• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৪ | ডিসেম্বর ২০০৪ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • ফ্যানি পার্কসের জার্নাল : মীনাক্ষী দত্ত

    [ইংলণ্ডের মেয়ে ফ্যানি পার্কস ১৮২২ থেকে ১৮৪৬ পর্যন্ত ভারতবর্ষে ছিলেন । তাঁর স্বামী যদিও ইস্ট ইণ্ডিয়া কম্পানির সাধারণ কর্মচারী, শ্রীমতী পার্কস নিজগুণে ও আকর্ষণী শক্তিতে সমাজের সর্বস্তরে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলেন । একদিকে যেমন লর্ড অকল্যাণ্ড ও ইডেন ভগ্নীদ্বয়ের সঙ্গে ভারতভ্রমণ করেছেন, অন্যদিকে ঘনিষ্ঠ হয়েছেন লখ্নৌর নবাব বা গোয়ালিয়রের মহারাণীর সঙ্গে ; প্রবেশ করেছেন ভারতীয় অন্ত:পুরে ও হারেমে যে সৌভাগ্য খুব কন বিদেশিনীরই হয়েছে । যত্ন করে শিখেছেন সেতার বাজাতে, শিখেছেন উর্দু ভাষা । ত্রক্রমে তিনি হয়ে উঠেছেন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ও ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কঠোর সমালোচক । তাঁর বই অবলমবন করে আরো অন্তত দুটি বই রচিত হয়েছে : উইলিয়াম ড্যালরিম্পলের (ঘঠত্ত্ঠছস্‌ ঈছত্শষ্স্‌ংঋত্‌ং) বেস্টসেলার দ্য হোয়াইট মুঘলস্‌ (মচ্‌ং ঘচ্ঠঞং ংঔণ্ণভচ্ছত্য) ও সুসান মুর-এর (নণ্ণযছত্র ংঔধধশং) উপন্যাস ওয়ান লাস্ট লুক (চত্রং ত্ছযঞ ত্ধধূ) ।

    জংভণ্ণস্‌, মচ্ণ্ণভয, ছত্ররু ঞচ্‌ং ঘচ্ঠঞং ংঔণ্ণভচ্ছত্য -এর (৫৫ পরিচ্ছেদ) সম্পূর্ণ অনুবাদ প্রকাশিতব্য । এখানে সামান্য অংশের অনুবাদ দেওয়া হলো ।]

    বেগম, ঠগী ও শ্বেতমোগল
    ফ্যানি পার্কসের জার্নাল (অংশ)

    ॥ ১ ॥


    অ্যাণ্ড্রুজ গির্জা - জেমস ফ্রেজারের আঁকা ছবি
    ১৮২৫-এ ভিউজ অব ক্যালকাটা-তে সংকলিত
    (কলকাতা একাল ও সেকাল)

    ১৮২২ সাল

    কলকাতাকে বলা হয় প্রাসাদনগরী, এ নাম কলকাতাকেই মানায় । ময়দানের উপর, নদীর কাছে গভর্নমেন্ট হাউস, তার পেছনে সেই অ্যাণ্ড্রুজ গির্জা । বাঁ-দিকের অংশের নাম চৌরঙ্গী, বাগান, ও মাটি থেকে উপর পর্যন্ত থামে ঘেরা সুদৃশ্য অট্টালিকা শোভিত সেই রাস্তা । বাড়িগুলি সিমেন্টের তৈরি, বাইরের দেয়াল দেখে মনে হয় পাথর । চৌরঙ্গী-পাড়ায় বাড়িভাড়া খুব বেশি ; আমরা দিই মাসে ৩২৫ টাকা, ৪০০/৫০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া ওঠে ।

    ইংলণ্ডের বাড়ির সঙ্গে ভারতবর্ষের বাড়ির অনেক তফাৎ । এখানে ঘরের মেঝে ঢাকা থাকে যে মাদুর বা পাটি দিয়ে, তার থেকে ঠাণ্ডা বা আরামের আর কিছু হতে পারে না । শীতের কয়েকমাস পাতা হয় পার্সিয়ান বা মির্জাপুরী কার্পেট । অনেক দরজা জানালা । জানালাগুলি ফ্রেঞ্চ-উইণ্ডোর মতো, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত । জানালার বাইরে রোদ আটকাবার শেড । উঁচু সিলিঙের বড়ো বড়ো ঘর । এক ঘরের দরজা আরেক ঘরে খোলে । ঘরে ঘরে পাখা । কলকাতার সবচাইতে নামকরা আসবাবের দোকান হলো এম দ্য বাস্তু-এর -- সেখানে শ্বেতপাথরের টেবিল, ভালো আয়না, বাহারি সোফা এসব প্রচুর পাওয়া যায় । ইওরোপিয়ানদের আরো দোকান আছে ভালো ভালো । ভারতীয় মিস্ত্রিরা নির্দেশমতো আসবাব বানিয়ে দেয় । ভারতীয় দোকানের আসবাবের মান ততো ভালো নয় ।

    কলকাতার আবহাওয়া আমাকে মুগ্ধ করেছে । কী চমত্কার ! আর এখানে বন্ধুদের সহৃদয়তার তুলনা নেই । ভারতের মতো দেশ নেই, আমার যেসব প্রিয়জনদের ইংলণ্ডে ফেলে এসেছি তাদের যদি আনতে পারতাম তবেই আমার সুখ সম্পূর্ণ হতো । ইওরোপ থেকে এসে ভারতীয় গৃহস্থালীতে ভৃত্যসংখ্যা দেখে অবাক লাগে, মনে হয় এ কী অমিতব্যয়িতা ! তাদের মাইনে খুব বেশি নয়, তবে খেতে তো দিতে হয় ; খরচ প্রচণ্ড ।

    ডিসেম্বর ১৮ -- মার্কিস হেস্টিংস গহর্নমেন্ট হাউসে `বল' দিলেন , সেনাবিভাগের লোকেরা ছাড়াও কলকাতার অধিবাসীরা নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন । নবাব, রাজা, মারাঠা, গ্রীক, তুর্কি, আর্মেনিয়ান, মুসলমান, হিন্দু -- কতোজনের কতোরকম পোশাক, তার সঙ্গে সেনাবিভাগের ইউনিফর্ম মিশে দেখবার মতো ব্যাপার ! তবে এই সময় কলকাতায় রাতে যেরকম কুয়াশা হয় তাতে নাচের আসরে যাওয়াটা বেশ বিপজ্জনক ব্যাপার দাঁড়িয়েছিলো । পথের সামনে কী আছে কিছুই দেখা যায় না, আমাদের গাড়ির দুটো আলো ছিলো, তাছাড়া ঘোড়ার আগে আগে আলো হাতে ছুটছিলো দুজন মশালচি ; মশালের আলো আর মশালচিদের হাঁক আমাদের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করেছে ।

    পালকি এক অভিনব যান ; বেহারাদের গতি দৌড়নো আর হাঁটার মাঝামাঝি, ঘোড়াদের যেমন টগবগিয়ে যেতে শেখানো হয় তেমন -- বলা চলে দু'পেয়েদের টগবগানি । বেহারার মুখ দিয়ে একটা বিশেষ শব্দ করতে করতে চলে, তাতে তাদের সময় রাখার সুবিধে হয় । ভালো বেহারার কাঁধে পালকি একটুও দোলে না ।

    ইংলণ্ডে কজনের ক্ষমতা আছে স্ত্রী-কন্যার জন্য ঘোড়া রাখার ? কলকাতায় এসে দেখি সমস্ত মহিলারই ঘোড়া আছে, ভাড়া করা নয়, নিজস্ব । সেদিন দেখলাম সন্তানের জন্মের তিন সপ্তাহের মধ্যে এক মহিলা গ্যালপ করে চেলেছেন । সাহস আছে, মানতেই হয় ।

    ডিসেম্বর ২০ -- কলকাতাবাসী সরকারি ও বেসরকারি কর্মী, সেনাবিভাগ -- সবাই মিলে মারকিস ও মার্চিওনেস হেস্টিংসের বিদায় উপলক্ষ্যে `বল' দিলেন । গভর্নর জেনারেল ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ।

    ডিসেম্বর ২৫ -- পরিচারকেরা বড়দিন উপলক্ষ্যে তাজা ফুংএংএলর মালা দিয়ে বাড়ির গেট সাজাচ্ছে । বেয়ারা ও ধোবিরা থালা-ভরা ফল, কেক, মিষ্টি নিয়ে এসেছে ফুল দিয়ে ঢেকে । আমাদের `ক্রিসমাস বক্স' শব্দটি এখানে `বকশিশ' হয়ে দাঁড়িয়েছে । আমরা উপহার গ্রহণ করলাম ও প্রত্যেককে টাকা `বকশিশ' দিলাম ।

    লোকে বলে চুরিবিদ্যায় চিনেরা অদ্বিতীয়, তবে তাদের পরেই বোধহয় ভারতীয়দের স্থান । আমরা গেটে একজন দারোয়ান রেখেছি, দুজন চৌকিদার আর বাড়ির কম্পাউণ্ড ঘেরা আছে উঁচু দেয়াল দিয়ে ।



    ॥ ২ ॥

    রামমোহন রায়ের বাড়ি (বর্তমান অবস্থা)
    ফটো : অলক মিত্র

    (বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি)

    ১৮২৩ সাল

    জানুয়ারি ১২ -- নিচে বেয়ারা গোলমাল করছিলো ; রাত্রে চৌকিদার হাঁক পাড়ছিলো ঘনঘন বোঝাতে যে সে জেগে জেগে পাহারা দিচ্ছে । তত্সত্ত্বেও সকালে দেখা গেলো আমাদের যে বন্ধু আমাদের সঙ্গে আছেন, তাঁর ডেস্ক থেকে সোনার মোহর সহ অনেক দামি জিনিস চুরি গেছে, সেইসঙ্গে কিছু জামাকাপড় ও তাঁর মিলিটারি ক্লোক । চোর ধরা গেলো না, তবে দেখেশুনে মনে হলো `খানসামা'ই দায়ী, দারোয়ান আর চৌকিদারও হয়তো সহায়তা করেছে । তাদের ছাড়িয়ে দেওয়া হলো ।

    মার্চ ২০ -- ভারতবর্ষে আমার চার মাস হলো । আবহাওয়া বিষয়ে মত বদলাতে বাধ্য হয়েছি । গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছে । মাঝে মাঝে গুমোট গরম । দিনের বেলা বাইরে বেরুলে গরম হাওয়ার ঝাপটা এসে বাড়ি মারে, হঠাৎ উনুনের ঢাকা খুললে যেমন হয় ।

    সন্ধ্যাগুলি খারাপ নয়, ঠাণ্ডা হাওয়া দেয় । আমরা অনেক রাত অবধি বাইরে থাকি, গাড়িতে ঘুরি, পূর্ণিমার রাতের তুলনা নেই । অন্ধকার রাত্রিতে গাছে গাছে আলো জ্বালে জোনাকি পোকা -- ছোটো আলোর ফুলকির মতো ।

    `পাঙ্খা' জিনিসটা প্রথম দেখা `গ্রিফিন' [১] প্রাণী যার মাথা ও পাখা ঈগলের মতো ও দেহ সিংহের মতো ।) দেখার চাইতেও অবাক করা । দানবীয় আকৃতির পাখা -- কাঠের ফ্রেমে দশ, কুড়ি, তিরিশ গজ কি তারও বেশি কাপড় আটকানো, সিলিঙ থেকে ঝোলে, দড়ি আর পুলির সাহায্যে বাইরে থেকে টানা হয়, দেয়ালের ফুটো দিয়ে বাইরে দড়ি ঝোলে । ভারতীয়দের উদ্ভাবন এবং সবচাইতে বড়ো বিলাসিতা । পাখাগুলি দেখতেও সুন্দর, কোনোটা রঙিন, কোনোটা গিল্টি করা, রেশমী দড়ি, আর এমন ভাবে তৈরি ও টাঙানো যাতে ঝাড়লন্ঠনের কোনো ক্ষতি না হয় । যখন ব্যবহার করা যায় না তখন গুটিয়ে রাখা যায় । উত্তরপ্রদেশে পাঙ্খা ঝোলে `চারপাই' বা বিছানার উপর, সারা রাত টানা হয় ।

    এখানে আবহাওয়া বড়ো অনিশ্চিত, এই গরমে মরে যাচ্ছি, এই এলো কালবৈশাখীর ঝড়, বাড়ির সমস্ত দরজা জানালা বাতাসের বাড়ি খেয়ে খুলে গেলো, আর শুরু হলো বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি । সেদিন রাত্রির মতো ঘন অন্ধকার করে এলো, তার মধ্যে এক কি দুই মুহূর্তের জন্য আকাশ চিরে বিদ্যুতের তীব্র নীল গন্ধক-আলো -- যেন কোনো নাটকের মঞ্চ -- এতো সুন্দর লাগছিলো ! যাঁরা সমুদ্রে আছেন তাঁদের অবস্থা নিশ্চয়ই ঈর্ষণীয় নয় এই রকম সময়ে ।

    শ্যামল সবুজ এই দেশের বৃক্ষরাজি চিকন, নধর ও অপরূপ । কলকাতা একেবারেই সমতল, কিন্তু সবুজের ধনে ধনী । আয়া আমাকে পোশাক পরতে সাহায্য করে, বাড়ি যায়, খায়, তারপর ফিরে এসে আমার ঘরের এক কোণায় শুয়ে সারা দিন ঘুমোয় । আর বেয়ারা পাখা টানার সময়টুকু [২] ছাড়া বাকি সময় খায় আর ঘুমোয় ।

    কিছু কিছু ভারতীয় দেখতে খুব সুন্দর কিন্তু শক্তপোক্ত বলে মনে হয় না । দু'একজনকে দিয়ে কাজ চালানো মুশকিল, অনেক লোক রাখতে হয় । রীতিনীতি ও কুসংস্কারের অন্ত নেই এদের ; এক এক জন এক একটা বিশেষ কাজই শুধু করবে, তার বাইরে কিছু করবে না । আর কতোরকম ঝঞ্ঝাট যে করে -- ইংরেজ ভৃত্যরা এদের তুলনায় অনেক নম্র ও বাধ্য । তবে আগে আলস্যের যতো নিন্দে করতাম এখন আর ততো করি না, এই গরম আবহাওয়ায় আমি নিজেও অলস ও উদ্যমহীন হয়ে পড়ছি । এখানে সবচাইতে বিরক্তিকর বস্তুটি হলো মশার কামড় ; না চুলকিয়ে পারা যায় না, আর চুলকোলেই জায়গাটা ফুলে ওঠে । গরমের চেয়েও মশার অত্যাচার বেশি কষ্টকর । অসহ্য !

    মে ১৮২৩ -- সেদিন সন্ধ্যায় বাঙালি বাবু রামমোহন রায়ের বাড়ির পার্টিতে গিয়েছিলাম । বিশাল বাগান, কতো আলো, কতো বাজি !

    বাড়ির বহু ঘরের কোনো কোনোটিতে নাচগান হচ্ছিলো । নাচের জন্য বাইরে থেকে পেশাদার নাচিয়ে মেয়েদের আনা হয়েছে । তাঁদের পরনের সাদা মসলিনের পেটিকোট একশো গজ কাপড়ে তৈরি, তাতে সোনা ও রুপোর জরির কাজ করা ; তার তলায় সাটিনের চোস্ত ; সুতোর কাজ করা দোপাট্টা দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানা । গায়ে প্রচুর গয়না ।

    এঁরা যখন নাচেন পায়ের ঘুঙুর বাজে । সঙ্গের বাজনদার সব পুরুষ, নানান আকৃতির বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিলেন তাঁরা ।

    অনভ্যস্ত কানে তাঁদের গান অদ্ভুত লাগছিলো ; মনে হচ্ছিলো যেন নাক দিয়ে সুর বেরুচ্ছে ; তবু কিছু কিছু সুর বেশ ভালো লেগেছে । একটি নাচিয়ে মেয়ের নাম নিকি, তাকে প্রাচ্যের কাটালানি [৩] বলা যায় । খাওয়াদাওয়ার পর শুরু হলো ভোজবাজি । তলোয়ার খাওয়া, নি:শ্বাসের সঙ্গে আগুন ও ধোঁওয়া বের করা -- এইসব নানান খেলা দেখানো হলো । একজন ডান পায়ে দাঁড়িয়ে, বাঁ পা পেছনে তুলে ডান কাঁধে নিয়ে এলো । ভাবো দেখি ! বাড়িটা ভারি সুন্দর সাজানো, সবই ইওরোপিয়, গৃহস্বামীই কেবল ভারতীয় ।

    ভারতবাসী ইওরোপিয়ানদের বাচ্চাদের চামড়া কেমন যেন ফ্যাকাশে মনে হয়, ইংলণ্ডে তো এমন লাগে না !

    ভারতবর্ষের ফল আকারে বৃহত্‌, কিন্তু ইংলণ্ডের ফলের মতো সুস্বাদু নয় । `আম'-এর কথা এতো শুনেছি, খেয়ে নিরাশ হলাম । অন্তত এই সময়ে বাজারে যে আম পাওয়া যাচ্ছে তাতে খুব আঁশ আর তার্পিন তেলের গন্ধ ।

    কেল্লাটা বেশ বড়ো ও সুন্দর, কিন্তু চারপাশের দেয়ালের জন্য ভেতরে খুব গরম । সৈন্যবাহিনীতে অসুস্থতার হার খুব বেশি, ছ'মাসের মধ্যেই তিনজন অফিসার মারা গেছেন, নজন অসুস্থ হয়ে ইংলণ্ডে ফিরে গেছেন, তিনশো `প্রাইভেট' [৪] হাসপাতালে । প্রাইভেটদের মধ্যে অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার এতো বেশি হওয়ার কারণ অবশ্য সস্তা মদ ও রোদের তাপ ।

    এখানে গ্রীষ্মকালে টেবিলে শেরি বা পোর্ট দেখাই যায় না ; মেডিরাও না ; বার্গেণ্ডি, ক্ল্যারেট ও হালকা ফরাসি ওয়াইন ক্কচিৎ দেখা যায় ।

    কলকাতায় দম বন্ধ করা গুমোট আবহাওয়া । তাই দেশে যা বিলাসিতা এখানে তা আবশ্যিক । এই গরমে হাঁটা অসম্ভব, সাধারণ ইওরোপিয়ান দোকানদারেরও গাড়ি [৫] আছে । সন্ধ্যায় সবাই গাড়ি করে হাওয়া খেতে বেরোয় । সন্ধ্যায় একটু ঠাণ্ডা পড়ে ।

    জুন ১ -- সকালে খুব গরম ছিলো, কিন্তু এখন বৃষ্টি আসছে । মনে হচ্ছে আকাশের জানালার পাট খুলে গেছে, ভেতর থেকে জলের তোড় নেমে এসে পৃথিবী ভাসিয়ে দেবে । বাজ পড়ছে, তীব্র বিদ্যুতের ঝলক । দেশে কখনো এরকম বৃষ্টি দেখিনি, কিন্তু এখানে কেউ অবাক হচ্ছে না । সব বাড়িতেই `কনডাক্টর' আছে । আমরা যারা ডাঙায় আছি তারা তাই নিশ্চিন্ত ও আবহাওয়া শীতল হওয়ায় খুশি ।

    লর্ড আমহার্স্ট এসে পৌঁছেছেন । তাঁর সম্মানে যে পার্টি হলো তাতে গিয়েছিলাম ।

    অগাস্ট ২৯ -- গভর্নর জেনারেল ও লেডি আমহার্স্ট কলকাতায় খুব জনপ্রিয় হয়েছেন । তাঁরা ব্যায়সংকোচ করার জন্য গভর্ণমেন্ট হাউসের ভৃত্য ও আলোর সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছেন । ব্যারাকপুরের পার্কে নাকি তিনি আলুর চাষ করবেন । ব্যায়সংকোচে অনভ্যস্ত ভারতীয়রা এতে বিস্মিত ।

    সেপ্টেম্বর ৬ -- বাড়িতে খুব চুরি হচ্ছে । সেদিন ৭০টাকা হাওয়া হয়ে গেলো, এখন দেখছি আমাদের ওয়াইন গ্লাশের আঠারোটা রুপোর ঢাকনা পাওয়া যাচ্ছে না ; আমার ধারণা আমাদের ওড়িয়া বেয়ারারাই ওগুলো নিয়েছে । ওদের ছাড়িয়ে তাই উত্তরপ্রদেশের লোক রাখছি ।

    অক্টোবর ১ -- মহিশূরের নবাব টিপুসাহেবের ছেলে শাহজাদা জাহাঙ্গির জামান জামউদ্দিন মাহমুদ এসেছিলেন ।

    উনি আমাদের বাড়ির কাছেই থাকেন, আগের দিন খবর পাঠিয়ে পরদিন সকালে এলেন ও দুঘন্টা থাকলেন । এক বছর ধরে উনি ইংরিজি শিখেছেন । পাখির খাঁচা দেখে বললেন, শৈংঞঞষ্‌ ঢঠশরু, ঞচ্ছঞ, ত্ঠঞঞত্‌ং ষ্‌ংত্ত্ধগ ঢঠশরু, গচ্ছঞ ষ্ধণ্ণ বছত্ত্‌? বললাম, ক্যানারি পাখি । তাঁর জবাব, হৃংয, বছত্রছশষ্‌ ঢঠশরু, ংঋশংঞঞষ্‌ ঢঠশরু, স্ছূং ংঈঠত্রং ত্রধঠযং, ঞচ্‌ংষ্‌ ত্রধঞ ভশধগ চ্‌ংশং. এইভাবে চললো আমাদের কথাবার্তা, ভাবছি কখন উঠবেন আমার অতিথি । `আগমন নিজের ইচ্ছায় কিন্তু গমন অনুমতিসাপেক্ষ' এই প্রাচ্য রীতি আমি জানতাম না । অবশেষে তিনি গাত্রোথ্থান করলেন, বললেন, ঝ ঞছূং ত্‌ংছটং ত্রধগ, বধস্‌ং ভংত্র যধধত্র. পরের দিন তিনি তিন ঝুড়ি ভর্তি মিষ্টি পাঠিয়ে দিলেন উপহার হিসেবে । আমি খুবই অবাক হলাম, কিন্তু শুনলাম এটাই নাকি ভারতীয় রীতি এবং এই উপঢৌকন গ্রহণ না করাটা অত্যন্ত অপমানজনক ।

    অক্টোবর ১৩ -- এক ধনী বাঙালি বাবুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিলো দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে । কেউ কেউ এই উত্সবকে দশেরাও বলেন । চারমহলা বাড়ি, মাঝখানে উঠোন ; সেখানেই দুর্গাপ্রতিমা বসানো হয়েছে, প্রতিমার সামনে ব্রাহ্মণ পুরোহিত বসে আছেন । দুর্গার দশ হাত, ডানহাতের একটিতে বর্শা ধরা যা দিয়ে তিনি অসুরকে হত্যা করছেন, বাঁ-হাতের একটিতে ধরা সাপের লেজ, সাপের মুখ অসুরের বুকে, অন্যান্য আটটি হাতের এক একটিতে একেক জিনিস ধরা, অধিকাংশই যুদ্ধাস্ত্র । দেবীর বাহন সিংহ তাঁর ডান পা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, বাঁ পায়ের তলায় শায়িত অসুর । এক পাশের একটি ঘরে ইওরোপিয় স্টাইলে খাবার টেবিল সাজানো (মেসার্স গুন্টের অ্যাণ্ড হুপারের কেটারিং), নানাবিধ ফরাসি সুরা ও বরফ শোভা পাচ্ছে । উঠোনের অন্যপাশে একটি ঘরে নাচগান হচ্ছে, ইওরোপিয়ান ও ভারতীয় অতিথিরা সোফা ও চেয়ারে বসে হিন্দুস্থানী গান শুনছেন ।

    দুর্গাপূজা হয় বাংলা বছরের আশ্বিন মাসে । ষষ্ঠীর দিন দেবী জাগ্রত হন, সপ্তমীতে হয় তাঁর আগমন, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিনদিন পূজার পর দশমীতে নদীর জলে দেবীর মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয় । এই পুজোয় যে পশুবলি হয় তার মাথা এক কোপে কাটতে হয় ।

    ধনী বাবুরা এই পুজোর পেছনে প্রভূত অর্থ ব্যয় করেন । এ সময়ে ছুটি নিয়ে সরকারি কর্মচারীরা সবাই দেশে যান ।

    ডিসেম্বর ২ -- ভাবা যায় ! এখন আমরা পাখা ছাড়া বসে আছি, জানালা বন্ধ করা, কার্পেটপাতা ঘরে । কোনো কোনো বাড়িতে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালানো হয়েছে । আমরা এখনো জ্বালাইনি, তবে এক এক সময় এমন ঠাণ্ডা পড়ে যে মনে হয় জ্বালাতে হবে শেষপর্যন্ত । কী সুন্দর হয় সকালগুলো ; রাতে তুলোভরা সিল্কের লেপ (বা রেজাই) গায়ে জড়িয়ে আরামে ঘুমোই ।

    এখানে স্থানীয়রা চমত্কার মাটির পুতুল বানায় । চোখ, চোখের পাতা, ঠোঁট -- একেবারে নিখুঁত । খুব ভঙ্গুর অবশ্য । কতো কী বানান তাঁরা, সমাজের সর্বস্তর ও সর্বজাতের মানুষ, গায়ে তাদের যথোপযোগী পোশাক । কলকাতায় বা কলকাতার আশেপাশেই নাকি সবচেয়ে ভালো মাটির পুতুল বানানো হয় । দাম আট আনা থেকে এক টাকা ।

    এখন কলকাতায় নানান উত্সব -- বল, নাটক, পার্টি কতো কী । ঘোড়দৌড়ও শুরু হয়েছে এই মাসে ; এখানেও আছে ডার্বি, ওক ও রিভলসওয়ার্থ । রিভলসওয়ার্থটা খুব ইন্টারেস্টিং, কারণ জকিরা নয়, সাধারণ ভদ্রলোকরা নিজেরাই ঘোড়ায় চড়েন । সকালে আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে স্ট্যাণ্ড থেকে পুরো কোর্সটা দেখা যায় ।

    চায়না থেকে দুটো আটপাল্লার পার্টিশন এসেছে, তাই দিয়ে আমরা দিনের বেলা রোদ ও রাত্রে ঠাণ্ডা বাতাস আটকাই । অসম্ভব সুন্দর পার্টিশন দুটো -- বলা যায় অতুলনীয় ।

    আমাদের সংসারে `ক্র্যাব দ্য টেরিয়র' এক বিশেষ সংযোজন । নেড়ি কুকুরই বলা চলে তাকে, কিন্তু দারুণ মজার আর স্বভাব খুব ভালো । সারাক্ষণ ছুটছে, এই বেড়াল তাড়া করছে, এই ইঁদুর মারছে, আস্তাবলেই শুধু নয়, বাড়িতেও প্রচুর ইঁদুর ।


    ॥ ৩ ॥

    ওয়েলেসলি প্লেস থেকে দেখা ডালহৌসি ইনস্টিট্যুট (স্থা: ১৮২৪)
    (কলকাতা একাল ও সেকাল)

    ১৮২৪ সাল


    জানুয়ারি ১৮২৪ -- কলকাতায় থাকার সুবিধে অনেক । প্রথমত, সরকারের চোখের সামনে থাকা যায়, কোনো পদ খালি হলেই ঢুকে পড়া সহজ । তাছাড়া ইংলণ্ডের খবর সবসময় পাওয়া যায়, মফ:স্বলে যা সম্ভব নয় । কলকাতার চিকিত্সা ব্যবস্থা সর্বশ্রেষ্ঠ । অসুবিধেগুলির মধ্যে প্রধান হলো চড়া বাড়িভাড়া ; অন্যান্য খরচও খুব বেশি ; এখানে এতো কিছু ঘটে আর এতো কিছু পাওয়া যায় টাকা উড়িয়ে সেওয়ার লোভ সম্বরণ করা মুশকিল ।

    আমাদের ব্যয়বাহুল্যের যাঁরা সমালোচনা করেন তাঁদের কী করে বোঝাই শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কতো প্রয়োজন একটা ভালো বাড়ি, ভালো আসবাব, ভালো গাড়ি, ভালো ঘোড়া, বন্ধুদের জন্য ভালো মদ ও ভালো মেজাজ ; চাই উত্তম পরিচারক, এবং অধিক সংখ্যক । এসবের জন্য অবশ্য চাই একটি ভালো চাকরি ।

    জানুয়ারি ১৫ -- গভর্নর জেনারেলের ব্যারাকপুরের বাসস্থানে চমত্কার পার্ক আছে । ঘোড়দৌড়ের সময় সারা কলকাতা ব্যারাকপুরে গিয়ে হাজির হয় । আমরাও গিয়েছিলাম এক সপ্তাহের জন্য । শহরের বাইরে গিয়ে ভারি ভালো লাগলো । লেডি আমহার্স্ট কোয়াড্রিলের (নাচ) ও বাজি পোড়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন, সারা গভর্নমেন্ট হাউস যেন খুশিতে ঝলমল করছিলো । আমার অবশ্য সবচাইতে ভালো লেগেছে দল বেঁধে একটা পুরোনো কেল্লা দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা । কেল্লাটা বর্ধমানের মহারাজার, ব্যারাকপুর থেকে পাঁচমাইল দূরে ; চমত্কার কেল্লাটা ।

    এই প্রথম আমি হাতির পিঠে চড়লাম । রাস্তা খুব খারাপ তাই গাড়ি ছেড়ে হাতির পিঠে চড়া -- ভয়ও করছে আবার মজাও লাগছে । হাঁটু মুড়ে বসা হাতির গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা মই চড়ে পিঠে উঠলাম, হাতি যখন উঠে দাঁড়ালো তখন মনে হচ্ছিলো একটা বাড়ি যেন পা গজিয়ে হাঁটছে ।

    গ্রামের পথ দিয়ে হাতি চলেছে ঝোপঝাড়, খানাখন্দ ও খেত পেরিয়ে । খেতের মাঝখানে আল দিয়ে পথ, মাহুত ঐ সরু আলের উপর দিয়ে হাতিকে নিয়ে যাচ্ছিলো যাতে শষ্যর ক্ষতি না হয়, কীভাবে যে হাতি ঐ মাটিতে সরু ঢিপির উপর দিয়ে সাবধানে যাচ্ছিলো তা দেখবার মতো ।

    কলকাতা ছেড়ে আসার আগে আমাদের দামি বাসন লোহার সিন্দুকে ভরে রেখে এসেছি । আমাদের এক বন্ধু তাঁর জিনিসপত্র বন্ধ করে রেখে এসেছিলেন লোহার পাত লাগানো ওক-কাঠের সিন্দুকে । ফিরে গিয়ে দেখেন বেয়ারারা বাক্স খুলতে না পেরে আগুন ধরিয়ে সমস্ত রুপো গালিয়ে বের করে নিয়েছে ।

    অন্য সবজায়গার মতো কলকাতাতেও পছন্দসই বাড়ি পাওয়া মুশকিল । আমাদের প্রথম বাড়িটা ছিলো খুব গরম, দ্বিতীয় বাড়ি স্যাঁতসেতে, যেজন্য সবাই জ্বরে পড়ছিলো । এখন আমরা সে বাড়ি বদলে চৌরঙ্গি রোডে একটা বাড়িতে উঠেছি ।

    নবাবজাদা জামউদ্দিন আমাকে নাচ দেখার নিমন্ত্রণ করেছিলেন । নাচ তেমন ভালো না লাগলেও কিছু গায়িকার গলা খুব ভালো লেগেছে ।

    কলকাতায় ফূর্তির অভাব নেই । গভর্নমেন্ট হাউসে অগুন্তি পার্টি, বহু নৈশভোজ ও ফ্যান্সি বল ।

    কলকাতার যে গরুর দুধ পাওয়া যায় সে তেমন ভালো নয়, ছাগলের দুধ বরং ভালো । একটা ভালো বাংলা ছাগল রোজ সকালে এক কোয়ার্ট [৬] দুধ দেয় । এখানকার ছাগল ছোটোখাটো, ও সযত্নলালিত । মর্নিংরুমের জানালার তলায় দুধ দুইয়ে ভৃত্যরা সফেন দুধ প্রাতরাশের টেবিলে নিয়ে আসে ।

