• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৯ | মার্চ ২০০৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • মার্কিন মুলুকে মাসকয়েক : নন্দন দত্ত





    ॥ উত্তুঙ্গ পর্ব ॥



    ফিনিক্স থেকে নিউ ইয়র্ক সাত ঘন্টার ধাক্কা, মাঝে লাস ভেগাসে প্লেন চেঞ্জ । সবথেকে সস্তা টিকিট কেটেছি ইন্টারনেটে ছিপ ফেলে বসে, তাও এই ভরা মোচ্ছবের মাসে দাম বেজায় । ফিনিক্সে বোর্ডিং পাস নেবার সময় কাউন্টারী বললেন, উইণ্ডো সীট, সো ইউ ক্যান এনজয় দ্য লাইট্স অ্যাট ভেগাস । ফিনিক্স থেকে ভেগাস ঘন্টাখানেকের যাত্রা, তবে কার্যত কয়েক মিনিট, একটা টাইম জোন পিছিয়ে আসতে হয় ।

    নামার সময় অধীর আগ্রহে জানালা দিয়ে তাকালাম নীচে, লাস ভেগাসের লাস্য তো নাম করা । আকাশ থেকে আর পাঁচটা শহর যেমন লাগে রাত্রে তার থেকে তফাৎ কিছু লাগল না, তবে আবছা হুল্লোড় কানে আসছে মনে হল । এই লাস ভেগাসের অনেক সুখ্যাতি শুনতাম আশেপাশে, অনেকে তো ফাঁক পেলেই ছোট্ট করে মেরে আসতেন । প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন'এর আইডিয়াল ব্যবস্থা নাকি, আমোদের ফোয়ারা ছোটে দিবারাত, অনাহত । সবাই বলতেন, ভেগাস ঘুরে এলাম, এহে: তোমাকে বলা হয়নি । আমি বলতাম মনে মনে, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে । সেই ভেগাস ছঁংউয়ে যেতে রোমাঞ্চ পেলাম রোমকূপে ।

    আধঘন্টা খানেকের জিরোনো, তারপরে পূর্বমুখী । বিমানঘাঁটির অপেক্ষা-অলিন্দে দেখি সার সার মেশিন, অনেকটা আমাদের স্টেশনের ওজনযন্ত্রের মত । কৌতূহল হল, মার্কিনরা তো এমন সর্বসমক্ষে ভারবাহার বসান না । কাছে গিয়ে দেখি, দ্যুত ব্যবস্থা । পর্দায় ঝকমকে আহবান, চড়া দরের নানা সংখ্যা, রিনরিনে হুক্কাহুয়া গোছের কিছু শব্দ, একপাশে দক্ষিণার খাঁজ, আর তলায় ছোট্ট বেসিন জাতীয় আধার, পাশে নির্মোক নিশ্চিন্তিতে লেখা, ইউ উইল উইন হিয়ার । বাঁদিকে একটা হাতল । কেমন জেদ চেপে গেল । ম্যানিব্যাগ হাত্ড়াতে গিয়ে দেখি বিবেক বলছে, ছি: তুমি জুয়া খেলবে ? তোমার বাবা সিগারেটও খেতেন না ! আমি বললাম, চোপ রও তুম স্পিকটি নট্‌ । তবে টঁযাকের টান টনটনে ছিল, তাই পঁচিশ সেন্ট দিয়েই শুরু করলাম । লেগেও যেতে পারে ডানদিকে কয়েক গাছা শূন্য, সেই যে বন্ধু বলেছিলেন না, সবই ঠাকুরের দয়া । খাঁজের মধ্যে চাকতি ফেলে, হাতলে আশালু মোচড় দিলাম, একদা কি জানি কোন পুণ্যের ফলে.... । ঘচাং'এর দু সেকেণ্ডের মধ্যেই হুক্কা-হুয়া হায়নার হেঁ:হে:ঁতে পৌঁছল । ফক্কা । তবে পর্দায় স্তোকবাক্য, জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা, আবার পঁচিশ সেন্ট দিলে গতবারের সাথে মিলে গিয়ে পঞ্চাশ সেন্টের বরাত মিলতে পারে এবার । বিবেক ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন । বললেন, বলেছিলাম । আমার যদিও হারানোর মত দ্রৌপদী ছিলেন না, অন্তত কাছে; তবু যুধিষ্ঠিরের কথা মনে পড়ল, সময় থাকতে ল্যাজ গোটালাম । পাশের মেশিনে দেখি ঝনঝন করে বেসিনে মুদ্রা ঝরছে, এক হঁংউকো-মুখো-হ্যাংলার কি হাসি । এই খোয়ানো পঁচিশ সেন্ট যে মোমবাতিবনের সেই কম্প্লিমেন্টারি পঁচিশ সেন্টই, মনকে এই বোঝাতে বোঝাতে প্লেনে চড়লাম ।

    এবার খানিক প্লেন চড়া সয়ে গেছে, পাঁচ ঘন্টার খানিকটা ঘুমোলাম, ত্রক্র্যাশ হলে দেখা যাবের নিশ্চিন্তিতে ।

    ফিনিক্সের মাউন্টেন টাইমের হিসেব ঘড়িতে, ভেগাসের প্যাসিফিক টাইম অনুযায়ী প্লেনে চেপেছি, পৌঁছলাম ইস্টার্ন টাইমে নিউ ইয়র্ক । কব্জিতে ভোর পাঁচটা, বাতাসে সকাল সাতটা । বিমানের কাপ্তেন বিদায় সম্ভাষণের সাথে বাইরের তাপমাত্রা জানালেন, বাই বাই'এর উষ্ণতা কেমন ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেল, বিশ ডিগ্রি ফ্যারেনহাইট । সি বাই ফাইভ, এফ মাইনাস থার্টি টু বাই নাইন না কষেই আঁচ পেলাম, সাব জিরো । জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি, টার্মিনাল বিল্ডিং বরফে ঢাকা, রানওয়ে থেকে কেমন ধোঁয়া উঠছে । ভাল করে দেখে দেখি উঠছে না, নামছে; মিহি বরফ । আমার সবেধন নীলমণি রেনকোটটা ভাল করে জড়িয়ে নিলাম । পাশের এক মেম সাহেব মিঙ্ক কোট গলাতে গলাতে বললেন, ও:! আই লাভ দ্য স্নোজ ।

    প্লেনের লাগোয়া সুড়ঙ্গপথে টার্মিনাল বিল্ডিং'এ ঢোকা গেল, সবই সেন্ট্রাল হীটিং, তাই গরম গরম অভ্যর্থনা । এই হল জগত্খ্যাত জেএফকে, নিউ-ইয়র্কের প্রবেশতোরণ, জন ফিত্জেরাল্ড কেনেডি বিমানবন্দর । অকালে প্রয়াত তরুণ নেতার চিরকেলে সৌধ । পৃথিবীর ব্যস্ততম বিমানঘাঁটির নির্ণয় নিয়ে বোধহয় বিবাদ মেটেনি, তবে প্রথম তিনটির মধ্যে শুনেছি এটি একটি । তেমনই মনে হল, অসংখ্য উড়ানদ্বার, অগুনতি গলিপথ, অশেষ যাত্রী, এই তুহিন প্রাতেও সরগরম । কোথায় দাঁড়ানো হবে সেই ধোঁয়াশা শেষ অবধি কাটেনি, আমার এয়ারলাইন্সের বিদায়ী অলিন্দের কাছে দাঁড়াব বলেছিলাম । উত্তরে বলেছিলেন, ঠিক আছে খঁংউজে নেব । বহুবার পথ টথ হারিয়ে নানা দুষ্টুমিষ্টি বকুনি খেয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছলাম আমার বিচারের নির্দিষ্ট জায়গায় । একটা বেঞ্চি খঁংউজে কোণের দিকে গুটিসুটি হয়ে বসলাম । অদূরে বেরোনোর রাস্তা, একটা কাঁচের দরজা খুলছে বন্ধ হচ্ছে আপনা থেকে, কেউ এলে গেলে । দোর খোলার সঙ্গে সঙ্গে যেন পুরো অক্ষয়তূণ ধেয়ে আসছে, বাইরে তুমুল তুষারপাত, চলন্ত গাড়িগুলোর ছাতে পুরু বরফের ছাউনি । আশেপাশের সকলের গায়ে গ্রেট কোট, মাথায় সিন্ধুঘোটক টুপি, হাতে লোমশ দস্তানা । আমার দিকে সমীহের চাহনি, প্যাংলা চেহারা আর ফুটো-ফাটা রেনকোট নিয়েই এমন প্রকৃতির সাথে পাঞ্জায় নেমেছি দেখে । মনে বড় ভয় হল, এই রণসজ্জায় যদি ট্যাকসি ধরতে বাইরে বেরোতে হয়, নির্ঘাত পাকস্থলিতে নিউমোনিয়া হবে, ফুসফুস তো ছবি ।

    যাক এসব কুচিন্তা মন থেকে ঝেড়ে, উডহাউস পড়তে লাগলাম, বোম্বাইয়ের পর আবার এই খোলা হল । পড়তে পড়তে খালি দরজার দিকে চোখ যাচ্ছে, সে আসিবে আমার মন বলে, তবে সারাবেলা গড়িয়ে না যায় । ঠাণ্ডাটাও বড্ড, বেশিক্ষণ বসে থাকলে ঘিলু টিলু সব জমাট বেঁধে যাচ্ছিল । উঠে পায়চারি করছি, বসছি, আবার উঠছি, মনকে বোঝাচ্ছি, শহরতলী থেকে আসছেন, এই প্রাতে আর শীতে, এক্ষুণি পড়বেন এসে । একটা নোটিশ বার চল্লিশেক পড়ে ফেললাম, সারা বন্দরেই নানা জায়গায় লটকানো; দিনকাল খুব খারাপ, নানা দুষ্ট চক্র চারিদিকে, এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেরোনোর সময় যেন শুধুই ট্রাস্টেড কনভেয়ান্সে'এ ভরসা করা হয়, তারপর ট্রাস্টেড গোষ্ঠীর ফিরিস্তি । প্রথম কয়েক লাইন পড়েই গলাটা শুকিয়ে আসত, বিশ্বাসী তালিকা পর্যন্ত আর পৌঁছতাম না । দেড় ঘন্টাখানেক কাটবার পর, হঠাত্‌'ই প্রবাসে দৈবের বসে' কেসটা মনে পড়ল । না: একটা বিহিত করতেই হয়, লড়েই না হয় ...।

    উঠে গিয়ে একজন ঘটোত্কচের মত রক্ষীকে বললাম, এটাই কি একমাত্র বেরোনোর পথ, অমুক বিমান-বহরের যাত্রীদের ? আই অ্যাম লস্ট, আই মীন ওয়েটিং ফর ...। উনি বললেন, ইয়াহ ইয়াহ স্টে রাইট হিয়ার, ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু গো নো হোয়ার । ডু এয পেজ । নির্দেশে দেখি একটা টেলিফোন যন্ত্র, কানে লাগাতেই, নেম প্লিজ । ফট করে নিজের নামটা বলতেই, কট করে কেটে গেল, পরক্ষণেই মাইকে শুনি, এযনি ওয়ান ফর নন্নন ড্যাটা, প্লিজ প্রোসিড টু টার্মিনাল বিল্ডিং নাম্বার ... । আর তক্ষুণি আলাদিনের প্রদীপ ঘষার মত, গা থেকে বরফ ঝাড়তে ঝাড়তে দরজা দিয়ে ঢুকলেন রঞ্জন, সাথে আরো দুজন ।

    প্রায় বছর তিনেক পরে দেখা, এর মাঝে হুগলীর বহু জল বাষ্প আর বৃষ্টির চক্কর কেটে হাডসনে মিলেছে । ব্যস্ত আলিঙ্গন সারতে সারতেই চড়িয়ে দিলেন পুরু নিউ-ইয়র্ক কোট, দস্তানা আর টুপি । গায়ে খানিকটা মাংস লাগল, প্রাণে বল । ওঁদের ট্রায়াম্ভারেটের দুরি ও তিরির দিকে ফিরলাম । একজন প্রীতীশ, রঞ্জনের পরম বান্ধব, আমারও পরিচিতি আজ অনেকদিন । অন্যজন অনুষঙ্গে খোলসা হলেন, রঞ্জন আলাপও করালেন, নানক । উজ্জ্বল গৌরবর্ণ সুদর্শন যুবক, স্বপ্নিল চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক । মাথায় আমার প্রায় দেড়া । দুজনের হাত মিলিয়ে দিয়ে রঞ্জন বললেন আমায়, নানক ইজ্‌ এক্স্যাট্লি ইয়োর এজ । আমি বললাম, ও: ইজ ইট ? আর নানককে বললেন, নন্দন হ্যাজ্‌ বিন পাব্লিশিং ফ্রম এ ভেরি ইয়ং এজ । এ এক বিরাট গর্ব রঞ্জনের, আমার তেমনই লজ্জা । ওসব অর্বাচীন মক্সোর কি লয় নেই ? শশ্যবস্ত হয়ে বললাম, আহ ! ওসব পরে হবে, আমি তো আছিই । নানকের গল্প অনেক শুনেছি, চাক্ষুস চেখে ভাল লাগল, ত্রক্রমশ আলাপে প্রীতি ।

    এয়ারপোর্টের বাইরে এসে কয়েক পা হেঁটে পৌঁছলাম আস্তাবলে । এই বোধহয় আসল ইন্ক্লেমেন্ট ওয়েদার বা নির্দয় নিসর্গ । মুহূর্মুহু তুষারপাত, সাথে হাড় কাঁপানো হাওয়া । চড়ে বসলাম নানকের ঐরাবতে, মান্ধাতা আমলের ল্যাণ্ড রোভার, বৃদ্ধ ও বিশ্বাসী বাহন । গাড়ি ছুটে চলল শহরের উপকন্ঠের দিকে । জানালা দিয়ে তাকিয়ে বিশেষ লাভ নেই, দৃষ্টির সমুখে যেন কে সাদা যবনিকা ফেলেছে । গাড়ির ভিতরের বাতানুকুল যন্ত্রের উষ্ণতা সপ্তমে চড়িয়ে শুরু হল গল্প, নানক চালক, সঙ্গে বাজছেন ওনার প্রিয় ব্রুখনার ।

    নানক জন্মসূত্রে পশ্চিম ভারতীয়, শৈশব কেটেছে লণ্ডনে, যৌবন নিউ ইয়র্কে । এখন পরিবার থাকেন নিউ ইয়র্ক রাজ্যের উত্তরের একটি শহরে, পিতা প্রসিদ্ধ চিকিত্সক । নানক ছিলেন রঞ্জনের ছাত্র, এখন মিত্র, বিশুদ্ধ গণিতে স্নাতক হওয়ার পর ওনার সাহিত্যের ফল্গুধারা চাগড়ে উঠেছে । এখন ফ্রীল্যান্স লেখালেখি করে কল্কে পাওয়ার চেষ্টায়, বিনয় করে বললেন, আই মেক প্রিটেনসান্স অফ রাইটিং । গণিত, সাহিত্য ছাড়াও নানকের ব্যুত্পত্তি সঙ্গীতে, পাশ্চাত্য ধ্রুপদী গুলে খেয়েছেন, বাজাতেও পারেন একাধিক বাদ্য । তবে মজার ব্যাপার, কথাবার্তায় এমন বিরাট স্পেক্ট্রামের ছায়াপাত নেইই প্রায়; আটপৌরে সংলাপ, তবে মাঝে-মধ্যের ঝলকানি রতন চিনিয়ে দেয় । বুদ্ধি, বোধি ও বৈদগ্ধ্যের এমন রসায়ন চট করে চোখে পড়ে না । লজ্জিত হলাম ভেবে, এক্স্যাট্লি মাই এজ, কিন্তু কতটাই উত্তীর্ণ । আলাপ জমতে আরেকটা ব্যাপার উচ্চকিত করল, নানকের রসবোধ, তুষার কণার মত নির্ভার ও নিক্কণ ।

    প্রীতীশ রঞ্জনেরই মত বিশুদ্ধ গণিতের গবেষণা ও অধ্যাপনায় রত, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে, বড়দিনের ছুটি কাটাতে এসেছেন বন্ধুর কাছে । গণিতের দুর্বার আকর্ষণে ব্যাপক যোত্রের হাতছানি উপেক্ষা করেছেন, এখন মনের আনন্দে মজ্জমান, সংখ্যা ও রেখার ব্যাপকতর ব্রহ্মাণ্ডে । সঙ্গীত ও সাহিত্যে গভীর অনুরাগী, গ্র্যাহাম গ্রীনের এমন নিবিড় পাঠক আমার চেনার মধ্যে আর কাউকেই পাইনি, পিয়ানোর পর্দার সাথে প্রণয়ও আশৈশব ।

    আর রঞ্জন তো আছেনই ।

    সব মিলিয়ে এক জমজমাট জমায়েত, নিজেকে বড় অকিঞ্চন লাগছিল, তবে ওঁরা স্নেহশীল, আমার প্রতি ছিল প্রশ্রয়ও পরম ।

    দেখা গেল সকলেরই খিদে পেয়েছে চনচনে । প্লেনের খাবার ছিল যত্সামান্য, রাত্রের উড়ানে বুঝি কোনো মীলই ঠিক ফিট করে না । নানক বেচারা ঘুম থেকে উঠেই গাড়োয়ানিতে লেগেছেন, ব্রেকফাস্ট হয়নি, আর প্রীতীশ ও রঞ্জন তো বললেন কাল রাতেও ওঁদের খাওয়া হয়নি, এক সূক্ষণ বিশ্লেষণের তর্কেই পেট ভরেছিল ।

    গাড়ি থামল এক সরাইয়ের সামনে । চারপাশ প্রগাঢ় নিরঞ্জন, পুরু বরফের বালাপোষে ঢেকে গেছে চরাচর । সব কৌনিকতাই যেন মিলিয়ে গেছে সুডৌলে, বাড়িগুলোর তেরচা চাল থেকে নেমে এসেছে শুভ্র চাদর, মাটি ছঁংউই ছঁংউই । পা বসে যাচ্ছে পেলব তুষারে, মনও চলতে চায় না, ইচ্ছা হয় দাঁড়িয়ে থাকি অনন্তকাল, হিমমানব হয়ে মিশে যাই এই প্রকৃতির সঙ্গে । তবে উদরের ক্ষুধার মত বালাই অল্পই আছে, তাই পায়ে পায়ে ঢুকতেই হল সরাইয়ের মধ্যে । খুশি খুশি আলোয় চাঙ্গা করা কফির গন্ধ, তাওয়া গরম, নানা সুখাদ্য সাজানো । তেজী মাংসের স্যাণ্ডউইচ আর ধূমায়িত পানীয় নিয়ে বসা হল জানালার ধারে । মাঝে একটা কাঁচের অন্তরাল, তার ওদিকেই নিসর্গের অবলীলা । নেমে আসছে বরফ, ছেঁড়া ছেঁড়া চিন্তার মত, অবয়বহীন অস্তিত্ব শুধু, কক্ষপথটুকুই নিজস্ব, তারপরেই বিলীন পূর্বসূরীদের ভিড়ে । আকাশের বিভা যেন গা পেয়েছে, এই যে আলো সূর্য গ্রহে তারায়, ঝরে পড়ে শত লক্ষ ধারায় ।

    -- একটা বই লেখা যায়, কলকাতা, লণ্ডন আর নিউ-ইয়র্কের কাহিনী , বললেন রঞ্জন ।

    চমকে ফিরলাম বাস্তবে । ট্রায়াম্ভারেট আড্ডায় মশগুল, নানক শোনাচ্ছেন তাঁর প্রিয় শহরের স্মৃতি; আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাস আর তাঁর জীবনের কাহিনী নিয়ে এক সেমিনাল ওয়ার্ক লেখার তাল ওনার বহুদিনের । আমি বললাম, নাম দেওয়া যেতে পারে, দ্য টেল অফ থ্রি সিটিজ্‌ । প্রস্তাবটা আদর পেল, ডেডিকেশন না হলেও অ্যাকনলেজ্মেন্টে আমার নাম ঢোকাবেন আশ্বাস দিলেন নানক ।

    প্রাতরাশ সেরে বাইরে বেরোনো হল । সরাইয়ের পাশে খানিক খোলা জায়গায় মাঠ মতন, বিছিয়ে আছে বরফ, গালিচা ত্রক্রমশ পুরু হচ্ছে । আমি বললাম, একটু ওদিকে গেলে হয় না ? প্রীতীশ বললেন, হঁযা চল, আবার তো সেই সাতাশে ফের বরফ পড়বে, অতএব ফ্রেশ স্নো আর পাবে না ।

    আঁজলা ভরে বরফ তুলে খানিক গায়ে মাখলাম । ঠাণ্ডাটা সয়ে গেছে, আর কামড়াচ্ছে না । তাছাড়া রঞ্জনের দেওয়া কোটটাও দজ্জাল । একদম তাজা তুষার, নাকের কাছে এনে পেলাম নবজাতকের গন্ধ । মুঠোয়ে ভরে ঝুরো বরফ চেপে রেখে হাত খুলতেই দেখি জমে গেছে । রঞ্জন বললেন, রেজিলেশন । বরফ ঝাঁকিয়ে দেয় পাঁচটা ইন্দ্রিয়কেই, হয়ত ছ'টা, গভীর সেনস্যুয়স এক আবেদন । চতুর্দিকে সাদার সাম্রাজ্য, বিধাতা যেন সৃষ্টির উপর চুনকাম চালিয়েছেন । ক'বছর আগে প্রখ্যাত এক শিল্পী একগুচ্ছ ছবি এঁকে তার পরে সাদা রঙের পোঁচে সবই মুছে ফেলেন, উপরেরও আজ মনে হচ্ছে তেমনই খেয়াল । কিছুক্ষণ থেকে ভীষণ ভাল লাগা আর এক অদ্ভুত অস্বস্তি মনের এপিঠে ওপিঠে খেলে যাচ্ছিল । অলৌকিক অনুরাগে ভেসে যাচ্ছি, কিন্তু কোনো লাগসই গান বা কবিতার ছত্র মনে পড়ছে না, এমন তো হয় না । ভীমরতি কি ?

    অনেক হাত্ড়ে বের করলাম, শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকির ঐ ডালে ডালে -- ঠিক জমল না । তবে কি, একি মায়া লুকাও কায়া জীর্ণ শীতের সাজে ? উঁহু তাও তো নয় । তাহলে, উত্তরবায় জানায় শাসন, পাতল তপের শুষ্ক আসন, সাজ খসাবার এই লীলা কার অট্টরোলে ? না: হাল ছাড়তে হল । বাংলার শীত শুষ্ক শ্রমণ, সারা বছরের ফসল বিলাসী হাওয়ায় তখন বৈরাগ্যের বেহাগ, তুরীয় বসন্তের আগে ক্ষণিকের তপস্যা, প্রকৃতির তুলিগুলির বাত্সরিক বিশ্রাম । তাই বাংলার সহিত্যেও শীতের অবর্ণেই বর্ণনা । চোখের সামনে এ যে দৃশ্য আজ, হয়ত তার কোনো বাংলাকাব্যের দোসর নেই । হয়ত আছে, আমি জানি না । তেমন এই লঙ আইল্যাণ্ডের কোনো কবিই হয়ত কখনো লিখতে পারেননি, অশ্বথ পল্লবে, বৃষ্টি ঝরিয়া, মর্মর শব্দে, নিশীথের অনিদ্রা, দেয় যে ভরিয়া, মর্মর শব্দে; অথবা, দিকে দিকে সঘন মগন মত্ত প্রলাপে, প্লাবন ঢালা, শ্রাবণ ধারা পাতে, সেদিন তিমির নিবিড় রাতে । কারণ এ দেশের কবির বিনিদ্র রাত্রি ধুয়ে যায়নি গাঙ্গেয় বঙ্গদেশের অবিশ্রান্ত শ্রাবণ বর্ষণে । প্রতিটি রোমকূপের অবাধ অনুভবের ভিতর দিয়েই বোধহয় কবিতা আসে-যায়, তাই এ জিনিস টিভি দেখে সম্ভব নয়, রিয়ালিটি শো হলেও নয় !

    রঞ্জন বললেন. কেমন লাগছে ? তারপর মুখ দেখে বললেন, কোটেশন পাচ্ছ না ? কেন, এমারসনের স্নো স্টর্ম ?

    ত্রিত্রধণ্ণত্রবংরু ঢষ্‌ ছত্ৎ ঞশণ্ণস্‌ংঋংঞয ধী ঞচ্‌ং যূষ্‌
    শিশঠটংয ঞচ্‌ং যত্রধগ, ছত্ররু, রুশঠটঠত্রভ ধ'ংশ ঞচ্‌ং ংঈঠংত্রুয,
    নংংস্য ত্রধগচ্‌ংশং ঞধ ছত্ঠভচ্ঞ, ঞচ্‌ং গচ্ঠঞংরু ছঠশ
    ণঠরুংয চ্ঠত্ত্য ছত্ররু গধধরুয, ঞচ্‌ং শঠটংশয, ছত্ররু ঞচ্‌ং চ্‌ংছটংত্রয

    বা, লঙফেলোর ঐটা, নামটা যেন কি,

    নঠত্‌ংত্রঞ, ছত্ররু যধীঞ ছত্ররু যত্ধগ
    ঈংযবংত্ররুয ঞচ্‌ং যত্রধগ
    ণঠরুংয চ্ঠত্ত্য ছত্ররু গধধরুয, ঞচ্‌ং শঠটংশয, ছত্ররু ঞচ্‌ং চ্‌ংছটংত্রয

    এটা তো তোমাদের পাঠ্য ছিল ।

    আমি চমত্কৃত হয়ে বললাম, বা: আর পরমূহুর্তেই, পাঠ্য ? ঠিক মনে পড়ছে না...., আমাদের আগের বারে হয়ত কোয়েশ্চেন চলে এসেছিল ফাইনালে, তাই আর কি, মানে সাজেশন করে পড়তাম তো...।

    আমরা পৌঁছে গেছি লঙ আইল্যাণ্ডে, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের পূর্ব উপকূলের সঙ্গে লাগোয়া প্রলম্বিত দ্বীপ । নিউ ইয়র্ক শহর ছেড়ে এসেছি, ছিমছাম গ্রামীণ পরিবেশ, বেঁটে বেঁটে বাড়িগুলো, গাছপালা প্রচুর, সবই অবশ্য এখন তুহিনে ছয়লাপ । য়ুনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে রঞ্জনের আস্তানা, আরও খানিক দূরে, আবার গাড়ি চড়ে রওয়ানা হওয়া গেল । বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে নামিয়ে দিয়ে নানক চলে যাবেন ওঁর বাসা পোর্ট জেফারসনে, আবার কালকে আসবেন, এমনই কথা ছিল । তবে আমার ভাব বিহবল অবস্থা দেখে, স্টিয়ারিং ঘোরালেন, সব আপত্তি অনুযোগ উড়িয়ে দিয়ে সটান বাড়ির দোরে পৌঁছে তবে নিষ্কৃতি । অনেক মনের জোর করে গ্লাভ্স খুলে করমর্দন করলাম, আমার অনারে এমন রোভার হাঁকালেন বলে ধন্যবাদ দিতে গেলে বললেন, মাই প্লেশার ।

    ইঁটের পরে ইঁট গেঁথে দোতলা বাড়ি, ঢালু ছাদ, রঞ্জনের ডেরা দ্বিতলের ডানদিকের ফ্ল্যাট । চারটি কামরার আবাস, প্রত্যেকেটিতে এক একজন পড়ুয়া, রান্নাঘর ও বৈঠকখানা সাধারণী । রঞ্জনের সহ-আবাসিকদের মধ্যে একজন মার্কিন, দুজন প্রাচ্য এশীয় । এই মঙ্গোলীয়রা নাকি খুব সিরিয়াস টাইপের, হল্লা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না একদম । এঁদের মাঙ্গলিকতা মনে রেখে আমরা রেফার করতাম মার্সিয়ান বলে । এই অনুবাদী ক্রিপটিক্‌ কোড্‌ বোধহয় ত্রক্র্যাক করতে পারেননি ওনারা শেষ অবধি । করিডরের শেষে রঞ্জনের ঘর, চাবি ঘুরিয়ে খোলার সময় মনে হল বেশ চেষ্টা লাগছে, খানিক ঠেলাঠেলির পর খোলসা হল, ভিতরে বইয়ের বারোয়ারি ব্যাপার । ওঁরাই থাকেন ঘরে, রঞ্জন আশ্রিত মাত্র, আমাকে নতুন শরণার্থী দেখে পুস্তক ইউনিয়নে ঘোর উষ্মা, তাই দরজা আটকাচ্ছিলেন । মেঝে, সীলিং, দেওয়াল ও মধ্যবর্তী মহাকাশ পরিব্যাপ্ত করে কেবল কেতাব; রেকর্ড ও ক্যাসেটও কিছু আছেন । গাউসের সাথে গ্রীনের, ম্যাক্সওয়েলের সাথে মোত্জার্টের, রাসেলের সাথে রবিবাবুর, সে এক এক অমর্ত্য আলাপ । রঞ্জন বললেন, একটু অসুবিধা হবে, গোছানো হচ্ছে না .....। আমি বললাম, আরে না না ! এত অনেক জায়গা, আর আমি তো প্রায় অশরীরী । ব্যাগ নামিয়ে রেখে বৈঠকখানায় বসা হল, পরিকল্পনার পালা ।

    রঞ্জনের কিছু কাজ আছে ডিপার্টমেন্টে, ছুটির আগে আজই শেষ দিন, একবার যেতে হবে । কাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, এখনই ঘুরে দেখে নেওয়া যাক । অতএব ক্যুইক মার্চ । তবে আগে একটা ফোন সেরে নিতে হবে । এক সম্পর্কীয় দাদা আছেন নিউ জার্সিতে, একটু তত্ত্ব তল্লাশ নেওয়া যাক ।

    -- হ্যালো সাগরদা, আমি নন্দন বলছি ....।
    -- আরে, নন্দন, কোথ্থেকে ?
    -- এই একটু আপিসের কাজে ফিনিক্স এসেছি, এখন রঞ্জনের কাছে, লঙ আইল যাণ্ডে ।
    -- অফিসের কাজে মানে, তোর অফিস ? তুই আবার কাজ করছিস নাকি, সেদিনের ছেলে ....?
    -- না মানে এই সফটওঅ্যার নিয়ে রগড়ানো আর কি, সেই থ্রুতেই ...।
    -- কোন অফিস, কবে এসেছিস, কতদিন থাকবি ?
    -- ...
    ফ্যাক্টস্গুলো নিয়ে এবার ফিগারের দিকে গেলেন সাগরদা ।
    -- সর্ট টার্ম মানে পার ডিয়েম দিচ্ছে তো ডলারে, কত ?
    -- ......
    -- বাবা: ভালই দিচ্ছে তো, রোজই দেয় ?
    -- হঁযা মানে পার ডিয়েম যখন, বাই ডেফেনিশন, প্রতিদিনই তো....।
    -- না মানে বলছি, ছুটির দিনেও দেয় ? এই যে লীভ নিয়ে এসেছিস ক্রিস্টমাসের সঙ্গে জুড়ে ... আর য়ুইকেণ্ডও তো নন-ওয়ার্কিং.. দেয় ?
    -- আশা তো করছি । তারপর বল, টুপসি কত বড় হল, স্কুল যাচ্ছে এখন ? রানীবৌদি ভাল তো ?
    -- হঁযা হঁযা ভাল ভাল । আর তোর রুপি স্যালারিটা কি দেশেই জমা হচ্ছে ব্যাঙ্কে, পুরোটাই ....?
    -- তেমনই তো ভরসা, গিয়ে স্টেটমেন্ট মিলিয়ে তবে কনফার্মড হব । তুমি কখন বেরোও আপিসে ?
    -- আরেব্বাস, পার ডিয়েম প্লাস স্যালারি, তোর তো দারুণ সেভিংস হয়ে যাবে না এ ক-মাসে !

    এ উক্তিটা বুঝলাম সলিলোক্যুয়ে গোত্রের, উত্তরের ধরতাই লাগে না । তারপরে খানিক্ষণ অবান্তর কিছু কথা হল, মাঝে সাগরদা জিজ্ঞেস করলেন গাড়ি ভাড়ার খরচ আর পেট্রোলের খরচও কোম্পানি দেয় কিনা । শেষে বললেন ঐ গণ্ডগ্রামে পড়ে না থেকে নিউ ইয়র্ক শহরটা ভাল করে ঘুরতে, আর ওঁদের বাড়ি আসতে । আমি বললাম, নিশ্চয়ই । ফোন রাখতে রঞ্জন বললেন, হয়েছে ? চল এবার ।

    সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটা মেজাজ থাকে একইরকম, ইঁটকাঠপাথরগুলো বুড়িয়ে যায়, কিন্তু আমেজটা সেই নতুনের । ক্যাম্পাসও আদি অকৃত্রিম, হন্ত দন্ত যাওয়া আসা, ক্রিং ক্রিং সাইকেল, গাছের তলায় জটলা, কোনের সঘন মিতালি, ডিপার্টমেন্টে নোটিশ, বিশ্ববিদ্যার তীর্থ প্রাঙ্গন কর মহোজ্বল আজ হে । বয়সের হিসেবে এ য়ুনিভার্সিটি নবীন, বিংশ শতকের মাঝামাঝি প্রতিষ্ঠা, তবে প্রসিদ্ধি প্রচুর । বাড়িগুলোর মধ্যে কারুকার্য, জাঁকজমকের বালাই নেই, স্থাপত্য নেহাতই অকুলীন । সবকটা বিভাগীয় বাড়ি একই রকম, কয়েকতলা অফিস বিলডিং'এর ছিরি ছাঁদ । মাঝে রাস্তাগুলো সোজা সোজা, ছোট ছোট মাঠ ছড়িয়ে আছে এদিক ওদিক । বরফ পড়া একটু বিরত, আকাশ কিন্তু জমাট বেঁধে আছে । ক্যাম্পাসের ভিড় পাতলা, ছুটিতে বেরিয়ে পড়েছেন অনেকেই । শেষ দিনের রেজাল্টের আশায় কয়েকটি উত্কন্ঠী মুখ এধারে ওধারে ।

    বিশুদ্ধ গণিত বিভাগের চারতলায় রঞ্জন ওঁর আপিসে নিয়ে গেলেন । চৌকো কামরা, একটা দেওয়াল জুড়ে পুরোটাই কাঁচের জানালা । বাইরে একটা বিরাট গাছ ডালপালা ছড়িয়ে আছে, প্রতিটি ডালে প্রতিটি পাতায় তুহিন তুলির পোঁচ । নীচের প্রাঙ্গনের বরফে অসংখ্য পদচারণের স্মৃতি, যেন এক বিরাট হাতের ভাগ্যরেখা । প্রকোষ্ঠের একটা দেওয়ালে ঢোকার দরজা, আরেক দেওয়ালে জানালা, অন্য দুটো দেওয়ালের দখলে দিগন্তদিশারি ব্ল্যাকবোর্ড । অক্ষৌহিনী চকের আঁচড়, সংখ্যা, সমীকরণ আর সারণি, মাঝেমধ্যে অতীন্দ্রিয় সব আঁক । এসবের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছি দেখে রঞ্জন বললেন একটা বিদ্ঘুটে ডায়্যাগ্রাম দেখিয়ে, বুঝতে পারছ তো, একটা রেডিয়াস ভেক্টর অ্যান্টিক্লকওয়াইস ঘুরছে, তারই প্রজেক্সন এক্স অ্যাক্সিসে ....। আমি বললাম, থাক থাক, কেউ বলে ভাই এক হাঁটু জল, কেউ বলে সাঁতার । রঞ্জনের টেবিল জানালার সামনে, স্তূপাকৃত বই, দরজার পাশের বেঁটে তাকও তথৈবচ, একটা সোফা-কাম-বেড, মাঝখানটা দেবে গেছে, কোনো দুর্মর বইয়ের বেগে হবে । রঞ্জন বললেন, দেরি হয়ে গেলে এখানেই শুয়ে পড়ি । রঞ্জনের গবেষণার কথা ভেবে বললাম, তোমার ল্যাব কোনদিকে ? রঞ্জন বললেন, কেন, এটাই তো । ব্ল্যাকবোডর্গুলো পুনরায় দেখে ভুল ভাঙল, নিজের মূঢ়তায় লজ্জা পেলাম । বিশুদ্ধ গণিত নিরালম্ব, তার সিদ্ধি চিন্তায়; পিপেট-ব্যুরেটের বরজে তার সন্ধান নয় ।

    রঞ্জনের কয়েকটা খাতা দেখা বাকি ছিল কিছু, আজ দুপুরের মধ্যেই নম্বর জমা দিতে হবে । ওঁকে টেবিলে ঝঁংউকিয়ে রেখে প্রীতীশ এবং আমি একটু ঘুরে নিলাম চারপাশে । প্রীতীশ অল্প কথার মানুষ, তবে ওঁর এককথায় দশকথার রণন । গল্প করতে মস্তিষ্কের এক্সার্সাইজ হয়ে যায় । বললেন প্রতিদিনই রঞ্জনের সঙ্গে ফোন হয়, ঘন্টার পর ঘন্টা, একটা সমস্যা নিয়ে বিতণ্ডা চলছে তো চলছেই, গাণিতিক । আমি বললাম, আরেব্বাস । পায়ে পায়ে একতলায় এলাম, এক কোণের দিকে কম্প্যুটার ল্যাব, কেমন যেন অন্ত্যজ চেহারা । চেনা পরিচিত পরিবেশ দেখে ভাল লাগল, কিন্তু সকলের দেখি অবজ্ঞা; যন্ত্রগণকের সমাদর নেই গণিতের ডেরায় । রঞ্জন খাতা দেখে নম্বর বসিয়ে নেমে এলেন, লবিতে আসতেই এক গাদা ছেলে মেয়ে ঘিরে ধরল, হ্যাভ আই পাস্ড গোছের প্রশ্নের ফুলঝুরি । রঞ্জনের বরাভয়ের বিভঙ্গে সকলেই খুশি, এক তরুণী বললেন, ইউ আর এয গুড ম্যান । দপ্তরে নম্বর জমা দিয়ে রঞ্জন বললেন, যাক ! এ সেমেস্টারের মত কাজ নামল, সামনে ছুটি ।

    দুপুরের লাঞ্চ খাওয়া হল ক্যান্টিনে । নুড্লময় স্যুপ, অনেকটা থুকপা ধরনের, সঙ্গে ব্রাউন ব্রেড । রঞ্জন ইচ্ছা, এবার হাঁটতে বেরোব । খেয়েই যাওয়া হল ক্যান্টিনের পাশেই য়ুনিভার্সিটি বুক শপে । নানা বইয়ের সমাহার, পাঠ্য ও অতিপাঠ্য । মার্ক টোয়েনের পায়ে হেঁটে কন্টিনেন্ট বেড়ানোর গল্প, ট্র্যাম্প এযব্রড, হাতে নিয়ে উল্টোলাম, তারপরে পাল্টে ব্যাক কভারে দাম দেখে রেখে দিলাম, পরে আফশোস হয়েছিল খুব । রঞ্জন বললেন, তুমি লিখে ফেল একটা, এই আমেরিকা ভ্রমণ । সেই যে ঢুকল মাথায় পোকা ।

    রঞ্জনের ভীষণ ইচ্ছা, য়ুনিভার্সিটির প্রধান পাঠাগার দেখাবেন আমাকে । ছ'তলা বাড়ি, বইয়ের যেন অতলান্ত । কি বই নেই সেখানে ? সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, অধ্যাত্ম, মানুষের মননের সব শাখায় ছুটেছে পুস্তক রথ, দেশ-কালের বেড়া ভেঙে । পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা, তাক থেকে বই পেড়ে বেঞ্চিতে বসে যাও, মাদুলি, পৈতে বের করে বনাফাইড স্টুডেন্ট প্রমাণ করতে হবে না । জে সি ঘোষের "বেঙ্গলি লিটারেচর", অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৪৮'র প্রকাশ, কোনোদিন শুনিনি, নেড়ে চেড়ে দেখলাম । অমিয় চক্রবর্তীর, "এ টেগোর রীডার", বীকন প্রেস, ১৯৬১'তে প্রকাশিত; শুনেছিলাম, এই প্রথম হাতে নিলাম । বইগুলো চেহারায় ওয়েল থাম্ব্ড কপিজ, শুধুই শোভা বর্ধন করেছে না । এ ছাড়া বাঙালির চিন্তন ও কৃষ্টির উপর পরিচিত আরও বহু বই, চর্চার সযত্ন অপেক্ষায় । পি জি উডহাউসের তাকে গিয়ে ছিটকে চলে এলাম, কি লাভ মায়া বাড়িয়ে ? এমন একটা লাইব্রেরী কাছে থাকলে ইণ্ডাকশনেই বোধহয় হয়ে যায় বহু কিছু, ঘর্ষণ গায়ে লাগে না । ভিডিও ক্যাসেট সেকশনে সত্যজিৎ রায়ের প্রায় সবকটি ছবি, আরও অনেক জগত্খ্যাত টাইটেল । প্রত্যেক বিভাগেই মিষ্টি পরিচারিকা, কোনো ছাত্রী হয়ত পার্ট-টাইম কাজ করছেন, সব প্রশ্নেরই উত্তর প্রস্তুত, বিশেষ বইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে, হলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত উজিয়ে এসে নিজেই বার করে দেবেন । এ জিনিস চোখের দেখায় হয় না, অনেক্ষণ থাকতে হয়, একেবারে থেকে গেলেই ভাল । সময় অল্প, অনেক দেখা বাকি, অগত্যা বেরোতেই হল ।

    ঠিক হল হেঁটে যাওয়া হবে পাশের গ্রাম সিট'অ'কেটে । ভীষণ দর্শণীয় কিছু নেই, তবে রঞ্জন বললেন দেখাবেন ওঁর প্রিয় জায়গা কয়েকটি । প্রীতীশ বললেন, ফেরার সময় ঠাণ্ডা হবে কিন্তু !

    হাঁটতে শুরু করলাম আমরা তিনজন, ক্লান্ত ঘড়িতে বিকেল, কিন্তু সারাদিনই একটা ফ্যাকাসে আলো, প্রহর ঠাহর হয় না । য়ুনিভার্সিটির গাঁ ছাড়িয়ে মাইল কয়েক পথ, পিচ ঢালা রাস্তার পাশে ফুটপাথ ধরে চলেছি, জুতোর নীচে ডেলা বরফ ঝুরো হয়ে যাচ্ছে । রঞ্জন চলেছেন পথিকৃত, ওনার গতির সাথে তাল রাখা দায়, প্রীতীশ ও আমি খানিক তফাতে । এবার তেড়ে বরফ পড়া শুরু হল । রঞ্জন জিজ্ঞাসেন, ফিরে যাবে ? আমি বললাম, না না, দারুণ লাগছে । দারুণ লাগছিলও, ঠিক যেন লেডিবার্ডের বইগুলোর পাতা থেকে উঠে আসা ছবি, এপাশে ওপাশে ছোট ছোট কুটির, ঘন বন, মেদুর বরফে ঢাকা চারপাশ, এক্ষুণি রেন ডিয়ার টানা স্লেজ চড়ে বেরিয়ে আসবেন স্যান্টা ক্লজ । ঠাণ্ডা তেমন লাগছে না, হাঁটছি বলেই বোধহয়, বরফের কুচি গা বেয়ে নেমে যাচ্ছে, কিছু লেগে থাকছে, ঝাড়লেই পড়ে যায় । একটা ফটকের মধ্যে ঢুকলাম, ম্যানসন ধরনের বাড়ি, জানালায় আমন্ত্রণী আলো । রঞ্জন বললেন, দেখবে এসো । সাইনবোর্ডে লেখা সিট'অ'কেট পাব্লিক লাইব্রেরি ।

    এখানেও এলাহি ব্যবস্থা, দেড়তলা জুড়ে দেওয়ালজোড়া মজবুত কাঠের তাকে ঠাসা বই, চামড়ার গদি আঁটা আরাম-কেদারায় ইতস্তত ছড়ানো নিবিষ্ট পাঠক । উজ্জ্বল বাতি, ঝকমকে মেঝে, তাজা উষ্ণতায় এক ভীষণ আরামী আয়োজন । দেখে অবাক লাগল, এমন গণ্ডগ্রামে এই সুযোগ, আর এমন দুর্যোগ ঠেলে এত পুস্তকপিপাসু । রঞ্জন বললেন, মাঝে মাঝেই এখানে চলে আসি, বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে । প্রীতীশও বললেন কয়েকবার এসেছেন বন্ধুর সঙ্গে ।

    সাধারণ পাঠাগারের ফটক থেকে বেরিয়ে ধরলাম আঁকাবাঁকা রাস্তা, রাজপথ ছেড়ে এসে । আশেপাশে কাঠের বাড়িগুলোর গেটের ফলকে কয়েকশো বছর আগের সন তারিখ । এ অঞ্চল খুবই পুরোনো মনে হল, পিলগ্রিম ফাদারদের সমসাময়িক অনেক ভিটে চোখে পড়ল । কেউ থাকেন বলে মনে হয় না, তবু সযত্নে রক্ষিত । অতীতের ভার নগণ্য বলেই হয়ত, ইতিহাসের প্রতি মার্কিনদের গভীর শ্রদ্ধা, খানিকটা ভয়ও বোধহয় । কালের এমন সব হিসেব চারিদিকে লেবেলে লটকানো, আমাদের ওদিকে সেগুলো খেলো বর্তমানের কোঠায় পড়ে যায় । বাড়িগুলো বেশ রোম্যান্টিক, সেই তবে থেকে দাঁড়িয়ে আছে, আমেরিকা যখন বর্বর-পরাকীর্ণ নিউ ওয়ার্ল্ড সবে ।

    একটা বাঁকে এসে দাঁড়ালেন রঞ্জন, পাঁচিল ঘেরা প্রাঙ্গণ; বললেন, এইখানে গত শীতে পায়চারি করতাম খুব । বহু পুরাতন গোরস্থান একটা, এখন আর ব্যবহার হয় না -- অসংখ্য ছোট বড় সমাধিসৌধ, এদেরই বোধহয় বলে ওবেলিস্ক । বরফে ঢাকা স্তম্ভ সব যেন জেগে আছে সাগরের মাঝে ডুবো পাহাড়ের চূড়ো । তুষারপাত তীব্রতর হচ্ছে, অজস্র কণা অনায়াস আলস্যে নেমে আসছে শূন্য থেকে । হঠাৎ মনে হল, বরফ পড়ারও একটা শব্দ আছে, কান আর মন দুইই পাততে হয়, অশ্রুত সেই তালে বাজে করতালি পল্লবপুঞ্জে । সেন্সিটিভিটির চরমে পৌঁছলে তবেই না লেখা যায়, হুড়মুড় ধুপধাপ -- ও কি শুনি ভাইরে / দেখছ না হিম পড়ে -- যেওনাকো বাইরে । আমরা ত্রিমূর্তি দাঁড়িয়ে আছি কত অনাদি জীবনের স্মৃতির সামনে, পৃথিবীর সব ঘড়ি থেমে গেছে, সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী - ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন । মহাকাল ভরে দিচ্ছে এক অবশ আশ্লেষ । এই নির্লিপ্তির মাঝে জেগে উঠছিল এক অকথ্য সৌকর্ষ, জীবন আর মৃত্যুর মাঝে ফাঁকটুকু যেন ভরাট হয়ে উঠছে । সমাহিত শব্দটি যে এমন ঔপলব্ধিক তা আগে বুঝিনি; শান্তি নিরাময়, কান্তি সুনন্দন, সান্ত্বন অন্তবিহীন আর শুধুই গানের লাইন রইল না । ঐ বরফাকীর্ণ সমাধিস্থলের সামনে সেই কয়েক মিনিটের অনন্ত অপেক্ষা, ভাবলে আজও গায়ে কাঁটা দেয় । মনে হচ্ছিল, বেঁচে থাকার ঘোড়দৌড়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এক পাশে শুয়ে পড়লেই হয় ।

    কিন্তু চরৈবেতি চাবকে চলেছে অবিরত, অতএব চলতেই হল । সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে এসেছে, বরফের ধারাপাতও অব্যাহত । পায়ের পাতায় হিমশীতল স্পর্শ, জুতো ফঁংউড়ে । প্রীতীশ বললেন, ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে কিন্তু, অগত্যা প্রত্যাবর্তন । তবে রাত্রের খাওয়া কি হবে ? রঞ্জনের প্ল্যান, আমার আগমনার্থে বড়বহরের সেলিব্রেশন, আমাদেরও আপত্তি নেই । খানিক দূরে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরস'এ যাওয়া হল, চর্ব্য ও পেয়ের সন্ধানে । নানা পশুপাখি, আস্ত ও আংশিক ঝুলছে ঝলসানো । তোলা হল কয়েকটা । প্রীতীশ বললেন স্বাস্থ্যপানটা আমার ডিপার্টমেন্ট । বেঁটে, লম্বা আধারে সোমরসও উঠল বিস্তর ।

    আগামী ব্রেকফাস্টের কথা ভেবে আরও কিছু টুকিটাকি নেওয়া হল । এবারে ফেরার পালা, তবে এবার হেঁটে নয় । টেলিফোন করে খানিক পীড়াপিড়ি করতে ট্যাক্সি এসে গেল, চালকের খুস মেজাজ, বুশ শার্ট পরে আপেল খাচ্ছেন । ফেরা বরফ ভেঙে ভেঙে, কয়েক ইঞ্চি আস্তরণে গাড়ির চাকা বসে যাচ্ছিল । ওয়াইপার চালিয়ে সামনের স্ক্রীন থেকে ঝুরো বরফ সরানোও চলছিল । রঞ্জন উত্সাহে ফুটছেন, বললেন, বাসায় ফিরে হল্লা হবে । প্রীতীশ বললেন, মার্সিয়ানরা আপত্তি করবেন না তো ?

    প্রকৃতির এয়ার কণ্ডিশনার থেকে আবার সেন্ট্রাল হীটিং'এর তাঁবে ফিরে স্বস্তি এল, শক্তিও । এখন আর দেরি নয়, বলে সকলেই হাতে হাতে ধরে ফেললাম । প্রীতীশ কার্ভিং করতে লাগলেন, সে এক শিল্প । আমি বোতলের ছিপি নিয়ে বেকায়দায় দেখে প্রীতীশ বললেন, ওটার একটা টেকনিক আছে । রঞ্জন অন্যান্য আয়োজনে লিপ্ত । খানিক্ষণের মধ্যেই আমরা শুরু করলাম, আজকের সন্নিবেশ থেকে শুরু করে বিশ্বশান্তি অবধি সবেরই স্বাস্থ্য কামনা হল । আমি বললাম, একটা ছবি তুলি । গেলাস ইত্যাদি প্রমাণ অন্তর্হিত করে নেওয়া হল ফটো, যাতে দিদিমা ও অন্যান্যদের দেখানো যায় দেশে । সেদিনের সংগতের শেষটা আমার ঠিক মনে নেই, ঢলে বা টলে গিয়েছিলাম হবে । পরে শুনেছিলাম, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, এবং পড়ার ঠিক আগে, স্টার স্প্যাঙ্গেলড ব্যানার গেয়েছিলাম, উঠ গো ভারত লক্ষ্মী'র ধুনে ।

    পরদিন ঘুম ভাঙতে দেখি নীরদবাবুর দাই হ্যাণ্ড গ্রেট অ্যানার্ক মাথায় শুয়ে আছি । শক্ত বই, ঘাড়টা ব্যাথা করছিল, ঘোরাতে গিয়ে জানালায় চোখ পড়ল । আকাশ নি:শেষে নীল, শিশু সূর্য তেজ শানাচ্ছে বরফের আয়নায়, চারিদিকে যেন আলোর অলিম্পিক, পৃথিবীতে কোথাও কিছু কম পড়েছে বলে মনে হয় না । প্রীতীশ, রঞ্জন দুজনেই প্রস্তুত, বললেন, তৈরি হয়ে নাও । প্রাতরাশের সময় গতরাতের পাখিটার সত্কার সম্পূর্ণ হল, প্ল্যান ভাঁজাও । নিউ ইয়র্ক শহর দেখে আসা যেতে পারে, ট্রেনে ঘন্টাখানেক একপিঠ । আমি বললাম, কাল যাব । অতএব ঠিক হল গন্তব্য পোর্ট জেফারসন, ছোট্ট বন্দর গাঁ । একটা নাকি দারুণ বইয়ের ডেরাও আছে ।

    য়ুনিভার্সিটি থেকে মাইল সাতেকের রাস্তা, কালকের পথ বেয়েই । তবে আজ হাঁটা হবে না, সারা দিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় লাগবে । ট্রেনে যাওয়া হবে, নিউ ইয়র্ক থেকে শাখা লাইন পোর্ট জেফারসন অবধি যায়, কাছেই স্টেশন আছে । আমার উত্সাহ খুব, আমেরিকাতে ট্রেনে চাপবার তাল অনেকদিনের ।

    বাইরে বেরিযে হাঁটতে দারুণ লাগল । ঝকমকে রোদ্দুর বরফে ঠিকরে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়, দৃষ্টিপথ স্ফটিকের মত স্বচ্ছ, দশ মাইল দূরেও চোখ চলে অবাধে । বরফ নতুনই এখনো, তবে নতুন করে পড়ছে না আর, গলতেও শুরু করেনি, প্রকৃতির নাটমন্দিরে ক্ষণিকের বিরতি, একটু জিরিয়ে নিচ্ছেন যেন কুশীলবরা ।

    ..চোখে চেয়ে রইলাম দূরের প্রান্তে, রোদ পড়ছে তেরচাভাবে, আকাশ আর
    পৃথিবী মিলেছে সেখানে অলীক আলোর মোহনায় ।
    রঞ্জন বললেন, একটু ঘুরে যাই, দারুণ একটা জিনিস দেখাব । ক্যাম্পাসের পিছন দিক দিয়ে বেরোনো হল, একটু এগিয়ে গিয়ে কিছু গাছের জটলা, কাছে আসতে দেখি ছায়া কেমন ঝলসানো, অনেকটা জায়গা জুড়ে মাটিতে যেন সিসের প্রলেপ, সূর্যের ছোঁওয়ায় উঠছে অসহ্য বিচ্ছুরণ । তার ওপরে নির্ভার স্বাচ্ছন্দ্যে খেলে বেড়াচ্ছে একঝাঁক পাখি, হেঁটে হেঁটে । এক ছুটে পাখিদের দলে ভিড়তে গিয়ে চৈতন্য হল, অঘটনের আগেই সামনে নিলাম, না'হলে দুর্যোধনের ইন্দ্রপ্রস্থে নাকালের মত হত । ছোট্ট হ্রদ, ওপরতলার জল জমে জমাট , তবে বিহঙ্গের ভারটুকুই বইতে পারে খালি, মানুষের তো অনেক বোঝা । খানিক্ষণ মোহিত চোখে চেয়ে রইলাম দূরের প্রান্তে, রোদ পড়ছে তেরচাভাবে, আকাশ আর পৃথিবী মিলেছে সেখানে অলীক আলোর মোহনায় ।

    দূর থেকে দেখে চিনতে পারলাম স্টেশনটাকে, ছোট্ট গুমটি, লাল টালির ছাত উঁকি মারছে বরফের ফাঁক ফোকরে, দুটো প্ল্যাটফর্মই শুনশান । তবে ব্যবস্থা নিখঁংউত, ওভারব্রীজ পর্য্যন্ত আছে । একটা ক্ষীণ ঝিককিঝক শোনা যাচ্ছিল কিন্তু কেউই আমল দিইনি, ওভারব্রীজ পেরোতে গিয়ে দেখি ট্রেন তলায় এসে গেছে । টিনটিনীয় কায়দায় রেলগাড়ির মাথায় টুপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ার ছক কষছিলাম তবে টাইমিং গড়বড়ের ভয়ে গা ভাসালাম না । আমাদের ফেলেই ট্রেনটা চলে গেল, দুদণ্ড সবুর করলে বিশ্বব্যবস্থার কোনো বড়সড় গোলযোগ হত না, তবু করল না । ট্রেন ফেল করা যে একটা স্পিরিচ্যুয়াল এক্সপিরিয়েন্স, টের পেলাম এবার । ঠিক হল, কুছ পরোয়া নেই, ট্যাক্সি করেই যাব ।

    পোর্ট জেফারসন ক্ষুদ্র জনপদ, তবে প্রাচীন বেশ । নামটা বোধকরি মার্কিন সংবিধানের পিতৃব্য তথা চতুর্থ কি পঞ্চম রাষ্ট্রপতির স্মৃতিতে । জাহাজঘাটায় কয়েকটা স্টিমার, পরিচ্ছন্ন জেটি, অল্প কয়েকজন অপেক্ষমান যাত্রী । রঞ্জন বললেন এখান থেকে জাহাজ চেপে কয়েকবার কনেকটিকট্‌ গেছেন ওদিকের আমন্ত্রণে । জলের ধারে হাওয়ায় ছুরি, বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না ।

    বন্দর ছেড়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকলাম, সারি সারি ছোট ছোট কটেজ বেড় দিয়েছে আঁকাবাঁকা পথ । সব বাড়ির সামনেটাতে বাগান, ঘাস পাতার গায়ে সাদার প্রলেপ । মানুষজন চলছেন ফিরছেন এলানো ছন্দে, তড়িৎ ত্বরার লেশমাত্র নেই । আমেরিকার যে ছবি ফিনিক্স বা নাগরিক নিউ-ইয়র্কে দেখলাম, তার সাথে মেলানো যায় না কোনোভাবেই, আশ্চর্য হলাম দেখে, একটাও দ্রুত খাদ্যের গাঁট নেই যেদিকে দুচোখ যায়, নেই কোনো পেল্লায় বিভাগীয় হাট'ও । লঙ আইল্যাণ্ডের এই অঞ্চলটায় য়ুরোপীয় মফস্বলের গন্ধ এখনো লেগে আছে ভরপুর, তবে জানি না য়ুরোপেও এখন এমনটা আছে কিনা, আমার বিদ্যা তো লেডিবার্ডের ছবি দেখে । রাস্তায় খানিক চলে ফিরে একটা সুন্দর স্বস্তি মনে এল । বাইরের জগতের সাথে পোর্ট জেফারসনের সংযোগ শুধুই ঐ জাহাজঘাটা, সেখানেও জলের ঢেউ মৃদুমন্দ । কে বলবে এত কাছেই নিউ-ইয়র্ক শহর, অভ্রভেদী কীতিতে তেজীয়ান । বন্দরের ঠিক আগায় নানকের আস্তানা, একবার হানা দেওয়া হল, মূর্তিমান বাড়ি নেই । রঞ্জন বললেন, এবার চলো ঐ বইয়ের দোকানটাতে ।

    খানিক অলি গলি ঠেঙিয়ে পৌঁছলাম -- দ্য গুড টাইম্স্‌ বুক শ্যপ, সাইনবোর্ডের নামের নীচে ভণিতা, টু ফ্লোর্স্‌ অফ স্কলারলি, স্কেয়ার্স এযণ্ড আউট অফ প্রিন্ট বুক্স । ঢুকে দেখি ধুন্ধুমার ব্যাপার, ছোট্ট দোকান, তবে চারপাশ থই থই । মেঝের কয়েকটা সর্পিল পথ বাদ দিলে বইয়ের বিরাম নেই । নীচের পাতালকুঠুরিও তদ্রুপ । মালিক এক দম্পতি, আলাপ হল, রঞ্জনকে দেখিয়ে বললেন, হি কাম্স ভেরি অফেন । কিছু বই নতুন, বেশির ভাগই পুরোনো, দামেও মোহিনী ছাড় । বিষয়ের নিরিখে সুন্দর বিন্যাস । দম্পতি মনে হল শুধু বই-ব্যবসায়ী নন, পুস্তক-প্রেমীও । নতুন আগত বই সোত্সাহে দেখালেন, আহূত কিছুর ফিরিস্তিও দিলেন । খানিক তফাতে ছোট ছোট টুল রাখা, কয়েকটা বই হাতে নিয়ে বসে যাওয়া যায়, তাগাদা মারার লোক এঁরা নন । ভেবে অবাক লাগল এমন প্রত্যন্ত জায়গায় দোকান দিয়েছেন এতদিন হল, চলছে নিশ্চয়ই, নইলে তো মার্কেট ইকনমি সাবাড় করে দিত । আশেপাশে উত্সাহী পাঠক ক্রেতা আছেন তাহলে, সবাই তো আর এক পৃথিবী উজিয়ে আসছেন না ।

    বই নাড়াচাড়া চলল অনেক্ষণ । এবার সংযমে কুলালো না, কয়েকটা কিনেই ফেললাম, বোঝার ওজন বাড়ল বেশ; আস্তে করে গেয়ে নিলাম, তুমি যত ভার দিয়েছো সে ভার করিয়া দিয়েছো সোজা, আমি যত ভার ইত্যাদি । সুদূর ইণ্ডিয়া থেকে ফিনিক্স ও নিউ ইয়র্ক হয়ে ওঁদের দোকান দেখে গেলাম বলে দম্পতি প্রীত হলেন খুব, আবার আসতে বললেন । দুপুরে খেয়েছিলাম একটা ছোট্ট রেস্তোংআর্‌ঁতে, স্যালমন মাছ ভাজা ও আনুষঙ্গিক । মাছের স্বাদটা অনেকটা ইলিশের কথা মনে করিয়ে দেয় । রাত্রে বাড়ি ফিরে অনেক্ষণ ধরে চলল বইয়ের নাড়াচাড়া, প্রীতীশ ও রঞ্জনও কিনেছিলেন বেশ কয়েকটি করে । একে অপরকে স্মারক উপহারও দেওয়া হল বই, গ্রহীতার পছন্দ মত । ডিনার য়ুনিভার্সিটির ক্যান্টিনের গরুর ঝোল ও ভাত । নানকের সঙ্গে ফোনে কথা হল, আগামীকাল সকালে আসবেন বললেন, আক্ষেপও করলেন আমরা গিয়ে ফিরে আসাতে, জানালেন, আই হ্যাড বীন টু দ্য সিটি ।

    পরদিন ভোর ভোর নানক ল্যাণ্ড রোভার চড়ে হাজির । প্ল্যানের পালা আবার । নিউ ইয়র্ক শহর দেখা যাক তবে ? আমি বললাম, থাক কাল যাব । অগত্যা ঠিক হল আজ যাওয়া হবে অ্যাটল্যান্টিক উপকূলে । এ অঞ্চল চেটোর মত চেনা নানকের, এমন সব রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন, নিসর্গের বহর ও বাহার যেখানে বেশি । দাঁড়ানো হল আরেকটা জলাশয়ের সামনে, বরফে জমা, পাখির মেলা জমাট আস্তরণের উপরে । প্রকৃতির পরম বিস্ময়, জল হিসেবে জলের ঘনত্ব, সবথেকে বেশি চার ডিগ্রি সেলসিয়েসে, তাই তো জলের প্রাণীরা বাঁচতে পারে, ওপরটাই শুধু বরফ হয়ে যায়; শিখেছিলাম সেই স্কুলে । নানক বললেন এই হ্রদের সাথে নাকি অ্যাটল্যান্টিকের তলে তলে সাঁট আছে, জল তাই নোনা । আঁজলায় তুলে চাখার জো নেই, চেটে দেখারও সাহস হল না, বিশ্বাসই করলাম ।

    ঘন্টাখানেকের মত চলা হয়েছে, নানক অনায়াসে গল্প আর গাড়ি চালাচ্ছেন, মাঝে মধ্যে নতুন ক্যাসেট চড়াচ্ছেন টেপে । বাড়ি ঘর কমে এসেছে, গাছপালাও ছাড়াছাড়া, সমুদ্রের সোঁদা গন্ধ নাকে আসছে মাঝে মধ্যে । দূর থেকে দেখা গেল একটা লাইটহাউস, নানক বললেন, এসে গেছি । লাইটহাউসের পাদদেশে গাড়ি থামিয়ে নামা হল, মনটওক পয়েন্ট, নিউ ইয়র্ক রাজ্যের পূর্বতম বিন্দু । লাইটহাউস একটা উঁচু পাড়ের উপর, গাড়ি রাখার জায়গা থেকে এই পাড়ের মাথা পেরিয়ে দেখা যায় না । সিঁড়ি ভেঙে পাড়ে উঠেই ছেয়ে ফেলল অতলান্ত ।

    দিকচক্রবাল ব্যেপে জলরাশি, হাওয়া যেন কুঠারের ফলা । ঠাণ্ডা ভীষণ, তবে শব্দ কই ? পুরীর সমুদ্রের যে বজ্রনির্ঘোষ চমকে দেয়, তেমন তো কিছুই নেই । শান্ত জল, ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ ভাঙছে পাড়ের পাথুরে বেলাভূমিতে, বালি প্রায় নেই বললেই চলে, বীচের বালাই নেই । জলের রঙ গাঢ় গম্ভীর নীল, হারানো অতলান্তিসের কত রহস্য হজম হয়ে আছে । অতলান্তিকের সাথে এই প্রথম সাক্ষাৎ আমি ভেবেছিলাম বেশ গমগমে ব্যাপার হবে, ঐ সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বাজল ভেরি টাইপের । তবে অতলান্ত সমীহ জাগালো শব্দে নয়, নৈশব্দ্যে । য়ুরোপ আর আমেরিকার মধ্যবর্তিনী, তার তদারকিতে সভ্যতার সেজবাতি পেরিয়েছে এ-কূল থেকে ও-কূল । আমি রঞ্জনের দিকে ফিরে বললাম, লুক্ড অ্যাট ইচ্‌ আদার য়ুইথ এয ওয়াইল্ড সারমাইজ, হাই অ্যাপন এয পীক ইন ড্যারিয়েন । রঞ্জন বললেন, ওটা প্যাসিফিকের গল্প, কর্টেজের । আমি বললাম, ওহো,সরি সরি !

    রঞ্জনের খুব উত্সাহ, জলের ধারে যাবেন । পাড়ের গা বেয়ে উত্রাই, রিপুর মত পিচ্ছিল । আমি বললাম, নামবে আবার ? এখান থেকেই তো ... । প্রীতীশ বললেন, পড়ে টড়ে গেলে ... । নানক মতামত দেন শেষে ; বললেন, ইট উইল বী ফান । অগত্যা নামলাম প্রাণটা পকেটে পুরে । ঢেউগুলো ধাক্কা খাচ্ছে তীরের বোল্ডারে । খানিক দূরেও ঢেউয়ের বালাই নেই, কূলের কাছে এসেই মনে পড়ে যায় যেন ওপারের বেদনা, খানিক উথলে উঠে ফেনিল সমর্পণ । রঞ্জনের পাশে দাঁড়ালাম, দেখি চেয়ে আছেন নির্নিমেষে । বললাম, মনে পড়ছে ? এ কী গভীর বাণী শিখালে সাগরে, চুরানব্বইয়ের পুরী ? বললেন, পড়ছে । খানিক্ষণ চুপচাপ । একটা সিদ্ধান্তে আসতে হয় বলে বললাম, তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে, তারপরে আরও পোক্ত করতে, পরের লাইনটা । রঞ্জন বললেন, চলো, জলে হাত দেওয়া যাক ।

    মনটওক পয়েন্ট থেকে ফেরার পথে নানক নিয়ে গেলেন একটা সরাইখানায়, ফিস এযণ্ড চিপ্স্‌ সহযোগে আদত ইংরাজ খানা । অনেক ধস্তানোর পর বিল মেটানোর সম্মানটা পকেটস্থ করা গেল, আমার যোশে ওঁদের এত আয়োজনার্থে ।

    খেয়েদেয়ে নানক বললেন, এসো আমার ঘরে এসো । আমরা বললাম, চলো । পোর্ট জেফারসনের জেটি থেকে কয়েক পা এগিয়ে কাঠের দোতলা বাড়ি, একতলায় চেম্বার অফ কমার্স । সব ছোটবড় শহরেই এঁদের উপস্থিতি, খবরাখবর রাখেন সবরকম । চেম্বার অফ কমার্সের উপরে নানকের বাসা । একটাই ঘর, আসবাব বলতে শুধু একটা দুলুনি কেদারা, মাটি থেকে মাথা অবধি থাক থাক বইয়ের পাঁজা । এই স্কাইস্ক্রেপার গুলোকে পাশ কাটিয়ে জানালার ধারে গেলাম, পোর্ট জেফারসনের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলে উঠেছে, অন্যদিকে নিকষ অতলান্তিক । দেয়ালে একটা ছবি চমকে দিল, মুখোশের ধাঁচে একটা মুখ আবছা চেনা চেনা । নানক বললেন, বিথোভেন'এর প্রতিকৃতি, এক প্রসিদ্ধ ভাষ্করের গড়া, তারই ছবি । চেনা মনে হচ্ছিল কেন বুঝলাম, রামকিঙ্কর-কৃত রবীন্দ্রনাথের উত্ক্রমী ভাষ্কর্যের সাথে আশ্চর্য মিল । নানকের সঙ্গীত সংগ্রহও ব্যাপক, একই সুরলহরীর ভিন্ন ইন্টারপ্রেটেশন যোগাড় করা ওনার নেশা । বললেন নাইনথ সিম্ফনির প্রায় দশটি পরিবেশনা আছে ওনার কাছে, ইচ হ্যাজ ইটস্‌ ওযন চার্ম । সন্ধেবেলা লেখালেখির কাজ করেন, আমরা আর ব্যাঘাত না ঘটিয়ে বাড়িমুখো হলাম । কাল সকালে আবার হাজির হবেন বললেন নানক, সবাহন । ঘরে ফিরে একটা কি করি কি করি ভাব । রাত্রি এখনো শৈশবে, তাছাড়া অদ্য শেষ রজনী, আমি বললাম রঞ্জনকে, গান ধর, প্রীতীশ বললেন, হয়ে যাক ।

    রঞ্জন বললেন, বহুদিন চর্চা নেই তো.... । প্রীতীশ বললেন, গত সপ্তাহেই শোনালি তো ফোনে, যেদিন ফুটল কমল । রঞ্জন বললেন, ওহো, লাস্ট য়ুইকেই না ! বার করলেন সঙ্গত, শতধ্বণ্যা সিন্থেসাইজার । আমায় জিজ্ঞেস করলেন, কি করা যায় ? আমি বললাম, কর কিছু একটা অ্যাপ্রোপ্রিয়েট, তোমার স্টক তো ওয়াটার অফ ইণ্ডিয়া । ভায়োলিন পিয়ানোর যুগল তান উঠল, ধরলেন রঞ্জন, মুখখানি কর মলিন বিধুর যাবার বেলায় । তারপর আমার দিকে ফিরে মৃদু হেসে বললেন, জানি আমি জানি, সে তব মধুর ছলের খেলা । দ্বিতীয় কলিতে ব্রেক কষলেন, দাঁড়াও লবির দরজাটা বন্ধ করে দিই । প্রীতীশ শুধোলেন, মার্সিয়ানরা আছেন কি ? আমি বললাম থাকলেই বা । তবে অবশ্য প্রিকশনের মার নেই, এই সব যোগে । সেই প্রমদারঞ্জন রায়ের বনের খবর'এ ছিল, ওঁরা জরিপ করতে বর্মা সীমান্তে গিয়ে একদিন সন্ধেবেলা গাওয়া ঘি'এর লুচি ভাজছিলেন, আশপাশ থেকে স্থানীয়েরা তেড়ে এসেছিলেন এমন দুর্গন্ধের উত্স খোঁজে । তেমন কিছু হলে রসভঙ্গ হবে । বৈঠকখানার দরজা সেঁটে সেই যে রঞ্জন বসলেন, ফোয়ারা খুলে গেল গানের, আর স্টপক'কের পঁযাচটা গেল কেটে । গান থেকে গান, তার থেকে গানান্তর । আভোগের ধুয়ো ধৈবতে না মেলাতেই উঠে আসছে মধ্যমের মিড় । সিন্থেসাইজারের পর্দায় সাদার থেকে কালোকে চেনা যায় না ।

    গানটা রঞ্জনের আসে । আসে মানে চাকাহীন শকট রাস্তাহীন পথে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে, আশা; নয় । সঙ্গীত স্বয়ং সুরলোকের রাজপথে রথ হাঁকিয়ে রঞ্জনের দরজায় নেমেছেন । সাবলীল আঙ্গিক ও কন্ঠের লালিত্যের এমন সন্নিবেশ বড় একটা চোখে পড়ে না । কলকাতার এক বর্ষীয়ান ও বিদগ্ধ সঙ্গীত সমালোচক ওকে বলেছিলেন, উইথ এয ভয়েস লাইক দ্যাট, ইউ ক্যান আর্ন মিলিয়নস । রঞ্জন সেই অযুত-নিযুতের দিকেই আছেন তবে তাদের সাথে শুধু গাণিতিক গেরস্থালিতেই । যতদূর জানি গানের প্রথাগত তালিমের বিশেষ ধার ধারেননি, এবং ওঁর গান শুনলে বোঝা যায় সেই যোগে অধরায় বিশেষ কমতি হয়নি । বিশুদ্ধ গণিত ভালই জারিয়েছে ওনার গান, তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষণিক বৃত্তিতে গলা খানিক ভেঙেছে, তা সে নগণ্য, আগে শুনে থাকলে তবেই বোঝা যায় । একে একে গেয়ে গেলেন নিজের প্রচুর প্রিয় গান, সঞ্চারির ফিরে ফিরে আসা গমক মাতিয়ে দিয়ে গেল । বাইরে তাকিয়ে দেখি সুরধুনির মায়ায় উত্কর্ণ চরাচর, গাছের পাতায় বরফের সংসক্ত স্মিতি । এক্সপেরিমেন্টের জন্য বললাম, একটা বর্ষার গান কর তো । ধরানোর অপেক্ষা কেবল, মাতোয়ারা হয়ে গাইলেন ঘনঘোরের আগমনী । তার বাঁশির ধ্বনিখানি আজ আষাঢ় দিল আনি, শুনতে গিয়ে কোনো লজিক্যাল ফ্ল চোখে পড়ল না, তানসেনের দীপকের গল্প তারপর থেকে আর গপ্প মনে হয়নি । মাঝে মধ্যে আমরা দুটো একটা ফরমাস ছোটাচ্ছিলাম, প্রীতীশ বললেন, মেঘ বলেছে যাব যাব হোক । ওনার ভাগ্যটা ভাল, প্রায় প্রাত্যহিক দূরভাষী তর্কের পরে গান শোনেন বন্ধুর কাছে । আমি বললাম, হঁযা হঁযা ওটাই হোক । প্রেম বলে যে যুগে যুগে তোমার লাগি আছি জেগে, সেই তৌষারিক স্তব্ধতায় যেন আকাশপ্রদীপ জ্বেলে গেল ।

    রাত প্রায় ভোর হতে চলে, কল্য প্রাতে নিষ্ক্রমণ, রঞ্জন তখনো সমান গীতিময় । আমি ঘরে এসে গোছগাছে ব্যস্ত, প্রীতীশ প্যাসেজে পায়চারিতে বিভোল, মার্সিয়ানদের দয়ার দড়া এবার ছিঁড়লেও ছিঁড়তে পারে । আমি বললাম প্রীতীশকে, এটাই শেষ তো ? প্রীতীশ বললেন, আমায় কিছু বলেনি । মনে হল উনি স্ট্যাটাস কুয়োতে তৃষ্ণা মেটাতেই উদগ্রীব । স্বল্প ফলাহার করে যখন শোওয়া হল, তখন প্রায় ঊষা এসে পূর্বদুয়ার খোলে । ঘুমের ভিতরেও এক শ্রুতিময় স্বপ্নে জেগে রইলাম, আর সব ইন্দ্রিয়ের চৈতন্য যেন হারিয়ে গেছে সেই মূর্ছনায় । কলিং বেলের তাড়নায় ঘুম ভাঙল, নানক এসে গেছেন, ল্যাণ্ড রোভার টগবগে । আজ নিউ ইয়র্ক যাওয়া, আর কাল যাব'র আঁচল নেই, বিকেল পাঁচটায় ফিনিক্স ফেরার উড়ান । আদি ট্রায়াম্ভারেট যাবেন আমার বিদায়ী বেলায় । নিউ ইয়র্ক শহরে টুনটুনিদিদিদের আস্তানায় দুপুরে নেমন্তন্ন সবার ।

    গাড়িতে লাদাই হয়ে চলা শুরু হল । নানকের ভীষণ উত্সাহ নিউ ইয়র্ক শহর দেখাবেন । বললেন আই অ্যাম ইন লাভ উইথ দ্য সিটি । দ্য সিটি ছাড়া অন্য কোনো অভিধায় চেনেন না নানক, অতিকায় আপেল'কে । জানালেন, পৃথিবীর ইতিহাসে দ্য সিটি'র শিরোপা নাকি মুণ্ডু বদলেছে বার বার, অ্যালেকজাণ্ড্রিয়া, রোম, লণ্ডন হয়ে এখনকার মূর্তিমান আমাদের সামনে । নিউ-ই-অর্ক এখন মধ্যগগনে গনগনে । জগত্ব্যাপী সব দ্রষ্টব্য আর দেখবার সময় নেই থেমে থেমে, আমি পক্ক চালে বললাম, ও টিভিতে দেখে নেব । নানক মর্মাহত, বাট ইউ ও'ন্ট ফীল ইট দ্যাট ওয়ে, দ্য সিটি ভাইব্রেট্স । আর যুত্সই উত্তর জুটল না । তাও নানক ল্যাণ্ড রোভার চক্কর কাটালেন বিস্তর, সমস্ত জাঁদরেল নিশানা চিনিয়ে দিলেন সবিস্তারে । ব্রূকলীন আর ম্যানহ্যাটনে সভ্যতার কেমন দুই ভিন্ন স্বাদ, তাও বোঝালেন সহজ করে । নিউ ইয়র্ক অলি গলি যেন গত জন্মের চেনা মনে হল , একেও তো দিব্যি কল্লোলিনী তিলোত্তমা বলে চালানো চলে । এক জায়গায় সার সার গুদাম ধরনের বাড়ি, লোহার গেট আর টিনের চাল, এক রাশ আবর্জনার জটলা চূড়ান্ত আবশ্যিকতায়, মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটের সাথে অমিল অল্পই । স্ট্যাচু অফ লিবার্টিকে প্রণাম করে, টাইম্স স্কোয়ার ছঁংউযে যাওয়া হল. এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং'কে দেখে আর চড়তে ইচ্ছা হল না, ওপরে অক্সিজেন মিলবে তো ?

    নদীর এপারে দাঁড়িয়ে ম্যানহ্যাটন স্কাইলাইনকে ব্যাকগ্রাউণ্ডে রেখে ছবি তুলেছিলাম, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দ্বৈতস্তম্ভ মধ্যমণি, আর সামনে আমরা । নাতিপুতিদের দেখানো যাবে । ওয়াশিংটন যেখানে শপথ নিয়েছিলেন সে বাড়িটা দেখলাম । আমি বললাম, কিন্তু ক্যাপিটল তো ওয়াশিংটনে । নানক বললেন, তখন রাজধানী নিউ ইয়র্কে ছিল, পরে নতুন শহরে উঠে যায় । আর তাছাড়া ওয়াশিংটনের জীবদ্দশাতে ওয়াশিংটনের নাম ওয়াশিংটন হয়নি । বড়দিনের সকাল, রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা, ছুটির আমেজ চারিদিকে । নিউ ইয়র্কের সেই ওজস্বী দৃপ্ত চেহারা না দেখাতে পেরে আফশোস হচ্ছিল নানকের, বললেন চল একবার ওয়াল স্ট্রীট ঘুরে আসি ।

    "সহরটা শিং তুলে আকাশটাকে যেন গঁংউতিয়ে মারার চেষ্টা করছে"
    গাড়ি চলছে সর্পিল রাস্তায়, আকাশ বলতে শুধু অসীম উচ্চতায় একফালি আলো, দুপাশে বাড়িগুলো প্রাচীরের মত খাড়া, মাথার নাগাল শুধু কল্পনায় । যেন একটা ক্যানিয়নের তলদেশ দিয়ে চলেছি । রবীন্দ্রনাথ সেই ১৯৩০'এই লেখেন নিউ-ইয়র্ক দেখে, "সহরটা শিং তুলে আকাশটাকে যেন গঁংউতিয়ে মারার চেষ্টা করছে" । নানক বললেন এইখানে নাকি উইক ডে'তে বাতাস নিংড়োলে টাকা বেরোয়ে । আর লক্ষ লক্ষ কর্মবীর জুতে থাকেন সেই আখ মাড়াই কলে । বহু পরিচিত সব বাণিজ্যিক নাম চারিপাশে, দপ্তরের পর দপ্তর ঢেলে স্বর্গের সিঁড়ি পাকাপোক্ত, কেমন মিইয়ে গেলাম সব দেখে টেখে, আমি তোমার ভুবন মাঝে, লাগি নি নাথ কোনো কাজে । গম্ভীর মুখে বললাম, আচ্ছা, ন্যাসড্যাকটা কোন দিকে ? নানক বললেন, ফেরার পথে দেখাব ।

    বরফ নেই তবু বীভত্স হাওয়ার দাপট । প্রীতীশ বললেন, উইণ্ড চীল ফ্যাক্টর আরো কমবে । ঠিক হল টুনটুনিদিদি-শুভ্রদাদার উষ্ণতায় ঢোকা যাক ।

    ম্যানহ্যাটনের অন্ত:স্থলে টুনটুনিদিদিদের ফ্ল্যাট, জমজমাট পাড়া । টুনটুনিদিদি ইংরাজি সাহিত্যের গবেষক, সম্ভ্রান্ত সব পত্রিকায় প্রায়ই লেখেন । শুভ্রদাদা জ্যোতির্বিজ্ঞানী । কলকাতায় ওঁদের উদ্বাহে খুব মজা হয়েছিল, তারপর এই দেখা । আমোদ আপ্যায়নে ভরিয়ে দিলেন অল্পখানিকের মধ্যেই । রঞ্জন, টুনটুনিদিদিরা, এঁদের সাথে দেখা হচ্ছে আমার এই সাগর পাড়ের পাড়িতে । মজা লাগে ভাবতে, যত হারাধন প্রাণ প্রিয়জন, আলো করে সবাই হেথায় ।

    সুন্দর ফ্ল্যাট, বহু প্রাচীন বাড়িতে অসংখ্য পরিবার, নানা দেশের নানা ভাষার মানুষ । ঘরের একপাশে পাকানো পাইপ, তাপের বিকীরণে মজিয়ে রেখেছে পুরো বাড়ি । প্রচুর বইয়ের উপচে পড়া র্যাক, টুনটুনিদিদিদের কলকাতার বাড়ির কথা মনে করিয়ে দেয় ।

    নানা হাসি ঠাট্টায় জমে ওঠা গেল, প্রীতীশ, নানকও যোগ দিলেন অবলীলায় । শুভ্রদাদার খুব ইচ্ছা ওনার আলমা মেটর কলম্বিয়া য়ুনিভার্সিটি দেখাবেন, হাঁটাপথেই, আমারও উত্সাহ কম নয় । টুনটুনিদিদি বললেন, আগে লাঞ্চ ।

    বিরাট সপ্তপদী খাদ্যবহর, কর্তা-গিন্নীর জযেন্ট ভেঞ্চার । ব্রকোলির ডালনা আর গ্রীলড মটন সাবাড় হল সোত্সাহে । তবে ভীষণ ভালো লাগল শেষ পাতের বাড়িতে পাতা দই । কোথায় লাগে সুপার মার্কেটের চাবড়া ইয়োগার্ট, বাটি উপুড় করে চিনি দিয়ে মেখে খেলাম হাপুস রসনায় । খাওয়া দাওয়ার পর আরেকপ্রস্থ আড্ডা, হাত শুকিয়ে গেল টেবিলে বসেই । আমি ফোকর খঁংউজে বললাম, কলম্বিয়া । শুভ্রদাদা বললেন, হঁযা চল্‌ ।

    ওঁদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটা শুরু হল, শুভ্রদাদা কোটের কলার তুলে বললেন, এমন শীত চট করে পড়ে না নিউ ইয়র্কে, নন্দনের ব্যাপটিজ্ম বাই আইস । আমি একটা চতুর উত্তর ভেবেছিলাম, কিন্তু টুপি মাফ্লারের জঙ্গলে কোথায় হারিয়ে গেল । শুভ্রদার নিজেদের পাড়া, চেনালেন ওঁদের নিত্য নৈমিত্যের নানা রেখাপথ । কয়েকটা ডাইনে বাঁয়ে মোচড় মেরে হঠাৎ দেখি ঢুকে পড়েছি কলম্বিয়ার চত্বরে । নিউ-ইয়র্ক শহরের ঘন জনাকীর্ণ অঞ্চলের মাঝখানে এই বিশ্ববিদ্যালয়, কিন্তু ক্যাম্পাসের মেজাজ বেশ আশ্রমিক ।

    সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া প্রাঙ্গণ, বাড়িগুলোর স্থাপত্যে স্বকীয়তা স্পষ্ট । প্রাচীন য়ুরোপীয় ধাঁচে দালান-স্তম্ভের যুগলবন্দী । শুভ্রদাদার স্নাতকোত্তর পড়াশুনা এখানে, বললেন কলম্বিয়ার অনেকটাই নাকি পাতালে, শহরের মেঝের থেকে নীচে বেশ কয়েকতলা ল্যবরেটরি, ক্লাসরুম । কলম্বাসের নামাঙ্কিত এই প্রসিদ্ধ বিদ্যায়তন, অনেক তাবড় মনীষীর কর্মস্থল, খুব অল্প জায়গার মধ্যে সুন্দর বিদ্যার্থী পরিবেশ সৃজিত হয়েছে ।

    দর্শন বিভাগের সম্মুখে দেখি চিরচিন্তান্বিত থিংকার,..
    ডানদিকে তাকিয়ে দেখি একটা সুভদ্র বাড়ির দেউড়ির ফলকে এক নি:শ্বাসে লেখা; হোমার, হেরেডোটাস, সোফোক্লেস, প্ল্যাটো, অ্যারিস্টট্ল্‌, ডেমোস্থেনিস, সিসেরো, ভার্জিল । ভেবে অবাক হলাম, এঁরা কেউই তো মার্কিন নন, তবু কেমন স্বাচ্ছন্দ্যে স্বীকৃত হচ্ছে এঁদের উত্তরাধিকার । সভ্যতার নির্যাসটুকু ছেঁকে নিয়ে শুরু হয়েছিল অতলান্তের এপারের এক্সপেরিমেন্ট, সমুদ্রমন্থনের অমৃতটুকুতেই এদের কারবার । দর্শন বিভাগের সম্মুখে দেখি চিরচিন্তান্বিত থিংকার, রঁদ্যার বিখ্যাত ভাষ্কর্যের প্রতিরূপ । বেশ অ্যাপ্রোপ্রিয়েট লাগল । শুভ্রদাদা চেনাচ্ছেন, এটা সাহিত্য, ওদিকে ফিজিক্স, ঘুরে গিয়ে লিবারেল আর্টস্‌ । মাঝে হঠাতি বললেন, জ্যোতিমেশো নেই ভাবাই যায় না, এয গ্রেট ভয়েড ইন আওয়ার লাইভ্স্‌ । কথাটা আকস্মাৎ হলেও পরিবেশের সাথে কেমন মানিয়ে গেল । আমি বললাম, তুমি তো ভাল করে আলাপের চান্সই পেলে না ।

    কলম্বিয়া থেকে বেরিয়ে ব্রডওয়ে ধরে হাঁটা হল খানিক্ষণ, ওপাশে দেখালেন বিখ্যাত নাটমন্দির সব । অ্যালেন গিন্স্বার্গের বাড়িও দেখলাম, বাংলার উদীয়মান কবিরা একসময় প্রচুর প্রেরণা কুড়িয়েছেন এঁর থেকে ।

    ছায়া লম্বমান, নিউ ইয়র্কের অট্টালিকার পিছনে সূর্য হেলে পড়ছে দিনান্তের বিশ্রামে, মনে পড়ল প্লেন ধরতে হবে ।

    বাড়ি গিয়ে বেরোনোর তোড়জোড়, সবাই বললেন, এত অল্প সময়ে হয় না । টুনটুনিদিদি বললেন, একটা গান হবে না ? আমি বললাম, নিশ্চয়ই । চটপট বসে পড়ে বই খুলে গেল, তোমারি রাগিণী জীবনকুঞ্জে, বেজে উঠল খানিক্ষণের সদা । বেরোনোর শুরু আর বেরিয়ে পড়ার মাঝে ঠোঁট ও চুমুকের সেই প্রবাদীয় ব্যবধান তো থাকেই । না-বলা বাণীর ঝুড়ি আবার উপুড় হল । ঘড়ির টিক টিক অব্যাহত, আমি বললাম, যেতে যদি হয় । নানক বললেন, খ্রিস্টমাস ইভনিং আশাকরি পথ ঘাট খালি পাব । টুনটুনিদিদিদের টাটা যখন অদৃশ্যে মেলালো শেষ পর্যন্ত, ঘড়িতে তখন পাঁচটা পাঁচ । দুটো মোড়ের পরপর লালবাতি তন্দ্রা ছুটিয়ে দিল, বড়দিনের রাত বড় করতে রাস্তায় বিস্তর যান ।

    নানক বললেন, দিস্‌ লুক্স্‌ এক্সাইটিং । যত যাওয়া যাচ্ছে, জট ততই বাড়ছে, সিগন্যালের রক্তচক্ষু ছাড়াই দাঁড়াতে হচ্ছে বার বার । আমার ঠোঁট শুকিয়ে আসছে । এক অনুপলের জন্য আরেকটা যানবাতি রাঙা হতেই প্রীতীশ বললেন, বাজে ব্যাপার । রঞ্জন বিব্রত, তোমাদের গল্প তো আর শেষই হচ্ছিল না । প্রীতীশের মতে, ওটাতো আর এখন বলে লাভ নেই । আমি নিরুত্তর । নানক বিনা বাক্যব্যয়ে একটা লালবাতি ঝাঁপালেন । খানিকদূর গিয়ে বললেন, ঐ যে ন্যাসড্যাক । আমি আড়চোখে দেখে বললাম, আই সি; আর কতখানি জেএফকে ? নানক বললেন, স্টিল সাম ওয়ে । গাড়িতে নৈশব্দ্য, হাতঘড়িও দেখছেন না কেউ, অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হবে ! নানক দ্য সিটির মোহন কণাটুকুও চেনাতে ছাড়ছেন না -- আলোর বর্ণালীতে ধুয়ে যাচ্ছে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং । আমি বললাম, বা:, না দেখেই । শেষ কয়েক মিনিট চোখ বঁংউজে ফেলেছিলাম, ল্যাণ্ড রোভার ছুটছিল যেন ইতি গজ'র আগের রথ যুধিষ্ঠিরের, মাটি থেকে ছ'আঙুল উঠে ।

    টার্মিনাল দিয়ে ছুটতে ছুটতে উড়ানদ্বারের কাছে পৌঁছে শুনি মাইকের হঁংউসিয়ারি, লাস্ট কল ফর ন্যান্ড্যান ড্যাটা । রসিয়ে বিদায় নেওয়া মাথায় উঠল । কোনো মতে করমর্দন সেরে নানককে ধন্যবাদ দিলাম, উনি বললেন ইট ওয়াজ ফান । প্রীতীশ বললেন, সব ঠিক ঠাক নিয়েছো তো ? রঞ্জনকে আমি বললাম, খাওয়া দাওয়া ঠিক মত কোরো । উনি বললেন, আরে হঁযা হঁযা । রক্ষীরা আমাকে প্রায় ঠেলে সুড়ঙ্গ পথে ঢুকিয়ে দিলেন, পিছনে তাকিয়ে দেখি রঞ্জন হাত নাড়ছেন, বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা ।

    সীটে বসে বেল্ট বাঁধলাম না, ভাবলাম নেমে পড়ি । অনেক্ষণ ধরেই ভাবলাম, কারণ প্লেন ছাড়ল দু ঘন্টা পরে, শীতের দরুণ হাইড্রলিক সিস্টেম বিকল হয়ে গিয়েছিল, প্লেনের ।

    এবার সরাসরি ফ্লাইট, গভীর রাতে ফিনিক্সে নামলাম, ট্যাক্সি ধরে মোমবাতিবনের দিকে । ক্যাবির নাম হামিদ, বছর দশেক ফিনিক্সের ট্যাক্সি চালক । ইরানের মানুষ । ডাউনটাউন ফিনিক্সের উঁচু বাড়িগুলোয় আলোর মালা, আকাশের গায়ে আলেয়া যেন । মজা লাগল, হামিদ আর আমি, দুজনেই এসেছি এদেশে উঙ্ছবৃত্তির বেদম টানে, অথচ মেসোপটেমিয়া আর মহেঞ্জোদরোয় যখন ঝাড়বাতির ঝকমক, তখন এদিকের অমাবস্যার অন্ত দেখা যেত না । কিন্তু পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা, এ নিদান খণ্ডাবে কে ? ইতিহাসের সাপ-মই খেলায় কয়েকটা ছক্কার ওলট-পালট, আর আজকের আমরা এখানে, সমস্বরের সামগান, অনেক তোমার টাকা কড়ি, অনেক দড়া অনেক দড়ি, অনেক অশ্ব অনেক করী, অনেক তোমার আছে ভবে । শ্যামখুড়ো বিনয়ে উপচে বলছেন, না: না: এ আর এমন কি ।

    ভাড়া মিটিয়ে আর বুঝে শুনে টিপ দিয়ে বললাম, মেরি খ্রিস্টমাস, হামিদ । বিজাতীয় সম্ভাষণে দুজনের জোড় লাগল তত্ক্ষণাত্‌, হামিদ বললেন, মেরি খ্রিস্টমাস টু ইউ স্যার । স্যর শুনে চমকে উঠলাম, প্রাচ্যে তো আমাদের প্রভুত্বের প্রথা । হামিদ কার্ড় দিয়ে বললেন, লাগলে ফোন করতে ।

    মোমবাতিবন নিশুতি । ঘরে ঢুকে দেখি রুমমেট জেগে, বললেন, ফিরে এসেছো ? কি আনলে ন্যূয়র্ক থেকে ?



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)