• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৪ | অক্টোবর ২০২১ | রম্যরচনা
    Share
  • ইতিহাসে নেই - (১) মুক্তোবিবি (২) সেন মহাশয় : সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়
    মুক্তোবিবি | সেন মহাশয়


    ১৯৬৮ সালের শেষ দিক। কালকা মেল-এর বেগে এগিয়ে আসছে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। আরো ভয়াবহ, ইস্কুলের টেস্ট পরীক্ষা তারও আগে। কয়েক সপ্তাহ পরেই। সে অতি বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার।

    আমাদের কয়েকজনের মুখ দেখলে এসব তেমন বোঝা যাচ্ছিল না। জন তিনেক ছেলে আর জন দু-এক মেয়ে হায়ার সেকেন্ডারি সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাসে ভরপূর, চিন্তা ওই টেস্ট নিয়ে। সে চিন্তা এতই বেশি যে লেখাপড়া বন্ধ, পরস্পরের বাড়ি গিয়ে শুধু বাজে আড্ডা। বিজ্ঞান যাদের বিষয় তারা আই আই টি, বি ই কলেজ, জে বি এন এস টি এস আর এন এস টি এসের প্রজেক্ট এসবের কথাও মাঝে মাঝে ভাবছে।

    এক বন্ধু আর আমি দুয়েকবার সব ফেলে সারা দিনের মতো শহরের বাইরে চলে যেতাম। বেশ লাগত। বিজ্ঞানের ছাত্র আমরা, সামনে নানারকম পরীক্ষা, চাগিয়ে উঠল ইতিহাসে ইন্টারেস্ট। এই তো লোকাল ট্রেনে সামনেই পাণ্ডুয়া, গৌড়(!) নিশ্চয় তারই কাছে, চ' দেখে আসি। দুজনেরই দেশ হুগলি, ওর গুরুজনরা সবাই আবার ফরাসী পড়া।

    বাড়ির দৈনিক বাজারের দায়িত্ব ছিল আমার। দুটি ভেক্টরের স্কেলার প্রডাক্ট হতো বাজারের টোটাল, একটি ভেক্টর মায়েরা আন্দাজী জানতেন, অন্যটা …

    কাজেই ফাইনান্স নিয়ে কোনো প্রবলেম হতো না।

    ওসব জায়গায় উইন্ডসর সিগারেট পাওয়া যাবে কি না কে জানে, ০.৫৮ দিয়ে একটা গোটা প্যাকেট কিনে নিলাম। পানওয়ালা ছোটুলালের কাছে রেখে দেওয়া প্রাইভেট চিরুনিটাও সেদিনের মতো সঙ্গে নিলাম। তার পর আট নম্বরে চেপে হাওড়া আর সেখান থেকে মেন লাইনের বর্দ্ধমান ধরে সোজা পাণ্ডুয়া। প্রায় ফাঁকা গাড়ি।

    পাণ্ডুয়ায় নেমে দেখি স্টেশনের পাশেই একটা বিরাট দিঘি। পাড়ে দুটো ছিপ আর সেগুলোর দুজন মালিক - চারজনেই ঘুমোচ্ছে। মনে হলো ছিপদুটোরও নাক ডাকছিল। একটু একটু নড়ছিল তো বটেই।

    সে যুগে আমাদের কেন জানি না কখনো কখনো খিদে পেত। তা দিঘির ধারে দেখলাম সাইনবোর্ড ঝোলানো হোটেল - পরোটা মামলেট কিরিমকেকার চা পাওয়া যায়।

    রেস্ত ভেরিফাই করে নিয়ে ঠিক করা হলো মোবিলে ভাজা পরোটা আর মামলেট খাওয়া হবে। বসে পড়লাম।

    দুজন ভালোমানুষ টাইপের লোক, যমজ মনে হলো, একটা বেঞ্চিতে উবু হয়ে বসে বিড়ি ফুঁকছিলেন। এক রকম গেঞ্জি, এক রকম সাড়ে পাঁচ হাতি কাপড়। একটু বয়স্ক, একজনের ইন্দ্রলুপ্ত, অন্যজনের চিবুকে ছোট একটা নূর। বোঝাই গেল ধর্মভাব ভিন্ন, মানে একজনের নাম হয়তো ঈশান মন্ডল, অন্যজনের নাম সেখানে ঈশাক মন্ডল, অর্থাভাবে কোরবানি না দিয়ে দিয়ে দ্বিতীয়জন প্রায় হিন্দুত্বপ্রাপ্ত।

    ওদিকে পরোটা ভাজা চলছে, কড়া মোবিলের গন্ধ ভুর ভুর করছে।

    আমার বন্ধু অমিত প্যাকেট থেকে দুটো সিগারেট নিয়ে ওনাদের কাছে উঠে গেল। জিজ্ঞেস করল,
    --আচ্ছা দাদা, গৌড় যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে? মানে, হেঁটে আর কি?

    উল্টো প্রশ্ন এল,
    --গৌড়? সে কোথায় বাবু?

    --কেন, ওই হোসেন শাহের রাজধানী ছিল? এই এদিকেই কোথাও একটা?

    পরস্পরে কিছুক্ষণ মুখ চাওয়া-চাওয়ি। তারপর নূর:
    --বুঝেছি। ওরে, সেই একবার মা গেসল না? খালাদের সঙ্গে? তা সে তো বাবু বর্দ্ধমান থিক্যা রেলেই চার ঘন্টা না কত।

    মনটা গেল খারাপ হয়ে। তাও জিজ্ঞেস করলুম,
    --আপনার মা গিয়েছিলেন? বেড়াতে বুঝি?

