• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩১ | অক্টোবর ২০০৩ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • সান্তাক্লজ এসেছিল : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য



    ভাই বুলু,

    এবারে পুজোয় বাবা-মা'র সঙ্গে কাশী গিয়েছিলাম বেড়াতে । সেখানে গঙ্গার ধারে অনেক বড়ো বড়ো নোংরা নোংরা পাথরের বাড়ি, অনেক চানের ঘাট আর অনেক কুস্তির আখড়া । দশমীর দিন বজরায় চেপে রামনগরের রাজার বাড়ি যাওয়া হ'ল । যেতে যেতে বজরার মাথায় বসে বাবার ক্যামেরা দিয়ে একটা ছবি তুলেছি । ওপরের কাচওয়ালা ফুটোটা দিয়ে চোখ চেয়ে লাল বোতাম টিপতেই ফি-স-স-স করে একটা আওয়াজ করে ছবিটা এসে ক্যামেরাতে ঢুকে গেল । শব্দটা অনেকটা কালী-বিল্লির এগারো নম্বর মেয়ে কুতুকুমারী রাগমাগ করে যেমন শব্দ করে আমাকে শাসায়, ঠিক তেমনি । সন্ধেবেলা রামনগর থেকে বজরায় চেপে ফিরতি রওয়ানা হলাম । এপারে পৌঁছে বজরাওয়ালাকে বাবা গিয়ে বলতে, সে মনিকর্ণিকা ঘাট অব্দি এগিয়ে গিয়ে তারপর বজরা আবার ফিরিয়ে নিয়ে চলল কেদার ঘাটের দিকে । ওইখানেই আমাদের নামতে হবে ।

    ঘাতে নামতেই আমাদের মতো বড়ো বড়ো অনেকগুলো ছেলেমেয়ে ছুট্টে ছুট্টে এল চারদিক থেকে । তাদের হাতে চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা বাঁশের চ্যাঙাড়ি । থুকুপিসির বিয়ের সময়ে যেমন চ্যাঙাড়িতে তত্ত্ব এসেছিল সেইরকম । তার ওপরে ছোটো ছোটো পাতার তৈরি একদিক খোলা সব কৌটো । কৌটোর মধ্যে এ--ই টুকুনি টুকুনি মাটির প্রদীপ । তাতে তেলের বদলে মোমে ভেজানো শক্ত পলতে রাখা রয়েছে একটা একটা করে । আমাদের বাড়ির পেতলের প্রদীপের মতো মোটেই দেখতে নয় । প্রথমে দাম বলেছিল একটাকা করে । মা একবার ধমক দিতেই থতমত খেয়ে কমিয়ে পঞ্চাশ পয়সা করে দিল । মা, মিঠুকাকি, পুঁটুকাকি, ঝুপাপিসি সবাই দু'টো-তিনটে করে প্রদীপ কিনল ।

    আমি বললাম ও দিয়ে কী হবে ? আমাদের বাড়িতে তো কারেন্ট আছে । বড়ো বড়ো মোমও আছে । তাহলে ? তখন মা বলল, জলের দিকে চেয়ে দেখ । তাকিয়ে দেখি, ওরে ব্বাস !! কত লোক, জন, জলের কাছে দাঁড়িয়ে প্রদীপগুলো জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে, আর নমস্কার করছে । ভারি মজার খেলা তো ! আমি বললাম, আমিও একটা ভাসাবো । মা বলল, ভাসাবিই তো । আর ভাসিয়ে দিয়ে চোখ বুজে শিবঠাকুরের কাছে যা চাইবি তা-ই পাবি ।

    একটা প্লাস্টিকের ঠোঙায় করে মা আমাকে তিনটে চারটে প্রদীপ কিনে দিলে, তারপর আমার হাত ধরে জলের কাছে নিয়ে গেল, আমি ঠোঙা থেকে একটা একটা করে প্রদীপ বার করে দিলাম, মা দেশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে দিল আর আমি সেগুলো জলে ভাসিয়ে দিয়ে দিয়ে অনেককিছু চেয়ে নিলাম শিবঠাকুরের কাছে । যেমন,
    ১ নং -- ঠাম্মা যেন কোনোদিন না মরে ।
    ২ নং -- মা যেন অফিসের কাজে কখনও একদিনের জন্যেও দিল্লি না যায় ।
    ৩ নং -- আমি যেন অন্বেষার সঙ্গে দৌড়ে ফার্স্ট হতে পারি ।
    তিন-নম্বর প্রদীপটা ভাসতে ভাসতে একটু দূরে গিয়ে একটা নৌকোর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ার পর আর দেখা গেল না । মা বলল, প্রদীপটা বোধহয় নৌকোর উল্টোদিকে ভেসে গিয়েছিল বলে দেখা যায়নি । আমি অবশ্য ঠিকই বুঝলাম, শিবঠাকুর এই তিন-নম্বর ইচ্ছেটা শুনলো না ।

    যাই হোক, সবার প্রদীপ ভাসানো শেষ অহ্লে আমরা গিয়ে হরিশচন্দ্র ঘাটে বসলাম । আমি আর মহুল মিলে ছুটোছুটি খেললাম, আর বড়োরা গান গাইল । তারপর কেউ যখন ভালো গাইতে পারল না, তখন গান ছেড়ে সবাই গল্প জুড়ল । মহুল গিয়ে ওর মায়ের কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ।

    তখন আমি প্লাস্টিকের ব্যাগটায় হাত ঢুকিয়ে দেখলাম, একটা প্রদীপ বাকি আছে । দেশলাইটাও আছে । শিবট:ংআকুরের কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা ইচ্ছে করব বলে এটা সরিয়ে রেখেছিলাম । এদিক-ওদিক চেয়ে দেখি কেউ খেয়াল করছে না । আমি তখন সিঁড়ি বেয়ে একদম জলের কাছে গিয়ে জলে পা ডুবিয়ে বসে প্রদীপটা পাশে রেখে দেশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে ফেললাম । তারপর নীচু হয়ে ঝুঁকে প্রদীপটা জলে ভাসিয়ে দিয়ে জোড় হাত করে বললাম, "শিবঠাকুর, প্রত্যেকবার বড়োদিনের সময় সান্তাক্লজ এসে চুপিচুপি গিফ্ট রেখে যায়, একবারও তাকে দেখতে পাই না । এবার যেন তুমি সান্তাক্লজকে বলে দিও আমায় দেখা দিয়ে যেতে ।

    প্রদীপটা বেশ দুলতে দুলতে জলে ভেসে গেল । ঠি তক্ষুণি কে যন আমার পিঠে এসে হাত রাখল । চেয়ে দেখি, ইয়া মোটা, কালো একটা লোক । খালি গা । গামছ পরা, মুখে অ্যাত্তোবড়ো পাকা দাড়ি । হিন্দিতে কথা বলছিল } আমি তো হিন্দি জানি, তাই বুঝতে পারলাম । তোমায় বাংলা করে লিখে দিচ্ছি ।

    লোকটা বলল, খুলি, তুমি একা একা এখানে বসে কি করছ ?
    আমি বললাম, প্রদীপ ভাসাচ্ছি ।
    সে বলল, রাত্রিবেলা এইটুকুন মেয়ে একা একা এভাবে জলের কাছে চলে এলে, তোমার বাড়ির লোকজন কোথায় ?
    - ওই তো ওপরে বাবা মা'রা সব বসে আছে ।
    - তাই বলে তুমি যে একা একা জলের কাছে নেমে এলে, তোমায় যদি জলরাক্ষস ধরে নিয়ে যেত ? এখানে জলরাক্ষস আছে তা জানো তো ?

    আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে লোকটাকে চেপ্পে ধরে ফেললাম । সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, এমা ভয় পেলে নাকি ? আমি এসে গেছি, ওমনি জলরাক্ষসও পালিয়ে গেছে । আমায় ওরা খুব ভয় পায় তো ! লোকটার এই মোটা মোটা হাত, পা লম্বা যেন পাহাড় । তাই দেখে, আর ওইরকম কথা শুনে আমার ভয় কেটে গেল, আর আমি ফিক করে হেসে ফেললাম । তখন লোকটাও হসল, আর গামছার কোমর থেকে একটা আমলকী বার করে আমায় খেতে দিল । তারপর বলল, চলো তোমায় তোমার মায়ের কাছে দিয়ে আসি । এই বলে আমায় কাঁধে বসিয়ে এক এক লাফে তিনটে চারটে সিঁড়ি পেরিয়ে বাবা মাদের কাছে নিয়ে এল ।

    সব শুনে মা ভীষণ ভয় পেয়ে গেল । বাবা চোখ গোল গোল করে রেগে মেগে আমাকে, মাকে বকল । তারপর লোকটার দিকে হাসি হাসি মুখ করে চেয়ে বলল, ভাগ্যিস তুমি দেখেছিলে ! নয়তো, ছোট্টো মানুষ, এই রাতে যদি জলে পড়ে যেত ?

    লোকটা বাবাকে নমস্কার করে বলল, আমি এইখানে নৌকো চালাই বাবু । যদি কখনও নৌকোয় চড়েন, আমায় বলবেন । খুকির জন্য ভাড়া ফ্রি । বাবা বলল, নিশ্চয়, নিশ্চয় । তা তোমায় খুঁজে পাবো কী করে ?

    লোকটা বলল, আমার নাম শান্তা সিং । হরিশচন্দ্র ঘাটে সবাই জানে । এখানে এসে শুধু বলবেন, শান্তা সিংএর নৌকো । তাহলেই সবাই দেখিয়ে দেবে । এই বলে বড়ো বড়ো পা ফেলে নীচে নেমে গিয়ে জলের কাছে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ।

    বাবা মাকে কিছু বলিনি । লোকটা আসলে শান্তা সিং নয় । আমি ঠিক জানি । ও হ'ল সান্তাক্লজ । শিবঠাকুর আমার প্রার্থনা শুনে, আর জলরাক্ষসের হাতে আমার ভয়ানক বিপদ দেখে ঠিক ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিল । তাই মাঝির ছদ্মবেশে আমায় এসে দেখা দিয়ে গেছে । একটা আমলকি উপহারও দিয়ে গেছে । নইলে এত নাম থাকতে ওর নামই বা শান্তা সিং হবে কেন, আর অতবড়ো সাদা দাড়িই বা হবে কেন ?

    বাবা মা শুনলে হাসবে বলে এসব কথা আর কাউকে বলিনি । খালি তোমায় জানালাম ।

    ইতি,

    তিতাস



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments