• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৭ | আগস্ট ২০০২ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • মার্কিন মুলুকে মাসকয়েক : নন্দন দত্ত





    ॥ উন্মেষ পর্ব ॥



    আমার ক্যাবের উদ্দেশ্যে হে-কার বিফলে গেল না । নিমেষেই দু-তিনটে এসে দাঁড়াল, ক্যাবিরা সবাই উদগ্রীব । আমেরিকান ট্যাক্সি, থুড়ি ক্যাবের সম্বন্ধে একটা ঔষধিক ভয় আমার সাথে ভারত থেকেই এসেছে । মাগিং থেকে সাবধান, ট্যাক্সি চড়তে গিয়ে, বলেছিলেন অনেক শুভানুধ্যায়ী । আর বলেছিলেন, তেমন কিছু হলে বাঙালের গোঁ না চাগাতে । তাই এসব বিচারে সব থেকে অষণ্ডমার্ক সারথিকে বাছাই করলাম, উচ্চতায় সাড়ে ছ'ফুট, আর প্রস্থে সামান্যই কম । মন মেজাজ খুব শরিফ মনে হল ক্যাবির, শিস দিতে দিতে বললেন, হাই ম্যান, হাউ আর ইউ ডুইং ? পিঙপিঙে ভারতীয়কে মার্কিনের ম্যান সম্বোধনে খুশি হলাম, দেশগর্বে বুক দশ-হাত, মানুষ আমরা নহি তো মেষ ।

    আমি বললাম, গুড আফটারনুন, আর এমনই জেটল্যাগী ম্রিয়মিতায়, যে ক্যাবি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে লটবহর তুলে দিলেন ডিকিতে । ক্যাবটার আকৃতি তিমিমাছের মত, গড়িয়াহাট থেকে রাসবিহারীর মোড় এমন দু-তিনটে ফেললেই ভরে যাবে । চড়ে বসতেই ক্যাবি দমাস করে দরজা বন্ধ করলেন, তার পরে একটা খুট্‌ শব্দ হল । আমি তড়িঘড়ি ঠিকানা বললাম, আর আশপাশের কিছু পথচিহ্ন, দূরদর্শী বন্ধু এক লিখিয়ে দিয়েছিলেন । ভাবটা, এপথে আমি যে গেছি বারবার, তাই বাড়তি দু'পয়সার লোভে চক্কর কাটানো চলবে না । ক্যাবি বললেন, ইয়াহ ইয়াহ, আই নো, আই নো, ডোন্ট ওরি, ম্যান ।

    অচিরেই ভীমবেগে মিশে গেলাম আরও নানা গাড়ির গড্ডালিকায় । জানালার কাচ নামাতে গিয়ে দেখি সে-গুড়ে বালি, খুট শব্দের তাত্পর্য বুঝলাম, সবই সেন্ট্রাল লক, সারথিই রথের সর্বময় । মিন মিন করে বললাম, উইনডো ওপেন, প্লিজ, এয়ার । আসলে ভাবছিলাম সব গেলে একবার অন্তত হাঁক ছাড়ব, যদিও ওই ছকে হাঁক বা ডাকে কোনো সুরাহা হত না । তবু চেষ্টা তো, শ্বাস আর আশ নিয়ে কি একটা প্রবাদ আছে না ? ক্যাবি বিনা বাক্যব্যয়ে অংকুশ তুললেন । বাতাসের প্রথম ধাক্কায় প্রায় উল্টে গেলাম এবং খ্যাঁক করে কামড়ও লাগল ঠাণ্ডার, তবে নিখিল ভুবন ফিরে পেয়ে সাহস বাড়ল । মাংকিক্যাপ আর মাফ্লার জড়িয়ে জুল জুল চোখে আমেরিকানা গিলতে লাগলাম ।

    ... উঁচু উঁচু বাড়ি, সাঁই সাঁই গাড়ি }
    প্রথম দর্শনে চেনা চেনা লাগল আমেরিকা । সোজা সোজা রাস্তা, উঁচু উঁচু বাড়ি, সাঁই সাঁই গাড়ি । সব কিছুই বেশ বেশি বেশি, দশ জনের কুলানো গাব্দা গাড়িগুলোতে শুধুই চালকের চালাকি, রাস্তাগুলো গড়ের মাঠের মতো পর্যাপ্ত, আকাশটাও অনেক বিরাট না ? লোকজনের চেহারাও হৃষ্টপুষ্ট, যতীন দাশের তেষট্টি দিনের রেকর্ড ভাঙতে পারেন যে কেউ, ইচ্ছা বা কারণ হলেই । আর সত্যিই যে আমেরিকা তা প্রমাণ করতে বিরাট বিরাট সাইনবোর্ডে গনগনে কোকা কোলা, ম্যাকডোনাল্ড ইত্যাদি, প্রথম দুনিয়ার শাশ্বতী স্লোগান সব ।

    আধঘন্টা খানেকের তড়িৎ চলার শেষে গন্তব্যে পৌঁছলাম । ইতিমধ্যে রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক বা অন্য কোনো বিতণ্ডায় যাইনি ক্যাবির সঙ্গে, উনিও নিজের মনে গান করছিলেন, সুরটা খানিক ঘুমপাড়ানি মাসিপিসির মতো । খুশি হয়ে ভাড়ার উপরি পাঁচ ডলার টিপ দিলাম, কিং কারেন্সির কড়কড় ভালই লাগল, আঙুলে প্রথমবার । তবে, হ্যাভ এ গুড ডে ম্যান, বলে ক্যাবি হুস করে চলে যেতেই মনে হল, এই যা:, মনে মনে গুণটাতো করিনি, পাঁচ পাঁচটা... । ঝরনার জল, ধনুকের তীর এবং ক্যাবির টিপ তো বেরিয়ে গেলে আর ফেরে না, তাই ডলারের গরমের দামটা কষতে কষতেই ভাবলাম, পরের বার সামলে ।

    দেখলাম দাঁড়িয়ে আছি এক সজ্জন সরাইয়ের সামনে । তিনতলা এল-শেপ-এর ভিটে, মাথায় লাল টালির টুপি । এখানেই আমার ঠাঁই হবার কথা, অন্তত তেমনই তো আশ্বাস । নামের আক্ষরিক অনুবাদ, মোমবাতিবন নিবাস । মোমবাতিবন অ্যাবস্ট্রাক্ট কনসেপ্ট মানছি, কিন্তু একটা খুশি খুশি ভাব জাগল, যখন দেখলাম মনে মনে, শিখায় শিখায় ছয়লাপ অটবী । আসলে এই দৃশ্য আমারই এক স্মৃতির নির্যাস । কলকাতায় থাকতাম একটি ঈশাই গোরস্থানের পাশে । নভেম্বর দোসরা, অল সোল'স ডে, প্রতিবছর প্রিয়জনের সমাধিতে প্রদীপ জ্বালাতেন আত্মীয়রা । সূর্যাস্তের পর অগণ্য আলোর বুদ্বুদে সে ছিল এক মায়াবী মূর্ছনা ।

    কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম । কাউন্টারের পিছনে চাঁদমুখো যুবক, হেসে বললেন, হাই ! হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ ? মনে পড়ল আরবিএন'এর কথা, আমরা বলতাম, রাবণ । ফ্লুইড মেকানিক্স পড়াতেন সেকেণ্ড ইয়ারে । সাতান্ন সালে একবার বিলেত গিয়েছিলেন, সাতানব্বই অবধি ধোপ সয়েছিল । প্রায়ই বলতেন, নেভিয়ার স্টোক্স'এর রগড় থামিয়ে, আ: কি দেশ ! রাস্তায় সাইনবোর্ড বড়ো বড়ো, অ্যারো দেওয়া, একদিকে লণ্ডন আরেকদিকে লিভারপুল । অফিসে ঢুকলেই রিসেপ্সনিস্ট হেসে বলেন, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ, স্যর ?

    চাঁদমুখো আমার সেবায় এত উদগ্রীব জেনে ভাল লাগল, নাম ধাম বলে বললাম, কোন ঘর ? চাঁদমুখো খানিক কি-বোর্ড খটাখট চালালেন, তারপর বললেন রিজার্ভেশন আছে, ফর নন্নন বাট্টা । একান্ত পৈতৃক সম্পদের এমন দফারফা দেখে মন্দ লাগল, গম্ভীর গলায় আবার নিজের নামটা বললাম, শেষে বানান করে করে । রাগও হল ; পিসতুতো বোন রাজধানীকে দাদখানি বলায় তো ক্ষেমংকরী পিসিমা ঝাঁটা নিয়ে তেড়েছিলেন টেনিদার দিকে । তবে এইসব খুঁটিনাটিতে চাঁদমুখোর মাথাব্যথা নেই, গোলাপ সম্বন্ধে সেক্সপীয়রের উক্তি স্মরণ করেই বোধহয়, নন্নন বাট্টার সাথে নন্দন দত্ত'র হৃদবিনিময় ঘটিয়ে দিলেন জলদি । বললেন রুম নাম্বার ৩১৮ এবং হাতে দিলেন চাবি । ঠিক চাবি নয়, ক্রেডিটকার্ডের মতো পাতলা প্লাস্টিকের পাতা । আমার ফ্যাল ফ্যাল দেখে বুঝিয়ে দিলেন, দরজার গায়ে খাঁজ আছে, সেখানে ঢুকিয়ে সড়াৎ করে টানলেই চিচিং ফাঁক । চাবির সঙ্গেই দিয়েছিলেন ২৫ সেন্ট, বললেন, মোমবাতিবনের তরফ থেকে সৌজন্যমূলক, বাই ইয়োরসেল্ফ অ্যা ড্রিংক । আমি ভাবলাম, আরেব্বাস ২৫ সেন্ট মানে তো ইনটু ফর্টি সেভেন পয়েন্ট কত যেন, ডিভাইডেড বাই ফোর । দুত্তেরি নামতাগুলো যে কেন ভাল করে শিখিনি স্কুলে, পাঁচের পর থেকেই যাহা বাহান্ন তাহাই তিপ্পান্ন হয়ে যায় । যাইহোক, ২৫ সেন্ট যে ২৫ পয়সার থেকে অনেক বেশি তা বুঝতে কুটিল হিসেব লাগল না, বুঝে বললাম, থ্যাংক ইউ । আর বললাম, এবার তাহলে বয়টয়দের ডাকা হোক, মাল তো কম নয় ।

    ইত্যবধি চাঁদমুখোর সাথে সাক্ষাত্কার চলছিল একান্ত নিভৃতে । জনমনিষ্যির সাড়া নেই, বেড়াল টেড়ালও নয় । আমি ভেবেছিলাম বয়টয়দের খোঁজ করতেই চ্যাঁ-স্বরে বেল বেজে উঠবে, পাশের প্রকোষ্ঠ থেকে উর্দিপরা বেয়ারাটেয়ারা'রা বেরিয়ে এসে সেলামটেলাম ঠুকে বলবে যে আজ্ঞে হুজুর, বা নিদেনপক্ষে হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ স্যর । আমি যাবার সময় টিপ দেব নিশ্চয়, এবার বুঝে শুনে, তবে দেব ।

    কিন্তু তেমন কিছুই হল না । চাঁদমুখো বললেন ওঁর নাম জ্যাক । সোম থেকে শুক্র দশটা থেকে ছ'টা উনি হালে থাকেন, অন্য সময় অন্যরা, দিবারাত্র কেউ না কেউ থাকেনই । কোন দরকার হলে যেন ফোন করি, অসংকোচে । ট্রলি আছে বাঁদিকে, লিফ্ট ডানদিকে, ৩১৮ তিনতলার ছ'নম্বর দরজা, লিফ্টের মুখ থেকে ডানদিকে । এবং বললেন অনেক করে, টু হ্যাভ এ গ্রেট টাইম । তারপর একটু থেমে, সরি আই ডোন্ট হ্যাভ অ্যা হ্যাণ্ড অ্যারাউণ্ড । আমাদের দুশো বছরের ইতিহাস তো প্রভুত্ব মজ্জায় মিশিয়ে দিয়েছে, সেটা আঁচ করেই শেষের কৈফিয়ত্টা হবে ।

    কেমন দেশ রে বাবা, সবাই হবে সব্যসাচী, তাও আবার কুলিগিরিতে ! কি আর করা, যস্মিন দেশে যদাচার । মারো জওয়ান হেঁইয়ো করে ট্রলি সাজিয়ে লিফ্টে উঠলাম, মনে মনে আশিস গুনলাম, মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে অন্তত লড়তে হল না ।

    তিনতলার সুড়ঙ্গ মতো করিডরের দুপাশে দরজার সারি । স্যাঁত্স্যাঁতে বিজলি আলোয় কবরখানার শৈত্য । জ্যাকের দেওয়া হদিশ মিলিয়ে ৩১৮ খুঁজে পেলাম অক্লেশে । আশপাশের বন্ধ দুয়ারের ওপার থেকে যে সব শব্দ আসছিল সেগুলো আশা করলাম টিভি থেকেই । চাপাটি চাবি ঢুকিয়েই দ্বার খুলে গেল, গান বা হাতের দরকার হল না ।

    পরে জেনেছিলাম এই ধরনের ঘরকে বলে স্টুডিও । ইজেল, রঙ, নগ্ন মডেল কেউই ছিলেন না, তাই বোধকরি এ শুধু কথার কথা । চারপাশে চোখ বুলিয়ে মনে হল, ব্যবস্থা ভালই । টিভি, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, সিডিপ্লেয়ার-রেডিও, ভিসিআর, বাথটাব-সম্বলিত-বাথরুম ইত্যাদি । জীবনানন্দের বিপুল সম্ভার । বর্ণনা শুনে পরে এক মাসিমা-স্থানীয়া বলেছিলেন, তা'লে তো বউ ছাড়া আর সবই দিয়েছিল । কথাটা অকাট্য । মাটিতে কোমল গালিচা, ঘাসে ঘাসে পা ফেলতেই সোঁ সোঁ শব্দে বাতানুকুল যন্ত্র চালু হয়ে গেল, কোনো অদৃশ্য অদৃষ্টের টিপ্পনিতে হবে । একটা আহ্বাংআনী খাটও ছিল, যেমন ব্যাপ্তি, তেমন গভীরতা । এসব জিনিসে ঠিক একলা জমে না, তাই দ্বিতীয় রাত থেকে -- না: সহজ পথটা বাছিনি -- মাটিতে কার্পেটে শুতাম, কোমরে ব্যথার দোহাইয়ে । রাণাপ্রতাপও শুতেন মাটিতে আমৃত্যু, মেবারের মোঘল-মুক্তির পণে ।

    পোঁটলাপুঁটলি ছুঁড়ে ফেলে শৌচাগারে প্রবেশ করলাম । স্নান ও আনুষঙ্গিক সেরে খানিক চাঙ্গা লাগল । ফোন করলাম মাকে, কাকভোরে ঘুম থেকে তুলে জানালাম কালাপানি পেরিয়েছি নিরাপদে । নন্নন বাট্টাকে নন্দন দত্ত বানিয়েই জ্যাক জানিয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক থেকে ফোন এসেছিল আমার জন্য, আসবার একটু আগে, সাম কাজিন । দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্বে কোনাকুনি ছিপ ফেলে ধরা গেল রঞ্জনকে । জেটল্যাগ কাটাতে ঘুমিয়ে নিতে বললেন, গল্পগাছা হল প্রায় ঘন্টাখানেক । অনেক ছেঁড়া সূত্রে গিঁট লাগল, আর তো যাহা যায় তাহা যায় । রঞ্জনের পরিচিতির আরো বিস্তৃতি প্রয়োজন । তাই পরে । সেদিনের সঙ্ঘারামের শেষ সঙ্গীতে, গাইলেন রঞ্জন, সিন্থেসাইজার সংগতে । বারতা পেয়েছি মনে মনে । নিউ ইয়র্ক থেকে ফিনিক্স সে গান বয়ে এল মেঘের মতন । শুনে খানিক্ষণ চুপ করে রইলাম, তারপরে বললাম, বারতা পেয়েছি ফোনে ফোনে ।

    রাত সাড়ে-ন'টা, মন বলছিল এবার খাওয়া যায়, শরীর বলছিল তাগিদ নেই । এলেম নতুন দেশে, তবে ভিতরের কলকব্জা বুঝি এখনো বেমানান । করিডরে এদিক ওদিক করতে করতে দেখা হল এক সহকর্মীর সঙ্গে, সহৃদয় বন্ধু বটে, দিলেন খেতে কমলা লেবুর রস । তাই দিয়ে ডিনার সেরেই শুয়ে পড়লাম ।

    ভীষণ ক্লান্ত অথচ ভীষণ ঘুম পায়নি । ঘড়ির হিসেবে সবে শুরু হয়েছে নতুন দিন, এমনিতে আমি এখন সকাল সকাল ই-মেল চেক করছি । তাড়াতাড়ি ঘড়ির কাঁটা বদলে নিলাম বেডসাইড ক্লকের সঙ্গে মিলিয়ে । এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না । কিন্তু ঘুমোনোর আগে মনে হয়েছিল ঠিক একমাস বাদে এমন সময় আমি রঞ্জনের আতিথ্যে নিউ ইয়র্কে । ঘুম ভাঙার আগের স্বপ্ন আর ঘুম গড়ার আগের ইচ্ছা নাকি সত্যি হয় ।

    তিনটের সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল কেন জানি না । এও কি জেটল্যাগের চক্রান্ত ? শরীরটাকে দম দিয়ে আর মনটাকে বুঝিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তে পারলাম । এক বন্ধু পরে বলেছিলেন, সৌভাগ্য, কারণ তাঁর নাকি প্রায় দিন পনেরো রোজ তিনটে বাহান্ন মিনিট থেকে জেগে বসে থাকতে হত, কড়িকাঠও ছাই ছিল না যে গুণবেন ।

    পরদিন রবিবার, সকালে ঘুম ভেঙে দেখি ঝলমলে রোদ । জানালার বাইরে মহা যোশে পত্পৎ করে উড়ছে তেরঙ্গা, থুড়ি স্টার-স্প্যাঙ্গেল্ড পতাকা । নীল আকাশ, জ্বলন্ত সূর্যের সামনেও তারাবাজির ঔদ্ধত্য, সমীহ আপনিই আসে । শ্যামখুড়োর সাম্রাজ্যে উত্তোলনের রেওয়াজ সর্বত্র, অনেক ব্যাক্তি বা সংগঠনই হর-রোজ নিশান তোলেন । এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যাথা নেই, ওই কে যেন বলেছিলেন না, জনগণের দ্বারা, জন্য, দিয়ে ।

    দিনটা কাটল নানা চেনা পরিচিতের সাক্ষাতে । সুদূর ফিনিক্সেও উপনিবেশ মতো গড়ে উঠেছে দেখলাম । সকলেই বিভোল উচ্ছ্বাসে, আরে তুইও ! এবং তারপরেই সুশ্রাব্য জনান্তিকে, কি করে ম্যানেজ করল বলত ? এই মোমবাতিবনে আশ্রিত সবাই, কেউ ডালে ডালে, কেউ পাতায় পাতায় । গতরাতের শুনশান পরিষ্কার হল, বেশির ভাগ বেড়াতে গেছেন থ্যাঙ্কস্গিভিং'এর লং উইকএণ্ড-এ । দিনের পলে-অনুপলে থ্যাঙ্ক-ইউয়ের বন্যা বইয়েও শ্যামখুড়োর শান্তি হয় না, জাতীয় ধন্যবাদের জন্যও দিন ঠিক করা আছে, নভেম্বরের শেষ বৃহস্পতিবার । সারা দেশে ছুটি থাকে । মার্কিন ন্যাশনাল হলিডে অল্প কয়েকটা, দেড় আঙুলের দাগেই কুলিয়ে যাবে । আমরা স্বাধীনতা আর সাধারণতন্ত্র দিয়ে শুরু করে সটান ধেয়ে চলেছি তিনশ পঁয়ষট্টির দিকে, লীপ ইয়ারের বাড়তি দিনটাও হয়ত ছুটি ঘোষিত হবে, জাম্বুবানের জন্মদিন, কিষ্কিন্দার ধামা ধরেছিলেন না ।

    সকালে উঠে চোখমুখ প্রক্ষালনের পর প্রাতরাশের পালা । গত সন্ধ্যায় জ্যাক জানিয়েছিলেন মোমবাতিবনের একতলায় আছে হনর কাবার্ড । শুনতে বেশ সম্মানজনক লেগেছিল, সরেজমিনে তদন্ত করতে গেলাম । একটা ঘরে সারিসারি তাকে নানা খাদ্যসামগ্রী, কিছু কিছু ফ্রীজের ভিতর । আমিষ, নিরামিষ, লেহ্য, পেয় সবই আছে । নিয়মটা হচ্ছে এমন, যা ইচ্ছা তাই তুলে নাও, আর কি নিলে তার তালিকা লিখে সই করে ফেলে দাও একটা বাক্সের ভিতরে । যাওয়ার সময় একসাথে বিল'এ যোগ হয়ে যাবে । প্রথমেই মনে হল, নিয়ে সরে পড়লেই তো হয়, আবার তলিকা টালিকা কেন । টেকনিক্যালি ব্যাপারটা যদিও হত চুরি, তবে এমন হাতানো তো অনেক হয়েছে ইতিহাসে, মহাভারতে তো ভুরি ভুরি । অপকর্মটির আগে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে নিচ্ছিলাম, মহাবিদ্যার সম্বন্ধে প্রবাদটা টনটনে মনে ছিল । একটা লম্বাটে একচক্ষু চোখে পড়ল, ক্যামেরা বোধহয় । আঁট ও ঘাট তবে সবই বাঁধা । অত:পর লক্ষ্মীছেলের মতো দুটো তিনটে টুকিটাকি তুলে, সবই কবুল করলাম মুচলেকায়, ফেলে দিলাম বাক্সে ।

    অনশন ভেঙ্গে এদিক ওদিক বেড়িয়ে আসব ভাবলাম, মার্কিন মাটিতে দাপিয়ে নেওয়া খানিক, সত্যিই যে এসেছি তার পায়েনাতে প্রমাণ ।

    মোমবাতিবনের পাশ দিয়েই প্রশস্ত রাস্তা, গোঁ গোঁ করে গাড়ি ছুটছে নানা, ঢাউস মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে টিরেনোসোরাসের মতো ট্রাক । পরে জেনেছিলাম এটি আন্ত:রাজ্য রাজপথ, নাম আই-১৭ । গাড়িগুলোর গতি দেখে মনে হয়, জলে না পড়লে থামবে না, হয় প্রশান্ত নয় অতলান্ত । এ-মুলুকের সড়কগাথা পরে আসছে, বড় করে । আশে পাশে কয়েকটা বাড়ি, প্রায় সবই সরাই গোছের । কিছু দূরে একটা পার্ক, বাচ্চা বুড়ো কেউই নেই । অসংখ্য গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, লাল নীল সবুজ হলদে । মানুষ নেই । দুয়েকজন যাদের দেখা যাচ্ছে তারা হয় গাড়ি চড়ছে, নয় নামছে. পদাতিক হওয়া যেন মহা পরাজয় । আই-১৭'এর হুশহাশ নিশ্বাস বাদ দিলে আর কোনো শব্দ নেই । উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা, ছুঁয়ে যায়, তারপরে আপ্লুত করে । হঠাতি নিজেকে বড় একা লাগল, এই মহাদেশ, স্বর্ণ আর দর্পের বুদ্বুদ আর পরিত্রাহি গতি, একটা লোকও কি পাওয়া যায় না একটু কথা বলার, দুদণ্ড বসে । গিজগিজে গড়িয়াহাটে কেমন গলাগলি, ক্ষুদ্র সুখ-দু:খ আর ক্ষুদ্রতর বিরক্তির কি গাঢ় গুঞ্জন । পায়ে হেঁটে বেশি দূর যাওয়া গেল না, আই-১৭'এ পদচারণা নিষেধ, কারণ তা নাইয়াগ্রার মুখে কাগজের নৌকার সামিল । ধীর পায়ে ফিরে আসতে আসতে মনে হল রবিবার সকাল, কোথায় মা'র হাতের লুচি হালুয়া খেয়ে সুধীন দত্ত পড়ব, তা না, ধনতন্ত্রের ধামা ধরতে এসেছি ধরণীর এ-ধারে ।

    রবিবার বাকি দিনটা কাটল খানিক ঘুমিয়ে, খানিক টিভি দেখে । নানা অবেলায় ঝিমুনি আসছিল, ধড় মুড়োর মানিয়ে ওঠা এখনও চলছে । টিভিতে অসংখ্য চ্যানেল, পুট পুট করে রিমোট টিপে নানা মনোহর মাত্রা । খবরের জানকারি জবরদস্ত, তবে এইসব চ্যানেল আমাদের ও-ধারের টিনের চালের তলেও আজকাল পাওয়া যায়, তাই চমকটা কম । নাটক ধরনের কিছু কিছু হচ্ছিল, এদেরই বোধহয় বলে সোপ অপেরা, খানিক্ষণ দেখলাম । মাঝে মাঝে পেছন থেকে হো হো হাস্যরোল বলে দিচ্ছিল এবার হাসা উচিত । বাক্যালাপে প্রাকৃত শব্দের এত ছড়াছড়ি যে মানেগুলো ঠিক খোলসা হয় না । আরেক ধরনের জিনিস দেখলাম, রিয়্যালিটি শো, চীজ'ও বলা চলে । শুরুর আগের উপক্রমণিকাতে মোস্ট পপুলার শো-টো বলে দর বাড়ানো চলল অনেকক্ষণ । চালু হল শো, টিভি'র ছায়ালোকের সঙ্গে বাস্তবের কায়ালোকের সেতুবন্ধন । মানে তেমনই প্রয়াস । এক দম্পতিকে আনা হয়েছে, আদালতে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদের মকদ্দমা চলছে । সূত্রধর গভীর সমব্যথায় তাঁদের ম্যারেড লাইফের ডিফিকল্টিজ সম্বন্ধে শুধাতে লাগলেন । প্রথম খানিক মামুলি ভণিতার পর শুরু হল আসল শরক্ষেপ । একে অপরকে যার-পর-নাই অভিযোগ আর যা-ইচ্ছা-তাই গালাগাল, তিন কূল কভার করে । সূত্রধর দু:খী মুখ করে সংযত হতে বলছিলেন বাদী-বিবাদীকে, ফর দ্য বেনিফিট অফ আওয়ার ভিউয়ার্স । বিতণ্ডা যখন তুঙ্গে তখন ছোট্ট বিজ্ঞাপন বিরতি এল এবং তারপরে স্টুডিওতে উপস্থিত দর্শকবৃন্দ প্রশ্ন করবেন দম্পতিকে, এমন লোভ দেখানো হল । বিনা প্ররোচনায় যা বিশ্রম্ভালাপ, উস্কানি পেলে কি হবে সেই ভয়ে চ্যানেল ঘোরালাম । ও, সূত্রধর প্রথমে বলেছিলেন আজকের অনুষ্ঠানের প্রেক্ষিত হচ্ছে, কন্সার্ন অ্যাবাউট গ্রোয়িং ম্যারিটাল ডিস্কন্টেন্ট ইন দ্য কান্ট্রি ।

    সোমবার ভোর থেকে সাজ সাজ রব । তিনটেতেই ঘুম ভেঙ্গেছিল উত্তেজনায়, আর আসেনি । যে বিজ্নেস ট্রিপে আসা, সেই ব্যবসার সঙ্গেই সাক্ষাৎ আজ । খুব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে দাঁড়ালাম নীচে মোমবাতিবনের পর্চে । এক সহকর্মী লিফ্ট দিলেন, ডাউনটাউন ফিনিক্স দেখতে দেখতে চললাম । ফিনিক্স শহরের বাণিজ্যিক অঞ্চলে এটা, উদ্ধত অফিস-কমপ্লেক্স সব চারিদিকে, মাথায় কেউই খাটো নয় । আহা উহু করাতে চালক বললেন, এ আর কি ! যেতে হয় নিউ ইয়র্কে, ম্যানহ্যাটান, বিশ্ব বাণিজ্যের হৃদযন্ত্র । আমি বললাম, আপনি, আপনি গেছেন সেখানে ? চালক কেমন অসাব্যস্ত হয়ে পড়লেন, লিফ্টের এমন প্রতিদান হয়ত ভাবেননি । বললেন, না..., মানে আমার জীজাজি কুড়ি বছর আছেন ওখানে ।

    আমাদের আফিসে পৌঁছনো গেল । অনেকগুলো সুড়ঙ্গপথের আস্তাবলে গাড়ি ভিড়িয়ে লিফ্টে চড়লাম । বাড়ি কুড়িতলা, আমাদের দপ্তর পাঁচতলাতে । আলাপ পরিচিতি জমে উঠল শিগ্গিরিই । এঘরে ওঘরে হানা দিয়ে করমর্দন গুচ্ছকয়েক, এই চন্দ্রবদন দেখে সকলেই দেখালেন ভীষণ খুশি । সবাই বললেন আমার আবির্ভাব কত, কত চেয়েছিলেন । শেষদিকে মনে হচ্ছিল ১৭৭৬ থেকে দেশটা চলল কেমন করে, আমা বিনা । আর সবাই জানালেন ভারত সম্বন্ধে তাঁদের বিভীষণ শ্রদ্ধা । কথার শুরুতে ওয়াও, মাঝে ওয়াণ্ডারফুল, শেষে গ্রেট । ভাবলাম, আলেকজাণ্ডার গ্রেটকে তবে এঁরা কি বলতেন । গ্রেট গ্রেট ?

    আমাদের ভারত থেকে আসা পদাতিক সৈন্যরা যে মহারথীর তলে, তিনি আসলে রথীনী, তবে শিখণ্ডীর বকলমে অম্বা নন, একেবারে চিত্রাঙ্গদা, তাও আবার সুরূপা । পি জি উডহাউসের নায়িকার মত নাম ও আর সব, নামটা ধরা যাক অ্যাঞ্জেলিকা । বয়সে চিরষোড়শী, হাসিতে পাহাড়ি ঝরনা । তাঁর মুখে গ্রেট, গ্রাণ্ড আর কু-উ-ল ফোয়ারার মতো ঝরত । অতিশয়োক্তি মার্কিনদের মজ্জার ভিতরে । আন্তর্যামী এতই দিয়েছেন যে খানিক ফাঁকা কথার বাজে খরচ গায়ে লাগে না । প্রথম প্রথম এই প্রশস্তির বাণ বইয়ে নেয়, নিজেকে যেন খুঁজে পাওয়া যায় নতুন করে, মন বলে ওঠে মনকে, ওর মধ্যে যে বিশ্বজয়ী জাদু আছে / ধরা পড়ুক তার রহস্য, মূঢ়ের দেশে নয় / যে দেশে আছে সমঝদার, আছে দরদি.... । এক সহকর্মী মাঝরাতে প্রায়ই দরজা ধাক্কিয়ে বলতেন, আজ ভেরি গুড বলেছে অ্যাঞ্জেলিকা, বা কোনোদিন, আজ ভেরি কুল । আমি বলতাম, বা: । শেষে একদিন আত্মহারা হয়ে বলে বসলাম, তখন সকলে বলিল বাহবা বাহবা বাহবা নন্দ বেশ । অ্যাঞ্জেলিকার স্নেহধন্য ছিলেন বাঙালি, তবে প্রবাসী, রায়েবেরিলিতে মানুষ, তাই রগড়টা ধরতে পারেননি, গদগদ হয়ে বলেছিলেন, থ্যাঙ্ক ইউ । যতদূর জানি পরবাসী নন, ভাগ্যিস !

    যাইহোক আমার অভিষেকের সময় দেবী বারবার বলেছিলেন, প্রীতিকম্পিত কন্ঠে, থ্যাঙ্ক ইউ ফর কামিং অ্যাট দিস টাইম অফ দ্য ইয়ার, দ্য ফেস্টিভ সিজ্ন । ওঁদের মহতী মোচ্ছবে আমারও পাত পড়বে জেনে ভীষণ গৌরব হয়েছিল. এই না হলে মেল্টিং পট অফ সিভিলাইজেশ্ন, দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে ! আসল পার্বণের গল্পে পরে আসছি ।

    আঞ্জেলিকার অঙ্গুলিহেলনে ফটাফট ব্যবস্থা হয়ে গেল আমার । চেয়ার টেবিল, কম্প্যুটার সবই বরাদ্দ প্রয়োজনের অতিরেকে, দশভুজা দেখিয়ে দিলেন ক্যান্টিনও । আমিও গম্ভীর মুখে বসে ভয়েস-মেইল চেক করতে লেগে গেলাম ।

    আগেও বোধহয় বলেছি, আমার অভিযান কলম্বাস সাহেবের মত শুধুই ইউজেনিক মোটিভ থেকে নয় । কিছু কোপন কারবারও ছিল । তাই যে বিজনেসের জেরে এই ট্রিপ, যেই বরে এত রোশনাই, তার কথা তো কিছু বলতে হয় । তবে আমি সাবধান হয়ে আছি, তাই বুঝে শুনে লিখব । হলিউডের বাঁধা-মাইনের গল্পকার যখন, ঠিক তখনই পি জি উডহাউস ছোট্ট কয়েকটা চুটকি ছেড়েছিলেন বাজারে । সেখানকার পরিশ্রম আর পারিশ্রমিক নিয়ে । কোঁদল কম হয়নি । ওনার টেকো মাথায় এমন দুর্দৈব নামত ঝমাঝম করে, প্রায়ই । জার্মান ব্রডকাস্টের কাজিয়ায় তো স্বদেশে ফেরাই বন্ধ হল চিরতরে । আসলে উনি বুঝতেন না সত্য হজম হতেও স্থান-কাল-পাত্রের ঠিকঠাক পাঁচন লাগে । এটুকু বোধহয় নির্ভয়ে বলতে পারি যে আমার কাছ থেকে কোনো অতিন্দ্রীয় প্রাচ্যতার নিদর্শন চাওয়া হয়নি, গ্রেট ইণ্ডিয়ান রোপ ট্রিক গোছের । মোটামুটি চেনাজানা কাজই করতাম এবং তা'তে আমার কোনো বিশেষ ব্যুত্পত্তি ছিল বলে তো মনে হয়না । যে-কোনো গড়পড়তা এস্কিমো বা হটেনটট যুবক সে-কাজ সমান সুষ্ঠুতায় করতে পারতেন । তাহলে কেন এমন সাগর পারের আমদানি ? উত্তরটা বুঝি গাণিতিক, আর তাই আমার নাগালের বাইরে ।

    সোমবারের পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে গিয়ে, কেন রে ওই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয় । একবার পেরিয়ে গেলে মঙ্গল, বুধ আর তত্পরের রেলগাড়ি চলতে শুরু করে ।

    দিনগুলো কাটতে লাগল বাঁধা ছকে, মার্কিন মৌতাতে মেতে উঠি ।

    আলো, বাতাস, জলের মতো এখানে দেখলাম একটা গাড়িও লাগে । আমযান বা পাব্লিক্‌ কনভেয়ান্সের ব্যাবস্থা ফিনিক্সে প্রায় নেই বললেই চলে । কয়েকটা ঘুম ঘুম বাস মাঝে মাঝে দেখি তবে তাদের দিয়ে তো আর বিজনেস ট্রিপ ওত্রায় না । রাজসিক রাস্তায় হাঁটতে গেলে পাশ দিয়ে হুস হাস করে চতুর্চক্ররা বেরিযে যান, মোটর গাড়ির চাকায় উড়ায় ধুলো, যারা সরে যায় তারা শুধু -- লোকগুলো । না: একটা বিহিত করতেই হয় ।

    অর্গানাইজেসন দেবেন খরচা, শুধু গাড়ি ভাড়া করার অপেক্ষা । তবে হ্যাঁ, আগে চালাতে শিখতে হবে । ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হলাম । একদিন থিওরি আর তিনদিন প্রাক্টিক্যালের তালিম নিয়ে অত:পর পরীক্ষা, টপকালে লাইসেন্স । প্রথম শনিবারই সকাল সকাল তৈরি হয়ে গেলাম তত্ত্বের ক্লাসে । শিক্ষিকা ক্লারা, ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার । বয়স বললেন সত্তর এবং রোজ হাঁটেন সাত মাইল । আমার মতো আরো অনেক ইন্দোপুঙ্গবদের দেখলাম চারপাশে, সপ্তাহখানেকের মার্কিন দ্যুতিতে দেদীপ্যমান । ক্লারা নানা স্লাইড সহযোগে শেখালেন গাড়োয়ানি, মাঝেমধ্যে করছিলেন রসময় সব ঠাট্টা । তার মধ্যে বেশিরভাগই খোদ মার্কিন রসিকতা, জল ছাড়া গেলা মুস্কিল, তবে একটির বৈশ্বিক আবেদন পেলাম । বললেন, আই হ্যাভ বিন ম্যারেড টু সো মেনি মেন, আই নীড অ্যান অ্যালবাম টু কীপ দেয়ার বিজনেস কার্ডস । সকলে বললাম, হা: হা: । পাশেই একজন হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন । রোড রুলস, পার্কিং সাইন ইত্যাদির গম্ভীর আলোচনা হয়ে গেলে ক্লারা কিছু সাধারণ জ্ঞান দিতে শুরু করলেন । নিয়মভঙ্গ ও তার সাজা প্রসঙ্গে বললেন, সিপাই-সান্ত্রীর পাল্লায় পড়লে প্রথমেই ভঙ্গি হতে হবে চৈতন্যমহাপ্রভুর মত, দুবাহু ঊর্দ্ধপানে । তারপরে তর্ক-বিতর্কে না যাওয়াই ভালো । কোনোরকম বেগড়বাঁই মনে হলেই ওঁরা গুলি চালাতে পারেন । এবং চালান । মনে হওয়াই যথেষ্ট । মনে পড়ল, বাবাদের মিশনারি স্কুলের এক পাদ্রীপিতা পরীক্ষার হলে ঢুকেই হুঁসিয়ারি হাঁকতেন, ওনলি ইফ আই থিঙ্ক ইউ আর চীটিং ..... । এখানেও তেমনি দেখছি । সবশেষের পাদটীকায় ক্লারা জুড়লেন, ইফ ইউ আর এনিথিং আদার দ্যান এ হোয়াইট মেল, বি কেয়ারফুল উইথ দ্য কপ্স । হাসিগুলো মুখ থেকে মুছে গেল, কেউ কেউ কব্জির কাছের জামা তুলে গায়ের রংগুলো আবার যাচাই করে নিলেন ।

    চাকার পিছে হাতেকলমে মহড়া শুরু হল, এবারের অধ্যাপিকা এলিজাবেথ । আমি করমর্দন করে বলেছিলাম, ফার্স্ট অর সেকেণ্ড ? উনি বললেন, অ্যাজ ইউ উইশ । শিখতে শিখতে মনে হচ্ছিল এর থেকে চাব্কে ঘোড়া হ্যাটানো সোজা নিশ্চয়, তাই না পার্থসারথি ওসব বিশ্বরূপটুপে নামতে পেরেছিলেন । তিন পিরিয়ড গলদঘর্ম ধস্তানোর আর কি বিবরণ দেব । গাড়িটাই আমার থেকে বেশি চালাক মনে হল, জানালা, দরজা, ওয়াইপার, এয়ারকণ্ডিশনার সবই অটোম্যাটিক, ঘচাং ঘচাং করে গিয়ার মারারও বালাই নেই, একটু চাপড়ে দিলেই পক্ষীরাজের মতো ছোটে । পরীক্ষাটাও পাশ করেছিলাম মহারানীরই দাক্ষিণ্যে, এলিজাবেথের চা খুব পছন্দ, আশা দিয়েছিলাম পরেরবার নিয়ে আসব খোদ দার্জিলিং টী, ওনার জন্য ।

    অধ্যাপনার ফাঁকে ফাঁকে আটপৌরে গল্পের ঝাঁপি খুলতেন এলিজাবেথ । তিন দশকের ওপর গাড়ি চালাচ্ছেন, পেশা ও নেশা । আগে চালাতেন বৃহতাকার আঠারোচক্রী ট্রাক, দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে । এখন আর অতদূর যান না, একানব্বই বছরের বৃদ্ধা মা'র দেখাশোনা করতে হয় । সারথ্য একটা শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছেন, ওনার গাড়ি চালানো যেন বেহালার ছড়ে টান । এক ছেলে এক মেয়ে, পড়ছে, তাদের খরচ উনিই জোগান । মেয়ে গোয়িং স্টেডি, ছেলেও । কথায় কথায় একদিন হঠাৎ বললেন, মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে থাকতেই উনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন । আমার সচকিত কেন'র আগেই এল কৈফিয়ত, ডটার-ইন-ল'স থিঙ্ক মাদার-ইন-ল'স এনক্রোচ ইন দেয়ার স্পেস । এলিজাবেথের বয়স পঁয়ষট্টি ।

    পিছনে ক্যামেলব্যাক মাউন্টেন, সামনে বহুতল গাড়ির আস্তাবল
    লাইসেন্স পেয়ে গাড়িভাড়া করতে গেলাম । বিরাট ডিপোতে সার সার যন্ত্রযান, যেটা খুশি বেছে নাও । সঙ্গে একজন প্রাজ্ঞ বন্ধু ছিলেন, তিনিই চয়েস করে দিলেন । থাকাকালীন ক'মাস, নড়বড় করে চালিয়েছি নানা গাড়ি । প্রত্যেক দুহপ্তায় বদল করে নিতাম, তেমনই চুক্তি । প্রাজ্ঞ বন্ধুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা এই ভাড়ার গাড়ি কেউ চুরি করে নেয় না, ভেগে গেলেই তো হল, তারপর নাম্বার প্লেট ঘষেটষে... । বন্ধু বললেন, তোমার যেমন চিন্তা, এখানে গাড়ি পুরোনো হলে বিড়ম্বনা, ফেলাও যায় না, গেলাও যায় না, তাই চুরি করার দায় বা রোমাঞ্চ কোনোটাই নেই ।

    আমার গাড়ি চালানোর ইতিহাস, চালাতে শেখার ইতিহাসের থেকেও ছোট করে দেব । প্রথম প্রথম নিরাপত্তার তাড়নায় রাস্তার বাঁদিকে চলে আসতে চাইতাম, অন্য আরোহীরা গেল গেল করে উঠতেন । গাড়ি ভাড়া নিয়ে প্রথম দিন, ব্যাক্‌ করতে গিয়ে মোমবাতিবনের বাগানে একটা গাছকে মেরেছিলাম কোনাকুনি । মহীরুহ নয়, ছোকরা টাইপের, তাই বেচারা একেবারে ধরাশায়ী হয়েছিল, গাড়িতে আঁচড় নামমাত্র । তাও নিয়মাতিক্রম মানতে হয়েছিল ভরপুর, ৯১১ ডেকে পুলিশ আনিয়ে স্বীকারপত্র লিখতে হল । আমার দোষটা নেহাৎ মামুলি, অ্যাক্সেলেরেটর আর ব্রেক গুলিয়ে ফেলেছিলাম । খেদ থেকে গেছে, কার নিয়ে ছবি তুলিনি নিজের । সহকর্মীরা সবাই তুলে দেশে বিস্তর বাহবা কুড়িযেছেন । আমি জেদ ধরেছিলাম, গাড়ির সাথে ঘোড়াকেই মানায় বেস্ট, অতএব ... ।

    ট্যাঁকে টান পড়তে যেতে হল ব্যাঙ্কে, ট্রাভেলার্স চেক ভাঙাতে । ব্যাঙ্ক অফিসের ঠিক উল্টো দিকে, মাঝে জবরদস্ত রাস্তা । এক সহকর্মীর সাথে গিয়েছিলাম, তিনি জেব্রা ত্রক্রসিং দিয়ে দেখি গট্গট্‌ করে চলেছেন পরপারে, আমাকেও টানছেন । গাড়িগুলো ধেয়ে আসছে উল্কার গতিতে, আমি তো কাঁটা । আমাদের দেখেই ক্যাঁচ করে থেমে গেল কাছের যানগুলো, সহকর্মী চালকদের অভিভাষণ জানালেন ঘাড় নুইয়ে । জেব্রা ত্রক্রসিং'এ পেডেস্ট্রিয়ানদের রাইট অফ ওয়ে, তাও ঝুঁকে ধন্যবাদের রীতি । যাক, আরেকটা আদবকায়দা শেখা গেল ।

    ব্যাঙ্কে এমন খাতির পেলাম, নিজেকে বেশ অযুত-বায়ু গ্রস্ত লাগছিল । ভাঙাবোতো সামান্য কয়েকটা ট্রাভেলার্স চেক্‌, তা'তেও ওঁদের যত্নের খামতি নেই । কাস্টমার ইজ দ্য কিং যেখানে, সেখানের ক্রেতা হওয়ার সম্মান চেটেপুটে নেওয়া যাক । কাজ হয়ে গেলে বিদায়ের সময় ওঁরা বললেন, প্লিজ কাম ব্যাক ফর এনি মোর হেল্প । আমি ভাবলাম, আহা মুখ ভেঙে যদি একবার চেক ভাঙতির উপরি কিছু চাইতাম, ওঁরা বোধহয় তাও দিতেন, যা চেয়েছো তার কিছু বেশি দিব, বেণীর সঙ্গে মাথা ।

    আমেরিকাতে শুনেছিলাম খাওয়াদাওয়াটা ব্যাপক । আমার খাদ্যবহর বিরাট নয়, তবে আয়োজন ভাল হলে মন্দ লাগে না । সকালে কোনোমতে দুধ-কর্নফ্লেক্স গিলে অফিসে আসতাম, দুপুরে বাইরে ফাস্টফুড । ম্যাকডোনাল্ড, বার্গারকিং প্রভৃতি নানা বিশ্বখ্যাত পতাকা চারিদিকে, যে-কোনো একটাতে ঢুকে পড়লেই হল । সব খাবারই মাংসে থই থই, গরু-ভেড়াই প্রধান, তার ওপরে চীজ মাখন চড়িয়ে একটা টৈটম্বুর ব্যাপার । আমার মা প্রগতিশীলা, দেশ ছাড়ার আগে 'ম' সংক্রান্ত কোনো গান্ধীয় শপথ করিয়ে নেননি, তাই সব মাংসই চাখলাম । প্রথম প্রথম মন্দ লাগত না, তবে একঘেয়ে লাগে একটু পরেই । সব পদেরই স্বাদ এক, যেন এসেমব্লী লাইনের ছাঁচেঢালা নাটবল্টু । আহা, এরা জানলই না, দিদিমার হাতের আদামাছের সেই স্বকীয় মোচড় ।

    তবে খাবার খুব সস্তা । এঁদের অল্প ক'টাকাতেই হৃদয় ও উদর, দুয়েরই পূর্তি মেলে । এইসব জায়গার রেওয়াজ সেল্ফ সার্ভিস, দাম চুকিয়ে, কুপন কেটে লাইন দিয়ে খাবার নাও ; আপনি-আজ্ঞে করে কেউ পাত পাড়বে না । পরিবেশিত হয়ে খেতে গেলে দাম হবে চড়্চড়ে । একজন বুঝিয়ে দিলেন, র'মেটিরিয়ালস আর চীপ, লেবার ইজ্‌ ডিয়ার । আমি বললাম, তা যা বলেছেন ।

    রাত্রে ফিরে এসে রান্না করতাম মোমবাতিবনে । হাঁড়ি-ঢাকনা-কড়া-খুন্তি সবেরই সাহেবি সংস্করণ ছিল, মাইক্রোওয়েভ বা গ্রীলে জ্বলনশক্তি । ডালে ঝোলে অম্বলে কিছু একটা বনত, পাকযন্ত্রের প্রদাহে রসনার বিদ্রোহ থাবড়ে যেত রোজ, এই যা রক্ষা । এক একদিন মুর্গির স্ট্যু ট্রাই করেছি, খানিকটা করে ফ্রীজে রেখে দিতাম, অসময়ে কেউ জ্বালাতে এলেই তাকে গেলাতাম, প্রতিষেধক কখনও নিরাশ করেনি । এতদিন পরে বুঝলাম মা কত ভাল রাঁধেন । এবং এও বুঝলাম যে রান্নাটা শুধুই ছ্যাঁকছোঁক নয়, তার পেছনে লাগে কত পরিকল্পনা, পরিশ্রম আর প্রীতি ।

    সপ্তাহে দুবার করতাম বাজার । বাজার মানেই যে শুধু চেক লুঙ্গি পরে থলি হাতে চারাপোনা আর পালংশাকের আঁটি উপড়ে আনা নয়, আরও সাব্লাইম কিছু, তা এবারে বুঝলাম । এঁদের সুপারমার্কেট হচ্ছে আমাদের হাটের ঠাকুর্দা আর বাজারের বাবা । ফুটবল মাঠের মতো হলঘরে লক্ষ পণ্যের পসরা । আলপিন থেকে জাহাজ পর্যন্ত সবই পাওয়া যেতে পারে । খাবারের দিকে গেলে আকুলিবিকুলি করে ওঠে মনটা, কত কাল রবে বল ভারত রে, শুধু ডাল ভাত জল পথ্য করে ? আমার একবার মাখন কেনার তাল ছিল । একজন পরিচারককে মিনমিন করে বলতেই উনি বললেন, অ্যাট দ্য জাংশন অফ ফিফথ রো অ্যাণ্ড ইলেভেন্থ কলাম । এ যেন ল্যাটিচি-লঙিচি মিলিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর জরিপ । যাইহোক, উক্ত পীঠস্থানে গিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেল, চোদ্দরকম মাখন, ননীগোপালও ঘাবড়ে যেতেন । ৫.৬৭% ফ্যাট, ২.১% ফ্যাট, এত ক্যালরি, অত ক্যালরির সূক্ষ্ম সব ক্যালকুলেশন ।

    অনেক গবেষণার পর যেটা নিয়ে এসেছিলাম, সেটা দেখে রুমমেট বলে উঠলেন, আহ ! এটা আনলে কেন, লো-ফ্যাট তো, মোটা না-হয়ে দেশে ফিরলে কি করে হবে ? লোকে বলবে কি ? তারপর থেকে বাজার উনিই করতেন, অনেক টিপেটুপে নেড়েচেড়ে, হাজারের মধ্যে একটি মুর্গির দাপনা বাছাইয়ের স্বর্গসুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছিলাম সক্লেশে । এই রুমমেট ছিলেন বেশ মজার লোক, অবসর সময় কাটাতেন শপিং মল'এ ঘুরে ঘুরে, বলতেন ভীষণ ভাল লাগে সব দেখতে পারছি বলে, আবার ভীষণ খারাপও লাগে সব কিনতে পারছি না বলে । একদিন একটা ঝকমকে সার্ট কিনে এনে দেখালেন, গৌরচন্দ্রিকায় বলেছিলেন, অ্যামেরিকান জিনিস, জাতই আলাদা । খানিক পরে কোণের দিকে আটকানো চিরকুট বেরোলো, মেড ইন বাংলাদেশ । গ্রাণ্ড ক্যানিয়নের সূর্যাস্তের সময় ইনি বলেছিলেন, এই শপিং মল'এর অপূর্ণ আকাঙ্খাই ওঁকে এগিয়ে নিয়ে যাবে । আমি ভাবছিলাম, ভাগ্যিস উনি এ-যাত্রায় সব নিতে পারছেন না, তরীতে গেদে সোনার ধান লাদাই করতে গিয়ে চাষির নাকাল হবার কি একটা গল্প আছে না ? তবে অবশ্য এনার অবশেষ সংগ্রহ নেহাৎ মামুলি ছিল না । দেশে ফিরেছিলেন ঝুড়িভরা চকোলেট ইত্যাদি, আর খানদানি অ্যাকসেন্ট নিয়ে । অপছন্দের কথা হলে বলতেন, ওঁ রিঁ-য়ে-লীঁ-ই, আর পছন্দের, দ্যাঁ-ট-স কুঁ-উ-ল । বছরখানেক ছিল পোঁচটা, তারপর অবশ্য সন্তোষ অসন্তোষ দুইয়ের সাথেই শ্যালক সম্বন্ধ পাতাতেন, যথাপূর্বং ।

    মোমবাতিবনে ঘরকন্নার সব উপাদানই ছিল, তবে আপনা হাত জগন্নাথ । বাসন মাজা, কাপড় কাচা সবেরই মেশিন আছে, কিন্তু ইচ্ছা আর উদ্যোগটা জোগাতে হত । রবিবার সকালে বাড়িতে বাবা জুতো পালিশ করতেন, আমাকেও ক্লাস ওয়ান থেকে করতে হত নিজের পাদুকা পরিচর্যা । এমন অসম্মানীয় কাজ আমার ছ'বছরের দম্ভে বড় বাজত, একদিন প্রস্তাব করেছিলাম, জুতো পালিশের একটা মেশিন কিনলে হয় না ? বাবা মুচকি হেসে বলেছিলেন, তখন মেশিনটা চালাতে ইচ্ছা করবে তো ? তারপরে রগড়টা আরেকটু চড়িয়ে বলেন, জুতো পালিশ ভাবলেই জুতো পালিশ হয়ে যাবে, তেমন মেশিন হলে, বেশ হয়, না ? আমার মুখে আর হ্যাঁ সরেনি । তারপর থেকে নিবিষ্ট মনে ন'টিবয়'তে কালো পোঁচড়া লাগাতাম, টুঁ শব্দ না-করে । এই শিক্ষাটা কাজে লাগত যখন সাড়ে দশটার সময় মোমবাতিবনে ফিরে দেখতাম এঁটো বাসনের ডাঁই আর কালকের জন্য একটাও ফর্সা পোশাক নেই ।

    মোমবাতিবনে চাকর-দাসীর বহর খুব কৃশ । সপ্তাহে একদিন ঘর পরিষ্কার করতে আসতেন পরিচারিকাবৃন্দ । এঁরা বেশিরভাগই মেক্সিকো অঞ্চল থেকে আগত, বাদামি গায়ের রঙ, ল্যাটিনো । কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ । এমন কাজে অন্য বর্ণ দেখিনি কখনও ।

    এই বাদামি মানুষদের রাস্তায় দেখে এক সহকর্মী ক্ষেপে উঠতেন । সব্বাইকে মামাশ্বশুরের ভাগ্নে ডেকে বলতেন, দে আর দ্য রুট অফ অ্যামেরিকাস ট্রাবলস্‌ । সাদার সাথে অ-সাদার মিশেল বুঝি ওঁর ভালো লাগত না । এই সহকর্মী একবার হ্যামবার্গার সাঁটানোর সময় আমাকে বলেন, সী মি ইন ইণ্ডিয়া, একদম ইণ্ডিয়ান, সী মি ইন ইউএস, একদম ইউএস । আহা, দ্বিজাতিতত্ত্বের এমন ফলন জিন্না সাহেব দেখে গেলেন না ।

    মোমবাতিবনের নিজস্ব স্যুইমিং পুল ছিল । অধিবাসীরা অনেকেই ঝাঁপাঝাপি করতেন, আমারও ইচ্ছা হত ঢাকুরিয়া লেকের তালিম ঝালিয়ে নিতে । তবে সাঁত্রাতে গেলে গায়ের রঙটা বড্ড বেশি বেরিয়ে পড়বার ভয়ে আর নামিনি, শেষ পর্যন্ত । রুমমেট নামতেন, সাঁতারুবেশে ছবিও তুলিয়েছিলেন আমাকে দিয়ে, বলেছিলেন ব্যাকগ্রাউণ্ডটা ঠিকঠাক আনতে ।

    শহরের অলিতে-গলিতে আরেক ব্যবস্থার সন্ধানে আমাদের অনেকে হন্যে হয়ে ঘুরত -- ইণ্ডিয়ান স্টোর্স । ভারতীয়ত্বের স্তম্ভ বিশেষ, বিস্তর বিক্রিবাটার আয়োজন, মশলাপাতি, ফোড়নটোড়ন থেকে শুরু করে, চ্যবনপ্রাশ হয়ে সটান মাধুরীদেবীর শেষ হিটে ।

    রাত্রে খেয়ে দেয়ে বায়ু সেবনে বেরোতে সাহস হত না, পায়ে হেঁটে । পাশের রাস্তায় খুনের খবর পেতাম মাঝেমধ্যেই । এখানে আলো, বাতাস, স্বরাজের মতো আগ্নেয়াস্ত্র রাখাও শ্যামখুড়োর দেওয়া ইনঅ্যালিয়েনেব্কল রাইটস্‌'এর ভিতর পড়ে । তাই স্বসম্মানের প্রতিষ্ঠার্থে সহজেই গোলাগুলি চলে । যেসব বিবাদ আমরা বাপান্ত করেই মিটিয়ে নিই, সেগুলোর সমাধানে এখানে বন্দুক ও আক্কেল দুইই গুড়ুম হয়ে যায় -- হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব । এই গান-কন্ট্রোল নিয়ে কিচিরমিচির মাঝে মাঝে শুনতাম টিভিতে ।

    শ্যামখুড়োর সাম্রাজ্যে অ্যাড্ভার্টাইজ্মেন্ট হল, যাহা কিছু আছে সকলই ঝাঁপিয়া, ভুবন ছাপিয়া, জীবন ব্যাপিয়া । খোলা বাজার, তাই সবই খোলামেলা । ধনতন্ত্রের আইডিয়াল ব্যাবস্থা তো পার্ফেক্ট কম্পিটিশান আর তার জন্য তো চাই পার্ফেক্ট নলেজ, তাই পসরা সাজালেই শুধু চলে না, সব্বাইকে জানানোও চাই । চকোলেট, দুধ, গাড়ি, ঘড়ি ইত্যাদি মামুলি জিনিস বিক্রীত হচ্ছে যেন চাঁদের টুকরো । আহার-নিদ্রা-মৈথুনের আরো অনেক গহন ব্যবহার্যেরও বেআব্রু হাট । সবেরই দ্রব্যীকরণ হয়ে গেছে, ঝকমকে মোড়কে ভরে জনগণকে খাওয়ানো

    কয়েকটি বিশেষ সার্ভিসের বিজ্ঞাপন খানিক উচ্চকিত করল । রাজপথের পারে বিরাট সাইনবোর্ড -- কুইক্‌ ডিভোর্স ডট্‌ কম, দ্য ওয়ান স্টপ্‌ ডিভোর্স শপ্‌ । অসহ্য বিবাহপাশ আর না সহ্য করে সত্ত্বর চলে আসবার আর্জি, ওঁদের কাছে । ওঁরাই গাঁটছড়ার গিঁটছেঁড়ার সব হ্যাপা পোয়াবেন । বিলবোর্ডের তলে নিয়ন আলোর জ্বলজ্বলে পাদটীকা, ডিভোর্স হ্যাজ্‌ নেভার বীন সো ইজি । মিলন ছোঁয়া বিচ্ছেদেরই অন্তবিহীন ফেরাফেরি / কাটিয়ে দিয়ে যাও গো নিয়ে, আনাগোনার ধারে । টিভি খুললেই ডেট্‌ কনসলিডেশনের জন্য পীড়াপিড়ি । নানান সংস্থা, ডাক ছাড়ছেন দেউলিয়াদের । বিভিন্ন ক্রেডিটকার্ডে যাদের পাহাড়প্রমাণ দেনা, তাঁদের বরাভয় দিয়ে বলছেন, আমাদের কাছে এস, সব ধার-পাওনার আগাছা কেটে একটা ছোট্ট গাছ পুঁতে দেব, তাতেই রোজ একটু করে জল দিলে চলবে । তোমাদের দুর্ভাবনা আমরা ভাবছি, তোমরা ফূর্তি কর । ক্রেডিটকার্ড চাগিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিলে, ও: ঠিক আছে, ছোটবেলায় ওরকম একটু হয় । ভেব না সব ঠিক হয় যাবে, আমরা তো আছি । আরেক হচ্ছে জমাট হাট পরমার্থের । ট্যারট রীডিং, ক্রিস্ট্যাল বল গেজিং ইত্যাদি নানা ভেল্কির বাজার । ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান হাতের তেলোতে নাচানোর আহবান । একদিকে টেক্নোলজির হুহুঙ্কার অন্যদিকে মিহি সুরেলা গলায় অলৌকিকের ঝালা । বিশ্ববিপদহন্তা, ভক্তবাঙ্ছাকল্পতরুরা সব দোকান দিয়েছেন, বাইরে সাইনবোর্ড -- ইউ ক্যান্‌ বি দ্য মাস্টার অফ ইওর ডেস্টিনি । ছুটছে লোকে চারিদিকেতে, ঝরছে ডলার ঝনঝন ।

    একদিন অফিসে ফোন সকাল সকাল, সমুদা । ইডাহো না ওহাইও কোথায় একটা থাকেন শোনা যায় । রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রিসার্চী, তবে ওনার গবেষণা অনেক বিষয়েই ।

    -- কি রে ? কেমন আছিস ? মোটা হলি ?

    -- তুমি জানলে .....

    -- হুঁ হুঁ, সব জানি, কবে কোন এয়ারওয়েজ ক্লায়েন্ট কে কতদিন সব, সব, আমাকে জানাসনি তো.... ।

    ওনাকে জানানো হয়নি অপিচ উনি জেনে গেছেন, এমন বিশ্বঘটনায় সমুদার শ্লাঘার শেষ থাকে না, চিরকালই ।

    -- তা বল, দেশের খবর কি, কলকাতার ?

    -- খবর আর কি, গড়িয়াহাট মোড়ে ফ্লাইওভার হবে হবে হচ্ছে ।

    -- আচ্ছা ছোটকু-মামা আর সুমিতা-মামীর ব্যাপারটা কতদূর গড়ালো, একদমই কি কাট হয়ে গেছে ?

    -- ঠিক জানি না ।

    -- কি হল বলত আসলে, দেখে তো বেশ হ্যাপি হ্যাপি লাগত ? আমি তো শুনলাম ছোটকু-মামা ওঁর স্টেনোর সঙ্গে দীঘা যাওয়ার পর থেকেই নাকি ফাটাফাটি শুরু হয় । অবশ্য আমাদের সুমিতা দেবীও তো ওয়াস্ড্‌ তুলসী নন, তিনিও নাকি বস'এর সঙ্গে লটরম পটরম, টিটো হবার আগে থেকেই, অনেকে তো বলে .... ।

    -- বাদ দাও সমুদা, একটু তাড়া আছে আমার ।

    -- আরে রাখ, তাড়া ! সফটওয়ারে এসে লায়েক হয়েছিস । অ্যাই জানিস তো, বিল্টুর গার্লফ্রেণ্ড না, সিনসিনাটিতে এসেছে । সেয়ানা মেয়ে, জার্মান গাইডের সঙ্গে যা চালাচ্ছে । আবার একটা তামিল ছেলের সঙ্গে রুম শেয়ার করে । আর বেচারা বিল্টু, ভূপালে হ্যাদাচ্ছে, মাঝে নাকি চাকরি গিয়েছিল । মেয়েটাকে তুই চিনিস তো, সোনালি না রুপালি কি একটা নাম, দিদির বিয়েতে এসেছিল ।

    -- না চিনি না ।

    -- আচ্ছা তোদের সফটওয়ারে রিশেসন আসছে না ?

    -- তেমনই তো শুনছি ।

    -- ডলারগুলোকে ভাঙাস না কিন্তু এয়ারর্পোটে নেমে । আমি তোকে একটা ঠিকানা দেব, বড়বাজারে, মার্কেট রেট থেকে আড়াই টাকা এক্সট্রা দেয় । রুপি ডলার এখন কত যাচ্ছে রে ?

    -- টাইম্স্‌ অফ ইণ্ডিয়ার সাইট'টা খুলে দেখে নাও, লেটেস্ট রেট পাবে ।

    -- তুই ভাবিছস আমি জানলাম কি করে, তুই এসেছিস ?

    -- না না, ভাবব কেন, তোমার যা সোর্স ... ।

    -- আরে না না, আসলে আমার এক্স-রুমমেটের ভায়রা থাকে উইস্কন্সিনে । তার খুড়শ্বশুরের শালা তোদের অফিসের বিগ বস । এই চ্যানেল দিয়েই তোর খবর পাই, মানে এই পেলাম আর কি, ফোন নাম্বারও পেলাম ফিনিক্স অফিসের ।

    মাথাটা কিরকম ভোঁ ভোঁ করল, সমুদা, তার এক্স-রুমমেট, তার(এক্স-রুমমেটের) ভায়রা, তার(ভায়রার) খুড়শ্বশুর, তার(খুড়শ্বশুরের) শালা -- এই না হলে জগত্‌-জোড়া-জাল !

    ক্রিস্টমাস আসন্ন, চারিদিকে উত্সবের আমেজ । শুকনো আপিস কাছারিতেও ঝলমলে ক্রিস্টমাস ট্রী, হাসিমুখে ঝুলিকাঁধে দাড়িদাদু । বাড়ির বাগানে আলোর রোশনাই, পাহাড়ের নিকষ কালো গায়েও কনিণিকার চিক্চিক্‌, প্রিয়ার হঠাৎ চাওয়ার মত । যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো / জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে...-- এ বুঝি চিরন্তন উত্সবের বৈতালিক, দেশে কালে পাঠান্তর হয়, কিন্তু কোথাও একটা একই ।

    এই ফেস্টিভ সিজন্‌ উপলক্ষে নানা ছোটবড় সমাগমে আমন্ত্রণ আসত । একজন বড়কর্ত্রী আসতে বললেন তাঁর বাড়িতে, একদিন সান্ধ্যআলাপ, অত:পর নৈশভোজ । ই-কার্ডে সুন্দর লাল-নীল হরফ, রঙীন বেলুন ফিতের ছবি, নিমন্ত্রণবাণী আর শেষে সুখাদ্যের ফিরিস্তি । শহরের বাইরে পাহাড়ের কোলে অতি সম্ভ্রান্ত পাড়া, সার সার বাংলো রাস্তার দুধারে । রুচি ও আভিজাত্যের নিশান উঁচু করে টাঙানো । ফটক থেকেই গৃহস্বামীন আপ্যায়ন করে নিয়ে গেলেন নুড়ি বেছানো পথ দিয়ে । সুচর্ব্য ও সুপেয়ের প্রতুল সমাগম, অতিথিও অল্প নয় । বাগান থেকে ফিনিক্স শহর চুমকি-মোড়া স্বপ্ন মনে হয় । দিনের বেলা ফিনিক্সের মতো একঘেয়ে জনপদ অল্পই আছে, শুধুই সোজা রাস্তার ছক আর ইমারতের বড়াই । তবে রাত্রি আর দূরত্বের মিশেলে এ এক অন্য রূপক । হাতে একটা সাম্মানিক গেলাস নিয়ে নিসর্গলেহী মুখে দাঁড়িয়ে আছি, কানটা আসলে আশপাশের কথা-উপকথার দিকে । আমরা দেশিরা কাছাকাছি আছি, ঘেঁষাঘেঁষিতে স্বস্তি ঢের ।

    -- কেমন দাম ববে বলত বাড়িটার .... ।

    -- দু-তিন মিলিয়ন তো বটেই, কত মাইনে পায় বল ... ।

    -- বাথরুমটা দেখেছেন, আল্টিমেট... আমি কয়েকটা ছবি তুললাম, বউকে দেখাব, আঁচ করেই ক্যামেরাটা এনেছিলাম ... ।

    -- মুঝে ভাগওয়ান কব্‌ অ্যায়সে ছপ্পড় ফাঢ়কে দেগা.... ।

    -- আনথিঙ্কেব্ল, হ্যাভিং ডিনার অ্যাট দিস্‌ হাউস .. আই.. ।

    খাওয়াদাওয়া বুফে । আমি দ-ংউতিন রকম পশু ও পাখি চেখে দেখলাম, সুস্বাদু আর সুসিদ্ধ । প্লেট হাতে নিয়ে খেজুরে আলাপ, সাদা কালো বাদামির মিশ্রণ এবার আর ডেলা পাকিয়ে নেই । ভারত এত ভাষার দেশ আবছা শুনেছিলেন এক শ্বেতাঙ্গিনি, চেখে নিতে চাইলেন । আমাদের কয়েকজনকে বললেন, মেরি ক্রিস্টমাস্‌ টু ইউ, তর্জমা করে বলতে, নিজের ভাষাতে । বাংলা, পাঞ্জাবি, তামিল, হিন্দি, ওরিয়াতে আবৃত্তির পর আমি সুযোগ বুঝে ঝাড়লাম, বেঙ্গলি ইজ্‌ স্পোকেন বাই ফোর্থ লার্জেস্ট নাম্বার অফ পিপ্ল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড টুডে । শ্বেতাঙ্গিনি বললেন, রিঅ্যালি.. । স্বদেশিরা অবিশ্বাসের ঢঙে হাসলেন । একজন চালাকি ধরার যোশে ফুট কাটলেন, বাট দ্যাটস্‌ টেকিঙ বাংলাদেশ টুগেদার, হা: হা: । ওনার টনটনে জ্ঞান দেখলাম এপার আর ওপার বাংলার হিসেব নিকেশে । হিস্টরি অফ দ্য ইংলিশ স্পিকিং পিপ্ল যে ধারণায় লেখা, সেসব কথা আর তুললাম না । হুইস্কি টানছিলেন, বিষম খেতেন । আর তাছাড়া ভদ্রলোক বাঙালি, বলেন কলকাতার আদত বাসিন্দা, জোব চার্ণক নাগাদ থেকে বাস, ওঁর পরিবারের ।

    উদ্বাহ, বিচ্ছেদ, প্রজনন প্রভৃতির আলাপে মার্কিনদের দেখলাম সরল অসঙ্কোচ । আমাদের ঊর্ধ্বতন এক সহকর্মী স্ত্রী ও শিশুকন্যা অহনাকে নিয়ে গিয়েছিলেন । নিমন্ত্রিত এক মার্কিন ভদ্রমহিলার সমবয়সী দুহিতার সাথে অহনা মেতে উঠেছিল খেলায় । ভদ্রমহিলা হঠাৎ বলে উঠলেন, আই ওয়াজ ডিভোর্সড্‌ লাস্ট ইয়ার, হাই নাইস ইউ আর হ্যাপিলি ম্যারেড, প্ল্যানিং এনি মোর কিড্স ? ঊর্ধ্বতন থতমত খেয়ে গিয়ে আমতা আমতা করে, লেট আস সি, গোছের কি একটা বলতে লাগলেন আর তস্য পত্নী, আঁচলের সলজ্জ পাকে-বিপাকে জড়িয়ে পড়লেন । আর আমরা নিবিষ্ট মনে অ্যাকুইরিয়ামের মাছের লীলা দেখতে লাগলাম ।

    সহকর্মীদের যাওয়া-আসা লেগেই থাকে -- সকলের দ্বীপান্তর যাবজ্জীবন নয় । ফেরার সময় সবাই বলেন, আবার আসব তো ? আবার কেউ কেউ নতুন আসেন, ফীলিং ভেরি গুড অ্যাবাউট দেমসেল্ভ্স । দেশাচারের অভাব নেই চারপাশে, ভারতীয়ত্বের উপাদান যথেষ্ট ।

    একদিন এক সহকর্মী বললেন, চল মন্দিরে যাওয়া যাক । আমি বললাম, এখানে ... । উনি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ চল না, বিরাট ব্যাপার, কাছেই .. । তারপর এমন ধর্মায়ণের কৈফিয়ত শুনিয়ে আমায় আরও চাড় দিতে গেলেন, বললেন, আমি প্রতি দুহপ্তায় ঠাকুরকে পুজো দিয়ে আসি, এত রাইজ্‌ করেছি, এমন ডলার কামাবো তো ভাবিনি কখনও, বেশি না, এক ডলারেই ভাল পুজো দেওয়া যায়, এটা উচিত, ঠাকুরের দয়াতেই তো সব । আমি বললাম , যা বলেছো । এমন বাগ্মীতায় টলে গিয়ে, সুড়সুড় করে চড়ে বসলাম গাড়িতে, বন্ধু চালালেন । সারা পথ শোনালেন ওঁর জীবনের নানা কার্য-কারণের পরম্পরা, কত স্ট্রাগ্ল করে আজকের এখানে পৌঁছেছেন ; সাইকেলে করে স্কুলে যেতেন, এখন হণ্ডা হাঁকাচ্ছেন -- ঠাকুরের দয়াতেই তো সব । নিশ্চিত প্রমাণ হয়ে গেল, দেহ-মন-প্রাণ-ধন সবই তাঁরই দান । একেবারে কিউইডি ।

    শহরের উপান্তে দেবালয়, বেঁটে ছাদ-ওয়ালা বাগানবাড়ি, শুনলাম শীঘ্রই চূড়া-ওয়ালা মঠ বসবে, টাকা তোলা চলছে । যে গোষ্ঠির আয়োজন, তাঁরা বিশ্বব্যাপী সক্রিয়, কলকাতাতেও বিশেষ পার্বণ-টার্বণে এঁদের মিছিল দেখা যায় ।

    ভিতরের হলে কীর্তন চলছে, ইতস্তত ছড়ানো ভক্ত ও ভক্তিরা । বিগ্রহের দিকে তেমন আগ্রহ দেখলাম না কারোর, সকলেই চক্ষু মুদে তালিতে ধুয়ো তুলছেন । সহকর্মী সটান সাষ্টাঙ্গে শায়িত, তারপের রসিদ কেটে এক ডলার দিলেন, পরে পুজো দেওয়া হবে সব দক্ষিণা একত্রে । আমি ইতি-উতি চাইলাম, একটা বোর্ডে আবেদন প্রত্যেক রবিবারের নৈশভোগ স্পন্সর করার । দেবদাক্ষিণ্য তো মিলবেই, তার উপর বোনাস হিসেবে নামও ঘোষিত হবে, স্পন্সর করলে । কীর্তনের হোতা একজন, ধরতাইয়ের জন্য অনেকে, সংগতে দিগন্তবিস্তৃত সিন্থেসাইজার, আর হাওদা ড্রাম । গায়ক বদলাচ্ছেন, এক শ্বেতাঙ্গ অনেকগুলি স্বরচিত গান গাইলেন, সবকটিতেই একই চারটি ছত্রের নানা অলিতে গলিতে মাতাল ভ্রমণ । প্রতি গান শুরুর আগেই বলছিলেন, কেমন ভাবে এই ইণ্ডিয়ান অধ্যাত্ম তাঁকে দিয়েছে, পীস্‌, পীস্‌, গ্রেট গ্রেট পীস্‌ । ফিনিক্সের অনেক হোমরাচোমরা ভারতীয়দের চিনিয়ে দিলেন সহকর্মী, তাঁর দ্বিসাপ্তাহিক ধর্মাচরণ পরিচিতির পরিধি বাড়িয়েছে । আমীর-ওমরারা সকলেই দিব্যোন্মাদ হয়ে তালে তালে মাথা দোলাচ্ছিলেন, একজনের নাম জ্বলজ্বল করছে বোর্ডে, নাতির জন্মদিন উপলক্ষে একশো এক ডলার দিয়েছেন, নৈশ-ভোগের খাতে । শেষে চলে আসবার সময় এক চোমরার সাথে আলাপ হল, বললেন এই মার্সিডিজ্টা গত সপ্তাহেই কিনেছেন । আলাপ করালেন স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গে, একদিন আসতে বললেন, যদিও স্কট্সডেলের বাংলোটা নতুন, এখনও ঠিক গুছিয়ে বসতে পারেননি । তবে ওনার চুঁচুড়োয় বাড়ি, সে সুবাদে আমরা তো ঘরের ছেলেই ।

    কেমন জায়গায় নিয়ে এলাম, ঢঙে সহকর্মী আমাকে এদিক ওদিক দেখাচ্ছিলেন নানা দ্রষ্টব্য, বেশিরভাগই বিভোর সাহেব মেমদের । ভারতীয় ধর্মতত্ত্ব এঁরা কেমন করে আঁকড়েছেন তা লক্ষ করালেন । আর বললেন, ওনার দারুণ গর্বিত লাগে নিজেকে, অ্যাজ্‌ এ পার্ট অফ্‌ দিস রিচ্‌ হেরিটেজ । দিস্টা ঠিক কোনটা বুঝলাম না । বললাম, সেই ।

    আর ভাবলাম, এ তামাশা চলে আসছে আজ বহুদিন হল । রঞ্জক-সাবানে চোবানো চেলিতে মুড়ে ভারতীয় দর্শন বিকোয় ভালই । কয়েক সহ্রসাব্দের সাধনা টু-মিনিট নুড্লের প্যাকে ভরে পাশ্চাত্যে না ফিরি করলে আমাদের মান থকে না যে । আগে অবশ্য জেনে নিতে হবে অম্ল-মধুর-তিক্ত-কষায় কোন রসায়ন ওঁদের রসনায় রুচবে । তেমনই করতে হবে তো চোলাইয়ের ছাঁচ । ভারতের বাণী তো হতে হবে একটা ভাসা ভাসা গদ্গদে ব্যাপার, মেটায় জ্বালা, মেটায় ক্ষুধা । এই যা চাহিদা তা মিটলে কোনো গোল বাধে না, অন্যথা হলেই বিপদ, ভ্যালু ফর মানি থাকছে না যে ।

    "ণং চ্ছরু ংঋশছবঞঠবছত্‌, ংঋত্ছঠত্রত্ষ্‌ ংন্‌ংঋশংযযংরু টঠংগয ছঢধণ্ণঞ ত্রছঞঠধত্রছত্ঠযস্‌, গছশ ছত্ররু ংঋংছবং, বশধযয-বণ্ণত্ঞণ্ণশছৎ ংরুণ্ণবছঞঠধত্র, ংঈশংংরুধস্‌ ধী ঞচ্‌ং স্ঠত্ররু, ঞচ্‌ং ঠস্‌ংঋধশঞছত্রবং ধী শছঞঠধত্রছৎ বশঠঞঠবঠযস্‌, ঞচ্‌ং ত্রংংরু ংঈধশ ধৃংত্রত্রংযয ছত্ররু যধ ধত্র.... ংংঐধৃত্‌ং বছস্‌ং ঞধ চ্ঠয ংঋণ্ণঢত্ঠব ত্‌ংবঞণ্ণশংয...ঠত্র স্‌ংংইশঠবছ, ংন্‌ংঋংবঞঠত্রভ শণ্ণস্ঠত্রছঞঠধত্রয ধত্র ভশছত্ররু, ঞশছত্রযবংত্ররুংত্রঞছৎ ঞচ্‌ংস্‌ংয... ঞচ্‌ংশং গছয যধস্‌ং শংযংত্রঞস্‌ংত্রঞ, ংঋছশঞঠবণ্ণত্ছশত্ষ্‌ (ছয শ্‌..ংঐমচ্ধস্যধত্র শংংঋধশঞয) গচ্‌ংত্র চ্‌ং রুংত্ঠটংশংরু ংঋধত্ঠঞঠবছৎ বশঠঞঠবঠযস্‌ ছঞ $৭০০ ছ যবধত্রু".

    প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথের ১৯১৬ আমেরিকা সফর, আলোচনার শিরোনাম, টেগোর অ্যাণ্ড হিজ্‌ ইণ্ডিয়া, লেখক অমর্ত্য সেন ।




    দুহপ্তা বাদে আবার দিব্যাশিসের ডাক এসেছিল । আমি দাঁতের ব্যথার দোহাই দিয়েছিলাম ।



    "রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে" -- সূর্যাস্তটা সে চিরন্তন ফিনিক্স কিংবা পতিসরে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments