সুপিনের বুক মাড়িয়ে আমরা পূর্বমুখী হয়ে চলি । জলের স্রোত নেই । অজস্র নুড়িনাড়া, বোল্ডার, বালিতে ভর্তি । গাঁয়ের মানুষজনের চলাফেরায় সরু মতো এক পথের রেখাও তৈরি হয়েছে এপারে পাহাড়ের কোল পর্যন্ত । বাঁ-ধারে সুপিনের পাহাড় থেকে নীচে নামার ভঙ্গি দুচোখ এড়ায় না । পাহাড় আর পাথরের রুদ্ধকারা ভেঙে যেন পালিয়ে এসেছে দুরন্ত মেয়েটি । "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ" কবিতার যেন হুবহু মিল । "আমি ভাঙিব পাষাণকারা/.../ হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি ।"
নদীর চর শেষ হল । খাদ থেকে খাড়াই পাহাড় উঠে গেছে মাথার ওপর । ঘন সবুজ পাহাড় । পায়েচলা পথ সাপের মতো পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠে গেছে গভীর নিটোল জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে । কুলিরাই প্রথম উঠতে শুরু করে । সারিবদ্ধ দল । যাত্রীসংখ্যা বড় কম নয় । বিশ জনের দল । গাঁয়ের মানুষজন অবাক হয় । গোল গোল চোখে চেয়ে দেখে ছোটরা । ভাবে, কারা এরা, কেন এসেছে, কীসের জন্যে ?
জঙ্গলের পথ । ঝোপঝাড় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে রাস্তার ওপর । হাত দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে ওপরে উঠতে হচ্ছে । গত রাতের বৃষ্টিতে পথের মাটি বেশ ভিজে ভিজে । চলতে অসুবিধা হয় । গাছপালার আগা ধরে ধরে ওপরে উঠি । মাঝে মাঝে পথ বেশ অন্ধকার গাছ-গাছালিতে । সূর্যের আলো ঢোকে না । আবার কোথাও পড়ন্ত রোদের টুকরো ঝিলমিল করে পথের ওপর । কত যে ওপরে উঠে এসেছি জানি না । একসময় মনে হল পথ বোধ হয় শেষ হয়েছে ।
পথ সত্যিই শেষ হয়েছিল সুন্দর সমতল মতো এক উপত্যকা-ভূমিতে এসে । ওপরে উঠে মাটিতে পা রাখতে চোখ জুড়িয়ে গেল । এ যেন সবুজের এক নন্দনকানন ! সারা জায়গা জুড়ে কোমল সবুজ গুল্মের আস্তরণ । তার ওপর নানা বর্ণালীর ফুল । মনে হচ্ছিল রেশমি সূতোয় ফুলতোলা একখানা সবুজ চাদর পাতা । মাঝেমধ্যে বিশাল বিশাল প্রাচীন পাইন, দেওদার, ওক গাছের জটলা । ঘনছায়ার সর পড়েছে সারা উপত্যকার বুকে । লেয়ারি গ্রাম (৮,৫০০' ফুট) অতি সুশ্রী, দৃষ্টিনন্দন । গ্রামের একধারে ঢেউ-তোলা পাহাড়ের পাঁচিল । তার মাথায় সারি সারি ঘরবাড়ি গ্রামবাসীদের । বাড়ির সামনের জায়গাটুকু জুড়ে ফুল-ফল, শাক-সব্জীর বাগান । লাউয়ের মাচা । মিষ্টি করলার ঢলঢলে লতার ললিত অঙ্গভঙ্গি--কেমন যেন নিবিড় করে চোখে লাগে । এগিয়ে যাই । ফাঁকা-মতো জায়গায় সোমেশ্বর শিবের টিনের চারচালা মন্দির । তার সামনে বিশাল `তেবারী', চারচৌকো । সমস্ত গ্রামের ছক একই ছাঁচে ফেলা । একই ব্লু-প্রিন্ট ।
!---
কুলিরা তেবারির মধ্যে এসে বসেছিল পিঠের মালপত্র নামিয়ে রেখে । মূর্তিরাম নাকি সবার আগে এসে গ্রামের মধ্যে গেছে । এখনও ফেরেনি । তেবারির মাটির মেঝের ওপর প্লাস্টিক বিছিয়ে আমরাও বসে পড়ি । পথ-হাঁটার ক্লান্তির পর এ এক পরম তৃপ্তি !
গ্রাম-ভাঙা মানুষের ঢল নেমেছে তেবারির আশেপাশে । অবাক অবাক চোখ ছেলে, বুড়ো, মাঝারি - সকলেই বেজায় কৌতূহলী । একজনকে গ্রামের মোড়ল বলেই মনে হল । বয়েস হয়েছে । একটু দূরত্ব বজায় রেখে এসে বসলেন নড়বড়ে এক কাঠের বেঞ্চে । পরিচয় হল । হ্যাঁ, তিনিই পঞ্চায়েত-প্রধান এই গ্রামের । সুধাংশু এগিয়ে এসে প্রধানের সঙ্গে কথা শুরু করে । আমরা আসছি সুদূর বাংলার মুলুক থেকে । আপনাদের গ্রামের কথা, গ্রামের মানুষের জীবনের কথা, সমাজের কথা, কাজকর্ম, উপজীবিকা, শিক্ষা স্বাস্থ্য ধর্মের কথা আমরা জানতে চাই, শুনতে চাই । সেইসঙ্গে এখানের অসুস্থ, রোগগ্রস্ত লোকজনেরও আমরা দেখবো, পরীক্ষা করে রোগের ওষুধ দেব বিনামূল্যে । আপনারা যদি একটু আমাদের সহায়তা করেন তাহলে কাজটা সুশৃঙ্খলেই হয়ে যায় আজই ।
প্রধান-সাহেব বেশ উত্ফুল্ল হলেন বলেই মনে হল । একটু নড়ে চড়ে বসলেন । সঙ্গে সঙ্গেই দু'চারজন বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকদের সঙ্গে ফিস ফিস করে কী সব বললেন । যুবকেরা ছুটলো গ্রামের দিকে ।
বেলা তখনও ছিল কিছুটা । প্রধান সাহেবকে নিয়ে জাঁকিয়ে বসলাম কাগজপত্র নিয়ে । আমাদের আসার কথাটা যদিও গাঁ-ময় রটে গিয়েছিল, কিন্তু উদ্দেশ্যটা রটেনি । এবার তাও রটে গেল । যেন বাতাসের কানে কানে কথা কওয়া । দেরি সইল না । সারি সারি মানুষজন, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে আসতে শুরু করলো পাড়া ছেড়ে, গাঁ ভেঙে । তেবারি উপচে পড়লো গ্রামবাসীদের ভিড়ে ।
করিত্কর্মা সুধাংশু ডাক্তার । তার গভীর অভিজ্ঞতা নিয়ে সমানে দেখে চললো রোগীকূল । অক্ষম, রোগজর্জর মানুষজন মনে হল যেন স্বর্গ হাতে পেয়েছে । রোগের কষ্ট, ব্যথা, যন্ত্রণার কথা কবুল করবার জন্যে যেন পাগল হয়ে উঠলো তারা । রবীন একের পর এক প্রেস্ক্রিপসনের চিরকূটখানা দেখে ওষুধ বিতরণ করলো সমানে । মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগের এক পরম পরিতৃপ্তিতে মনে হয়েছিল জীবনের এ এক পরম আনন্দঘন মুহূর্ত !
আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছিল । হঠাৎ মনে হল দুর্যোগ যেন আসন্ন ! পাহাড়ের আবহাওয়া । খেয়ালির খেলাঘরের মতো । এই গড়া হচ্ছে - এই ভাঙছে । কিছুই বলা যায় না । তুমুল বৃষ্টি নামলো । সেই সঙ্গে ঝড় । গাছের পাতা ঝরলো, ডাল ভাঙলো । বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিল সব । কিন্তু সে কতক্ষণের জন্যে ? আবার খেয়ালি প্রকৃতির রূপের হল বিবর্তন । সাজবদলের পালা চললো তার সাজঘরে । আবার রোদ উঠলো । বৃষ্টি থেমে গেল । অন্ধকার যেন কোথায় হারিয়ে গেল আলোর হাসির দীপ্তিতে ।
খেয়ালি প্রকৃতির আর এক প্রস্থ খেয়ালের সাক্ষী হয়ে রইলাম সেদিন আমরা । দুর্লভ এ দৃশ্য ! কোনও দিনই দেখিনি । রামধনু উঠেছে । কিন্তু আকাশের গায়ে নয় । সামনের পাহাড়ের ঢালে যেখানে গ্রামবাসীদের ঘরবাড়ি, গাছপালা, তারই ওপর । পরিষ্কার, স্বচ্ছ । কিন্তু এ দেখা ক্ষণিকের । স্থায়িত্ব ছিল না তার । মুহূর্তের দেখা, মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় ।
বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর নজরে এল আমাদের সঙ্গে নতুন আজকের আসা ফিতারি গাঁয়ের র্পোটারের দল তেবারি ছেড়ে চলে যাচ্ছে নীচে এক এক করে । মনে হল, ওরা বোধ হয় বাড়ি ফিরেই যাচ্ছে । কেননা পয়সাকড়ির হিসাব-নিকাশ একপ্রস্থ হচ্ছিল একটু আগেই তরুণ ও মূর্তিরামের সঙ্গে । ওধারে বসে । এসব পোর্টারদের আবারও বিদায় দেওয়া হল । জানিনা কী মতলব ভাঁজছে মূর্তিরাম । শেষ পর্যন্ত কী হবে কে জানে ?
সূর্যাস্তের পূর্বরাগ । সিঁদুর-রঞ্জিত পশ্চিম আকাশ । একপাল ছাগল-ভেড়া উঠে আসছিল নীচে থেকে ওপরে । গলায় তাদের ঘন্টার টুং-টাং শব্দ । দুটি কিশোরী মেয়ে । রঙিন জোব্বা পরা । হাতে কাঁচা পাইনের ডাল । তাই দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে আসছিল তাদের । একাজ রোজই ওরা করে । সকালে উঠেই খোঁয়াড় খুলে ছাগল-ভেড়াদের নিয়ে ওরা বাইরে বেরিয়ে যায়, যেখানে ঘাস আছে পাতা আছে গাছের । ঘাসের জন্যে ওদের গ্রামের বাইরেও যেতে হয় । তখন নাস্তা সঙ্গে নিয়ে যায় । নদীর কি ঝরনার জল খেয়ে নেয় আঁচলায় করে পেট ভরে । পশুর পাল চরে বেড়ায় সারাদিন । ওরা গাছের ছায়ায়, গাছ-পালার আড়ালে খেলা করে, শুয়ে পড়ে, গান গায় আবার কখনো ঘুমিয়েও পড়ে । এর মধ্যে লক্ষ রাখতে হয় তাদের পশুর পালের ওপর । মাঝেমধ্যে বিপদ যে তাদের হয় না তা নয় । হিংস্র প্রাণীর আক্রমণ মোটেই অস্বাভাবিক নয় । মারাও পড়ে পশুরা মাঝে মাঝে । এরপর সূর্য পশ্চিম-আকাশে ঢলে পড়বার আগে ওরা পশুর পাল তাড়িয়ে নিয়ে এক জায়গায় করে তবে বাড়ি ফেরে । অনেক সময় তারা ঘাস কাটে হাঁসুলি দিয়ে । আঁঠি বেঁধে পিঠে ফেলে নিয়ে আসে । এখানেই কিন্তু তাদের কাজের শেষ নয় । এরপর পশুদের খোঁয়াড়ে তোলা, ঘাস-জল দেওয়া এসবও তাদের করতে হয় । তবেই তাদের নিষ্কৃতি ।
সুধাংশুর এক চোখের রোগী রামশরণ সিং তাঁর বাড়িতে আজ রাতে আমাদের অতিথি হবার আমন্ত্রণ জানালেন হঠাৎ । তেবারির মধ্যে একখানা বেঞ্চের ওপর বসে ছিলেন এতক্ষণ । লক্ষই হয়নি । বিনীত ভাব । সরল, সাদাসিধে মানুষ । দেখলেই মনে হয় । মুখে পাতলা হাসি । -- যদি দয়া করে আমার বাড়িতে আজকের রাতটা থাকেন তাহলে আমি সবিশেষ অনুগৃহিত হই । বলার ভঙ্গিটি বড় সুন্দর তাঁর । এ অনুরোধ তরুণ ফেলতে পারেনি । আমরা হৈ-হৈ করে এরপর তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হই সানন্দে ।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে । টর্চের আলোয় আমরা পাথরের চাঙড়ের ধাপ ভেঙে ভেঙে গ্রামের মধ্যে এসে ঢুকি । ছিমছাম, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রাম । বৃষ্টির জল এখানে ওখানে জমে ছিল । ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক । বড়িঘর ছোট ছোট খুপরির মতো । তাতে ঘুলঘুলির মতো জানালা । জানালার ফাঁক চুঁইয়ে কেরোসিনের কুপির আলো আসছিল । ঢেঁকির শব্দ কানে আসে । ধান ভাঙা হচ্ছে বলেই মনে হল । ছোট ছোট ক্ষেতিবাগান বাড়ির সামনে । বেড়া দেওয়া । তার পাশ দিয়েই এসে আমরা উঠলাম রামশরণ সিংয়ের বাড়ির দরজায় । মস্ত কাঠের বাড়ি । দোতলা । নীচে দুখানা ঘর । তার পাশ দিয়ে কাঠের সিঁড়ি ওপরে ওঠার । সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এলাম । ওপরেও দুখানা ঘর । মোটামুটি প্রশস্ত । সামনে রেলিং দেওয়া বারান্দা । কাঠের পাটাতনের মেঝে । যেমন হয় এসব অঞ্চলের কাঠের বাড়ি ।
থাকবার জন্যে দুখানা ঘরই আমাদের ছেড়ে দিলেন তিনি । সঙ্গে আনা মালপত্রে ঘর, বারান্দা বোঝাই হয়ে গেল । ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দিল রবীন । রেলিং-ঘেরা বারান্দার একধারে চায়ের সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে বসে গেছে স্বপন । স্টোভ ধরিয়ে চা তৈরির উদ্যোগ শুরু হল । রাতের রান্না সেই করবে । মনখোলা, প্রাণখোলা যুবক স্বপন । হিমালয় ভালবাসে । তাই আমাদের সঙ্গে অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে । সেবারের কুমায়ুন হিমালয়ে ছোট কৈলাস পরিক্রমায় তার অবদানের তুলনা ছিল না । বরফ-ঝরা দুর্যোগের সে রাতে সে সামলে ছিল একা হাতে অনেক কিছু । তাঁবু খাটানো থেকে শুরু করে রান্নার পাট, পরিবেশন, সাজ-সরঞ্জাম বাঁধাছাঁদা এমনকি হিসাব নিকাশের খাতাতে পাই-পয়সার জমাখরচটুকু পর্যন্ত । বেশ বড়মাপের পাহাড়ি পর্যটক ।
রামশরণ সিংয়ের আপ্যায়নের তুলনা ছিল না । আন্তরিকতার স্পর্শ সব জায়গায় মাখামাখি । ঝুড়িভর্তি বাগানের আপেল, আড়ুফল, ভুট্টা, মিষ্টি করলা, সিম, কুমড়ো এনে হাজির । ছোটখাট সংসার । ঘোমটার নীচে নাকে নাথলি ঝোলানো স্ত্রী আর তার এক মেয়ে ও ছেলে । দুজনেই এখানের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে । অবস্থাপন্ন মানুষ । চাষবাস, ছাগলভেড়া নিয়েই আছেন । ইদানীং চোখের অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন খুব । সুধাংশু চোখের ভাল ওষুধ দিয়েছে । তাতেই মহাআনন্দ তাঁর ।
ঘটা করে সে-রাতে অনেক কিছুই রান্না হল । কুমড়ো সিমের তরকারি মাংসের টিন কেটে উপাদেয় খিচুড়ি পাঁপর-সেঁকা ও সেইসঙ্গে গৃহস্বামীর ঘরের ঘি ও মাখন । পরিশ্রান্ত দেহ, ক্ষুধার্ত উদর । স্বর্গীয় ভোজ্যবস্তুর অমৃত-আস্বাদ পেয়েছিল সবাই সে-রাতে ।
দুখানা ঘর জুড়ে ঢালাও বিছানা পেতেছিল পার্থ ও রাজা । প্লাস্টিক সিট, ক্যারিমেট বিছিয়ে । হাত-পা অসাড় হওয়া কাঁপ-ধরা শীত । স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে অনেকেই শুয়ে পড়লো । সারা দিনের পথ চলার ক্লান্তি । ঘুম যে নি:শব্দে নেমে আসবে সবার চোখে সে বিষয়ে নি:সন্দেহ ।
কিন্তু ঘুম ছিল না তরুণ ও মূর্তিরামের চোখে । বাইরের বারান্দায় তখনও কীসব কথাবার্তা চলছিল ওদের মধ্যে । কানে আসে কথা । -- "রোজ রোজ পোর্টার বদলে নতুন পোর্টার আমদানি করার কী উদ্দেশ্য তোমার ?" তরুণের ক্ষুব্ধ গলা বুঝতে পারি । -- "কিছু নয় বাবুজী, সিংকা যেতে কেউই রাজি নয় । বহুৎ খতরনক পথ, তকলিফ করতে কে আর চায় বলুন ।" মূর্তিরাম কেমন অবলীলায় বলে উঠলো কথাগুলো । -- "কিন্তু, আমাদের এই যে দেড়া পাড়াও কুলিদের গুনতে হচ্ছে -- তার কি ? এরকম কথা কী আগে ছিল ?" তরুণের গলায় অসম্ভব বিরক্তির সুর । "ওতো দিতেই হবে বাবুজী, যদি কেউ যেতে না চায় তাহলে আপনি কি জবরদস্তি করবেন ? সেদিন কী এখন আর আছে ?" মূর্তিরাম বেশ খোলাখুলি গলায় কথাগুলো বলে । তার গলায় কেমন একটা প্রতারণা করার প্রচ্ছন্ন কৌশলের সুর মেশানো ছিল । তরুণ কোন কথা আর বলে না । বলতে পারে না, বলতে চায়ও না । মূর্তিরামের এই ফন্দি বা চক্রান্তের কাজে মনে মনে সে যথেষ্টই ক্ষুব্ধ, কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা জোগায় না তার গলায় । সে ভাবে যদি যাত্রাপর্বে কিছু বিঘ্ন ঘটে । তাহলেই তো বিপদ । এত পরিশ্রম এত অর্থব্যয়, এত আশাআকাঙ্খা সবই তো নি:শেষ হয়ে যাবে । কারণ সে খুব ভালরকমই জানে কুলিদের এইসব আচরণ, অনাচার হয় এই সময়ে । তাই সে দ্বিরুক্তি করেনি । শুধু মনে মনে ক্ষোভ প্রকাশ করে সমস্ত পর্বটাকে সহজ করে দিয়েছে ।
রামশরণ সিং জারিকেন ভর্তি খাবার জল ঘরে দিয়ে ; সকলের শোবার ব্যবস্থা ঠিকমত হয়েছে কিনা জেনে নিশ্চিত মনে নীচে নেমে গেলেন । এমন চেতনাসম্পন্ন মানুষ সমাজে থাকতে পারে জেনে আনন্দ হয় ।
খোলা বারান্দায় এসে দাঁড়াই । একঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া চোখেমুখে এসে লাগে । গরম র্যাপারে মাথা ঢেকে নিই ।
ঘুমন্ত গ্রাম । নি:শব্দ । পাতা পড়ার আওয়াজটুকুও যেন কানে শোনা যায় । আকাশে চাঁদ উঠেছে, পাতলা ফিনফিনে কুয়াশার ওড়না মুখে দিয়ে । ভাবছিলাম ওর কথা । মূর্তিরামের । কতই বা বয়েস । তারুণ্যের কোঠার মধ্যে এখনও সে পড়ে । যৌবনের আঁচ এখনও লাগেনি গায় । কিন্তু কুটিল বুদ্ধি, ক্রিয়া-কৌশলের জাল কেমন বুনতে শিখেছে সে । আমাদের অবস্থার অসহায়তার কথা চিন্তা করে সে কেমন ধীরে ধীরে তার সুযোগের রাস্তাটা পরিষ্কার করে ফেলেছে । ভাবতে সত্যি কষ্ট হয় ! এমন স্বচ্ছ তরুণ জীবন অকালে কেমন ঘুণ ধরে অবক্ষয়ের পথে চলে যাবে আগামীতে । জীবনের অনেকখানি তো তার বাকি এখনো । এমন ক্ষিন্ন, ক্লেদাক্ত, কুটিলতার আবর্তে পড়ে সে তার ভবিষ্যতের পথ তৈরি করে নেবে ? সে আরও এই সব কাজে সুদক্ষ হবে, আরও কৌশলী হবে, কুক্রিয়ায় আসক্ত হবে ভাবতেও কেমন লাগে !
কি জানি, গত রাতের ভুরিভোজন আর কাঠের ঘরে হাত-পা মেলে রাত্রিযাপন সুনিদ্রার কারণ হলেও হতে পারে । কিন্তু সে যাই হোক, নীচের উঠোনে পুরুষকন্ঠের কানফাটানো আওয়াজ পাচ্ছিলাম । মাঝে মাঝে উত্তেজনার স্বরও কথাতে মেশানো ছিল । বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখি একরাশ স্থানীয় মধ্যবয়সী, প্রৌঢ় যুবক মূর্তিরামের সঙ্গে বচসায় মত্ত । বুঝলাম মূর্তিরাম কুলি বাছাই করছে । আজও নতুন কুলি আমাদের সহযাত্রী হচ্ছে ।
-- "এরাই কিন্তু অমরদা, আমাদের যাত্রাপথের শেষ সঙ্গী হয়ে থাকবে ?" রবীন একটু হেসে বলে ওঠে ।
আমি বলে বসি, "কেন, শেষ সঙ্গী কেন ?"
রবীন সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, "কেন আবার ! ওদিকের পথে তো গ্রাম আর পড়বে না । কুলি পাবে কোথায় ?"
-- "হ্যাঁ,হ্যাঁ, তা ঠিক । খেয়াল ছিল না লেয়ারি এ পথের শেষ গ্রাম । যাক বাঁচা গেল ।" বলে উঠি ।
সুধাংশু বলে ওঠে, "বাঁচা গেল কেন ?"
-- "বাঁচা গেল না ? আমরাও বাঁচলাম, মূর্তিরামও বাঁচলো ।" বলে বসি ।
-- "মূর্তিরাম বাঁচলো কী সে ?" সুধাংশুর জিজ্ঞাসু প্রশ্ন ।
-- "মূর্তিরাম বাঁচলো না ? তার দুনম্বরি কাজ আর ভগবান সহ্য করতে পারছে না ।" বলে উঠি ।
হো হো করে হেসে ওঠে সবাই ।
স্বপন স্টোভ ধরিয়ে চা তৈরি করছিল । পার্থ. নীলাদ্রি মিল্ক পাউডার গুলছিল গরমজলে চামচ দিয়ে গ্লাসে । তরুণ ঘরছাড়া অনেক আগেই । মনে হচ্ছে নীচেই গেছে কুলিদের ওখানে । বেচারার জ্বালা বেশি । বিমলবাবু এখনও কম্বলের তলায় ও-ঘরে ।
-- "রামশরণবাবু একবার এসে ফিরে গেছেন । কেননা, তখনও বিছানা ছাড়েনি অনেকে ।" নীলাদ্রি বলে জানায় । মনে মনে লজ্জিত হই ।
চায়ের পর্ব তাড়াতাড়ি মিটিয়ে ফেলে মালপত্র বাঁধাছাঁদার কাজে হাত দিতে হবে বলেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে স্বপন । আমরাও উঠে পড়ি হৈ-হৈ করে । রামশরণবাবুর সঙ্গে কথা কইতে কইতে তরুণকে উঠে আসতে দেখি সিঁড়িতে । স্বপনকে বলি রামশরণবাবুকে চা-বিস্কুট দিতে ।
-- "হ্যাঁ, গাঁয়ের অনেকেই মাল বওয়ার কাজ করে এই মরশুমে । তবে এদিকে বাইরের লোক বিশেষ কেউ আসে না । হর-কি-দুনের পথে হামেশাই ওরা এইসব কাজ করে । ওদিকে অনেক পার্টি আসে ।" রামশরণবাবু চায়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলেন তরুণকে । তরুণ কিছু বলে না, নি:শব্দে চা খায় ।
-- "আবার এইসব কুলিদের ইউনিয়ন আছে জানেন না বুঝি, মোড়িতে, নৈটেয়ারে । কুলিদের সব রেট বাঁধা । কে কত ওজনের মাল বইবে, কত ঘন্টা হাঁটবে, শুখা না খানা মিলবে যাবার পথে -- কমিটি সব ঠিক করে দেবে ।" রামশরণবাবু পোর্টার গাইডকূলের বিস্তারিত বর্ণনার অবতারণা করে চলেন ।
বেলা বাড়ছিল । দেরি করা আর ঠিক হবে না । কেননা, এবার ওপথে গ্রাম আর মিলবে না । তাঁবু খাটাতে হবে । ভাল টেন্টসাইট দেখে পছন্দ করতে হবে দিনের আলোয় । চঞ্চল হয়ে উঠি ।
ছবি তোলার আনন্দে বেজায় খুশি |
নীচে নেমে আসি । মূর্তিরামের গলা পাই -- "হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবুজী, ন'টার জায়গায় দশটা পোর্টার যাবে । রেশনের মাল কমেছে তো কী হয়েছে । বহুৎ খতরনক পথ । একটা লোক বেশি থাকা ভাল ।" রবীনকে বুঝিয়ে ছেড়ে দেয় সে । যাবার সময় হৈ-চৈ করা ঠিক হবে না ভেবে তরুণ রবীনকে চুপ করে থাকতে বলে । রবীন আর এগোয় না । রুকস্যাক পিঠে তুলে নেয় ।
পাথরের চাঙড় বসানো সিঁড়ির ধাপ ভেঙে নেমে আসি উঠোনে । রামশরণবাবু, তাঁর স্ত্রী, দুটি ছেলেমেয়ে উঠোনের একধারে পাশাপাশি হয়ে দাঁড়িয়েছিল । আমিই এগিয়ে যাই । তাঁর হাতদুটো ধরে বিদায় চেয়ে নিই । আমাদের যাত্রা সফল হোক এ প্রার্থনা তাঁদের করতে বলি । রামশরণবাবু শক্ত করে আমার হাতদুটো ধরে বললেন, "এ-বয়সে এই দুর্গম পথে আপনি যে পাড়ি দিতে সাহসী হয়েছেন তার জন্যে আপনাকে কী বলে অভিনন্দন জানাবো বুঝতেই পারছি না । আপনার যাত্রাপথ মঙ্গলময় হোক । আবার আসবেন এখানে ।" আর আসবো কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে যদিও পারিনি তবু বলেছিলাম, "আপনাদের আতিথেয়তা ছিল নি:স্বার্থ, নিখাদ -- তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ।"
পথে নেমে এসেছি ।
প্রতিবেশীদের পাশাপাশি ঘর । একই পরিকল্পনা মাফিক । কারো বা কাঠের ঘর, কারো বা পাথরের গাঁথুনি । কাঠের ওপর সেই একই সুন্দর সুন্দর নক্সার কাজ । বাড়ির সামনে সেই একই ছোট ছোট শাক-সবজীর বাগান । লাউ-কুমড়োর মাচা । কোথাও বা শশা, মিষ্টি করলার ।
পাড়ার মাঝখানে আসি । সেই তেবারি -- তার সামনে সোমেশ্বর শিবের মন্দির । গাঁয়ের মানুষ আসে । ফুল জল দেয় নিত্য । সন্ধ্যায় প্রদীপ, বাতি জ্বেলে দিয়ে যায় । বছরে একদিন বছর সালিয়ানার পুজো হয় । ধূম পড়ে যায় তখন । পাড়ার ঘরে ঘরে লোক কুটুম্বের ভিড় হয় । নতুন জামাকাপড় সকলের হয় । নাচগান হয় । ছোট্ট মেলা বসে । আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই ।
পাড়া ছেড়ে বাইরে আসি । পথ একজায়গায় এসে দু'ভাগ হয়ে গেছে । একটা পথ নেমে গেছে সুপিনের কিনারায় । গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নাকি পথ । অসম্ভব ভাঙাচোরা । বোল্ডার টপকে টপকে যেতে হয় । হিংস্র জীবজন্তুর সাক্ষাত পাওয়াও নাকি অসম্ভব নয় । কুন্দন সিং বলছিল চলতে চলতে । আর এক পথ গিয়েছে গ্রামের মাথার ওপর দিয়ে । চড়াই ভাঙতে হয় খুব । খুবই সঙ্কীর্ণ রিজের মতো । একদিকের ঢাল নেমে গেছে সুপিনের কিনারায় । আর একপাশের ঢাল গভীর খাদের মধ্যে । কোথায় কে জানে !
মূর্তিরাম আমাদের চড়াই পথ ধরতে বলে দেয় । কেননা নীচের পথ অত্যন্ত জঙ্গলাকীর্ণ, বিপজ্জনকও । আবার চলা অত্যন্ত কষ্টকর । সময়ও লাগবে খুব । আর এপথ চড়াই হলেও অনেকটা সুগম । হাঁটতে অসুবিধা হবে না ।
চড়াই পথ ধরাই ঠিক করলাম আমরা । প্রতিবেশীদের বাড়ির উঠোন, আনাচ-কানাচ মাড়িয়ে চড়াইয়ের মুখে এসে পৌঁছাই । পথ ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠে গেছে । তবে খুবই সঙ্কীর্ণ । পথের কয়েকটা পাক ভেঙে ওপরে উঠতেই লেয়ারি গ্রামখানার সবটাই ভেসে উঠলো চোখের ওপর । সারিবদ্ধ ঘরবাড়ির পিছন দিকগুলো চোখে পড়ছিল । পথ খুবই সরু । অত্যন্ত সন্তর্পনে তাই উঠতে হচ্ছিল । একদিকের খাদ নেমে গেছে অতলস্পর্শী সুপিনের কোলে । জঙ্গলের নিটোল ঘনত্ব সেখানে । চড়াইয়ের বাকি কটা পাক ঘুরতে ঘুরতে যখন ওপরে এসে হাজির হলাম সত্যিই মনে হল নতুন এক পরিবেশে এসে পৌঁছেছি । অপ্রশস্ত কিন্তু সমতলমতো রিজ । রিজের গা লাগোয়া একটানা সারি দেওয়া সমান উচ্চতার গাছের শীর্ষ সত্যিই কেমন অভিনব লাগে চোখে । মনে হয় কে যেন ফিতে ফেলে মাপজোক করে গাছগুলো পুঁতে রেখে গেছে । গাছের সারির ওপারে ফাঁকা নীল আকাশ । ধূ ধূ করছে । আকাশের নীচে পাহাড়ের দেওয়ালের ধূসর ইশারা । দাঁড়িয়ে দেখি অনেক্ষণ ধরে ।
নীচে থেকে সবাই উঠে এল এক এক করে । রিজ ধরেই পথ । নতুন কুলির দল সবাই এগিয়ে গেছে । কুন্দন সিংও । সে একাই থেকে গেছে আমাদের দলে । দলের একমাত্র বিশ্বস্ত পুরনো কুলি সে । নৈটেয়ার থেকেই দলে আছে সিংকার মাথায় সেই গিয়েছিল একবার তার কাকার সঙ্গে ভেড়ার পাল নিয়ে । ভেড়ার পাল ওপারে নামাতে পারেনি । ফিরে এসেছিল । সে জানে এপথের হদিশ । তাই মূর্তিরাম তাকে দল থেকে ছাড়তে চায়নি ।
রিজের দূরত্ব খুব বেশি নয় । এক কিলোমিটারের কিছু কম বেশি মনে হল । বাঁ-ধারে খাদের মাথায় গভীর বনের ঘেরাটোপ । ডানদিকে গভীর নীচে সুপিনের রুপোলি জলধারা সরু তারের মতো দেখা যাচ্ছে । রিজের শেষ অংশ মিশে গেছে পাহাড়ের গায় । পাহাড়ের গা ধরে আমরা নামতে থাকি । ঘাসের ঝাড় পাহাড়ের খাঁজেখন্দে চোখে পড়ে । জঙ্গল এবার হাল্কা হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হল ।
ঘাস আর পাথরের চাঙড়ে ভর্তি পাহাড়ের ঢাল । কত পথ এসেছি কে জানে । সূর্য মাথার ওপর ঝক ঝক করছিল । মূর্তিরাম আকাশের দিকে চেয়ে কুন্দন সিংকে বলে ওঠে, "ভুলকোনায় আজ যেতেই হবে চাচাজী । ওখানেই তাম্বু গাড়বো ।" কুন্দন সিংও মনে হল একবার আকাশে সূর্যের অবস্থানটা দেখে নিল । তারপর বলে ওঠে, "দেখা যাক, কী হয় ।" ওরা আকাশে সূর্যের অবস্থান দেখে সময়ের গতি বুঝতে পারে । আমার মনে পড়ে, সেবারে রূপকুণ্ড যাবার পথের কথা । রূপকুণ্ড পার হয়ে রন্টি ঘুরে ফেরার পথ । সঙ্গে ওপথের বিখ্যাত গাইড দেবলের গঙ্গা সিং । কিংবদন্তীপ্রতিম গাইড কেদার সিংয়ের ছেলে । গাড়োয়ালের পথঘাট ছিল যার নখদর্পণে । সেই গঙ্গা সিংও বার বার সূর্যের দিকে তাকিয়ে দিক ঠিক করেছিল গাঁয়ে ফেরার পথঘাট । কর্ণপ্রয়াগের মাথায় কুঁয়ারী পাসের বেসক্যাম্প যেখান থেকে শুরু হয় । ওরা পাহাড়ের মাথার চূড়ো দেখে পথের নিশানা ঠিক করে, পথের দিশা খুঁজে বার করে । সূর্য দেখে ওরা দিক ঠিক তো করেই আবার বেলা মেপেও দিতে পারে সময়ের ঘন্টা, মিনিটের চুল চেরা হিসাব নিকাশের ।
বেলা বাড়ছিল । রোদের ধারও ওঠে । গরম পোষাক মনে হয় যেন আর গায়ে রাখা যায় না । রাজা রবীনের দল পথের মাঝে কাত হয়ে পড়েথাকা বিশাল এক পাথরের ছায়ায় বিশ্রাম নিতে বসে । সেইসঙ্গে পাথরের ওপর খড়ি দিয়ে ছক এঁকে বাঘবন্দি খেলে । রাজার তুলনা হয় না পাহাড়যাত্রায় । অনেক পাহাড়ি পথ হেঁটেছে আমাদের সঙ্গে । হটকারিতায় ওর তুলনা মেলা ভার । লম্বা, ফর্সা, ছিমছাম গড়ন -- অসম্ভব সাহসী ।
একটু হেসে বলে উঠি, "কী হচ্ছে রাজা ? এখন যাবার সময় ।"
সেও হেসে বলে ওঠে, "ডোন্ট মাইণ্ড অমরদা, একটু রিলাক্স করছি -- আর কিচ্ছু নয় ।" বলেই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায় । রুকস্যাক পিঠে তুলে নিয়ে আবার হাঁটতে থাকে । এই হচ্ছে রাজা ।
পথ এসে হোঁচট খেল বিশাল-আকার এক পাথরের গায় । তাই পথ ঘুরে গেল বাঁদিকে । পথ তো নয় ! সরু দড়ির মতো পথের রেখামাত্র । ছাগল ভেড়ার পায়ে পায়ে তৈরি । অজস্র গুল্মে আচ্ছন্ন পাথরের গা । ঢাল বেয়ে বেয়ে আবার উঠতে হচ্ছে ওপরে । খুব একটা খাড়াই ঢাল নয় । পার্থ আর নীলাদ্রি দেখছি বেশ তর তর করে উঠে যাচ্ছে ওপরে । গুল্মের মধ্যে ছোট ছোট একোনাইটের গাছ চোখে পড়ছে । তীব্র বিষাক্ত গাছ । ওর বেগুনে রঙের ঝুমকোর মতো ফুল যখন গাছে ফোটে তখন দেখলে কেমন যেন ভয় ভয় করে ! মনে হয় তীব্র বিষ বুকে ভরে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । কোন এক মায়াবিনী যেন রূপের জাল পেতে । রূপের মোহে ধরা পড়লেই মৃত্যু তার অবধারিত । এ গাছে ছাগল, ভেড়া, গরু কেউই মুখ দেয় না । তবে এগাছের ফলের বীজ থেকে জীবনদায়ী ওষুধ তৈরি হয় । বিশেষত হোমিওপ্যাথি শাস্ত্র অনুযায়ী ।
পাথুরে গুল্ম-আচ্ছন্ন ঢাল বেয়ে বেয়ে আরও ওপরে উঠতে নজরে পড়ে ব্রহ্মকমল ফুলের গাছ । মাথায় তার ফুলের তবক । যেন শ্বেতপাথরে তৈরি ! পাথরের ঢালে মেলা বসে গেছে । এত ব্রহ্মকমল ফুল একসঙ্গে এর আগে কোথাও দেখিনি । রূপকুণ্ডে যাবার পথে বগুয়াবাসার পথে হুনিয়াথর উপত্যকায় দেখেছিলাম একবার । তবে এত বেশি গাছ সেখানে ছিল না । এ-যেন ব্রহ্মকমলের কুঞ্জবন তৈরি হয়ে আছে । এত উঁচুতে বাতাসও ভারি হয়ে আছে ফুলের তীব্র গন্ধে ।
পাহাড়ের ঢাল একসময় শেষ হয়ে গেল । ঢালের এপ্রান্তে বিশাল উপত্যকা নেমে গেছে গড়াতে গড়াতে নীচে । উপত্যকা গুল্মাচ্ছন্ন, সবুজ । উপত্যকার ঢেউ-গড়ানো বুকের একপ্রান্তে আকাশস্পর্শী পাহাড়ের দেওয়াল এগিয়ে গেছে দূরে আর প্রান্তের পা ছুঁয়ে বয়ে চলেছে রূপসী সুপিন । তবে সে প্রগল্ভতা নেই, প্রমত্তাও নয় । অনেক শান্ত হয়ে গেছে এখানে । দেহের সে বিস্তার আর নেই । অনেক শীর্ণ, অনেক ক্ষীণ । গলার সে বজ্রহুঙ্কার আর নেই । নিখাদে বেজে চলেছে কন্ঠের সে সুরব্যাঞ্জনা ।
ঘাসের মধ্যে দিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে পালিয়ে এসেছে শীর্ণ এক ঝরনা । পথ ভাসাচ্ছিল জলে । তার ওপর ছোট সাঁকো, কাঠের তক্তা ফেলা । দুপাশে পাথর সাজিয়ে । পার হয়ে আসি । ঝরনার জল ঘাসের ফাঁকফোকর দিয়ে নেমে গেছে সুপিনের বুকে ।
উপত্যকার বুক চিরে পথ । সরু ফিতের মতো । ছাগল, ভেড়া গুজরেরা শুধু জানে এ-পথের হদিশ । জনমানবহীন, খাঁ খাঁ করছে । গাছপালা হারিয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই । মানুষজনের বসতি এসব অঞ্চল স্পর্শ করেনি এখনও ।
বড় ঘাসের জঙ্গল শুরু হচ্ছে বলে মনে হল । ঝাড় ঝাড় ঘাসের ঝাঁটি এখানে ওখানে । সামনে যতদূর পারি দেখি, শুধু ঘাসেরই আস্তরণ । ঢেউ খেলিয়ে উঠেছে-নেমেছে । এসব অঞ্চলের পাহাড়ি নাম `বুগিয়াল', মানে পশুচারণ ক্ষেত্র । হিমালয়ের দশ-বারো হাজার ফুটের মাথায় সাধারণত ঘাস দেখা যায় । বনজঙ্গল পাতলা হয়ে যায় । এখানেও তাই ।
ঘাস ঠেলে ঠেলে পথ চলা । পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল ঘাসের ডগা । বর্ষার মুখ । ঘাসের রঙে সবুজের জোয়ার । মাঝেমধ্যে ফুলের মেলা । এনিমোন, ক্যালেনডুলা, প্রিটোনিয়া, ফ্লকস । রঙের উত্সব চলেছে সেখানে । একোনাইটের ছড়াছড়ি । একদল পাহাড়ি মেয়ে চোখে পড়ে । ওরা গাছ-গাছড়া, মূল, কন্দ সংগ্রহ করছিল জড়িবুটি, ভেষজের । সুধাংশু এগিয়ে গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা কয় । কোন রোগে কী গাছের ব্যবহার তাই হয়ত জানছিল । হিমালয়ের অলিতে-গলিতে এমন বহু গাছ-গাছড়া আছে যা আমাদের জীবনদায়ী ওষুধে লাগে । ওরা এইসব গাছ-গাছালি, মূল, ফুল, বীজ, ছাল শুকিয়ে যত্ন করে তুলে রাখে সারা বছরের ওষুধ হিসাবে ব্যবহারের জন্যে । ওদের রোগ হরণের এটুকুই ভরসা, সম্বল ।
!---
[ছবি ১৮ বিশ কুপরি বুগিয়াল - ঘাসের রঙে বাদামী সবুজের ইশারা ।]---
ঘাসের উজান ঠেলে কত পথ এসেছি জানি না । কুন্দন সিং এদিক ওদিক চেয়ে বলে ওঠে, "বিশ কুপরি বুগিয়ালে এসেছি । এ অঞ্চলের নামকরা বুগিয়াল বাবুজী ।" শীতের কটা মাস বাদে বরফ যখন গলতে শুরু করবে তখন থেকে পাল পাল গুজরেরা এসব অঞ্চলে এসে ভিড় জমায় । সঙ্গে তাদের থাকে ছাগল, ভেড়া, গাধা, ঘোড়ার পাল । শয়ে শয়ে । গোনা গুনতি । এদল-ওদল বড় একটা হয় না । গলায় সব বাঁধা থাকে টিনের চাকতি, তকমা আর ঘন্টা । ওরা নিজের নিজের পশুর পাল বুঝে নিতে পারে । তবে দলছুট যে হয় না এমন নয় । গুজরেরা পাহাড়ের গুহা খুঁজে ঝুপড়ি বানিয়ে ছোট ছোট তাঁবু খাটিয়ে মাসের পর মাস এখানে কাটিয়ে দেয় । পরিবার, পরিজন, সন্তান-সন্ততিরাও অনেকের সঙ্গে এসে বসবাস করে । সঙ্গে থাকে সারা মাসের খাবারদাবার । রান্নাবান্না করে খায়, আর পশু চরায় । পশু চরাতে চরাতে বহু দূরে গিয়ে পড়ে তারা এক এক সময় ঘাসের সন্ধানে । এমনি একবার কাকার সঙ্গে আমি এসেছিলাম এই অঞ্চলে ঘাসের সন্ধানে । কানে এসেছিল সিংকা-লার ওপারে নাকি ভাল ভাল বুগিয়াল আছে । কিন্তু না বাবুজী, ওপারে যাওয়া আর আমাদের হয়নি । সেরাতে এতবেশি বরফ পড়েছিল যে প্রাণ হাতে করে পালিয়ে এসেছিলাম । ছাগল ভেড়াদের ওপারে নামাতে পারিনি । তাদের দুর্গতির শেষ ছিল না । কয়েকটা ভেড়া মারাও গিয়েছিল ।"
কুন্দন সিংয়ের মুখে তার ছোটবেলার গল্প শুনি । বেশ ভাল লাগছিল শুনতে । জিজ্ঞাসা করি, "তুমি এখন ছাগল ভেড়া আর চরাও না ?" -- "না, বাবুজী বড় কষ্টের কাজ । ছেড়ে দিয়েছি । ঘর-সংসারের ঠিক থাকে না । পরিবার, ছেলেমেয়েদের হাল খারাপ হয়ে যায় । জমি যেটুকু আছে তার দেখভাল, চাষ-আবাদ কিছুই হয় না । একদম বাউণ্ডুলে জীবন বাবুজী । আমার ঘরদোর আছে, এ আমি কেন করবো ? আমার দু'দশটা ছাগল ভেড়া আছে । আমি তাদের নিয়েই থাকি ।"
কুন্দনের জীবিকার কিছু হদিশ পাওয়া গেল তার মুখ থেকে । সে যে পশুচারণবৃত্তি পছন্দ করে না তাও বোঝা গেল । হয়ত এও হতে পারে ওর কাছে, এ বৃত্তি নিম্নমানের সম্প্রদায় ভুক্ত । বুঝি না । আবার জিজ্ঞাসা করে বসি, "আচ্ছা কুন্দন, এই যে আমরা এসেছি তোমাদের দেশে এপথে পাহাড় বন-জঙ্গল, নদীনালা, ঝরনা, বরফ, পাহাড়ি মানুষজন দেখতে, ঠিক এমনই এপথে আমাদের মতো আর কোন বিদেশি দলকে এর আগে আসতে দেখেছ ?"
কুন্দন কিছুক্ষণ চুপ করে একটু ভেবে বলে, "না, বাবুজী এর আগে কোন দল নিয়ে আমি এধারে আসিনি । আমি গিয়েছি হর-কি-দুন, রুইসারা তলাও, বোরাসু-পাস, স্বর্গারোহিণী ক্যাম্পে । আবার গিয়েছিলাম ধূমাধার পেরিয়ে যমুনোত্রী । এই সব ।" একটু থেমে আবার বলে, "এপথ বহুৎ খতরনক বাবুজী । কে আর আসবে ।"
গল্প করতে করতে অনেকটা চলে এসেছি । ওঠানামা ঘাসে বোঝাই পথ ধরে ধরে । অস্পষ্ট পথের রেখা কখনও চোখে পড়ে, কখনও পড়ে না । ঝিরঝিরে শীর্ণা ঝরনার শেষ নেই এপথে । পাহাড়ের ওপর থেকে পাথরের গা বেয়ে নেমে এসেছে । তারপর ঘাসের বনে আত্মহারা হয়ে সুপিনের সঙ্গে সখ্যতা পাতিয়েছে ।
আকাশে মেঘের আনাগোনা । আলোছায়ার কানামাছি খেলা চলছিল । মেঘ সরে যেতে মুহূর্তেই ঝলসে ওঠে চোখের ওপর একগুচ্ছ বরফশৃঙ্গ । কুন্দন সিং আঙুল দিয়ে দেখায় খিমলোগা শৃঙ্গ (১৯,২৮০ ফুট) আর তার তলায় খিমলোগা পাস । আবার একটু এগিয়ে গিয়ে দেখিয়ে বলে, "দেওখিরা, ওর পেছনে হর-কি-দুন পাহাড়ের সব চূড়ো আছে এখান থেকে দেখা যায় না । বোরাসু হর-কি-দুন পিক । খিমলোগার নীচে দেখুন রানীকোণ্ডা, বাঁয়ে লাম্বিধর ।" ধবধবে বরফের টোপর পরা পরা । মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি ।
-- "বিশকুপরি অনেক আগেই ফেলে এসেছি বাবুজী, এখন যেখানে এসেছি এর নাম `বিড়া বুগিয়াল'," কুন্দন জানায় । এর পরের বুগিয়াল নাকি `ভুলকোনা' । ওখানেই হবে আজকের যাত্রা শেষ । প্রায় সন্ধে হয়ে যাবে নাকি সেখানে পৌঁছতে ।
চাপ-চাপ ঘাসের জঙ্গল ; ত্রক্রমশ গভীর হচ্ছে । হাত দিয়ে ঘাস সরিয়ে সরিয়ে যেতে হচ্ছিল । মেঘের ফাঁকে এক ঝলক রোদ । রবীন ক্যামেরা-বুকে অনেকক্ষণ ধরে সুযোগের সন্ধানে যাতে খিমলোগার মুখ ক্যামেরায় ধরে রাখতে পারে । পারছিল না । এবার কিন্তু এসুযোগ আর হাতছাড়া করেনি সে ।
ম্লান অপরাহ্ন । ঘাসের মাথায় পড়ন্ত রোদের আভা । সূর্যাস্তের আগেই নাকি পৌঁছে যেতে হবে ভুলকোনায় । মূর্তিরাম বলে দিয়েছে । না-হলে পথ চলতে অসুবিধে হবে রাত হলে । বিশেষত এই ঘাস ঠেলে । তত্পর হই সকলে । ক্লান্ত দু'খানা পা আবার সচল হয়ে ওঠে । প্রয়োজনের তাগিদে ।
