বাতাসের কোন সংকট নাই, পক্ষপাতহীন বাতাস উড়ে যেতে পরে ধূপের গন্ধ আর আগরবাতির গন্ধ নিয়ে । শোক হাহাকারেও বাতাসের কিছু যায় আসে না । রমযানের হাসি আর প্রতাপের বিলাপ একই জিবে রেখে কুমার নদে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পরে, আবার কুমার নদের মাছ শ্যাওলার গন্ধ নিয়ে আড়িয়ালখার বুড়ি ছুঁয়ে আসতে পরে একই দমে । হায়, বসন্ত ঠাকুর যদি কার্তিকের বাতাসের মতো এমন সহজ নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে কোথাও উড়ে যেতে পারত, বিসর্জনের আগে, একবিন্দু শিশিরের মতো মিলিয়ে যেতে পারত সর্বভূতে ! অমঙ্গল অনাচার কিছুই তাকে বিষণ্ণ, অসহায় করে তুলত না । বসন্ত ঠাকুরের বুক পিঠ উদোম, ভিজা ধুতি শুকিয়ে আসছে, ঠোঁট কাঁপছে অথবা বিড়বিড় করে মন্ত্র জপ করছে কে বলতে পারে ! তার চোখ বন্ধ, হাত দুটি মাপ চাওয়ার ভঙ্গিতে জড়ো করা, লগ্ন ক্ষণ কিছুই তার স্মরণে নাই ?
শিবু যখন প্রথম খবর দেয় তখনো তার শরীরে ছিল ভিজা ধুতি, খালি গা এবং শিবুর সব কথা বুঝে উঠতে উঠতে সে অনুভব করে বাতাসের শিহরণ । এতো বড়ো রাত জেগে কাটাবার পর শরীরের ক্লান্তি খুবই স্বাভাবিক, তারপর নবমীর সন্ধ্যা আরতি ছিল দীর্ঘ সময় জুড়ে । মধ্যরাতের অনেক পরে ধূপনৃত্য শেষ হলেও সব কাজ শেষ হতে চায় না, কুটিন সাহার নাচের শেষে কপালের ধূপের ভার সহ পিছনে বাঁকা হয়ে পড়ে জ্ঞান হারায় । মণ্ডপের এক কোণে বসে বসন্ত ঠাকুর তখন বাস্তবেই ঝিমাতে ছিল । হঠাৎ ওরকম ধপাস আওয়াজ আর হট্টগোলে সে চমকে ওঠে, কালো হয়ে যাওয়া কলা, আতপ চাল, সফেদা বেল ডাবের প্রসাদ মুখে ঠেকিয়ে কুটিন সাহার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে । তারপর সে আর কোথাও যায় না, দশমীর লগ্ন শুরু হতেও বিলম্ব নাই দেখে শরীরের ক্লান্তি অথবা আরও শুদ্ধ হতে কুমার নদে নমে নাম জপ শেষে পরপর তিন ডুব দেয়, প্রণাম শেষে পাড়ে উঠে দাঁড়ায় । তখনই শিবু তাকে বৃত্তান্ত বলে, এইতো মাত্র সময়, খুব বেশি হলে আধঘন্টা পূজামণ্ডপে কেউ ছিল না, অথবা কেউ থাকলেও ঘুমিয়ে পড়েছিল । এর মধ্যে এমন সব ঘটনা ঘটতে পারে ! বসন্ত ঠাকুর জোড়া হাতে মার্জনা চাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, এর মধ্যে কয়েকটি শাড়ি দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে মণ্ডপ । ঘেরা পাঁচিলের অন্যপাশে তখন শিবু জড়ো করে ফেলেছে অনেককে, এমনকি পুলিশ আমলা কর্মচারীদেরও ভিড় বাড়ছে । কেউ কেউ শাড়ি ডিঙিয়ে দেখতে চায় - কার্তিক, গনেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী দেখে কেউ কিছু বুঝতে পারে না, দুর্গাকে ওই শাড়ির ওপর দিয়েও দেখা যায় না । শুধু সিংহের পা আর অসুরের মুখের কিছু অংশ বেরিয়ে আছে । দুর্গার শরীরে আরও একটি আটপৌরে শাড়ি, উপরন্তু বসন্ত ঠাকুর কিছু আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে ।
বসন্ত ঠাকুরের এই আড়াল অনেকটা পুরনো বটের আড়াল, যে বটবৃক্ষের চোখ নাই, গভীর খোড়লে বাতাসের হাহাকার, মাঝারি ঝড়েও উপড়ে পড়ার ভয়ে থির থির করে কাঁপে, বিরল পাতার ফাঁকে পাখিদের বিশৃঙ্খল চেঁচামেচি, মাটির সাথে সম্পর্কও আলগা, গোড়ায় ততো জোর নাই । এতোদিনের মাটিও তাকে আত্মীয়বোধে আঁকড়ে রাখতে পারছে না ! শিবু এবং লক্ষণ যখন কানের কাছে এসে বলে, ঠাকুর টিএনও-সাব কথা কইতে চায় । বসন্ত ঠাকুর তখন সত্যই আমূল কেঁপে ওঠে, সেই কাঁপে সকল পাখি চিত্কার করে কোথাও ছুটে পালাতে আকুল হয় । হাত বাড়িয়ে লক্ষণকে ধরে বসন্ত ঠাকুর । শিবু পুনরায় জানায় টিএনওর কথা । কিন্তু চোখ না খুলেই দুর্গার দিক পিছন ফিরে ধীরে ধীরে বলল, অন্য কেউ কথা বলুক, আমি পুরোহিত মাত্র । শিবু তবুও তার হাত ধরে সামনে এগিয়ে আনতে চায় । টিএনও কে দেখে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেয়, ঠোঁটের বাঁ-কোণে অতি সূক্ষ হাসির রেখা, কিসের সহযোগিতা কিসের প্রতিকার, ঠাকুর মুখ ফুটে বলতে পারে না, সব অপমানের প্রতিকার হয় না । টিএনও তখন জানতে চায় শাড়ি গহনা মিলে কত চুরি হয়েছে ! বসন্ত ঠাকুরের খোলা চোখ দ্রুত ঝাপসা হয়ে ওঠে, দুইহাত জড়ো করে সে আবার দেবীর দিকে ফিরে, যদিও তার চোখ আর খোলা নেই । শিবু তখন বলল, তার গলায় কিছু উষ্মার প্রতিঘাত, শাড়ি গয়না কোনো বিষয় না, আপনে বুঝবেন না, যান পারলে চোর ধরেন গা ।
দুর্গার শরীর থেকে শুধু শাড়ি অলংকার খুলে নগ্ন করা হয়নি, তার মসৃণ পেটের ওপর চক দিয়ে এঁকে রেখেছে পুরুষ লিঙ্গ, দু'উরুর সন্ধিতে কালো চুল এঁকে লাল দাগ । শুধু বসন্ত ঠাকুর নয় অন্যদেরও বুঝতে অসুবিধা হয়নি এ কোন চৌর্যবৃত্তি নয়, শুধু দূর্গার বস্ত্রহরণ বা শাড়িচুড়ি নয়, আরও অনেক কিছু । লাল পাড় ত্রক্রীম রঙের অর্ধেক গরদ কেউ চুরি করতে আসে না ।
পূজামণ্ডপ ছাড়িয়েও ভিড় এখন অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত । রাস্তায় টিস্টল-গুলোতে, সকালের কাঁচাবাজারে এখন অনেক মুখরোচক গল্প, কেউ হঠাৎ শুনলে মনে করতে পরে, দুর্গা নামের কোন ষোড়শীর ধর্ষিত হওয়ার গল্প নিয়ে সকলে বেশ উত্তেজিত । বিহ্বল ম্লান মুখগুলোকে দেখে মনে হতে পরে ধর্ষিতার আত্মীয় । তবে মণ্ডপ ঘিরে এখন পুলিশের সংখ্যাও কম নয়, কারণ দুইজন এমপি জেলাশহর থেকে এসেছে, এবং তারাই খবর ছড়িয়েছে যে, ভোলা যাওয়ার পথে মন্ত্রীও আসবেন । তো পুলিশ বা প্রশাসনের ব্যস্ততা আর দুর্গাকেন্দ্রিক নয়, মাননীয়দের নিরাপত্তাকেন্দ্রিক । একজন লোকাল নেতা পূজা-অধিকর্তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে, মন্ত্রী আসার আগেই দুর্গার শরীর থেকে সকল দাগ মুছে নতুন করে শাড়ি গহনা পরিয়ে দেয়া হোক । হয়তো নগ্ন দেবী দেখে মন্ত্রীমহোদয় অপমানিত হতে পারেন । বসন্ত ঠাকুর সেই প্রাথমিক বিপর্যস্ত অবস্থা কাটিয়ে লগ্নমতো বাকি পর্বটুকু শেষ করে ফেলতে তত্পর । কিন্তু সংকট হচ্ছে, দুর্গার শরীর থেকে ওই দাগ কে ধুয়ে ফেলতে পারে ? কে তাকে পরাবে শাড়ি ? সধবা ব্রাহ্মণ পত্নীগণ কি এই দায়িত্ব নিতে পারে ? শাস্ত্রে এবিষয়ে কিছু উল্লেখ আছে কিনা বসন্ত ঠাকুর তা জানে না, পূজার দেবীকে আর কে স্পর্শ করতে পারে ? ঠাকুর কি নিজেই পরিয়ে দিবে শাড়ি ! পুরোহিত অন্যদের সাথে পরামর্শ করেও কোনো বিধান দিতে পারছে না, এদিকে দশমীর লগ্ন বেশিক্ষণ নাই, তারপর আয়োজন করতে হবে বিসর্জনের । যখন স্থির হলো দুইজন সধবা ওই দাগ ধুয়ে শাড়ি পরিয়ে দিবে এবং বসন্ত ঠাকুর সকলের হয়ে গোবিষ্ঠা জিভে ঠেকিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে পূজাপার্বণ করবে তখনই পূজা-অধিকর্তাদের জানানো হয়, মন্ত্রী আসবার আগে বিসর্জন হতে পারবে না, কারণ মন্ত্রী নিজেই দেবীর কাছে ক্ষমা চাইবেন ! আহা এতো মহান বাসনা । পূজার্থীদের আহ্লাদিত হওয়ার কথা ! কিন্তু লগ্নক্ষণ অতিক্রম করে তো দেবীকে রাখা যাবে না । বসন্ত ঠাকুর হাতজোড় করে, লগ্ন মতোই বিসর্জনের অনুমতি ভিক্ষা করলে টিএনও সাহেব তখন পুরোহিতের শরীরে হাত রেখে সামান্য হাসি জড়িয়ে যেন মিনতি রাখছে, ঠাকুর, পঞ্জিকার লগ্ন সবসময় ঠিক নাও হতে পরে, আপনিই লগ্ন ঠিক করে নেন । বসন্ত ঠাকুর ওই স্পর্শে কেঁপে ওঠে । তার উদোম শীর্ণ শরীরে ওই হাতের ওজন ঠাণ্ডা পাথরের মতো লাগে । তাকে হয়তো আবারও শুদ্ধ হতে হবে, কিন্তু সে কী করে লগ্ন উপেক্ষা করবে !
দশমীর পূজাপর্ব শেষ, ঢাকঢোল বাজছে মেঘের বিরতিহীন গর্জনের মতো, লক্ষণ নির্দেশ দিয়েছে গায়ের জোরে বাজাতে, যতক্ষণ এই মণ্ডপে দেবী থাকবে, ঢাক যেন না থামে । বিরতিশূন্য আওয়াজে কি সেই মহাঔষধ আছে, যা নিরাময় করবে সকল শোক তাপ ! নাকি এই আওয়াজ আড়াল করবে অন্যদের গুঞ্জন ! অথবা লক্ষণ হয়তো অব্যক্ত ক্রোধ এভাবেই প্রকাশ করতে পারে ! অথবা হতে পারে দেবীর বিলম্বিত বিদায়ের ঘোষণা স্বর্গে পৌঁছে দিতে চায় ! সে যাইহোক এখন মন্ত্রীর জন্য সকলে অপেক্ষায়, ভিড় বাড়ছে, এ বড়ো মওকা হয়তো । বসন্ত ঠাকুর পারেনি নতুন কোনো লগ্ন তৈরি করতে । সে মণ্ডপ ত্যাগ করে কালিবাড়ি সংলগ্ন নিজের বসতবাড়িতে যেয়ে ওঠে, তার শরীর আর বেশি চলছে না, সে কোনো ভাড়া-করা পুরোহিত নয় যে পূজা-অধিকর্তাদের বা অন্য কারো নির্দেশ মানতে বাধ্য, বরং মণ্ডপের সেই কর্তা, তার নির্দেশই পালিত হওয়া উচিৎ । যখন তার মিনতি উপেক্ষা করে দেবীকে মন্ত্রীদর্শনের জন্য বেঁধে রাখা হয় তখন পুরোহিত খুব গৌণ ব্যাপার । বিশেষ করে মন্ত্রীর দেবীদর্শনের পরিবর্তে দেবীর মন্ত্রীদর্শনের ঘটনা ঘটতে যায় তখন বসন্ত ঠাকুর নিজেরও বিসর্জন কামনা করে । জগত্মাতার কাছে গোপনে ক্ষমা চেয়ে সেই প্রার্থনা করে অন্তত প্রথমবারের মতো দেবীর আগে পুরোহিতের বিসর্জন হোক, এবং সে আশায় বসন্ত ঠাকুর তার শীতল বিছানায় গা এলিয়ে দেয় ।
কার্তিকের বাতাস তখনও ধূপের গন্ধ ঢাকের আওয়াজ আর মন্ত্রীর আগমনের তোড়জোড় বয়ে চলছে, হয়তো বসন্ত ঠাকুরের প্রার্থনাও বাতাসে ফিস ফিস করে উড়ছে । দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে ঢোলের শব্দ হুহু করে ঢুকে পড়ছে সকল চৈতন্য জুড়ে । বসন্ত ঠাকুর চোখ বন্ধ করে ফেললেও টিএনওর কথা ভুলতে পরে না । তার ঠোঁটে হাসির রেখা স্থির হয়ে থাকে ।