নাগিনা চলে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর একটা লোক এসে বলল, আমার ঢোলকটা যে ছেয়ে দেবে বলে এনেছিল, কই, ফেরত দিলেনা-তো ।
রঙ্গিনী কোনো কথা না বলে ছেঁড়া আঁচল খানিতে ঘোমটা লম্বা করে টেনে ধীরে ধীরে ঢুকল গিয়ে নাগিনার কাজের ঘরে, কিন্তু ঢোলক দেখতে পেলনা কোথাও ! তাহলে কি লোকটা মিছে কথা বলছে !
রঙ্গিনী বেরিয়ে এলে পর ঢোলকের মালিক নিজেই ঢুকল গিয়ে ঘরে । খুঁজে পেতে না পেয়ে নাগিনার উদ্দেশ্যে গালাগাল বর্ষণ করতে করতে চলে গেল ।
এমনি করে এল খোলের মালিক, সারিন্দার মালিক, সারেঙ্গি, দুতারা, একতারা, এস্রাজ, সেতার তানপুরা, বায়াতবলা, ডবকি, ডুগডুগি, কাড়ানাকাড়া, ঢাকের মালিক নানাজন নানাখান থেকে নানা সময়ে, কিন্তু একটা জিনিসও রঙ্গিনী ফেরত দিতে পারলনা । নাগিনার উপদেশে বর্ষিত সকল গালিগালাজ নিজের মাথায় পেতে নিয়ে রঙ্গিনী ভাবতে লাগল আগামী দিনের কথা ।
কাজকর্ম করেই যাদের পেট কোনোরকমে চলত, সেখানে কাজকর্ম মোটে না করে দীর্ঘ পাঁচবছর রঙ্গিনীর চলবে কেমন করে । ঘরের কাছে একটা কচু বন অবশ্য ছিল, রঙ্গিনী সেই কচু তুলেও এনে তা সিদ্ধ করেও দিন চালাত, শুধু কি তাতেই চলত ! বোষ্টমী আসত প্রায়ই রঙ্গিনীর দু:খের কথা সে জানত, তার ভিক্ষের চাল থেকেই হয়ত সে দুমুঠো রঙ্গিনীকে দিয়ে যেতো । কিন্তু এমনি করে আর কদিন চলে ।
রঙ্গিনী বিক্রি করতে চাইল পুনিকে । কিন্তু খদ্দের যখন এল, গিয়ে দেখে পুনি নেই । কে তাকে নিয়ে গেল - কোনোদিন তার হদিস হলনা ।
শুধু চুরি যাবার ভয়ে নাগিনার জুতো সেলাই এর যন্ত্রপাতি গুলি রঙ্গিনী তার বসত ঘরের মাঝখানে গর্ত খুঁড়ে একটা বড় মাটির গামলা বসিয়ে তার ভিতর রেখে উপরে একটা কাচ ঢাকনা দিয়ে তার উপর মাটি চাপা দিয়ে রেখে দিল । যদি কখনও ফিরে আসে, যদি রঙ্গিনীকে না পায়, তবু যেন সে কাজ করে খেতে পায় !
বোষ্টমী চলে গেলেই আজকাল খালের ওপারের আলিহুসেন এসে হাজির হয় একটা লোককে সঙ্গে নিয়ে । বলে, কতদিন নাগিনা নেই, কেমন করে তোমার চলছে, এই রেখে গেলাম কিছু চাল, ঘরে তুলে নাও ।
রঙ্গিনী সে সব কখনও ঘরে তোলেনি । কাকে-কুকুরেই সেগুলো খেয়ে নেয় ।
আলিহুসেনের কানে এসব যায় । সে একদিন দুপুররাতে এসে বলে, নাগিনা মুচির বউ, তোমার বড় আস্পর্ধা হয়েছে বুঝি ! এই বলে দরজায় লাথি মারে ।
রঙ্গিনী রাম রাম জপ করতে থাকে হাতে বটি নিয়ে বসে ।
ভোলা কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে বাড়ি কাঁপিয়ে তোলে ।
আলিহুসেন রাগে গজ্ গজ্ করতে করতে সরে পড়ে ।
রঙ্গিনী সেই রাত্রিতেই পালিয়ে যায় বাড়ি ছেড়ে । ভোলা কুকুরটা তার সঙ্গে থাকে । পরের দিন দুপুর বেলা এসে পৌঁছয় সেই সই বোষ্টমীর আখড়ায় । কিন্তু বোষ্টমী তখন ভিক্ষে করতে করতে বেরিয়ে পড়েছে ।
বোষ্টমীর ঠাকুর ঘরের দরজা বন্ধ । রঙ্গিনী সেখানেই ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকে । ভোলা কুকুরটা তাকে আগলে বসে ভাবে কতক্ষণে জানি আসবে বোষ্টমী ।
রঙ্গিন্নিকে বাড়িতে না পেয়ে বোষ্টমীও তাড়াতাড়ি ফিরে এল আখড়ায় । রঙ্গিনীকে আদর করে তুলে নিয়ে বলল, ভয় কিসের, তুমি প্রভুর আশ্রয় চাও, তাকালেই কোনো দু:খ থাকবেনা ।
বোষ্টমী ঠাকুর ঘরের দরজা খুলে দিল - গৌর নিতাই এর উজ্জ্বল মূর্তি দেখে রঙ্গিনীর দুচোখে ধারা বইতে লাগল । তাঁদের কাছেই শ্রীকৃষ্ণের বাল গোপাল মূর্তি । বোষ্টমী দেখিয়ে বলল, এই গোপালটি তোমার ।
জমিদারের সন্তান নিশীথবাবু । তাঁদের পূর্বপুরুষের নামই গ্রামের পরিচয় নন্দীগ্রাম । এবার সেই গ্রামের সেরা ছাত্র মৃন্ময় নন্দী । মুনিয়ার এই নূতন নামকরণ করেছেন তিনিই । মুনিয়া কোনো কিছুতেই আপত্তি করেনা, তাইতেই মুনিয়াকে নিশীথবাবু খুব ভালবাসেন ।
মুনিয়ার সাধ ছিল ইস্কুলে পড়ার । সে সাধ এতদিনে পূর্ণ হচ্ছে । কিন্তু নিজের আত্মপরিচয় গোপন করে এই যে তার জীবন আরম্ভ হল, সেটা কি রকম মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন মনে জাগে, কিন্তু যখনই ইস্কুলের ছেলেরা এসে মৃন্ময়দা মৃন্ময়দা, বলে চারিদিক থেকে ভেঙে পড়ে তখন শুধু আনন্দ ছাড়া আর কোনো চিন্তাই মনে ঠাঁই পায়না । ক্লাসে মাস্টার মশায় যখন আদর করে মৃন্ময় বলে ডাকেন, সেটা কি মুনিয়া ডাকের চেয়ে কিছুমাত্র কম শোনায় ! শুধু মা আর বাবাকে দিয়ে- তো সংসার নয় - চার পাশে যত মানুষ আছে সকলের সঙ্গে পরিচয় সাধন করতে পারলে তবেই জীবনের সার্থকতা ! এই পরিচয় যখন একদিন আরও গভীর হবে যেদিন তার বাপের নাম জানলেও কেউ তাকে অবজ্ঞা করতে সাহস পাবেনা - তখন হঠাৎ একদিন গিয়ে সে হাজির হবে তার মা বাবার কাছে । দুজনেই চমকে যাবে ছেলেকে দেখে -চমকে যাবে মা বাবা দু:খ মোচনে ছেলের শক্তি দেখে !
নিশীথবাবু এমন সময় এসে হাজির হন মুনিয়ার কাছে । বলেন কি ভাবছিলে মৃন্ময় মুনিয়া বলে মিউজিয়াম ঘরে ঐ যে একটা চাঁদকপালে জন্তুর চামড়া, সেটা কিসের ?
জমিদারের ছেলে হলেও শিকার ছাড়া অন্য খারাপ কোনো খেয়াল ছিলনা নিশীথবাবুর । শিকার যত করছেন সব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছেন একটা ঘরে, সেটার নামই দিয়েছেন মিউজিয়াম ঘর । মুনিয়া সে ঘরে ফাঁক পেলেই চলে যায় আর ঘুরে ঘুরে দেখে যত সব বাঘ ভালুক, হরিণ, হায়না, শেয়াল, আরও কত চেনা অচেনা জন্তুর চামড়া । সবগুলোর চাইতে ঐ চাঁদ কপালে জন্তুর চামড়াটার বিষয়ে জানতেই তার কৌতূহল ।
নিশীথবাবু বললেন, শিকারের নেশা এমনি যে অনেক সময় পায়ের শব্দ শুনেই গুলি ছুঁড়তে হয় । সেদিনও সারাদিন ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে যখন একটাও কিছু পেলামনা, তখন সূর্য্য অস্ত যায় যায় । হঠাৎ শুনি একটা উঁচু জায়গা থেকে জলের দিকে একটা হরিণ বুঝি যাচ্ছে জল খেতে । শব্দ অনুমানেই ছুঁড়লাম গুলি । পরে গিয়ে খুঁজে নিয়ে এলাম । যখন আলোতে দেখলাম তখন যেন জ্ঞান হল - হরিণ নয়, একটা বাছুর । ঠিক করেছিলাম তখনই নিজের বুকেও গুলি চালাবো, কিন্তু সঙ্গী বন্ধুরা দিলনা । বলল, প্রায়শ্চিত্ত করলেই মনের অচেনা অনুশোচনা দূর হবে । তুমি-তো আর ইচ্ছে করে করোনি ।
মুনিয়া এই কথা শুনে একেবারেই মুষড়ে পড়ল । কোনো কথা বললনা নিশীথবাবুকে, শুধু মনে মনে মুংলি কবে বাড়িছেড়ে পালিয়েছে সে দিনটা খুঁজে বের করবার চেষ্টা করতে লাগল । বাছুরের চামড়াটাতে সন তারিখ দেওয়া আছে ।
সেদিন থেকে আর পড়াশুনার মন বসছেনা মুনিয়ার । কেবলই তার মনে হচ্ছে - এটাই সেটাই কিনা । সারাদিন বিষন্নমুখে অন্যমনস্ক হয়ে থাকে, কারও সঙ্গে কথা বলেনা । বাড়ির এক বুড়ো চাকর একদিন মুনিয়াকে চুপি চুপি ডেকে বলল,
একটা কথা বলবে খোকাবাবু
মুনিয়া অপ্রস্তুত হয়ে বলে, কি কথা
তোমার মনে যেন কিসের একটা কষ্ট হচ্ছে । তুমি যেন সব সময় অন্য কার কথা ভাবছ । একটি বৌদিদি এনে দেবার জন্য মাকে বলবো নাকি !
মুনিয়া বলল, ধ্যেৎ ।
আরে লজ্জা করোনা । জমিদারের ছেলের অল্প বয়সে বিয়ে করলেই ক্ষতি কি, তাকে-তো আর রোজগার করে খাওয়াবার কথা ভাবতে হয়না । বলোনা মন খুলে । মুনিয়া বলল, সে-সব নয়, আমার একটা খুব সুন্দর বাছুর ছিল, সেটা হারিয়ে গিয়েছে । সেটা এখন বেঁচে আছে জানলেই আমি নিশ্চিন্ত হই ।
তার জন্যে আবার এত ভাবনা । এসোনা এক্ষুনি নিয়ে যাই ও-পাড়ার টিপুদার কাছে । ও ঠিক ঠিক বলে দেবে বাছুরটা এখন কোনখানে আছে !
সত্যি !
একবার পরীক্ষা করেই দ্যাখোনা ! পয়সাকড়ি নেয়না । এক নাগা সন্ন্যাসীর কাছে জ্যোতিষ শিখেছিল । সন্ন্যাসী বলে দিয়েছিল যে কারও কাছ থেকে পয়সা নিলেই জ্যোতিষ মিথ্যে হয়ে যাবে । কোনো বই পত্র নেই । মাটিতে আঁকজোঁক কেটেই বলে দিতে পারে ।
শরীর খারাপ ভান করে মুনিয়া সেদিন ইস্কুলেই গেলনা । সারাটা দুপুর বিছানায় গ.দাগড়ি দিয়ে বিকেলের জন্য অস্থির হয়ে উঠল । চারটে বাজতেই নিশীথবাবু বেরিয়ে গেলেন কোন বিশেষ কাজে । মুনিয়া সেই বুড়ো চাকরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে হাজির হল টিপুদা জ্যোতিষীর বাড়ি ।
বেশী বয়স নয় টিপুদার । সাধারণ চাষী । নিশীথবাবুর বাড়ি থেকে লোক এসেছে শুনে টিপুদা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে উঁচু টুলখানি বের করে দিল । মুনিয়া বলল, আমি বসবই না ।
টিপুদা বলল, না বসলে আমি বলবই না ।
এবার বসতে হল । বুড়ো চাকর বসল একখানা চাটাই এর উপর ।
মুনিয়ার বাছুরের বিবরণ শুনে টিপুদা একটা শুকনো গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে এসে তাই দিয়ে মাটিতে আঁকজোঁখ কাটতে লাগল । শেষে বলল, আপনার বাছুর এখন তিপরা বাড়িতে আছে । এই পাহাড়টা পার হয়ে পূবদিকে গেলেই পাবেন । কিন্তু তিপরাদের বাড়িতে যাওয়া সহজ নয় !
মুনিয়া বলল, আমি কি আর যাব, তবু বেঁচে আছে সেটুকু শুনেই নিশ্চিন্ত হলাম !
চাকরকে বিদেয় করে দিয়ে মুনিয়া বলল, আমি একটু পরেই আসছি মাকে গিয়ে বলবেন ।
বুড়ো বলে, না, না, আমার সঙ্গেই চলুন, তা নাহলে মা আমাকে বকবেন ।
আরে কি মুশকিল, ইস্কুলে সকালে যেতে পারিনি - একটা জিনিস জানবার দরকার - বুঝলেতো এবার ।
বুড়ো এবার চলে গেল । মুনিয়া রওনা হল সেই পথটা ধরে -যে পথে সেই গাছটা - যার ডালে চড়ে রাত কাটিয়ে ছিল । সেই পথ পার হয়ে সোজা হেঁটে চলল জঙ্গলের ভিতর দিয়ে । যেন একটা নেশা নয় - একটা রোগ - বাঘ ভালুকের ভয় নেই - যেতে হবে পাহাড় ডিঙিয়ে তিপরার বাড়িতে ।
চৌকিদার কিছুতেই রাজি হলনা ।
মুনিয়া নিজের জামাকাপড় পরেই রওনা হল পূবদিকে । পাহাড়ের পথ ধরিয়ে দিয়েছিল সেই চৌকিদার । কিছুদূর যেতেই সঙ্গী পেল - যত সব কাঠুরের দল, তবে সবাই কাঠ আনবে না পাহাড় থেকে । কেউ আনবে বাঁশ, কেউ আনবে ছন, কেউ আনবে কাঠ । সবারই পরনে নেংটিপ্রায় ছোটো একটুখানি কাপড় । মুনিয়া ভাবল এমন খালি গায়ে এরা আমারও আগে ঘর থেকে বেরিয়েছে !
কাঠুরেরা এতক্ষণ তামাক টানতে ব্যস্ত ছিল । হঠাৎ দেখে তাদের মাঝখানে একটি বেশ ভদ্রঘরের ছেলে ঢুকে পড়েছে । তারা সবাই দাঁড়িয়ে গেল । বলল, রাগ করে এসেছেন বুঝি । শিগ্গির ফিরে যান, সামনে বাঘ, ভালুক, সাপ - কত কি আছে ।
মুনিয়া বলল, রাগ করে আসিনি, একটা বিশেষ কাজেই যাচ্ছি । পাহাড়ের ওপারে তিপরাদের বাড়ি - এটাইতো পথ ।
কাঠুরেরা বলল, তিপরা-বাড়ি যাইনি কখনও ।
আর কিছুদূর এগিয়েই কাঠুরেরা যে যার কাজে লেগে গেল - ডানে বায়ে ঢুকে পড়ল তারা জঙ্গলে জঙ্গলে ।
মুনিয়া একা একা এগিয়ে যেতে লাগল ।
পাহাড়ের উঁচু নিচু যেখানে একবার শেষ হল - সেখানে একটা ছড়া - বালিপাথর নিচু জায়গা । নদীর মতো - কিন্তু নদী নয়, ঝির ঝির করে কাক চক্ষু জল বয়ে চলছে - তাতে পাহাড় চুইয়ে চুইয়ে ।
মুনিয়া সেই ফটিক জলে পা ভিজিয়ে নিয়ে উজান দিকে যেতে লাগল । পূব থেকে পশ্চিম দিকে ছড়াটা জল বয়ে চলেছে । সূর্যের অস্তরশ্মি কোন ফাঁক দিয়ে হঠাৎ একটু এসে পড়লো যেন এখানটাতে । মুনিয়া অবাক হয়ে দেখে এক পাল ছোটো হরিণ নেমেছে এসে জল খেতে । মুনিয়াকে দেখে তারাও যেন অবাক । হঠাৎ কি মনে করে দৌড় দিল সবগুলো একসঙ্গে । মুনিয়া কিছু পিছু পিছু ছুটেও আর একটি বারের জন্য তাদের একজনকেও দেখতে পেলনা ।
একটুকু পথ আর এগিয়ে যেতেই সন্ধ্যে হয়ে গেল । মুনিয়ার একটু ভাবনা হল । এমন সময় মানুষের গলার শব্দ শুনল । সামনের চড়াইটা ডিঙিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে যাবে কি পড়ে গেল একটা প্রকান্ড গহ্বরে ।
সেখানে কতগুলো হা.দগোড় ছিল, তাতে কেটে গেল পায়ের এখানে ওখানে । গায়ের চামড়াও কেটে গেল ডালপালার ঘষা লেগে ।
মুনিয়া বুঝতে পারল - এখানটাতে বাঘমশায় কোনো জীবজন্তুকে সাবাড় করে হাড়গুলো বাদ দিয়ে গেছে । অনেক হাড়গোড় দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে এটা বাঘের একটা স্থায়ী আহারের জায়গা - ডাইনিং রুম । এখন হয়তো বাঘটা কোনো শিকার সন্ধানে বেরিয়েছে ।
আঘাতে অসাড় শরীরটাকে কোনো রকমে টেনে নিয়ে মুনিয়া যখন একটু সামনের দিকে এগিয়েছে অমনি একটা পাহাড়ী কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তাকে কামড়াতে এল । মুনিয়া দেখল বিপদের উপর বিপদ । ভাগ্যিস কুকুরের মালিকও পিছু পিছু ছুটে এল । এসে আবিস্কার করে বলল, আরে বোকা বাঙালি তুই এখানে এসেছো কেনো !
মুনিয়া কিছুই বললনা । লোকটা বাংলা ভাষায় কথা বলল শুনে খুব ভালো লাগল । মনে মনে ভাবতে লাগল - এই কি সেই তিপরা ।
কিছুদূর যেতেই লোকটার বাড়ি । পাতায় ছাওয়া ছোট্টো ঘর । দপ্ দপ্ করে একটা মশাল জ্বলছে । মশাল দেখেই মুনিয়ার মনে পড়ল - বাঘের অঞ্চল ।
মশালটার কাছেই মুনিয়াকে বসতে দিল । মশালটা বেশ বড় আর জোরালো অনেক জায়গা জুড়ে আলো হয়েছে । মুনিয়া নিজের শরীরের কাটা ছেঁড়াগুলি দেখছিল । লোকটা বুঝতে পারল আর তাড়াতাড়ি দুটো পাতা হাতে থেত্লে নিয়ে ঘষে দিল মুনিয়ার আঘাতের স্থানে । মুনিয়া এই সুযোগে লোকটার চেহারাটা দেখে নিল ।
ভুরু আর গাল দুদিক থেকে চেপে ধরেছে চোখ গুলোকে - সেজন্য চোখ দুটো যেন ভালো করে মেলতে পারছেনা লোকটা । এই কি তিপরা ! এরাই তন্ত্র মন্ত্র জানে ! এ লোকটাই জানে ! মেরে ফেলবে নাকি । তাহলে বাঘের গহ্বরটা থেকে বাঁচিয়েই বা আনলো কেন !
একটা কাঠুরে মুনিয়াকে বলেদিয়েছিল, যদি বাড়ি ফিরে না যাও আর তিপরাদের কাছ অবধি গিয়ে পৌঁছাও, তাহলে রাত্রিবেলা ওদের ঘরে শোবেনা । যদি শোও তাহলে সটান হয়ে হয়ে ঘুমোবেনা । কুকুর কুন্ডলী হয়ে ঘুমোবে -তাতে তিপরার বউ এসে তোমাকে সূতো দিয়ে মাপতে পারবেনা । সূতো দিয়ে মাপ নিতে পারলে সেই সূতো লাউপাতার ভিতর ঢুকিয়ে ভাজা করে খেলেই তোমাকে খাওয়া হয়ে যাবে ।
মুনিয়া তিপরাকে বার বার দেখছে - আর এই কথাগুলি মনে পড়ছে । এখন আর যাবেই বা কোথায় । তবে দেখা যাক শোবার কথা ওরা নিজে থেকে বলে কিনা ।
মুনিয়া এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল - কোথাও গোয়ালঘর আছে কিনা দেখছিল । তিপরা বুঝতে পারল, তোমার বাছুরটাকে খুঁজছো বুঝি ।
মুনিয়া ভাবে এ লোকটা আমার বাছুরের কথা জানল কি করে !
লোকটা বলল, এ-সব আমরা জানে । থুড়া থুড়া খবর রাখে । তবে সব খবর জানে আরেকটা তিপরা ।
মুনিয়া বলল, সে কোথায় থাকে ?
ওই দিকে ।
আমাকে নিয়ে যাও ওর কাছে ।
তুমি ওর চাকর থাকবে ?
হ্যাঁ, থাকব ।
এক বচ্ছর থাকতে হবে ।
তাই থাকব ।
গরুর যত্ন করবে ?
করব ।
ঠিক আছে । কাল সকালে নিয়ে যাবো ।
তিপরার বউ চাল, ডাল, নুন, তেল, তরিতরকারী, একটা নূতন হাড়ি, একটা উনুন সব দিল মুনিয়াকে, তাকে রান্না করে খেতে হবে ।
মুনিয়া বলল, আমার ক্ষিদে নেই ।
লোকটা হাসল, মিছা কথা বলবেনা ।
মুনিয়া আর কি করে - লোকটাকে ভয় পেয়ে শেষকালে রাঁধতে লেগে গেল ।
রাত্রিবেলা মুনিয়া জেগেই ছিল । তিপরার বউ কখনও মাপ নিতে আসেনি সূতো দিয়ে । আর কেনই বা আসবে । যদি জানেই-যে মুনিয়া জেগে থাকবে তাহলে এসে তো ফল নেই । তবে শুতে দিয়েছিল বেশ ভালো ঘরে মাচার উপর ।
কোনোরকমে রাতটা শেষ হতেই পরেরদিন ভোর বেলা মুনিয়াকে নিয়ে রওনা হল বড় তিপরার বাড়ির দিকে । তিপরার ছোটো ছেলেটা মায়ের কাছে বসে মুরগী নিয়ে খেলা করছে । আর বড় ছেলেটা বাবার খুড়ুঙ্গে উঠে বসেছে । খুড়ুঙ্গে একটা দড়ি লাগানো । খুড়ুঙ্গটা পিঠে নিয়ে দড়িটা লাগিয়ে দিল নিজের কপালের উপরটাতে । তিপরার পিছু পিছু মুনিয়াও চলল ।
আরেকটা টিলা পার হতেই দেখা গেল দূর হতে প্রকান্ড এক আটচালা ঘর । নানা আকারের নানা রঙের নানা জাতের গরু শুধু । আর একটাও ঘর নেই । মুনিয়া খোঁজ নিয়ে জানল এই বড় তিপরার বয়স একশ বছর, কিন্তু কখনও ঘরে থাকেনা, ঘর তৈরীও করেনা, শুধু গরুর সেবাযত্ন করে দিন কাটিয়ে দেয় । গরুর অসুখবিসুখের সকল ওষুধও জানে । গরু হারিয়ে গেলে বলে দেয় কোথায় গিয়েছে । কিন্তু যে আসবে কিছু জানতে তাকেই এক বছর থাকতে হবে । তা না হলে ওই বুড়ো নাকি কোনো কথাই বলেনা ।
বুড়োর কাছে ছেড়ে দিয়েই তিপরা পালিয়ে এল । কোনো কথা বলেনি, পরিচয় করিয়েও দেয়নি । তিপরা-তো বলেছেই আগে - ও সবার মনের কথা জানে, কিছুই বলবার দরকার হয়না ।
মুনিয়ার দিকে শুধু একবার বুড়ো তাকালো । মুনিয়া দেখল বুড়োর সাদা চুল মাথায় লাগিয়ে ছাঁটা । ভুরু জোড়া ঝুলে পড়েছে চোখের উপর । চোখগুলো দেখাই যায়না । শরীরের রংটা লাল যেন পরিস্কার তামার রং । মুনিয়া কাজ করতে আরম্ভ করল ।
গরুগুলোর কাছেই মুনিয়া শুয়ে থাকে । কিছুই অসুবিধে হয়না । এমন জঙ্গল অথচ মশা নেই মাছি নেই - এক আশ্চর্য জাদুতে যেন তৈরি এই গোয়ালঘরটা । গরুর যা যা খাবার দিতে হয় সব হাতের কাছে আছে । কে যে কখন এ-সব দিয়ে যায় কিছুই বোঝা যায়না । শুধু গরুর সামনে ঠিক ঠিক সময়ে তুলে দিতে হয় । আর গরুর গোবর পরিস্কার করতে হয় । গরুকে রোজ স্নান করাতে হয় । সকাল থেকে রাত নটা পর্যন্ত সব সময় একটা না একটা কাজ করতে হয় । কিন্তু তাতে কোনো ক্লান্তি হয়না । মুনিয়া এক গোয়াল ভরতি গরুর সেবাযত্ন করে কিন্তু কখনও কাজ খারাপ লাগেনা ।
বুড়ো তিপরা কোনোদিন একটা কথাও বলেনা । শুধু মুনিয়ার নির্দিষ্ট খাবার সময়ে একটা বুনোলতা কেটে নিয়ে এসে ধরে মুনিয়ার মুখে - ঝির ঝির করে ক্ষীরের মতো রস ঝরতে থাকে । মুনিয়া এমন সুস্বাদু বস্তু জীবনে কখনও খায় নাই । রোজ রোজ একই জিনিস খেয়ে এক ঘেঁয়েও লাগেনা মুনিয়ার ।
যেন একটা রাত্রি পার হতেই একটা বছর শেষ হয়ে গেল । বুড়ো তিপরা এল । ইশারা করে বলল যে সময় হয়ে এল এবার তুমি বিদায় দাও । মুনিয়া তবু দাঁড়িয়ে রইল । তিপরা পাহাড়ের গায়ে তাকাতে ইঙ্গিত করল মুনিয়াকে । মুনিয়া অবাক হয়ে দেখে পাহাড়ের গাটা একটা বিরাট শ্লেটে পরিণত হয়েছে - তাতে নাগিনার বাড়ির পিছনের সেই তাল গাছ তিনটে স্পষ্ট ভাসছে । তালগাছ তিনটে মুছে যেতেই দেখে মুংলি বাছুরটা ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে ।
মুনিয়া তিপরাকে আর কোনো কথা না বলে বাড়ির দিকে রওনা দিল । বুঝতে পারল মুংলিটা ওদের বাড়ির কাছেই ঘুরে বেড়াচ্ছে । এখন গেলেই হয়ত দেখতে পাবে ।
এমন সময় ওর সামনে ঠিক সেই বিরাট স্লেটটি দাঁড়াল । তাতে লেখা খুব একটা বড় অক্ষর-না !
তবু সে এখন বাড়ির দিকেই যাবে বলে স্থির করে ছুটল ।
কিন্তু বাঘের পূজা করার আগেই দোহাই দিতে হয় গাজী সাহেবের । ফতে গাজী বাঘের পীর । গাজীর দোহাই দিলে বাঘ নাকি হাতের শিকার ছেড়ে দিয়ে পালায় । সেজন্য সকল সম্প্রদায়ের লোকই ফতে গাজীকে খুব মানে । সাহাবিবাজার স্টেশন থেকে ট্রেন ছা.দলেই ট্রেনের যাত্রীরা পশ্চিম দিকে জানালায় হাত বাড়িয়ে রাখে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখা যায় দরগা । দরগার সামনেই বাঁধান চত্বরে পয়সা ছুঁড়ে দেয় ভক্তরা ট্রেন থেকে সে পয়সা কে নেয় ভক্তরা দেখতে পায়না । ট্রেন দ্রুত চলে যায় দক্ষিনে চট্টগ্রামের চাঁদপুরের দিকে ।
ফতেগাজীর দরগার মেলা জমেছে এবার অনেক বছর পর । দূর দূরান্তর থেকে লোক আসছে মেলায় । কেউ আসে জিনিস কিনতে, কেউ আএ বিক্রি করতে । কেউ-বা শুধু ফতে গাজীকে শ্রদ্ধা জানাতেই আসে । কেউ আসে পয়সা কড়ি ফল মূল নিয়ে, কেউ আসে গরু বাছুর ভেড়া ছাগল - কোনো না কোনো জন্তু জানোয়ার নিয়ে : গাজীর নামে মানত করা ছিল, গরু বাচ্চা দিলে একটি বাচ্চা গাজীর দরগায় দিবে । হয়ত বা অসুখ বিসুখ করেছিল গরুর, গাজীর দোহাই দেওয়াতে সেরে গেল - তখন সে-গরুর একটি বাচ্চা দান করলে কি ক্ষতি ! তাছাড়া বাঘের মুখ থেকে সারা বছর গৃহস্থের পোষা জীবগুলি রক্ষা যদি পায়, তাহলে মেলার সময় একটিকে গাজীর নামে উত্সর্গ করতে কারও আপত্তি থাকেনা । এ-রকম মানত হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই করে থাকে গাজীর উদ্দেশ্যে ।
গাজী যেমন সহজ সরল তেমনি তাঁর সানটিও আড়ম্বরহীন । জাঁকজমক নেই দালান কোঠার । ছোট্ট একটুকুনি বাঁধান জায়গা । উপরে টিনের চালা । ভিতরে একটুখানি উঁচু বেদী । তাতে জ্বলছে সারবন্দী মোমবাতি । আসলে এই বেদী টুকুই সব - এটিই মূলে ছিল । চালা টালা পরে হয়েছে । বেদীর সামনে দাঁড়ালে একটি পবিত্রভাবে দেহমন স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে । মনে হয়- মৃদু মিষ্টি আলোয় গলে পড়েছে গাজীর করুনা ।
বড় শহরের অলিতে গলিতে যত রকমের দোকান থাকে তার যেন সবই এসে জুটেছে এই জঙ্গলের মাঝখানে । গাজীর করুণায় বাঘের ভয় জয় করেছে আজ সকল মানুষ ।
জঙ্গলটা যেন রাতারাতি একটা শহর হয়ে উঠেছে । সার্কাস-বায়স্কোপ বলতেই ছেলে পিলেরা অজ্ঞান । এক পয়সায় বেলুন বাঁশি কিনে মুখে লাগিয়ে ফোলায়, বাঁশি বাজায় আর সার্কাসের ঘরের দিকে ওরা ছোটে । একটা কাড়ানাকাড়া সব সময় গের্ গের্ শব্দে - এক অদ্ভুত মুখোশ পরে একটা লোক দমাদদম্ পিটোচ্ছে ডুগডুগিতে দুইহাতে আর চেঁচিয়ে মুখে চোঙ্গ লাগিয়ে বলছে -
এই-যে আসুন এক এক নানা
চলে গেলে তা-না-না-না...
কতরকমের কত ভাবের মানুষই যে মেলায় আসে । একদিকে যেমন পয়সার জন্য চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ভেঙে ফেলেছে এক শ্রেণীর লোক, তেমনি অন্যদিকে পয়সার কথা মোটে চিন্তা না করে মনের আনন্দে গান গেয়ে চলেছে বাউল দরবেশের দল । গানের পর গান চলছেই । একজনের কন্ঠ থামলে আরেকজন গাইছে । গাওয়ার আর বিরাম নেই । গান চলছে নদীর ধারার মতো । পুরুষ গাইছে, নারী গাইছে, বুড়ো গাইছে ছোটো শিশুও গাইছে । বোষ্টমী ভৈরবীরাও এসেছে গাজীর স্নানে আজ ।
রেল লাইনের ওপারে পাহাড় থেকে নেমে আসতে আসতে মুনিয়া শুনতে পেল বোষ্টমীর গানটা :
হাতে বাড়ি নন্দরানী চলছে ধেয়ে ধেয়ে
লম্ফ দিয়া ওঠে কৃষ্ণ কদম্ব ডাল বেয়ে ।
দ্রুত পায়ে লাইনটা পার হয়ে মেলায় এল মুনিয়া । সঙ্গে সঙ্গেই একটা ট্রেন হুস্ হুস্ করে বেরিয়ে গেল । মুনিয়া এসে দাঁড়াল বাউল বৈরাগীর আসরটার কাছেই । বোষ্টমী তখন গাইছে সেই গানটাই । এই গান মুনিয়া এর আগে কোথাও শুনেছে । খুবই মনে পড়ছে - ঠিক যেন এই গলায়ই শুনেছে, কিন্তু বোষ্টমীকে -তো কখনও দেখেনি ! মুনিয়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল বোষ্টমীকে - গলায় তার তুলসীর বড় বড় মালা, ন্যাড়ামাথার মাঝখানে প্রকান্ড চুলের ঝুঁটি, একতারা হাতে নিয়ে চোখ বুজে বিভোর হয়ে গাইছে কৃষ্ণের গুণ । দুই বাহুতে পদাচিহ্ন আঁকা, নাকে ও কপালে তিলক । গান গাইছে - চোখ থেকে ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে । দেখে মুনিয়ার চোখেও জল এল ।
প্রথমে এত লোক ছিলনা । কৃষ্ণের গানটা শুনে শুনে অনেকেই এসে ভিড় করেছে । একটা গাছ তলায় চাতাল মতো, সবাই বসে গেছে গান শুনতে । ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি তো আছে । একটা বানরওয়ালাও এসে বসেছে । ছোট্ট বানরটা জামাজোড়া পরে এদিক ওদিক তাকচ্ছে ঘুরছে, চোখের তারা দুটো দ্রুত নাড়ছে, আর থেকে থেকে হাত বাড়াচ্ছে ওই চোখ বোজা বোষ্টমীর সামনে রাখা কয়েকটা কলা ও কমলা লেবুর দিকে । কে যেন গান শুনে মুগ্ধ হয়ে এইসব পুরস্কার দিয়ে গেছে, বানরটার ওই দিকেই লোভ । আবার যেমনি হাত বাড়াল, অমনি বানরওয়ালা বুড়োটা গলায় জোরে ধমক দিয়ে উঠল, তবে-রে মুনিয়া ....
ধমকের চোটে বানরটা কাচুমাচু হয়ে এসে ঢুকল বুড়োর কোলের ভিতর মাথাটা নিচু করে । বুড়ো বানরকে নিয়ে উঠে চলে গেল গানের আসর থেকে ।
বোষ্টমী বানরওয়ালার মুখের মুনিয়া চীত্কারটা শুনে হঠাৎ চমকে উঠে চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু দেখল একটা বানর আর সেই বানরের মালিক একটা পাকা চুলদাড়িওয়ালা বুড়ো । আবার সে চোখ বুজে গাইতে লাগল,
গোপালরে, কবে জানি তোমার দেখা পাবো,
তোমারে খাইতে দিয়া নিজে প্রসাদ পাবো -
গোপালরে ....
মুনিয়ার ভালো লেগেছিল বুড়ো বানরওয়ালাটাকে ও । কিন্তু লোকটা উঠে চলে গেল কেন । ভেবেছিল লোকটার পিছন পিছন যায়, কিন্তু তাহলে-যে বোষ্টমীর এমন সুন্দর গানটা শুনতে পাবেনা । তবু কিছুক্ষণ উসখুস করতে করতে উঠে চলে গেল বানরওয়ালাকে খুঁজতে । কিন্তু লোকটা এমনি উধাও হয়েছে যে সারাটা মেলা ঘুরে ঘুরে হয়রাণ হয়েও আর তার দেখা পেলনা । শেষকালে বিরক্ত হয়ে যখন গান শুনতে আবার ফিরে এল - তখন দেখে যে বোষ্টমীও নেই । বাউল ফকিরদের শুধালো বোষ্টমীর খবর, কিন্তু তারা কেউই বলতে পারলনা বোষ্টমী কোন দিকে গেছে ।
লক্ষ মানুষের মেলায় একটা মানুষকে খুঁজে পাওয়া শক্ত । সে আছে, তুমিও আছো । সেও ঘুরছে, তুমিও ঘুরছো - ঘুরতে ঘুরতে যদি দেখা হয়ে যায় হবে, খুঁজে পাবেনা কিছুতেই ।
এক বুড়ো বাউলের এই কথাগুলি মনে গেঁথে মুনিয়া মেলা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল ।
এই পথটা মুনিয়ার পরিচিত । এখান দিয়ে সোজা দক্ষিনে হেঁটে গেলে মনতলা স্টেশন পাওয়া যাবে সেখানেই নিশীথবাবুর বাড়ি । এই পথ দিয়ে মেলা থেকে লোক ফিরে যাচ্ছে - আবার মেলায় আসছে, চেনাজানা কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে - আশঙ্কা করে মুনিয়া গ্রামের ভিতর দিয়ে নেমে পড়ল । মাঠ দিয়ে ওপথে কোনো লোক হাঁটেনা এমন অসময়ে ।
মুনিয়া যেখানে এসে সড়কে পড়ল - ঠিক এখানটাতেই নৌকোটা রেখে গিয়েছিল কয়েক বছর আগে, সেটা কি তার বাবা খুঁজে এসে নিতে পেরেছিল সেই সুন্দর বৈঠাটা এবার যদি বাবাকে গিয়ে বলে তাহলে আরেকটা বৈঠা আর নৌকো কি কিনে দেবেনা । এখন অবশ্য বর্ষার দিন চলে গিয়েছে ।
সড়কের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কত লোকের সঙ্গেই দেখা হল । সবাই মুনিয়ার দিকে তাকাল, কিন্তু কেউই চিনতে পারলনা । সড়ক ছেড়ে এবার বাজারে ঢুকল মুনিয়া । হ্যাঁ সেই খোঁয়ারটা এখনও আছে । গেল খোঁয়ারের কাছে । তালাবন্ধ । বেড়ার ফাঁকে চোখ দিয়ে দেখল - মুংলির মতই একটা ছোট্টো বাছুর ভিতরে হতাশ হয়ে ঘুরছে - আর থেকে থেকে ডাকছে - হেম্বে-হেম্বে ...
মনে পড়ল সেই জায়গাটার কথা - যেখানে বসে হাটের দিনে ওর বাবা জুতো মেরামত করত । ছুটতে ছুটতে গিয়ে দাঁড়াল সেইখানে । ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে চামড়ার টুকরো টাকরা ঢুকে আছে কিনা খুঁজে দেখল । না, একটিও নেই । আজকাল কি এ-সব জায়গা কেউ ঝেঁটিয়ে দেয় নাকি ওর বাবা জুতো মেরামতির কাজ ছেড়ে দিয়েছে কথাটা মনের ভিতর ঘুরতে লাগল মুনিয়ার ।
হাঁটতে হাঁটতে বাজার ছাড়িয়ে ঢুকল গ্রামের ভিতর । গ্রাম ছাড়িয়ে এল খালটার কাছে । এক দাড়িওয়ালা বুড়ো বেরিয়েছে হুঁকো হাতে । নবীহুসেনের বাবা বোধ হয় । মুনিয়া ওদিকে না গিয়ে সোজা নেমে পড়ল খালে । খালটা পার হয়ে একটু দাঁড়াল ।
সামনেই সেই হিজল গাছটা । নৌকোটা এখানেই বাঁধা থাকত । এখন-তো সব শুকনো পথ । পায়ে হেঁটে যেদিকে খুশি যাওয়া যায় ।
নিচু জমি থেকে উপরে গিয়ে উঠল মুনিয়া । তিনটে তালগাছ যেন এখন এগিয়ে এসেছে । - সে কি করে হল গাছের কি পা আছে নাকি ঘর গুলো চলে গেল কোথায় ওর বাবার কাজের ঘর নেই, শোবার ঘর নেই, রান্নাঘর নেই, গোয়ালঘরও নেই - উঠোনের চারপাশে চারটা ভিটে খাঁ খাঁ করছে । শুধু শোবার বা বসতঘরের ভিটেটা ঢাকা দিয়ে রেখেছে কালোমেঘের একটা ছোট্টো বাগান ।
ঘরের মালিকও নেই । মা নেই, বাবা নেই । পুনি মিনি ভোলা সব পালিয়ে গেছে ।
বুড়ো তিপরার কাছে দাঁড়িয়ে ঠিক এমনি ছবিটাই দেখেছিল মুনিয়া শুধু ওই তিনটি তালগাছ ছাড়া আর কিছুই ছিলনা । তখনই ওর মনটা কেমন করে উঠেছিল ।
বুড়ো-তো সহজ পাত্র নয় ! বুড়োর কাছে আবার যেতে হবে । কিন্তু মুংলির মতোই একটা বাছুরগুলো দেখা গিয়েছিল - ছুটছে ! কোথায় সে- এখানে তো দেখা যাচ্ছে না ।
এখনই চলে যাবে নাকি আবার সেখানে । বুড়ো তো একবছর থাকতে দেবেই । কিন্তু সে-যে আবার মনের কথা জানে !
কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে রইল মুনিয়া । চোখ মেলে তাকাল আবার । বিদায়ী সূর্য্যের লাল আলোতে কালোমেঘের বাগানটা চক্চক্ করছে ।
সন্ধ্যে হয়ে এল । কালো অন্ধকার এসে কালোমেঘের বাগানটাও ঢেকে দিল । মাটির কাছাকাছি সবই এখন এক রং কালো -কালো-কালো ।
কেউ নেই কাছে পিঠে । যেন একটা নির্জন দ্বীপ সমুদ্রের মাঝখানে । মাঝে মাঝে কালো ঢাকনাটা নড়ে উঠেছে তালগাছের ডগার নড়াচড়িতে । শকুনের চিঁহি চিঁহি শব্দে কেঁপে কেঁপে উঠেছে স্তব্ধ অন্ধকার ।
সারাটা রাত এমনি বসে বসে কাটাবে কেমন করে । মুনিয়া একটা কাজ খুঁজতে লাগল ।
কালমেঘের গাছগুলো ওর মা বড় আদর করে লাগিয়েছিল । গোড়া খুঁড়ে দিলে নিশ্চয় ভালো হবে আর ফুল ধরবে ওতে ।
একটা জংধরা বটির লেজ পেয়ে গেল খোঁজাখুঁজি করে । এটাই খুড়িপর মতো চালাতে লাগলো কালমেঘের বাগানের । কাজ করতে করতে মুনিয়ার মনে হল, এগুলো-তো ছিল রান্নাঘরের পিছনে -এতদূরে এল কেমন করে !
গাছের গোড়া খুঁড়ে খুঁড়ে যখন ভিটের মাঝখানে এল তখন খুড়পিটা কর কর লাগছিল মাটির নিচে একটা শক্ত জিনিসে । মুনিয়া খানিকটা মাটি সরিয়ে দিয়ে হাতে বুঝতে পারল একটা পোড়ামাটির বড় সরার মতো ঢাকনা যেন । সাবধানে খুঁড়ে ওটা তুলল । হাত ঠেকিয়ে দেখে নিল একটা বড় গামলা বানানো । এবার তার মধ্যে থেকে একটি একটি করে সব জিনিস পত্র তুলল ।
টাকা নয় পয়সা নয়, ওর বাবার জুতো সেলাই করার লোহার যন্ত্রপাতি । হাতুড়ি, বাটালি, সাঁড়াশি, নেহাই - এমনি আরও কত খুঁটিনাটি । সবগুলির নামও জানেনা মুনিয়া । বাইরে থেকে জল ঢোকেনি, মাটি লেগে মরচে ধরেনি । জুতো সেলাই-এর ছুঁচগুলোও রয়েছে, কাঠের হাতল এতটুকু নষ্ট হয়নি ।
এবার আবার ভালো করে গামলার নীচটা হাতড়ে হাতড়ে দেখল । আর কিছু নেই । একটা ছোট্টো মাটির ঘটি ছাড়া অন্য জিনিস পেলনা আর । ঘটিটা বের করল । ঘটির মুখে একটা ন্যাকড়া ঠাসা ছিপি । ছিপিটা খুলল । ঘটিটা অন্ধকারেই বা হাতের তেলোয় উপুড় করল । চক্চক্ করছে মিটিমিটি তারার আলোয় দুটো ছোটো পাথর । মনিমানিক্য নয়, মুনিয়ার মায়ের কানের অলঙ্কার ।
একটা ছোট্টো কাগজের মোড়কও ছিল ঐ সঙ্গে । মুনিয়া সাবধানে খুলে দেখল । পরিষ্কার দেখা না গেলেও বুঝতে পারল এটা মধুর মোম, জুতো সেলাই এর সুতো তৈরী করতে হয় এ দিয়ে ।
ন্যাকড়ার ছিপিটা ফেলে দিলনা মুনিয়া । জড়ানো ন্যাকড়াটা ধীরে ধীরে খুলে নিয়ে শেষে পেলো তাতে কিছুটা সুতো । দুহাতে টেনে দেখল বেশ শক্তই আছে ।
এবার বুঝল কালমেঘের বাগানটা ভিটের উপর কেন । এ নিশ্চয় ওর মায়ের কাজ । পাছে অন্য লোক ভিটে খুঁড়ে চুরি করে নেয় সেজন্য মা কালমেঘ দিয়ে ঢাকা দিয়েছিল তার পতিপুত্রের সম্পত্তি । ভেবেছে, যদি ওরা কখনও ফিরে আসে, আর এই ভিটেয় ঘর বাঁধে, তাহলেই পাবে সমস্ত ।
মুনিয়ার মনে হল -যদি মা তার মতো সামান্য লেখাপড়াও জানতো, তাহলে নিশ্চয় একটা চিঠিও রেখে যেতো ।
মায়ের কানের ফুল দুটো হাতে নিয়ে মুনিয়ার দুচোখ ভরে এল জলে । তার মনে হল খেতে না পেয়ে মা হয়ত শুকিয়ে শুকিয়ে মরছে, তবু ছেলের জন্য এই জিনিস রেখে গেছে -শত অভাবে দু:খেও বিক্রি করেনি ! দুপুর রাত্তির পর্যন্ত মায়ের স্নেহের কথা মনে করে করে বুক ভাসিয়ে কাঁদল মুনিয়া ।
এবার উঠে দাঁড়াল । বাড়ির চারদিক থেকে ডালপালা কেটেকুটে নিয়ে এল । তালগাছের তলায় পড়েছিল কয়েকটা শুকনো পাতা । এই সবদিয়ে মাথা গোঁজবার মতো একটা কুঁড়ে তৈরি করল মুনিয়া ।
কাজ করতে করতেই ভোর হয়ে গেল । গায়ের জামাটা দিয়ে জড়িয়ে বেঁধে নিল জুতো সেলাই-র যন্ত্রপাতি । নাগিনা মুচির মতোই বোঁচকা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মুনিয়া । এখন শীতের দিন । বাড়ি বাড়ি ঘুরলে নিশ্চয় কাজ পাওয়া যাবে । মায়ের কানের অলঙ্কার গুলি কিছুতেই সে বিক্রি করবেনা ।
মুনিয়ার অনভ্যস্ত যত্নে কালমেঘের বাগানটা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে কাল রাত্রিতে । কোনো গাছের পাতা ছিঁড়ছে, কোনোটার ডাল ভেঙেছে, কোনো কোনোটা সমূলে উত্পাটিত হয়ে পড়ে আছে বাগানের বাইরে আগাছার দলে । এ অবস্থায় দুদিন থাকলেই বেচারী শুকিয়ে খড় হয়ে যাবে সে কথা সে জানে, তবু তার মুখে ফুটেছে এক ফোঁটা হাসি, ছোট্টো তারার মতো একটি ছোট্টো ফুল ।
শীতের কুয়াসা ভেদ করে সকালবেলার সূর্য্য এসে সেই ছিন্নমূল কালমেঘের ফুলটিকে অভিনন্দিত করেছে ।
নিজের গ্রাম পার হয়ে মুনিয়া ছুটছে গ্রামান্তরের দিকে । একটু দূরে না গেলে বেলা হবেনা, বেলা না হলে এই শীতের দিনে ঘুম থেকে উঠেই জুতো সারতে দেবে কে ?
মাঠের মাঝে একটা পুকুর পারে একটু বসল মুনিয়া । ঘাটে একটা ভালো পাথরের টুকরো । এটাতে দাঁড়িয়ে, বসে লোকে মুখ হাত ধোয় । মুনিয়া ওই পাথরটাতে বাটালিটা বেশ করে ধার দিয়ে নিয়ে আবার এগিয়ে চলল ।
[শেষ]