"আজ দাও, আভি দাও, উত্তরাখণ্ড রাজ্যদাও" - অচল করে দেওয়ার হুমকি সারা উত্তরাঞ্চল জুড়ে । পাহাড়ি মানুষের সেই বুকফাটানো চিত্কার পথের অলিতে গলিতে । তোয়াক্কা করিনি আমরা । না করেই ঢুকে পড়েছিলাম উত্তরাখণ্ডের গভীরে - দেরাদুন শহর ছেড়ে পুরৌলা তহশিলে । সময় : উনিশশো পঁচানব্বুই-এর মে ।
চোখের পাতা বোজাতে পারেনি তরুণ । সারারাতের অর্ধেকটাই কেটেছিল তার দেরাদুন হোটেলে মানচিত্র দেখে, মালপত্রের হিসাব-নিকাশ, আর বাঁধাছাঁদার নজিরবিহীন দায়িত্বশীল পর্বে । ভোরবেলায় হোটেলের নিচে বাস টার্মিনাসে নৈটেয়ারগামী বাসের মাথায় সকলের লটবহর তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে হাঁফ ছেড়েছিল সে ।
সময় ধরেই বাস ছেড়েছিল । ভোরের আলোফোটা শহুরে পথঘাট । শহর এখনো জেগে ওঠেনি । মানুষজন বিরল, যানবাহন বিরল । গাড়ির বেশ কয়েকটা আসন আমাদের দখলদারীতে । বাকি আসনে স্থানীয়দের ভিড় ।
ওঠানামা মসৃণ পথ । বাস চলেছে হু-হু করে । বাসের জানালায় শীত শীত হাওয়া চোখেমুখে লাগছিল সারাক্ষণ । শহরের ঘনত্ব, দোকান-পাট পাতলা হয়ে আসছিল ।
বাসের ঝাঁকানিতে সিট থেকে প্রায় পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে বিমলবাবু কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বললেন, "অমরবাবু চা খাওয়া হবে না ?" তরুণের কান এড়ায়নি কথাটা । সেও বলে ওঠে, "হবে-হবে, সামনের স্টপেজে বাস থামবে ব্রেকফাস্টের জন্যে । ওখানেই সকলে চা খেয়ে নেব ।" একটু স্বস্তি বোধ করলেন মনে হল বিমলবাবু । আজীবন শহরে মানুষ । ষাটোর্দ্ধ । মাঝেমধ্যে এখানে ওখানে যান । প্রাত্যহিকের সময় মাপাজোপা রুটিন । একটু এদিক ওদিক হলে মনটা খুঁত খুঁত করে বৈকি !
মনে পড়লো সে-বার চাক্রাতা যাবার কথা । এই দেরাদুন থেকেই বাসে যাওয়া । পশ্চিম গাড়োয়ালের রূপসী পাহাড়ি শহর চাক্রাতা । এই পথে এসে যমুনা ব্রিজ পার হয়ে সাত হাজার ফুটের মাথায় ছবির মতো শহরে আসা যাওয়া । ইংরেজ আমলের হাতে গড়া । নির্জন জায়গা । সবুজে সবুজে একাবারে মাখামাখি । সেই সবুজের অতলে ডুবে আছে বনবাংলো খানা । বহু আদিবাসীর বাস ওখানে । উনিশ শতকের সাতের দশকে ব্রিটিশ আর্মি অফিসার কর্নেল হিউম এই অঞ্চলকে মিলিটারি ক্যানটনমেন্ট করতে চেয়েছিলেন । সূর্যোদয়ের তুলনা নেই ওখানে । এমনকি, এরকম জায়গায় রাতে বনের বিভীষিকাও উপভোগ্য হয়ে ওঠে । চিতা, ভালুক, বন্যমুরগির বিচরণ ক্ষেত্র । চোখ জুড়নো টাইগার ফলস্ হিমালয়প্রেমীদের ডাকে এপথে । এপথের আর এক কাহিনী জড়ানো শহর লাখামণ্ডল । মহাভারতের সেই জতুগৃহ ছিল নাকি সেখানে । কিংবদন্তী : অতীতে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারা হত ওখানে ।
তেমাথানি পথের সংযোগস্থলে বাস এসে দাঁড়াল । চা-পানের বিরতি স্থান । বাস থেকে নেমে এলাম দলের সবাই । পথের ধারে কয়েকটা চায়ের দোকান । বারকোশ বোঝাই চূড় করা জিলিপি, গরম সিঙ্গাড়া আর পকৌড়ার লোভপ্রদ ইশারা । হতাশ করেনি তরুণ কাউকে । প্লেট বোঝাই সিঙ্গাড়া, পকৌড়া, জিলিপি আর মাটির ভাঁড় ভর্তি গরম চা সবাইয়ের হাতে হাতে । চুটিয়ে ব্রেকফাস্ট ।
বিমলবাবুর সতৃপ্ত মুখখানা সেদিন দেখেছিলাম ।
মিনিট কুড়ি-পঁচিশের বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু । বেলা আস্তে আস্তে বেড়ে চলেছে । সকালের রোদের মিষ্টি অনুভূতি । দূরে পাহাড়ের গায়ে চলমান ছায়া । বাসের জানালা দিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে দেখি ।
নিলাদ্রি, নিতান্তই কিশোর । পনেরোর কোঠা এখনো বোধহয় পার হয়নি । এ-বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, আমাদের দলের একজন সহযাত্রী । কী করে দলে এসে ভিড়লো জানি না । রাজাই মনে হয় ওকে সঙ্গে করে এনেছে । পার্থ সল্টলেকের বাসিন্দা । তরুণের কোঠা পেরিয়ে যুবকের পর্যায়ে এসে পড়েছে । লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে একটা চাকরিতে ঢুকেছে । হিমালয়ের নেশা ধরেছে মনে । উত্সাহ, উদ্দীপনায় টগবগ করছিল । পাথরের মাইলপোস্ট গুনছিল নিলাদ্রি । বাসের গতির উল্টোদিকে ছুটছিল পোস্টগুলো এক এক করে ।
সকালের হিমে ভেজা রোদ এখন বর্ণময় । সোনালি হলুদ । পিচঢালা পথ রোদের আলপনায় চিত্রিত । ছোটো ছোটো পাহাড়ি গ্রাম আসে, পড়ে থাকে পিছনে । বাস ছোটে ।
বেলা বাড়ে । দুপুর ছুঁই-ছুঁই । বাস এসে দাঁড়ালো ডামটায় । ছোট্ট পাহাড়ি শহর । ঘরবাড়ি, দোকান, হোটেল, ডাক্তারখানা, পঞ্চায়েত অফিস, সবই আছে । টুকিটাকি ব্যবসার জায়গা ।
বাস চলার বিরতি আধঘন্টার মতো । দূরের যাত্রীদের মধ্যাহ্নভোজনের পালা এখানে চুকিয়ে নিতে হয় । পছন্দসই, একটু পরিচ্ছন্ন দেখে এক হোটেলে তরুণ আমাদের সকলকে নিয়ে ঢুকলো । প্লেট ভর্তি দেরাদুনি আতপের সুগন্ধী গরম ভাত, রাজমার ডাল, আলুপনির আর টক দই । চিনি চেয়ে নেওয়া চলে । ক্ষিদের সময় সত্যি উপাদেয় ভোজ্য ।
বাস ছাড়তে এখনো কিছু দেরি আছে ভেবে রাস্তা পেরিয়ে কাছেই ফাঁকা মতো এক মাঠের ধারে এসে দাঁড়াই । মাঠের কোণে বিশাল ঝাঁকড়া এক আখরোট গাছ অনেকখানি ছায়া করে দাঁড়িয়ে আছে । মে মাসের শেষ । কচি সবুজ আখরোট ফল একগাছ হয়ে আছে । মাঠের পাশে আগাছায় ভর্তি সরু খাদ ; মধ্যে ক্ষীণ জলধারা । হোটেলে খাওয়ার পর এখানে এসে দাঁড়িয়েছিলাম বাস ছাড়তে দেরি আছে বলে । মনে পড়ছিল আগের বার হর-কি-দুন যাবার কথা ।
বাসের হর্নের আওয়াজ কানে আসে । উঠে পড়ি বাসে তাড়াতাড়ি ।
পালিশ করা পিচের পথ । রোদে চকচক করছিল । বাসের গতি বাড়ে । কাচের সার্সি-তোলা চৌবন্দি জানালার ফাঁকটুকু দিয়ে দূরের কত কী দৃশ্য সিনেমার স্লাইডের মতো এক এক করে চোখে এসে পড়ছিল । সবুজে ভেসে যাওয়া ফসলের টুকরো টুকরো ক্ষেত । যবের শীর্ষে সোনালি রোদ । শিশুকে পিঠে বেঁধে কাস্তে হাতে মহিলা - ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত । ওড়নার ফাঁক দিয়ে মাঝেমধ্যে চলন্ত বাসের দিকে সলজ্জ চাহনি । ঘোমটার তলায় নাকের ঝুলন্ত নাথলি রোদে চিক চিক করে । ভরন্ত বেলা । এত বেলা পর্যন্ত ওদের মাঠে কাজ করতে হয় । কষ্টের সংসার । আশা আকাঙ্খা সামান্যই । মানিয়ে নিয়ে চলে ওরা ।
বাস চলে । কোথাও পথ সারাইয়ের কাজ হচ্ছে । পিচের ড্রাম, পাথরকুচি, নদীর বালি ঢিবি ঢিবি পথের ধারে ধারে । পিচ গরম হচ্ছে কাঠের গনগনে আগুনে । তার কড়া গন্ধ নাকে আসে । এক ঝাঁক কুলি রাস্তার কাজে ব্যস্ত । মজুরি সামান্য । খাটুনি হাড়ভাঙা । মুখে কোনো কথা নেই । ওদেরও দু:খের সংসার । জোড়াতালি দিয়ে ওরাও চালায় ।
নৈনবাগে বাস এসে দাঁড়ালো । স্থানীয় কিছু যাত্রী বাস থেকে নামলো মালপত্র নিয়ে । সপরিবারে এক যাত্রী উঠলো বাসে । মহিলার পরণে রঙিন জোব্বা । ঝলমলে ওড়নায় ঢাকা সারা দেহ । একহাত ঘোমটা টানা । নাকে সোনার নাথলি । হাতে বাজু, চুড়ির গোছা । পায়ে রুপোর মল । ছেলেমানুষ । নতুন বিয়ে হয়েছে বলেই মনে হল । ছোটো টিনের একটা সুটকেশ হাতে যুবকটি আমার পাশের সিটে এসে বসলো । গায়ে পড়েই আলাপ করি : "কোথায় যাবেন ?" অপ্রতিভ যুবক, লজ্জিত মুখে বলে ওঠে, "নওগাঁ" । আবার বলি, "নওগাঁতে কী আপনার বাড়ি ?" "না, নওগাঁয় নেমে বাস বদল করতে হবে বরকোটের । ওখানেই আমার বাড়ি ।" যুবকটি বলে ওঠে । - "নতুন বিয়ে হয়েছে বুঝি ?" একটু হেসে বলি । লজ্জিত হল বলেই মনে হল যুবককে । বলে উঠলো, "হ্যাঁ"। আবার প্রশ্ন করি, "কী করেন ?" - "ক্ষেতি বাগান আর ঘুরনচাক্কি আছে, গম, যব পেশাই করি ।" বলেই যুবকটি সুটকেশটা সিটের নিচে ঠেলে রেখে দেয় । - "লোকজন আসে পেশাই করতে ? এতে সংসার চলে ?" কৌতূহলী প্রশ্ন করি । নিরুত্তর যুবকটি মাথা নিচু করে থাকে ।
বাস কখন ছেড়ে দিয়েছিল টেরই পাইনি । সমতল ভাব ত্রক্রমশই কমে পথ চড়াইমুখী হচ্ছে আস্তে আস্তে । বাসের গা দোলানিও শুরু হয়েছে সেই সঙ্গে ।
স্বচ্ছ আকাশ ময়ূরকন্ঠী রঙ । বেলা গড়াতে শুরু করেছে দুপুরের দিকে । নওগাঁয় এসে পড়েছি ।
বেশ জমকালো গ্রাম নওগাঁ । হবে নাই বা কেন ? দু'টি নামকরা যাবার রাস্তা এখানে এসে মিশেছে । টনসভ্যালি বা তমসা উপত্যকা আর যমুনোত্রীর পথ । এখান থেকে দু'পা এগোলেই চোখে পড়বে খুশির লহর তুলে নিচে বয়ে যাচ্ছে যমুনা নদী । কলকল, ছলছল শব্দে । পায়ে যেন রুপোর ঝুমুরের গোছা ! শুধু কী একা একাই নৃত্য পরায়ণা যমুনা ? না, তার সখী কমলনদীও এসেছে সে আসরে । নাচের ছন্দে অঙ্গে অঙ্গে লীন হয়ে গেছে - `নৃত্যেরই তালে তালে ।' যমুনা এসেছে স্বর্গের রাজ্য যুমনোত্রীর অঙ্গ থেকে আর কমলনদী এসেছে আমাদেরই পথের আরো ওপরে জারমোলা গাঁয়ের গরু গার্ড নদী থেকে । খুশির ছন্দে দু'জনেই মাতোয়ারা ! এখান থেকে যুমনোত্রী যাওয়া যায় যমুনার কূলে কূলে পাইনমেদুর বরকোট গ্রাম হয়ে ।
সবুজের রাজত্ব নওগাঁ । অফুরন্ত জলের উত্স ধারায় সারা গ্রামের বুকে সবুজের আঁচল বিছানো । ফুল, ফল, শস্য, সমৃদ্ধিতে গ্রাম শ্রীমণ্ডিত স্বচ্ছল ।
বাস থেকে নেমে গেল নতুন বিবাহিত দম্পতি । নকসা-করা ছোট্ট সুটকেসটি হাতে নিয়ে । ওরা এখান থেকে বাস বদল করবে । যাবে বরকোট গ্রামে । আবার সেখান থেকে কোনো পাহাড়ি গাঁয়ের স্নিগ্ধ ছায়ার অতলে - কে জানে ? ওড়নার ফাঁক দিয়ে নববধূর সলজ্জ দু'টি চোখের চাহনি মুহূর্তের জন্যে চোখে ভেসে উঠেছিল আমার । স্বামীর ঘরে যাচ্ছে পরিণীতা বধূ হয়ত এই প্রথম । আগামীর কত স্বপ্ন, কত কল্পনার চিত্র তার চোখ দুটি ঘিরে আছে ।
বাস ছেড়ে দিল । ব্রিজ দিয়ে যমুনা পার হয়ে এলাম এপারে । দূরে যমুনার কূল ধরে বরকোট যাবার আঁকাবাঁকা রাস্তা অস্পষ্ট চোখে পড়ছিল । কমলনদীও সমান্তরাল ভঙ্গিতে আমাদের বাস রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়েছে । সবুজের ঘনত্ব মনে হল আরো বেড়ে চলেছে । ঝোপঝাড়, পাইন, দেওদারের জটলা রাস্তার গা বরাবর । বাসের জানালার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ এক আশ্চর্য দৃশ্য চোখে পড়লো । একদল শবযাত্রী এক মৃতদেহকে চেয়ারের মতো বাঁশের এক খাটিয়ায় সোজা করে বসিয়ে সত্কার করতে যাচ্ছে । মৃতের দেহে নতুন পোশাক ও গলায় মালা । যমুনার তীরে যাচ্ছিল দাহ করার জন্যে । পিছন পিছন আসছিল মৃতের স্বজন-পরিজন, পড়শিরা । রাম, রাম শব্দের অস্ফুট কন্ঠোচ্চারণ । প্রায় দৌড়তে দৌড়তে যাচ্ছিল শববাহীরা । মৃতের মাথাটি কেবলই ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছিল । অবাক হলাম এই দৃশ্যে । সাধারণত আমরা দেখি শবদেহকে শায়িত অবস্থায় বহন করে নিয়ে যেতে । যস্মিন দেশে যদাচার । হাজারো সংস্কারে আকীর্ণ ভারতবর্ষ ।
বেলা বেড়ে চলেছে । সেই সঙ্গে পথের চেহারাও রূপান্তরিত হচ্ছে । নওগাঁ ছিল সমুদ্রতল থেকে ১৩৭৫ মি: ওপরে । আমরা যে আরো ওপরে উঠে আসছি বেশ বুঝতে পারছিলাম । বাস থেকে চোখে পড়ছিল পুরৌলা শহরের অংশ । পাহাড়ের গায়ে গায়ে পাইনের ছায়ায় ঢাকা ঘরবাডি । কমলনদীর গা বরাবর জনপদের বিস্তৃতি । শহরের মাঝখানে রাস্তার ধার ঘেঁসে বাস এসে দাঁড়ালো (১৯ কি.ংইম.) । কুলির ভিড় । স্থানীয় যাত্রীদের বেশিরভাগ নেমে গেল এখানে ।
পুরৌলা পশ্চিম গাড়োয়ালের উত্তরকাশী জেলার এক মহকুমা শহর । বেশ জমজমাট । পাহাড়ের চৌহদ্দি জুড়ে সব কিছুই আছে । স্কুল, হাসপাতাল, ডাকঘর, সরকারী অফিস, কাছারি, দোকানবাজার । হোটেল, রেস্টুরেন্টও হয়েছে বেশ আধুনিক সাজ-সজ্জায়, এছাড়া থানা, তহশিল আছে । ছোটখাট ব্যবসাবাণিজ্য ও লেনদেনের কেন্দ্র । পথের দু'পাশে শাক সব্জী, ফলমূল বিক্রি হচ্ছে । রেডিমেড জামাকাপড়, মনোহারী দ্রব্যের পাট খুব । সুশ্রী, সুবেশা তরুণীদের সমাবেশও খুব । দেখলে মনে হয় শিক্ষিতা মার্জিতা রুচিসম্পন্নাও বটে ।
তরুণ আমাদের নিয়ে চা খাওয়াতে ঢুকলো এক রেস্টুরেন্টে । চমত্কার পকৌড়া সহযোগে চা । দাম মিটিয়ে সবাই ফিরে এসে বাসে উঠলাম । স্থানীয় যাত্রীদের ভিড়ে বাস থিকথিক করছে । ভিড় হওয়াও স্বাভাবিক । কেননা সারাদিনে এ-অঞ্চলের প্রত্যন্ত জনপদের সঙ্গে সংযোগকারী এই একমাত্র পরিবহন ব্যবস্থা । মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে আবার কর্মমুখীও হয়ে পড়েছে অনেকে । যাতায়াতের মাত্রাতো বাড়বেই ।
বাস ছেড়ে দিল আধঘন্টার মতো বিরতি নিয়ে । সমতল ছেড়ে চড়াইয়ের পথ ধরে বাস । পথ ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের গা ধরে ওপরে ওঠে । সেইসঙ্গে নজরে আসে পথের শ্যাম শোভা । পাইন, দেওদারের তোরণ দ্বার দিয়ে বাস প্রবেশ করে সুন্দরের রূপঘরের আরো অভ্যন্তরে - আরো গভীরে জারমোলায় (২২ কিংই.)। কোনো এক হিমালয় কন্যা এখানে যেন তপস্যারতা ! শুচিস্নিগ্ধ শান্ত মনোরম তার রূপ । অরণ্যবাসরে এ দেবকন্যার শ্যামল কোমল রূপ যেন তুলনাহীন । সারা পাহাড়ের হাল্কা ঢালে অজস্র পাইন, দেওদারের বন । পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত সে সবুজ অরণ্যের ঢেউ যেন গড়িয়ে নেমে গেছে । বনের মাঝখান দিয়ে পাতাঝরা অজগরী পথ । তার এক পাশে জারমোলার বনবিশ্রাম বাংলো । যেন স্বর্গীয় নন্দনকাননে দেবকন্যার পর্ণকুটির । শান্তির বিরাম কুঞ্জ । নির্জন, নিস্তব্ধ পরিবেশ দিনরাত । সে নি:শব্দ পরিবেশ যেন চমকে উঠছে মাঝে মাঝে পাতা খসার মর্মর ধ্বনিতে ! পাহাড়ের গায়ে ধাপ ধাপ কাটা । সেখানে নিটোল ধানের গাছে হাল্কা হলুদ রং আধপাকা ধানের শিষে শিষে । যেন উথলে উঠছে । চোখ জুড়িয়ে যায় । দৃষ্টি ফেরাতে পারি না । রূপের এ নম্রতায় মন যেন মাতাল হয়ে ওঠে ।
বাস এসে দাঁড়িয়েছিল জারমোলা ফরেস্ট রেস্টহাউসের সামনে । কয়েকজন স্থানীয় মানুষ নেমে গেলেন সেখানে । আমরা নেমে পড়ি । সুধাংশুকে ফটো তুলতে বলি । সবুজের মধ্যে এমন সোনালী হলুদের মিশ্রণ বড় একটা চোখে পড়ে না । সুধাংশুর ক্যামেরা এ রূপের স্নিগ্ধতা কতটা বন্দি করতে পেরেছে জানি না । বাসে ফেরার তাগিদে ফটো তোলার পর্বটা সংক্ষিপ্তভাবেই মিটিয়ে নিতে হয়েছিল ।
জারমোলার শ্যামলিমা ছেড়ে চলে এলাম । বাসের রুদ্ধশ্বাস গতি, অবশ্য গর্জন তার আরো বেশি । ঢেউ ওঠা-নামা রাস্তায় মাঝে মাঝে সে গতি ব্যাহত হচ্ছিল । সূর্য এখনো অস্ত যায়নি । রোদের রক্তসিঁদুরের আভাস সবে এসে লাগছে । পথের পাশে খাদ । শীর্ণ ঝরনা পথ ভাসিয়ে দিচ্ছিল মাঝে মাঝে । চোখে পড়ে উইয়ের ঢিবি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে গাছগাছালির মধ্যে । জল ঝরার শব্দ কানে আসে । জানালার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে জলের প্রবাহ । রুপোলি জল নুড়ি-নাড়ার আগল ভেঙে ছুটে চলেছে । গরুগার্ড নালা । কমলনদীর মাতৃজঠর । পথের ওপর পাথর দিয়ে গাঁথা কালভার্ট । বাস ধীরে ধীরে পেরিয়ে আসে । এ পাসে মোরি গ্রাম (১৬ কি.ংইম.) । ছোট্ট পাহাড়ি পরিধি নিয়ে গ্রামের পরিসর । বাজার অঞ্চলটুকুই তার হৃদপিণ্ড । বেশ কিছু বাড়িঘর, দোকান পসার নিয়েই তার অঙ্গসজ্জা । বিশ্রামভবন, ডাক্তারখানা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, অনেক কিছুই আছে । মোরির আসল রূপ খুলেছে তমসা নদীর জন্যে । উচ্ছল, উদ্বেল-গতি তমসা মোরির কন্ঠে যেন নিবিড় আলিঙ্গনে মগ্ন ।
সূর্যাস্তর । আকাশে রঙের উত্সব । তারই রক্তিম আভায় লাল হয়ে উঠেছিল তমসার জল । পাইনের ছায়া তখনও দুলছিল জলের ঢেউয়ের মাথায় । তমসার তীর ধরে পথ চলে গেছে তিউনি অভিমুখে । মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি একদৃষ্টে তমসার দিকে । পশ্চিম গাড়োয়ালের হিমবাহ নি:সৃত সুপিন আর রুপিনের মিলিত ধারার স্রোতে জন্ম হয়েছে তমসার । রামায়ণের তমসা তীরে বাল্মীকির লেখা বিলাপ-বিহ্বল ক্রৌঞ্চ-মিথুনের গল্পের সে তমসা এ নয় । এ মহাভারতের । হাজার হাজার বছরের মহাভারতীয় যুগের প্রাচীন সংস্কৃতি ধারা ও সত্ত্বার সাক্ষী এ তমসা । কুরুক্ষেত্রের ঘোরতর যুদ্ধে পরাজিত, রক্তাক্ত, ক্লান্ত কৌরবকূলের অবশিষ্ট জীবিত সেনানীবর্গ অপমানে লজ্জায় দিশেহারা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল পশ্চিম ভারতের হিমালয় প্রান্তরে তমসার তীরবর্তী এইসব অঞ্চলে । যুদ্ধের নেশা ছুটে গেলে তারা স্বভাবসিদ্ধ, স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্রতী হয়েছিল । কৃষি ও পশুপালন ভিত্তিক জীবনযাত্রাই তারা অবলম্বন করেছিল । বীরের জাত ছিল তারা । অতীতে বীরত্বের দম্ভময় জীবন নিয়ে বীরের পুজাই ছিল তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি । পৌরাণিক দেবদেবীর পুজাপাঠে অংশ নেয়নি তারা । উভয় তীরবর্তী তমসার উত্তর উপত্যকায় মহাভারতের মহাবীর দুর্যোধন, কর্ণ প্রভৃতির উপাসক ছিল তারা এবং আজও আছে । আজও তমসার উত্তর উপত্যকার গ্রামে গ্রামে কর্ণ ও দুর্যোধনের মন্দিরে মন্দিরে তাঁদের পুজা হচ্ছে । গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে দেবতারা মিছিল সহযোগে পুজা নিতে যান সেসব অঞ্চলের মানুষের । মহাভারতের দ্রৌপদীর বহু পতিত্ব গ্রহণের মতো এসব উপত্যকার রমণীগণও বহু পতির পতিত্ব গ্রহণ করে এসেছেন এবং আজও আসছেন । তবে বর্তমানে এ-প্রথা অনেক কমে এসেছে ।
সন্ধ্যার প্রাক্কাল । বাসের মুর্হূ-মুর্হূ হর্নের আওয়াজ আসছিল । তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি বাসে । শান্ত, স্তব্ধ পরিবেশ । শুধু বাস চলার শব্দ ও সেইসঙ্গে তমসার অশান্ত কল্লোল ধ্বনি । ঘন পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তমসার কূল বরাবর বাস ছুটছিল । বাস যাত্রার ইতি ঘটবে নৈটেয়ারে - পরের গ্রামে । মোরি থেকে নৈটেয়ার ১২ কি.ংইম. মাত্র । পথের অবস্থা বিশেষ ভালো নয় । খানাখন্দ, ভাঙাচোরা । মাঝে মাঝে বাস দাঁড়াচ্ছিল । ঝোপে ঝাড়ে অন্ধকার জমছে । ঝিঁঝিঁ-দের কান ফাটানো চিত্কার । হঠাৎ মনে হল দূর থেকে অস্পষ্ট গোঁঙানির একটা শব্দ কানে আসছে । মানুষের গলার কাতর কন্ঠ । সন্ধ্যার ঝাপসা অন্ধকারে মনে হল কে যেন উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে আসছে হাঁফাতে হাঁফাতে । তার কাঁধে মনে হল একজন মানুষ । তারই কাতর স্বর । সত্যিই ঢিলে পাজামা, গেঞ্জি পরা এক গাড়োয়ালী যুবকের পিঠে অসুস্থা এক মহিলা । সালোয়ার-কামিজ পরা । ওড়নাটা গলা থেকে ঝুলে পড়েছিল রাস্তায় । জিজ্ঞাসা করতেই যুবক বলে ওঠে, "বিমার, পেটের দরদ" । কোথায় যাচ্ছে প্রশ্ন করায় সে বলে ওঠে, "মোরি । ডাক্তারখানায়" । বলেই যুবক অন্ধকার পথে অদৃশ্য হয়ে গেল ।
বাসে উঠে এসে বসি । কী সব মেরামতি কাজ করে বাস আবার ছেড়ে দিয়েছিল । মনে মনে ভাবি, শহর, জনপদ ছেড়ে দূরে গভীরে পাহাড়পল্লীর সাধারণ মানুষের বাস্তব অবস্থার কথা । গ্রামে ডাক্তার নেই, যানবাহনও নেই । আপদে বিপদে রোগে শোকে তাদের কী করুণ বেহাল অবস্থা !
পাজামা, পাঞ্জাবী, মাথায় কালো টুপি - স্থানীয় এক তরুণ যুবক বাসে উঠে পড়েছিল আমাদেরই সঙ্গে । বাস ছাড়ার একটু পরেই হঠাৎ সে আমাদের সিটের কাছে এসে আমাদের পরিচয়, গন্তব্য সব কিছু জেনে বলেছিল, সে ও-পথে গেছে, এবং আমাদের নিয়ে ও সিংকা ত্রক্রশ করে কিন্নরে নামতে পারবে । তরুণ ছেলেটিকে পাশের সিটে বসিয়ে আলাপ শুরু করে দেয় ।
রাতের পাতলা অন্ধকারে মনে হচ্ছে ঘরবাড়ি রাস্তার গায়ে এসে পড়েছে । দু'চারটে আলোর বিন্দুও চোখে পড়ে । নৈটেয়ারে এসে পৌঁছেছি । রাস্তার বাঁদিকে নদীর গভীর খাদ । সেখানে অন্ধকার জমাট দানা বেঁধেছে । কিছু দেখা যায় না । শুধু নদীর গর্জন কানে আসছিল ।
নৈটেয়ার (১৪০১ মি:) এ-পথের সমৃদ্ধ গ্রাম । বাজারের মাঝখানে বাস এসে দাঁড়ালো । বাস রাস্তার শেষ এখানে । সেই ছেলেটি বাস থেকে নেমেই সঙ্গে সঙ্গে বাসের মাথায় উঠে পড়ে মালপত্র নামাতে শুরু করলো । আজকের রাতের আস্তানার জন্যে তরুণের নির্দেশ মতো আমি আর রবীন দৌড়লাম ট্যুরিস্ট রেস্টহাউসের দিকে । কেননা এর আগে আমি দু'বার এই রেস্টহাউসে রাত কাটিয়েছি । আমার জানাশোনা ছিল সব কিছুই । রবীনকে নেওয়ার উদ্দেশ্য এসব কাজে ভারি দক্ষ সে । হিমালয়ের বহু দুর্গম অঞ্চলে সে ঘুরে বেড়িয়েছে । অভিজ্ঞতায় একাবারে ঝকঝক করছিল !
নৈটেয়ার বাজার ফেলে বেশ কিছুটা যেতে হয় রেস্টহাউসে । পাহাড়ের গায়ে ধাপ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে তবে রেস্ট হাউসে পৌঁছতে হয় । কিন্তু এ কী ! রেস্টহাউসের প্রবেশ ফটকে তালা ঝুলছে । ঘরের জানালা দরজা সব বন্ধ । চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার । নেমে এলাম । স্থানীয় পথচারীর মুখে জানলাম উত্তরাখণ্ড আন্দোলনকারীরা সরকারী বিশ্রামভবনে তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে ।
হতাশ হয়ে ফিরে আসি । এসে শুনলাম, বাসে আলাপ হওয়া স্থানীয় সেই যুবকের ব্যবস্থাপনায় বাজারে লালার দোকানের মাথায় একখানা ঘর ভাড়া করা হয়েছে থাকার জন্যে । নিশ্চিন্ত হয়ে ওপরে উঠে আসি । মস্ত লম্বা হলঘর । দরজা, জানালা বিরল । কল নেই, পায়খানা নেই । সবই রাস্তা নির্ভর । কম পাওয়ারের একটি বাল্ব জ্বলছিল ঘরে । মাথার ওপর ঘুরছিল ছোট্ট একখানা পাখা । সিঁদুরমাখা গণেশ, লক্ষ্মী আর সেই সঙ্গে রাম, সীতা, হনুমানজীর ছবি দেওয়ালে । পোড়া ধূপের কাঠি; শুকনো ফুলের মালা ছড়ান ইতস্তত । মোটা দড়ির একখানা ধূলিধূসর কার্পেট শুধু কাঠের মেঝের ওপর পাতা । তার ওপর নজরে এল একগাদা সার্টিফিকেট ও প্রশংসাপত্র বিছিয়ে সেই যুবকটি আমাদের দলের সকলকে নিয়ে গোল হয়ে বসে কথার ঝড় ওড়াচ্ছে । তরুণ গম্ভীর হয়ে সব শুনছিল । সিংকা-লা পার হয়ে বসপা ভ্যালিতে ঢোকেনি সে কোনোদিন, তবে চাচার সঙ্গে ভেড়, বকরীর পাল চরাতে গিয়ে সুপিন ভ্যালিতে একবার সিংকায় গিয়েছিল যদি ওপারে বকরীর পাল নিয়ে নামানো যায় । কিন্তু সে অসম্ভব, চাচা ফিরে এসেছিল । তাই সবই তার চেনা । ও-পথে মানুষজন যেতে বড় একটা কাউকে দেখেনি । তাম্বু জরুর লাগবে । রেশন লাগবে । পথ খতরনক । এখন শুকনো, বরফ খুব একটা মিলবে না । মৌসম আচ্ছা । কথায় কথায় সে আরো বলে, সে বোরাসু পাস গিয়েছিল সাহেবদের সঙ্গে । ওপারে চিনিতে নেমেছিল । পরে সিমলা হয়ে ফিরেছিল । পরমুহূর্তেই বলে ওঠে, স্বর্গারোহিণী, ধূমাধারকান্দি একসপিডিসনেও সে ছিল ।
- "কতদিনে বাসপায় নামা যাবে ?" তরুণের এ প্রশ্নের উত্তরে সপ্রতিভ যুবক কিছুক্ষণ ভেবে বললো, "কমসে কম সাত পাড়াও তো লাগবে ।" কুলির প্রশ্ন ওঠায় যুবক সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে আমাদের আনা মেঝেয় পড়ে থাকা স্যাক, পিট্রু কয়েকটা হাতে তুলে ওজনের বহর কত হবে আন্দাজ করে বলে বসে, "রেশন তো এখান থেকে কাল সকালে কিনে নিতে হবে ।" তরুণ মাথা নাড়ে । - "জনা বারো তেরো তো জরুর লাগবে ।" যুবক পরিষ্কার বলে । তরুণ চমকে ওঠে ! সেও সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, "অসম্ভব, এত বেশি কেন লাগবে ? আমরা ন'জনের পার্টি । অনেকে সামান ক্যারি করবে ।" যুবকটি কোনোরকম অপ্রস্তুত না হয়েই বলে ওঠে, "জরুর লাগবে বাবুজী, পথ আচ্ছা খতরনক । তাম্বু আছে, রেশন আছে, লকড়ি নিতে হবে, লাগবে বাবুজী, লাগবে ।" শেষ পর্যন্ত অনেক লড়ালড়ির পর ন'জন কুলি সঙ্গে থাকবে এটাই স্থির হল । তরুণ এইসঙ্গে সবকিছুই মিটিয়ে ফেলে একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থায় আসতে চায় বলেই মনে হল । সে কুলিদের মজুরীর প্রশ্ন তুললো । চনমনে যুবকও মনে হল, এ প্রশ্ন আসবেই, ভেবে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, "শুখা না ভোজন ?" স্বপন বলে ওঠে, "না, না শুখা ।" - "দেড়শো রুপিয়া বাবদ দিয়ে দেবেন পাড়াও," যুবক বলে ওঠে । অবশেষে অনেক দর কষাকষির পর ঠিক হল - একশো কুড়ি টাকা পাড়াও কুলি পিছু আর গাইড হিসাবে তার মজুরী দেড়শো টাকা প্রতিদিন । আগামী কাল সকাল দশটায় সে কুলিদের নিয়ে চলে আসবে । আমরা যেন এক সপ্তার মতো রেশন কিনে নিয়ে তৈরি হয়ে থাকি । বেলাবেলি আমরা সাঁকড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব । একথা বলে, নমস্কার জানিয়ে সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল ।
সুধাংশুর মুখে শুনলাম, যুবকের নাম মূর্তিরাম রাণা, বাড়ি সাঁকড়ি গ্রামের নিচে হর-কি-দুন নালার ওপারে নীচলাপাঁও গাঁয়ে । দেরাদুনে স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা করেছিল । তবে ছেলেটি যে বেশ বুদ্ধিমান, সপ্রতিভ এবং চালাক-চতুর সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । বেশ প্রাণখোলা, দিলখোলা ভাবও সেইসঙ্গে আছে ।
- "মোটামুটি খুব একটা খারাপ হবে না বলে মনে হচ্ছে," তরুণকে বলি । সে কিছু বলে না । একটু মৃদু হেসে উঠে পড়ে পোশাক বদলাবার জন্যে ।
রাত হয়েছে বেশ । আমরাও উঠে পড়ি । গরম র্যাপার মুড়ি দিয়ে নিচে নেমে বাইরের রাস্তায় আসি । লালজীর হোটেলে আমাদের ন'জনের খাবার কথা বলে দিয়েছিল স্বপন । লোকজন কমে এসেছে হোটেলে । স্বল্প বিদ্যুতের আলো । নড়বড়ে টেবিলচেয়ারে সবাই এসে বসি । গনগনে কাঠের উনুনে রুটি সেঁকা হচ্ছিল । গরম রুটি আর কুঁদরুকির তরকারি । আলু লৌকির তরকারিও ছিল । সেই সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ আর ট্যমাটোর সস্ । শেষ পাতে বিমলবাবুর বাড়ি থেকে আনা বাগবাজারের সন্দেশ দু'খানা করে । হৈ-হৈ করে বিমলবাবুর জয়ধ্বনি উঠেছিল হোটেলে সে রাতে ।
তরুণ হোটেলের টাকা মিটিয়ে দিয়ে ফিরে আসে । আমরাও ফিরে আসি । প্রায় জনশূন্য পথঘাট । টিমটিম করে আলো জ্বলছিল কয়েকটা দোকানে । লালার মালের আড়ৎ বন্ধ হব হব । ওপরে আসতেই তরুণ সকলকে বলে দিয়েছিল, যে যার মতো মালপত্র বেঁধেছেঁদে তৈরি হয়ে নিতে হবে কাল সকালে । খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে নিয়ে আমরা বার হব । পর পর ক্যারিমেট পেতে সকলেই বিছানা বানিয়ে নিয়েছিল । আমিও নিয়েছিলাম ।
ঘরের বাইরে বারান্দায় এসে বসি । সিগারেট ধরাই । ভালোই ঠাণ্ডা । মে মাস । রাস্তার দিকে চেয়ে থাকি । উত্তরাখণ্ডের দাবি-দাওয়ার ঢেউ তাহলে এখানে এসেও লেগেছে । স্কুল, কলেজ, তহশিল, কোর্ট-কাছারি বন্ধ করে দিয়েছে । ইন্সপেকশন বাংলো, রেস্টহাউস, ব্যাঙ্কও বন্ধ । ওরাও মাঠে-ময়দানে সভা করে, মিটিং করে, বর্ক্তৃতা দেয় । রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বার করে ঝাণ্ডা উড়িয়ে । স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের অধিকার থেকে কেউই বঞ্চিত হতে চায় না । এ সুরের হাওয়া লেগেছে হিমালয়ের অন্দরে অন্দরে ।
রাত অনেক হয়েছে । জনহীন রাস্তাঘাট । নিস্তব্ধতায় ডুবে গেছে ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম । শুধু কানে আসে তমসার একটানা ঢেউয়ের কল্লোল । দেরি করি না । উঠে পড়ি । ঘরে এসে ঢুকি ।
তরুণ উঠে পড়েছিল আমার আগে । অসীম দায়িত্ব তার মাথায় ।
বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম । পাহাড়ি শহর । ঘুম ভাঙতে তার এমনই দেরি হয় । রাস্তায় লোক চলাচল এখনো শুরু হয়নি । একপাল পথের কুকুর হোটেলের বারান্দায় কুণ্ডলী পাকিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে । রাস্তার আলোগুলো তখনও জ্বলছিল দপদপ করে ।
তমসার ধারে এসে দাঁড়াই । রাস্তার ওপারেই নদী । নদীর গভীর খাদ বহু নিচে নেমে গেছে । খাদের গা ধরে পাথুরে সিঁড়িও নেমে গেছে নদীর কিনারা পর্যন্ত । সিঁড়ির ওপর এসে বসি । জলকণা মেশানো এক রাশ ঠাণ্ডা হাওয়া চোখে মুখে এসে লাগে । অশান্ত তমসা । জলোচ্ছাস যেন বেপরোয়া । নদীর মাঝখানে পড়ে থাকা বিরাট একখানা পাথরের চাঙড়ের সঙ্গেই চলেছে তার অবিরাম সংঘাত । নদীর রূপের তুলনা নেই । ঝুলে পড়া একরাশ পাইনের শাখা-প্রশাখা স্পর্শ করে উদ্দাম নাচের তালে তালে বয়ে যাচ্ছে নিচে । নাচের ছন্দে আত্মহারা, পাগলপারা ।
পশ্চিম গাড়োয়ালের পাহাড়ের হিম অঙ্গ থেকে নেমে আসা রুপিন ও সুপিন নদীর মিলিত মোহনা এখানেই । পরে একসময় যমুনায় হয়েছে কন্ঠলীন । নদীর মোহনাকূলে শিবের মন্দির সবুজ ঘাসের আঙিনা জুড়ে । তার পাশেই প্যাগোডাকৃতি কাঠের প্রাচীন মন্দির - স্থানীয় দেবতা `পোখুর'। মন্দিরে কাঠের কাজ নজর কাড়ে । মন্দিরের দেবতার বার্ষিক পুজো হয়, উত্সব হয়, মেলা বসে । ছাগল ভেড়া বলি দেওয়া হয় দেবতার তুষ্টি সাধনে । এখানে তমসার ওপর উপত্যকায় কর্ণের মন্দির আছে । দেবতা এক আসনে স্থায়ী নন । ঘুরে বেড়ান মানুষের কাঁধে চেপে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে । মন্দিরে মন্দিরে । তারপর একদিন দেবতা নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন । সেই সময় পুজোপার্বনের ধূম পড়ে । মেলা বসে, উত্সব চলে জমজমাট । নাচ-গান, খাই-খাওয়া । প্রতিটি পরিবারে লোকের আনাগোনা চলে । আনন্দ ও খুশির জোয়ার বয় তখন ।
ফিরে আসি হোটেলে । সারা শহর জেগে উঠেছে । সকালের রোদ এসে পড়েছে রাস্তায় । দোকানপাট খুলে সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা । ব্যবসা-বাণিজ্যের জায়গা নৈটেয়ার ।
যাত্রাপর্বের পুরোদস্তুর প্রস্তুতি চলেছে হোটেলে । লালার দোকান থেকে রেশনের সব কিছু মালমশলা - চাল, ডাল, আটা, নুন, তেল, মশলা, চা, চিনি, কেরোসিন, দেশলাই, বাতিটা পর্যন্ত স্বপনের তৈরি ফর্দমাফিক কেনা হয়ে গেছে । মালপত্রের বাঁধাছাঁদার পাটও শেষ পর্যায়ে । কথায় মূর্তিরামের খেলাপ নেই । হোটেল থেকে নিচে নামতেই তার সাক্ষাৎ মিললো । সেইসঙ্গে তার মস্ত দলবল । দড়িদড়া, ছালা একরাশ । এলাহি ব্যাপার !
অভিযাত্রী দল - যাত্রার পূর্ব মুহূর্ত - নৈটেয়ার |
সাঁকড়ির পথ ধরেছিলাম । সুপিন নদীর গা লাগোয়া পথ । জঙ্গলের গভীরে নদী কখনও হারিয়ে যাচ্ছে, কখনও উঁকি দিচ্ছে দুষ্টু মেয়ের মতো । ভাঙাচোরা পথ । খানাখন্দ । পাহাড়ের গায়ে বনবিশ্রাম বাংলোখানা চোখে পড়লো । গতকাল রাতে এখানে এসেছিলাম । গেটে তালা ঝুলছে । ফিরে এসেছি । এর আগে দু'বার এখানে উঠেছিলাম । হর-কি-দুন যাবার সময় । সুন্দর বাংলো । দু'খানা ঘর, রান্নাঘর, ডাইনিং স্পেস, ইত্যাদি । সারা চৌহদ্দি পাইনের আগলে ঘেরা । পরিকল্পনামাফিক ফুল ও ফলের চাষ সারা চত্বর জুড়ে । অনুগত চৌকিদার সব কিছুই করে দেয় । এবারে এখানে থাকতে না-পারার দু:খ নিয়ে চলতে হচ্ছে ।
বনবিশ্রাম ভবনের মাথা ছেড়ে পথ আরো চড়াই ধরেছে । অনন্য, তুলনাহীন পথশোভা । চীর, পাইনের মাতাল হাওয়ায় পথ চলা । সারিবদ্ধ ভাবে চলেছি আমরা । কুলিরা এগিয়ে গেছে । পেছনে তরুণ ও মূর্তিরাম । বিমলবাবু আমার পিছন পিছন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গতিতে আসছিলেন । রবীন, সুধাংশু ক্যামেরা নিয়ে উদভ্রান্ত । কী করবে বুঝতে পারছে না । অর্থাৎ কোন জায়গা ছেড়ে কোন জায়গার ফটো নেবে । মনে মনে ভাবছে সব কিছুকে ক্যামেরায় বন্দি করে নিলে ভালো হয় ।
সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার মধ্যে আছে এ পথে বাস চলাচল । (বর্তমানে চলছে) । তাই পথের সমতা অনেক অনেক জায়গায় ঠিক করা হয়েছে মাটি কাটা ও ফেলার কাজ করে । সুন্দর হবে বাস আসলে । পাহাড়প্রেমীরা আরো কিছু পথ এগিয়ে যাবে আগামী দিনে ।
রাজার টিকির নাগাল পাওয়া যাচ্ছিল না অনেকক্ষণ ধরেই । পার্থ বললো, সে নাকি কুলিদের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আছে । দুরন্ত, সাহসী, প্রাণখোলা যুবক । ভয় হয় মাঝে মাঝে ওর হঠকারিতা দেখলে ।
ছায়ার আলপনা আঁকা পথ - সৌর গ্রামের অভিমুখে |
মনে হল বেশ লক্ষ্মীমন্ত গ্রাম সৌর । গায়ে গায়ে মেশামেশি অনেক বাড়িঘর । ঘরের গা-ধরা ক্ষেত-খামার । ছাগল চরছে, ভেড়া চরছে । ফসলের সমারোহ ক্ষেতি-বাগানে । রামদানার ক্ষেতে মনে হল আগুন জ্বলছে । মাচায় ঝুলছে লাউ, কুমড়ো । ছোটো বড় কাঁচায়, পাকায় শশা । রাশি রাশি । হাঁসুলি হাতে বাগানে কাজ করছে বাড়ির মেয়েরা । নাকে দুল দুল করে দোলে পেতলের নাথুয়া । এই খরদুপুরেও ওদের কাজ না করলে চলবে না । গাছের পরিচর্যা ওরা করে । ফসল তোলে । সাঁকড়ি নৈটেয়ারে গিয়ে ফসল নিয়ে বসবে, বিক্রি করবে । সেই পয়সায় হাটবাজার করে তবে ঘরে ফিরবে । এ ওদের সারা বছরের কাজ । শুধু শীতের দিনগুলো বাদে । সে-সময়ে বাড়িতে সঞ্চিত ফসলে ওরা সংসার চালায় । কষ্ট, দু:খ ওদের নিত্য সঙ্গী সংসারে । সরল, অনাড়ম্বর জীবন ।
পোর্টাররা পিঠের মালপত্র নামিয়ে গোল হয়ে বসেছে রাস্তার পাশে বিশ্রাম নিতে । হাড়ভাঙা পরিশ্রম ওরাও করে । তবেই রুজি-রোজগার মেলে । মরশুমের কটা দিন ছাড়া ওদের বড় কষ্ট । চাষবাস, পশুপালন ছাড়া গতি থাকেনা । ছোটোখাট ব্যবসা-বাণিজ্য, রাস্তা মেরামতির কাজও করে কেউ কেউ ।
|
--
আবার পথ চলা শুরু । সাঁকড়ির উদ্দেশ্যে । এখান থেকে সাঁকড়ি আরো ৫ কি.ংইম । পথ বেশ ভাঙাচোরা । কখনও ওপরে উঠছে, কখনও নামছে । পথে গাছগাছালির ছায়া । উড়ো মেঘের দল আকাশে ।. যাচ্ছে কোনো নিরুদ্দেশের পথে । ঠিক-ঠিকানা নেই ।
পথ চলতে ভালোই লাগছিল । খানিক হাঁটি, খানিক দাঁড়াই, বিশ্রাম নিই । পথ চলার অবসাদ দূর হয় এখানের স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়ায় । হিমালয়ের পথে হাঁটার মস্ত সুবিধা হল এখানের হাওয়ায় আছে মজার এক যাদু । সে যাদুতে পথের কষ্টতো দূর হবেই, সেই সঙ্গে বাড়তি পাওনা হবে আনন্দ ; উত্সাহের ভাঁটাতে আসে প্রবল জোয়ার । সে জোয়ারে গা ভাসিয়ে চলেছি আমরা । পথের কষ্টকে আর কষ্ট বলেই মনে হয় না ।
রোদের তেজ নরম হতে শুরু করেছে । দূরে নদীর মাথায় সারা উপত্যকা জুড়ে থাক থাক ধানের ক্ষেত । কোথাও ঘন হলুদের আভা আবার কোথাও বা হাল্কা হলুদের ছোপ । চোখ জুড়িয়ে যায় দেখলে ।
রাজা হাত তুলে দেখায় সাঁকড়ি গ্রামের ঘরবাড়ি পাহাড়ের গায় দেখা যাচ্ছে । দেখে সত্যিই মনে হল, যেন কোনো জাত শিল্পীর সুদক্ষ হাতের তুলির টানে আঁকা এক অভিনব চিত্রপট । হাল্কা সবুজ পশ্চাত্পটে অসংলগ্ন একরাশ ঘরবাড়ি নিচে ওপরে । চেয়ে চেয়ে দেখি । শিল্পীর নিখুঁত কল্পনায় অপরূপ মিল খুঁজে পাই ।
সাঁকড়ির গা ঘেঁসে এসে পৌঁছেছি । বেশ বড়সড় গ্রাম । জনবহুল, সমৃদ্ধ । পথে ঢুকতেই চোখে পড়লো পাথুরে টিলার ওপর গাড়োয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের বিশ্রামগৃহ । দেখে মনে হল, বেশ সাজানো গোছানো পরিপাটি বাংলো । যদিও রাত্রিবাসের সৌভাগ্য আমাদের হবে না তবুও বাংলোর চেহারাখানা ভালোই লেগেছিল ।
|
তরুণ এসেই চায়ের অর্ডার দোকানিকে দিয়ে দেয় । কুলিদেরও চা করতে বলে । এ-দোকানে সে-দোকানে উঁকিঝুঁকি দিই । পথের এক ধারে হঠাৎ হদিশ মেলে বাঙালি হোমিওপ্যাথি এক যুবক ডাক্তারের । ডাক্তারখানা বানিয়ে বসেছেন । ছোটো, পাকাপোক্ত টিনের একচালা ঘর । কাঠের চেয়ারটেবিল পাতা । বসবার জন্যে বেঞ্চ আছে দু'খানা । সব নতুন তৈরি । ডাক্তার মেদিনীপুর জেলার অধিবাসী । কয়েকবছর হল এখানে আছেন । স্থানীয় মানুষজন অনেকেই চিকিত্সার জন্যে এখানে নিত্য আসেন । মাঝেমধ্যে দেরাদুনে তাঁকে যেতে হয় ওষুধ আনবার জন্যে । যুবক ডাক্তার খুবই খাতির করলেন আমাদের । বললেন, প্রতি বছর এইসময় আর পুজোর আসেপাশে বহু বাঙালি পরিবার ও পাহাড়যাত্রীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয় । বড় ভালো লাগে যখন বাঙালি বলে তাঁরা পরিচয় দেন । চা খাবার অনুরোধ জানালে, না বলি । আমাদের চায়ের কথা বলা হয়েছে দোকানে বলে তাঁকে সুস্থিত করি । স্থানীয় মানুষেরা বড় ভালো সংবেদনশীল । সবদিক থেকেই আমায় সহায়তা করে । বাংলাদেশে মাঝে মাঝে ফেরেন কিনা জিজ্ঞাসা করতেই ডাক্তারবাবু চুপ করে থাকেন । পরে ম্লান কন্ঠে বলে ওঠেন, "ফেরা আর হবে না । এখানেই সংসারী হয়েছি ।" বিদায় চেয়ে নিয়ে ফিরে আসি চায়ের দোকানে । বিমলবাবু এদিক সেদিক আমাকে খুঁজেছেন, শুনলাম । চা, বিস্কুট খেলাম । রাজা গাঁয়ের মধ্যে থেকে কয়েকটা বড় বড় শশা প্যাকেট ভর্তি করে কিনে এনেছিল । তাই ছাড়ানো হল দোকানে বসে । সকলকে বিলি করা হল । হিমালয়ান শশা, যেন অমৃততুল্য বৈকালিক চা পর্বে ।
সাঁকড়ি থেকে আমাদের পথ বদল করার কথা । মূর্তিরাম পোর্টারদের বলে দিয়েছিল তারা যেন পথে বসে অপেক্ষা করে যেখান থেকে পথ দু'ভাগ হয়ে গেছে । সাঁকড়ি গ্রামের শেষ সীমা আমরা পেছনে ফেলে এলাম । পথ গোল হয়ে নিচে নেমে গেছে । বাড়িঘর, দোকানপাট এক এক করে শেষ হয়ে গেল গ্রামের । এদিকে দেখলাম নতুন রাস্তার কাজ জোর কদমে চলছে । পথ নাকি আপাতত আগের গ্রাম তালুকা পর্যন্ত যাবে । এখান থেকে ১১ কি.ংইম. । হর-কি-দুনের পথে পড়ে । অরণ্য ঘেরা সুন্দর বন বিশ্রামভবন আছে "গোবিন্দপন্থ অভয়ারণ্যের" মধ্যে । মনে পড়ে, ওপথে যাবার সময় দু'রাত কাটিয়েছিলাম বন-বাংলোয় । চৌকিদারের আতিথেয়তার কথা ভোলবার না । রাতের গভীরে শ্বাপদসঙ্কুল অভয়ারণ্যের মধ্যে বন-বাংলো থেকে সে আমাদের বাঘের গর্জন শুনিয়েছিল আর সেইসঙ্গে ভয়ার্ত কোনো দুর্বল প্রাণীর অন্তিম চিত্কারও । সে কথা আজও ভুলিনি ।
ভাঙাচোরা, খানাখন্দ পথ । কয়েকদিন আগের বৃষ্টিতে পথে জল জমে আছে । মাঝে মাঝে থকথকে কাদাও বেশ । পথ দেখে শুনে চলতে হচ্ছিল । বিমলবাবুকে সাবধানে হাঁটতে বলি । সেই সঙ্গে নীলাদ্রিকেও । সে নতুন আসছে পাহাড়ে । নৈহাটিতে থাকে । রাজার পাড়ায় । রাজাই ওকে এনেছে । মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে এবার । তেরো, চোদ্দ বছর বয়েস হবে । সুন্দর স্বাস্থ্য । বেশ ডানপিটে মতো ।
কুলিরা বসে বসে বিড়ি টানছিল । আমাদের দেখেই একটু চঞ্চল হয়ে ওঠে । রেশনের মালপত্র আমাদের এবং পোর্টারদের, তাঁবুর বেশ বড় বড় পিট্টু, রান্নার সাজ-সরঞ্জাম, কেরোসিনের জারিকেন, স্টোভ, প্লাস্টিক, দড়িদড়া অনেক কিছুরই আয়োজন সঙ্গে নিয়ে যাওয়া । এছাড়া তো প্রত্যেকেরই স্বতন্ত্র রুকস্যাক আছে । এ যেন এক বিশাল অভিযান পর্ব !
পিঠে মালপত্রের গাঁটরি, পিট্টুগুলো তুলে বেঁধে নিয়ে কুলির দল এপথ ছেড়ে দিয়ে নিচে নামতে শুরু করলো পাহাড়ের খাদের দিকে । আমরা যে-পথ ছেড়ে দিচ্ছি সেটা চলে গেছে হর-কি-দুন, বোরাসু ও নলগার পাসে । নতুন পথের কাছে এসে চমকে উঠি । এই পথ ! সরু লিকলিকে দড়ির মতো পথ যেন ঝুলছে পাহাড়ের গা থেকে । দু'পাশ ঝোপঝাড়ে ভর্তি । কোথাও কোথাও জঙ্গলে পথ ভালো মতো দেখাও যাচ্ছে না । বৃষ্টির জলে মাটি ক্ষয়ে গেছে । মাঝে মাঝে পাথর বার হয়ে ঝুলছে । সব থেকে অসুবিধে হল বড্ড বেশি খাড়াই ।
বিমলবাবু পথ দেখেই মুখখানা কেমন করলেন ওপর থেকে । আমার দৃষ্টি কিন্তু এড়ায়নি । বললাম, "ভাববেন না, মূর্তিরামকে বলছি, ওই আপনাকে নামিয়ে দেবে"।
রাজাই প্রথমে নিচে নামতে শুরু করলো । `হিম-আলয়ের' স্থায়ী সদস্য সে । সুন্দর স্বাস্থ্যবান যুবক । দুর্গম পাহাড়ের টানে ইতিমধ্যেই সে অনেক পাহাড়ে ঘুরেছে । মন ওর বড় সুন্দর । কোনো সমস্যাকে ও বিশেষ বড় ভেবে আমল দিতে চায় না । সবই হাল্কা ভাবে নেয় । হঠকারিতায় ওর জুড়ি মেলাও ভার । নিচের খাড়াই পথ ধরে ঝোপঝাড়ের পাশ কাটিয়ে ও কেমন নাচতে নাচতে নেমে গেল । রবীন, সুধাংশু, স্বপন ওরাও নেমে পড়লো পথে । পার্থ নীলাদ্রিও । আমিও । ঝোপঝাড় ধরে পিছন ফিরে নামতে শুরু করি । বিমলবাবুকে তরুণ আর মূর্তিরাম হাঁটি-হাঁটি-পা-পা করে নামতে লাগলো । অনেকটা ঠিক `কথামালার' হাঁস ও কচ্ছপের গল্প ও ছবির মতো ।
নিচে গভীর জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়ি । চারদিকে নানা জাতের গাছপালায় ঠাসাঠাসি । রোদ এসে পডে ংআ এখানে একফোঁটা । কেমন স্যাঁত্সেঁতে আর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব ।
কান দু'টো যেন ঝালাপালা হবার উপক্রম । জঙ্গলে ডোবা বিশাল বিশাল বোল্ডারের মধ্যে দিয়ে হর-কি-দুন নালা গভীর গর্জনে নিচে নেমে যাচ্ছে । নালা এখানে প্রবলা-প্রমত্তা । জলের তোড়ে রাশি রাশি শুকনো পাতা, কাঠ, গাছের টুকরো ডালপালা ভেসে যাচ্ছে নিমেষে । একটু নিচে নামতেই চোখে পড়লো নালার মাথায় ঝুলন্ত লোহার পুল । থর থর করে কাঁপছে । নালার ওপারে খাড়াই পাহাড়ের পাঁচিলের ঢাল ওপরে উঠে গেছে । চোখ চাইতেই নজরে পড়লো কুলিরা পাঁচিলের মাথায় বসে আছে । বোল্ডারের ওপর পুরু জমাট বাঁধা শ্যাওলার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া জলের ছিটেয় লোহার ব্রিজ ভিজে যাচ্ছিল সব সময় । এক এক করে আমরা সবাই ব্রিজ পার হয়ে আসি এপারে । ঝুরো পাথরে বোঝাই সারা জায়গাটা । পাহাড়ের দেওয়ালের গা ধরে সরু খাড়াই পথ এবার ওপরে উঠে গেছে ।
সূর্য এখনো অস্ত যায়নি । পশ্চিম আকাশ গাঢ় লাল । খাড়াই পথে পা বাড়াই সবাই । পথ শেষ হল ওপরে বেশ খানিকটা মাঠের মতো স্বল্প পরিসরে । টুকরো হলুদ পাথরের ছড়াছড়ি খাদের ওপর চারদিকে । মনে হল খুব বেশি দিন হয়নি পাহাড়ের এক বিরাট অংশের ধস নেমেছিল এখানে । কেননা পাহাড়ের অনেকখানি অংশ হাঁ-হাঁ করছে । গাছপালা শূন্য পাথর বিচ্ছিন্ন মধ্যাংশ দেখা যাচ্ছে হলুদ রঙের পাথরের দগদগে স্তর । ধস পরিষ্কারের ফলে পরিসর অনেকখানি বেড়েছে এবং স্থানটুকু মাঠের মতো সমতলও হয়েছে ।
কুলিরা অনেক আগেই এগিয়ে গেছে । মূর্তিরাম বলে উঠলো, "নীচলাপাঁও গাঁয়ের চৌহদ্দি শুরু হল এখান থেকে বাবুজী" । "নীচলাপাঁও গ্রাম যদি এখানে হয়, তাহলে উঁচলাপাঁও গ্রাম নিশ্চয়ই এখানে আছে" বলে উঠি । "জী-বাবুজী এই পাহাড়ের মাথায় আছে উঁচলাপাঁও গাঁ । বহুৎ সুন্দর জায়গা । ক্ষেতি, ফসল আচ্ছা হয় সেখানে"। মুর্তিরাম বলে ওঠে ।
আধখানা বৃত্তের পরিধির মতো পথ পাহাড়কে ঘিরে নেমে গেছে নিচে হাল্কা ঢাল ধরে । পথের বাঁ ধারে খাদ । বেশ গভীর বলেই মনে হল । সন্ধ্যার অন্ধকারে বিশেষ কিছুই দেখা যায় না । পথ ঘন বনাচ্ছন্ন । ম্লান আলো এখানে ওখানে ছড়ানো । পথ নেমে যাচ্ছে আস্তে আস্তে । ঝিঁঝিঁ-র ডাক শুরু হয়েছে । কী একটা তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে প্রবেশ করেছি । দু'চারটে আলোর বিন্দু এদিক ওদিক চোখে পড়ে । ঘরবাড়ি যে শুরু হয়েছে গ্রামের তা বেশ বুঝতে পারছিলাম । বেশ খানিকটা পথ নেমে এসেছি । এরপর নামতে নামতে এক জায়গায় এসে থেমে পড়ি । কুলিদের চোখে পড়ে । ওরা গল্প করছিল বসে বসে । গ্রামের মানুষ এসে হাজির হয়েছে দু'চার জন দেখলাম । মূর্তিরাম এসেই অদৃশ্য হল বলেই মনে হল । পিঠের স্যাকগুলো নামিয়ে আমরাও বসে পড়ি রাস্তার ওপর ।
প্যান্ট ও বুশসার্ট পরা বেশ সভ্যভব্য স্থানীয় এক যুবককে সঙ্গে নিয়ে মূর্তিরাম ফিরে এল একটু পরে । টর্চের আলোয় দেখলাম, রাস্তার পাশে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি একটা ঘরের তালা খুলে দিল যুবক । মনে হল ঘরখানা তারই । মূর্তিরাম পেট্রল ম্যাচ জ্বেলে বাতি ধরিয়ে ঘরের এক কোনায় বাতিটা বসিয়ে দেয় । বাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় চোখে পড়ে কাঠের তক্তা, টিন, কোদাল, গাঁইতি, বেলচা আর সিমেন্টের বস্তায় প্রায় আধখানা ঘর ঠাসা । তরুণ কানে কানে বলে, "এখানেই আজ আমাদের থাকতে হবে ।" মনে মনে একটু না চমকে পারিনি । তবে ভালো না-লাগার প্রকাশভঙ্গিকে একটু সংযত করতে সচেষ্ট হয়েছিলাম । বিদেশ-বিভূঁই বেপোট জায়গা - এতো হবেই । প্রত্যাশা, চাহিদা মাফিক পাওনা পাব কোথায় সবসময় ?
যুবকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল মূর্তিরাম । নমস্কার বিনিময় হল । নাম জয়দীপ রানা । নিচলাপাঁও গ্রামেই বাড়ি । বয়স ত্রিশের কোঠার মধ্যে । স্থানীয় রাস্তাঘাটের কনট্রাক্টর । আলাপ জমে উঠতে দেরি হল না । যুবক এম. এস. সি. পাস । একটু আশ্চর্য হলাম ! কথায় কথায় বলে বসি, "পড়াশুনা কোথায় করতেন ?" সহাস্যে যুবক বলে ওঠেন, " দেরাদুনে । ওখানের কলেজেই পড়তাম । হোস্টেলে থাকতাম ।" কৌতূহলি হয়ে আবার প্রশ্ন করি, "কনট্রাকটরির কাজ কী খুব ভালো লাগে বুঝি ? এতে এলেন কেন ?" মুখটা একটু ম্লান হয়ে গেল আমার প্রশ্ন শুনে । বলে ওঠেন, "দেখুব এ কাজ করার খুব ইচ্ছে আমার ছিল না । পড়াশুনার মধ্যে থেকেই বাইরে কোনো চাকরি নিয়ে থাকবো । কিন্তু তা হল না ।" যুবক একটু চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করেন, "বাবা মারা গেলেন । মার মোটে ইচ্ছে নয় আমি বাইরে থাকি । চাষবাস, ক্ষেতিবাড়ি কে দেখাশোনা করবে ? বাধ্য হয়ে এই রাস্তার কাজে নামলাম । তখন এসব অঞ্চলে সরকার রাস্তা, রেস্টহাউস, ইন্সপেকশন বাংলো, ব্রিজ এইসব নতুন নতুন পরিকল্পনার কাজ হাতে নিয়েছেন । তাছাড়া রাস্তা মেরামতির কাজ তো নিত্যই লেগে আছে । তাই এই কাজেই এলাম । বাড়িতে থাকাও হল । লাভজনক কাজ ।"
"ভালো, খুবই ভালো । তবে যদি সত্ভাবে চালাতে পারেন ।" বলে উঠি ।
যুবক কিছু বলে না । মৃদু হাসতে থাকেন ।
চুপচাপ কিছুক্ষণ কাটার পর আবার বলি, "দেখুন, আর একটা কথা বলবো ভাবছি আপনাকে । আপনার গ্রামের শিশুশিক্ষার দিকে পারেন তো একটু নজর দেবেন । শিক্ষার অগ্রগতি এসব অঞ্চলে বড় কম ।"
সঙ্গে সঙ্গেই যুবক বলে ওঠেন, "ঠিকই বলেছেন, এডুকেশনের মান খুবই খারাপ এসব অঞ্চলে । তবে আমিও চেষ্টা করছি । যদিও এখানে শিশুদের একটা ফ্রি প্রাইমারি স্কুল আছে, কিন্তু তারপরে পড়াশুনা করতে হলে নৈটেয়ারে গিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা করা খুবই অসুবিধাজনক । তাই এখানে জুনিয়র হাই স্কুল করার চেষ্টা করছি । সরকারি স্যাংশানের জন্যে আবেদনও করেছি ।"
- "ভালো, চেষ্টা করে যান । আপনার যাঁরা গ্রামের এডুকেটেড পারসন, তাঁদের অবশ্যই এই ভাবনা চিন্তা হওয়া দরকার । ভগবানের আশীর্বাদ অবশ্যই আপনারা পাবেন ।" অভিভাবকের মতো বলে ফেলি ।
তরুণ আমাকে ইশারা করে বলে, ওঁকে একটু বলে দেন, আগামীকাল সকালে আমরা লোকাল ভিলেজ সার্ভে করবো আর সেই সঙ্গে গ্রামের অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখে কিছু ওষুধপত্র বিতরণ করবো । যুবককে সঙ্গে সঙ্গে এসব কথা বলি এবং সেই সঙ্গে আরো জানাই তিনি যেন আজই রাতে পাড়া প্রতিবেশিদের এ কথা জানিয়ে দেন । আগামী কাল খুবই সকালে আমরা পাড়ায় যাব । যুবক মনে হল, আমার কথায় বেশ খুশি হয়েছে । সপ্রশংস দৃষ্টিতে বলে ওঠেন, "নিশ্চয়ই বলবো, এক্ষুনি গিয়ে । জানেন চিকিত্সা রোগের ওষুধপত্রের এখানে অত্যন্ত অভাব ।" মাথা নেড়ে জানাই, আমরা তা জানি ভালো ভাবেই ।
রাত হয়ে আসছিল । ঠাণ্ডাও বেশ পড়েছে । যুবক নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিল । মূর্তিরামও তাঁর সঙ্গে চলে যায় । তার বাড়ি এখানেই । কাল সকালে সার্ভে ওয়ার্কে আমাদের সঙ্গে থাকবে ।
রবীন ইতিমধ্যেই কুলিদের দিয়ে কাঠের ঘরের মধ্যে থেকে অনেক কিছু মালপত্র বাইরে বার করে দিয়ে ঘর প্রায় খালি করে ফেলেছিল । আরো দু'টো বাতি জ্বেলে স্বপন তাদের দিয়ে পাড়ার বাড়ি থেকে জল আনিয়ে চায়ের উদ্যোগ শুরু করে । পোর্টারদের কয়েকজনের বাড়ি নাকি এই গাঁয়েই । কুন্দন সিং এই গাঁয়ের মানুষ । কুলিগিরি করে । সে নাকি সিংকা-লার পথে গিয়েছিল একবার ভেড়া ছাগল চরাতে । লা পার হতে পারেনি । ঝড় বৃষ্টির জন্যে ফিরে এসেছিল । ওদিকের পথ নাকি মারাত্মক বিপজ্জনক ।
প্যাকেট থেকে বিস্কুট বার করে রবীন হাতে হাতে দিয়ে দেয় । সকলে যে যার মতো চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে চা ঢেলে নেয় । পোর্টাররাও যে যার মতো চা, বিস্কুট নিয়ে নেয় ।
কুন্দন আর কল্যাণ সিংয়ের উদ্যোগে, স্বপনের তদারকিতে রান্নাপর্ব শুরু হয়েছিল । ঢালাইয়ের কাঠের টুকরোর অভাব ছিল না ঘরে । খিচুড়ি, আলুসিদ্ধ, পাঁপরসেঁকা আমাদের জন্যে আর পোর্টাররা চাপাটি বানিয়ে নিয়েছিল ।
সারা ঘর জুড়ে প্লাস্টিক আর কেরিমেট বিছিয়ে ঢালাও বিছানা । পোর্টাররা বাইরে মাথায় প্লাস্টিক সিট খাটিয়ে নিয়েছিল টানটান করে দড়ি বেঁধে ।
রাত গড়িয়েছে অনেক । খাঁ খাঁ করছে সারা গাঁ । দূরে পাড়ার কুকুরের ডাক কানে আসছিল মাঝে মধ্যে । র্যাপার মুড়ি দিয়ে বাইরে এসে বসি পাথরের চাঙড়ের ওপর । কনকনে ঠাণ্ডা । সিগারেট ধরাই ।
নি:শব্দ পাষাণপুরী । মাথার ওপর এক আকাশ জলন্ত নক্ষত্র । দপদপ করছিল । সারা গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে ।
ফিরে আসি ঘরে । মিটমিটে বাতিটা তখনও জ্বলছিল ঘরের কোণে । তরুণ জেগে আছে । ওষুধের পিট্টু খুলে ওষুধের বাক্স গুলো বার করছিল এক এক করে । কাল সকালে
নিচলাপাঁও গ্রামের সার্ভেওয়ার্ক শুরু হবে । সেই সঙ্গে হবে কলকাতার দে'জ মেডিক্যাল স্টোর্সের দেওয়া ওষুধ বিতরণ । এই ওষুধ প্রাপ্তির ব্যাপারে "হিম-আলয়" সংস্থার প্রাণপুরুষ বিদ্যুৎ কর্মকারের অবদান সব থেকে বেশি । দে'জ মেডিকেল স্টোর্সের কর্মকর্তা গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সে বহু ওষুধপত্র বিনামূল্যে পাহাড়ি দু:স্থ, অসুস্থ মানুষদের বিতরণের জন্যে সংগ্রহ করেছিল । ধন্যবাদ সত্যি ওরই প্রাপ্য ।
[ক্রমশ:]