• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩৩ | এপ্রিল ২০০৪ | রম্যরচনা
    Share
  • কথার কথা : সোডা জল


    সকালবেলায় একটা অঘটন ঘটে গেছে ।

    খবরটা এনেছে গ্যাঞ্জাম । স্বাধীনতা দিবস বাবদ লোকজন নিয়ে কপিক্ষেতে পতাকা তুলতে এসেছিলেন সন্তোষ মিত্তির । মাল্যদান ও বাচ্চাদের প্যারেড শেষ হ'লে একটা মাউথঅর্গান আর জোড়া কেটলড্রামে জনগণমন বেজে ওঠে । সন্তোষ মিত্তির হাসিমুখে উঠে গুটিয়ে রাখা পতাকার দড়িতে টান দেন । তখনই কাণ্ডটা ঘটে । শ' দুয়েক বিস্ফারিত চোখের সামনে ফুল ছড়াতে ছড়াতে যে পতাকা উপরে উঠে যেতে থাকে, তার সাদা জমিতে কালো দিয়ে আড়াআড়ি দুটো হাড়ের মধ্যে হাসিখুশি একখানা খুলি আঁকা ।

    এরপর নাকি সন্তোষ মিত্তিরের মত পোড়খাওয়া লোকের হতভম্ব মুখেও কথা ছিল না । চলে যাওয়ার আগে তিনি নাকি তীক্ষণ সন্ধানী চোখে জটলার মধ্যে কাউকে খঁংউজেছিলেন, কিন্তু চম্পটকে সেখানকার ত্রিসীমানায় দেখা যায়নি ।

    মেজোদাদু এসব শুনে মৌনী হয়ে গেছেন । চোখ খুলে ধ্যানস্থ । দৃষ্টি সোজা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার ফঁংউড়ে চলে গেছে । ভাবগতিক ভালো বোঝা যাচ্ছে না । অন্যরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন । কে আর সাহস ক'রে মুখ খুলবে ?

    সত্যসাধনই একটা আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন - একটা খুলিমার্কা চিঠি এসেছিল না ক'দিন আগে ?

    সে তো গাংলু গ্যাঞ্জামও জানে । দিদিমা সে চিঠিতে সুপুরি মুড়ে কৌটোয় রেখেছেন ।

    কংকাবতী এদিক ওদিক তাকিয়ে আরেকটা ঢিল ছঁংউড়লেন - কাম্বুরিয়া যদি বখরা চায় দরদাম করলেই হয় ।

    অংকস্যার ঘাবড়ে গিয়ে বললেন - কিসের বখরা ?

    এর উত্তর কারোরই জানা নেই । অতএব এ লাইনে আর এগোনো গেল না । তবে অন্য দিক থেকে এগোলেও সুবিধে হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না । মেজোদাদুর কোন হেলদোলই নেই ।



    কিছুতেই যখন কাজ হয় না, তখন দিদিমাকে আসরে নামতে হয় । এটাই নিয়ম । বরাবরই এতে আশ্চর্য ফল পাওয়া গেছে । আজও তার ব্যতিক্রম হ'ল না । মেজোদাদুর সুদূর দৃষ্টি আস্তে আস্তে ফোকাস পাল্টাতে পাল্টাতে মালপোয়ার থালার ওপর স্থির হ'ল । গন্ধে গন্ধে মিচকের লেজও খাড়া হয়ে উঠেছে ।

    - তুচ্ছ চিঠিচাপাটি নিয়ে কে ভাবছে ? - মেজোদাদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন - ধূ ধূ সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ নিয়ে চলেছি, কামানে হাত বুলোচ্ছি, নীল আকাশে পতপত ক'রে করোটি উড়ছে - কতদিনের স্বপ্ন মোহন ! সাধ না মিটিল আশা না পুরিল ।

    এরকম হাহাকারের সামনে সকলেই হতবাক । যাই হোক, মেজোদাদুই করুণাবশত: একটা কামড় দিয়ে বোঝালেন মালপো ঠাণ্ডা ক'রে লাভ নেই ।

    - এই গ্যাঞ্জামটাকেই দেখো - কোন অ্যাম্বিশন নেই - মেজোদাদুর গভীর হতাশা - অরণ্যদেব পর্যন্ত হ'তে চায় না । কেউ বলবে এরা শিবাজি গান্ধীজির দেশের ছেলে ?

    কংকাবতী আচমকা বিষম খেয়েছেন । অন্যেরাও তথৈবচ । সত্যসাধন মিনমিন ক'রে বলেছেন - কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম গান্ধীজি অহিংসার পূজারী না কিসব -

    - হঁংউ: - মেজোদাদু মৃদু হেসেছেন - অহিংসার পূজো করতে সবসময় হাতে লাঠি নিয়ে ঘুরতে হয় নাকি ? ডাণ্ডা অভিযানের নাম পাল্টালেই কি সব চাপা দেওয়া যায় ?

    ওদিকে অংকস্যার উসখুস করতে শুরু করেছেন । মেজোদাদু সহানুভূতির গলায় বললেন - আর দুটো মালপো দিই মোহন ? এই রোমহর্ষক দিনে আর প্যাপিরাসের বিদঘুটে অংক নাই বা তুললে । গ্যাঞ্জামের কি জলদস্যুর কেরিয়ার হ'তে পারে মনে হয় ?

    অংকস্যার মালপোর ব্যাপারে আপত্তি ক'রে মেজোদাদুকে দু:খ দিতে চাননি । তবে গ্যাঞ্জামের কেরিয়ার নিয়ে একটু কিন্তু কিন্তু করছিলেন । বার দুয়েক হাঁ করেও গিলে ফেললেন । ওদিকে মেজোদাদু অপেক্ষা ক'রে আছেন । অন্যরাও উত্কর্ণ । শেষমেষ মরিয়া হয়ে বলেই ফেললেন - ভালো পেট্রন পেলে না হওয়ার কী আছে ?

    - পেট্রন ! - মেজোদাদু দেড়মিনিট হাঁ ক'রে থেকে কোনরকমে বললেন - এতেও আবার জলপানি আছে নাকি ?

    - কেন থাকবে না ? - অংকস্যার ডবল অবাক - জাহাজ বন্দুক কেনার খরচা নেই ? প্রাকটিসের ঝকমারিটাই ভাবুন না । আরাকানের রাজা সাহায্য না করলে বেচারারা যেত কোথায় ?

    - বখরার ব্যাপার ছিল বুঝি ? - কংকাবতী উত্সুক ।

    - আলবাত - অংকস্যার বললেন - শিহাবুদ্দিন তালিশ ছিলেন আসামের ইতিহাস লেখক । তিনি লিখেছেন আরাকানের মগ আর পর্তুগীজ জলদস্যুরা প্রায়ই জলপথে এসে বাংলা দেশ লুঠ করত । হিন্দু মুসলমান যাকে সামনে পেত ধরে নিয়ে যেত । হাতের চেটোয় ফুটো ক'রে তাতে সরু বেত ঢুকিয়ে নৌকোর পাটাতনের নিচে তাদের বেঁধে রাখত । সকালের দিকে কয়েক মুঠো চাল ফেলে দিত, যেন হাঁস মুরগী খাওয়াচ্ছে । অনেক সম্ভ্রান্ত মানুষও এভাবে ধরা প'ড়ে দাসদাসী হয়ে যেতেন । আর লুঠের অর্ধেক ভাগ পেতেন আরাকানের রাজা ।

    - এসব সত্যি ? - ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন সত্যসাধন ।

    - বানিয়ে লিখে লাভ কী বলুন - অংকস্যার উদাসভাবে বললেন - সেবাস্টিন মানরিক নামে এক পর্তুগীজ পাদ্রী সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ায় ভারতে এসেছিলেন । গদিতে তখন শাজাহান । ধর্মপ্রচারের কাজে তিনি বেশ কিছু জায়গায় যান । বাংলার মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করেন বেশ কয়েকবার । ভদ্রলোক প্রায় বছর ছয়েক আরাকানে ছিলেন । তিনিও লিখেছেন মগ রাজা পর্তুগীজদের চাকরিতে রাখতেন । তাদের প্রধানদের ক্যাপ্টেন উপাধি দেন, জমিদারিও দেন । শর্ত ছিল তারা তাদের নিজেদের দেশের কিছু লোককে সেখানে সৈন্য হিসেবে রাখবে, দরকার পড়লেই যাতে কাজে লাগানো যায় । জমিদারি ছাড়াও তাদের আরেকটা অধিকার ছিল এই যে তারা বাংলা রাজ্যে অর্থাৎ মুঘল সাম্রাজ্যে গিয়ে সব বসতি ধ্বংস করতে পারে, জিনিসপত্র নিয়ে আসতে পারে আর যত খুশি লোক ধরে আনতে পারে ।

    মেজোদাদু আড়চোখে গ্যাঞ্জামের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন - চাকরিগুলো এখনও আছে নাকি হে ?

    কংকাবতী বললেন - বাব্বা: ! ভাগ্যিস পর্তুগিজরা গেছে - আপদ বিদেয় !

    - না এলেই ভালো হ'ত - সায় দিল গাংলু ।

    অংকস্যার জিভে চুকচুক শব্দ ক'রে বললেন - দুম ক'রে এরকম একটা সিদ্ধান্ত ক'রে ফেললি ? পর্তুগীজরা কী কী দিয়ে গেল সেটা দেখবি না ?

    - দিয়ে গেল ? - গাংলু কৌতূহলী ।

    - গেল বৈকি । যেমন ধর চাষবাসের ব্যাপার । পর্তুগীজরা বরাবরই এসবে খুব ওস্তাদ । কত রকম গাছগাছড়া তারা নিয়ে এসেছে । এই যে উঠতে বসতে আলু খাস, সেটা এল কোথ্থেকে ? গোড়ায় ইনকা'রা খেত । সেখান থেকে স্পেনের লোকেরা ইউরোপে নিয়ে আসে । তারপর পর্তুগীজদের হাতে সেই আলু এদেশে এল । তারপর পেঁপে । আমেরিকা থেকে পর্তুগীজরা এখানে আমদানি করে । পর্তুগীজ ভাষায় পপৈঅ । নামটা ওরা সম্ভবত: আমেরিকার কোন আদি ভাষা থেকে নিয়েছিল । পেয়ারার ব্যাপারটা আরো ইন্টারেস্টিং । ফলটা ওরা এনেছিল আমেরিকা থেকে । কিন্তু নামটা ওদের । আসলে পিয়ার ব'লে একরকম ফল - অনেকটা নাসপাতির মত - পর্তুগীজরা তাকে বলত পের । পিয়ারের সঙ্গে মিল থাকায় পেয়ারার জন্যও একই নাম বরাদ্দ হয় । তারপর সেই ফল আর তার নাম সরাসরি বাংলায় ঢুকে পড়ে । আনারসের নামও তো পর্তুগীজ অননস থেকে এসেছে । এমনকি তামাকও তো পর্তুগীজদের আমদানি । নামটা এসেছে স্প্যানিশ তবচো থেকে । যদি বলিস তবচো কোথ্থেকে এল তাহলে অবশ্য মুশকিল । কেউ কেউ বলেন তোবগো ব'লে একটা দ্বীপের নাম থেকে তবচো এসেছে, আবার অনেকের ধারণা সেই দ্বীপের লোকেরা এনতার তামাক খেত ব'লে সেখানকার নাম তোবগো হয়েছে । মজা হচ্ছে ভারতবর্ষের সব ভাষায় তামাকের নাম এলেও গোয়ার কোঙ্কণী ভাষায় নামটা ঢোকেনি । অথচ সেখানেই পর্তুগীজদের প্রতিপত্তি সবচেয়ে বেশি ছিল ।

    অংকস্যার তারিফের জন্য এদিক ওদিক তাকিয়েও সুবিধে করতে পারলেন না । আলু আর পেঁপের খবরে গাংলুর কোন উত্সাহ ছিল না । পেয়ারা আনারসের নামে একটু নড়েচড়ে বসলেও তামাক শুনেই আবার তার নাক কঁংউচকে গেছে ।

    মেজোদাদু ন্যাতানো গলায় বললেন - জলদস্যু থেকে আলু আর পেঁপেতে নামালে মোহন ? এর চেয়ে তো প্যাপিরাসও ভালো ছিল । যা ফিরিস্তি দিচ্ছ উচ্ছে পটলে পৌঁছতে তো দিন কাবার হয়ে যাবে ।

    অংকস্যার তাড়াতাড়ি বললেন - এই কাবারটাও তো পর্তুগীজ অচবর থেকে । তারপর ধরুন কিরিচ । মালয় দেশের ছোরা । সে দেশে নাম ছিল ক্রিস । তবে পিস্তল কোথা থেকে এল বলা কঠিন । পর্তুগীজে পিস্তোল, ইংরেজিতে পিস্টল আর ওলন্দাজে পিস্তোওল । তারপর ধরুন হারমাদ - এও তো পর্তুগীজ অর্মদ থেকে ।

    মেজোদাদুকে আবার জলদস্যুতে ফিরিয়ে দিয়ে অংকস্যার পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছেন । অন্যরাও গা তুললেন । গ্যাঞ্জামকে আরেকবার কপিক্ষেতে যেতে হবে । মেজোদাদুর নির্দেশ । যদি পতাকাটা পাওয়া যায় । এমন সময় সত্যসাধন হঠাৎ হাত তুললেন - লাস্ট কোয়েশ্চেন । কাম্বুরিয়া শব্দটা পর্তুগীজ না ওলন্দাজ ?








    পাশাপাশি
    উপরনিচ
    (১) মন সাধা উত্তর (৪) উপরে ঢের ঠেলা মেরেছে কেউ; বাদ দিতে পেরে কলেরা, মরে ঊর্মি-মুখর (৯) অর্থ পায়স (১১) পালটে ক'-আছাড় দিয়ে ফেললে ? (১২) আমার ভবিষ্যত্‌ (১৪) হিন্দু তারা, শ্রমণ নয়, দূরে সরায় রণে (১৬) চার নির্মাণ (১৭) হাওয়া ভরা লেবু দিন (১৯) রক্তবর্ণ ভাঁটায় শোলক বললাম - নাম অশোক (২১) অবজ্ঞা করানো লোক তো নানা (২২) দারুণ পোশাক (২৪) বিষ্ঠা গর্জন (২৫) কচি শিশু কত জানব (২৮) রজনী কি যাবে কাপড় কেচে ? (৩১) খসড়া শনাক্ত হঠাত্‌ (৩২) পদাবনত নেতা, বিপদ নতুন (৩৪) চোখের জলে ভাসলো পাগল, শ' দ্রুম - তায় মাপ নেই (৩৬) মারা যায় সুন্দরী (৩৭) বহন-দাম নেব বিরাট নদীতে (৩৯) বসতিতেই সব নয় শেষে (৪১) কোলাহল হলে হোক না, দলায় লাগিয়ে দুই রং (৪২) বেত দিলে দে, তবু মোসাহেবি করবে (১) বাহন সহে যদি, তবে অসহনীয় (২) সোপানে আধ-পা আনি (৩) নয় দীন চোখে (৫) পদব্রজ উমা মজা হারায় উত্পাতে (৬) উলটে নিলে জন্তু (৭) কাঠের দেমাক (৮) চেলা ছঁংউলে চাঁদনিতে চতুর সে (১০) সংযত করা মাল, সোনা (১৩) কবুল না করে বলে যদি (১৫) অস্ত্র'র মূল নাম "শ" (১৮) কড়াই রোদে নত (২০) অস্থির বান জলে (২৩) একশ'তে কত রাশ ? (২৫) দুধ থেকে দুই বার দীন নই (২৬) কামার বেশ চাবকাবে (২৭) শাস্তি কমলা না (২৯) খুব ভারী লাগে, জেদে স্বরহীন (৩০) মুঠোয় কলি (৩৩) বজায় হয় বলা (৩৫) শতেক ত্রুটি বিকট শোনাতে (৩৮) নও হরগিজ (৪০) স্নেহ বলতে কাটব



    (এবারের শব্দজব্দ তৈরি করেছেন অংশুমান গুহ)

    আগের বারের শব্দজব্দের উত্তর পাঠিয়েছেন কলকাতা থেকে শর্মিলা ব্যানার্জি । এবারেও প্রথম দুজন সঠিক উত্তরদাতাকে পুরস্কার দেওয়া হবে ।

    দয়া করে এবার থেকে ডাকযোগে উত্তর পাঠালেও ই-মেল (যদি থাকে, তো) জানাতে ভুলবেন না ।



    আগের বারের ত্রক্রসওয়ার্ডের উত্তর এখানে






  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • কীভাবে লেখা পাঠাবেন তা জানতে এখানে ক্লিক করুন | "পরবাস"-এ প্রকাশিত রচনার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রচনাকারের/রচনাকারদের। "পরবাস"-এ বেরোনো কোনো লেখার মধ্যে দিয়ে যে মত প্রকাশ করা হয়েছে তা লেখকের/লেখকদের নিজস্ব। তজ্জনিত কোন ক্ষয়ক্ষতির জন্য "পরবাস"-এর প্রকাশক ও সম্পাদকরা দায়ী নন। | Email: parabaas@parabaas.com | Sign up for Parabaas updates | © 1997-2022 Parabaas Inc. All rights reserved. | About Us