    ফেব্রুয়ারি ২৭ -- আমার স্বামী কলকাতা লটারিতে. [৭] সাড়ে তেরোটা টিকিট কেটেছিলেন, প্রত্যেকটার দাম ১০০ টাকা ; সবই তাঁর এজেংএংএন্টর কাছে পাঠিয়ে একটি কেবল আমাকে দিয়েছিলেন । তাতে আমরা ৫০০০ টাকা পেয়েছিলাম । পরের দিনই ঐ টাকা দিয়ে আমরা একটা অত্যন্ত উঁচু জাতের আরব (ঘোড়া) ও দুটো পার্সিয়ান ঘোড়া কিনলাম । আরবের নাম রেখেছি ওর্লিও ।

    ফেব্রুয়ারি ২৮ -- চাল দিয়ে বিচার -- সেদিন কজন বন্ধু খেতে এসেছিলেন । খাবার টেবিলে যাবার আগে আমার স্বামী তাঁর হাতের ঘড়িটা বসার ঘরের টেবিলে রেখে গিয়েছিলেন । ফিরে এসে দেখা গেলো ঘড়িটা চুরি হয়ে গেছে । আমরা পুলিশে খবর দিলাম । মুন্সি এসে সবার নাম লিখে নিলেন ও বললেন, সাতদিনের মধ্যে ঘড়ি পাওয়া না গেলে চাল দিয়ে বিচার হবে । চালের বিচারে ভারতীয়দের খুব আস্থা তাই অনেক সময় চোর ধরা পড়ার ভয়ে মাল ফেরৎ দিয়ে দেয় । নির্দিষ্ট দিনে মুন্সি এসে সমস্ত পরিচারককে দেকে তাঁর সামনে সার বেঁধে বসালেন । তাঁর হুকুমে সবাইকে সেদিন উপোস করে থাকতে হয়েছিলো ।

    মুন্সি ২ পাউণ্ড চাল ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে রোদে শুকিয়ে নিয়েছিলেন । সেই চাল পালাপানসারার একদিকে আকবরী চৌকো মুদ্রা রেখে (ভারতীয়রা এখনো বিশেষ কাজে আকবরী মুদ্রা ব্যবহার করেন) মাপা হলো । এইবারে মুন্সি ৩৫ জন ভৃত্যের প্রত্যেককে এক এক করে ডেকে শপথ নিয়ে বলতে বললেন যে সে ঘড়ি চুরি করেনি ও কে চুরি করেছে তাও সে জানে না । প্রত্যেকের হাতে একমুঠো করে চাল দেওয়া হলো আর তাদের সামনে দেওয়া হলো একটুকরো কলাপাতা । এবারে মুন্সি বললেন, `তোমাদের মধ্যে এক বা একাধিকজন মিথ্যা শপথ নিয়েছো ; ভগবান আমাদের মাঝখানেই আছেন ; প্রত্যেকে যার যার অংশের চাল মুখে দিয়ে চিবিয়ে সামনের কলাপাতার উপরে ফেলো । যে সত্য কথা বলেছে তার মুখের চাল হবে ভেজা ও চিবোনো, যে মিথ্যাবদী হবে তার মুখ থেকে চাল যেমন ছিলো তেমনি শুকনো বেরিয়ে আসবে ।'

    সবাই চাল চিবিয়ে কলাপাতায় ফেললো, জল মেশানো দুধের মতো হয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, শুধু তিনজনের মুখ থেকে চাল বেরুলো শুকনো পাউডারের মতো হয়ে । এদের মধ্যে একজন পুরো চালটা মুখে না দিয়ে অল্প একটু দিয়েছিলো চিবোতে পারার আশায় কিন্তু লাভ হয়নি । মুন্সি বললেন, এরাই চোর, ওদের মধ্যে একজন হয়তো স্বীকার করবে । তাদের নিয়ে তিনি পুলিশ স্টেশনে গেলেন । সত্যিই, খুব ভয় পেলে মুখ থেকে লালা বেরোয় না, তাই ঠিকমতো চিবোনো যায় না ।

    চোর ধরা পড়লো, তিনজনের মধ্যে একজন ছিলো আমাদের এক অতিথির হরকরা, অন্য দুজন আমাদের নিজেদেরই লোক । ঘড়িটা অবশ্য পাওয়া গেলো না, চোরদের অন্তত তাড়ানো গেলো । আমি এখন এই চাল-বিচারে গভীর বিশ্বাসী ।

    মে ৪ -- ভয়ানক গরম পড়ে গেছে । যদিও এক বন্ধু এসে সেদিন বললেন, `বা: ঘরটা যেমন সুন্দর তেমনি ঠাণ্ডা' । আমাদের বাড়ির নিচেটা ইঁদুর আর ছুঁচোয় ভর্তি, আমার ছোট্ট স্কচ টেরিয়র রোজ চার-পাঁচটা করে মারে । ছুঁচো মারলে ওর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা ওঠে বোধহয় ঘেন্নায় । আমার ছোট্ট সোনামণি ত্রক্র্যাব -- প্রাচ্যে যেসব টেরিয়র ভাগ্যান্বেষণে এসেছে তারা কেউ ওর মতো মনোহরণ নয় ।

    আমাদের বন্ধুরা অনেকেই বাগানের জন্য বীজ পাঠিয়েছেন । কিন্তু হায় ! এদেশে প্রকৃতির প্রতি কী অবহেলা দেখুন -- সব সব্জীর বীজ -- গোলাপের মুখের চাইতে বুঝি মোটকা-সোটকা কড়াইশুঁটি এঁদের কাছে বেশি সুন্দর ?

    জুলাই ১৭ -- সেদিন আমাদের এক তরুণ বন্ধু রাইটার্স বিল্ডিঙে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমরা তাকে বাড়ি নিয়ে এলাম । তার দুদিন পরে আমি জ্বরে পড়লাম, তেরোদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলাম না । আমার স্বামী আমার সেবা করলেন তারপর তিনিও পড়লেন ; আমাদের পরিচারকদের মধ্যে এগারোজন জ্বরে শয্যাশায়ী ।

    সারা কলকাতায় এই জ্বর ছড়িয়ে পড়েছে । সর্বসাকুল্যে দুশোজনের বেশি মানুষ এর হাত থেকে বেঁচেছে কিনা সন্দেহ, তবে বয়স্কদের মধ্যে কেউ মারা যায়নি । হামের মতো গুটি বেরোয়, জ্বর ছেড়ে গেলেও ভয়ানক দুর্বল করে রেখে যায় । আমার স্বামী ন'দিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেননি । এক একজনের গায়ে তো চিতাবাঘের চামড়ার মতো চাকা চাকা দাগ হয়ে গেছে । আদালত, কাস্টম হাউস, লটারি অফিস, বলতে গেলে কলকাতার সমস্ত সরকারি অফিস বন্ধ ছিলো এই জ্বরের জন্য । ভাগ্য বলতে হবে যে এতো ব্যথা-বেদনা সত্ত্বেও জ্বর ছেড়ে যাবার তিন সপ্তাহের মধ্যে রোগী স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পায় । দু'তিনটি বাচ্চা অবশ্য মারা গেছে ।

    এদেশে খাবার টেবিলে কতোজন পরিচারক উপস্থিত থাকে দেখলে ইংলণ্ড থেকে সদ্য আগতরা ভিরমি হান । সেদিন আমরা আটজন ডিনার খেলাম । ভৃত্যসংখ্যা ছিলো তেইশ । নারীপুরুষ প্রত্যেকে নিজের নিজের পরিচারক বা পরিচারিকা নিয়ে আসেন এক থেকে ছয়জন করে । কলকাতায় হুঁকোটা খুব চলে । খাওয়া শেষ হবার আগেই প্রত্যেকের চেয়ারের পাশে হুঁকো রেখে দেওয়া হয় । তামাক এতো ভালো করে তৈরি করা হয় যে গন্ধটা খারাপ লাগে না, তবে মফ:স্বলের ভদ্রলোকের পাশে বসলে মুশকিল । তাঁদের তামাক উত্তরভারতীয় হুঁকোবরদারের হাতে তৈরি নয়, তাই গন্ধটা খুব কড়া ও অপ্রীতিকর ।

    সেপ্টেম্বর ১ -- অবশেষে জ্বরের প্রকোপ কমেছে কলকাতায় । জ্বরের কারণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত । কেউ বলছেন বৃষ্টির অভাব, কেউ বলছেন এ বছর বজ্রবিদ্যুৎ নাকি কম হয়েছে । ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় নাকি একবার এরকম জ্বর এসেছিলো । সেবারেও কেউ মারা যায়নি ।

    চৌরঙ্গী--টমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েল-এর আঁকা ছবি (১৭৯৮)
    (কলকাতা একাল ও সেকাল)

    (পরবাস, ডিসেম্বর, ২০০৪)


    [১] গ্রিফিন -- কাল্পনিক প্রাণী যার মাথা ও পাখা ঈগলের মতো ও দেহ সিংহের মতো ।

    [২] প্রতি দু-ঘন্টা অন্তর পাঙ্খা-পুলার বদল হতো ।

    [৩] ত্‌ংইংঈশংরুধ ঙছঞছত্ছত্রঠ, ১৮৫৪-১৮৯৩ [ঝঞছত্ঠছত্র ধৃংশছ]

    [৪] সর্বনিম্নপদস্থ সৈনিক

    [৫] এক্কাগাড়ি জাতীয় ছোটো গাড়ি

    [৬] কোয়ার্ট -- ২ পাইন্ট বা ১০ ছটাক

    [৭] বর্গীর ভয়ে কলকাতায় সার্কুলার খাল কাটা হয়েছিলো ; তার খরচ তোলার জন্য যে লটারির ব্যবস্থা করা হয়েছিলো তার কথা বলা হচ্ছে ।


    অলংকরণের ছবিগুলি নেওয়া হয়েছে কলকাতা একাল ও সেকাল (রথীন মিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯৯) এবং বনেদি কলকাতার ঘরবাডি . (লেখা : দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ছবি : অলক মিত্র; আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০২) থেকে ।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • কীভাবে লেখা পাঠাবেন তা জানতে এখানে ক্লিক করুন | "পরবাস"-এ প্রকাশিত রচনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রচনাকারের/রচনাকারদের। "পরবাস"-এ বেরোনো কোনো লেখার মধ্যে দিয়ে যে মত প্রকাশ করা হয়েছে তা লেখকের/লেখকদের নিজস্ব। তজ্জনিত কোন ক্ষয়ক্ষতির জন্য "পরবাস"-এর প্রকাশক ও সম্পাদকরা দায়ী নন। | Email: parabaas@parabaas.com | Sign up for Parabaas updates | © 1997-2023 Parabaas Inc. All rights reserved. | About Us