• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৩০ | মে ২০০৩ | রম্যরচনা
    Share
  • দিদিভাই : দীপালি চক্রবর্তী

    দোকানের নাম মনোরমা । চুঁচড়োর ঘড়ির মোড় পার হয়ে আখনবাজারে ঝলমলে কাপড়ের দোকান । শো-কেসে থাকে থাকে সাজানো ব্লাউজ । কতো রং, কতো ডিজাইন । তবু খুঁজে খুঁজে হয়রান । শেডে মেলে তো ফ্যাশনে মেলে না । কী একখানা পিঠ রে বাবা ! ঘাড়ের নীচেই প্রশান্ত মহাসাগর । হু হু করে হাওয়া খেলবে । বারো মাসের মধ্যে ন'মাস থাকি শিলং - আমাদের কি ওই ফ্যাশন চলে ? তবু এদের দেখাবার উত্সাহেরও শেষ নেই । এটাই তো চলছে আজকাল - গরমের দেশ তো ? এয়ারহস্টেস তো কবেই উঠে গেছে । মনে মনে বলি - ফ্যাশনেরও বলিহারি ! ওই একখানা পিঠের কাপড়ে তো ছোটো বাচ্চার ফ্রকের আধখানা সুন্দর হয়ে যায় । কেমন এক ঢিলে দুই পাখি !

    হতাশ হয়ে শেষে হাল ছেড়ে দিই । এমন সুন্দর একখানা শাড়ির একটা ম্যাচিং ব্লাউজ জুটলো না । কী আর করা যাবে ! নাহয় এখন থেকে লতা মঙ্গেশকারের স্টাইলেই শাড়ি পরবো । এতো ঝামেলার দরকর কী ?

    এমন সময়ে পাশে বসে থাকা ছেলেটি - দোকানের সহকারী হবে হয়তো - বলে উঠলো - একটু বসবেন দিদিভাই ? আমি আরো কিছু ব্লাউজ নিয়ে আসছি অখুনি - ঠিক মিলে যাবে - বলেই এক দৌড় ।

    দিদিভাই ! আহা কতো দিন পর আবার ওই মিষ্টি ডাক ! কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল । এ দোকান আমার অনেক দিনের চেনা । ছেলেটিকে অবশ্য আগে দেখিনি - হয়তো নতুন কাজ নিয়েছে । এখানে আমি বছরে একবার শিলং থেকে আসি শীতের ছুটি উপভোগ করতে । শাড়ি ব্লাউজ টুকিটাকি কেনাকাটা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখাশোনা - বেড়ানো - এতেই শীতের দিনগুলো বেশ কেটে যায় ।

    প্রথমে এ দোকানে এসেছিলাম বোনটিমাসির সঙ্গে । বোনটিমাসি আমার মায়ের সবচেয়ে ছোটোবোন - আগে বোনটিই ডেকেছি মায়ের দেখাদেখি - অনেক ধমক খেয়ে পরে বোনটিমাসী ডেকেছি সেটাই সবাই মেনে নিয়েছে । ছেলেবেলায় মামাবাড়িতে আমি ছিলাম তার নিত্যসঙ্গী - আর তার ছোটো ছোটো দুষ্কর্মেরও অংশীদার ।

    বোনটিমাসি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন - এই যে সন্তোষ - এ আমার বোনঝি শিলং-এ স্কুলটিচার - একে ভালো করে শাড়ি দাও - তোমার শাড়ি কতোদূর গিয়ে নাম করবে দেখো ।

    বোনটিমাসিকে সন্তোষ মাসিমা বলে ডাকতো । আমাকে ডাকতো দিদিভাই । আমার তখনও বিয়ে হয়নি । রঙিন সিল্কের শাড়ি পরতাম । চুল বাঁধতাম পনিটেল করে । বিশেষ করে এখানে ছুটিতে এসে তো আর ছাত্রীদের সামনে মান মর্যাদা ইত্যাদি নিয়ে মাথাব্যথা থাকতো না । কাজেই বেশ খুশি মতো সাজগোজ করতাম । বোনটিমাসি হেসে বলতেন - সত্যি পিয়ালি, বেশ ছিপছিপে শরীরটা রেখেছিস । কে বলবে তুই একজন টিচার, পঁচিশ পার হয়েছিস । দিব্যি কুড়ি একুশ বলে চালিয়ে দেওয়া যায় ।

    সেই থেকে মনোরমাতে আসছি বছরে একবার । প্রচুর শাড়ি কিনতাম নিজের জন্য, বোনদের জন্য । তাছাড়া শিলং-এর বান্ধবীদের অর্ডারি শাড়িও কিনতে হতো । মাঝেমাঝে সন্তোষ চা এনে খাওয়াত - এতক্ষণ ধরে দেখছেন দিদিভাই - একটু চা খেয়ে নিন । তারপর খুব যত্ন করে সব প্যাক করে দিত - শিলং-এ আমার দোকানের কথা বলবেন দিদিভাই, অনেকেই তো এদিকে আসেন শীতের ছুটিতে ।

    সে বছর আমার বিয়ে হ'ল শিলং-এরই এক অধ্যাপকের সঙ্গে । নিজের দায় উদ্ধার হল । চাকরি আর শীতের ছুটিও বজায় রইল । সেবার যখন চুঁচড়ো এলাম সন্তোষ মহা খুশি দাদাবাবুকে দেখে । শুধু শাড়িই দেখেছেন এতদিন - এখন দেখুন আমাদের পাঞ্জাবী-পাজামার স্টক - দাদাবাবুর জন্য কী নেবেন বলুন ।

    বোনটিমাসি খুব খুশি । একটু মুটিয়ে যাচ্ছিলাম বলে চিন্তা করছিলাম । লম্বা মেয়ে বেশি রোগা হলে ভালো লাগে না পিয়ালি, এখন কিন্তু বেশ মানানসই চেহারা হয়েছে তোর - বলতে নেই বাবা মা মাসির নজর ভালো নয় বলে সবাই - ইত্যাদি বলে বোনটিমাসি আমাকে আশ্বস্ত করতেন ।

    কী করে সময় যায় ! বিয়ের আগে সময় চলছিল যেন পায়ে হেঁটে । তারপর রিক্স, অটোরিক্স ছাড়িয়ে একেবারে যেন জেটপ্লেন । অনেক সময় তার গতিও টের পাওয়া যায় না ।

    একবার শীতের সময় মনোরমাতে গিয়ে সন্তোষকে দেখতে পেলাম না । তার বদলে ওখানে বসে আছে যে লোকটি তার নাম বিজয় । আমি নিজেই পরিচয় দিয়ে বললাম - ওই দোকানে যে সন্তোষ ছিল সে কোথায় ?

    - সন্তোষদা আমার মাসতুতো দাদা । তিনি তো এখন শিলিগুড়ি চলে গেছেন ।এ দোকান আমি তার কাছ থেকে কিনে নিয়েছি । আপনি বুঝি এখানে বরাবর আসেন মাসিমা ? কী চাই বলুন না, সবই পাবেন ।

    খটকা লাগলো, এর মধ্যে মাসিমা হয়ে গেলাম ! যাক দেখলাম এ-লোকটির ব্যবহারও বেশ সুন্দর । তবে পছন্দের সময় মনে হ'ল ও বেশ ভারিক্কি শাড়িগুলোই আমার দিকে এগিয়ে দিল ।

    দোকানের সামনে দেয়ালে একটা বড়ো আয়না বসানো । সেখানে আমার মুখের ছায়া পড়েছে । মাসিমা বলবে না তো কী ? একখানা সাদাখোলের ধনেখালি শাড়ি পরেছি, চুল খোঁপা করে বাঁধা । তবু চট করে মাসিমা না-বললেও পারত । তুমিও তো বাছা কচি খোকাটি নও - তিরিশ বত্রিশ বয়স তো হবেই । তানিয়ার বন্ধুরা আমাকে আন্টি ডাকে বটে, তাবলে তোমার মতো গুঁফো ছেলের মাসিমা হতে বয়ে গেছে আমার ।

    বোনটিমাসির সঙ্গে দেখা অহেত বললাম - আজ সন্তোষের ভাই বিজয় আমাকে মাসিমা ডেকেছে ।

    প্রথমেই একচোট বকে নিলেন আমাকে । মাসিমা কেন, এরপর দিদিমা ডাকবে সবাই । আর পর সাদা শাড়ি - আজকাল তোদের বয়সীরা কেমন চলে কলকাতায় - একটু ভালো করে দ্যাখ তো । চোখ ভুরু, ঠোঁট সব মেকআপ করে একদম ভোল পালটে নেয় । তুই একটু সাজতে শেখ তো দেখি, বিউটি পার্লারে গিয়ে একটু বিদ্যেটা রপ্ত করে নে ।

    - বিউটি পার্লার ?

    - হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিউটি পার্লার । আকাশ থেকে পড়লি যে ! কেন, শিলং-এ বিউটি পার্লার নেই নাকি ?

    - থাকবে না কেন ? সেখানে তো আমার ছাত্রীদের ভিড় । মিজো-নাগা-খাসিয়া মেয়েরা - তার ওপর বাঙালি মেয়েদের সংখ্যাও কম নয় আজকাল । সেখানে কি আমি যেতে পারি ?

    - ওই দ্যাখো, ওই বুদ্ধি নিয়ে আর কতো হবে ? আজকাল পাড়ায় পাড়ায় বিউটি পার্লার । ডাক্তার, প্রফেসার, টিচার, অ্যাডভোকেট সব মহিলাদের ভিড় সেখানে । মা-মেয়ে, শাশুড়ী-বউ সব লাইন দিয়ে বসে সাজতে । মেদিনী দেবীর নাম শুনিসনি ? সেদিন তো টিভিতেও দেখিয়েছিল ।

    দেখেছি বৈকি ! বিখ্যাত কসমেটিসিয়ান । পঁচাত্তর বছর বয়সে নাকি পঁচিশ বছরের রূপ । টিভিতে দেখে কিন্তু উত্সাহ পাইনি । মনে হ'ল পদভারে মেদিনী কাঁপিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন মেদিনী দেবী - কোন রূপচর্চার স্বর্গলোকে । উড়ন্ত চুল, উড়ন্ত আঁচল । কালো কাজলের ঘেরে কুতকুত করছে দুটো চোখ । খরখরে কন্ঠস্বরে বেলে গেলেন কী করে সারা জীবন জৌলুষ বজায় রেখে চলতে হয় ।

    যাক্‌, বোনটিমাসির কথামতো আমি সেদিন মনোরমাতে গিয়েছিলাম একটু বিশেষরকম সেজে । সাজাটা যে সার্থক হয়েছে তা বোঝা গেল দিদিভাই ডাক শুনে ।

    বেশ চটপটে ছেলে ! যে ব্লাউজের প্যাকেটটা নিয়ে এলো তা থেকে আমার ম্যাচিং ব্লাউজ তো পেলামই, আরো কয়েকটা সুন্দর, সম্ভ্রান্ত ব্লাউজও পছন্দ করে নিলাম ।

    হঠাৎ মনে হ'ল, বোনটিমাসি বলে দিয়েছিলেন, তোকে মাসিমা ডাকে ডাকুক আমার কী ? আমাকে দিদিমা ডাকলে দেখাব মজা !

    আমি হেসে বলেছিলাম - আমি তো আর ওদের কাছে তোমার পরিচয় দিচ্ছি না, চিন্তা নেই তোমার ।

    যাক্‌ এবার গিয়ে আমার অ্যাচিভমেন্টটা সগর্বে বলা যাবে ।

    ফেরার সময়ে ছেলেটিকে ডেকে বললাম - না বলে পারছি না ভাই, তোমার দিদিভাই ডাকটি বেশ মিষ্টি ।

    ছেলের মুখে সরল তৃপ্তির হাসি । আমাকে অনেকেই ওকথা বলেন দিদিভাই । আমারই এক দাদা বলতেন - দোকান চালাতে হলে লোককে মিষ্টি করে ডাকতে হয়, তবে তো ! আমার দিদিমাকেও আগে দিদা ডাকতাম, এখন ডাকি দিদিভাই । আগের মতো সাদা শাড়ি এখন কজন পরেন, বলুন ? কেমন সুন্দর বব্‌ কেটে, ডাই করে, রঙিন শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সবাই । এখন কি এদের দিদা কি দিদিমা ডাকলে মানায়, বলুন ?

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments