• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩০ | মে ২০০৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • মার্কিন মুলুকে মাসকয়েক : নন্দন দত্ত





    ॥ উদারা পর্ব ॥



    নিউ ইয়র্ক থেকে ফেরার রাত্রে রুমমেট জেগে বসেছিলেন আমার বিহার-বৃত্তান্ত শোনার জন্য । সব অবহিত হয়ে বলে বসলেন, তাহলে ওখানে দেখলেটা কি ? আমি বললাম, বরফ আর বই ! উনি বললেন, আরে বই তো দেশেও পেতে ; আমি বললাম, আর বরফ তো ফ্রীজেও পাবো । বলে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম । খানিক বাদে মনে পড়ল পারশুরামিক ঠাট্টা, নিউম্যানস্‌'এর দোকান থেকে দু মণ বই আনিয়ে নিও । ছুতো বেছে ওঁকে ঠেস দিতে গিয়ে দেখি নাক ডাকছে ।

    প্রত্যাবর্তনের পর দিনগুলোতে যেন ঘোড়ার জিন লেগে গেল । কাজ, কাজ আর কাজ । ফেস্টিভ সিজন্‌'এর টেম্পো তুলে রাখতেই যে আমাদের আমদানি তা এখন পরিষ্কার । আপিসের উঁচু আধিকারিকরা সকলেই ভেকেশনে, মোবাইল ফোনে আমাদের নির্দেশ-উপদেশ পাঠাচ্ছেন, শুরুতে বলছেন মেরি খ্রিস্টমাস, শেষে বলছেন হ্যাপি নিউ ইয়ার । এমন ইয়ারি সম্বোধনের মর্যাদা রাখতে আমরাও লড়ে যাচ্ছি, যায় যাবে যাক প্রাণ !

    আমি এধারে-ওধারে তাল বুঝে কেটে আসবার ফোকর খঁংউজি । সামনে আসছে পয়লা জানুয়ারি, দৈবক্রমে সোমবার, লঙ য়ুইকেণ্ড পাওয়া যাবে তবে । সেই ভেবে দিলখুশ, সুপারমার্কেটে বাজার করতে বেরিয়েছি একদিন, আলাপ হল এক বাঙালি দম্পতির সঙ্গে । ঝকঝকে তরুণ সুমিতবাবু, তস্য পত্নী বললেন, আমি রুমি । আমি বললাম, নমস্কার । বছর পাঁচেক আছেন ফিনিক্সে, আমেরিকাতে বললেন পাশ করার পর থেকেই । বাড়িতে আসতে ডাকলেন অনেক করে, রাত্রে খেয়ে যেতেও । আমি বললাম, নিশ্চয়ই । কাজের গোলেমালে ভুলেই গিয়েছিলাম, আবার সেই অতিবাজারি সাক্ষাৎ । এবার আর ছাড়লেন না সুমিতবাবু, বগলদাবা করে নিয়ে চললেন তেজি টয়োটায় ঢেলে । মোবাইল ফোনে খবর ছুটল, টেল মাম্মি, উই উইল হ্যাভ এয গেস্ট ফর ডিনার । আমি বললাম, আহা এত ব্যস্ত .... । উনি বললেন, রিল্যাক্স ম্যান, দ্য প্লেজার ইজ অল আওয়ার্স, এদিকে তো বাঙালি বেশি নেই !

    সুমিতবাবুর বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি, সুন্দর লনওয়ালা । রুমিদেবী আপ্যায়নে নিঁখুত, সফ্ট ড্রিংক আর স্ন্যাক্স দিয়ে রান্না চড়াতে গেলেন, মাঝে মাঝে এসে গল্পে যোগ দিচ্ছিলেন । আলাপ হল ওঁদের চার বছরের পুত্র সুস্মিতের সঙ্গে । ডাক নাম র্যাম্বো । একটা লম্বাটে বন্দুক নিয়ে অ্যালিয়েন শিকারে ব্যস্ত ছিলেন সুস্মিত । আমি ভাবলাম সার্থকনামা ছোকরাই বটে, দুষ্টের পালন শিষ্টের..., সরি সরি, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনে দড় মার্কিন জাতিক বীর র্যাম্বো হতে গেলে তো আর্লি স্টার্টেরই দরকার । আলাপ হতে আমার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে চাইলেন র্যাম্বো, অ্যালিয়েন কিনা ঠাহর করছিলেন হয়ত । আমি বললাম, হ্যালো সুস্মিত, হাউ আর ইউ ? সুস্মিত বললেন, আর ইউ য দেশি ? তালব্য শ'টা উচ্চারলেন ইংরাজির এস'এর ঢঙে । রুমিদেবী তড়িঘড়ি বলে উঠলেন, সে হাই টু আঙ্কল, র্যাম্বো । সৌজাত্যের প্রশ্নটা সৌজন্যেই চাপা পড়ে গেল ।

    সুমিতবাবুদের গান বাজনার সখ, দেখলাম অনেক ক্যাসেট সিডি বাংলা গানের । রুমিদেবীও বললেন, অনেকদিন গান শিখেছেন দক্ষিণীতে । তবে সে বিয়ের আগে, এখন তেমন চর্চা নেই । কলকাতার সাথে যোগাযোগ আছে, অল্টারনেট পুজোতে ঘুরে আসেন সপরিবারে ।

    খাওয়াদাওয়ার পর পিছনের পর্চে বসে গল্প হচ্ছিল । সুমিতবাবুই পৌঁছে দেবেন, তাই ফেরার ব্যাস্ততা নেই । র্যাম্বো বৈঠকখানায় সিনেমা দেখছেন, একজন পেশিময় পালোয়ান কিছু কিম্ভূত ভিনগ্রহীদের পেঁদিয়ে ঠাণ্ডা করেছেন প্রায়, তবে আকাশপথের উড়োযান থেকে নতুন ব্যাটালিয়ন নামল বলে, বিবাদীদের পক্ষে, তাই বাজার গরম । একথা সেকথার ফাঁকে রুমিদেবী বললেন, সুমি ভীষণ টেনশনে আছে এ-কদিন । আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, অফিসের প্রব্লেম কিছু, সুমিতদা ? সুমিতবাবু সিগারেট ধরাচ্ছিলেন, রুমিদেবী বললেন, না না, ওসব কিছু নয়, মামণির শরীর খারাপ খবর এসেছে, তাই .... । সিগারেটের প্রথম টানটা শেষ করলেন সুমিতবাবু । করে বললেন,
    -- আমার মা, দেশের বাড়িতে থাকেন ফুলিয়াতে, অ্যাবভ এইট্টি ।
    -- ওহো:, অনেক বয়স তো, দেখাশোনার লোকটোক..., মানে কেউ আছেন সাথে ? আপনার ভাইয়ের ফ্যামিলি ট্যামিলি..?
    -- হঁযা খুড়তুতো ভাইরা পাশেই থাকে, ওরাই তো প্রপার্টি সব এন্জয়, মানে দেখছে.., আমি সিঙ্গল চাইল্ড, ওরাই মাকে.... ।
    -- প্রতিমাসেই ড্রাফ্ট পাঠানো হয় । ব্যাঙ্ক অফ অ্যামেরিকার তো ক্যুইক ক্লিয়ারিং, তাই অসুবিধা নেই, বললেন রুমিদেবী ।

    সুমিতবাবুর কথায় জানলাম খুড়তুতো ভাইরা পুরী বেড়াতে গেছেন কদিনের জন্য, তার মাঝেই এই বিপত্তি । প্রতিবেশীরা কাছের হাসপাতেল দিয়েছেন তিনদিন, খুড়তুতো ভাইকেও পুরী-হোটেলে জানানো হয়েছে । এক সম্পর্কীয় মামা আইএসডি করে জানিয়েছেন ফিনিক্সে ।

    -- শুনেছি রাণাঘাটে হোম হচ্ছে, রুমিদেবী বললেন, ।
    -- হোম ? মানে যজ্ঞের কথা বলছেন ? দৈব ওষুধের ব্যাপার কিছু ?
    -- না, না, ওল্ড এজ হোম । দারুণ ব্যবস্থা নাকি, থাকা-খাওয়া-ট্রিটমেন্ট-এন্টারটেন্মেন্ট এভ্রিথং, আমার মামাতো বোনের শ্বাশুড়ি তো আসতেই চান না বাড়িতে ।
    -- না না, মাকে হোম'এ দেওয়া যায় নাকি ? দাবড়ালেন সুমিতবাবু ।

    মনে হল খুব বাধছে, প্রিন্সিবালে ।

    -- মামণিকে তো কতবার চলে আসতে বলেছি আমাদের এখানে ।
    -- সুনীলটার একটা আক্কেল নেই, বউকে নিয়ে ফূর্তি করতে গেছে এই সময় ।
    -- আহ, রাগ করছ কেন, ওরা কি জানত এমন হবে ।
    -- আরে রাখো তো ওসব কথা, যাদের করবার কথা তারা কিছু করবে না, আমায় ফোন করে করে.....।

    র্যাম্বো বললেন পর্চে এসে,
    -- মাম্মি পিত্জা খাবো ।

    কয়েকদিন পরে ফোন করে খবর নিয়েছিলাম মাসিমার, শুনলাম পিজি'তে আনা হয়েছে । সুমিতবাবু উড্ল্যাণ্ডে শিফ্ট করতে বলেছেন ।

    নাইট ক্লাব নামক এক ধরণের আমোদ আমাদের মোমবাতিবনের সহবাসীদের ভীষণ টানত । ফিনিক্সের নাইট লাইফ যদিও মার্কিন মাপে ম্যাড়মেড়ে, তবুও কয়েকটা নৈশ-সঙ্গত ছিটিয়ে ছিল এদিকে ওদিকে । প্রায় প্রত্যহ রাত্রেরই গমনের গল্প শুনতাম এর ওর মুখে, নানান স্বাদু শরীরী স্মৃতি । একদিন খাওয়াদাওয়ার পর কম্বলটা পাতছি, টিভিতে ল্যারি কিং শো'তে বেশ এক জমাট অতিথি, এমন সময় দরজায় টোকা । খুলে দেখি এক দঙ্গল বান্ধব, ডিনার সেরে টগবগে, দলপতি বললেন, চল্‌, প্যাসন'এ যাচ্ছি । নামটা চেনা ছিল ; বললাম, না ভাই ঘুম ঘুম পাচ্ছে, কাল সকাল ন'টায় কনফারেন্স কল, আর আমার আবার রাত জাগলে পেটটা একটু আপ্সেট হয় । সকলে হো হো করে উঠলেন, আরে ভায়া, ঘুম ! এস আমাদের সঙ্গে, চটে যাবে ঘুম । চান্স অফ্‌ এ লাইফটাইম, নো বডি উইল নো অ্যাট হোম । আমি বললাম, না না তার জন্য নয়, জানলেই বা কি আছে, এমনিই বলছি, আজ থাক না, পরে না হয় আরেকদিন ... । পিছন থেকে কে একটা বলে উঠলেন, ওক্কে গুড বয়, স্লিপ ওয়েল, স্যুইট ড্রিম্স । চোর, জোচ্চোর, বদমাস, বা অন্য বহু আমিষ খিস্তি সবই গেলা যায় চাঁদ মুখে তাল বুঝে, কিন্তু এই বয়সে গুড বয় শুনলে কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে । আমি বললাম, ওয়ান মিনিট ।

    পাঁচটা গাড়ি উপচে প্রায় পঁচিশ জন রজনীগন্ধা চললাম মাইল পনেরো দূরে । ঝিলিমিলি আলোবাজির ভিতর প্যাসন'এর ঘোষণা দেখা যায় অনেক দূর থেকেই । একটা একতলা লম্বাটে হল গোছের আবাস, পিছনের কারপার্কে গাড়ির মেলা । অবতরণের সময় আশপাশের গাড়ি থেকে যাদের নামতে দেখলাম সবার বিভঙ্গেই, মম-যৌবন-নিকুঞ্জে-গাহে-পাখি । ঢোকার দরজা একটাই, সামনে লাইন পড়ে গেছে, বিরাট নোটিশ বোর্ডটা পড়তে লাগলাম, রুলস্‌ অফ দ্য গেম জেনে রাখা ভাল । খুব খোলামেলা ভাষায় ডু'স এযণ্ড ডোন্ট'স্‌'এর ফিরিস্তি । এমন সব কীর্তির হঁংউসিয়ারি, যা ভাবলেই কর্ণমূল রক্তিম হতে পারে আমাদের ওধারের সতী-সাবিত্রী-শাঁকচুন্নিদের । শেষে বিরাট হরফে লেখা, প্রমোদ-পারদ বেশ চড়ে গেছে বুঝলে কর্তৃপক্ষ রিটেন্স দ্য রাইট টু থ্রো পেট্রন্স আউট । নোটিশের ঠিক পাশের ভাষ্য ও ছবি দেখে ভীষ্ম পিতামহও টলে যেতেন নির্ঘাৎ । আমার টার্ন চলে এসেছে, দাবড়া রক্ষী শুধোলেন, এজ প্রুফ ? আমি বললাম, এই যা:, পাসপোর্ট তো আনিনি, ড্রাইভিং লাইসেন্স'ও না, ওয়ান মিনিটে আর কতটা টানা যায় ? রক্ষী বললেন, গেট লস্ট । আমি বললাম, বাট আই অ্যাম .... । মনে পড়ল সেই কলেজ কেটে এক রসিক বন্ধু গিয়েছিলেন নিউ এম্প্যায়ারে, সিনেমাটা তেমন নীলাচলে-মহাপ্রভু ধাঁচের ছিল না । গেটে আটকে বলা হয়েছিল, এই তোমার তো গোঁফই ওঠেনি । বন্ধু তেড়িয়া হয়ে বলেন, কি দেখালে ..... । যাইহোক, এর থেকে বেশি বললে হয়ত সুভদ্র পরবাসমণ্ডলির পক্ষে একটু বেশিই হয়ে যাবে, তাই বন্ধু কি অফার করেছিলেন তা কল্পনার ওপরেই ছাড়লাম ।

    এজ প্রুফের মাইনর টেক্নিক্যাল পয়েন্টে সেদিন বিতাড়িত হলাম । বুদ্ধি-প্রজ্ঞা-অনুভূতি কোনো কিছুর মাপকাঠিই ধরা হল না । ভোর রাত্তিরে সকলে ফিরে বললেন, উফ্ফ্ফ্‌, যা মিস্‌ করলে ।

    পয়লা জানুয়ারির সুবাদে তিনদিন ছুটি পরপর, শনি-রবি-সোম । নেহাৎ চক্ষুলজ্জার খাতিরেই হয়ত, আপিসে হাজিরার ব্যাপারটা উহ্যই রইল, আমরাও আর ঘাঁটালাম না । সেল ফোন, পেজার ইত্যাদি নানা টিকি ধরাই ছিল, টানলেই ছুটে যাব এমন কম্বল-আশ্বাসও । ঠিক হল আরেকপ্রস্থ মোটর ভ্রমণ ।

    শনিবার ভোর ভোর গাড়ি জুতে তৈরি আমরা, পার্কিং লটে পায়চারি অন্য সঙ্গীদের অপেক্ষায় । এবারের সফরে পাঁচজনের মধ্যে দুজন রমণী, তাঁদের একজন সহকর্মিনী, অপর তস্য ভগিনী, বছর দশেক এদেশে আছেন, আলাপের সময় বলেছিলেন, কার্ডও আছে একটা সবুজ রঙের । এঁদের প্রস্তুত হতে খানিক সময় লাগল । ঘন্টা দুয়েক । বললেন, সারাদিনের ব্যাপার তো, রোদও চড়া হতে পারে, তাই সানস্ক্রীন লোশন-টোশন সব ভালো করে লেপছিলেন ।

    সঙ্গীনীরা গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন দেখেননি । বললেন, এতদিনে কেউ দেখায়নি । আমি বললাম, আহা ! মেল শিভল্রির এমন বেহাল দশা এদেশে ! অবলাত্বের দিকে কোনো চোরা ইঙ্গিত মনে করে ওঁরা ঝাঁঝালেন, ইচ্ছা করলেই নিজেরা যেতে পারতেন, বাট উই ডিড্‌ নট্‌ ফীল লাইক ইট । আজ যে ফীল লাইক করছেন, এ সঙ্গ গৌরবে আমরা রেঙে উঠলাম । চালক চুলটা ঠিক করলেন রিয়ার ভিউ মিররে, গুনগুন করে তুমি না হলে জীবন বরবাদ জাতীয় হিন্দী গান ধরলেন, আমি বললাম সাবধানে ভাই, রাস্তাটা দেখো ।

    ফ্ল্যাগস্টাফে পৌঁছে আমি তড়িঘড়ি বলে উঠলাম এবার কিন্তু ভায়া মিটিওরাইট ক্রেটার । রমণীকুল কি এক গহিন তামাশায় হি হি করছিলেন, শুনতে পেলেন না বোধহয় । চালক সদয় হয়ে বললেন, তথাস্তু । সামনের ডান পাশের জনও ঘাড় নাড়লেন; উনি নির্বিবাদী মানুষ, মাইনর হয়েই মেজরিটিতে থাকেন সদাই । গতবারের পরিচিত রাস্তা থেকে এবার ডাইনে মোচড় মারলাম, সাইনবোর্ডের শলাকা ধরে এবড়ো খেবড়ো পাকদণ্ডী । ঝাঁকুনিতে অসহিষ্ণু হচ্ছিলেন ওঁরা, আমি বললাম, কি আর করা, উল্কা তো আর পথ কেটে আসেননি, নেমেছেন আকাশ থেকে ।

    এই মিটিওরাইট ক্রেটার ব্যাপারটা বেশ রোমহর্ষক । কোন অসম্ভব অতীতে আকাশ থেকে ছিটকে এসেছিলেন উল্কা, পৃথিবীতে রেখে গেছেন স্মৃতি । এমন মহাকালীন আত্মীয়তা মন উদাস করে দেয় । বহুদূর পথ চলল, খানিক বেয়ে উঠে সমতল প্রকাণ্ড প্রান্তর । দশদিগন্ত মিলে মিশে একাকার, নুড়িময় মাটি । ধূ ধূ করে যে দিক পানে চাই কোনখানে জনমানুষ নাই । এমন নিরেট শূন্যতায় মনটা হাবুডুবু খায়, ইঁট কাঠ আসবাব কিছুই নেই যে আঁকড়ানোর । থ্রী ডাইমেনশনাল স্পেসের তৃতীয় অক্ষটা মনে হচ্ছিল অবান্তর । স্কুলের এক ভাবুক শিক্ষক বলেছিলেন একবার, পিঁপড়ের কাছে জগত্টা টু ডাইমেনশনাল; তেমন আজগুবি ঠেকল না আর কথাটা এখন । অজগরের মত আঁকাবাঁকা পথ ধরে পৌঁছলাম কয়েকটি সংলগ্ন বাড়ির জটলায় । দুথাক সিঁড়ি ভেঙে দর্শন-অলিন্দ । প্রথম ধাপের আগেই অবশ্য উল্কাদর্শনের দাক্ষিণ্য ঠেকাতে হল, যেমন সব জায়গাতেই রীতি ।

    " তাকিয়ে দেখি একটা বিরাট বাটির কানায় দাঁড়িয়ে আছি । বিস্তীর্ণ
    সমতলের মধ্যে কে যেন এক খাবলা মাটি সরিয়ে নিয়েছে । অনেকটা
    নীচে তলদেশ দেখা যায়, চারপাশের চক্রাকার দেয়াল নেমেছে খাড়া ।"
    তাকিয়ে দেখি একটা বিরাট বাটির কানায় দাঁড়িয়ে আছি । বিস্তীর্ণ সমতলের মধ্যে কে যেন এক খাবলা মাটি সরিয়ে নিয়েছে । অনেকটা নীচে তলদেশ দেখা যায়, চারপাশে চক্রাকারে দেয়াল নেমেছে খাড়া । পঞ্চাশ হাজার বছর আগে অকস্মাৎ এক বিরাট উল্কাপিণ্ড ভীমবেগে ধেয়ে এসে আছড়ে পড়েছিল ঠিক এইখানটায়, নিজে চৌচির হয়ে মিশে গেছে মাটিতে, কিন্তু রয়ে গেছে শাশ্বত ক্ষত । ঝকঝকে রোদ, দৃষ্টি চলে বহুদূর, তাই ক্রেটারের আয়তন তেমন কিছু লাগছিল না । সাইনবোর্ডের বিস্তারিত গল্প পড়ে জানলাম যে কানা থেকে নিম্নতম বিন্দু প্রায় সাড়ে পাঁচশো ফুট গভীর, পরিধি আড়াই মাইল । আরও জীবন্ত আন্দাজ দিতে লেখা, ক্রেটারের মেঝেতে একসঙ্গে কুড়িটি ফুটবল মাঠ ঢুকে যায় আর গায়ের ঢালে বসে দেখতে পারেন একসাথে কুড়ি লাখ দর্শক । চারিদিক ঊষর পাণ্ডুর, একগুচ্ছ গুল্মও নেই কোথাও । ধুলোতে মিশে আছে সৌরাগতের কত রহস্যের বার্তা । পাথরের প্রত্যন্ত প্রাণরস বের করতে পারতেন যিনি, মনে পড়ল তাঁর কথা; দূরে অনেক । এখানেও নুড়ি কুড়োনোয়ে তেমনি কড়াকড়ি । সাহসে কুলোলো না । ক্রেটারের সাথে লগোয়া মিউজিয়াম আর প্রেক্ষাগৃহ । যাদুঘরে আকর্ষক প্রদর্শনী, কার্যকারণের খুব সুন্দর ভাষ্য, ছবি সহযোগে । পতিত উল্কা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছিলেন আমাদের উষ্ণ আতিথ্যে, সবথেকে বড় অক্ষত খণ্ডটি প্রদর্শিত, শতকরা সাতানব্বই ভাগ বিশুদ্ধ ইস্পাতের অমন নমুনা পৃথিবীর মাটিতে পাওয়া যায় না । ছোট্ট একটা চলচ্চিত্র দেখানো হচ্ছে, ঢুকে পড়লাম । উল্কাদের ধর্ম-অধর্ম নিয়ে গৌরচন্দ্রিকার পর এখানকার ঘটনার রসালাপ । এমন উল্কাপাত নাকি কিছুই অপ্রত্যাশিত নয় । পার্থিব ইতিহাসের প্রধান নিয়ন্তা এই সব মহাকাশের দূতেরা আসেন মাঝে মাঝেই । ধরণীতে আরও বড় উল্কাপাতের ঘটনা আছে কিন্তু এত মমতায় রক্ষিত হয়নি অন্য কোনো ক্রেটার । এদিকে বাত্সরিক বৃষ্টিপাত খুব কম ; তাই জল ভরে হ্রদও হয়ে যায়নি এ গহবর । সিনেমার শেষে এল কিছু অমোঘ জল্পনা । প্রতি পঞ্চাশ হাজার বছরে এমন একটি করে মহতী আগমন হতেই পারে, সম্ভাবনাশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের তেমনই বিধান । আগেরটা এসেছে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে, অতএব পরেরটার সময় হয়ে এসেছে । এতটা পথ উজিয়ে আসতে হয়, তাও আবার নেমন্তন্ন ছাড়াই, তাই একটু আধটু লেট হতেই পারে । আর এবারেও যে এমন পাণ্ডববর্জিত প্রান্তরে পড়বে তার তো কোনো অভয় নেই । বেরোনোর সময় মনে হচ্ছিল, সেদিক দিয়ে ঠিক এইখানটাই সব থেকে নিরাপদ, বাজ যেমন এক জায়গায় দুবার পড়ে না, যুক্তির সেই চুক্তিতে ।

    ষাটের দশকের চন্দ্রাভিযানের প্রস্তুতির সময় এইখানে অনেক গবেষণা চালিয়েছিল নাসা আর তার সন্নিহিত সংস্থারা । তেমন একটি ল্যাবরেটরিও দেখা গেল, অবশ্যই পরিত্যক্ত । গহবরের কানাটা আশপাশ থেকে অল্প একটু উঁচুতে, তাই গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে বাইরে একটা প্যানোর্যামিক ভিউ পাওয়া যায় । যেদিকে যতদূর চোখ চলে, প্রান্তরের কোনো অন্ত নেই । ঈশান কোনের আবছা আগায় আবছা নীল পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে দৃষ্টি খানিক বিরাম পেল । খাসা জায়গা বেছেছিলেন উল্কা ভায়া, এমন ফাঁকা মাঠেই না অমন কেরামতি জমে । এই খোলায় মনটাকে বেশ মেলা যাবে মনে করেছিলাম, সখীরা বললেন বড্ড রোদ । অগত্যা গাড়িতে চড়ে এসি চালিয়ে আবার চলা ।

    বেরোতে বেলা হয়েছে, উল্কা গহবর অনেকটাই আউট অফ দ্য ওয়ে, গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়নের পথে ফিরতেই দুপুর গড়াতে শুরু করল । গাড়িতে আজ গল্পগাছার আড়া অন্যরকম, যেসব বিষয়ে আলোচনা চলছিল, তার বেশিরভাগই আমার নাগালের বাইরে । বোদ্ধা মুখ করে শুধু শুনে যাচ্ছিলাম । মাঝে হঠাৎ শুনলাম, দিদি, আম্রিকা মে ঝোপড়পট্টি হ্যায় না ? সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে বললেন দিদি, নো দ্য স্টেট টেক্স কেয়ার অফ দেম । একজন বললেন, ইণ্ডিয়াতে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন । আমি বললাম, ল্যাক অফ পোলিটিলিক্যাল উইল । সবাই বললেন, যা বলেছো ।

    গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়নে পৌঁছলাম যখন, সূর্যে তখন কোমল সোনা । সঙ্গিনীদের প্রথম দর্শন বলে কথা, তাও আবার কনে দেখা আলোয়, তাই দর্শাবার দায় অল্প নয় । বেস্ট পয়েন্টের গোলকধাঁধায় গাড়ি তো ঘুরেই চলে, এদিকে সন্ধ্যার চাদর বিছানো শুরু হয়েছে । আমি বললাম কাছাকাছি কোথাও থেমে এঁদের দেখিয়ে দাও । গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে দর্শনার্থী একজন চেঁচিয়ে উঠলেন বিপুল বিস্ময়ে, ওয়াও দ্যাট্স এ বিগ ওয়ান । পুলক লাগল মনে, কার কথা বলছেন ? তার পরেই বুঝলাম, ওহো, গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়নই তো আছেন, তাহলে আর সংশয় কি ? তারপর থেকেই একটু দূরে দূরে ছিলাম, গতবারের ক্যানিয়ন-স্মৃতির উপর এবারের কোনো রাঙালু প্রলেপ সহ্য হত না । কিন্তু বিশেষণের ফুলঝুরি কানে আসছিল, বেশিরভাগই একটা চার অক্ষরের শব্দ, শেষে এক্স আর ওয়াই; সেই সর্বাত্মক অভিধা, যা আজকাল সঙ্গীত থেকে সমুদ্র অবধি সবেই প্রযুক্ত হয় ।

    তফাতে দাঁড়িযে তাকালাম আরেকবার । ঘনিলা আঁধারে গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়নের আজ আরও মোহন । ক্লান্ত রোদ্দুরের সোনার কাঠি ঘুমের তুলি বুলিয়ে দিচ্ছে পরিখার আনাচে কানাচে । পূরবীর তানে ক্যানিয়নের রঙ মিশে গিয়ে তৈরি হচ্ছে এক আশ্চর্য আশ্লেষ । গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন শিবত্বে যেন আজ আরও প্রশ্নাতীত । সুদূর কানায় সোনার মুকুট আস্তে আস্তে নিভে এল, দিনরাতের সেখানে এক সরলরেখার সাক্ষাত্‌; রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে । তবে আফশোষের এই, সেই মোহনায় দেখা হল'র যোগ্য তিনি ছিলেন না । তখন কাছে ।

    "...গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন স্টেশন দেখলাম । গাছের গঁংউড়ি কেটে
    ঘর প্ল্যাটফর্ম; অতীতে কোনো সময় ছোট্ট টয় ট্রেন চলত,..."
    আরও খানিক ঘুরে ফিরে গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন স্টেশন দেখলাম । গাছের গঁংউড়ি কেটে ঘর প্ল্যাটফর্ম; অতীতে কোনো সময় ছোট্ট টয় ট্রেন চলত, তখনও রাস্তা ভাল হয়নি । এখনও ট্রেন চালান কর্তৃপক্ষ, তবে আর দরকারের দায়ে নয় । অন্ধকার গাঢ় হয়েছে, এবার ফেরার ফিকির ।

    হঠাৎ চোখ পড়ল আকাশে; ফেরাতে পারলাম না । যেন নিকষ কালো মার্বেলের মেঝেতে বিছিয়ে আছে বরফের স্তবক । তারাদের আর আলাদা করে চেনা যায়না, জমাট বেঁধে আছে ছোট বড় তোড়ায় । মিল্কি ওয়ে'র অনুভব হল নিমেষে, দুধেল ফেনায় ভরে আছে চরাচর, তার ঠিক মাঝখানে শুভ্র সড়ক ছুটছে ধরা থেকে অধরায় । রাতের আলোর উত্সবে দিনের ঝাঁঝালো তেজ নেই, আছে শান্ত স্নৈগ্ধ্য । আমাদের ওজস্বী ভাস্কর একদিন নিভে যাবেন, কিন্তু এই বাতির মহড়া জেগে থাকবে সময়ের শেষ ছঁংউয়ে । বহু পৃথিবী পরের কবিও লিখে চলবেন, তোমার সাঁঝের তারা ডাকল আমায় যখন অন্ধকার হল ।

    রব উঠল ইট্স সো কোল্ড, লেটস্‌ গো ব্যাক । গাড়ির জানালায় বসে তেরচা চোখে সারা পথ তাকিয়ে রইলাম উপরে । সবচেয়ে নিভৃত নক্ষত্রও আজ নেমেছে আলোর হোলিতে ; সাদার আড়ালে কত না রঙ-হবাহার । অশ্রাব্য স্বরগ্রামে গেয়ে নিলাম, মন মিলে যায় আজ ঐ নীরব রাতে, তারায় ভরা ঐ গগনের সাথে । চলতে চলতে হঠাৎ শহুরে কর্কশ মশালগুলো ধাক্কা মারল চোখে, চটকা ভেঙে আকাশে তাকিয়ে দেখি ম্যাড়মেড়ে চেনা রাত । ফ্ল্যাগস্টাফ এসে গেছি, তাল উঠল লাওয়েল অবজারভেটরির দুরবীন চেখে গেলে হয় ।

    সেই গতবারের গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন অভিযানের সময় ভরদুপুরে এখানে এসে নাকাল হয়েছিলাম, আশা ছিল পরের কোনো আঁধার অভিসারের সুযোগ হবে । মিলে গিয়ে আজ ফূর্তি হল, গাড়ি বেয়ে উঠতে লাগল দূরবীক্ষণাগারের খাড়া পাহাড়ে । শেষবারে চত্বর পেয়েছিলাম শুনশান, এবার দেখি থৈ থৈ জনতা । প্রায় সাড়ে আটটা, শীতের রাত, আকাশে মেঘের আঁচল নেই একরত্তি, ঠাণ্ডা নামছে যেন গলন্ত লোহা । চারিদিকে টুপি-দস্তানার মেলা, বাচ্চা বুড়ো সকলেই সোত্সাহে লাইনপন্থী । ব্যাপারটা খানিক খটকায় ফেলল । প্লুটো-টুটো কিছু আবিষ্কার হবে নাকি আবার আজ ? হয়ত আগেই হয়ে গেছে, এখন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন । আমার এ তামাশায় তেমন রমণীয় সাড়া না পেয়ে মনের দু:খে এগিয়ে চললাম । কুণ্ডলিকৃত লাইনের আগায় টিকিট-ঘর, তার পাশেই সাইনবোর্ড । আলোকিত হলাম ; মাসের শেষ শনিবারে বক্তৃতার ব্যবস্থা থাকে, তার পরে দুরবীন দিয়ে কোন এক চিহ্নিত নক্ষত্র দর্শন । আজ তেমনই এক দিন । অবাক লাগল দেখে; সপ্তাহান্তের আলস্য, শীত, টিভি প্রোগ্র্যাম ও সর্বোপরি আসন্ন নিউ ইয়ারের আমোদ ছেড়ে এত নাগরিকের আগমন, শুধুই মহাকাশী কচকচি আর তারকার শুভদৃষ্টির লোভে ! অনেক দম্পতি শিশু-শাবকদের নিয়ে এসেছেন, বাচ্চাদের চোখে-মুখে শাশ্বতী শৈশব । প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ারাও অল্প নন, লোমশ ঘেরাটোপে লোলচর্ম ঢেকে চনচনে । মেটিরিয়ালিজ্মে মজেও যে এমন ইম্মেটিরিঅ্যাল ঝোঁক, হলিউডের ছবি দেখে তা বুঝিনি । এই লাওয়েল ল্যাবে শুভ্রদাদা গবেষণায় কাটিয়েছিলেন কয়েকমাস ।

    টিকিটের দর দেখা গেল মাথাপিছু পাঁচ ডলার, স্টুডেন্ট হলে আড়াই । আমাদের দলের রমণীরা আগায় থাকতেন, কাউন্টার পৌঁছতেই বললেন, উই আর ফ্রম ইণ্ডিয়া, ভেরি পুওর কান্ট্রি আওয়ার্স, থার্ড ওয়ার্লড । তারপর মিষ্টি করে হাসলেন । কড়কড়ে রসিদ বেরিয়ে এল, ফাইভ ইন্টু টু পয়েন্ট ফাইভ, সাড়ে বারো । আমরা সমস্বরে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ।

    সভাঘরে বক্তৃতায় এক এক বার আড়াইশো করে লোক, আধঘন্টা ধরে পিরিয়ড । একটা চলমান শো আধাআধি হয়ে এসেছে, পরেরটার জন্যও টিকিটে ছাপ পড়েছে, আমাদের জলদিতম আশা তার পরেরটাতে । একটা প্রদর্শনী হচ্ছিল ঢুকে পড়লাম, হাতে অন্তত তিনসিকি ঘন্টা । মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক মডেলভিত্তিক একজিবিশন, প্রায় সবকটা মডেলই হাতে-নাতে চালিয়ে দেখা যায় । থিকথিক করছে লোক, কিন্তু হট্টগোল নেই, এবং যন্ত্রগুলোকে অযান্ত্রিক বানানোর তেমন চেষ্টাও নেই । মডেলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে সকলে পড়ে নিচ্ছেন কার্যপ্রণালী, এবং নির্দেশ নিখঁংউত মেনেই তারপরের ব্যবহার । অনেক জটিল জ্যোতির্তত্ত্বও মনে হল বেশ টপ করে বুঝে গেলাম, আর না বোঝাটাও হয়ে রইল উপাদেয় হাতছানি ।

    হলঘরে ঢুকে জুত্সই জায়গা নিয়ে বসে দেখি সামনে পোডিয়াম, তার পিছনে বিরাট সাদা পর্দা । পাঁচমিনিটের ভিতর নি:শব্দে ভরে গেল সব সীট, বক্তা এক ঢোক জল খেয়ে নিলেন ।

    সদ্যাগত বড়দিনের ধুয়ো তুলে শুরু করলেন, খ্রীষ্টের জন্মের সময় বেথলেহেমের আকাশে যে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক দেখা গিয়েছিল সে নিয়ে পরবর্তী গবেষণা অনেক আশ্চর্য দিশা দিয়েছে । পরের আধঘন্টায় সরল ভাষায় বর্ণনা চলল ব্রহ্মাণ্ডের আবির্ভাবের অস্পষ্টতা থেকে তিরোভবের অদৃশ্যতা অবধি । সাথে মনকাড়া স্লাইডে পিছনের পর্দা ছেয়ে যাচ্ছিল । বক্তা বক্তৃতায় পটু, স্বরগ্রামের নিপুণ ওঠা-নামায় উঠে আসছিল কখনও বিস্ময়, কখনও সন্দেহ, কখনও সন্ধিত্সা । আর এসবের সঙ্গে মচমচে কৌতুক । সারা ঘরে এক ফোঁটাও উশখুস নেই, সকলে শুনছেন অধীর আগ্রহে । আধঘন্টা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল তা বুঝলাম না । শেষে বললেন, স্রষ্টা কে তা সঠিক না-জেনেও সৃষ্টির উপলব্ধি আমাদের আনন্দিত করে, আন্দোলিত করে । গমগম করে বেজে উঠল, আল্লেলুয়াইয়াহ, হ্যাণ্ডেলের মেসাইয়া'র সেই অপূর্ব সুরলহরী । পয়গম্বরের পরিচয় অবান্তর লাগল আবার, সুরটাই তো ঐশ্বরিক । প্রথা অনুযায়ী সকলে দাঁড়িয়ে উঠে গলা মেলানো হল ।

    সেদিনের নক্ষত্র ছিলেন বৃহস্পতি । বক্তৃতার শেষ দিকে এ সম্বন্ধে খানিক চুম্বক দিয়ে দেওয়া হয়েছিল । হল থেকে বেরিয়ে বাগানে গিয়ে দাঁড়ালাম । প্রায় আধমাইল লম্বা লাইন, শেষ হয়েছে গম্বুজের দরজায়, চালের উপর থেকে দুরবীনের নল উঁকি মারছে । বাগানে গাছের ফাঁকে ফাঁকে ঢিমে আলোর নিশানা, বেশ প্রাণয়িক পরিবেশ । আমাদের টার্ন এল প্রায় আধঘন্টা পরে । লাওয়েল স্পর্শিত দুরবীনে চোখ সেঁটে এক ঝলক সাক্ষাৎ গ্রহরাজের সঙ্গে । বৃহস্পতির বহুগামিতাও দেখলাম, গণ্ডা কয়েক চাঁদও ছিলেন আশে পাশে । এক ভীষণ ধৈর্যী স্বেচ্ছাসেবক পাশেই দাঁড়িয়ে, প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে বীক্ষণ অ্যাডজাস্ট করছিলেন । আমি তাঁকে এক গাদা অর্বাচীন প্রশ্নেও বিব্রত করতে পারলাম না, সুমিষ্ট উত্তরে নিজেই বেকুব বনলাম । পিছন থেকে কেউ আগে বাড়ুন দাদা, ইত্যাদিও কিছু বললেন না ।

    তবে বৃহস্পতির নেকনজরের থেকেও সেদিন বেশি মনে ধরল গম্বুজের বাগান থেকে নীচের ফ্ল্যাগস্টাফের দৃশ্য । ছঁযাকা দেওয়া ঠাণ্ডাকেও ভুলিয়ে দিয়েছিল আলোর সেই নক্সিকাঁথা । ছোট্ট জনপদের প্রত্যেকটি মিড় যেন অরূপ আলোর নূপুর । মেদুর মনে চেয়ে থাকতে থাকতে ভাঁজলাম, এ জীবনে যা কিছু সুন্দর ইত্যাদি । আর গাঁথলাম কবিতা । একদম অরিজিন্যাল লাগল ; কবিতাটা । বিশেষ করে এই বিপ্রলম্ভের বাজারে ।

    লিখলেন, কি সব যা তা লিখছ চিঠিতে, আলোয় আঁধারবাতি, সে তো তুমি, সে তো তুমি । বড্ড চাইল্ডিশ, ক্লাশ এইটের বাচ্চাও এমন লেখে না, এইটে তুমিও লিখতে না । বয়সটা বাড়ছে, না কি ? মন খারপ লাগল । ভাবলাম, সাধে কি আর রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, তুচ্ছ সা-রে-গা-মা'য় আমায় গলদঘর্ম ঘামায়..../ স্বয়ং প্রিয়া বলেন `তোমার গলা বড়ই রুক্ষ' । প্রিয়ারা বোধহয় এমনই চিরন্তনী, বেরসিক ।

    প্রিয়া বলতে মনে পড়ল একটা গল্প । আমার স্বর্গত পিতামহ কমর্সূত্রে বিহারের এক শিল্পাঞ্চলে থাকতেন । ছোট্ট নগরীতে বাঙালি পরিবার কয়েকটি কাছাকাছি, কলকাতা থেকে কেউ ঘুরে এলে স্বভূমির হাল হকিকত নিয়ে আড্ডা বসত । সহকর্মী এক বললেন একদিন,
    -- আরে মশাই, শহরটা একদম উচ্ছনে গেছে ।
    কলকাতার বিপদ শুনলে প্রবাসী বাঙালি স্থির থাকেন না । -- কেন ? কেন ? কি হল ? খুনখারাপি, ল' অ্যাণ্ড অর্ডার প্রব্লেম... ?
    -- আরে না না, যা'তা' ব্যাপার .....।
    -- কি ব্যাপারটা ?.. বলুন না ।
    -- বলব, মানে এই সব বাচ্চা-কাচ্চাদের সামনে, খোকন সোনা, একটু ও'ঘরে যাওতো, মামণি তোমার নতুন পুতুলটা আমায় দেখাবে না ? হঁযা যাও বাবা... ।
    -- আরে মশাই, রাসবিহারী এযভিন্যুতে একটা সিনেমা হল বানিয়েছে, নাম দিয়েছে.., মানে নাম দিয়েছে, বৌদি কিছু মনে করবেন না, মুখে আনা যায় না, নাম দিয়েছে, প্রি-য়া । দেশটা কোন দিকে যাচ্ছে বলুন তো ?

    এ-কাহিনী পিতামহের মুখে শুনিনি, হালে বাবা বলেছিলেন ।

    এই সময়টা মার্কিন মুলুক খুব সরগরম ছিল, পোলিটিকসের হাট গমগমে । রাষ্ট্রের পতি পাল্টানোর পালা । প্রত্যেক চার বছরে এই সার্কাস বসে, রাষ্ট্রিক হুল্লোড়ে. মেতে ওঠে মহাদেশ । দেশে বসেই নির্বাচনের খবর পেয়েছিলাম, তবে নিষ্পত্তি এবারে ঝুলে গিয়েছিল । অভিনব ব্যাপার, এক সজ্জন-সাময়িকে হেডিং দেখলাম, আনপ্রেসিডেন্টেড । মার্কিন ভোটিং'এর জটিল হিসেব, ইলেক্টোরাল কলেজ-টলেজ কিসব বুকনি বাতাসে থিকথিক করছিল । যেটুকু বুঝলাম, এবারে দৌড় যাকে বলে ফোটো ফিনিস, এত কম ভোটের ব্যবধান বাদী ও বিবাদীর মধ্যে যে গণনার ছোট্ট ভ্রান্তিও বিরাট ছক উল্টে পাল্টে দিতে পারে । সেই জন্য গণনা, প্রতিগণনা ও উপগণনায় সপ্তাহ বইছে বিস্তর, ব্যাটার ধ্যা-রা-রা-রা চলছে যেন রেকারিং ডেসিমাল । প্রতিযোগিরা তড়পাচ্ছেন; তাঁদের স্যাঙাতদের কি টেনশন । টিভি, কাগজ ইত্যাদিতে রোমহর্ষক চর্চা, কথা একই, টু ক্লোস টু কল ।

    উত্তেজনার পারদ ত্রক্রমশ ঊর্দ্ধগামী, বিতণ্ডাও ঝাঁঝালো হচ্ছে । তবে রাজনৈতিক বিতর্ক যতই গরম হোক না কেন, শ্লেষ-বিদ্রুপ-প্রতিযুক্তির বাণ যতই শাণিত, একটা লিমিটের লক্ষ্মণরেখা কেউই পেরোচ্ছেন না দেখলাম । প্রিন্সিপাল, ইন্টেগ্রিটি ইত্যাদি শব্দ গুডগুড় করে উঠছে, কিন্তু একে অপরকে চোর ছঁযাচড় বা অন্য কোনো ব্যাক্তিক অভিধা লেপা হচ্ছে না । ভেবে আশ্চর্য লাগল, এঁদের নির্বাচন এখনও কাগজে ছাপ্পা মেরে, ইলেকট্রনিক যন্তরের নামও শোনেননি কেউ । এই নিয়ে এক গ্যাস-স্টেশনের কাণ্ডারীকে অনেক জ্ঞান ঝাড়লাম ; আমাদের দেশে এসব কবে চালু হয়ে গেছে । শেষে বললাম, ইণ্ডিয়া, গ্রেটেস্ট ডেমোক্র্যাসি । আই মীন, লার্জেস্ট ।

    মাস ঘুরে এল দুয়েক চক্কর, ফয়সালা দুরস্ত । প্রত্যেক গণনার শেষে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, তারপর সেই এক হাহাকার -- এই যা ! গেল ফস্কে ফেঁসে - হেঁই মামা তুই ক্ষেপলি শেষে ? ক্ষেপছিলেন সকলেই, শেষে সুপ্রিম কোর্টের পরচূলী ধর্মাবতার্দের শরণ নেওয়ার অবস্থা । তাঁরাও বাবরি ঝাঁকিয়ে নিদান হাঁকছেন, রাম খটাখট ঘঁযাচাং ঘঁযাচ, কথায কাটে কথায় পঁযাচ । মার্কিন জনগণেশের এমনিতে রাজনীতির উত্সাহ অল্প, চায়ের ঠেকে বা জ্ঞানের আড্ডায় দেশীয় ব্যাপার নিয়ে অহেতুক তাতাতাতি নেই; মেরেকেটে পঞ্চাশ শতাংশ ভোট পড়েছে । তাও এবার নাকি টেলিফোনে-ইমেলে স্বয়ং পাণিপ্রার্থীরা লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে নিজেরাই এক এক করে প্রায় সব ভোটারকে আকুতি জানিয়েছিলেন, গতর নাড়িয়ে ছাপটা মেরে আসতে ।

    কিন্তু ভোটের পরের এই সব গণনীয় গোলযোগ, কে যেতে কে হারের চাপান উতোর, আম-মার্কিনকে খানিক চাঙ্গা করেছিল । কিছুতেই-কিছু-আসে-যায়না'র মায়াবী সিনিসিজ্ম ছেড়ে সকলে আবার দেশ-টেশ নিয়ে বিচলিত-বিগলিত হয়ে পড়ছিলেন । একজন টিভি ভাষ্যকার বললেন, এটাই নাকি শাপে বর, অ্যামেরিকান্স আর এগেইন ওয়েকিং আপ টু দেয়ার কান্ট্রি ।

    টিভিতে এই উপলক্ষ্যে এক ধরনের অনুষ্ঠান দেখে খুব মজা পেতাম । রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের আচার ব্যাবহারের মক্সো, প্রায় ভ্যাঙানোই বলা চলে । দুজন দক্ষ অভিনেতা নকল করতেন প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটের । নানা অদ্ভুত প্রসঙ্গ টেনে এনে বাক্যুদ্ধ, বাদী-বিবাদীর সাজপোষাক, আদব-কায়দার রঙ চড়ানো অনুকরণ, পিছন থেকে মাঝে মাঝে হো হো হাসি । এ ছাড়াও টিভি, খবরের কাগজে খুব খোলামেলা আলোচনা দেখতাম নানা ; পলিসির মতানৈক্য হলে ধুয়ে দিতে ছাড়েন না কেউই, তবে বচন পরুষ হলেও ক্কচিৎ অসম্বৃত ।

    অবশেষে উত্তেজনা যখন ফাটো ফাটো, এক পক্ষ কন্সীড করলেন । ছোট্ট মার্জিত বক্তৃতায় পরাজয় স্বীকার করে বিজয়ীকে অভিনন্দন জানালেন বিজিত । সকলে বললেন, স্টেট্সম্যানলাইক । তাজ্জব বনে গেলাম দেখে, রীগিং'এর অভিযোগ নেই, কারচুপির কাদাছোঁড়া নেই, শুধুই জনগণের রায়ের দোহাইতেই সরে দাঁড়ালেন একজন । তাঁর সমর্থকদের আশাহনন নিশ্চয়ই অল্প হয়নি, কিন্তু ভাঙচুর বা বাস পোড়ানোর তেমন খবরও চোখে পড়ল না । আর তাও এবারের সংগ্রাম যখন ছিল টুথ এযাণ্ড নেল !

    এখানে রাষ্ট্রপতির শপথগ্রহণ বেশ জাঁক করে হয়, বলা হয় ইন'অগরেশন । ব্রিটেনের সাথে প্রতিযোগিতা যেন সবেতে ; রাস্তার বাঁদিক ডানদিক ঘুলিয়ে দিয়ে, কিলোমিটারকে মাইলে টেনেও ক্ষান্তি নেই । টিভিতে শপথ-সম্প্রচারের আগে বলা হল সাফাইয়ের সুরে, দ্য ইউনাইটেড কিংডম করোনেট্স, দ্য ইউনাইটেড স্টেট্স ইন'অগরেট্স । জমকালো অনুষ্ঠান, আসল শপথগাথা ছোট্ট, কয়েকটা সরল শব্দে প্রবল প্রতিজ্ঞা । তবে শেষে শুনলাম বললেন, সো হেল্প মি গড । তার মানে কি এই শপথ নিতে গেলে আস্তিক্যে আস্থা থাকতেই হবে, নাকি নাস্তিকদের জন্য অন্য স্ক্রিপ্ট আছে ?

    শপথের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ধন্যবাদের ফোয়ারা ছুটল । পিতা-পুত্রী জায়া-জননী সকলকে ছঁংউয়ে অত:পর প্রতিদ্বন্দীকেও ছাড়লেন না । উষ্ণ অভিবাদন জানালেন, ফর রানিং এয ক্যাম্পেন উইথ স্পিরিট, অ্যাণ্ড কন্সীডিং উইথ গ্রেস । এটাও নতুন লাগল ; আমাদের ওধারে তো কুপোকাৎ শত্রুকে পায়ে পেষা হয় প্রকাশ্যে, পাছে আবার চেগে ওঠে । নব রাষ্ট্রপতির পিতাও ছিলেন রাষ্ট্রপতি অদূর অতীতে, শরীর স্বাস্থ্যে এখনো মজবুত, সস্ত্রীক এসেছিলেন পুত্রের ইন'অগরেশনে । তবে বংশ-পরম্পরার খেই টেনে কোনো মাতব্বরি নেই বাপ-বেটার; এক্স-প্রেসিডেন্টের সারণিতে নির্লিপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন পিতা ।

    বিদায়ী রাষ্ট্রপতির মিডিয়া-স্যাভি বলে সুখ্যাতি ছিল; তা প্রমাণ করতেই বোধহয় যাবার আগে টেলিভিশনে ভাষণ দিলেন । আবেগঘন স্মৃতিচারণের শেষে কি ছেড়ে যাচ্ছেন বলতে গিয়ে বললেন, আই শ্যাল নট হোল্ড অ্যান অফিস হায়ার অর এয কভেন্যান্ট মোর সেক্রেড ইত্যাদি । এই পবিত্র প্রতিজ্ঞা পাকড়ানোর সময় যে খানিক চলকে গিয়েছিলেন, সেসব ব্যাপার উহ্যই রইল ।

    পাব্লিক ফিগার, বিশেষত রাজনীতিকদের অন্তর্জীবনের আনাচ কানাচ নিয়ে মিডিয়া ওখানে খুব গরম থাকে । মাঝে হঠাৎ জোর খবর, একজন প্রথম সারির নেতা, নীতি নিয়ে নাড়া যিনি প্রায়ই তোলেন, তাঁর নাকি প্রণয়পুত্র আছে, বর্ন আউট অফ ওয়েড্লক । ক্যামেরার সামনে কর্ণধার কোনঠাসা, বললেন মুখ কালো করে, ফীলিং ভেরি গিল্টি অ্যাবাউট ইট, এবং এই যোগে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবেন প্রায়শ্চিত্তের যোগে । সকলেই বলে উঠলেন থাক থাক, সরি বলছে যখন আর রগড়িও না ।

    প্রায় পুরো জানুয়ারিটাই চলল নতুন বছরের যোশে । একদিন তাল উঠল আপিসের ভারতীয় মজুরদের ভোজ দেওয়া হবে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে । আমরা তো মহাখুশি, এমন স্বাদেশিক সম্মান তো কম কথা নয় । ইম্পিরিয়াল তাজ না ঐ রকম কি একটা সাম্রাজ্যিক-নামা রেস্তোরায় সান্ধ্যস্ফূর্তি, তত্পরে নৈশভোজ । সকাল সকাল উঠে জুতোটুতো পালিশ করে নিলাম, রুমমেট তড়িঘড়ি জ্বলজ্বলে হলদে শার্ট ইস্তিরি করতে গিয়ে পুড়িয়ে ঝামা করলেন । অনেক শ্যালক সম্বন্ধ পাতিয়ে অবশেষে একটা সবুজ জামা পেয়ে শান্তি ।

    বিকেল বিকেল কাজকর্ম গোটানোর পালা সেদিন আপিসে । মজার ব্যাপার দেখতাম ফিনিক্সে, অ্যামেরিকানরা এমনিতেই আপিসে আসেন খুব ভোর ভোর এবং ক্ষান্ত দেন দুপুর হেলে বিকেল হতেই । তাড়াতাড়ি আসার একটা কারণ অনুমান করেছি ইস্টার্ন টাইম তো দু ঘন্টা এগিয়ে, তার সাথেই তাল রাখতে বোধহয় । এছাড়া অ্যামেরিকানদের অফিস-আওয়ার্সের বাইরে বা উইকেণ্ডে কখনও কর্মক্ষেত্রে ধ্বস্তাতে দেখিনি, যেমন দেখিনি কাজ থামিয়ে বেস-বলের স্কোর গুনতে বা নানা বৈশ্বিক সমস্যায় উদ্বেল হতে । যাইহোক, সেদিনের প্রমোদভূমে ঢোকার মুখে ক্যাটকেটে আলোয় নাম আর একটা ছঁংউচলো গম্বুজ জাতীয়ের ছবি, প্রেক্ষিত থেকে পরিষ্কার হল, তাজ । ভারতীয়ত্বের চিহ্ন ঠিকঠাক দিতে হবে তো । খাদ্য ও মদ্যের বিপুল আয়োজন, অশনের স্বাদ-বর্ণ-গন্ধ চেখে অনশনই শ্রেয় লাগল । আধপোড়া মুর্গির ঠ্যাঙে লালচে ছোপ লেপে তন্দুরি চিকেন আর গাজরের হালুয়ার নামে চিনি মাখানো কাঠের গঁংউড়ো, এমনই পরিবেশিত হচ্ছিল ফাইনেস্ট ইণ্ডিয়ান ক্যুইসিনের জবানিতে । সৌজন্যের খাতিরে গুটিকয়েক মার্কিন আধিকারীকও সস্ত্রীক বা সস্বামীক এসেছিলেন, তাঁরা সমস্বরে বললেন, ও: দ্য ফুড ইজ ফ্যাব্যুলাস, সো ইণ্ডিয়ান । আমি থালা উপচে খাবার নিয়ে পেয়ালা থেকে চুমুক-চুমুক জল খেয়ে পূর্ণোদর পরিতৃপ্তি ফোটাচ্ছিলাম মুখে । সামনেই এক বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মী, মানে বেশ জ্যেষ্ঠ, প্রায় জেঠু স্থানীয়; গভীর দরদে গাইছিলেন, মেরা জুতা হ্যায় জাপানি । ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানির গমক আশপাশ টেবিল ঝাঁকিয়ে দিচ্ছিল, উরুতে চাপড় মেরে বোল তুলছিলেন । হঠাৎ গান থামিয়ে বললেন, একটু ক্যাবারে হবে না, একটাই তো জীবন । আমি বললাম, আরে ! তাই তো ।

    "সেডোনার বিখ্যাতি রেড রক্‌ মাউন্টেন্স । লালচে বাদামী রঙের
    ছোট বড় নানা টিলা..."
    ফিনিক্সের কাছেই সেডোনা ও প্রেস্কট লেক । দেখা হয়নি এখনও । একদিন সকালে রুমমেট বললেন চলো চলো, দেখে আসা যাক । সেডোনার বিখ্যাতি রেড রক্‌ মাউন্টেন্স । লালচে বাদামী রঙের ছোট বড় নানা টিলা; কোনোটার আকার ঘন্টার মত, কোনোটা বা মুঠো করা কমরেডী লাল সেলাম, কোনোটা ধ্যানী তপস্বীর মুখাকৃতি । দূর থেকে অবয়বগুলো স্পষ্ট হয়, কাছে এলে তোবড়ানো কান, ভাঙা নাক ইত্যাদি খঁংউতগুলোই যেন বেশি দৃশ্যমান । একটা খরস্রোতা নালার পাশে বসে দুপুরের আহার হল চড়িভাতির ঢঙে । দলের মাঝে আমিই বেজোড় দেখে তড়িঘড়ি নিদ্রা নিলাম । ঘুম ভেঙে দেখি তখনও জোড় জোরদার, জলে ঢিল ফেলে অনেক রঙিন ভবিষ্যতের জাল চারিদিকে ।

    সেডোনা থেকে যাওয়া হল প্রেস্কট লেক'এ । এরও নাম শোনা যায় ফিনিক্সে বেশ, শুকনো দেশে হ্রদ বড়ই হৃদ্য । লেক শুনে মিশিগান বা টাঙ্গানিয়াকার জিওগ্র্যাফি বইয়ের ছবি ফুটে উঠেছিল চোখে । গিয়ে দেখি আমাদের ঢাকুরিয়া লেকেরও ধারে কাছে আসে না । ডোবা বললে রাগ হতে পারে যদিও, সুবিচারই হবে । তবে ক্ষুদ্র সায়রের ধার ঘেঁষে পাইনের ইতস্তত বনানী, বিশ্রম্ভালাপের উপযুক্ত । এক ধারে কতগুলো নৌকো বাঁধা আছে, কিন্তু বোটিঙের দু:সাহসিকতা কেউই করছেন না, তরীর তলা লেগে যেতে পারে । লেকের বহর ও বাহার নিয়ে রগড় করতে করতে বেরিয়ে আসা গেল । একটা গ্যাস স্টেশনে পেট্রোল ভরার সময় মালিকের সঙ্গে খুচরো গল্প জমে উঠল । একথা সেকথার পর মালিক বললেন, কাছেই প্রেস্কট লেক, দেখেছি কিনা । আমরা বাঁকা হেসে বললাম ও: ইট ইজ সো স্মল । মালিক দেশজ গর্বে খাপ্পা, বললেন, বাট দ্যাট ইজ অ্যাজ বিগ অ্যাজ ইট গেট্স হিয়ার । সত্যি, ছোট বড় নিয়ে তর্ক চলে না, সবটাই আপেক্ষিক, আর ছোটকে ছোট বললে তো আর ছোট'র ভাল লাগে না ।

    সেবারে ফিনিক্সে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছিল, মানে ফিনিক্সীও মাপে আর কি । শনশনে হাওয়া, গঁংউড়ি গঁংউড়ি বৃষ্টি, তাপমাত্রা শতক স্কেলে তিন চার । দপ্তরের একজন উঁচু পদের কাজী, ভদ্রমহিলা, একদিন বললেন, মাই মাদার-ইন-ল হ্যাজ গন টু দ্য গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন টুডে । গলায় উদ্বেগ, এবং উষ্মাও খানিক । এদেশের এম্পাওয়ার্ড্‌ উইমেনদের শশ্রুমাতার প্রতি এমন দরদ দেখে আশ্চর্য লাগল, ভালও । বললাম, ওহ ! ইন দিস্‌ ওয়েদার ?
    -- সী ওয়ন্ট লিসেন টু এনিবডি, ইউ ডোন্ট নো মাই মাদার-ইন-ল ।
    মুখে ভাবনা ফুটিয়ে চুপ করে রইলাম । সত্যিই তো, আক্ষেপই বটে, ওনার শাশুড়িমা'কে চেনা হয়নি এখনও !
    -- অ্যাণ্ড রিক হ্যাড টু ড্রাইভ হার ডাউন, মাই হাজব্যাণ্ড । উত্যক্তির কারণটা এবার খানিক বোঝা গেল ।

    কাজের চাপ এত বেড়ে উঠলো বড়, য়ুইকের আর এণ্ড থাকত না । সপ্তাহের ভৈরবী-পূরবীর খিচুড়িতে সে এক বিচিত্র গর্ধব রাগিণী । যেটুকু সময় ঘরে আসতাম নিদ্রাদেবী ছোঁ মেরে তুলে নিতেন কোলে । বেড়াতে যাওয়া মাথায় উঠল । তারই মাঝে দুয়েকবার চোরাগোপ্তা বইয়ের দোকানে যেতে পেরেছিলাম, বর্ডার্স এবং বার্নস এযণ্ড নোব্লস ।

    সে এক এলাহি ব্যাপার, বিরাট জায়গা জুড়ে বৈঠকখানি ব্যবস্থা, থাক থাক বইয়ের মাঝে ছেটানো আরামকেদারা । যতক্ষণ ইচ্ছা বসে থাকা যায় বই হাতে, কেউ বলবেন না, কি হল দাদা, নেবেন কিনা বলবেন তো । পরিচারকদের হাসি মুখ, পরিচারিকাদের তো কথাই নেই, কোনো কেতাবের খোঁজ করলে উত্সাহের ফোয়ারা ঝরে, সে বইয়ের ভূগোল ইতিহাস কিছুই বাদ থাকে না । ক্যাটালগ ঘেঁটে আন্কালেক্টেড উঢাউস নামে একটা সংগ্রহের তল্লাশি চালালাম । দোকানে নেই, দোকানী বললেন চারদিনের মধ্যে আনিয়ে দেবেন, ফ্রম আওয়ার ওঅ্যারহাউসেস অন দ্য ইস্ট কোস্ট । আড়াই দিনের মাথায় টেলিফোনে সুরেলা আহবান, প্লিজ কালেক্ট ইয়োর অর্ডার ইত্যাদি । এইসব দোকানে বই ভাগ করা থাকে বিষয় বিন্যাসে, শুধুই বিকিকিনির দায়ে এলোপাথাড়ি ছড়ানো নয় । সঙ্গীতের সম্ভারও প্রচুর, সি ডি'র ঢল একধারে । বিথোভেনের ন'টা সিম্ফনির একটা সেট ভীষণ মন টানল, ঘুরিয়ে দাম দেখেই ফিফথের প্রারম্ভিক ধাক্কাটা খেলাম । তারপরে পারমহংসিক টাকা ও মাটির যুক্তিটা মনে পড়ল, কিনেই ফেললাম । কলকাতার এক সাঙ্গীতিক বন্ধুকে উপহার দিয়েছিলাম, তাঁর খুশির দাম মাপার কারেন্সি এখনো বেরোয়নি ।

    অবশেষে ফেরার দিন কাছে এল । অনেকে পরামর্শ দিলেন, হাত বা পা ভাঙলে নাকি আই নাইন্টি-ফোরের মেয়াদ বাড়ানো যায় । কিন্তু পেনলেস পা ভাঙার কোনো উপায় কেউ বাত্লাতে পারলেন না । তাই প্ল্যানটা ভেস্তে গেল । হতাশ হয়ে মন্ত্রীরা বললেন, নো পেন নো গেন । আমার মনে হল স্কুল ছাড়বার দিন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বলেছিলেন প্রণামের প্রত্যাশিসে, মানুষ হয়েও, মাছ ধরতে ধরতে মাছ হয়ে যেও না । তারপর থেকেই মানুষ না হবার চেয়ে মাছ হবার ভয়টাই আমাকে বেশি তাড়ায় ।

    ফেরার পথটা প্রায় ঘটনাবর্জিত । তুলতে এসেছিলেন বেশ কয়েক বান্ধব । ফিনিক্স থেকে শিকাগো-লণ্ডন হয়ে প্রত্যাবর্তন । কাকভোরে স্কাইহার্বার বিমান বন্দরে প্লেন পাকড়ানো । বোঁচকা এবার বেশ বেড়েছে, গাড়ির ডিকি থেকে নামাতে হিমসিম খাওয়ার যোগাড় । এগিয়ে এলেন এক অতিকায় কৃষ্ণমানব । লীভ ইট ম্যান, আশ্বাসী ভঙ্গিমায় কড়ে আঙুলে তুলে নিলেন আমার এক জীবনের বোঝা । ভাবখানা যেন, খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ হাতি লোফেন যখন তখন । কনভেয়র বেল্টে মালগুলো রওয়ানা করে দিয়ে নির্লিপ্ত মুখে চলে যাচ্ছিলেন । খেয়াল করলাম ইউনিফর্ম, হবেন হয়ত এয়ারপোর্টের বাঁধা মাইনের বাহক । আমি অভিবাদন করে হাত বাড়িয়ে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ । তাচ্ছিল্যে ঘোঁৎ করে চলে গেলেন, আমার বাড়ানো হাত ঝোলাই রইল । বিস্মিত হলাম, চিন্তিতও, আমার ব্যবহারে কি কোনো ভুল হল ? নাকি এই ভুল হয়ে আসছে শতাব্দীক্রমে ?

    শিকাগোতে ও'হেয়ার (এই সেদিন এক বোদ্ধা সহকর্মী শুধরে দিয়ে বললেন, উঁহু ওটা ও'হারে ) ভীষণ ব্যস্ত বন্দর, হয়ত ব্যস্ততম । নামার আগে মিশিগান হ্রদের বিস্‌ংঈতর্ণ জলরাশি ঝলকে উঠল, আমি তো সমুদ্র ভেবেছিলাম । টিনটিনকে অজ্ঞান করে ছঁংউড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল এই লেকে, কিন্তু যথারীতি শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে ঠিক বেরিয়ে এসেছিলেন বীর-বালক । এ সূত্রে অ্যাল-ক্যাপনের কথা মনে পড়ল, দেখা করবার উপায় নেই, দেহ রেখেছেন বহুদিন ।

    বিমানবন্দর বিরাট, এতই যে ভিতরে যাতায়াতের জন্য রেলগাড়ি রাখতে হয়েছে । সঠিক টার্মিনালে গিয়ে অপেক্ষা, প্লেন ধরে অ্যাটল্যান্টিক টপকে লণ্ডন, তার পরে এক লাফে ঘরের ছেলে ঘরে । ভাল লাগে আরবার পৃথিবীর কোনটি ।



    ॥ উত্ক্রান্তি পর্ব ॥



    কলকাতার পুরোনো পাড়ায় অসীমকাকুর সঙ্গে দেখা,
    -- তুমি নাকি অ্যামেরিকা ঘুরে এলে ?
    -- হঁযা মানে এই আর কি, বিজনেস ট্রিপ, বহুদিন ধরেই বলছিল আপিস থেকে, এইবারে আর ঠেকানো গেল না ...।
    -- কি দেখলে অ্যামেরিকায় ? বললেন, অসীমকাকু ।
    -- সে বিরাট ব্যাপার, বাড়িগুলো কি ! আর গাড়ি ! জানেন, টয়েওটা, ফোর্ড, হণ্ডা সব চালিয়েছি । কি সিস্টেম, দেখবার মত, রাস্তায় ভিড়ভাট্টা নেই, লোকজন সব সভ্য-ভদ্র, যা চকোলেট পাওয়া যায় না ! আপনাকে দেব, ফ্রীজে আছে এখনও কয়েকটা । আসুন না একদিন, গল্প বলব সব, ছবিও আছে অনেক, আর একটা সিডি প্লেয়ারও কিনেছি, কি সাউণ্ড ! চলে আসুন, তবে একটু জানিয়ে আসবেন, জেট ল্যাগটা এখনও কাটেনি তো.......।

    অসীমকাকু গান্ধী বিড়িটা মাটিতে ফেললেন, থ্রী-কোয়ার্টার বাকি ছিল; উষ্মিত পায়ে বিড়ি পিষে বললেন,

    -- দেড়শো বছরের কালঘাম জলে গেল ।

    আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, এইরে উনি তো একসময় দিন বদলাতে গিয়েছিলেন । সে আমার জন্মেরও আগে ।

    কিন্তু প্রশ্নটা মনে বিঁধল । কি দেখলে অ্যামেরিকায় ?

    প্রকৃতিটা না হয় বাদ দেওয়া যাক, গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়ন আর তুষারপাত তো শ্যামখুড়োর নিজের সম্পত্তি নয়, দেবোত্তর । তবে অ্যামেরিকান নেশনটাও দ্রষ্টব্য বটে ।

    কিন্তু এই নিয়ে কোনো ইউজেনিক কচ্কচি আমার এক্তিয়ার নয় । সেই ওয়াশিংটন সাহেবের সময় থেকে যে আপ্রাণ আবাদ, তার ফল নিয়ে বলার আমি কোন বান্দা ? পৃথিবীর ইতিহাসে সভ্যতার তেজী-মন্দা আজ থেকে নয়, ঐ সাইন-কোসাইনের চক্কর চিরকেলে । এই তো সেদিন হরপ্পার হিল্লোল দেখে নিউ-ইয়র্কের নাল পড়ত । আরও কাছেই তো শৌর্যের সংজ্ঞায় সুকুমার লিখেছিলেন সাত জার্মান জগাই একা ইত্যাদি । জাতি ওঠে জাতি পড়ে, এই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই । আমাদেরও টার্ন আসবে আবার ; কে যেন বলেছিলেন না, পৃথিবী বিপুলা এবং কাল নিরবধি (নাকি উল্টোটা ? যাইহোক, মানে সেন্সটা হল ওটাই) । যতদিন না এসে পৌঁছয় আমাদের বাঁক, ততদিন কীর্তনীয় ফোরকাস্ট চলতেই পারে, ভারত আবার জগৎ সভায় স্রেষ্ঠ আসন লবে । আর করোলারি হিসেবে, ধর্মে মহান হবে, কর্মে মহান হবে ইত্যাদি ।

    মার্কিন মুলুকে ভারতীয়রা বেশ জাঁকিয়ে আছেন, দেখে গর্ব হয় । শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতির অনেক শীর্ষই দখলে, রাজনীতিতেও অধুনা অভ্যুথ্থিত । বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী, নির্বিবাদী গোষ্ঠী হিসেবে ইণ্ডিয়ান কম্যুনিটি সমাদৃতও । একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়, একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগরময়, সন্তান যার তিব্বতচীন জাপানে গড়িল উপনিবেশ ....।

    একদার এই সোনার ঝাণ্ডা এখন শক্ত করে ধরা মার্কিন মুলুকে । এই ডায়াস্পোরাতেই হয়ত ভারতের ভবিষ্যত ।



    ॥ উন্মন্থন পর্ব ॥



    পাঁচ কিস্তির পরবাস'এ মুহূর্মুহূ মেগাবাইট সাঁটিয়ে এবার মীমাংসার পালা । উপ, অপ যাহোক কিছু একটা সংহার করতেই হয়, অশ্বথামাও নাকি শেষ দিকে অমরত্বে হেজে গিয়েছিলেন ।

    বাঙালির কাছে দুটো পথ থাকে । এক, আয়ু ক্ষয়িয়ে নিজের নির্মাণ । দুই, রবীন্দ্রনাথ খুলে মাইল ধরে কোটেশন । অবশ্য বাঙালির সব ব্যাপার আসলে সেই ফোটো-সিন্থেসিসি ! তাহোক, এবার সরাসরি শরণ নেওয়া যাক সূর্যের ।

    ইয়োরোপ প্রবাসীর পত্র, রবীন্দ্রনাথের প্রথম ভ্রমণোপাখ্যান । সতেরো বছর বয়সে লণ্ডনে পাঠানো হয় ব্যারিস্টার বনতে । প্রথার পড়াশোনা বাদে আর প্রায় সবই করেন সেখানে তরুণ-তপন ; বেড়ানো, বই পড়া, গান শোনা, ছবি দেখা, গান গাওয়া এবং মন পাওয়া । চিঠির আকারে সেসব গল্প বেরিয়েছিল ধারাবহিকভাবে ভারতী পত্রিকায় । প্রায় ষাট বছর পরে পুস্তক রূপে প্রথম প্রকাশের নতুন ভণিতায় রবীন্দ্রনাথ এই লেখাকে কৈশোরিক কাঁচা হাতের পর্যায় ফেলেন । এবং প্রচুর লজ্জা প্রকাশ করেন । তবে তার সঙ্গে এও স্বীকার করেন যে বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে এই সম্ভবত আধুনিক চলিত ভাষায় প্রথম প্রকাশিত রচনা, এবং সেই খাতে এর তাত্পর্য কিছু থাকলেও থাকতে পারে ।

    এমন আশ্চর্য-সুন্দর গদ্য কবি-সার্বভৌম নিজেও পরে আর খুব বেশি লেখেননি । শৈলীর সৌকর্ষে এর তুলনা চলে একমাত্র ছিন্নপত্রাবলী ও ছেলেবেলার সঙ্গে ।

    ১৯৩৬'এ লিখিত ইয়োরোপ প্রবাসীর পত্র'এর পরিশিষ্ট থেকে উদ্ধৃত করছি ।

    "বাঙালির ছেলে প্রথম বিলেতে গেলে তার ভালো লাগবার অনেক কারণ ঘটে । সেটা স্বাভাবিক, সেটা ভালোই । কিন্তু কোমর বেঁধে বাহাদুরি করবার প্রবৃত্তিতে পেয়ে বসলে উল্টো মূর্তি ধরতে হয় । বলতে হয় `আমি অন্য পাঁচজনের মত নই, আমার ভালো লাগবার যোগ্য কোথাও কিছুই নেই ।' সেটা যে চিত্ত-দৈন্যের লজ্জাকর লক্ষ্মণ এবং অর্বাচীন মূঢ়তার শোচনীয় প্রমাণ, সেটা বোঝবার বয়স তখনও হয়নি ।"

    আমাদের সুবিধা অনেক । রবীন্দ্রনাথ ছিয়াত্তরে বুঝে আমাদের ছাব্বিশেই বোঝান !





    ॥ শেষ ॥




  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments