সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে বাংলা কাব্যজগতে একটি বিশেষ অধ্যায় সমাপ্ত হ’ল। ১৯৪০-সালে যখন তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ প্রকাশিত হয় তখনো রবীন্দ্রনাথ জীবিত, জীবনানন্দ তাঁর কাব্যজীবনের মধ্যগগনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। এই সময়ে তরুণ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বাংলা কবিতায় একটি নতুন ইডিয়ম সংযোজন করলেন ‘পদাতিক’-এর মাধ্যমে। পদাতিকের পদচারণার সেই যে শুরু, সুদীর্ঘ ছয় দশকের অধিক অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পর আজ তা সমাপ্ত।
খুব সম্ভবত সুভাষই প্রথম কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন শুরু করেননি। সাধারণত কৈশোর ও যৌবনের প্রেম ও বিশেষত প্রেম-ব্যর্থতা থেকে কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা অনেক কবিই লাভ করেন। একমাত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও সুকান্ত ভট্টাচার্যের আবির্ভাব লগ্নের অবিস্মরণীয় কবিতাগুলি সাধারণভাবে জীবনসংগ্রাম সম্বন্ধীয়, বিশেষভাবে প্রেমের মিলনবিরহ সম্বন্ধীয় নয়, সাধারণ অর্থে রোম্যান্টিকও নয়। সুভাষ যে সুকান্তর কবিতা পড়া-মাত্রই তার মধ্যে অসামান্য প্রতিভা দেখতে পেয়েছিলেন, তা তাই স্বাভাবিক।
সুকান্ত মাত্র বিশ বছরের অতিহ্রস্ব জীবনযাপন করে, কয়েকটি অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তি বাঙালিকে দান করে সেই চল্লিশের দশকেই অকালে প্রয়াত হলেন। অন্যদিকে বাঙালির পরম সৌভাগ্য, সুকান্তর পরিচিত ও অগ্রজপ্রতিম কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় দীর্ঘ জীবন ধরে অজস্র কবিতায় বাঙালিজীবনকে সমৃদ্ধ করলেন। সুকান্তর কথা উল্লেখ করছি, কারণ তাঁর অকালপ্রয়াণে বাংলা কবিতার যে ধারাটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারতো, সুভাষের কবিতায় তা জীবিত ও জীবন্ত থেকে গেছে। এক অর্থে সুভাষের কবিতায় সুকান্ত মরণোত্তর জীবনলাভ করেছেন।
পদাতিক (প্রথম প্রকাশ
১৯৪০, ’কবিতা ভবন’) সুভাষের প্রথম আবির্ভাব যে কতোটা কঠিন ছিলো তা বুঝতে হলে দুই পূর্বসূরী মহাকবির কাব্যসৃষ্টিকে স্মরণ করা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি হিসেবে নয়,
গীতিকার হিসেবেও বাঙালির প্রেমমনস্কতাকে প্রকাশ করেছেন বহু দশক ধরে; ১৯৩০-এর দশকের মধ্যে তাঁর কাব্য ও সঙ্গীতের রোম্যান্টিক রূপটি সম্পূর্ণ রূপলাভ করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়; বাঙালির উপর তার প্রভাব ব্যাপক। অন্যদিকে, জীবনানন্দ ১৯২০-র দশকের শেষাংশ থেকে কবিতা প্রকাশ করতে শুরু করে প্রেমভাবাপন্ন কবিতায় একটি নতুন শৈলী গঠন করতে সক্ষম হ’ন। প্রথম দিককার কবিতায় তিনি "সস্মিত নয়ন তুলি কবে তব প্রিয়া / আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদকৃষ্ণ পাণ্ডুচূর্ণ ব্যথিত কপোলে"-র মতো ক্ল্যাসিকাল শব্দবন্ধ ও পঙ্ক্তি ব্যবহার করে প্রেমের অনুভূতিকে প্রকাশ করেছেন। পরে অবশ্য তাঁর প্রেমের কবিতার শৈলীও পরিবর্তিত হয়ে যায়, এতোটা ক্ল্যাসিকাল না-থেকেও তা তাঁর এক নিজস্ব শৈলীতে পরিণত হয়।জীবনানন্দ তাঁর চারপাশের জনজীবনের কঠোর সংগ্রাম ও নানারকমের অস্থিরতা নিয়ে মহান কবিতা রচনা করে গেছেন; সেখানে প্রেম অনুপস্থিত, যদিও হিংসা ও রিরংসার আদিমতা কখনো উপস্থিত, যদিও তার অধিকাংশই ১৯৪০-এর পরে প্রকাশিত হয়। তাই ১৯৩০-এর দশকে তাঁর রোম্যান্টিক প্রভাব যে অতি গভীর ও দূরবিস্তারী ছিলো তা সহজেই বুঝতে পারা যায়; এমন কি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও পঞ্চাশের দশকে এই প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি।
কিন্তু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠস্বরটি, কথনভঙ্গিটি, ছিলো স্বতন্ত্র। প্রথম থেকেই কথ্য বাংলা তাঁর প্রধান অবলম্বন, একেবারে দৈনন্দিন জীবনের ভাষায় বা তার কাছাকাছি কোনো শৈলীতে যে আদৌ কবিতা রচনা সম্ভব, তা জীবনের শেষে রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন, তবুও ‘হঠাৎ দেখা’র মতো কবিতাতে এ ভাষা ব্যবহার করতে গিয়ে তার উচ্চারণকে কিছুটা পেলব করবার প্রয়োজনে ‘করলেম’, ‘দিলেম’, ‘বললেম’, ‘চললেম’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করেন। দৈনন্দিন কথ্য ভাষাকে হয়তো তাঁর কবিতার পক্ষে কিছুটা বন্ধুর বা কর্কশ মনে হতো। জীবনের শেষ লগ্নের কবিতায় ও গানে তিনি তাঁর চিরাচরিত তত্সম শব্দবহুল ক্ল্যাসিকাল শৈলীতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। অন্যদিকে জীবনানন্দও কথ্য ভাষা ব্যবহার করেছিলেন, তবে তা প্রধানত ১৯৪০-এর পরে। প্রথমদিকে তিনি তাঁর কবিতায় সাধু গদ্যের ক্রিয়াপদও ব্যবহার করেন অজস্র। সুভাষ ১৯৩০-এর দশকে তাঁর বয়:সন্ধিকাল অতিবাহিত করে কী উপায়ে যে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের প্রভাব অনেকটা এড়িয়ে নিজস্ব একটি কথনশৈলী গঠন করতে সক্ষম হলেন, তা ভাবতে গেলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। এ কাজ যে সহজ ছিলো না তা বুঝতে পারা যায় এটি লক্ষ করেও যে কবিতায় কথ্যভাষা ব্যবহারে তাঁর সমগোত্রীয় কবি তাঁর পরেও কমই উদিত হয়েছেন।
সুভাষের শৈলীর একটি বিশেষ গুণ অবশ্যই, এবং অবধারিত ভাবেই, তাঁর সহজবোধ্যতা। জীবনানন্দ-পরবর্তী আর কোনো প্রথম সারির কবিই বোধহয় কবিতায় দুর্বোধ্যতাকে পরিহার করবার ব্যাপারে সুভাষের মতো সাহসী হতে পারেননি। দুর্বোধ্যতার মাধ্যমে, দুরূহ ও কষ্টকল্পিত শব্দবন্ধ ব্যবহার করে পাঠক-পাঠিকার অবোধগম্যতা ও অজ্ঞতা তাঁদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে এক প্রকার সূক্ষ্ম ও প্রচ্ছন্ন ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে তাঁদের সম্ভ্রম আদায় করে নেওয়ার যে নব্যগৌড়ীয় রীতি বাংলা কবিতার জগতে বিংশ শতাব্দীতে সুপ্রতিষ্ঠিত ও বদ্ধমূল হয়েছে, সুভাষ বরাবরই তার বিপরীত ধারায় কাব্যসৃষ্টি করেছেন।
কবি বলতে সাধারণত আমরা বুঝি এক ঔদাস্যপ্রবণ মানুষ - কিছুটা বিষণ্ণ ও দু:খবিলাসী ; কল্পনার একটা আচ্ছন্নতা তাকে যেন ঘিরে থাকে সর্বদা। কিন্তু সুভাষের কবিসত্তা ছিলো অন্যরকম - সেই ১৯৪০-এর দশক থেকেই তিনি সংগ্রামের কবি, দৈনন্দিন আলাপচারিতার কবি, সাধারণ মানুষের আটপৌরে সুখদু:খের কবি ; কঠিন বাস্তবে তাঁর চিন্তার প্রসার। তাঁর কবিতা পড়ে মনে হয় তিনি যেন মহানগরীর পথ চলতে চলতে লিখছেন, হাটেবাজারে সহস্র মানুষের কোলাহলের মধ্যেও যেন তাঁর সহজ অথচ গভীর উচ্চারণ ধ্বনিত হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে? সহজ কথা যায় না লেখা সহজে’। সুভাষ সহজ কথা সহজে লিখতে পারতেন, তাঁর অনেক কবিতাই বাংলা কাব্যজগতের সহজতম; অথচ তা অতি গভীর - হঠাৎ কয়েকটি আপাত সরল পঙ্ক্তির মধ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে কোনো অমোঘ সত্য।
সুভাষের কবিতায় যে বাংলা কাব্যে একটি দিনবদলের পালা সূচিত হয়েছিলো তার কারণ অনুসন্ধান সহজ নয় ; তবে কিছু আংশিক আলোকপাত করতে পারা যায় : কথ্য ভাষায় কবিতা রচনা করলে তার ভাব উচ্চকোটি স্পর্শ করে না এই মর্মে একটি বিশ্বাস ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত লালিত হয়ে এসেছিলো : কবিতার ভাষা কিছুটা তত্সম শব্দবহুল হবে, কিংবা ছন্দের প্রয়োজনে তার মধ্যে এমন কতগুলি উপকরণ থাকবে যা তাকে দৈনন্দিন কথ্য ভাষা থেকে উঁচুতে প্রতিষ্ঠিত করবে - এই ছিলো প্রচলিত বিশ্বাস। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেকার পৃথিবী এত নির্মম ও কঠোর রূপ ধারণ করে যে কাব্যে আগেকার সেই ক্ল্যাসিকাল স্নিগ্ধতা ও মগ্নতা অনেকেই যুগোপযোগী বলে স্বীকার করে নিতে অস্বীকৃত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মানুষের এই ক্লিষ্ট ভুবনবোধ ক্লিষ্টতর হয়ে পড়ে, সুকান্ত ভট্টাচার্য লেখেন সেই অবিস্মরণীয় কবিতা -
হে মহাজীবন, আর এ-কাব্য নয়
এবার কঠিন কঠোর গদ্য আনো।
পদলালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক,
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো।
প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা --
কবিতা, তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় :
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
এই কবিতাকে সুভাষের কাব্যজীবনের ‘ম্যানিফেস্টো’ বলতে পারা যায়। তিনি কবিতাকে ছুটি না দিয়েও তাকে গদ্যধর্মী করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেই চল্লিশের দশক থেকেই ; গদ্যময় এক পৃথিবীতে বাস করে তিনি গদ্যস্পর্শী কাব্যশৈলী গঠন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন ; যখন তাঁর কবিতার অন্ত্যমিল আছে (উদাহরণ : ‘প্রস্তাব’) তখনও তার শরীর বলিষ্ঠ গদ্যের মতো ঋজু ও সুঠাম। এ সত্ত্বেও তা প্রকৃত অর্থেই কবিতা - এইখানেই কবি সুভাষের জয়। এই নতুন শৈলীতে থেকে বাঙালির মনে একটি স্থায়ী আসন অধিকার করার জন্য যে গভীর আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন, তা তাঁর ছিলো।
প্রেমের কবিতা লিখে তিনি আত্মপ্রকাশ করেননি; এ ব্যাপারে অবশ্যই তিনি ব্যতিক্রমী কবি; তবে লক্ষণীয় এও, যে নিসর্গ প্রেমও বিশেষ আসেনি তাঁর প্রথম যৌবনের কবিতায়। প্রেম ও প্রকৃতি - এই দুইটি বিষয়ে কবিতা বিশেষ না লিখেও কী করে তিনি পাঠকসমাজে সমাদৃত হলেন? অল্প কথায় এ-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়; তবে একথা অবশ্যই বলতে হবে যে তিনি বিংশ শতাব্দীর বাঙালির জনজীবন ও তার মানসিক জীবনকে ভালো বুঝতেন। জীবনসংগ্রাম ও সাধারণ মানুষের মনের উপরে তার অভিগাত তাঁর কবিসত্তাকে বরাবরই আলোড়িত করে এসেছে। প্রেম বা নিসর্গ প্রত্যক্ষভাবে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিমানুষের চিন্তাকে আচ্ছন্ন বা প্রভাবিত করে না ; নানা পরিস্থিতির স্মৃতি, সাধারণ কথোপকথন ও বিভিন্ন ব্যবহারিক খণ্ডচিন্তা মানুষের মনে প্রতিনিয়ত এমনভাবে যাওয়া-আসা করে, যাকে প্রকাশ করতে গেলে গদ্যধর্মী কথ্যভাষাই উপযুক্ত ; প্রেম বা প্রকৃতিকে নিয়ে কবিতা লিখলে হয়তো অধিক পেলবতার প্রয়োজন হয়। সুভাষ তাঁর শৈলীর পক্ষে উপযুক্ত বিষয়েই কবিতা লিখতেন; অথবা বিষয়োপযোগী একটি শৈলী তিনি গঠন করে নিয়েছিলেন। তাঁর এই বলিষ্ঠ মৌলিকতাই পাঠকদের স্পর্শ করেছিলো, তাঁকে এক প্রভাবশালী কবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো।
এবারে সুভাষের কয়েকটি কবিতার অংশবিশেষ নিয়ে আলোচনা করা যাক। তাঁর বহু কবিতাই বহুপঠিত ও জনপ্রিয়; প্রবন্ধের সীমিত পরিসরে অল্প কয়েকটির আলোচনাই সম্ভব।
আগেই বলেছি, তাঁর কবিতার সহজবোধ্যতা উল্লেখযোগ্য; "ঝুলতে ঝুলতে" কবিতায় তিনি লিখছেন :
"... আমার যে বন্ধুরা পৃথিবীকে বদলাতে বলেছিলো
ত্বর সইতে না পেরে
এখন তারা নিজেরাই নিজেদের বদলে ফেলেছে। ... "
এটি একটি সরলবাক্য, দৃপ্ত উচ্চারণ, কিন্তু এটি কথোপকথনের মধ্যেও কবি হয়তো কখনো বলে থাকবেন, এমন অনুমান বা কল্পনা করা যায়। লক্ষণীয়, মৌখিক ভাষাকে বিশেষ পরিবর্তন না-করেই এখানে কবিতায় ব্যবহার করেছেন তিনি। বিংশ শতকের আরো বহু বাঙালি কবি এই পঙ্ক্তিটিকে এতো সহজে লিখবার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারতেন না, তাঁরা সম্ভবত এটিকে আরো কিছুটা স্পষ্ট, প্রচ্ছন্ন ও ব্যঞ্জনাময় করতে চাইতেন। অস্পষ্টতা, অকারণ রহস্যময়তা, দুরূহ শব্দবন্ধের ব্যবহার ও ইচ্ছাকৃত দুর্বোধ্যতার সঙ্গে বাংলা কবিতার পাঠকপাঠিকা সুপরিচিত ; কেউ কেউ এইগুলির প্রতি আকৃষ্ট হয়েই কবিতাপাঠ করে থাকেন। সুভাষ এই ধারার বাইরে অবস্থান করেছেন ; উপরের পঙ্ক্তির মতো আরো অজস্র উদাহরণ উদ্ধৃত করা যায়।
"হয় না" কবিতাটি এমনই, যে ১৯০০ বা ১৯২০ সাল নাগাদও সেটিকে অনেকেই কবিতা বলে মানতেই চাইতেন না। রবীন্দ্রনাথ এটি পড়লে সম্ভবত বিরক্তই হতেন। প্রথম কয়েকটি ছত্র :
"কবিতা চাই ? মাপ করবেন,
হয় না।
কলমটা ঠিক কল নয় তো
কবিরাও নয়
দাঁড়ের ঠিক ময়না।
হয় না। ..."
তবে এই কথোপকথনধর্মী ভাষাও সুভাষের লেখনীতে প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠেছে। এ কবিতাটি হয়তো আবৃত্তির উপযোগী নয়, পড়বার উপযোগী; এটি পড়লে কথাগুলির সাধারণত্ব ও কবির স্বভাবসিদ্ধ ‘আইরনি’ বার বার চিন্তায় ফিরে আসে। সাধারণত্বের এই যে সহজ প্রকাশ, এই যে অনাবিল বুদ্ধিদীপ্তি, এর মধ্যেই কোথাও অসাধারণত্ব নিহিত রয়েছে। "কলমটা ঠিক কল নয় তো" এই শব্দগুচ্ছ সুভাষ ছাড়া অন্য কোনো কবি বোধহয় লিখতে পারতেন না, বা লিখতে চাইতেন না।
"একটি কবিতার জন্য"-তে তিনি লিখছেন :
"একটি কবিতা লেখা হবে। তার জন্যে
দেয়ালে দেয়ালে এঁকে দেয় কারা
অনাগত একদিনের ফতোয়া,
মৃত্যুভয়কে ফাঁসিতে লটকে দিয়ে
মিছিল এগোয়
আকাশ-বাতাস মুখরিত গানে,
গর্জনে তার
নখদর্পণে আঁকা
নতুন পৃথিবী, অজস্র মুখ, সীমাহীন ভালোবাসা।
একটি কবিতা লেখা হয় তার জন্যে।"
নগরজীবন ঠিক এতোটাই জীবন্ত হয়ে ধরা দিত সুভাষের কলমে। ‘মিছিল’ বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ তাঁর কবিতায়। মনে পড়ে, যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা ক্লাসে এসে ভাষণ দেবার সময় আমাদের বলতেন যে ‘এপলিটিক্যাল’ হওয়া সম্ভবপর নয়, সবাইকেই ‘পলিটিক্যাল’ হতে হবে; এ-প্রসঙ্গে এক নেতা সুভাষের পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, " ‘মিছিলে যাবে না বলে করেছ ধনুকভাঙা পণ, আসলে তো মিছিলেই আছ’ - ওই যে, যারা মিছিলে যাবে না তাদেরও একটা মিছিল ....! " ইত্যাদি।
নগরজীবনের বিপদসঙ্কুলতা তাঁর কবিতায় এসেছে, অবিস্মরণীয়ভাবে; ‘কেন এল না’ কবিতার নির্মম পরিণতি বার বার পাঠকের মনকে আলোড়িত করেছে, তা বিশেষ লক্ষণীয়। এটি সুভাষের বহুলপঠিত কবিতাগুলির মধ্যে অন্যতম।
তবে নস্টালজিয়াও যে আসেনি তাঁর কবিতায় তা অবশ্যই নয়। ‘যতদূরেই যাই’ কবিতাটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করি :
আমি যত দূরেই যাই
আমার সঙ্গে যায়
ঢেউয়ের মালাগাঁথা
এক নদীর নাম -
আমি যত দূরেই যাই।
আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে
নিকোনো উঠোনে
সারি সারি
      লক্ষ্মীর পা
আমি যত দূরেই যাই।"
এমন সরল, মার্জিত অথচ মর্মস্পর্শী শৈলী বাংলা কবিতায় বিরল।
কিন্তু সুভাষের কবিতার আলোচনায় বারংবার রূঢ় ও নির্মম বাস্তবেই ফিরতে হয় :
"ফুলকে দিয়ে
      মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায়
                বলেই
ফুলের ওপর কোনও দিনই আমার
           টান নেই।
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি
যা দিয়ে কোনও দিন কারও
      মুখোশ হয় না।"
সমাজ নিয়ে তাঁর বিশেষ সচেতনতা অবশ্যই ছিলো, তার বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে ; তবে এখানে শুধু একটিমাত্র প্রাসঙ্গিক কবিতাংশই উদ্দৃত করলাম :
"আমি দেখে এসেছি নদীর ঘাড় ধরে
আদায় করা হচ্ছে বিদ্যুৎ।
ভালো কথা।
কলে তৈরী হচ্ছে বড় বড় রেলের ইঞ্জিন।
খুব ভালো।
মশা মাছি সাপ বাঘ তাড়িয়ে
ইস্পাতের শহর বসছে
আমরা সত্যিই খুশী হচ্ছি।
কিন্তু মোটেই খুশী হচ্ছি না যখন দেখছি -
যার হাত আছে তার কাজ নেই
যার কাজ আছে তার ভাত নেই
আর যার ভাত আছে তার হাত নেই।"
যোদ্ধৃবেশে কবিজীবনে তাঁর প্রবেশ :
"প্রভু, যদি বলো অমুক রাজার সাথে লড়াই কোনো দ্বিরুক্তি করবো না, নেবো তীর ধনুক। এমনি বেকার ; মৃত্যুকে তো ভয় করি থোড়াই ; দেহ না-চললে, চলবে তোমার কড়া চাবুক।"
তারপর আত্মপরিচয় দানে তিনি লিখছেন :
"আমাকে কেউ কবি বলুক
আমি চাই না।
কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত
যেন আমি হেঁটে যাই
আমি যেন আমার কলমটা
ট্রাক্টরের পাশে
নামিয়ে রেখে বলতে পারি -
এই আমার ছুটি
ভাই, আমাকে একটু আগুন দাও।"
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জীবনাচরণও ছিলো বেশ ব্যতিক্রমী। কোনো গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতার মুখাপেক্ষী না হয়েই তিনি বরাবর লিখেই জীবিকা অর্জন করেছেন। বেস্টসেলার লেখক তো ছিলেন না কোনোদিনই কিছুটা অসচ্ছলতাতেই জীবন কেটেছে তাঁর। অথচ এই অতিসাধারণ জীবনশৈলীর সঙ্গে তাঁর লিখনশৈলীর কোথায় যেন মিল ছিলো ; একটিকে অন্যটি থেকে পৃথক করে দেখবার উপায় নেই। তাঁর গদ্যও ব্যতিক্রমী ; স্বভাবসিদ্ধ ‘আইরনি’ সেখানেও বিদ্যমান। সবক্ষেত্রেই তাঁর এক বলিষ্ঠ নিজস্বতা ছিলো ; তারই জোরে দীর্ঘ ছয় দশকের অধিক লেখালেখি করতে সক্ষম হলেন। এতো দীর্ঘকাল যাবৎ খুব কম বাঙালি কবিই সক্রিয় থাকতে পেরেছেন। ইদানীন্তন যে-সমস্ত কবি দুর্বোধ্যতায় ও দুরূহতায় আশ্রয় নিয়ে বাঙালির মনে স্থায়ী আসন অধিকার করতে সচেষ্ট, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন ও সৃষ্টিকর্ম থেকে তাঁদের হয়তো বিশেষ কিছু শিক্ষাগ্রহণ সম্ভব ও প্রয়োজনীয়। দীর্ঘায়ু এই কবির কবিতাও দীর্ঘায়ু হবে ; আজ থেকে বহু বসন্ত পরেও ফুল ফুটুক বা না ফুটুক বাঙালিকে তাঁর কবিতা বারংবার পড়তেই হবে। পদাতিক কবির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জীবনের পথ চলা শেষ হলেও বাঙালির পৃথিবীতে তাঁর সৃষ্টিকর্মের পরিব্রাজকতা অব্যাহতই রইলো।
(লেখক আন্তর্জাল ও স্মৃতি থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃতি সংগ্রহ করেছেন; ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়)