• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৭ | আগস্ট ২০০২ | গল্প
    Share
  • চন্দ্রাহত : সাবর্ণি চক্রবর্তী



    ॥ ১ ॥


    আজ রায়বাড়িতে উত্সব । বাড়ির চার নম্বর, অর্থাৎ ছোটোছেলের বৌভাত ।

    রায়েরা কলকাতার বনেদি জমিদার । জমি ছিল কলকাতারই বিভিন্ন জায়গায়, কলকাতার আশেপাশে । কিন্তু জমি যত, জ্ঞাতিগুষ্টি, শরিক, তার থেকে বেশি । এই চার ভাইয়ের বাবা হঠাৎ মারা গিয়েছিলেন -- তখন এদের বড় ভাইয়ের বয়েস কুড়িও হয়নি । তারপর যা হয়ে থাকে -- বিভিন্ন জমির দলিল চারপাশের লোকজন হাত করে নিতে লাগল, চুপচাপ সেই জমি নিজেরা দখল করে নিল । বলতে গেলে জমিজায়গা এখন এদের আর বিশেষ কিছুই নেই । এরা এখন চাকরি করে, ব্যবসাও করে । এই বংশের পুরুষরা এসব করার কথা আগে কখনো চিন্তাও করেনি ।

    কিন্তু মাথার ওপরে একটা ছাত আছে । সেটা এই পৈত্রিক বাড়িটা । বাড়িটা প্রকাণ্ড । তিনতলা -- প্রচুর জমির ওপর এলোমেলোভাবে তৈরি বিরাট ঘর । বাড়ির সিঁড়ি অত্যন্ত খাড়াই -- ধাপগুলো উঁচু উঁচু । যার এই সিঁড়ি-ভাঙা অভ্যেস নেই তার জিভ বেরিয়ে যায় এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে । শরিকে শরিকে ভাগ হয়ে বাড়িটা টুকরো টুকরো হয়েছে -- ভেতর দিয়ে দেয়াল উঠে উঠে বাড়ি ভাগ হয়েছে । এখন রয়েছে খালি বাড়ির এই অংশটা -- তার লাগোয়া একটা বড় পোড়ো জমি, তাতে একটা বিরাট বড় গাছ । গাছের গুঁড়িটার ও-পাশটায় জমে থাকে ছাই, পোড়া কয়লা, তরকারির খোসা, মাছের আঁশ -- পাতের ফেলে দেওয়া ভাত । জমাদার রোজ আসে না । যেদিন আসে জঞ্জাল তুলে নিয়ে যায় । গুঁড়িটা পরিষ্কার দেখায় -- গাছের পাতাগুলো সেদিন হাওয়ার তালে তালে আনন্দে মাথা দোলায় ।

    বড়ভাই শ্রীমন্ত সংসারের কর্তা । যেটুকু জমিজমা এখনো হাতে আছে তার দেখাশোনা সেই করে । লম্বা, ফর্সা, বনেদি চেহারা -- অনেক লোকের ভেতর আলাদা করে চোখে পড়ে । এই একান্নবর্তী পরিবারের সব লোক শ্রীমন্তকে সম্ভ্রম করে, ওর কথা মেনে চলে । তার পরে দুই বোন -- প্রণতি আর মিনতি । তাদের ভাল পরিবারে বিয়ে হয়ে গেছে -- দু জনেই এখন বেশ কিছু ছেলেপিলের মা । পরের ভাই অনন্ত -- একটা মোটামুটি কাজ চালানো গোছের চাকরি করে । ওর ছোটো দুই ভাই -- দাশু আর নান্টু । ওদের পোশাকি নাম আছে একটা করে । তবে এই নামেই ওরা মোটামুটি পরিচিত ।

    আজ বাড়িভর্তি লোক । চারপাশ আলোয় আলো । তেতলার যে-ঘরটা নান্টুর, তার পাশের একটা বড় ঘরে বৌ বসানো হয়েছে । এখন বৈশাখ মাস । বৌ বেচারি, মুখের রঙ, তার ওপর চন্দনের ফোঁটা, ফুলের টোপর, গা-ভর্তি গয়না আর বেনারসী শাড়িতে ভারাক্রান্ত হয়ে সমানে ঘামছে । ওর চারপাশে ভিড় করে বসে আছে সাজগোজ করা সব মহিলারা -- অল্প বয়েসী মেয়েরাও রয়েছে সেই ভিড়ে । তার ফলে একেবারেই হাওয়া খেলছে না সেই ঘরে । কোন না কোন অতিথিকে কোন আত্মীয়া নিয়ে এসে সামনে দাঁড় করাচ্ছেন -- নতুন বৌ শুনতে পাচ্ছে -- নীলিমা, ইনি হচ্ছেন অমুক, সম্পর্কে তোমার ভাশুর -- বা -- ইনি আমাদের অমুক দিদি । নতুন বৌ-এর মাথাটা যন্ত্রের মতো নিচু হয়, ডান হাতটা এগিয়ে যায়, আঙুলগুলো অতিথির পা আর নিজের কপাল ছুঁয়ে আসে । তারপর আবার দু-হাত বাড়াতে হয় -- উপহারটা তো নিতে হবে । বৌ-এর পাশে বসা মিনতি -- তার কোলের ওপর একটা খাতা, ডান হতে খাপ খোলা একটা কলম, আর পাশে জাহাজের মতো প্রকাণ্ড একটা ট্রাঙ্ক । বৌ কার কাছ থেকে কি উপহার পেল সব ওই খাতায় লিস্ট করে লিখে রাখছে, তারপরই সেটা ট্রাঙ্ক খুলে ভেতরে রেখে ট্রাঙ্কে তালাচাবি লাগিয়ে দিচ্ছে । এরকম না-করলে উপায় আছে? নিজেদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেই অনেক থাকে এই সব উপহারের জিনিষ গাপ করে দেবার তালে ।

    খুব ব্যস্ত নান্টুও । ধুতি পরেছে অনেক কষ্টে -- বেঁধে রাখার জন্যে একটা মোটা বেল্ট লাগিয়েছে কোমরে । এই বেল্ট ঢাকা পড়েছে সিল্কের পাঞ্জাবীর তলায় । নান্টুর বেশ তাগড়া পালোয়ানি চেহারা -- ভাল ফুটবল খেলত, বক্সিং-টক্সিংও শিখেছিল কিছুদিন । এখন ব্যবসা করছে -- দুটো মিনিবাস, একটা ট্যাক্সি, কোথায় একটা কয়লার আড়ত নিয়েছে । সমানে একতলা থেকে তিনতলা করতে হচ্ছে ওকে । দাদাদের, জামাইবাবুদের সঙ্গে মিলে অতিথি অভ্যর্থনা আছে, সব লোকজনদের খেতে বসানো আছে । শরিকেরা সব এসেছে -- তাদের গাদা গাদা বাচ্চা । তারা সমানে সিঁড়িতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে -- তাদের সামলানোও একটা বিরাট কাজ । বনেদি বাড়ি, খাওয়াদাওয়ার ব্যপারটা কেটারারদের হাতে দিয়ে দেওয়াটা পছন্দ করে না । রান্না হয়েছে বাড়ির পাশের জমি পরিষ্কার করে -- সেখানে কাপড়ের চাঁদোয়া টাঙিয়ে । খাওয়ার ব্যবস্থা বাড়ির ছাতে । সিঁড়ি দিয়ে সমানে তোলা হচ্ছে বালতি বালতি পোলাও, মাছ, মাংসের কালিয়া, ঝুড়িতে করে লুচি আর ফিশফ্রাই । তাছাড়া আছে ডাল, নিরিমিষ তরকারি, দইয়ের হাঁড়ি আর মিষ্টির বালতি । একটা দলের খাওয়া শেষ হতে না হতেই আর একটা দল উঠে যাচ্ছে ওপরে । সিঁড়িতে প্রায় একটা ধাক্কাধাক্কি হবার মতো অবস্থা । রান্নার ঠাকুরদের লোকজন বিরাট বিরাট লোহার কানা-উঁচু ট্রেতে পাতে ফেলে দেওয়া খাবারদাবার ভর্তি করে ‘রাস্তা দিন, রাস্তা ছাড়ুন’ বলতে বলতে নেমে আসছে । সব মিলিয়ে অবস্থাটা সুশঙ্খল -- একথা মোটেই বলা যাবে না ।

    তিনতলার কোণের দিকের একটা ঘর বাইরে থেকে হুড়কো টেনে বন্ধ । এই ঘরটা অপেক্ষাকৃত ছোটো । ঘরের দুটো জানালা -- দুটোই ভেতর থেকে বন্ধ । জানালাগুলোর কাঠের পাল্লা, তাতে লোহার গোল কড়া লাগানো । সেই কড়ায় তালা লাগানো আছে । খালি খড়খড়িগুলো অল্প ফাঁক করা যায় । ঘরে কোন আসবাব নেই -- খালি একটা আলনা -- তাতে অত্যন্ত নোংরা কয়েকটা গেঞ্জি, পাজামা, ফতুয়া এসব রয়েছে । ঘরের মাঝখানে মাদুরের ওপর একটা নোংরা তেল-চিটচিটে বিছানা । এই বিছানায় দাশু বসা । মাঝেমাঝেই তোষক মাদুরের ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে মাদুর কামড়ে ধরছে -- দাঁত দিয়ে তা ছেঁড়ার চেষ্টা করছে ।

    দাশুর বয়েস এই তিরিশ বত্রিশ হবে । পরে আছে একট ফতুয়া আর পাজামা । দুটো একই রকম ময়লা । অনেকদিনের না-কাটা চুল প্রায় কাঁধ পর্যন্ত এসে পড়েছে । এই চুলে জট পড়েছে -- ময়লায় খুস্কিতে উকুনে ওর চুল ভর্তি । সারা মুখে বড় বড় খোঁচা খোঁচা অযত্নে বেড়ে-ওঠা গোঁফ-দাড়ি -- এরই মধ্যে পেকে গিয়ে সাদাটে হয়ে এসেছে । লাল লাল চোখ দুটি পিঁচুটিতে ভরে আছে ।

    এবাড়ির সব লোক বোকা, ভীষণ বোকা । একমাত্র দাশু জানে সেটা । ওরা একটা বিরাট ভুল করেছে । আজ আসলে দাশুর বৌভাত -- ওরা সবাই বলছে নান্টুর নাকি বিয়ে হয়েছে -- নান্টুর বৌভাত । আরে অনন্তর পরেই তো দাশু -- ওকে টপকে নান্টুর বিয়ে হবে কি করে? এই যে নতুন বৌটা এসেছে, ও আসলে দাশুর বৌ -- কিন্তু ওরা কেউ জানে না । যাতে দাশু বাইরে বেরিয়ে কাউকে কোন কথা বলতে না পারে তার জন্যে ওরা ওকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে । আগে আগে জানালাগুলো খোলা থাকত । একদিন সন্ধেবেলা দাশু জানালা দিয়ে উঁকি মেরে নিচে রাস্তা দেখছিল । সে সময় হঠাৎ ওর পেচ্ছাপের বেগ আসে । তারপর খানিকক্ষণ খুব চিত্কার চেঁচামেচি শুনল দাশু -- রাস্তায়, বাড়ির একতলায় । ও নিজের ঘরেই ছিল । তারপর তিন ভাই ঘরে ঢুকে এল । বড়দার হাতে একটা কাঠের রুলার । ওরা তিনজনে চেঁচিয়ে দাশুকে গাল দিল । শ্রীমন্ত ওই রুলার দিয়ে দাশুর মাথায় মুখে এলোপাথাড়ি মারল । তারপরই ওরা ছুতোর ডাকল । জানালার পাল্লায় কড়া লাগিয়ে তালা দিয়ে দিল । ওরা কেউ ওর ভাই নয় -- সব শয়তান, সব শত্রু ।

    মাকে দিয়ে এই কথাটা বলিয়ে দিতে পারলে হয় । ওই গালফুলো চন্দনপরা সাজাগোজা মেয়েটা দাশুর বৌ । তাহলে ওই শয়তানগুলো আর কিছু বলতে পারবে না । এই মাদুরে একটা শক্ত গিঁট লাগানো আছে । সেটা দাশু ছাড়া আর কেউ জানে না । ওই গিঁটটা খুলতে পারলে একটা দরজা পাওয়া যাবে । সেই দরজা খুলে একটা ঘর । সেখানে মা থাকে । কিন্তু এই গিঁটটা ভীষণ শক্ত । আঙুল দিয়ে খোলা যায় না । সেজন্যে মাঝে মাঝেই দাঁত লাগাচ্ছে দাশু । তাতে করে যদি গিঁটটা ছিঁড়ে ফেলা যায় ।

    এবাড়ির সব লোক ভাবে মা মরে গেছে । ভুল, ভীষণ ভুল । সেই অনেক বছর আগে মার অসুখের যখন খুব বাড়াবাড়ি যাচ্ছে তখন ভাইয়েরা সবাই ডাক্তার ডেকে এনেছিল । দুই দিদি, জামাইবাবুরা এসেছিল । ডাক্তার মার নাড়ি ধরে দেখছিল -- দাদা দিদিদের বাচ্চাগুলো সারা বাড়িতে হই হই করে চোর-পুলিস খেলে বেড়াচ্ছিল । তারপর ডাক্তার মার নাড়ি ছেড়ে দিয়ে হাতটা নামিয়ে রাখল -- গম্ভীর মুখ করে ঘাড় নাড়ল । দিদিরা হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগল । বড়দা পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছল । অনন্ত আর নান্টু ফুঁই ফুঁই আওয়াজ করে ফোঁপাচ্ছিল । দুই জামাইবাবু মুখ খুব গম্ভীর করে ঘাড় নিচুকরে মাটির দিকে তাকিয়েছিল । কান্নাকাটির আওয়াজে বাচ্চাগুলো খেলা থামিয়ে দিয়েছিল । চোখ বড় বড় করে দরজা দিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি মেরে মেরে দেখছিল কি হচ্ছে না হচ্ছে । বৌদিরা বাচ্চাদের ঘর থেকে বার করে দিছিল । বলছিল -- এই যা: -- এখানে থাকিস না, অন্য ঘরে চলে যা ।

    তারপর সমানে লোক আসতে লাগল বাড়িতে -- যেখানে যাও সেখানে লোক । বিরক্ত হয়ে দাশু নিজের ঘরে গিয়ে বসেছিল । তারপর ওরা সব মাকে নতুন লালপাড়ের কাপড় পরিয়ে পায়ে আলতা দিয়ে নতুন খাটে শুইয়ে সে-খাট ফুল দিয়ে সাজালো । একগাদা লোক খাটসুদ্ধ মাকে কাঁধে তুলল, হরিবোল দিয়ে খই ছড়িয়ে বেরিয়ে গেল । মাকে নাকি পোড়াতে নিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু দাশু দেখল মা ওর বিছানার মাদুর তুলল -- তারপরই একটা দরজা -- সেই দরজা খুলে ওর ঘরের নিচে আর একটা ঘরে ঢুকে গেল । যতক্ষণে দাশু নিজের বিছানার কাছে গেল ততক্ষণে সে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে । সেটা মাদুর দিয়ে ঢাকা -- সেখানে আবার একটা শক্ত গিঁট । এসব খালি দাশু জানে -- আর কেউ না । দাশু কাউকে একথা বলেও না । ওরা সব শয়তান, বদমাশ । ওদের বলে লাভ কি?

    রাত তখন অনেক । অতিথিরা সব চলে গিয়েছে । বনমালি ঘরের হুড়কো খুলল । ও দাশুর রাতের খাবার নিয়ে এসেছে । বনমালি বুড়ো । ও এবাড়ির পুরোনো রান্নার ঠাকুর -- শ্রীমন্তর বাবার আমল থেকে আছে । হুড়কো খুলবার সময় ও খাবারের থালা আর জলের গেলাস মাটিতে নামিয়ে রেখেছিল । দরজা ঠেলে খুলে থালা গেলাস হতে নিয়ে ও ঘরে ঢুকল । ওর পেছনে প্রণতি আর মিনতি -- দাশুর দুই দিদি । ভাইকে একবার দেখে যেতে এসেছে ।

    ঘরে একটা দমচাপা দুর্গন্ধ । সারা ঘরের নোংরা ময়লা তো আছেই তার ওপর শুকিয়ে থাকা পেচ্ছাপ । এই গন্ধ বনমালির সয়ে গেছে । দুই দিদি মুখ বিকৃত করে নাকে কাপড় দিল -- মিনতি অস্ফুটে বলে ফেলল -- বাপ রে, কি গন্ধ ।

    প্রণতি নাকে কাপড় চাপা দিয়েই বলল, কিরে দাশু কেমন আছিস ? বনমালি ততক্ষণে দাশুর খাবারের থালা আর জলের গেলাস ঘরের মেঝেয় নামিয়ে রেখেছে ।

    দাশু মাদুরের ওপর আক্রমণ ছেড়ে দিয়ে দরজার দিকে পেছন করে শিরদাঁড়া টান করে বসেছিল । প্রণতির গলার আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে দাঁত মুখ খিঁচোতে লাগল, আর মুখে বিড়বিড় করতে লাগল । শয়তানি ডাইনি, আমার বৌটাকে নান্টুর কোলে তুলে দিয়েছিস -- আবার আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিস ? যা দূর হয়ে যা এখান থেকে -- নিজের বরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকগে যা ।

    বনমালি চেঁচিয়ে এক ধমক দিল, এই চুপ ।

    দাশু চুপ মেরে গেল । ও বনমালিকে একটু ভয় পায় । এই লোকটি চটে গেলে ওর খাবার আসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে । বনমালি দাশুকে বলল, শয়তানি না করে চুপচাপ খেয়ে নাও । তারপর বোনেদের দিকে ফিরে বলল, আজ একটু বেশি ক্ষেপে আছে । তোমরা এখান থেকে যাও গো দিদিরা ।

    দিদিদের ভ্রাতৃস্নেহ শুকিয়ে এসেছিল । চটপট ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তারা । বনমালি ওদের পেছনে বেরিয়ে ঘরে দরজা ভেজিয়ে দিল । কিন্তু এবার আর হুড়কো লাগাল না । বাইরের লোকজন সবাই চলে গেছে । এখন আর দরজা বন্ধ রাখার দরকার নেই । তাছাড়া খুব বেশিক্ষণ ঘর বন্ধ করে রাখলে মলমূত্রের বেগ চাপলে দাশু ঘর নোংরা করবে । তখন আবার আর একটা ঝামেলা ।

    ওরা চলে যেতে দাশু খাবারের থালাটা দেখল । কতগুলো শুকনো ঠাণ্ডা লুচি, খানিকটা ডাল তরকারি আর এক টুকরো মাছ । থালার একপাশে খানিকটা দই আর একটা রসের মিষ্টি রয়েছে । শয়তান -- বনমালিটা ঘোর শয়তান । দাশু মাংসের হাড় চিবোতে এত ভালবাসে, তার ছিটেফোঁটাও দেয়নি ওকে । শুকনো লুচি চিবোতে চিবোতে দাশুর মনে পড়ল এঘরের দেয়ালের কোণে কোণে পিঁপড়েরা সারি দিয়ে হেঁটে বেড়ায় । আজ বাড়িতে দাশুর বৌভাত আর ওই পিঁপড়েগুলো না খেয়ে থাকবে? লুচির গোছা হাতে থালা ছেড়ে উঠে গেল দাশু । লুচির টুকরো ছিঁড়ে ছিঁড়ে ঘরের কোণে কোণে ছড়িয়ে ফেলল । তারপর ওর মনে এল মায়ের কথা । মা মিষ্টি খেতে খুব ভালবাসে । ওর পাতের ওই মিষ্টিটা মাদুরের গিঁট আর বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে গলবে না । মিষ্টিটা চিপে দাও ! রসটা মাদুরের ওপর নিংড়ে দিল । ওই রসটা গড়িয়ে যাবে সব ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে -- ঢুকবে গিয়ে মায়ের ঘরে -- মা সেটা খাবে ।

    থালার বাকি খাবার, মাছের কাঁটাকুটো সব ঘরের ভেতরেই ঢেলে ফেলল দাশু । গেলাসের জল কয়েক ঢোঁক খেয়ে বাকি জলটুকু ঘরের মেঝে দিয়ে গড়িয়ে দিল দেয়ালের কোনার দিকে । যদি লুচি খেয়ে পিঁপড়েগুলোর তেষ্টা পায় তাহলে এই জল খাবে ।

    ঘরের দরজা টেনে দেখল দাশু । দরজা খোলা । ও বাইরে বেরোল । নান্টুর ঘর বারান্দার অন্য কোণে । দাশু সেদিকে এগোল ।

    প্রথমে দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দিল দাশু । তারপর অধৈর্য হয়ে দুমদুম করে জোরে জোরে ঘা মারতে লাগল । এবার ভেতর থেকে ঘরের দরজা খুলে দাঁড়াল নান্টু । কিন্তু ও দুহাতে দরজার দুই কবাট ধরে আছে -- দাশুর ঢোকার উপায় নেই । কিন্তু খোলা দরজার ফাঁক দিয়েই দাশু দেখল নতুন বৌ-এর ভয়পাওয়া মুখ । ওর চোখে চোখ পড়তেই একটা চাপা চিত্কার করে উঠল ।

    দাশুর দিকে তেড়ে এল নান্টু । গর্জন ছাড়ল, এই দাশুদা -- হচ্ছেটা কি? তারপর হাত তুলে বলল, মারব টেনে এক চড় -- পেছন ফিরে টেনে দৌড় মারল দাশু । সোজা নিজের ঘরে ঢুকে এল । শত্রু, সব ওর শত্রু । এক্ষুনি একবার মাকে ডাকার দরকার । কিন্তু মাদুরের ওই গিঁটটা । নিচুহয়ে আবার তাতে দাঁত লাগালো দাশু ।


    ॥ ২ ॥





    এখন বেলা প্রায় একটা । গরমকালের নির্মেঘ দুপুর -- সূর্য মনে হয় আগুন ঢালছে । দাশু বসে আছে গাছটার গুঁড়িতে জমে থাকা ছাইগাদার ওপর । ছাইএর স্তুপের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে মন দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কি দেখছে ।

    দাশু এখন আর তিনতলার ঘরে থাকে না । এই জমির এক কোণে একটা ছোটো পাকা ঘর -- দাশুর আস্তানা এখন সেখানে । বহু বছর আগে যখন এবাড়িতে দারোয়ান ছিল তখন এই ঘরটা সেই দারোয়ানের ব্যবহারের জন্যে ছিল । পাশেই দারোয়ানের কলঘরটা -- সেটা এখন দাশুর ব্যবহারের জন্যে । তবে প্রাকৃতিক কাজকর্মের জন্যে দাশু কলঘরটাকে বিশেষ পছন্দ করে না । গাছটার পেছন দিকে অনেকটা জায়গা জংলা হয়ে আছে -- কেউ কখনো যায় না -- সে জায়গাটাতেই এসব কাজ সারে দাশু । জমাদারকে এখন বেশি করে টাকা দেওয়া হয় -- দাশুর অপকর্মও সাফ করতে হবে তো ।

    বৌভাতের দিনের ওই ঘটনার পরেই নান্টু সাফ বলে দেয় দাশুকে আর বাড়ির ভেতর রাখা চলবে না । নীলিমা তাহলে থাকতে পারবে না এবাড়িতে । নিচে দারোয়ানের ঘরটা নোংরা হয়ে পড়েছিল বহুকাল । তাড়াহুড়ো করে সেটা পরিষ্কার করে দাশুকে নিচে নামানো হোল ।

    বাড়ির বড় দুই বৌ অবশ্য আড়ালে মুখ বাঁকিয়েছিল । ছোটো-বৌ একটা আব্দার করলেই শুনতে হবে? দাশু ওর দিকে তাকালেই ওর ধর্ম নষ্ট হয়ে গেল নাকি? য়তসব ঢং ।
    তবে এসব ভেতরে ভেতরে । নিজের ঘরে নিজের বরের কাছে । ছোটোবউ এ বাড়িতে এসেই বেশি আস্কারা না পেয়ে যায় । তবে সব রকম চিন্তা করে প্রত্যেকেই শেষ পর্যন্ত ঠিক করল দাশুর নিচে থাকাই ভাল । সকলেরই ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে । দাশু সবাইকে যা-তা বলে গালাগাল দেয় - অনেক সময় উদোম হয়ে বারান্দায় ঘোরে । ছোটো বাচ্চাদের কচি মন । এ অবস্থায় দাশুকে দেখলে - দাশুর মুখখিস্তি শুনলে ভবিষ্যতে ওদের কি ক্ষতি হবে কে জানে ।
    দাশু এ-ব্যবস্থায় খুব একটা অখুশি নয় । এখানে ওকে ঘরে বন্ধ করে রাখে না কেউ । একটা খালি ছোটো অসুবিধে । সেটা ওর খাওয়ার ব্যাপারে । এ-ঘরে নেমে আসার পরের থেকে ওর খাবার দিতে আরও অযত্ন হয় । বনমালির সময়সুযোগ মতো ও দাশুকে খেতে দেয় । কোনদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় - কোনদিন রাতের খাবার এত দেরিতে দেয় যে দাশু ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে - সে-রাতে হয়তো খাওয়াই হল না ওর । তবে বেশি ক্ষিদে পেলে মাঝে মাঝে দাশু নিজেই চলে আসে রান্নাঘরে । রান্নাঘরটা বাড়ির একতলাতেই - চেঁচিয়ে বনমালিকে গাল দেয়, এই শালা বনমালি, ভাত দে শীগগির । তেষ্টা পেলে একইভাবে জল চায় । বনমালি এক ধমক লাগায় - দাশু কুঁকড়ে গিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে ফিরে যায় । তারপর বনমালি ভাত নিয়ে আসে ওর জন্যে - জল খেতে চাইলে জল । //
    দাশু বাড়ির পাঁচিলের বাইরে পা দেয় না । ওখানেও সব শত্রু । একদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে বেরিয়ে গিয়েছিল । দাশুর খালি গা, পরনে খালি অত্যন্ত নোংরা একটা পাজামা । ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নেমে পড়ে দাশু হাঁটছিল আর বিজবিজ করে মুখে বকছিল । একটা রিক্সাওয়ালা রিক্সা নিয়ে দৌড়ে যেতে যেতে ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় । ও সেই ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল, ফের দাঁড়িয়ে উঠে ও যখন চিত্কার করে রিক্সাওয়ালার মা-বাপের শ্রাদ্ধ করছে তখন দু তিনটে অল্পবয়েসী চায়ের দোকানের ছোকরা ওকে এই পাগলা, এই পাগলা বলে ক্ষেপাতে থাকে । দাশু ওদেরও মা-বাপ তুলে গালাগাল দেয় - দূর থেকে থুতু ছেটায় । তখন ছেলেগুলো ওকে ঢিল মারতে থাকে - দুটো রাস্তার কুকুর বিচ্ছিরিভাবে দাঁত খিঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে ওকে তাড়া করে । দৌড়ে বাড়িতে ফিরে এসেছিল দাশু । সবাই শয়তান - যেমন বাড়ির ভেতরে, তেমনি বাইরে । একবার যদি মাকে কাছে পাওয়া যেত । তাহলে দাশু সবাইকে মজা দেখিয়ে দিত । দাশুর সঙ্গে সঙ্গে ওর মায়ের ঘরের দরজাটাও নিচে নেমে এসেছে । ঠিক ওর বিছানার মাদুরের তলাতেই । কিন্তু কিছুতেই মাকে বার করে আনা যাচ্ছে না । যত মুস্কিল সেখানে ।

    সূর্য এখন এদিকে চলে আসায় গাছের ও পাশটায় ছায়া পড়েছে । ওপাশে কতগুলো বাচ্চা ছেলেমেয়ের গলার হই হই চিত্কার শুনতে পেল দাশু । ওরা এ-বাড়িরই ছেলেমেয়ে - নিচে নেমে এসে খেলছে । দাশু উঠল - গাছটাকে ঘুরে এপাশে এল । ওকে দেখেই বাচ্চা গুলো, এই এই, পালা পালা বলতে বলতে ছুট দিল । খালি একটা আট দশ বছরের গাব্দাগোব্দা মেয়ে নড়ল না সেখান থেকে । ও বোধহয় এই বাচ্চাদের দলের সর্দার । বড় বড় চোখ মেলে দাশুকে দেখতে লাগল ।

    দাশু মেয়েটাকে চেনে । এ বাড়িতে অনেকবার দেখেছে । ও জানে এ-বাড়িরই কারোর মেয়ে । কিন্তু ঠিক কার মেয়ে সেটা ওর গুলিয়ে যাচ্ছে । হয়তো ও দাশুর নিজেরই মেয়ে । কিন্তু কি করে সেটা জানা যায় ! মেয়েটা কি ওকে বাবা বলে ডাকবে ? তাহলেই তো বোঝা যাবে ।

    দাশু ওকে হাতছনি দিয়ে কাছে ডাকে । এই শোন্‌, এদিকে আয় ।

    মেয়েটা দু'পা কাছে এগোয়, হাসি হাসি মুখ করে দাশুকে দেখতে থাকে । না:, এবার দাশুর খুব জোর মনে হচ্ছে এই বাচ্চাটা ওরই মেয়ে । বাবা হিসেবে দাশুর তো মেয়েকে একটু আদর দেওয়া উচিৎ । ওকে কিছু খেতে দিলে হয় । এক টুকরো বড়সড় পোড়া কয়লা ছাইয়ের থেকে তুলে নিল দাশু । মেয়েটার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, এই নে - আম খা ।

    হাসিতে মেয়েটার মুখ ভরে গেল । তারপরই নাক মুখ কুঁচকে বলল, বাবারে, গায়ে কি গন্ধ । পেছন ফিরে বেশ খানিকটা দৌড়ে গেল । দাশুর গায়ে পোড়া কয়লার টুকরোটা ছুঁড়ে মেরে হি হি করে হাসতে হাসতে চেঁচাতে লাগল, পাগলা দাশু, পাগলা দাশু ।

    দাশু চোখ ঘোরায়, দাঁত খিঁচোয় আর গালাগাল দেয় - আমি কেন পাগলা হতে যাব রে - শালা তুই পাগল - তোর বাপ পাগল ।

    মেয়েটা হাসতে হাসতে হাততালি দিতে দিতে চেঁচাচ্ছিল, পাগলা দাশু বলে । তারপর হাসতে হাসতেই দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল ।

    দাশু গজরাতে গজরাতে এসে আবার ছাইয়ের ঢিবির ওপর বসল । ও একটা পিঁপড়ে কে খুঁজছে । একটা বড়সড় কালো মোটা পিঁপড়ে । আসলে পিঁপড়ে নয় । একটা কালো শাড়িপরা যুবতী মেয়ে । কাল দেখে ফেলেছিল দাশু । ওকে দেখেই মেয়েটা পিঁপড়ে হয়ে গিয়ে ছাইএর গাদায় ঢুকে পড়ল । তারপর থেকেই দাশু বার বার এসে খুঁজছে পিঁপড়েটাকে । কোথায় ঢুকে বসে আছে কে জানে ।

    বাড়ির ভেতর থেকে বনমালি বেরিয়ে এল । ওর ডানহাতে একটা জলভরা বড় বালতি, সেই জলের ওপর একটা প্ল্যাস্টিকের মগ ভাসছে । বাঁ-হাতে একটা পরিষ্কার ফতুয়া আর পাজামা ধরা - আর একটা বড় কাঁচি । গাছটার কাছে এসে ছায়ার দিকে জলের বালতিটা মাটিতে নামিয়ে রাখল - ফতুয়া আর পাজামাটা গাছের একটা ডালের ওপর ঝুলিয়ে দিল, তারপর কাঁচিটা হাতে নিয়ে দাশুকে ডাকল - এই, এদিকে এস ।

    দাশু হিংস্র চোখে বনমালিকে দেখছিল । এই লোকটা শত্রুদের দলে - সেটা দাশুর জানা আছে । খাবার তো আনে নি ? তাহলে কি মতলবে এসেছে এখানে ?

    মাটি থেকে একটা ঢেলা কুড়িয়ে নিল দাশু । তারপর সেটা ছুঁড়ে মারবে এরকম একটা ভঙ্গি করে হাতটা ওপরে তুলল ।

    বনমালি জোরে ধমকে উঠল - এই ও, খবরদার । ইঁট ফেলে দাও এক্ষুনি । বদমায়েসি করলেই খাওয়া বন্ধ করে দেব ।

    এই শাস্তিটাকে দাশু ভয় পায় । ক্ষিদে পেলে, আর তখন ভাত না পেলে পেটের ভেতরটা কিরকম জ্বালা করে আর মোচড় দেয় । হাত নিচে নামিয়ে ইঁট ফেলে দিল দাশু । গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল বনমালির কাছে । একটু ভয় ভয় চোখ করে কাঁচিটার দিকে তাকায় । ওটা আবার গলায় বা পেটে বসিয়ে দেবে না তো ?

    বনমালি ঘাড় ধরে দাশুকে মাটিতে বসাল । দাশুর জটবাঁধা চুল এখন কাঁধ পর্যন্ত পড়েছে । বিরাট গোঁফ দাড়িতে সমস্ত মুখটা ভর্তি । বনমালি নির্মম ভাবে কাঁচি চালায় । দাড়ি গোঁফ যতটা পরে ছোটো করে ছাঁটে । বড় বড় চুলের ঢেলা মাটিতে পড়তে থাকে । প্রায় ন্যাড়া করে দেয় দাশুকে । দাশু তাকিয়ে তাকিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ওর চুল, দাড়ি গোঁফ দেখে । আহা, ওগুলোকে এভাবে কেটে ফেলল । কত ব্যাথা লেগেছে ওদের । দাশুর চোখ ছাপিয়ে জল আসে - ফোঁস ফোঁস নাক টেনে কাঁদতে থাকে ।

    বনমালি দাশুর কান্নাকে পাত্তাই দিল না । জলের বালতিটা হিঁচড়ে কাছে টেনে নিয়ে এল - মগে করে দাশুর সারা গায়ে মাথায় জল ঢালল । তারপর ওর ফতুয়া আর পাজামা খুলে ফেলে ওকে উলঙ্গ করে - ফতুয়াটা নিংড়ে নিয়ে সেটা দিয়েই ওর জলে-ভেজা গা খানিকটা খানিকটা মুছে দেয় । দাশুর মাথার ভেতর রগ টগবগ করে ফুটছিল । ও কি বাচ্চা ছেলে যে বনমালি ওর গায়ের সব জামা এভাবে খুলে নিল । কিন্তু বনমালিকে মারতে গিয়েও ওর হাত আবার নমে যায় । যদি সত্যি সত্যিই খাওয়া বন্ধ করে দেয় ?

    বনমালি দাশুকে পরিষ্কার পাজামা আর ফতুয়া পরাল । হাত ধরে ওর ঘরের ভেতর নিয়ে এসে বসিয়ে দিল । বলল, এখানে বসে থাকো । একদম কোথাও যাবে না । আমি তোমার ভাত নিয়ে আসছি ।

    আজ বনমালি ভাতের থালা নামিয়ে দিয়েই চলে গেল না । যতক্ষণ দাশুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাওয়া শেষ হয় ততক্ষন বসে রইল । মাটিতে ছড়ানো ছিটোন ভাত, ডালের ছিটে, তরকারির টুকরো সব তুলে ফেলে পরিষ্কার করে থালা নিয়ে গেল । আবার এসে জল দিয়ে দাশুকে মুখ ধুইয়ে দিল । তারপর দাশুর হাত ধরে বলল, এসো আমার সঙ্গে ।

    দাশু নড়ল না । জেদ করে দাঁড়িয়ে রইল এক জায়গাতেই । শয়তানটার মতলব কি ? কোথায় নিয়ে যেতে চায় দাশুকে ?

    ওর হাতে একটা হ্যাঁচকা টান দিল বনমালি । আবার বদমায়েসি ? ভাত খেয়ে গায়ে তেল হয়েছে, না ? শীগগির চল, নইলে মেরে বাপের নাম ভুলিয়ে দেব ।

    এবার দাশু চলল ওর সঙ্গে । সত্যিই যদি মারে ! তাছাড়া ওই কাঁচিটা - যেটা নিয়ে এসেছিল । সেটা এখন লুকিয়ে ফেলেছে । লুকোন জায়গা থেকে বার করে এনে যদি পেটে বসিয়ে দেয় ?

    বাড়ির একতলায় ঢুকেই একটা বড় ঘর - সেটা বসবার ঘর হিসেবে ব্যবহার হয় । সোফা, সেন্টার-টেবিল এসব দিয়ে ঘরটা সাজানো - কিন্তু কোন টিভি নেই । ভাইয়েরা নিজেরা আলাদা আলাদা টিভি কিনে নিজের নিজের ঘরে রেখেছে । কয়েকটা গদি-ছাড়া হাতলওলা কাঠের চেয়ারও রয়েছে এ-ঘরে । বনমালি দাশুকে নিয়ে এসে এরকম একটা কাঠের চেয়ারে বসিয়ে দিল । বলল, একদম চুপ করে বসে থাকো - কোন বাঁদরামো করবে না । আর হ্যাঁ - খবরদার ঘর নোংরা করবে না । তাহলে কিন্তু আজ রাত থেকেই খাওয়া বন্ধ ।

    আর একটা ওরকম চেয়ার টেনে নিয়ে বনমালি নিজে দাশুর পাশে বসল । দাশু ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল - ঘরের খোলা জানালার ফ্রেমে বসে কিচ কিচ আওয়াজ করছিল । পাখিটার ক্ষিদে পেয়েছে - দাশু বুঝল সেটা । আর একটু আগে এলে তো দাশুর সঙ্গেই ভাত খেতে পারত । এখন অবশ্য আর ভাত নেই, কিন্তু পাখিটাকে গাছতলায় ডেকে নিয়ে যাওয়া যায় । অনেক পোকা আছে সেখানে । ঠোঁট দিয়ে খুঁটে খুঁটে তুলে খেতে খেতে ওর ঘাড় ব্যথা হয়ে যাবে । কিন্তু এই বনমালিটা - ও যে কিছুতেই চেয়ার ছেড়ে উঠতে দেবে না ।

    ঘরে ঢুকল তিন ভাই । সেই সঙ্গে এক সৌম্য চেহারার বয়স্ক ভদ্রলোক । দাশু দেখল বড়দা এই লোকটাকে খুব খাতির করে সোফায় বসাল । দাশুকে দেখিয়ে বলল, এই আপনার রুগী ।

    ডাক্তার একবার দাশুর দিকে তাকিয়ে দেখলেন । তারপর শ্রীমন্তকে জিজ্ঞেস করে রুগীর কেস হিসট্রি জেনে নিয়ে সে-সব একটা বড় প্রেসক্রিপশনের প্যাডে লিখলেন । ততক্ষণে বনমালি দাশুর ঠিক মুখোমুখি একটা গদিমোড়া চেয়ার এনে রেখেছে । দাশু আড়ে আড়ে সব দেখে যাচ্ছিল । ষড়যন্ত্র - একটা ঘোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে । কোন সন্দেহ নেই !

    ডাক্তার উঠে এসে দাশুর সামনের চেয়ারে বসলেন - হাসিমুখে দাশুকে নানা কথা বলতে লাগলেন । সে-সব দাশুর কানে যাচ্ছিল না । একটা অজানা ভয় ওর ওপর চেপে বসেছে । শয়তানদের দলে আরও একটা লোক জুটেছে । ঘরের পুরোনো সিলিং ফ্যানটা ফুলস্পীডে ঘুরছে, মাঝে মাঝেই ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ বেরোচ্ছে সেটার থেকে । দাশু বার বার মুখ তুলে সেদিকে দেখছিল । শ্রীমন্ত একটা ছোটো গোছের ধমক দিল - ডাক্তারবাবুর দিকে তাকাও, উনি যা বলছেন তার উত্তর দাও ।

    এখন দাশুর চোখের সামনে একটা গোল মুখ - মাথার সামনের দিকটায় টাক, তাতে ঘামের ছোটো ছোটো ফোঁটা চকচক করছে । লোকটার মুখ নড়ছে, দুর্বোধ্য সব আওয়াজ বেরোচ্ছে তার থেকে । মোটা কাঁচের চশমার ভেতর দিয়ে লোকটার চোখদুটো দেখা যাচ্ছে, ত্রক্রমে সে-দুটো বড় হয়ে উঠছে । দাশুর ভয়টা এখন ওর তলপেটে ভর করেছে, সেখান থেকে ফেটে বেরোতে চাইছে । দাশু বনমালির দিকে মুখ ঘোরাল । চিত্কার করে কেঁদে উঠল, ও বনমালি, আমি পেচ্ছাপ করব ।

    ডাক্তার ইঙ্গিত করলেন - বনমালি দাশুকে ঘর থেকে বার করে নিয়ে গেল । ডাক্তার ওই চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে সোফায় রাখা তার কাগজপত্রের পাশে বসলেন । শ্রীমন্ত প্রশ্ন করল, কেমন দেখলেন ওকে, ডাক্তারবাব ংউ?

    ততক্ষণে বাড়ির বড় আর মেজ দুই বউ চা আর মিষ্টি নিয়ে এসেছে । চা সকলের জন্যে, মিষ্টি খালি ডাক্তারবাবুর । ছোটো বউ নীলিমা আসেনি । সেই বৌভাতের দিন ও যে দাশুর থেকে ভয় পেয়েছিল সেটা এখনও কাটেনি । ও নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে ।

    ডাক্তারবাবু চয়ে চুমুক দিলেন । তারপর পেয়ালা-পিরিচ সামনে সেন্টার-টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বললেন, দেখুন, কেসটা খুব পুরোনো । সে-জন্যে খুব কমপ্লিকেটেড হয়ে গিয়েছে । সাধারণ সাইকোথেরাপিতে এর কিছু উপকার হবে বলে মনে হয় না । একে অবসারভেশনে রাখতে হবে - ইলেকট্রিক শক দেওয়ারও দরকার হতে পারে । আমার নার্সিংহোমে দিতে পারেন । সেটা না করলে সরকারি লুনাটিক অ্যাসাইলাম ।

    ডাক্তারবাবু চলে যাবার পর তিন ভাই আর দুই বউ-এর একটা ছোটো বৈঠক হোল । একটা ব্যাপারে সবাই একমত - দাশুকে বাড়িতে রেখে চিকিত্সা করানো যাবে না । দাশুকে এ-বাড়ির বাইরে রাখার গরজটা নান্টুরই বেশি - নীলিমা মাঝে মাঝেই ওকে খোঁচায় এ ব্যাপারে । বলতে গেলে নান্টুই শ্রীমন্তকে বার বার বলে ডাক্তার ডেকে দাশুকে দেখানোর ব্যবস্থা করেছে । এতদিনে তো ডাক্তার ডাকার কথা কারোর মাথায় আসেনি । কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দাশুকে কোথায় রাখা হবে । এই ডাক্তার খুব নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, কিন্তু তার নার্সিংংএহামে দাশুকে রাখা মনে হাতি-পোষার খরচা । এই একটা ভিজিটেই তো পাঁচশো টাকা নিয়ে নিলেন । টাকার প্রসঙ্গটা আসাতেই সবাই চুপ করে গেল - একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকাতে লাগল । দ্বিতীয় পথের কথাটাই সকলের মাথায় পাক খাচ্ছিল । অনন্ত শেষ পর্যন্ত মুখ ফুটে বলল, সরকারি অ্যাসাইলামে দেওয়াটাই ভাল ।

    দুই ভাই আর দুই বউ শ্রীমন্তের মুখের দিকে তাকিয়েছিল - বাড়ির কর্তা কি বলে ? শ্রীমন্ত একটুখানি চুপ করে রইল । নার্সিংংএহামে দিতে পারলে তো খুবই ভাল - কিন্তু অত টাকার দায়িত্ব কেউ নেবে না - ভাগাভাগি করেও না । এ অবস্থায় যেই নার্সিংংএহামের কথা বলবে পুরো টাকার দায়িত্বটা তারই ঘাড়ে চাপবে । শ্রীমন্ত অনন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল । সরকারি অ্যাসাইলামই ভাল ।


    ॥ ৩ ॥


    এখন দুপুর রাত । ওর ঘরে মাদুরের ওপর তোষকের বিছানায় শুয়েছিল দাশু । ঘরের ভেতরটায় জমাট অন্ধকার । একটা বাল্ব হোল্ডারে লাগানো রয়েছে ঠিকই, কিন্তু অনেকদিন আগে সেটা ফিউজ হয়ে গিয়েছে । নতুন বাল্ব লাগানোর কথা কারোর খেয়াল হয়নি ।

    দাশুর চেহারা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছে -- চোখ গর্তে ঢোকানো । গাল তুবড়ে গেছে, বুকের পাঁজরগুলো আঙুল দিয়ে গুণে নেওয়া যায় । শুয়ে শুয়েই হঠাৎ একটা বিকট চিত্কার করে উঠল দাশু । বাড়ির লোকদের, প্রতিবেশীদের, দিনে রাতে এই চেঁচানি শুনে ঘুম ভাঙলে আর বুক ধড়ফড়ানি হয় না । বাচ্চাদের তো ঘুমই ভাঙে না ।

    তবে মন্তব্য অনেকেই করে । প্রতিবেশীরা ভাবে -- পাগলটা মরেও না । রাতে একটু শান্তিতে ঘুমোতে দেয় না । বাড়ির লোকেরাও বিরক্ত । ওকে অ্যাসাইলামে রেখে দিলেই হোত । বাড়িতে আনার কি দরকার ছিল ?

    নীলিমা আর নান্টু রাত জেগে প্রেম এবং প্রেমালাপ করছিল । দাশুর চিত্কারের ধাক্কায় নান্টুর আলিঙ্গন একটু ঢিলে হয়ে গেল । নীলিমা বলল, ওই নাও -- তোমার পাগল দাদা আবার ক্ষেপেছে ।

    প্রায় ছ'মাস দাশু পাগলা গারদে ছিল । এই ছ মাসে ওর অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি । বরং চেহারা কঙ্কালের মত হয়েছে -- ক্ষ্যাপামি আরও বেড়েছে । শেষ পর্যন্ত শ্রীমন্ত ওকে ফেরৎ নিয়ে এসেছে ।

    এ-বাড়িতে এখন দাশুকে দেখাশোনা যেটুকু করার তা বনমালিই করে । তবে আজকাল বনমালিও ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করেছে; চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাবার ভয় দেখাচ্ছে । দাশু আজকাল অনেক সময় ঘরের ভেতর মলত্যাগও করে রাখে, পেচ্ছাপ করা তো আছেই । রোজ জমাদারকে দিয়ে এসব পরিষ্কার করানোর হ্যাপা কি পোষায় ? বনমালির মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে । বাড়ির বউরাও খুব তোয়াজে রাখে ওকে । ও যদি সত্যিই কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যায় তাহলে মহা বিপদ হবে ।

    দাশুর ঘুম হয় না । জেগে থাকার ভেতরই একটা তন্দ্রার ভাব আসে --- সে সময়টায় খালি হাত পাগুলো নাড়তে পরে না, চোখের পাতা খুলতে পারে না । কিন্তু তখনও অনেক কিছু দেখতে পায় দাশু । ওর ঘরের জানালাটা খোলা -- সেখান দিয়ে দুটো লোকের মাথা উঁকি দিচ্ছে । যদিও জানালায় লম্বা লম্বা গরাদ লাগানো রয়েছে, লোকদুটো কিরকম একটা কায়দায় গরাদের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতর ওদের মাথা গলিয়ে দিল, তারপর পুরো শরীরটা গলিয়ে ঢুকে এল ঘরে । লোকদুটোকে চিনতে পারল দাশু । এরা তো ওই হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, যেখানে ওর ভাইয়েরা ওকে রেখে চলে গিয়েছিল । কিন্তু আসলে তো দাশু এখনও ওই গারদেই । ও পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল বলে এই লোকদুটো ওকে দুহাত ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে । ওদের হাতে রুলার সাইজের ছোট লাঠি -- তাই দিয়ে দাশুকে মারছে -- পিঠে, হাতে, পায়ে, পেটে । চেঁচিয়ে কাঁদছে দাশু, কিন্তু লোকদুটো ওকে ছাড়ছে না, সমানে মারছে আর টেনে নিয়ে যাচ্ছে । এবার ওরা ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে দু'হাত আর দু'পা লোহার খাটের সঙ্গে বেঁধে দিল । তারপর ওরা মাথায় একটা লোহার টুপি পরিয়ে দিচ্ছে । সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওই লোকটা -- চোখে চশমা, গলায় টাই বাঁধা । কিন্তু দাশু জানে যখনই এই চশমা পরা লোকটার সামনে ওরা ওকে বিছানায় বেঁধে মাথায় লোহার টুপি পরায়, তখনই মাথায় অসহ্য ব্যাথা পায় দাশু । চশমা পরা লোকটার পাশে কি সব যন্ত্রপাতি, এইবার কি সব যন্ত্র টিপছে লোকটা -- দাশুর মাথা লোহার জ্বলন্ত শূলে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল । আগুনের একটা তীর ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত সারা শরীর ফুঁড়ে ছুটে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে । দাশুর সমস্ত শরীর ধড়ফড় করে, মাথাটা এপাশে ওপাশে ছটফট করে লুটোপুটি খায় । তারপর দাশুর মুখ দিয়ে গোঙানি বেরোতে থাকে, হেঁচকি ওঠার মত, দমকে দমকে ।

    এবার চোখ খুলতে পারল দাশু । ওই ওয়ার্ডবয় দুটো, চশমা আর টাই পরা লোকটা – কেউ কোথাও নেই । গভীর রাত থমথম করছে -- দাশু ওর ছোট্ট ঘরে ময়লা বিছানার ওপর শুয়ে আছে । ওর গলার নিচের থেকে সমস্ত ধড়টা এখনও থরথর করে কাঁপছে, মাথার ভেতর লোহার ছুঁচ ফোটানোর ব্যথা হচ্ছে । পেচ্ছাপ করে ফেলেছে দাশু । দুর্গন্ধ, ফেনাভর্তি হলদে রঙের জলীয় পদার্থটা ওর দুই পা, বিছানা ভিজিয়ে দিয়ে মেঝেতে গড়িয়ে গড়িয়ে দেয়ালের দিকে চলেছে । মা -- এখন যদি একবার মাকে খুঁজে পাওয়া যেত । কিন্তু তোষকের নিচে মাদুরের গিঁট, মায়ের ঘরের দরজা তো তারও নিচে । হাত পা নাড়তে পারছে না দাশু -- মনে হচ্ছে সব অসাড়, অবশ । খালি ওর মুখ দিয়ে অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ বেরোয় -- মা, মাগো ।


    তখন দাশুর বিছানার মাদুরের নিচে চোরাকুঠরির দরজা খোলে, সেই আশ্চর্য গিঁটটাও খুলে যায় । বেরিয়ে অসে এক নারী । তার পরনে লাল পাড় শাড়ি, পায়ে লাল আলতা । অত্যন্ত স্নেহে এই নারী দাশুর মাথা কোলে নিয়ে বসে, আলতো করে ওর মাথার জটপড়া চুলের ভেতর দিয়ে আঙুল বোলায় ।

    দাশুর মাথার ভেতরে ছুঁচ ফোটানোর যন্ত্রণাটা আস্তে আস্তে কমে, শরীরের থরথরানি থেমে আসে । ওর দু'চোখ বুজে আসে, শান্তির ঘুম ঘুমোয় দাশু ।




  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments