• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ২৭ | আগস্ট ২০০২ | প্রবন্ধ
    Share
  • সুরের সাহসে ... :

    কবিতায় দুরকম সুর । ব্যবহৃত শব্দগুলির ধ্বনিসৌকর্ষ তার বাইরের সুর । শব্দালঙ্কার দিয়ে বোঝানো যায় তাকে । ধ্বনির ওঠানামা বা স্পন্দন কবিভাবনা ও লিখনশৈলীর সঙ্গে অন্বিত হয়ে পাঠককে যে কাব্যরস আস্বাদন করায় তারও তো একটা অশ্রুত সুর রয়েছে, হ্যাঁ, সুরই বলবো একে । ভেতরের সুর যেভাবে পাঠককে এ-জিনিস শোনাতে চান প্রেরণাঋদ্ধ কবি, পাঠকের কাছে সেটা সেভাবে ধরা দেবেই - একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না । সতর্কতা প্রয়োজন এ বিষয়ে । কতখানি সতর্কতা ?

    জীবনানন্দের কবিতার পাণ্ডুলিপিতে অসংখ্য কাটাকুটি থেকে কিঞ্চিৎ আভাস মেলে । কিংবা শিশুসাহিত্যিক অখিল নিয়োগী (স্বপনবুড়ো)'র `স্বনামধন্যের সান্নিধ্যে' বইটিতে লেখকের সঙ্গে ঠাকুরমার ঝুলির দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের কথোপকথনে -

    "তিনি (দক্ষিণারঞ্জন) বললেন, রূপকথার পাত্রপাত্রীদের মুখে যে-জাতীয় কথা আমি বসিয়েছি সেটা একটু ভালো করে তলিয়ে দেখেছ কি ?

    আমি (স্বপনবুড়ো) ব্যাপারটা ঠিক অনুধাবন করতে না পেরে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম ।

    তিনি জবাব দিলেন, তাহলে বলি শোনো, ধরো রাজা একটা দু:সংবাদ শুনে তাড়াতাড়ি অন্দরমহল থেকে বেরিয়ে আসছেন, এখন রাজা হচ্ছেন রাজ্যের প্রধান, গাম্ভীর্যপূর্ণ কথা দিতে হবে তাঁর মুখে ! তাই আমি রাজার মুখে বসিয়ে দিলাম - কে ? - কে ?

    রানী হচ্ছেন নারী । রাজ্যের সবাইকার মা, তাঁর কন্ঠ থেকে সরু আর মধুর কথা বেরুনোই স্বাভাবিক তাই আমি রানীর মুখে বসিয়ে দিলাম - কি ? - কি ?

    পড়ে দেখো - ঠিক মানিয়ে যাবে, শুনে আমি জবাব দিলাম, সত্যি এতটা তলিয়ে ত' আমি পড়িনি !"


    সামান্য `ংএ ' এবং ংই ' ধ্বনি সম্পর্কে এতখানি সচেতনতা এমনিতে পাঠকের দরকার নেই । কিন্তু লেখকের আছে ষোলোর জায়গায় আঠেরো আনা ।

    শিল্পী যিনি - মাধ্যম তাঁর শব্দ হোক কিংবা সুর কিংবা ছবি - জগত্জীবনকে সেই মাধ্যমের বশ করে ফুটিয়ে তোলার ইচ্ছেটা তো স্বভাবজ ।


    যে সৃজনীশক্তিকে কবি শিল্পীরা অনুভব করেন প্রেরণা হিসেবে তার শুরুটা হয়ত একই - কিন্তু শেষটা কখনো সুর, কখনো ছবি, কখনো কবিতা । মন কাড়ার কাজটা সুর যত সহজে পরে, ছবি ততটা নয়, আর কবিতা তো আরোই কম । তাই কবিকে `হৃদয়ে হৃদয় যোগ' করার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয় সবচাইতে বেশি, পাঠকের চেয়েও আগে নিজেকে যে যতটা পারা যায় সন্তুষ্ট করতে হবে ।

    প্রেরণার জোর নিজের মধ্যে সবসময় অনুভব করতে পারাটা একটা চ্যালেঞ্জ । সে-কাজে সুর আর ছবি - দুই-ই কবিকে সাহায্য করে থাকে । বিষয়টি উল্টো দিক থেকেও সমান ভাবে সত্যি কতটা, তার একটা আঁচ পাওয়া গেল ১৬ই মার্চ ২০০২-এর সন্ধ্যায় । `সৃজন' গোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনায় এদিন কবি জয় গোস্বামী ও সরোদিয়া তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার পাশাপাশি বসলেন । কবিতা / কবিতাংশ পড়তে লাগলেন জয় । একেকটি লেখা কিভাবে তাঁকে নাড়া দিয়েছে সেটাই বিভিন্ন রাগ-রাগিনী বাজিয়ে বোঝাতে চাইলেন তেজেন্দ্র । মনে রাখতে হবে প্রকাশ্যপাঠ বা আবৃত্তির তাত্ক্ষণিকতা নয়, নিভৃত নি:শব্দ কবিতাপাঠের ধারাবাহিকতা ভেতরে ভেতরে কিভাবে সাঙ্গীতিক বোধকে উদ্দীপ্ত করে - সেটা বোঝানোই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল এই অনুষ্ঠানের । ফলে কবিতা ও রাগ নির্বাচন পরস্পরের পরিপূরক কিনা, শ্রোতাদের সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার স্বাধীনতা অবাধ থাকলো । নইলে তো গোটা অনুষ্ঠানটাই নিছক গিমিকে পর্যবসিত হত ।

    একপাতা স্বরলিপির কাছে কবিতার পাণ্ডুলিপির একপাতা যে সবসময় হেরে যায় তা তো করেই বলে গিয়েছেন ভ্যালেরি । কিন্তু জীবনানন্দের মতো `কেউ কেউ কবি'রা বোঝেন এই হার অগৌরবের নয় আদৌ ।

    দুটি কবিতাংশ উদ্ধার করা যাক -

    চক্ষু এই - ছিঁড়ে গেছি - ফেঁড়ে গেছি - পৃথিবীর পথে হেঁটে হেঁটে কত দিন-রাত্রি গেছে কেটে !
    কত দেহ এল, গেল, হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
    দিয়েছি ফিরায়ে সব - সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে
    নক্ষত্রের তলে
    বসে আছি -


    [ ১৩৩৩ / ধূসর পাণ্ডুলিপি]

    তারপর, কতবার চাঁদ আর তারা,
    মাঠে মাঠে মরে গেল, ইঁদুর পেঁচারা
    জ্যোত্স্নায় ধানক্ষেত খুঁজে
    এল গেল, - চোখ বুজে
    কতবার ডানে আর বাঁয়ে
    পড়িল ঘুমায়ে  -

    [ মাঠের গল্প / ধূ. পা.]


    সৃষ্টির বেদনার মূলে মিশে রয়ে যাওয়া অমোঘ আমোদকে ফুটিয়ে তোলার কাজে জীবনানন্দের প্রথম এবং শেষ প্রেম অক্ষরবৃত্ত, তাই পর্বনির্মাণ করতে গিয়ে প্রেরণার তীব্রতায় তিনি ১৮, ২২, ২৬ মাত্রা ছাড়িয়ে অক্লেশে ৩০, ৪২-এ পৌঁছে দীর্ঘ তানকারির আস্বাদ পেতে চান । সচেতন ভাবে যুক্তব্যাঞ্জন ধ্বনির বিশ্লিষ্ট উচ্চারণকে প্রশ্রয় দেন, নানা রকমে -র ও নানা স্থায়িত্বের অনুপ্রাস ব্যবহার করেন, শৈলীতে নিয়ে আসতে চান স্বাভাবিক বাক্যস্পন্দ - যতি ও লয়ের সূক্ষ্ম পরিবর্তনের সাহায্যে, যার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে বাইরের ও ভেতরের সুর মিলে গিয়ে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আবহ তৈরি করে ।

    প্রথম উদাহরণে `এল, গেল' চারমাত্রা পেলেও পরের উদাহরণে লয় ঈষৎ কমে `এল, গেল' পেল ছয়মাত্রা - এল(ও), গেল(ও) । ফলে `মধুর অবসাদের ক্লান্তি' বেড়েই গেল অনেকখানি । এরকম গীতল অভিভাব সৃষ্টির দৃষ্টান্ত বাংলা কবিতায় খুব বেশি নেই আর ।

    এই সঙ্গীতময়তার স্বরূপ বুঝতে গেলে আমাদের শব্দ বাক্য নিরপেক্ষ সুরের কাছে আসতে হবে আগে । তারপর সুরের হাত ধরে পৌঁছতে হবে কবিপ্রেরণার দোরগোড়ায় । সেইসঙ্গে মনে রাখতে হবে চিত্রাচার্য নন্দলাল বসুর স্বামী প্রজ্ঞানানন্দকে লিখিত চিঠির অংশবিশেষ -

    "দরদী শিল্পীর কাছে রস জিনিসটা স্বত:স্ফূর্ত ভাবে আসে, বিশ্লেষিত হয়ে আসে না - যদিও শিল্পী পরে তা বিশ্লেষণ করেন - কেবল তাঁর অনুভবটা ঠিক হয়েছে কিনা মিলিয়ে দেখার জন্য । এই অনুভবের রাস্তাই দরদী শিল্পীর পক্ষে ঠিক । ... এই রূপ বিশ্লেষণ ঠিক হলেও যাঁরা সাধারণ শিল্পী, অনুভাবক ও দরদী নন, তাঁদের কাজ চলতে পরে, কিন্তু সৃষ্টির দিক দিয়ে ... রসিকের পীড়ার কারণ হয় ।"

    সুরসাধক প্রাচীন মানুষ সুর পেয়েছে প্রকৃতি থেকে । বৃষ্টি বজ্রপাত থেকে, ঝর্ণা - নদী থেকে, অরন্যে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ থেকে, পাথর গড়িয়ে পড়া থেকে, পশুপাখির ডাক থেকেই সুর আহরণ করতে চেয়েছে তারা । ৪,
    ৫, ৬ বা ৭-টি স্বর মিলে একটি রাগের অবয়ব তৈরি হয় । তিন বা তার কম সংখ্যক স্বর কোন রাগকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে না পারলেও অংশত রাগছায়া নির্মাণ করতে পারে ।

    ভাব এবং রসই সঙ্গীতের মূল কথা । তাই সুরসাধক স্বরের রস ও বিন্যাস অনুসারে যখন কন্ঠ বা যন্ত্রসঙ্গীতে রাগরাগিনীর ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেন তখন মনে মনে তাঁকে রাগরাগিনীর একটা রূপ কল্পনা করে নিতে হয় । সেই রূপটি ছবিতে প্রকাশ করেন চিত্রকর আর কবিতায় তকে মূর্ত করে তোলেন কবি । সার্থক সুরসঙ্গমে এমনটি ঘটে ।

    একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করা যাক । তোড়ি'র গায়নকাল দিবা দ্বিপ্রহর । প্রকৃতি - শান্ত ও গম্ভীর । অবয়ব : সা রে গ ম প ধ নি । সা

    [বাদীস্বর : ধৈবত । বাদীস্বর রাগছায়া তৈরির মাধ্যমে রসভাবের ধারণা দিতে চায় । এর প্রয়োগ অন্যান্য স্বরের চাইতে বেশি ।

    সংবাদী স্বর : গান্ধার । সংবাদী স্বর সেই ধারণাকে বাস্তবায়িত করে । এর প্রয়োগ অন্যান্য স্বর (অনুবাদী) এর চাইতে বেশি হলেও বাদীর চেয়ে কম । ]

    এই রাগিনীর রূপকল্পনা করা হয়েছে একটি মেয়েকে অবলম্বন করে । বিরহিনী বেশে সে বসে আছে কোন বিজন শস্যক্ষেত্রে । বীণা বাজিয়ে নিজের বেদনার কথা বলছে বনের হরিণদের । `সঙ্গীতদর্পণ'-প্রণেতা দামোদরের ভাষ্যে -

    তুষারকুন্দোজ্জ্বল দেহযষ্টি:
    কাশ্মীর কর্পূর বিলিপ্ত দেহা,
    বিনোদয়ন্তী হরিণং বনান্তে
    বীণাধরা রাজতি তোড়িকেয়ম্‌ ॥


    তোড়িয় চাক্ষুষচিত্রের উপাদানও এর মধ্যেই বিধৃত । উত্সাহী পাঠক স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের দুই খণ্ডে সমাপ্ত `রাগ ও রূপ' বইটিতে এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা পাবেন ।

    আমাদের ঔত্সুক্য - আধুনিক কালের কবি কীভাবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনে প্রেরণা পান এবং তাঁর মহৎ কবিতা কোন রাগরাগিনীর ভাবরস আস্বাদন করতে চায় আমাদের - সেই সম্পর্কে ।

    একটি কবিতা কোন রাগ বা রাগিনীর সঙ্গে কতখানি সুরসাম্যে আসতে পারে এবং গায়ন বা বাদন ক্রিয়ার সঙ্গে লিখনক্রিয়ার কোন সাযুজ্য আছে কিনা - এটা যেকোন সচেতন কবিরই চিন্তার বিষয় । `পরবাস'-এর র্‌৪থ সংখ্যায় জয় গোস্বামীর একটি কাব্যগ্রন্থের নিবিড় পাঠ প্রসঙ্গে আমি কবিতায় কীভাবে শুদ্ধ, কোমল- তীব্র, স্পর্শ স্বর আসতে চায় তা দেখানোর চেষ্টা করেছিলুম । পৃথিবীর সমস্ত স্বর যেমন সুরসাধকের কাছে মাত্র ১২টি স্বরে (সা, রে, রে , গ, , , ম, প, ধ, , নি, নি ) সংহত হয়ে আসে তেমনি জগজ্জীবন সম্পর্কে কল্পনা - অভিজ্ঞতার নির্যাস কবিতায় একটি সংহত শিল্পমূর্তি পেতে চায় । রবীন্দ্রনাথের `গীতাঞ্জলি', জীবনানন্দের `বনলতা সেন', জয়ের `সূর্য-পোড়া ছাই' এর সার্থক উদাহরণ । বিপরীতক্রমে ঐ বারোটি স্বর যদি পৃথিবীর অজস্র স্বরে মুক্তি পেতে চায় তাহলে কি জন্ম নেবে নজরুলের `অগ্নিবীণা', সুকান্তর `ছাড়পত্র', সুকুমারের `আবোল তাবোল', জয়ের `হরিণের জন্য একক' ? উত্তর জানা নেই আমার ।

    একটি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনতে শুনতেই রাগনির্ণয় করার মতো দক্ষ কান তৈরি হয়নি আমার; সঙ্গীতপরিভাষা-জ্ঞানও ক'অক্ষর গোমাংস । তাই অনুষ্ঠান শুরুর আগেই কোন কবিতার পর কী রাগ বাজানো হতে পরে তার একটা ধারণা পেতে চেয়েছিলুম কবি-শিল্পীর কাছে ।

    এদিন জয় শুরু করলেন বহুপঠিত আমার দোতারা কবিতাটি দিয়ে -

    সুর তো ফকির, চলে ধুলো পায়ে গ্রাম থেকে গ্রামে সুরের মাথায় চূড়া, পরওয়ারদিগরের নমে
    সুর তো গাছের পাতা, উড়ে জলে সহজিয়া বাউলে বীরভূম মাতে, দাওয়া ঘেয়ে কীর্তনে নদীয়া
    ফকির চলেছে আগে, সুরে কাঁপছে গাছের পাতারা শতাব্দী পরের কবি, আমি বাঁধছি আমার দোতারা
    ধন্য ধন্য করে সব - পাখি ডাকে - ভোর হয়ে যায় ফকির তোমার বাংলা জেগে ওঠে আমার বাংলায় ।


    পড়তে পড়তেই মনে হয় জগৎ সুরময় । সুরের এই সর্বাত্মক উপস্থিতির ধারণাটি জোরদার হয় তেজেন্দ্রর সুরেলা হাতে ঝিঁঝিট মাঝ রাগের আলাপে - দীর্ঘ মীড়ে ।

    পরের কবিতাংশে মানুষের রণরক্ত সফলতা-য় বেদনার্ত কবির মুখটি ফুটে উঠেছে -

    পুরাকাল থেকে তীর তুলে আছে ব্যাধ
    বোতাম টিপলে পৃথিবী ধ্বংস হবে
    এসো কবি, এসো বাধা দাও,
    মা নিষাদবলে ওঠ তুমি, ভেঙে যাক উইঢিবি


    আমার প্রত্যাশা মতোই শুনতে পেলুম মন্দ্রসপ্তকের মারোয়া, পূর্বী, বীতপঞ্চম মারোয়ায় তীব্র মধ্যম, কোমল ঋষভ মনকে বিষণ্ণ করে দেয় । পূর্বীতে তো ধৈবতও কোমল ।

    স্বপ্নে পাওয়া বাদল হাওয়া কবিতাটির পরে দেশ - দেশমল্লার - মিঞা কি মল্লার সুখশ্রাব্য লাগে । আমার অবশ্য এর সঙ্গে ধুলিয়া মল্লার শোনার সাধ হচ্ছিল । সূর্যের তেজ কমে আসছে ধুলোওড়ানো ঝোড়ো বাতাসে বৃষ্টির আসন্নতায় - সেই সন্ধিমুহূর্তের রাগ এটি ।

    বসন্ত রংতা-র হিন্দী অনুবাদ [`শুকনো পাতার ডালে']

    সবার সঙ্গে বসেছিলাম, পথের পাশের চায়ের দোকান মাথার ওপর খড়ের চালা, ছই
    আবার কেন ডাক পাঠালে, ও অন্ধকার বসন্ত দিন, এখন আমার ভূমিকা অল্পই


    মন - কেমন - করানো এই কবিতায় কবি ও পাঠকের মধ্যে শ্যামকল্যাণের সম্পর্কটি আবিষ্কার করতে চাইলেন তেজেন্দ্র ।

    শিকার ভ্রমণ করে বনমধ্যে নিষ্পাপ শিকার .... তুমি কি আড়াল থেকে তাকে লক্ষ করো অন্ধকার ? - কবিতাংশটি তাঁকে উদ্বুদ্ধ করলো ছায়ানট বাজাতে ।

    এরপরে জয় যখন পড়লেন

    ভুতুম ভগবান থেকে আমরা পান করি, আমরা প্রাণ করি, মৃত্যুকে
    মৃত্যু কে মৃত্যু কে ? ... ....
    আমরা যাই বলি ব্রহ্ম তাই কালব্রহ্ম তাই বালব্রহ্ম তাই আমরা নিজেদের জায়গা চাই ।

    কে দেবে জায়গা তোকে .....
    বাজে গাল ববম ববম
    আগুনের চিন্তা করি আগুনের সময় কখন
    আগুনের সময় এখন বলো জয় ববম ববম
    বলো জয় ...


    আর সঙ্গে সঙ্গে তেজেন্দ্র ধরলেন শিবরঞ্জনী - বিলম্বিত গতের পর তিনতালেই দ্রুতগত - শেষমেশ এক দুরন্ত ঝালা - সকলেই উদ্দীপ্ত হলেন ।

    পরে সত্কার গাথা'র (চিত্রলেখা বসুর স্বকৃত সাবলীল ইংরেজি অনুবাদ ছিল সমগ্র অনুষ্ঠান সঞ্চালনার মতোই প্রশংসনীয়) রেশ ধরে রাখলো দরবারী কানাড়া ।

    অনুষ্ঠানটি শেষ হল অনবদ্য ভৈরবী দিয়ে -

    আমার কবিতার তলায় মস্ত শহর
    যে শহর রাত্রিবেলা বিরাট একটা সরোদ হয়ে যায়
    কিন্তু তার গা মসৃণ থাকে না, খানাখন্দ ভরা তার উঁচু নিচু শরীরে
    উন্মাদের মতো চলাচল করছে আমার রক্তমাখা আঙুল
    ঝাঁপ দিচ্ছে একটার পর একটা আশ্চর্য পর্দায়
    তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমার এই রাগ উন্মোচন ?
    আলাপ থেকে জোড়ে পৌঁছোচ্ছি আমি, গৎ ধরবার আগেই আমার
    আঙুল খসে যাবে
    তার আগে তুমি কি একবার দেখবে না কিভাবে আমার
    হাত খেলছে কলকাতা নামক এই অপরূপ বাদ্যযন্ত্রের গায়ে ?

    অন্তর্লীন সুরবোধ এবং সঙ্গীতের কাছে কবিতার পরাজয় স্বীকারের গরিমা কবিকে দিয়ে শেষ পর্যন্ত নীরবে বলিয়ে নেয় -

    আমি
    জানতাম না যে আমার হাত এই কেঠো রোগা হাত
    একটা বীণাযন্ত্র

    যার তার আসলে বাঁধা গভীর সংবেদনশীল মনে, যে মনের হদিশ লিখতে বসে কবি কখনো-সখনো পেয়ে যান সঙ্গীত - কবিতার সুরসুষমার ঈপ্সিত অভেদবিন্দুতে; - সৃষ্টিসুখের উল্লাসে শিহরিত হন তখন ।


    [ভারতীয় সঙ্গীত বিষয়ক তত্ত্বগুলি স্বামী প্রজ্ঞানানন্দের `রাগ ও রূপ' থেকে নেওয়া হয়েছে ]



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments