে জানতেন তাঁর গন্তব্য কোথায় ।

    মেয়েটির চরিত্রে কি একটা জিনিস আছে যা তাঁকে কেবল বিপদের দিকে আকৃষ্ট করে । রবিঠাকুরের সেই চরণদু'টি হুবহু খেটে যায় তাঁর বেলায় : `বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয় ...।' ভয় কাকে বলে সুমি জানেন না । ভয়কে আমরা সমীহ করি, তিনি করেন অবজ্ঞা । ভয় দেখে আমাদের রক্ত জমে যায়, তাঁর রক্ত টগবগিয়ে ওঠে । ভয় আর বিপদের সঙ্গে সুমির গোপন মিতালী আছে । সাধারণ চুরিডাকাতি আর গার্হস্থ্য খুনখরাবীতে তাঁর আগ্রহ নেই, তাঁর দৃষ্টি হল উপরতলার আলোঝলমল কক্ষটিতে প্রতিদিন কত পুকুরচুরি আর কত অবর্ণনীয় কুকীর্তি ঘটছে সেদিকে । কোথা থেকে কেমন করে সব লোমহর্ষক খবর সংগ্রহ করেন তিনি জানি না, কিন্তু তাঁর জনপ্রিয় কলাম থেকে লক্ষ লক্ষ পাঠক জানতে পারে দেশের শত শত সন্ত্রাস আর অপরাধচক্রের সঙ্গে ক্ষমতাবান শাসনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে জঙ্গী মৌলবাদ আর পুলিশবাহিনীর অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা । জানতে পারে অস্ত্রচালান, শিশুচালান ও আদমচালানের পৈশাচিক তথ্যসমূহ । দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জানমাল সম্পত্তির ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আক্রমণ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং কখনো কখনো হত্যা -- এসবের পেছনে মৌলবাদী চক্র ও রাজনৈতিক দলসমূহের কি ভূমিকা, সেসব খবরও প্রামাণ্য চিত্র ও সাক্ষ্যসাবুদ সহ সূর্যালোকের মত স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পেয়ে যায় সুমির কলমে । সুতরাং তাঁর হাতখানি যে মৌচাকের গূঢ়তম প্রকোষ্ঠেই ঢুকে থাকে সবসময় সেটি পাঠকেরও অজানা ছিল না । বাংলাদেশে ওপরতলার ময়লা চাদর প্রকাশ্যে ঝাড়ার চেষ্টা যে যমের সঙ্গে পাঞ্জা লড়াইয়ের শামিল সেটা সবাই জানত । সেজনে সুমির নিরাপত্তা নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তা ছিল সবার, দুশ্চিন্তা ছিল না কেবল তাঁরই । তাঁর কলমকে তিনি ওদের ছুরি তরবারি আর আগ্নেয়াস্ত্রের চেয়ে হাজার শক্তিশালী মনে করতেন । তাই তাঁর কলমই একদিন সেই ছুরির লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ালো ।

    ২০০৪ সালে এপ্রিলের এক সোনালি সন্ধ্যায় সুমি রিক্সা করে যাচ্ছিলেন পত্রিকার অফিসে লেখা পাঠাবার জন্যে । চাটগাঁর এক জনাকীর্ণ রাস্তা । সেই ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ করে উন্মুক্ত ছোরা হাতে তিনজন তাগড়া জোয়ান এসে রিক্সা থামিয়ে তাঁর ওপর আক্রমণ চালালো । ছোটখাট মানুষ, লম্বায় হয়ত পাঁচ ফুটের বেশি নয়, কিন্তু ছোরা দেখে ভয়ে কাঁচুমাচু হবার পাত্রী তিনি নন । হাত পা ছুঁড়ে তুমুল বিক্রমে ওদের বাধা দেবার চেষ্টা করলেন । ওদের উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে রিক্সা থেকে নামিয়ে অপেক্ষমান একটি গাড়িতে তুলে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া । সুমির চিত্কার শুনে রাস্তার লোকজন ছুটে এল সেখানে । অবস্থা বেগতিক দেখে গুণ্ডাগুলি পালিয়ে গেল গাড়িতে করে । যাবার আগে অবশ্য সুমির সারাগায়ে, বিশেষ করে ডানহাতের পাঁচটা আঙুলে, অব্যর্থ স্বাক্ষর রেখে গেল তাদের পাশবিকতার । আঙুলগুলো এমনভাবে থেঁতলে গিয়েছিল যে তিনমাস লেগেছিল তাঁকে আবার কলম ধরতে । কিন্তু কলম তিনি ধরেছিলেন ঠিকই । নতুন উদ্যমে, আগের চেয়ে শতগুণ তেজের সাথে । ওরা তাঁর কলম থামাবার চেষ্টায় ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছিল সমস্ত শরীরটাকে । সেই ক্ষতের রক্তই তাঁর কলমে এনে দিল নতুন শক্তি । এমনই আশ্চর্য নারী এই ক্ষুদ্রকায় মানুষটি, আমার কল্পনাতে এক নতুন বাংলাদেশী হিরো জন্ম নিল ।

    দেশে নিশ্চয়ই সুমি খানের নাম ও কীর্তিকাহিনী অনেকের কাছেই সুবিদিত, কিন্তু প্রবাসে কতজন বাঙালি তাঁর নাম শুনেছেন সেবিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ । অন্তত আমি যাদের জিজ্ঞেস করেছি কেউ মনে করতে পারেনি নামটি । সত্যিকারের হিরোদের নাম কোনদিনই খুব বেশি প্রচার হয় না । কিন্তু বিদেশের বোদ্ধা মানুষদের কাছে তাঁদের খবর ঠিকই পৌঁছায় । সুমির দু:সাহসী সাংবাদিকতার জন্যে ইণ্ডেক্স-গার্ডিয়ানের এক আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংস্থা তাঁকে একবছরের হুগো-ইয়াং পুরস্কারপ্রাপক হিসেবে লণ্ডনে অনুষ্ঠিত এক সাম্প্রতিক সমাবেশে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছে । সম্মেলনকালের প্রশ্নোত্তরপর্বে স্থানীয় সংবাদিকরা তাঁর ধীরস্থির ভাব ও হাসিখুশি স্বভাব দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন । চাটগাঁর সেই ভয়াবহ ঘটনাটির বর্ণনা তিনি দিলেন এমন নির্বিকারভাবে যেন বাজারের তালিকা পড়ে শোনাচ্ছেন শ্রোতাদের । যেন এটা কোন ভয়ভীতির বিষয়ই নয়, খাওয়া-পরা-ঘুম-নাওয়ার মতই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার । একজন প্রস্তাব করলেন, নিশ্চয়ই আক্রমণের সময় ভয়ে তাঁর জিভ শুকিয়ে গিয়েছিল । সেকথা শুনে সুমির পেট ফেটে হাসি এসে যায় : হা হা হা হা হা ! প্রতিটি `হা' তার আগের `হা'-এর চাইতে জোরদার । মানে এর চেয়ে হাস্যকর কথা জীবনে শোনেননি । তারপর মাথা নেড়ে বারবার শব্দ করে বললেন : `না, না, না, না । ভয় আমি পাইনি, গুণ্ডারাই আমার ভয়ে কাঁপছিল ।' স্তম্ভিত সাংবাদিকদের মাঝ থেকে কেউ একজন বলে উঠলেন " `নিশচয়ই সংসারে কিছু-না-কিছু আছে যাকে আপনি ভয় পান ।' প্রশ্ন শুনে সুমির হাসির দমক আরো উচ্চ-মার্গে উঠে যায় । তাঁর অটল জবাব " `না, এমন কোন বস্তুর অস্তিত্ব আমার জানা নেই । ভয়কে আমি চিনি না ।'

    তবে তাঁর বিরক্তি আছে, রাগও হয় মাঝে মাঝে । বিরক্তি হয়েছিল যখন তিনমাস বিছানায় পড়ে থাকার ফলে কলম ধরতে পারছিলেন না । বিরক্তি হচ্ছিল কেন এত সময় লাগছিল ভাল হয়ে উঠতে । তাঁর রাগ হয় যখন পবিত্র ঈদের কারণে পত্রিকায় তাঁর কলম না ছাপিয়ে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা ছাপা হয় । রাগ হয় যখন দেখতে পান যে পত্রিকার নিয়মিত লেখকদের মধ্যে ফ্যাশান আর তাঁর কলাম ছাড়া আর একটিও মহিলা নেই । রাগ হয় যখন পুরুষপ্রধান সাংবাদিকগোষ্ঠী নানারকম চালাকিচাতুরী করে মহিলাদের পথ বন্ধ করে রাখে সাংবাদিকতায় । এসব দেখেশুনে তিনি ফুঁসে ওঠেন ভেতরে ভেতরে, কিন্তু করণীয় কিছু থাকে না ।

    দেশের বর্তমান অরাজকতা, সন্ত্রাস ও আইনশৃংখলার চূড়ান্ত অবনতির মূল কারণ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন এরশাদের শাসনকালে যখন সংবিধানের একটি মৈলিক সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করা হয় । সুমির মতে, সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় জাতির দ্রুত অধোগতি । সমকালীন বাংলাদেশে ধর্ম ও জাতিগত নানা বিদ্বেষ ও বৈষম্যের সমস্যা, অসহিষ্ণুতার সমস্যা, সুন্নী মতাবলম্বী মুসলমান জাতি অন্যদের চাইতে শ্রেষ্ঠ ভেবে সংখ্যালঘুদের নাগরিক ও মানবিক অধিকারের প্রতি চরম ঔদাসীন্য ও অবজ্ঞার ভাব প্রদর্শন, এ সবেরই মূল কারণ হিসেবে তিনি সেই ঘোষণাটিকে দায়ী করেন । লণ্ডনের সাংবাদিকটিকে তিনি পরিষ্কার বলে দিলেন : `আমি যখন আপনার দিকে তাকিয়ে কথা বলি তখন আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই জানার যে আপনি খৃষ্টান না হিন্দু না মুসলমান । আর সকলের মত আপনিও একজন মানুষ, আমার জন্যে তাই যথেষ্ট ।' এমন একজন খাঁটি ধর্মনিরপেক্ষ, ইহজাগতিক মানুষ বাংলাদেশে খুব বেশি নেই । এ বিষয়গুলিতে সুমি খানের সঙ্গে আমার পূর্ণ মতৈক্য । তবে সেই রাষ্ট্রধর্মের ব্যাপারে আমি আরো এক ধাপ পেছনে যাবার পক্ষপাতী । আমি বলব, জাতির পতনের শিঙা বেজে উঠেছিল জিয়াউর রহমানের শাসনকাল থেকে, যখন তিনি জামাতে-ইসলাম নামক একটি রাজাকার-সংকুল পাকিস্থানপন্থী দলকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হবার অনুমতি দিলেন । সেদিনকার আপাতদুর্বল মূষিক আজকে কি ভয়াবহ দানবের মূর্তি ধারণ করেছে সে-দৃশ্য এখনো যার চোখে পড়েনি সে হয় অন্ধ নয়ত দেখেও দেখতে চায় না ।

    সুমি খানকে জিজ্ঞেস করা হল : আর সব পেশা বাদ দিয়ে সাংবাদিকতা কেন ? তাঁর স্পষ্ট জবাব : সত্য । লুকানো সত্যকে উন্মোচন করতে হলে সাংবাদিকতার মত মোক্ষম হাতিয়ার আর নেই । আমি আমার দেশকে, সমাজকে সেবা করতে চাই সেই সত্যের ঢাকনা খুলে দিয়ে । ওটা পারলেই আমার জীবন সার্থক । লণ্ডনের সমবেত সাংবাদিকরা সবিস্ময়ে শুনল তাঁর কথা, অনুভব করল তাঁর চারিত্রিক শক্তি ও সংকল্পের দৃঢ়তাকে । সুমির বয়স ৩৪ । বিশ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে । বাংলাদেশের সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে সেখানেই তাঁর ব্যক্তিজীবনের সমাপ্তি ঘটতে পারত । কিন্তু ঘটেনি তাঁর উদারমনা স্বামীটির জন্যে । বরাবরই তিনি স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে সর্বপ্রকার সমর্থন দিয়ে গেছেন । ১১ আর ৭ বছরের দুটি ছেলে আছে সুমির । মায়ের কীর্তিতে দু'ছেলেরই গর্বে বুক ফোলা । অ্যামনেস্টি-ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে দেশবিদেশ থেকে তিনি অভিনন্দন ও শুভেচ্ছাপত্র পেয়েছেন ছ'হাজারের বেশি । তাঁর পরিবারের জন্য সেটাও দারুণ গর্বের বিষয় ।

    প্রশ্ন হল : সেটা কি সারা বাংলাদেশেরই গর্বের বিষয় নয় ? আমার তো প্রবাসে থেকেও বুক ফুলে উঠছে গর্বে । এবং আমার বিশ্বাস প্রবাসের নির্দলীয় বাংলাদেশী যে যেখানে আছে, সুমির কাহিনী শুনে সবাই গর্ববোধ করবে । এমনকি দেশের ভেতরেও এত দলাদলি মারামারি হানাহানি সত্ত্বেও, সুমির গল্প সাধারণ মানুষের কানে পৌঁছালে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠবে । কিন্তু সাধারণ মানুষের কানে পৌঁছানোর সুযোগ পাবে কি এই গল্প ? সুমির বুকে যে সাহস সে-সাহস হয়ত সব সাংবাদিকের নেই । সাংবাদিকের সাহস থাকলেও হয়ত সম্পাদকের নেই, বা প্রকাশকের নেই । সত্য কথা শুনতে চায় সবাই, কিন্তু সত্য কথা বলবার সাহস দরকার । কারণ সত্যকে চেপে রাখাতে যাদের স্বার্থ দেশের প্রকৃত ক্ষমতা তো তাদেরই হাতে । সেই চাপা সত্যের মুখ খুলে দেওয়ার সংগ্রামই হল সুমি খানের সংগ্রাম । সুমির মত দু'চারজন মানুষ যদি থাকত দেশের ক্ষমতার আসনে তাহলে হয়ত এতটা দুর্দশায় পড়তে হত না দেশটাকে । কিন্তু সুমির মত মেয়েরা ক্ষমতার আসনে যায় না, যেতে চায় না, চাইলেও ক্ষমতার দালালেরা তাদের যেতে দেবে না । সুমির মত বলিষ্ঠ চরিত্রের সাহসী মানুষ বিদেশে সম্মান পাবে, পশ্চিমের মুক্ত সমাজ তাকে পুষ্পমাল্য দিয়ে সম্বর্ধনা জানাবে, কিন্তু নিজের দেশে হয়ত কোনদিনই পূর্ণ স্বীকৃতি পাবেন না তিনি । সুমি খান কোনদিন একুশে পদক বা অনন্য পুরস্কার পাবার জন্যে মনোনীত হবেন বলে মনে হয় না । এটা শুধু `গাঁয়ের যোগী ভিখ' না পাওয়ার ব্যাপার নয় । গাঁয়ের যোগী ভিখ ঠিকই পায় যখন সে অন্য গাঁ থেকে মণিমুক্তা নিয়ে আসে । কিন্তু সুমি খানের বেলায় সে-আশাও পূর্ণ হবার সম্ভাবনা নেই । তিনি তো অনেক মণিমুক্তোই কুড়োলেন বিদেশ থেকে, কিন্তু দেশে `ভিখ' পাবেন কি ?

    সুমির গল্পটা পড়ার পর এক সমবয়সী বন্ধুকে টেলিফোন করে বললাম : `একটি নতুন তারকা জন্ম নিয়েছে দেশে । বহুকাল পর আমার একজন হিরো উদয় হল ।' এতটা উত্তেজনা হয়ত এবয়সে মানায় না, কিন্তু দীর্ঘদিনের তৃষার্ত মন অল্প পানীয়তেই কৃতার্থ । চারদিকে যখন ঘন অন্ধকার তখন আকাশের একঝলক বিদ্যুত্কেও মনে হয় দৈবদত্ত । সুমি খান বাংলাদেশের এমনি এক দৈবদত্ত আলোচ্ছটা । অথৈ উত্তাল সমুদ্রে একটি আশ্বাসময়ী বাতিঘর । কিন্তু একটি প্রদীপ দিয়ে তো গোটা জাতিটার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের দেয়াল ভেদ করা যাবে না । আরো অনেক প্রদীপ জ্বালাতে হবে আমাদের । সুমি খানকে দেখে আশা জাগছে মনে, হয়ত এমনি অনেক সুমি লুকিয়ে আছে আমাদের মধ্যে । হয়ত একদিন তারাও জেগে উঠবে, নাড়া দেবে দেশের মুমূর্ষু চেতনাকে, আঘাত করবে দূষিত ক্ষমতার রুদ্ধ প্রাচীরকে । অবক্ষয় আর জীর্ণতার যে বিষাক্ত কলুষ জমা হতে হতে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলেছে দেশকে তা থেকে কল্যাণময় স্বস্তি নিয়ে আসবে তারা মানুষের ঘরে ঘরে ।

    দেশের শাসকমহলে নতুন একটা ধুয়া উঠেছে যার নাম `ভাবমূর্তি' । ধুয়াটা ঠিক নতুন নয়, কারণ আগের শাসকরাও অনেকটা একই রকম রোগে ভুগতেন । তাঁরা শাসন যতটা করেন তার চেয়ে বেশি করেন ভাবমূর্তির ভাবনা । ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথে মানুষের মস্তিষ্কে কি এমন কোন প্রক্রিয়া ঘটে যাতে করে তারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও অপ্রাপ্তদের মত ব্যবহার শুরু করেন, নাকি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেবল অপরিণতমস্তিষ্করাই আকৃষ্ট হয় জানি না, কিন্তু তাঁরা যে কেমন করে `সরকারের' ভাবমূর্তির সঙ্গে `দেশের' ভাবমূর্তিকে গুলিয়ে দিলেন তা আমি কখনোই বুঝব না । আসলে `দেশের' ভাবমূর্তি বলতে কি বুঝায় সেটা হয়ত তাঁরা বোঝেনই না, তাঁরা যে ভাবমূর্তির কথা বোঝেন সেটা হল `সরকারের' ভাবমূর্তি । ভাবমূর্তি শব্দটা এত বেশি আওড়াচ্ছেন তাঁরা যে মনে হয় মূর্তিটাকে পূজাই করতে শুরুর করবেন শিগগির । এটা তাঁদের একটা মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে । তাঁরা প্রবাসীদের ওপর মহাখাপ্পা কারণ তারাই নাকি দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে । তাঁরা একাত্তরের কথা ভুলে গেছেন । ভুলে গেছেন তখন প্রবাসী বাঙালি কতখানি উঁচুতে তুলে ধরেছিল তাদের দেশকে । তুলে ধরেছিল কারণ তুলে ধরার মত জিনিস তখন ছিল দেশে । এখন কি আছে ? সংসদ ও মন্ত্রণালয়ের নির্বাচিত মূর্খের দলকে কি করে বোঝাব যে দেশের ভাবমূর্তি কোনদিনই বিদেশে তৈরি হয় না, বা বিদেশে সেটা ভাঙেও না । দেশের ভাবমূর্তির কারখানা দেশের ভেতরেই । দেশে যা ঘটবে তা'ই তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বিদেশে ছড়াবে বিদ্যুতবেগে । দেশে যদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা ফাটে, সিনেমাহলে বোমা ফাটে, বিদেশী রাষ্ট্রদূতকে মসজিদে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়, বিরোধী দলের নেত্রীকে সদলবলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়, শাহ কিবরিয়ার মত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্ষণজন্মা পুরুষকে গ্রেনেড মেরে নিপাত করা হয়, এবং সর্বোপরি, সরকার যদি নিদারুণভাবে ব্যর্থ হন এসব ঘটনার একটিরও রহস্য মোচন করতে, তাহলে কেমন করে বাংলাদেশকে নিয়ে বড়াই করবে প্রবাসের বাঙালি ? কেমন করে বড় মুখে কথা বলবে তারা যখন পর পর চারবচ্ছর ধরে বাংলাদেশের নাম সবার ওপরে থাকছে দুর্নীতির তালিকায়, বা `বাংলাভাই' নামক তালেবানী দস্যু তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করছে উত্তরবঙ্গের বিস্তৃত এলাকায়, এবং তাকে পাকড়াও করে আইনের হাতে সোপর্দ করা দূরে থাক, সরকারি মুখপাত্রদের অনেকে তার অস্তিত্বই স্বীকার করতে রাজি নয় ? কেমন করে তারা মুখ দেখাবে বিদেশীদের কাছে যখন সুমি খানের মত আশ্চর্য সাহসী মেয়ে বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ শিরোপা পায়, আর নিজের দেশের ক্ষমতাবান গডফাদাররা তার পেছনে গুণ্ডা লেলিয়ে দেয় তাকে অপহরণ করে গায়েব করার বাসনায় ? দেশের শাসককূল কি কোনদিন বুঝবেন যে বাংলাদেশের যা কিছু ইতিবাচক ভাবমূর্তি তা তাঁরা সৃষ্টি করেননি, করেছেন সুমি খানের মত কৃতী নারীরা, করেছেন গ্রেনেডবিদ্ধ মহাপুরুষ শাহ কিবরিয়া, করেছেন দেশের অসংখ্য নারীপুরুষ যারা যুগ যুগ ধরে হাজার বঞ্চনা লাঙ্ছনা সহ্য করেও মাতৃভূমির প্রতি তাদের অকুন্ঠ ভালবাসা ও আনুগত্য অটুট রেখেছেন । দেশের ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয় দেশের মাটিতে, সরকারের মন্ত্রণালয়ে বা রাষ্ট্রদূতের জলসাঘরে নয় । প্রবাসের বাঙালি আজ সুমি খানকে নিয়ে একটু উত্সব করুক, কারণ তিনি একটি প্রদীপ জ্বালিয়েছেন । এই প্রদীপের আলোতে যদি আরো প্রদীপ জ্বলে ওঠে দেশে, সেই আশাটাই বুকে পোষণ করে একটুখানি শান্তি পাবে তারা ।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments