কুঁংএড়ঘরের দরজার ঠিক সামনেটায় নিবন্ত আগুনের গায়ে প্রায় গা ঠেকিয়ে বাবা আর ছেলে নি:শব্দে বসেছিলো ; ভিতরে শুয়ে বৃদ্ধের অল্পবয়সী পুত্রবধূ বুধিয়া প্রসবযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে । মাঝে মাঝেই তার মুখ থেকে এমন বুকফাটা আর্তনাদ বেরোচ্ছে যে তাদের বুক ধড়ফড় করে উঠছিলো । শীতের রাত ; চরাচর ব্যাপী অসীম নির্জনতা । গোটা গ্রাম ডুবে আছে গাঢ় অন্ধকারে ।
ঘিসু বলে, "ও আর বাঁচবে না রে । সারা দিনটা যন্তন্নায় ছটফট করেছে । দেখ লে একবার কেমন আছে ।"
মাধব বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, "মরতে হয় তো জলদি মরলেই হয় ? দেখে আর কী করবো ?"
"তোর তো বিলকুল মায়ামম্তা নেই রে ! এক সাল ধরে যার সঙ্গে জীবনটা ভোগ করলি, তারই সঙ্গে এমন অন্যায্য ব্যবহার ?"
"কী করবো, আর আমি তার হাত-পা আছাড়ি-পিছাড়ি করে এই যন্তন্নায় ছটফট করা সহ্য করতে পারছি না ।"
জাতে চামার এই পরিবারটার বদনাম সারা গাঁংএয় । ঘিসু যদি কোনোরকমে এক দিন কাজ করতো, তবে তিন দিন বিশ্রাম নিতো । আর মাধব এতই অলস ছিলো যে আধঘন্টা কাজ করার পর অন্তত: একঘন্টা ছিলিম না টানলে তার চলে না । ফলে কেউ আর তাদের কাজ দিতো না । ঘরে একমুঠি আটার যোগাড় থাকলেই তারা দু'জনেই আর কাজ করতে চায় না । ক'দিন উপোস দেওয়ার পর ঘিসু গাছে চড়ে ক'টা ডাল ভেঙে আনলে মাধব সেগুলি হাটে নিয়ে গিয়ে বেচে কিছু পয়সা আনে । ঐ ক'টা টাকায় আবার যদ্দিন চলে, তত দিন তারা ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটায় । সব খরচা হয়ে গিয়ে খিদেটা জমিয়ে বসলে আবার তারা ডাল ভাঙে নয়তো অন্য কোনো কাজের সন্ধান করে । গাঁংএয় কাজের অভাব নেই । চাষীদের গাঁ । সুতরাং, পরিশ্রমী যেকোনো কারুর জন্য সেখানে অঢেল কাজ ছিলো । কিন্তু এই দু'জনের কেবল তখনই ডাক পড়তো যখন একজনের করার মতো কাজ দু'জনকে দিয়ে করিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া লোকের আর কোনো উপায় থাকতো না ।
ওদের নিজেদের চরিত্রই এমন যে সাধু হলে আর ওদের পার্থিব তৃপ্তি বা স্থৈর্য লাভের জন্য আত্মসংযম অভ্যাস করার দরকারই হত না । অদ্ভূত জীবন কাটিযে যাচ্ছিলো ওরা । দুটো কি তিনটে মাটির পাত্র ছাড়া সারা বাড়িতে আর কোনো সরঞ্জাম নেই । ছেঁড়া কাপড় পরে ধারদেনায় আকন্ঠ ডুবে থেকে অনেক অপমান, অনেক ঘাড়ধাক্কা সহ্য করেও ওদের মধ্যে কোনো দু:খবোধ কাজ করে না ; জাগতিক কোনো বিষয়ই ওদের স্পর্শ করতে পারে না । অথচ, দারিদ্র্য ওদের এত বেশি গ্রাস করেছিলো যে ধার শোধ হবার বিন্দুমাত্র আশা না থাকা সত্ত্বেও লোকে তাদের কিছু না কিছু দিয়েই দিতো । আলু কিংবা মটরশুঁংইটর মরসুমে ওরা লোকের ক্ষেত থেকে ওগুলি খঁংউড়ে বার করে এনে আগুনে ঝলসে খেতো, নয়তো পাঁচ-দশটা আখ ভেঙে নিয়ে গিয়ে তাই দিয়ে রাত্রের খাওয়া সারতো । ঘিসু আকাশবৃত্তি অবলম্বন করে ষাট-ষাটটা বছর পার করে দিয়েছে, আর মাধব কর্তব্যপরায়ণ ছেলের মতো বাপের পদচিহ্ন ধরে চলতে গিয়ে তার বাপকেও ছাড়িয়ে গেছে !
এখনো ওরা কারুর ক্ষেত থেকে খঁংউড়ে নিযে আসা আলুই ঝলসাচ্ছিলো বসে বসে । ঘিসুর স্ত্রী তো বহু দিন আগেই মরে গিয়েছিলো । তার মৃত্যুর ঠিক আগের বছরেই মাধবের বিয়েটা হযেছিলো । বিয়ে হয়ে এসে থেকে মাধবের স্ত্রী এই পরিবারটাকে পথে আনার চেষ্টা করেছে । দু'-মুঠি আটার জন্য লোকের বাড়ি গম গুঁংএড়া করে, ঘাস কেটে এই দু'টো নির্লজ্জ লোককে বসিয়ে বসিযে এতকাল খাইয়েছে । বুধিয়া আসার পর থেকে তাদের দু'জনকে শুধু যে আরো বেশি কুঁংএড়মিতে ধরেছে তাই নয়, তারা সময় সময় বুধিয়ার ওপর রাগ দেখাতেও ছাড়তো না ! কেউ কোনো কাজের জন্য তাদের ডাকতে পাঠালে তারা অনায়াসে দ্বিগুণ মজুরি দাবী করে বসতো । সেই মেয়েটাই বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে এখন মরতে বসেছে । আর এরা দু'জনে বাইরে তার মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে, সে মরলে যাতে নিজেরা রাতটুকু অন্তত: শান্তিতে ঘুমাতে পারে ।
ঘিসু একটা আলু ছাড়াতে ছাড়াতে মাধবকে বললো, "দেখ লে না কি অবস্থায় আছে । বহু তো বোধহয় ডাইনই হয়ে যাবে । ওঝার খরচ তো এক রুপৈয়ার কম না, কার থেকে নেওয়া যাবে বল দেখি ?"
মাধব ঘিসুর আসল মতলব আন্দাজ করতে চেষ্টা করে । তার দৃঢ় ধারণা যে সে ভিতরে গেলেই ঘিসু আলুগুলো সব সাবাড় করে ফেলবে । সুতরাং সে বলে উঠলো, ""ভিতরে যেতে আমার ডর লাগছে ।"
"অত কিসের ডর ? আমি তো আছিই এখানে ।"
"তাহলে তুমিই যাও না ক্যানো ।"
"আমার বিবি যখন মরেছিলো, তখন তিন-তিনঠো দিন তার কাছছাড়া হইনি । আর, এখন এই - তার কি লজ্জাশরম নেই ? কখনো তার মুখখানাও দেখা হয় নি, এখন মরবার সময তার উলঙ্গ শরীরটা দেখতে যাবো ? তার শরীরটাকেও তো একটু আরাম দেওয়া লাগে । আমাকে দেখলে তো হাত-পা ছঁংউড়তেও পারবে না ।"
"ভাবছি, একটা বাচ্চা জম্মালে - তখন কী হবে ? শুকনা আদা, এট্টু গুড়, তেল - ঘরে যে কিচ্ছু নেই ।"
"সব বন্দোবস্ত হয়ে যাবে । ভগোবানের দয়ায় যদি ঘরে বাচ্চা আসে, এখন যারা আমাদের এক পয়সা দেয় না, তারাই আমাদের ডেকে পাঠিয়ে জিনিষউনিষ দেবে । ন’-ন’টা ছেলের বাপ হয়েছি । ঘরে কখনো কিছুর বন্দোবস্ত ছিলো না, কিন্তু এ'ভাবেই সব বার ভগোবান পার করিয়েছেন ।"
এই সমাজে দু'বেলা দু'মুঠো ভাতের যোগাড় করার জন্য যাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিবারাত্রি পরিশ্রম করতে হত, তাদের অবস্থা এই দু'জনের থেকে খুব বেশি ভালো কিছু ছিলো না ; এখানে চাষীদের দুর্বলতাকে নিংড়ে বার করে তাদের দিযে জবরদস্তি কাজ করিযে নিতে পারা লোকেরা অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতো --সুতরাং এই সমাজের একটি শ্রেণীর মধ্যে এই ধরনের মানসিকতার জন্ম হলে তাতে অবাক হওযার আদপেই কিছু নেই । দেখতে গেলে বরং সাধারণ কৃষকদের তুলনায় ঘিসুর বাস্তববোধ অনেক বেশি ; এবং সেজন্যই সে নির্বুদ্ধি কৃষকদের দলে যোগ দিয়ে খেটে মরার চেয়ে চালাকচতুর নিষ্কর্মা আড্ডাবাজদের দলে ঢোকাটা বেশি বাঙ্ছনীয় মনে করেছে । সে অবশ্য আড্ডাবাজদের নিয়মনীতি মেনে চলার ব্যাপারেও সাবধান হতে পারেনি । ফলে যখন তার দলের অন্য লোকেরা সমাজের মাথা হয়ে বসলো, তখনও সে পিছনে পড়ে থেকে সারা গ্রামের চক্ষুশূল হোলো । তবুও ঘিসু নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতো যে, অতি দুর্দশায় তার দিন কাটলেও তাকে অন্তত: কৃষকদের মতো কোমরভাঙা পরিশ্রম তো করতে হয় না, বা মুখ বুজে থেকে দেখতেও হয় না যে অন্য লোকেরা কিভাবে তার সারল্যের অপব্যবহার করছে ।
আগুন থেকে টেনে বার করে ওরা দু'জনে ঝলসানো আলুগুলি ঐ প্রচণ্ড গরম অবস্থাতেই খেতে শুরু করে দিলো । আগের দিন থেকে কিছুই না খেতে পাওয়ায় আলু ঠাণ্ডা হওয়া অবধি অপেক্ষা করার মতো ধৈর্যও ছিলো না । ফলে বারবারই ওদের জিভ পুড়ে যাচ্ছিলো । ছাল ছাড়িয়ে নেবার পর আলুগুলোর বাইরের দিকটা আর তত গরম লাগেনি । কিন্তু, দাঁত বসানো মাত্র ভিতরের তাপে জিভ, টাকরা আর গলা একেবারে জ্বলে গেলো । আয়েস করে খাবার চেয়ে করে সেগুলোকে তখন তাড়াতাড়ি ভিতরে ঠেলে দেওয়াই ভালো মনে হল, যেহেতু ভিতরে ওগুলোকে ঠাণ্ডা করে ফেলার মতো কিছু যন্ত্রপাতি আছে । সুতরাং চোখে জল চলে এলেও ওরা দু'জনেই খুব দ্রুত গিলতে শুরু করলো ।
গিলতে গিলতে ঘিসুর মনে পড়লো, কুড়ি বছর আগে সে এক জমিদার পরিবারের বিয়ের ভোজে খেতে পেয়েছিলো । সেই ভোজে তার ভাগ্যে যা রাজসিক খাওয়া জুটেছিলো, তা তার জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা ; এখনো সেই স্মৃতি তার মনে তাজা হয়ে আছে । সে বলে, "ওই ভোজের কথা ভুলিনি । তারপরে আর কখনো অমন খানা জোটেনি, অমন পেট ভরে খাইওনি । মেয়ের ঘর সব্বাইকে পুরি খাইয়েছিলো । ছোটো, বড়ো. - সব্বাই খেয়েছিলো সেই পুরি, তাও আবার খাঁটি ঘিয়ে ভাজা ! সঙ্গে ছিলো চাটনী, রায়তা, তিন রকমের শুকনা শাক, একটা ঝোলঝোল তরকারি, দই, মিষ্টি । তোকে আর কি বলবো সেই ভোজে কি সোয়াদ পেয়েছিলাম । কোনো বারণ নেই । যা খেতে ইচ্ছা, কেবল চাইলেই হলো ! আর যত ইচ্ছা খাও । লোকজন অ্যাত্তো খেয়ে ফেলেছিলো যে একঢোঁক জল আর খেতে পারে না । অথচ গোল গোল খোশবুদার কচুরি তখনো পাতে দিয়ে যাচ্ছে । বলছি যে আর চাই না, হাত দিয়ে পাতাটা ঢেকে রেখেছি । কিন্তু, তারা দিয়েই যাচ্ছে তবু । আবার, মুখ ধুয়ে নিবার পর পান-ইলায়চিও দিলো । কিন্তু আমার আর তখন পান খাবার উপায় ছিলো ? খাড়িয়ে থাকতে পারা যাচ্ছিলো না । জলদি নিজের কম্বলের ভিতরে ঢুকে গেলাম । এইরকম দরিয়ার মতো দিল ছিলো - ঐ জমিদারের ।"
ভোজের গল্পের মজা লুটতে লুটতে মাধব বলে, "যদি আমাদের এখন কেউ অমন ভোজ খাওয়াতো !"
"এখন আর কে খাওয়াবে ! সেই সময়টাই ছিলো অন্য রকম । এখন সকলেই রুপৈয়ার কথা চিন্তা করে -- বিয়েতে খরচ কম করবো, পূজাপাঠে খরচ কম করবো ! জিগাস করতে ইচ্ছা হয়, গরীবের ভাগের যত পয়সা -- সব বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে কোথায় রাখবে ! পয়সা বাঁচানোর তো কিছু কমতি নেই, যত চিন্তা সব খরচের বেলায় ।"
"তুমি অন্তত: কুড়িটা পুরি তো খেয়েছিলে ?"
"কুড়িটার থেকে বেশিই খেয়ে থাকবো ।"
"আমি তো পঞ্চাশটা খেয়ে ফেলতাম ।"
"পঞ্চাশটার কম তো শায়দ আমিও খাইনি । জোয়ান সমর্থ শরীর ছিলো, তুই তো অর্ধেকও হবি না ।"
আলুগুলো সব শেষ হলে দু'জনেই অল্প করে জল খেয়ে ধুতিতে শরীরটা ঢেকে আগুনের পাশে এমন ভাবে কুঁকড়ে শুলো যেন দুটো দৈত্যাকার সাপ কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে । বুধিয়া তখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলো ।
সকালে উঠে মাধব কঁংউড়ের ভিতর গিয়ে দেখলো, তার বৌয়ের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে । মুখের উপর মাছি উড়ছে । চোখ পাথরের মতো স্থির, উল্টে গিয়েছে । ধীরে ধীরে শরীরের উপর ধুলো জমতে শুরু করেছে । বাচ্চাটাও বেরোতে না পেরে মরে গেছে ।
মাধব দৌড়ে ঘিসুর কাছে এলো । তারপর, দু'জনে বুক চাপড়ে চিত্কার করে কাঁদতে আরম্ভ করলো । তাদের কান্নার শব্দে সচকিত প্রতিবেশীরা দৌড়ে এলো । সনাতন পদ্ধতি অনুযায়ী চললো সান্ত্বনা দেওয়ার পালা ।
কিন্তু, তখন আর খুব বেশি দু:খিত হবার সময় নেই । বরং মৃতের পরিচ্ছদ এবং চিতার কাঠ কিভাবে যোগাড় হবে, তাই নিয়ে মাথা ঘামানোটা বেশি জরুরী । কারণ, তাদের বাড়িতে জমানো টাকা থাকা আর চিলের বাসায় মাংস থাকা একই রকম দুর্লভ ব্যাপার ।
বাবা আর ছেলে কাঁদতে কাঁদতে গাঁংএয়র জমিদারের কাছে গেলো । এদের দু'জনের মুখ দেখতেও তাঁর ঘৃণাবোধ হত । কতবার তিনি নিজের হাতেই এদের পিটিয়েছেন--চুরি করে ধরা পড়ার পর, কিংবা আসবে বলেও সময়মতো কাজে না আসায় ।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "কী ব্যাপার ঘিসুয়া, কাঁদছিস কী জন্য ? আজকাল তো তোর দেখাও পাওয়া যায় না । এই গাঁয়ে থাকতে চাস না মনে হয় !"
ঘিসুয়া জলভরা চোখে সোজা মাটির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বললো, "বড়ো. বিপদে পড়েছি, হুজুর ! কাল রাতে মাধবের বিবিটা মরে গিয়েছে । রাতভর যন্তন্নায় ছটফট করেছে হুজুর ; তার বিছানার পাশে দু'জনে রাতভর বসে ছিলাম । যা ওষুদ পেরেছি, দিয়েছি । কিন্তু, ধরে রাখতে পারলাম না । আমাদের দেখাশুনা করার আর কেউ রইলো না হুজুর--সব্বোনাশ হয়ে গেলো আমাদের--সংসারটা এক্কেরে ছারখার হয়ে গেলো ! আমি আপনার চাকর । এখন আপনি ছাড়া আর কে তার শেষ কাজের দায়িত্ব নেবে হুজুর ? হাতে যা পয়সা ছিলো, ওষুদ কিনতে সব খরচা হয়ে গেছে । হুজুরের যদি দয়া হয়, তাইলে তার শেষ কাজটা ঠিক মতো হয় । আপনাকে বাদে আর কার কাছে যাবো হুজুর ?"
জমিদার দয়ালু মানুষ ছিলেন । কিন্তু ঘিসুকে দয়া দেখানোর সঙ্গে কালো কম্বলে রঙ লাগানোর বিশেষ পার্থক্য ছিলো না । তাঁর ইচ্ছা হল বলেন, "দূর হয়ে যা সামনে থেকে ! এমনিতে ডেকে পাঠালেও দেখা পাওয়া যায় না --এখন যখন দরকার পড়েছে, এখানে এসে আমাকে তেল দিচ্ছো ! হারামজাদা কোথাকার ! শয়তান !" কিন্তু, এখন রাগ দেখাবার কিংবা প্রতিশোধ নেবার সময় নয় । ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, তিনি দুটো টাকা বার করে তাদের দিকে ছুঁংএড় দিলেন । কিন্তু, একটিও সান্ত্বনাবাক্য তাঁর মুখ থেকে বেরোলো না । ঠিক যেন বোঝা নামিয়েছেন, এইভাবে তিনি ঘিসুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রইলেন ।
জমিদার স্বয়ং যখন দু'টাকা দিয়েছেন, তখন গাঁয়ের ব্যবসায়ী আর সুদখোর মহাজনদের ঘাড়ে ক'টা মাথা যে তারা টাকা দিতে চাইবে না ? জমিদারের নাম করে কিভাবে ফয়দা তুলতে হয়, তা ঘিসুর বেশ ভালো জানা ছিলো । একজন দুইআনা দিলো, এবং আরেক জন চার আনা । একঘন্টার মধ্যে ঘিসু দিব্যি পাঁচটাকা যোগাড় করে ফেললো । একজনের কাছ থেকে কিছু গম এবং অন্য আরেকজনের থেকে কিছু কাঠও পাওয়া গেলো । দুপুর নাগাদ ঘিসু আর মাধব বাজারে নতুন কাফন কিনতে চলে গেলো । ততক্ষণে লোকেরা এদিকে বাঁশ কাটা এবং অন্যান্য কাজ শুরু করে দিয়েছে ।
গাঁ-ঘরে নরম মনের বৌ-ঝি যারা ছিলো, তারা এসে নিষ্প্রাণ দেহটা দেখে চোখের জল ফেলে ওখান থেকে সরে গেলো ।
বাজারে পৌঁংএছ ঘিসু মাধবকে জিজ্ঞাসা করলো, "ওরে পোড়ানোর জন্য প্রচুর কাঠ তো পাওয়াই গিয়েছে, না রে মাধব ?"
মাধব বললো, "হঁযা, কাঠ তো যথেষ্ট । এখন একটা কাফন হলেই হয় ।"
"তাইলে চ', হাল্কা দেখেই একটা কাফন কিনে নিই গে' !"
"তাই ভালো ! লাশ তুলতে তুলতে তো সেই রাত্তির । রাত্তিরে কে আর কাপড় দেখছে ?"
"কি বিচ্ছিরি নিয়ম বল দেখিনি যে একটা লোক বেঁংএচ থাকতে একটা ভালো কাপড় পেলো না, অথচ মরবার পরে তাকে নতুন কাপড় দিয়ে ঢাকা দিতে হবে ।"
"বটেই তো, কাপড়খানাও তো শরীরের সঙ্গেই পুড়বে ।"
"কিই বা থাকে ? এই পাঁচ রুপৈয়া আগে পেলে আমরা ওকে কিছু ওষুধ এনে দিতে পারতাম ।"
দু'জনেই ভিতরে ভিতরে আন্দাজ করেছিলো যে অন্যজন কী ভাবছে । দু'জনে সন্ধ্যা র্পয্যন্ত বাজারের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘুরে বেড়ালো । এই দোকান থেকে ওই দোকান ঘুরলো । সূতি আর রেশমের নানা রকম কাপড়ও দেখলো, কিন্তু কিছুই তাদের পছন্দ হোলো না । ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে । কেজানে কোন ঠাকুরের বিশেষ দয়ায় তারা মদের দোকানের সামনে পৌঁছে গেলো । আর ঠিক যেন পূর্ব-পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দু'জনে ভিতরে ঢুকেও গেলো । কিছুক্ষণ কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো । কিছু পরে ঘিসু গিয়ে দোকানিকে বললো, "আমাদেরও একটা বোতল দ্যান সাহুজি ।"
মদ কেনার পর কিছু ভাজাভুজিও এলো তার সঙ্গে । মাছভাজা আর তিলের মিষ্টি নিয়ে তারা দু'জনে পরম শন্তিতে বারান্দায় মদ্যপান করতে বসে পড়লো ।
কয়েক পাত্র মদ একটানা খাবার পর দু'জনেই কিছুটা শিথিল হয়ে পড়লো ।
ঘিসু বললো, "ওকে নতুন কাপড়ে জড়ানোর দরকারটা কি ? পুড়েই তো যাবে সব । দুলহিনের সঙ্গে তো কিছুই যাবে না ।"
যেন দেবতাদের নিজের নিষ্পাপ চরিত্রের সাক্ষী মানছে, এমনিভাবে উদাসীন মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে মাধব বলে উঠলো, "এই তো দুনিয়ার রীত - নইলে লোকে ব্রাহ্মণদের হাজার হাজার টাকা দেয় ক্যানো ? পরলোকে শান্তি পাওয়া গেলো কি গেলো না, কে দেখতে যাচ্ছে !"
"বড়ো.লোকদের অনেক টাকা- নষ্ট করুক তারা যত খুশি ! আমরা নষ্ট করি ক্যানো ?"
"কিন্তু লোককে কি বলবে ? তারা জিগাবে না কাফন কোথায় ?"
ঘিসু হাসে । "বলবো কোমরের গেঁজে থেকে টাকা পড়ে গিয়েছে । বহুত খঁংউজেছি, কিন্তু পাইনি । লোকের বিশ্বাস হবে না, কিন্তু তবু আবার টাকা দেবে ।"
মাধবও হাসে - এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যের আনন্দে । তারপর বলে, "বেচারি ছিলো বড়ো ভালো । মরার পরেও আমাদের জন্য এট্টা ভালো ভোজের ব্যবস্থা করে গিয়েছে ।"
অর্ধেকের বেশি বোতল নি:শেষিত হয়েছিলো । ঘিসু দোকানে দু' সের পুরি, চাটনী, আচার আর মশলাদার মেটে চেয়ে পাঠালো । মদের দোকানের সামনেই খাবারের দোকানটা ছিলো । মাধব দৌড়ে গিযে দুটো পাতার থালায় করে সব কিছু নিয়ে ফিরে এলো । সব মিলিয়ে পুরো দেড় টাকা খরচা হয়ে গেলো । আর মাত্র কয়েক পয়সা বাকি পড়ে ছিলো ।
বাঘ জঙ্গলে শিকার ধরে যেমন রাজকীয় ভঙ্গিমায়, তেমনি ভাবে তারা দু'জন বসে বসে পুরিগুলো খাচ্ছিলো । জবাবদিহি করার ভয়, বা বদনাম হয়ে যাবার দুশ্চিন্তা -- কোনোটাই হোলো না তাদের ! এই সব দুর্বলতা তারা বহু আগেই কাটিয়ে উঠেছে ।
ঘিসু দার্শনিক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো, "আমার আত্মা শান্তি পেলে বুধিয়ার মঙ্গল হবে না ?"
মাধব মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালো, "নিশ্চয়ই । ভগোবান, তুমি অর্ন্তযামী । তাকে সগ্গে নিয়ে যাও !
আমরা দু'জনেই তাকে প্রাণ ভরে আশীর্ব্বাদ দিচ্ছি । আজ যে ভোজ খেয়েছি, সারা জীবনে তেমনটি আর কখনো খাইনি !"
অল্প একটু পরে মাধবের মনে একটা সন্দেহের উদয় হল । সে বললো, "আচ্ছা, আমরাও তো এক-না-একদিন ওখানে যাবো, নয় ?"
ঘিসু এই শিশুসুলভ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না । স্বর্গের কথা চিন্তা করে এই অনির্বচনীয় মুহুর্তটিকে নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা ছিলো না তার ।
"সেখানে যখন সে আমাদের জিগাস করবে যে আমরা তাকে কাফন দিইনি ক্যানো, তুমি কী বলবে ?"
"বলবো তোর মাথা !"
"সে তো জিগাস করবেই ।"
"তুই ক্যামন করে জানলি যে সে কাফন পাবে না ? তুই আমায় অমন গাধা ভাবিস ? ষাটটা বছর ধরে দুনিয়ায় কি ঘাস কাটছি ? সে কাফন পাবে আর খুব ভালোই পাবে ।
ঘিসুর কথা মাধবের অবিশ্বাস্য ঠেকে । সে বললো, "দেবে কে ? সব পয়সা তো তুমি গিলে নিলে । সে তো আমাকে জিগেস করবে, -- তার সিঁথিতে সিঁদুর তো আমি দিয়েছি ।"
ঘিসু রেগে ওঠে, বলে, "বলছি যে সে কাফন পাবে, তুই শুনিস না ক্যানো ?"
"কে দেবে বলো না ক্যানো ?"
"যারা একবার দিয়েছে, তারাই আবারও দেবে । হঁযা, এবারে সে টাকা আমাদের হাতে আসবে না ।
সন্ধ্যার আঁধার যত ঘনিয়ে আসে, আর তারাদের ঔজ্জ্বল্য যত বাড়ে, মদের দোকানের চমকধমকও তত বাড়তে থাকে । কেউ গান গায় তো কেউ টলতে থাকে, কেউ তার সঙ্গীর গলা জড়িয়ে ধরে, আর কেউ তার বন্ধুর ঠোঁটে মদের গেলাস তুলে ধরে । ওখানকার পরিবেশে আনন্দের ছলনা আর বাতাসে ছিলো নেশা । কত লোকে তো ওখানে গিয়ে চুল্লুর নেশাতেই হাবুডুবু খেতো । মদের থেকেও ওখানকার পরিবেশই তাদের মাতাল করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট ছিলো । জীবনের অন্ধকারগুলি তাদের এখানে টেনে আনে । আর, কিছুক্ষণের জন্য তারা ভুলে যায় যে তারা বেঁংএচ আছে, মরে গেছে নাকি অর্ধমৃত অবস্থায় আছে ।
আর এই দু'জন, বাবা আর ছেলে এখনো শেষ চুমুকের মজাটুকু উপভোগ করছে । সবাই তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে । একটা গোটা বোতল নিয়ে দু'জনে বসতে পেরেছে - তারা কত ভাগ্যবান !
খাওয়া শেষ হলে, মাধব পাতার থালাটা তুলে একজন ভিক্ষুকের হাতে দিয়ে দিলো ; সে ক্ষুধার্ত চোখে এতক্ষণ তাদের খাওয়া দেখছিলো । কাউকে কিছু দেওয়ার আনন্দ, রোমাঞ্চ এবং গর্বটুকু মাধব জীবনে প্রথম বারের জন্য অনুভব করে ।
ঘিসু বলে, "নিয়ে যা । খেয়ে পেট ভরলে আশীর্বাদটুক দিবি । যার জন্য খেতে পেলি, সে মরে গিয়েছে, কিন্তু তোর আশীর্বাদ ঠিক পৌঁছবে তাকে । তোমার সারা শরীর তার জন্য আশীর্বাদ করুক, বড়ো কঠিন পরিশ্রমে এই খাওয়া জুটেছে ।"
মাধব ফের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, "সে সগ্গ্যে যাবে--সগ্গের রানি হবে সে ।"
ঘিসু উঠে দাঁড়ায় ; যেন সুখের সাগরে ভাসছে, এমনিভাবে বলে ওঠে, "হঁযা বেটা, সে সগ্গেই যাবে ! সে কখুনো কাউকে দুখী করেনি, কাউকে কষ্ট দেয়নি ; এমনকি মরতে মরতেও আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড়ো সাধটা পূর্ণ করে গেছে সে । সে যদি সগ্গে না যায় তো কি ঐ মোটা বড়ো.লোকগুলো যাবে -- যারা গরীবকে দু'হাতে লুটে নিয়ে গঙ্গায় পাপ ধুতে, আর মন্দিরে জল ঢালতে যায় ?"
তাদের এই পবিত্র ভাবনার রঙ দ্রুতই বদলে গেলো ; ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন নেশার অন্যতম বৈশিষ্ট্য । এবার হতাশা এবং দু:খের পালা । মাধব বলে, "কিন্তু বেচারি জীবনে বড়ো কষ্ট পেয়েছে । তার মরণটাও এত যন্তন্নার মধ্যে হয়েছে ।" দু'হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে আরম্ভ করে সে জোরে জোরে ফোঁপাতে লাগলো ।
ঘিসু তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে, "তুই কাঁদছিস ক্যানো বেটা ? এই ভেবেই সুখী হ’ যে সে এই মায়াজাল থেকে মুক্ত হয়েছে ; জঞ্জাল থেকে পালাতে পেরেছে । তার কী ভাগ্যি যে সে দুনিয়ার এই মায়ার বন্ধন অ্যাতো তাড়াতাড়ি কেটে বেরোতে পেরেছে ।"
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দু'জনে গাইতে শুরু করে, "মায়াবিনী ! তোর চোখ ক্যানো চমকায়, মায়াবিনী ?"
সারা সুরাগৃহ তামাশা দেখতে লাগলো, আর এই দুই মদ্যপ নেশায় চুরচুর হয়ে গেয়েই চললো । তারপরে তারা হঠাৎ নাচতে শুরু করে দিলো -- লাফ দিলো, ঝাঁপালো, পড়েও গেলো, নাটকও করলো, আর সবশেষে নেশার ভারে শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে ওখানেই পড়ে গেলো, পড়েই রইলো ।