যাকগে । ওসব ভেবে লাভ নেই । যা হবার হবে । ভুলে যদি যাই গেলামই বা । কি আসে যায়, তাতে । বিদেশে তো যাচ্ছি না, যাচ্ছি নিজেরই দেশে । নিজেরই দেশ ! শব্দটা বিজুলীর মতো চমকায় মনে । নর্তকীর নুপূর হয়ে বাজে । বাদলারাতের বর্ষার মতো টিনের চালেতে ছন্দ তোলে । দেশ ! অথচ মন জানে এদেশ সেদেশ নয়, যে-দেশকে আমি ছেড়ে এসেছিলাম বিয়াল্লিশ বছর আগে । তখনো দেশে আগুন লাগেনি । দস্যুরা আসেনি লুঠ করে নিতে সবকিছু । তখন আমার বাহুপাশে আবদ্ধা ছিল এক মেঘরঙা নবোঢ়া নারী -- আমার জীবনসঙ্গিনী । আজকে আমি দেশের কাছে ফিরে যাচ্ছি, নি:স্ব, একাকী, ওকে ফেলে যাচ্ছি ছায়াঘন এক দেবদারুর নিচে । সারাজীবন দুরারোগ্য বৃক্করোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত পরাস্ত বন্ধু আমার শুয়ে পড়েছে ক্যানাডার মাটিতে । ঢাকার বন্দরে এবার আমাকে দাঁড়াতে হবে একান্ত একা, নির্বান্ধব । জানি না দেশমাতা জানতে চাইবে কিনা আমার সাথে সে নেই কেন ।
সে নেই, তাই বুঝি সে এমন করে খেলা করে আমার সঙ্গে, এমন নিষ্ঠুরভাবে । যেখানে সেখানে যখন তখন উদয় হয় চেতনায়, স্মরণে । বেঁচে থাকতে সে এত চপল ছিল না, এখন যত হয়েছে । সে নেই বলে আজকে সে সবখানে । দেশও তো অনেকটা তাই । হারিয়েছি বলেই বারবার খুঁজি তাকে, বারবার যেতে চাই তার কাছে । যতই হচ্ছে সে হতশ্রী আর দীনদরিদ্র ততই প্রবলভাবে সে টানছে আমাকে । দেশের দৈন্য আমার নিজের দৈন্যকে করেছে প্রখর ।
আমি জানি না, আমরা কেউ জানতে পারি না, প্রবাসের অর্জিত সম্পদের মধ্যেই একটু একটু করে জমা হতে থাকে কিনা প্রাণের দৈন্য । আজকে দুয়ারে দাঁড়িয়ে মন আমার তাই উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে আকাশপথে দেশের কাছে যাওয়ার জন্যে, পা'দুটি যেন ততই গুটিয়ে পড়তে চায় নিজের ভেতরে । আযানের কর্কশ ধ্বনির মতো বাজতে থাকে সাবধানবাণী : দেশে গিয়ে আজেবাজে কিছু খাবেন না, দরজা-জানালা বন্ধ করে শোবেন, না ফুটিয়ে জলস্পর্শ করবেন না, কথা বলবেন খুব সতর্কতার সাথে, দেশে দেয়ালেরও কান আছে । বন্ধুবান্ধব উদ্বেগ প্রকাশ করে : দিনকাল ভাল নয় । এসময় যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে ? হিতৈষী পাঠকরা ফোন করে বলে : আপনার জন্যে দোয়া করব আমরা । ডাক্তার উপদেশ দেয় : ওষুধপত্র সব সঙ্গে নিও । হ্যাঁ, সঙ্গে নিয়েছি বই কি । পুরো একটা সুটকেসই তো আমার ওষুধে ভর্তি । হার্টের দুটো ওষুধ, একটা সকালে একটা বিকেলে । কলেস্টরেলের জন্যে দুটো: একটা দিনের বেলা, একটা রাতে শোবার আগে । প্রেশারের জন্যে দুরকম ওষুধ: একটাতে প্রেশার কমে, আরেকটায় শরীরের জল কমে । পেটের ওষুধ একটা । কি একটা ব্যাধি দাঁড়িয়েছে, একরকমের বৈকল্য অবশ্যই, যার কারণে টম্যাটো খেতে পারি না, বেশি মশলার রান্না খেতে পারি না (দুটোই আমার প্রিয়) । আরেকটা ওষুধ খেতে হয় গোদ নিবারণের জন্যে । কি অসম্ভব বাজে নামের রোগ একটা । কি কারণে যেন দেশে গেলেই পায়ের আঙুল ফুলে ঢাউস হয়ে যেত, আর ব্যথায় টনটন করত । ওটা রোধ করার জন্যেই ওষুধটা কেহেত হচ্ছে রোজ । এরকম আরো তিনটে ওষুধ আছে, নামগুলো থাক । শটগুলো অবশ্য নিতেই হয়--ফ্লু আর নিমোনিয়া -- এ-বয়সের সাক্ষাৎ যম । ম্যালেরিয়ার কথাটা ভুলে যাবেন না কিন্তু । দেশে এখন মশার রাজত্ব । রাতের বেলা নাহয় মশারীর নিচে আশ্রয় নিলেন, দিনের বেলা ? মশাদের কাছে আজকাল দিনরাত সব সমান । তবে কি জানেন ম্যালেরিয়ার ট্যাবলেট খেয়েও আপনি নিরাপদ নন । ডেঙুজ্বরের কথা শুনেছেন ? ডেঙু কিন্তু ট্যাবলেটকে কেয়ার করে না । সুতরাং সাবধান । সুটকেস গুছিয়ে আমি হাসবার চেষ্টা করি । এর নাম কি দেশে যাওয়া না বনবাসের প্রস্তুতি নেওয়া ?
সক লোকে জানতে চায় কদ্দিন থাকব দেশে । বলি, দেড় মাসের মতো । তাই নাকি ? বইমেলা পর্যন্ত থাকবেন না তাহলে । না, থাকছি না । বইমেলাতে থাকবার বিশেষ কোনো কারণ নেই আমার । নতুন কোনো বই বেরুচ্ছে না আমার । কলকাতা বা ঢাকা, কোনো বইমেলাই আমাকে তেমন আকৃষ্ট করে না । দুবছর আগে ঢাকার বইমেলাতে যাবার সুযোগ হয়েছিল । ওখানে বইয়ের চেয়ে ধূলাই দেখলাম বেশি । আর দেখলাম ভিড়, তরুণতরুণীদের । বড় বড় লেখকরা পান চিবোতে চিবোতে তাঁদের সদ্যপ্রকাশিত বইয়ের দোকানে দর্শন দিতে যান প্রতি সন্ধ্যায়, স্তাবকের দল লাইন করে দাঁড়ায় তাঁদের অটোগ্রাফের আশায় । বেতারে, দূরদর্শনীতে তাঁরা সুদূরপ্রসারী বিবৃতি দেন, পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখেন -- সে-দৃশ্য অবলোক করে নয়ন জুড়াবার বয়স আমার চলে গেছে । ফেব্রুয়ারির বইমেলাটি প্রবাসী লেখকদের জন্যে অনেকটা তীর্থস্থানের আকার ধারণ করেছে । কাশী বেনারস, বুদ্ধগয়া বা মক্কায় যাওয়ার মতো । প্রবাসী বাংলাদেশী সমাজে আজকাল লেখালেখি করে না এমন লোক পাওয়া দুষ্কর । বিশেষ করে যারা কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়েছে -- যেমন আমি । মাঝে মাঝে ভাবি, আর কোনো কাজের যোগ্য নই বলেই কি আমি কলম ধরেছি ? ক্যানাডা-আমেরিকার স্থানীয় লোকেরা যখন অবসর নেয় তখন চট করে লেখক হয়ে যায় না আমাদের মতো । তারা ছবি আঁকতে শুরু করে, কাঠের আসবাব তৈরি করে, কেউ বা মাটির জিনিসপত্র বানায়, স্বেচ্ছাসেবক হয় পাড়ার গীর্জায়, হাসপাতালে বা বৃদ্ধসদনে, কেউ বা ক্লাবে যোগ দেয় -- ব্রিজ, দাবা কার্লিং, বোলিং, বিঙ্গো । সামর্থ্য থাকলে অনেকে দূর দূর দেশে ভ্রমণ করতে যায় । কেবল আমরাই হয় দিনরাত মন্দিরে-মসজিদে পড়ে থাকি নয়ত স্মৃতিচারণ করে বা ছড়া পদ্য আর গল্প লিখে খাতা ভরি । বছরের শেষে খামের ভেতরে সেগুলোর সাথে হাজারখানেক ডলার পুরে পাঠিয়ে দিই দেশের কোনো ডলারকাতর প্রকাশকের কাছে । তারপর আরো হাজারতিনেক খরচ করে আমরা দেশে যাই । আমাদের কচমচে ডলারপ্রাপ্ত প্রকাশকগণ গলায় মালা পরিয়ে নিয়ে যায় বইমেলার প্রাঙ্গনে, আমরা অটোগ্রাফ দিই পুলকিত চিত্তে, সেই অটোগ্রাফের স্মৃতি জমা করে রাখি পরবর্তী প্রকাশের জন্যে । প্রকাশক নিজের চেনাজানা (এবং প্রায়শ:ই ভাড়াকরা) গ্রন্থ-পর্যালোচক দিয়ে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় আমাদের প্রণীত পুস্তকাদির উচ্ছসিত প্রশংসা ছাপানোর ব্যবস্থা করে দেয় । আমরা প্রকাশনা উত্সবের প্রধান তারকা হয়ে নীহারিকার স্বাভাবিক উজ্জ্বলতাকে লজ্জিত করে তুলি । ভাগ্যিস একুশেটা হয়েছিল শীতঋতুতে । জুন-জুলাইতে হলে প্রবীণ প্রবাসীর গায়ে সইত কিনা সন্দেহ । কে জানে, বইমেলাতে তারকা হবার আকর্ষণ কি দমে যেত তাহলে ? মনে হয় না । না ভাই, আমার সে-আকর্ষণ নেই । যোগ্যতাও নেই । এই মরদেহটি সত্কার করবার ব্যবস্থা হয়ে গেছে আমার স্ত্রীর পাশে, তার বেশি চাহিদা আমার নেই ।
দেশে যাওয়ার সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা হল উপহার । কার জন্যে কি কিনব সে-ভাবনাতে মাথা খারাপ হয়ে যায় । গিন্নী থাকাকালে ঐ ঝামেলাটি আমার ছিল না । ও সারাবছর ধরে দোকানে দোকানে ঘুরে নানাবিধ ফ্লায়ার, কুপন আর সেল ব্যবহার করে শ'পাঁচেকের মধ্যে বাজার সেরে ফেলত । মেয়েরা যে কেমন করে পারে এসব । ওকে নিয়ে এ-দোকান ও-দোকান করতেই আমার গা ব্যথা করত । এখন তো সে নেই, সুতরাং গা-ব্যথা মাথাব্যথা সবই আমার । আমার প্রথম সমস্যা হল উপহারযোগ্য আত্মীয়ের সংখ্যা কত ঠিক জানা নেই । জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে তাতে তো সকালের সংখ্যাটিই বিকেলে টেকে না । দেশ ছাড়ার আগে আমার নিজের পরিবারে লোকসংখ্যা ছিল গোটা বিশেক, এখন সেটা তিনগুণ বেড়েছে । শ্বশুরালয়ের কথা না'ই বা বললাম । পুরো একটা মফস্বল শহর ভরে যাবে তাদের দিয়ে । এদের সবার জন্যে নিতে হলে আমার পেনশানের টাকা সব ফুরিয়ে যাবে । অথচ একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজনের জন্যে নেবার উপায় নেই -- রায়ট লেগে যাবে । আমার এক বন্ধু আছে যে কারো জন্যে কিছু নেয় না । এতে কারো মন জয় করা সম্ভব নয়, তবে উপহার নিয়েও মন পাওয়া যায় না সবসময় । আজকাল দেশের মানুষের নাক অনেক উঁচুতে । সেলে-কেনা সস্তা জিনিসে ওদের মন তুষবে না । সামনে বলবে: বাহ্ কি সুন্দর । আড়ালে বলবে: আচ্ছা ছোটোলোক, একটা ন্যাকড়া নিয়ে এসেছে ক্যানাডা থেকে । তার চেয়ে বরং বন্ধুর নীতিই ভালো । খরচ কম, ওজন কম, ঝামেলা কম -- দুর্নাম তো এমনিতেও হবে ওমনিতেও হবে ।
দেশ থেকে এক অভিজ্ঞ আত্মীয় উপদেশ দিয়েছিলেন, টিকিট কেনার সময় যেন এমন ব্যবস্থা করি যাতে ঢাকার বিমানবন্দরে পৌঁছানোর দিনটা হয় শুক্রবার । মুসলমান পঞ্জিকাতে এ-দিনটিই সবচেয়ে পুণ্যের দিন সেটা জানি, কিন্তু আত্মীয়টি আমার পুণ্য নিয়ে অতটা উদ্বিগ্ন হবার মানুষ নন । জিজ্ঞেস করলাম, রহস্যটা কি বলুন তো । রহস্য কিছুই নয়, বললেন তিনি, শুক্রবার হল জুম্মার দিন, ছুটির দিন । ওদিন কোনো হরতালের ভয় নেই । ও তাই বলুন । ভুলেই গিয়েছিলাম যে নভেম্বরের পনেরো তারিখ থেকে হরতালের ঋতু শুরু হবে । হরতাল জিনিসটা এখন আর প্রতিবাদের বিষয় নয় কোনও, এটা বাংলাদেশের সপ্তম ঋতু, মানুষ এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে । সরকার আসে, সরকার যায়, থেকে যায় শুধু হরতাল । অনেক সময় মানুষ জানেও না কেন হরতাল হচ্ছে । বলবেন, পনেরো তারিখে কেন । এজন্যে যে চৌদ্দ হচ্ছে ঈদের দিন । তার আগের একমাস মুসলমানদের রমজান । রোজার মাসে সন্ত্রাসীরাও একটু সংযত থাকে । শত হলেও ওরাও তো ধর্ম করে । বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের প্রধান কর্মকাণ্ড হল ধর্ম -- অবধ্য ধর্ম বলতে ওখানে সাধারণত একটা ধর্মকেই বোঝায় । ধর্মের সময় গোপনে যত অধর্মই করুন না কেন প্রকাশ্যে করা যাবে না । রোজার দিন রাস্তাঘাটে একটা সিগারেট ফোঁকা বা লজেন্স চোষা অবস্থায় আপনাকে দেখতে পেলে ধর্মের পাণ্ডারা আপনাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে, আপনি যে'ই হোন । সুতরাং হরতাল জিনিসটা রোজার সময় কেউ বরদাস্ত করবে না । বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায়, হরতালের উত্কৃষ্ট মরসুম হচ্ছে দুই ঈদের মাঝখানকার দুটি মাস । বস্তি থেকেØ ভাড়া-করা মার্তানরা সব বেরিয়ে আসে রাস্তায় । অধিকাংশ সময় হয়ত তারাও জানে না হরতালের কারণ । তাদের জন্যে হরতাল হল একটা রোজগারের পথ -- অর্থাৎ হরতালের দিন জীবাকর্জনের অধিকার শুধু ওদেরই, অন্য কারো নয় । ওদের সামনে গাড়ি নিয়ে কাজে যাবার চেষ্টা করুন, বুঝবেন কত ধানে কত চাল । আপনার গাড়ি যাবে, মাল যাবে, ড্রাইভার জখম হবে, আপনি নিজেও প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলে ভাববেন হাজার ভাগ্য । হরতালের দিন ঢাকায় শুধু সশস্ত্র পুলিশের গাড়ি চলে । ডাক্তারদের গাড়ি আগে নিরাপদ ছিল, এখন আর নয় । কারণ ওরা তের পেয়ে গেছে যে ডাক্তারী ছাপ থাকলেই গাড়িটা ডাক্তারী গাড়ি না'ও হতে পারে । বাংলাদেশের আরো অনেক কিছুর মতো ছাপ কেবলি ছাপ । শুনেছি বিদেশ থেকে যারা বিমানবন্দরে গিয়ে পৌঁছায় হরতাল চলাকালে তাদের যানবাহনের অন্যতম পন্থা হল অ্যাম্বুলেন্সের ভ্যান । সিঙা বাজালেই বোঝায় এমার্জেন্সি । তখন আর ঝামেলা হয় না । অর্থাৎ আজকাল ঢাকায় অ্যাম্বুলেন্সের ভেঁপু বাজলেই ধরে নেওয়া যাবে না যে ভেতরে কোনও গুরুতর অসুস্থ বা আহত রোগী আছে, গুরুতরভাবে আটকে পড়া প্রবাসীও হতে পারে ।
দু:খের বিষয় যে শুক্রবার ঢাকা পৌঁচানোর ব্যবস্থা করা গেল না । ছ'মাস আগে রিজার্ভেশন করেও মনের মতো দিনতারিখ পাওয়া শক্ত আজকাল । দেশ থেকে যে হারে লোক আসছে বাইরে সেই একই হারে তো প্রবাসের লোক দেশে যাচ্ছে বেড়াতে । এমন অবস্থা দাঁড়িয়ে যাবে অচিরেই যে একবছর আগে টিকেট কিনে রাখতে হবে । আমি পৌঁছব মঙ্গলবার । কোনো কোনো পঞ্জিকা অনুযায়ী মঙ্গলবারটা ঠিক মঙ্গলসূচক দিন নয় । আমার এক পিএইচডি ডিগ্রী করা অত্মীয় ছিলেন যার জন্যে মঙ্গল আর শনিবার ছিল অশুভ দিন -- ওই দিনগুলোতে যে-কোনোঅরকম যাত্রাই নিষিদ্ধ ছিল তাঁর পরিবারের জন্যে । সৌভাগ্যবশত আমার কোনও মঙ্গল বা শনিবাতিক নেই, তবে হরতালের ঋতুতে শুক্রবার ব্যতিরেকে বাংলাদেশের সব দিনই শনিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা রাখে । তবু যাচ্ছি । দুই আঙুল জোড়া লাগিয়ে । ঈশ্বরের নাম করে । পাঠকরা যেন দোয়া করেন আমার জন্যে । শেষপর্যন্ত যদি অ্যাম্বুলেন্সে উঠতেই হয় বোনের বাড়িতে যেতে, আশীর্বাদ করুন যেন মাস্তানরা গাড়ি থামিয়ে তদন্ত করার চেষ্টা না করে ।
দেশের অবস্থা ভাল নয় । দেশ রসাতলে যাচ্ছে । কথাটা নতুন নয় । ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি । পাকিস্তান হবার পর বাপকাকারা বলতেন, ব্রিটিশ আমলই ভালো ছিল । বাংলাদেশ হবার পর কাকাদের ছেলেমেয়েদের মুখে শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তানই ভালো ছিল । প্রত্যেক যুগেরই একটা কষ্টকর বর্তমান থাকে, আর থাকে ঘন কুয়াশার মতো একটা স্মৃতি । স্মৃতি আর আজকের বাস্তব কোনোটাই পুরোপুরি সত্য নয়, সত্য কেবল আজীবন কষ্টটা । কদাচিৎ কোনো সুখের ঝলক হয়ত বা--একটা ছেলে পরীক্ষায় ভালো করেছে, ক্ষেতে ফসল ভালো হয়েছে, মেয়ের জন্যে একটা বিদেশী বর পাওয়া গেছে, এমনই দু-চারটে বিরল ঘটনা । তারপর অন্ধকারে ফিরে যাওয়া । এই নিয়ে বেঁচে আছে দেশের মানুষ--দেশের অগণিত মানুষ । আমার বাপদাদাদের সময় এই জিনিসটি ছিল না --অগণিত মানুষ । আগে মানুষের বসবার জায়গা ছিল, এখন দাঁড়াবারও জায়গা নেই । তাই হিংসা বেংএংএড়ছে দ্বন্দ্ব বেড়েছে । সাথে সাথে বেড়েছে দু:খ, কষ্ট । তবু মানুষ বেঁচে আছে, বেঁচে তাকে থাকতে হয়--দু:সময় আর সুসময় উভয়কালেই তারা দেশের মানুষ । আমরা প্রবাসীরা তা নই । আমরা দু:সময়ের যাত্রী নই । আমরা সুসময় খুঁজি । এপ্রিল-মে-তে যাই না ঝড়তুফান হয় বলে । জুনজুলাইতে যাই না প্রচণ্ড গরমে বাচ্চাদের অসুখ করবে বলে । আগস্ট-সেপ্টেম্বরে যাই না বন্যার ভয়ে । আমরা যাই যখন মেঘ গর্জায় না, সূর্য তাতায় না, বর্ষার জলে ডোবে না গাড়ির চাকা । আমরা সুসময়ের দেশপ্রেমিক । দেশে যাবার আগে বিদেশী পাসপোর্টটা ভালো করে গুঁজে নিই পকেটে, ডলারভর্তি ওয়ালেটটা ঢোকাই ভেতরের পকেটে যাতে কোনো তস্করের খপ্পরে পড়তে না হয় । স্বাস্থ্যবীমা, জীবনবীমা, ভ্রমণবীমা প্রভৃতি নানাবিধ বীমাবর্মে সুসজ্জিত হয়েই শুরু হয় আমাদের শুভযাত্রা । দেশে যাবার পর সামান্যতম বিপদের গন্ধ পেলে আমরা নাগরিকত্বের দাবিতে বিদেশী দূতাবাসের শরণাপন্ন হই । আমরা দেশকে ভালোবাসি বটে, তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে, কষ্টটাকে বাদ দিয়ে, দিনের গ্লানি আর রাতের দু:স্বপ্নটাকে বাদ দিয়ে । আমার দেশপ্রেম নিয়ে আমার নিজের কোনো বড়াই নেই । দেশপ্রেম শব্দটা ব্যবহার করতে লজ্জা লাগে আমার, বিশেষ করে রিক্সাওয়ালার সামনে, রাস্তার দিনমজুরের সামনে, গ্রামের নিরক্ষর চাষীর সামনে । আমি দেশে যাই নিজেরই প্রয়োজনে, দেশের প্রয়োজনে নয় । আমি যাই নিজের চেতনার ভেতরে পুনর্জীবিত হবার আশায় । গাড়িচালকের অনুজ্ঞাপত্র নবায়ন করার মতো আমার দেশজ চিত্তকে নবায়িত হতে হয় ।
আমার দেশ যাওয়ার ইতিহাস শুরু হয়েছিল প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে -- ছাত্রাবস্থায় । সেবারের যাওয়াটিই ছিল সত্যিকারের দেশে যাওয়া । তখন গিয়েছিলাম দেশকে দেবার জন্যে, যখন আমার দেবার মতো বিশেষ কিছু ছিল না, ছোটখাট একটা বিলিতী ডিগ্রী ছাড়া । তখনকার যাওয়া ছিল দেশের কাছে যাওয়া, দেশের মাটিতে নতজানু হতে যাওয়া, ভক্তির অর্ঘ্য সেজে নিজেকে অর্পণ করতে যাওয়া । দেশের সুখদু:খ অভাবকষত সবকিছুকেই বরণ করেছিলাম অবনতশিরে । আজকের আমি সেই পূজারী আমি নই । এখন আমি দেশের কাছে যাই না, দেশে বেড়াতে যাই । নিজের দেশেই আমি এক বিদেশী পর্যটক । এটুকু তফাৎ শুধু যে ওখানে আমার অত্মীয়স্বজন আছে । ছুটির জন্যে আমি ফ্লোরিডাতে যেতে পারতাম বা পারতাম গ্য্রাণ্ড ক্যানিয়ন দেখতে যেতে ।তার বদলে আমি দেশে যাই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেতে, বাচ্চাদের জন্মদিন আর বিয়েবাড়ির পোলাওকালিয়া খেতে । প্রথমবার যখন গিয়েছিলাম তখন আমাদের পরিবারের কারো গাড়ি ছিল না, এখন গাড়িছাড়া আত্মীয় ঢাকা শহরে বলতে গেলে একটিও নেই ।সেকালে ঢাকাশহরে হাতে-গোণা গুটিকয় পরিবারের গাড়ি ছিল -- কয়েকটির লাইসেন্স নাম্বার আমি মুখস্থ করে ফেলেছিলাম । তখন আমাদের প্রধান যানবাহন ছিল ঈশ্বরদত্ত দুখানি পা । পথ ছিল দিগন্ত বিস্তৃত । সেকালে ঢাকার রাস্তাঘাট ছিল পদচারীর স্বর্গ । এমনকি অলিগলিতেও আকাশ ছিল, পাখিদের কিচিরমিচির ছিল । আমরা, বন্ধুরা, হাঁটতাম, নি:শব্দে নির্দ্বিধায় হাঁটতাম আর গল্প করতাম । গল্প করতে করতে বুড়িগঙ্গায় সূর্য ডুবে যেত, নীল কুয়াশার বেড়িতে ছেয়ে যেত ওপারের গ্রাম । আজকে সেখানে অসংখ্য শকুনের বাসা, তাদেরই পাখাতে ঢেকে গেছে আকাশ, সূর্য । ঢাকার রাস্তায় আজকে গাড়িতেমানুষে জীবেযন্ত্রে অবিরাম যুদ্ধ । দেশে গিয়ে গাড়ি ছাড়া কোথাও বেরুই না আমি । গাড়ি ছাড়া কেউ বেরুতে দেয় না আমাকে । গাড়ি ছাড়া নিরাপদ নয় । গাড়ি না হলে গাড়িতেই চাপা পড়তে পারি, কিম্বা ট্রাকের নিচে, বাসের নিচে, ট্যাক্সির নিচে, বা একেবারে অগণিত জনতারই পায়ের নিচে ।
তবু আমি যাই, আমাকে যেতে হয় । নবায়িত হতে হয় । এখনো মাটি আছে । এখনো দেশ আছে । বিমানবন্দরে নামার পথে দুপাশের আমগাছ আর কলাগাছ একনো চোখ ভিজিয়ে দেয় ।
(পরবাস, ডিসেম্বর, ২০০৪)