খুব কম করেও প্রায় আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার পথ আমরা হাঁটলাম । ঘন্টা-দেড়েক লাগলো । উপত্যকা মতন জায়গাটা । চড়াই-উত্রাইয়ের বালাই ছিল না বিশেষ । ঘাসের বিস্তার কমে আসছে । পাতলা ঝোপঝাড় এখানে-ওখানে । সুপিনের সরু খাদ খুবই কাছে দেখা যাচ্ছিল ডানদিকে । ওপর থেকে নীচে গড়িয়ে নেমে আসছে বিচ্ছিন্ন কয়েকটা স্রোতের ধারায় । দেখলে মনে হয় যেন গলন্ত রূপো বা পারদ একসঙ্গে অনেকখানি ঢেলে দিয়েছে কে । তার পিছনে বরফের চালচিত্র -- খিমলোগার রজতকান্তি দেহ । বাঁ-দিকে রুক্ষ পাহাড়ের দেওয়াল মাথার ওপর উঠে গেছে । সবুজের প্রলেপ বর্জিত ।
সূর্য অস্ত যাচ্ছিল । দিনের আলোয় আলোয় সেদিনের যাত্রা শেষ হল সেখানেই । তরুণ ও মূর্তিরামের পরামর্শমতো তাঁবু ফেলার জায়গাও নির্বাচিত হল । পাহাড়ের গা ছেড়ে বেশ কিছুটা তফাতে খোলা আকাশের নীচে । জলের অভাব নেই । পাহাড়-নামা ঝরনা ভাসিয়ে দিচ্ছিল চারদিক । পরিষ্কার নুড়িনাড়া বালির মধ্যে দিয়ে চূঁইয়ে আসা জল । অসুবিধা হবে না ।
!---
[ছবি ১৯ ভুলকোনার ঘাসের মাঠে রাতের তাঁবু পড়েছে ।]---
রবীন, স্বপনের তদারকিতে তাঁবু খাটানোর পর্ব শুরু হল । কুন্দন সিং পিট্টু খুলে জারিকেনগুলো বার করে । কুলিদের দিয়ে জল আনানোর ব্যবস্থা করে সেও এসে হাত লাগায় তাঁবু খাটাতে । তিনখানা তাঁবু পাশাপাশি পড়বে । কুলিদের জন্য মোটা প্লাস্টিক সিট খাটানো হবে টান টান করে দড়ি বেঁধে । সেখানেই হবে রান্না ও থাকা ।
পাথরের এক চাঙড়ের ওপর এসে বসি । দেখি তাঁবু খাটানোর কৌশল । কত পরিপাটি করে তাঁবু খাটিয়ে ফেললো কুন্দন । স্বদেশি, বিদেশিদের সঙ্গে নানা পর্বত-অভিযানে গিয়েছে সে । অনেক অভিজ্ঞতা তার ।
আমার পায়ের কাছ থেকে শুকনো ঘাসের টুকরো ঠোঁটে করে নিয়ে উড়ে পালাল একটা পাখি । নিভাঁজ কালো পাথরের ফাটলে গিয়ে ঢোকে । বাসা বাঁধছে বোধহয় । লোকালয়ের অন্তরালে ওরা বাসা বাঁধে । এরপর বাসায় ডিম পাড়বে । ছানাকে পালন করবে । শক্তপোক্ত করে তুলবে । নিরাপত্তা বোধ ওদেরও আছে । কী মনুষ্যসমাজে -- কী প্রাণীজগতে ।
পশ্চিম-আকাশ রাঙা করে সূর্য অস্ত গেল । অস্তশেষের আভায় সবকিছু ঈষৎ রক্তিম । খিমলোগার মাথায় রক্তচন্দনের ছিটে । সুপিনের শুভ্র বর্হিবাসে সিঁদুরের স্পর্শ ।
সাজ-সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে ঝুরো পাথরের ওপর প্লাস্টিক বিছিয়ে চা বানাতে বসলো স্বপন । একটানা স্টোভ জ্বলার শব্দ । চামচ, গ্লাসের টুংটাং বেশ লাগে কানে । চাতক পাখির মতো শুকনো গলা । ধোঁয়া বার হওয়া স্টেনলেশ স্টিলের গ্লাস ভর্তি গরম চা ভাবতে দারুণ লাগে । সারাদিনের নিরবচ্ছিন্ন পায়ে চলা । শ্রান্ত ক্লান্ত দেহ । অপরাধ দেওয়া যায় না ।
পাথর সাজিয়ে উনোন তৈরি করছিল কুলিরা । একরাশ শুকনো ঘাস এসে পড়েছে । আটার ডেলা থেবড়ে থেবড়ে ওরা চাপাটি বানাবে আগুনে সেঁকে । ডাল বানাবে । কাঁচা পেঁয়াজ রসুন । কত অল্প চাহিদা । আকাঙ্খার লেশমাত্র নেই । ক্ষোভ খেদ সে তো দূরের কথা । হয়ত তারা তা জানেও না । কিন্তু নির্দ্দিষ্ট পাওনাটুকু তাদের মিটিয়ে দিতে হবে । সেটুকু তাদের চাই । সেখানে তারা আপোষ করতে জানে না । শঠতা বঞ্চনার শিকার হলেই তারা কিন্তু ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে । প্রচণ্ড প্রতিবাদে ফেটে পড়ে । অসত্য অন্যায়ের ক্ষেত্রে তারা শক্ত মজবুত ।
সন্ধ্যার ছায়া নামছিল সারা পাহাড় জুড়ে । পশ্চিম-আকাশে সবে ওঠা তারার ঝিকমিক । হাওয়ায় ছিল হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডার আমেজ । চুপচাপ বসে থাকি । মনে পড়ছিল বিগত জীবনের কত পাহাড় পরিক্রমার কথা । সহায়হীন, সম্বলহীন আয়োজনহীন সে-যাত্রা । ছিল শুধু পায়ের উদভ্রান্ত গতি । অজানা পথ অচেনা পরিবেশ । কেমন করে মানিয়ে নিয়েছিলাম আজ আর তা মনে পড়ে না । তবু ছুটেছিলাম রুদ্ধশ্বাস অদেখাকে দেখতে । ভাল লাগতো ।
পিঠে কার যেন হাতের স্পর্শ পেলাম । চমকে উঠি ! চেয়ে দেখি, আবছা অন্ধকারে তরুণ । মোটা চাদরে আগাগোড়া ঢেকে দাঁড়িয়ে । -- "কী ভাবছেন, বসে বসে অমরদা !" তরুণ প্রশ্ন করে স্বাভাবিক কন্ঠে । একটু সরে বসে তাকে পাথরের একধারে বসতে বলি ।
-- " না এমন কিছু নয়, সেসব দিনের পাহাড় যাওয়ার কথা ভাবছিলাম । কত তফাৎ হয়ে গেছে এখন ।" আস্তে আস্তে বলি ।
-- "ঠিকই বলেছেন । যদিও খুব বেশি ঘোরাঘুরি এখনও করিনি, তবু যেটুকু হয়েছে তাতে একটা সুস্থ নজির পেয়েছিলাম সে-সময় । কিন্তু এবারে অত্যন্ত ব্যথা পাচ্ছি মনে মনে ।" তরুণের ম্লান গলা ।
-- "হ্যাঁ, সে তো বুঝতে পারছি । এখনকার ছেলেরা নিজেদের অত্যন্ত বুদ্ধিমান, চালাক বলে মনে করে । কিন্তু ওরা জানে না, ওদের ভবিষ্যত এতে কতটা অন্ধকার হয়ে যাবে । সে জ্ঞান ওদের নেই ।" সংক্ষিপ্ত ভাবে জানাই ।
-- "এতই চতুর, প্রথমটা আমাকে কিছু জানতেই দেয়নি । পরে স্বরূপটা আস্তে আস্তে জানা গেছে । আমাদের অসহায়তার মস্ত একটা সুযোগ সে নিয়ে নিল । এসব জায়গায় কুলি, গাইড ছাড়া কী করবো বলতে পারেন ? এক পাও যাওয়া যাবে ?" তরুণের গলায় ক্ষোভের সুর ।
-- "সত্যি, এপথে আগে কেউই এসেছে বলে মনে হয় না । সেটা বুঝেই সে এই সুযোগ নিয়েছে । কেন না অন্য কেউ তো জানে না এ-পথের হদিশ । সুতরাং সে বুঝেছে সেই হচ্ছে এ-পথের একমাত্র কাণ্ডারী," বলে উঠি ।
-- "ঠিকই বলেছেন, নাহলে অমন মেজাজি কথাবার্তা বলে ? এসব তো প্রচার হবেই । তখন ওর গাইডেন্সে কেউ আর যেতে চাইবে ?" তরুণ বলে ওঠে ।
-- "বললাম তো, কিছু টাকার মুখ চেয়ে নিজের কবর সে নিজে খুঁড়ছে । ভাল কী হয় ?"
জলন্ত স্টোভের সামনে স্বপনের মুখখানা এখান থেকে দেখা যাচ্ছিল । ফর্সা ধবধবে মুখ ওর লাল হয়ে উঠেছিল । ডেক্চিতে খিচুড়ি ফুটছে । পাশেই গামলায় একরাশ পাঁপর সেঁকা । বুঝতে অসুবিধা হয় না আজ রাতের খাদ্যতালিকা ।
তাঁবুর মধ্যে বাতি জ্বালা হয়েছে । প্লাস্টিক, কেরিমেট বিছিয়ে সুখদায়ক শয্যারচনাও সম্পূর্ণ । আসা অবধি বিমলবাবুর কোনও সাড়াশব্দ নেই । সেই যে এসে কম্বলের মধ্যে ঢুকে তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁর আর বর্হিগমন হবে কিনা সন্দেহ । বাতির অনুজ্জ্বল আলোর সামনে খোলা মেডিকেল জার্নালের পাতা ওল্টাছিল সুধাংশু । উঠতি চিকিত্সক । পাশের ক্যাম্পে শুধু চিত্কার, চেঁচামেচি । রাজা, পার্থ, রবীনদের তাসের আড্ডায় হুলুস্থুল কাণ্ড । বাজি জেতার মহোল্লাস ।
রাতের ভোজনপর্ব সকাল সকাল চুকিয়ে নিতে হল তরুণের অনুরোধে । কেননা আগামী কাল থেকেই সিংকা পাসের পথে আমাদের প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটবে । সুতরাং সকাল সকাল যেমন শুয়ে পড়া দরকার তেমন সকাল সকাল ওঠাও দরকার । তাঁবু খোলা রান্নার সাজপাট গুছিয়ে নিয়ে প্যাকিং করা বাঁধাছাঁদা অনেক কাজ । চা, ব্রেকফাস্ট এসবও আছে । বিশজনের টিমওয়ার্ক । বড় সহজ কথা নয় ।
রান্না যদি শিল্পর হয় তা হলে সে শিল্পনৈপুণ্যে স্বপনের যে দক্ষতার উন্নতি ঘটেছে তা এককথায় বলা যায় । কেননা রান্নার যাবতীয় উপাদানের স্বল্পতায় রান্নায় যে স্বাদুতা আনা যায় সে কৌশল বা যাদু এখন তার হাতে । মানে করায়ত্ত । যদিও প্রাত্যহিকিতে একই আহার্য বস্তুর সাড়ম্বর ঘোষণা, তবুও হাতের কৌশলে সে খাদ্যবস্তু বিভিন্ন স্বাদে স্বাদু হয়ে উঠেছে । গতরাতে রামশরণবাবুর বাড়িতে যে-প্রণালীতে খিচুড়ি নামক ভোজ্যবস্তুটি প্রস্তুত হয়েছিল, তার স্বাদগন্ধের তুলনায় আজ খোলা আকাশের নীচে পশুচারণ ক্ষেত্রে তাঁবুর মধ্যে তৈরি খিচুড়ির স্বাদগন্ধর কোন অংশেই কম বলা যায় না । গতকাল রামশরণবাবুর গৃহে প্রস্তুত ঘি-মাখনের সমন্বয় সাধন ঘটেছিল আহার্যবস্তুতে আজ কিন্তু যদিও সে সমন্বয় ঘটেনি তথাপি খিচুড়ি পদার্থটি যথার্থ উপাদেয় হয়েছিল । এ কী শিল্পীর হস্ত কৌশল, না অন্য কিছু ?
হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায় বাতির স্বপ্নালোকে স্টিলের থালার কানা ভর্তি উপাদান যখন পরিপূর্ণভাবে গলাধ:করণ হল, তখন পরিতৃপ্তির একটি মাত্র শব্দ উচ্চারিত হয়েছিল কন্ঠে -- `চমত্কার'। মনে মনে স্বপনের বাহাদুরিকে তারিফ করেছিলাম ঠিকই তবে পুরস্কৃত করতে পারিনি, কেননা সে পুরস্কারের বাইরে । পাহাড় পদযাত্রায় অগম্য দুর্গমতার চরম স্থানে পৌঁছে, কুটিল আবহাওয়ার অসহ্য প্রতিকূলতা সহ্য করে তাকে যে শ্রম নিবেদন করতে হয় তার বিকল্প নেই । তাকে কী দিয়ে পুরস্কৃত করা হবে ?
তাঁবুর বাইরে পড়ে থাকা সেই পাথরের ওপর আবার এসে বসি । সিগারেট ধরাই । ছেঁড়া ছেঁড়া এক আকাশ মেঘ । চাঁদ উঠেছে । ঘোলাটে জ্যোত্স্না । খিমলোগাকে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল । ম্লান আলোর আবর্তে কেমন মায়াময় । সুপিন আর চোখে পড়ে না এখান থেকে । শুধু তার গলার মৃদুসুর কানে আসে । নিশ্চুপ প্রান্তর যেন বোবা হয়ে গেছে । বিরাট শূন্যতা । প্রাণহীন, অস্তিত্বহীন বলে মনে হয় । চুপ করে বসে থাকি ।
আগামী কাল হবে নাকি সিংকার অনুপ্রবেশ পথের প্রথম পাদস্পর্শ । জানি না সে পথ কেমন । কত দুর্গম -- কত দুস্তর ! শুধু কানে এসেছে কটি কথা, "বাবুজী, বহুৎ খতরনক ওহি জায়গা "।
তবে ঠিক নির্বিঘ্নে বলা সঙ্গত হবে না । মাঝরাতে ঝির ঝির করে বরফ পড়া শুরু হয়েছিল । তবে বেশিক্ষণ ধরে হয়নি ভিজে গিয়েছিল তাঁবু । রোদ না উঠলে শুকোবে না । থার্মোমিটারে পারদের স্তম্ভ নেমেছিল পাঁচ ডিগ্রিতে । তাঁবুর মধ্যে ঝুলন্ত থার্মোমিটারটা একবার উঁকি মেরে দেখেছিলাম ।
তাঁবু ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসি । ঝরঝরে পরিষ্কার সকাল । প্রথম নজরেই খিমলোগাকে অপরূপ লাগলো । রোদের আলতো ছোঁয়াচ এসে লেগেছে মাথায় । রোদের প্রতিফলন ঘটছে সেখানে মুর্হূমুর্হূ । বর্ণালির কেমন একটা ছন্দের কাজ চোখে পড়ছিল কেবলই । সুপিনের জলধারার ওপর জমে থাকা সাদা বরফের সর চোখে পড়ছিল স্পষ্ট । সকালের হালকা হলুদ রোদে সারা ঘাসের মাঠ প্লাবিত । কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘাসের ডগাগুলো কাঁপছিল থর থর করে । পাতলা বরফের স্তর জমে আছে এখানে ওখানে । একটু বাদেই রোদের তাপে সব গলে মিলিয়ে যাবে । কিছু আর থাকবে না ।
স্টোভর শব্দ কানে আসছিল তাঁবুর ওপাশে মাথায় খাটানো প্লাস্টিক সিটের তলা থেকে । স্বপনের সংসারে চা-প্রস্তুতির পর্ব শুরু হয়েছে । বিমলবাবু তাঁবু ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছেন রোদ পোয়ানোর উদ্দেশ্যে মনে হল । তরুণের তত্পরতার শেষ নেই । মুক্তিরামের সঙ্গে আবার কীসব পরামর্শ চলছিল ।
সিংকার উদ্দেশ্যে আজ হবে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ । জানি না অভিষ্ট সিদ্ধ হবে কিনা । তরুণের এ-বছরের পরিকল্পিত যাত্রা । গাড়োয়াল হিমালয়ের মানচিত্রের অনেক রেখার হিজিবিজি ঘেঁটে ঘেঁটে এই পথকে সে নির্বাচন করেছিল । অটুট সিদ্ধান্ত আর তারই ফলশ্রুতি এবারে এ-পথের অভিযান । বিদ্যুতের সর্বাঙ্গীন উদ্যোগ আয়োজন আর আমাদের সহযোগিতা । জানি না শেষ পর্যন্ত কোথায় এসে পৌঁছবে ?
কুন্দন সিং ও রবীন এক এক করে তাঁবুগুলো খুলে ফেলছিলো । সাজ-সরঞ্জাম, এটা সেটা বাঁধাছাঁদার কাজও প্রায় শেষ । আমূল দুধের সঙ্গে চিনি আর কর্নফ্লেক্স দিয়ে ব্রেকফাস্ট করালো দলপতি । সপ্রতিভ অভিজ্ঞ যুবক তরুণ । কঠিন যুদ্ধের সঙ্গে মুখোমুখি হবার প্রাক্কালে সেনানিকূলকে বোধহয় এইভাবেই চাঙ্গা করতে চায় সেনাপতি । মনে মনে ধন্যবাদ দিই তাকে ।
`ভুলকোনা' বুগিয়ালের পাততাড়ি গুটিয়ে নিলাম আমরা । সকালের প্রথমার্ধ । ঝলমলে রোদ । কুলিরা এগিয়ে গেছে যে যার মতো । কুন্দন সিংকে নিয়ে মূর্তিরামও । আবার সেই পায়ের তলায় উলের মতো নরম গুল্মের কার্পেট । তারই ওপর এদিকে সেদিকে মস্ত মস্ত ঘাসের ঝাড় । সেই ছাগল ভেড়া গুজরদের পায়ে পায়ে তৈরি সুতোর মতো পথ । পথ কখনো ওপরে উঠছে কখনো নামছে । ছোট ছোট রিজের মতো মনে হচ্ছিল । ঝরনার সেই একই দুরন্তপনা । পা ভিজিয়ে দিচ্ছিল । প্যান্টের তলা, জুটো মোজায় কাদা মাখামাখি । পথের গা-লাগোয়া পাহাড়ের ঢালে বিশাল এক ফাটল -- পাহাড়ি গুহার রূপ নিয়েছে । গুজরদের রাত্রিবাসের পরম নিশ্চিন্তের আস্তানা । ওরা ওখানে থাকে । রান্না করে । খায়-দায় । আবার মাসের পর মাসও কাটিয়ে দেয় । পশুর পাল নিয়ে । গ্রীষ্ম, বর্ষা কেমন কেটে যায় তাদের ওপর দিয়ে । অদ্ভুত ওদের জীবন, অদ্ভুত ওদের জীবিকা । পশুদের লোম ছাঁটাই হয় মাঝে মাঝে । কিলো ওজন দরে সে লোম বিক্রি হবে । লোম ব্যবসায়ীরা লোম কিনতে আসে এখানে তাদের কাছে । সঙ্গে থাকে লোম ছাংআঁটাই মেশিন । লোম মোটা দরে বাইরে চলে যায় । উল তৈরি হয় । কম্বল, কার্পেট বোনা হয় । শালও হয় । আবার পালের পশুও বিক্রি হয় মোটা টাকায় । ভারবাহী প্রাণীরা তো ভার বয় । দুধ থেকে ঘি, মাখন তৈরি হয়ে বাজারে যায় । এসব অঞ্চলের অনেক জায়গায় মাখনের কারখানাও আছে । সংসারের, সমাজের একাংশের অর্থনৈতিক দিকটা বজায় থাকে এদের পশুপালনের ওপর নির্ভর করে ।
বেলা বেড়ে চলে ।
[ছবি ২০ ভুলকোনা বুগিয়াল ছেড়ে নিশানী তৃণভূমির উদ্দেশ্যে ।]
আমরাও এগিয়ে চলি । একসময় মনে হল ঘাসের মাঠ বোধ হয় শেষ হয়ে গেল । কিন্তু না । ফাঁকা মতো খানিক পথ ফেলে এসে নজরে পড়ল আরও সুন্দর সবুজ এক ঘাসের মাঠ । ঘাসের যেন শেষ নেই এ পথে । ঘাসের এ বুগিয়ালের নাম `নিশানী' । তরুণ বলে ওঠে । ওকে কুন্দন সিং বলেছিল, নিশানী বুগিয়ালই নাকি এ পথের শেষ চারণভূমি । তারপরই পাথরের রাজত্ব ।
!--
[ছবি ২১ তৃণভূমি নিশানীর হলুদ আঁচলে ।]--
নিশানীর ঘাসের-মাঠের রূপের তুলনা ছিল না । ভিতরে ঢুকতেই চোখ জুড়িয়ে গেল । এ-যেন সেই রূপকুণ্ড যাবার পথে `বৈদিনী বুগিয়াল' এর মতো । রূপকুণ্ড যাবার আগে বারহাজারী পথের মাথায় বৈদিনীর পশুচারণ ক্ষেত । এইপথে নিশানীর উচ্চতাও বার হাজার ফুটের মাথায় । নীল আকাশের নীচে বৈদিনীর ঢেউ খেলানো বিশাল প্রান্তর যেমন দিগন্তে গিয়ে মিশেছে বলে মনে হয়, নিশানীর বিস্তৃতি অত বিশাল না হলেও অপরূপত্বে কম যায় না । বৈদিনীর প্রচারের ঘটা আছে । বহু অভিযাত্রী, পদযাত্রী, হিমালয়প্রেমী মানুষজন প্রতি বছরই ওপথে যাতায়াত করে, কিন্তু এপথে কেউই আসে না । কিছু স্থানীয় গুজর সম্প্রদায় ও পশুপালকের দল এ চারণ ক্ষেতের কেবল সন্ধান রাখে । বৈদিনীর চারণ ক্ষেতে আসে দূর-দূরান্তের পাহাড় অঞ্চলের গুজরেরা হাজার হাজার পশুর পাল সঙ্গে করে । মাসের পর মাস কাটে তাদের খোলা আকাশের তলায় । এখানে গুজরদের সংখ্যা অত না হলেও পশুর সংখ্যা নেহাৎ কম নয় । রূপবৈচিত্রে বৈদিনী যেমন, নিশানীও তেমনই দৃষ্টিনন্দন । ঢেউ-খেলানো চারণভূমি উত্তরে মিশে গেছে খিমলোগার চরণে । পূর্বাংশ মিশেছে সুপিনের অঙ্গে অঙ্গে । পশ্চিমে আকাশছোঁয়া পাহাড়ের পাঁচিল । নিশানী সত্যিই অনন্যা । গাঢ় সবুজ আস্তরণ রেশমের মতো নরম । স্পর্শের অনুভূতিতে যেন রোমাঞ্চের শিহরণ লাগে । ফুলের ঘর বসে গেছে সারা প্রান্তর জুড়ে । লাল, নীল, হলুদ -- অজস্র ঝরনার জলধারা তার বুকে । যেন রমনীর পিঠময় খোলা এলো চুলের রাশ ।
!--
[ছবি ২২ সুপিনের কূল ছোঁয়া নিশানী বুগিয়াল ।]--
পথ চলি আর ভাবি, এত রূপের যিনি রূপকার তাঁর খেলাঘরে এ রূপবৈচিত্র্য থেকে মানুষের দৃষ্টিকে কেন ফাঁকি দিলেন বুঝতে পারি না । এ রূপের সমঝদার কে হবে ?
!--
[ছবি ২৩ পায়ের তলায় নিশানী তৃণভূমি - দিগন্তে খিমলোগার ছায়া ।]--
রবীন, সুধাংশু, রাজা এরা আশ মিটিয়ে ফটো তুলছিল হিমালয়ের সেই অজানা, অচেনা, প্রচারহীন এক রূপময় তৃণপ্রান্তরের । এগিয়ে চলি আরও গভীরে । ঝরনার পাগলামির শেষ নেই । খামখেয়ালি দুষ্টু মেয়ের মতো কেবলই পায়ে পায়ে জড়াচ্ছে । যেদিকেই চেয়ে দেখি সেদিকেই ঘাসের মাথাগুলো কেবলই দুলছে । তলায় চাইলেই চোখে পড়ে ঝরনার জলধারা ঘাসের গা ছুঁয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে ।
অনেক সময় নিয়ে অনেক পথ চলে এসেছি । এবারে বোধ হয় পথ শেষ হয়ে আসছে । চোখে পড়ে ঘাসের প্রান্তর কেমন রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে রুক্ষ পাথুরে প্রান্তরে । ঘাস, গুল্মের অস্তিত্ব কেমন কমে কমে যাচ্ছে বেশ বোঝা যায় । একসময় প্রান্তরের মাথা মনে হল যেন লাফিয়ে উঠে গেছে ওপরে । যেখানে আছে শুধু নিরস পাথরের স্তূপ একের পর এক ।
!--
[ছবি ২৪ নিশানী বুগিয়াল ছেড়ে রায়মূলা পাশের পথে ।]--
পশ্চিমে পাহাড়ের পাঁচিল যেখানে বাঁক নিয়েছে উত্তরে সেই পাহাড়ের নীচে মূর্তিরাম ও কুন্দন সিংকে বসে থাকতে দেখলাম । বসে বসে ওরা বিড়ি খাচ্ছিল । কাছে আসতেই মূর্তিরাম বলে ওঠে, "সিংকা কলের রাস্তা এবার এখান থেকে ঘুরে গেল । বুগিয়াল খতম হয়ে গেছে ।" জিজ্ঞাসা করলাম, "যাবার রাস্তা তো দেখতে পাচ্ছি না মূর্তিরাম ?" পাহাড়ের ঢালের দিকে হাত তুলে সে দেখিয়ে জানাল, "এই তো সড়ক বাবুজী ।" তার হাতের ইঙ্গিতে যা বুঝলাম, তাতে প্রমাদ গণেছিলাম সেদিন । পাহাড়ের খাড়াই ঢাল দেখে বুক কেঁপে উঠেছিল । রুক্ষপাথর, তার ওপর শুকনো গুল্মের স্তর । মাঝে মধ্যে পাথরের গায় শুকনো ঘাসের ঝাড় । পাহাড়ের দেওয়াল আকাশ ছুঁতে চাইছিল ।
বসে পড়ি সামনে পড়ে থাকা একখানা পাথরের চাঙড়ের ওপর । মাথার ওপর সূর্য এসে দাঁড়িয়েছে । তবু রোদে উত্তাপ নেই । এত শীতে ঘামছিলাম । রাজা, রবীন কুলিদের পিছন নিয়েছে । মূর্তিরাম আমাদের তাড়া দেয় । -- "বাবুজী, ওপরে মৌসম খারাপ হতে পারে । উঠে পড়ুন ।" সত্যিই তো । মৌসমের কথা খেয়াল ছিল না । উঠে পড়ি । পার্থ, নীলাদ্রি পাহাড়ের গা বাইতে শুরু করেছে । স্বপন, শুধাংশু, বিমলবাবুও । আমিও শুরু করি । তরুণ, কুন্দন, মূর্তিরাম সবাই পিছনে ।
মামুলি ঢাল পাহাড়ের । অসুবিধা কিছু নেই । ঘাস, গুল্মের গোড়ায় পা রেখে অনেকটা উঠে এলাম । পিছনে চেয়ে দেখি । অনেক রূপান্তর ঘটে গেছে কিছুক্ষণ আগে নীচে যা দেখে এসেছিলাম । খিমলোগার বরফের মাথা এখান থেকে আর দেখা যাচ্ছে না । আড়ালে চলে গেছে । সুপিনের রূপোলি রেখাও প্রায় অদৃশ্য । মাঝেমধ্যে বরফের শুভ্রতা চোখে পড়ছে একটু আধটু । আমাদের পাহাড়ের পায়ের তলা কেমন ঢালু হয়ে গড়িয়ে নেমে গেছে নীচে ।
ঘাসে পা রেখে রেখে উঠছি । মামুলি ঢাল এখন আর নেই । অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে । বিমলবাবু দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন মাঝে মাঝে । নীলাদ্রিও তাই । পার্থ ওকে ছেড়ে আরও অনেক ওপরে উঠে গেছে । স্বপন, সুধাংশুও বেশ ওপরে । রবীন, রাজাকে আর দেখতেই পাচ্ছি না । চোখের বাইরে চলে গেছে ।
পাহাড়ের ঢালের অবস্থা আস্তে আস্তে যে বেশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে বুঝতে পারছিলাম । বিপজ্জনক পরিস্থিতি । ঘাসের ঝাড় ছাড়া ধরার আর কিছু নেই । মাঝেমধ্যে পাথরের বেরিয়ে থাকা অংশ চোখে পড়ে । তাও আবার সব জায়গায় মেলে না । তবু তাই ধরে ধরে উঠি যতটা পারি । কখনও শুকনো ঘাসের গোছা শক্ত করে মুঠোয় ধরে উঠতে হচ্ছে । অসম্ভব সময় লাগছে উঠতে । কিছুটা উঠি আবার দাঁড়াই । খানিক বিশ্রাম নিই । ওপরের দিকে চাইতেই চোখে পড়ে বাঁদিকের পাহাড়ের দেওয়াল আরও ওপরে উঠে গেছে । আকাশকে মনে হচ্ছে ছুঁয়ে ফেলবে । কী ভয়ঙ্কর রূপ তার ! সবুজের এতটুকু স্পর্শ নেই সারা গায় । রুক্ষ, গেরুয়া রঙ পাথরের । ক্ষয়ে যাওয়া পাথর ঝুরে পড়েছে কোথাও কোথাও গা থেকে । কেমন অদ্ভুত ঠেকে চোখে !
মৌসমের কথা হঠাৎ মনে পড়ে । দাঁড়াতে সঙ্কোচ হয় । আবার ঘাসের আগা শক্ত করে ধরি । কতটা ওপরে উঠে এসেছি জানি না । আরও কত উঠতে হবে তাও জানি না । শুধু পলকের জন্যে ওপরের দিকে চাই । মাথা ঘুরে যায় । শিরাগুলো টন টন করে ওঠে । চোখ বুজিয়ে থাকি ।
অবস্থা ত্রক্রমশ খারাপ হতে থাকে । ঢালের যা পরিস্থিতি ওপরে পা তুলতে আর সাহস হয় না । কেবলই মনে হচ্ছে শুকনো ঘাসের গোড়া যদি উপড়ে আসে, পা যদি না থাকে ঘাসের ওপর । চিন্তা করা যায় না, কী ঘটে যাবে মুহূর্তে !
নীলাদ্রি কাঁদছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । এক পাও ওপরে আর উঠতে পারছে না । ওপর থেকে দেখতে পাই । মাধ্যমিকের ছাত্র সে । নৈহাটিতে থাকে । রাজাই ওকে এনেছে । বেচারা নতুন এসেছে পাহাড়ে সেখানের কী রহস্য তাও সে জানে না । আর তার পক্ষে প্রথম পাহাড়ে আসার এই কঠিন পরীক্ষা । ভাবাও যায় না ।
বিমলবাবুও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে । যেখানে ছিলেন ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছেন । প্রবীণ মানুষ পাহাড়ে ঘুরেছেন, চিন্তা-ভাবনা আছে । যতটুকু সক্ষমতা ততটুকুই এসেছেন । তারপরই অক্ষম হয়ে পড়েছেন । হটকারিতা করেননি । বুঝেছেন কারও সহায়তা ছাড়া এ দুর্গম গিরি লঙ্ঘন করা অসম্ভব । তাই তিনি সহায়কের আশায় দাঁড়িয়ে আছেন । ভালই করেছেন ।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবি শুধু আবহাওয়ার কথা । হিমালয়ের অনিশ্চিত আবহাওয়া । ক্ষেপা পাগলের মতো । কখন কী করে, কখন কী ঘটায় বোঝাবার উপায় নেই । অদেখা সেই ভয়ঙ্করের কথা ভাবি ।
সাহসের ভিতে দাঁড়িয়ে আবার পা দিই আরও এক ধাপ ওপরে । ঘাসের মুঠি সজোরে ধরেছি । দমবন্ধ রুদ্ধশ্বাস পাহাড় ভাঙা ।
কতক্ষণ এভাবে উঠেছি মনে নেই । মনে পড়ে ওপরে মানুষের কন্ঠস্বর । কুলিদের বলেই মনে হল । তারপর রাজার গলায় আবৃত্তির সুর । ওরা পৌঁছে গেছে ওপরে ।
ঢালের শেষাংশের খাড়াই এমন কঠিন যে চার-হাত পায়ে বুক দিয়ে বেয়ে উঠতে হয়েছিল । প্রায় চার-ঘন্টার মতো জীবনমরণ পরিশ্রম । তাই মনে হয়েছিল কেউই আসেনি
এ-অঞ্চলে । এলে পথের সামান্যতম রেখাও ফুটে উঠতো পাহাড়ের গায় । আমরা যে সম্পূর্ণ অজানা, পরিচয়হীন নতুন এক পথে আসছি ত্রক্রমশই সে ধারণা শক্ত হচ্ছিল মনে ।
!--
[ছবি ২৬ সুপিনের উত্স মাথায় খিমলোগার রজতমুকুট ।]--
পাহাড়ের শেষ অংশ বেশ সমতল মতো । তবে খুবই সংকীর্ণ পরিসর । কুলিরা এক সঙ্গে গোল হয়ে বসতে পারেনি । পাশাপাশি গা ঘেঁসাঘেঁসি করে বসেছিল । পেছনে আবার গভীর খাদ । তাই জায়গার আকার সম্পূর্ণ রিজের মতো । ১৩,০০০ ফুটের মতো উঁচু । রিজের মাথায় এসে মনে হল যেন অন্য এক জগতে এসে পৌঁছেছি । মাথার ওপর সম্পূর্ণ খোলা আকাশ । টুকরো টুকরো মেঘের আভাস । পশ্চিম ও উত্তরে দুর্ভেদ্য পাহাড়ের প্রাচীর অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে । পূবদিকে খিমলোগার অভ্রধবল চালচিত্র । আর দক্ষিণদিকে তো চাওয়া যায় না । পাহাড়ের নিম্নমুখী দেওয়ালের ঢাল কোথায় গিয়ে নীচে মিশেছে জানি না । শুধু চোখে পড়ে কুন্দন সিংয়ের হাত ধরে নীলাদ্রি উঠে আসছিল পাহাড়ের গা ধরে । আরও নীচে দেখতে পেলাম বিমলবাবুর হাত ধরেছে তরুণ । পিছনে মূর্তিরাম ।
কুলিদের কাছ থেকে জেনে রাজা এবার আমাদের আগামী পথের যে রেখাটা দেখাল আঙ্গুল দিয়ে তার মোটামুটি একটা ছন্দ আছে বলে মনে হল । রিজের পশ্চিম মাথা থেকে শুরু করে পথ পশ্চিমের পাহাড়ের গা ধরে গোল হয়ে উত্তরের পাহাড়মহলে গিয়ে মিশেছে । পথের ডানধারে বিশাল খাদ । পথের সমতা প্রায় এই রিজের সমতার মতই । সামান্য ওঠানামা । তেমন নাকি কষ্টকর নয় । খানিকটা আশ্বস্ত হই । ভাবি কষ্টের মধ্যে দিয়েই বোধ হয় সুখের অনুপ্রবেশ ঘটে ।
একে একে সবাই আগেপিছে করে উঠে এল ওপরে । বিমলবাবুর মুখের দিকে চাওয়া যাচ্ছিল না । তাঁর যে বেশ দমের কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারলাম । ঘামের ঝরনা নেমেছে সারা দেহে হিমালয়ের এই হাড় কাঁপানো শীতে । নীলাদ্রির চোখে বিস্ময়ের অগুনতি ঢেউ । ওপরে এসেই পার্থের সঙ্গে তার যে একটু খিটিমিটি লাগেনি তা নয় । আমাকে ফেলে সে একলা চলে এল ওপরে । আমার যদি কিছু হোত । নীলাদ্রির কাঁদ-কাঁদ মুখের অভিযোগ, অভিমান । পার্থ কথা বলে না । চুপ করে থাকে । হয়ত মনে মনে ভাবে তার বিরাট অন্যায় হয়ে গেছে ।
কুলিরা উঠে পড়ে এক এক করে । পিঠে মালপত্র, গাঁটরি । সার দিয়ে ওরা চলা শুরু করে গোল পথের মুখ থেকে । জৈষ্ঠ্যের ভরন্ত বিকেল । রোদের রঙে হলুদ মেশানো । সুধাংশু এই আলোর শুধু আশীর্বাদপ্রার্থী । তাই এ-সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় না । সমস্ত নিষ্ঠা সে ঢেলে দিয়েছিল এসব দুর্লভ দৃশ্যকে বন্দি করতে ক্যামেরায় ।
ভাঙা চোরা সংকীর্ণ পথ । পাথরে ঠাসা । মাথার ওপর ঝুলন্ত পাথরের চাঙড় । খুবই সন্তর্পণে চলতে হচ্ছিল । কিছুটা এগিয়ে আসার পর পথের সমতল ভাব আবার ফিরে আসে । পথের বৃত্তাংশের শেষে একসময় এসে পৌঁছই । সামনেই সমতল মতো বেশ খানিকটা জায়গা । সুন্দর ক্যাম্পসাইট হতে পারে । হলও তাই । কুন্দন এখানেই তাঁবু ফেলার কথা বলে ওঠে । সূর্যাস্তের এখনও দেরি আছে । তরুণ আরও কিছুটা এগিয়ে যেতে চেয়েছিল । কিন্তু কুন্দন রাজি হয়নি । সে বলেছিল এখানে সুন্দর একটা জলের কুণ্ড আছে । আরও এগিয়ে গেলে ওপরে উঠতে হবে । তাঁবু ফেলার জায়গা মিলবে না । সব থেকে বড় কথা -- জল তো নয়ই ।
তাঁবু এখানে ফেলা হবে পাকাপাকি সাব্যস্ত হবার পর কুলিরা পিঠের মালপত্র নামাতে শুরু করে । আমরা বসে পড়ি পাথরের ওপর যে যার মতো । জায়গাটা বৃত্তের আকার । ত্রিশ ফুটের পরিধি তো হবেই । এক অংশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে এক ধারে । সেখানে তৈরি হয়েছে এক ডিপ্রেশান । ছোটখাট কুণ্ড কাঁচের মতো জলে টইটুম্বর । ছোট ছোট নুড়ি, পাথর জলের তলায় । বসে বসে এখান থেকেই দেখা যায় হাল্কা সবুজ কচি কচি ঘাস কুণ্ডের চারধারে । রেশম নরম । হিমেল হাওয়ায় ঘাসের ডগা গুলো কাঁপছিল থর থর করে । বড় সুন্দর লাগছিল দেখতে । হিমালয়ের প্রান্তরে, অভ্যন্তরে এমন বহু ডিপ্রেশান বা কুণ্ড ও খাদ জলে বা বরফে পূর্ণ হয়ে থাকে । আবার শুকনো অবস্থায় পড়ে থাকে ।
!--
[ছবি ২৭ রায়মূলা পাশের নীচে রাতের আস্তানা ।]--
তাঁবুখাটানোর কাজে হাত লাগিয়েছিল কুন্দন সিং । রবীন এটাসেটার জোগাড় দিচ্ছিল তার হাতে হাতে । নরম ঘাস মাড়িয়ে মাড়িয়ে কুণ্ডের জলে চোখ মুখ ধুতে গিয়ে চমকে উঠি ! বরফ গলা জল । কিন্তু পরম তৃপ্তি । চোখ মুখ যেন জুড়িয়ে গেল । খোলা আকাশের নীচে মনে হয় প্রায়ই রূপান্তর ঘটে কুণ্ডের । কখনও বৈধব্যের রূপ, কখনও বা সাদামাটা । বরফ পড়লে বুক তার আচ্ছন্ন হয়ে যায় শুভ্রতায় আবার রোদের উত্তাপে বরফ গলে গলে তার নগ্ন রূপ আবার প্রকট হয় । এ রূপের খেলা চলে নিত্য নৈমিত্তিক ।
ঘটা করে স্বপন কফি বানিয়েছিল । সঙ্গে আনা চানাচুর । সেদিনের সান্ধ্য কফি পর্ব ইতি টেনেছিল সত্যিকারের এক তৃপ্তিকর পর্যায়ে ।
এখন থেকে আমাদের সঙ্গে রান্না হবে কুলিদেরও । কেননা পথেতে জ্বালানির অভাব । তাই ওরাও বসে গেছে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রান্নার কাজে । জল এসেছে জারিকেন ভর্তি হয়ে কুণ্ড থেকে । চাল, ডাল, আলু পেঁয়াজ বার করেছিল ওরা পিট্টু খুলে । পাঁপরের প্যাকেট, আমের টক আচারের বোতল । কেমন রুটিনমাফিক প্রাত্যহিকের ধারাবাহিকতা । একঘেয়েমির ধার ধারে না । সত্যি করে বলতে কি পাহাড় পরিক্রমায় এ মানসিকতার প্রয়োজন হয় । নাহলে কেউ পাহাড়ে আসতে পারবে না ।
বাতির মিটমিটে আলোয় তাসের আড্ডা জমে উঠেছিল রবীনদের ক্যাম্পে । চিত্কার, চেঁচামেচি, হৈ-হৈ । শেষ পর্যন্ত খেলা মুলতুবি । শেষ পরিণতি যা হয়েই থাকে । ওদেরও হল তাই ।
তরুণকে সেদিন শোনাচ্ছিলাম আমার জীবনের পাহাড়-পরিক্রমার অনেক কথা ও কাহিনী । ইদানীংয়ের সঙ্গে কত তফাৎ সেদিনের । না ছিল পাহাড় চড়ার শিক্ষা দীক্ষা, না ছিল ট্রেনিংয়ের বেসিক, এডভান্স এর জানা কোর্স, না ছিল সাজ-সরঞ্জাম, ভাল পোশাক-আসাক, কিছুই ছিল না । ছিল শুধু পাহাড়কে ভালবাসা । ছাত্রজীবন -- চল্লিশের দশক থেকে পড়েছিলাম হিমালয়ের প্রেমে । এরপর বাবার হাত ধরে হরিদ্বারে আসা । মনসা, চণ্ডী পাহাড়ের মাথায় ওঠা কাঠবিড়ালির মতো তর তর করে । তারপর পঞ্চাশের দশকে চাকুরি জীবন থেকে বার বার এসেছি হিমালয়ের অমলধবল মুখশ্রী দেখতে । বছরে একবার নয়, দুবার নয়, তিন-চার বার । দড়ি ছেঁড়া প্রেমের অমোঘ টানে । থাকতে পারিনি ঘরে । বিশেষ করে শরতের ময়ূরকন্ঠী আকাশে রোদের সোনা যখন মাখামাখি হয়ে যেত তখন পিঠে কে যেন চাবুক মারতো সপাং সপাং করে । বেরিয়ে পড় - বেরিয়ে পড় কে যেন অহরহ দুটো কান ঝালাপালা করে দিত । বেরিয়ে পড়তাম । পাথেয় কিছুই ছিল না, সাজপাটও তথৈবচ । সামান্য সম্বল নিয়েই হত সেসব দিনের যাত্রা । কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রীর আঁচলছায়ায় প্রতি বছরই যেতাম একবার করে । পঞ্চকেদার, সপ্তবদরীর অগম্য পথে গেছি বারবার । অমরনাথের দুর্গম পথযাত্রায় পর পর ন'বার গিয়ে রেকর্ড করেছি । জুতো চুরি হয়ে গেছে । খালি পায়ে অমরনাথ দর্শন করে নেমে এসেছি পঞ্চতরণীতে । কুলির কাছ থেকে জুতো চেয়ে নিয়ে পহেলগাঁয়ে ফেরা । তরুণ অবাক হয়ে চেয়ে থাকে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে ।
সিগারেট ধরাই, তারপর আবার শুরু করি বলতে । এরপর ষাটের দশকে অফিসের সহকর্মীদের নিয়ে দল বেঁধে পিণ্ডারী, সুন্দরডুঙ্গার দুর্গম প্রান্তরে মৃগথুনীর পায়ের তলায় গুজরদের ঝুপড়িতে রাত কাটিয়েছি তাদেরই সঙ্গে । মুক্তিনাথের পথে ঘাসায় সারারাত কেটেছিল ভেড়ার খোঁয়াড়ে । তাঁবু ছিল না । তাঁবু, পোশাক-আসাক যে ভাড়ায় পাওয়া যায় তাও জানতাম না । শুধু একটা উদ্দীপনা আর আবেগে ডুবে থাকতাম । সেই আবেগের টানে ছুটতাম এখানে-সেখানে । এরপর রূপকুণ্ড আমাদের টেনেছিল । সাতের দশকের গোড়ার দিকে । একটু তৈরি হয়ে নিতে পেরেছি সেসময় । তাঁবু ভাড়া করেছি, রুকস্যাকও । একহাঁটু বরফ ভেঙে রূপকুণ্ডের গহ্বরে ঢুকে অতীতের মৃতদেহের হাড়গোড় টেনে টেনে বার করেছি কুলিদের গালাগাল, ভত্সনা সহ্য করে । তারপর কুণ্ডের মাথায় জিউনার কল পার হয়েছি জীবন হাতে করে । তুমি শুনলে তবাক হয়ে যাবে তরুণ, পাহাড় আরোহণের কোনও শিক্ষাই আমার ছিল না ।
আকাশ অন্ধকার করে আসছে বলে মনে হল । কেমন সাঁই সাঁই করে একটা শব্দ কানে আসে । বৃষ্টি আসবে নাকি ? তরুণের মুখের দিকে চেয়ে থাকি । সে উঠে পড়েছে পাথর ছেড়ে । বৃষ্টি নামেনি । সন্ধ্যা নামার মুখে বরফ পড়তে শুরু হল । আমরা তাঁবুর মধ্যে গিয়ে ঢুকি ।
!---
[ছবি ২৮ রায়মূলা পাশের নীচে রাতের তাঁবুর মাথায় তুষারপাত ।]--
সাদা হয়ে যাচ্ছে সব । ঘাস, পাথর, কুণ্ড, তাঁবু সামনের পাহাড় সবকিছু সাদা হয়ে যাচ্ছে । তাঁবুর মাথায় আউটারের ওপর জমা বরফ তরুণ একবার ঝাঁকানি দিয়ে ফেলে দিল । আবার জমতে শুরু করে । তাঁবুর ফাঁক দিয়ে বাইরে চেয়ে দেখি কিছুই দেখা যায় না । ধোঁয়ার মতো মনে হল । সব ঝাপসা ।
শুয়ে পড়েছিলাম তাঁবুর মধ্যে । তরুণ মাঝে মাঝে তাঁবুর মাথার পর্দা ঝেড়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছিল । বিমলবাবু কম্বল মুড়ি দিয়ে অঘোরে ঘুমচ্ছেন বলে মনে হল । কতক্ষণ এভাবে কেটেছিল জানতেই পারিনি । ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । স্বপনের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙলে দেখি, বরফ পড়া বন্ধ হয়ে গেছে । সবাই খেতে বসেছে তাঁবুর মধ্যে । হাড়হিম ঠাণ্ডায় সেরাতের আগুনগরম খিচুড়ি সত্যিই অমৃতবৎ মনে হয়েছিল ।
আগামীকাল পথের অবস্থা কেমন থাকবে তা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল তরুণের সঙ্গে মূর্তিরামের । পাশে বসেছিল কুন্দন সিং । কুন্দনই বলে ওঠে, "অসুবিধা হবে না বাবুজী রোদ উঠলেই বরফ গলে যাবে । পথ পরিষ্কার হবে । তবে এদিক ওদিক কিছু বরফ তো থাকবেই ।"
তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসি । অসম্ভব ঠাণ্ডা । মনে হচ্ছিল সারা শরীরের রক্ত যেন জমে বরফ হয়ে যাবে । আকাশে চাঁদ উঠেছে । কেমন ঝাপসা ঝাপসা । ম্যাড়মেড়ে জ্যোত্স্নায় ঢেকে গেছে চারদিক । সামনের মাথা তোলা পাহাড় সাদা বরফের চাদরে মুড়ি দেওয়া । কেমন অদ্ভুত ভূতুড়ে ভূতুড়ে মনে হচ্ছিল । সামনের সমতল মতো জায়গা বরফে ঢেকে গেছে । তার ওপারে পাহাড়ের সেই গভীর অতল খাদ ঘন অন্ধকারে ঢাকা । কিছুই দেখা যায়না সেখানে । শুধু হিমেল হাওয়ার একটা শনশন শব্দ সব সময় কানে এসে বাজছিল । আর সেইসঙ্গে দূরে কোন পাহাড়ে অ্যাভালেঞ্চ পড়ার ভয়ঙ্কর শব্দও ।
রাত অনেক হয়েছিল । নির্জন পাহাড়পুরী । নিশ্চুপ প্রান্তর । একা জেগে আছি । অতীতের কত কথার জটলা মনের মধ্যে ঠেলে ঠেলে আসে । আবার হারিয়ে যায় । ধরে রাখতে পারি না । এই দুর্গমতা, এই দুস্তরতা, এত কষ্ট, এত অনিশ্চয়তা তবু এসব ভালবেসেই তো এখানে আসা । কী হবে আর কী হবে না, কী পাব আর কী পাব না তার চুলচেরা হিসাবনিকাশের মধ্যে মন যেতে চায় না । শুধু সুন্দরের অপরূপ অনুভূতির স্পর্শ বারে বারে মন পেতে চায় । মন পেতে চায় শুধু নতুনের আস্বাদ । শুধু নতুনের আশীর্বাদ ।
ফিরে আসি তাঁবুতে ।
[ক্রমশ:]