    এবারে ইন্দ্রলুপ্তর পালা:
    --না না ওই মুক্তকেশী মায়ের থানে গেসল বোধ হয়।

    দুর্দ্ধর্ষ চটপটে আমার বন্ধু, তাও মুখটা কেমন বোকাটে হয়ে গেল। আমিই গলাটা বাড়িয়ে দিলাম,
    --সেটা কী ব্যাপার দাদা?

    সিগারেট দুটো তখনও অমিতের হাতে। নূর, মানে ঈশাক, সেদিকে তাকাতে অমিত তাড়াতাড়ি ইন্দ্রলুপ্ত, মানে ঈশানকে একটা আর ঈশাককে অন্যটা দিয়ে হাত খালি করে ওদের ওদিকেই বসে পড়ল। আর উইন্ডসরটা হাতে নেওয়ার পর ইন্দ্রলুপ্তর ঘটল স্মৃতিবিভ্রম,
    --ঠিক জানি না বাবু। এই তুই তো জানিস, বল না।

    শুনে আমি:
    --ও ভাই, পরোটা মামলেট চার জনকেই দেবেন।

    নূর এমনিতেই কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, আমার ওই কথায় তাঁর বিবরণের চাকায় পড়ল তেল।
    --সে বাবু হোসেন শায়ের আমল - একশো বছর আগেকার কতা। এক জন মৌলবী আপুনাদের কয়েকজন লেডিসকে - বোধ হয় বেওয়াটেওয়া হবেন তারা - কলমা পড়াতে এনেছিল মজ্জিদে। তা বামুন পুরুতরা চটে গিয়ে সোজা ছোলতানের দরবারে হাজির। ওই আপনাদের গৌড়ে। তা ছোলতান নামে ছেয়া কাজে ছুন্নি - গেল চটে। লেডিসদের জন্যে নদীর পাড়ে বোষ্টম মন্দির বানিয়ে তাদের সেথায় পাঠিয়ে দিলে। এখন হয়েছিল কি, তাদের একজন কী যে বুঝল - মন্দিরে না গিয়ে চলে গেল সেই সেথা বাঘ ভাল্লুকে ভরা জঙ্গলে। সেখানেই থাকত - তারা কিছু বলত না। তেনার নাম ছিল মুক্তোবিবি - এই এরা বলে মুক্তকেশী। জঙ্গলের মধ্যে ওনার থানে গিয়ে সবাই মানতটানত করে এখনো - পেয়েও তো যায়। এই আমার দাদামশাইকেই তো তিনি কালাজ্বর থেকে বাঁচিয়ে দেন।

    মন দিয়ে শুনছিলাম আমরা। হঠাৎ দেখলাম ছিপে-মানুষে চারজন-ই ঘুম থেকে উঠে এসে হাঁ করে গপ্পোটা গিলছে।

    আগের বছরে ঠান্ডা লেগেছিল বলে দোল খেলতে দেওয়া হয়নি, আমার ভাগের রংগুলো ছিল পড়ে। সেই রংগুলো ব্যবহার করে আর একটুখানি ফাঁপিয়েটাঁপিয়ে পদ্য টাইপের লিখে দিলাম।



    মুক্তোবিবি

    হোসেন শাহ সে মহাবিক্রম
    গৌড়ের সুলতান
    সকল প্রজারে সমান দেখে সে
    হিন্দু মুসলমান
    জনসাধারণ সদাই স্বাগত
    খোলা তার দরবার
    নাই কোনো বাধা জানাতে নালিশ
    তাহাকে কোনো প্রজার

    একদিন এক প্রৌঢ় হাজির
    শিরে শিখা উপবীত
    অভয় জেনেও সজল চক্ষু
    কোন এক ভয়ে ভীত
    মৌলবী এক খানকা পেতেছে
    পাশের গাঁয়েতে তার
    জুলুম চালায় এ গাঁয়েতে এসে
    প্রায়ই নানা প্রকার
    অন্য গাঁয়ের হিন্দুকন্যা
    কয়েক জনেরে নাকি
    ধরে এনেছে সে খানকাতে
    শুধু কলমা পড়ানো বাকি
    মহানুভবতা শুনেছে অনেক
    তারা যে জাহাঁপনার
    তাই দরবারে এসেছে সে যদি
    হয় কোনো প্রতিকার

    শুনে সব কথা গৌড়েশ্বর
    ক্রোধে হয়ে গেল লাল
    উজিরে নাজিরে তখনি শুধালো
    কোথা গেল কোতোয়াল
    দরবারে এনে করুক হাজির
    মৌলবীটারে পাজী
    সেই সাথে আমি দেখতে চাই সে
    মহকুমার কে কাজী
    পুরো সম্মানে নিয়ে আসে যেন
    সকল মহিলা দল
    কি নালিশ কার শুনব দেখব
    খানকার কত ছল
    মশরিক খানা ঢেকে দেওয়া হোক
    মহিলাদিগের তরে
    বেগম সাহিবা স্বয়ং তাঁদের
    বসাবেন হাতে ধরে

    পরদিন প্রাতে এল মৌলবী
    সাথে এল কাজী তার
    দুটি গোশকটে এসে পৌঁছলো
    মহিলারা দরবার
    করে কুর্নিশ কোতোয়াল বলে
    মাথাটি করিয়া নীচু
    যুবতী সে এক এল নাকো সাথে
    শুনল না কথা কিছু
    বলল সে এসে সঠিক সময়ে
    জানাবে জাহাঁপনাকে
    আসবে নিজেই হবে নাকো যেতে
    কাউকে আনতে তাকে

    কাজী মৌলবী লম্বা কয়েদে
    গেল বিচারের পরে
    পরিবার ও সমাজ নেবে কি না ফিরে
    মহিলাদের অন্দরে
    ছিল সন্দেহ দিলেন হুকুম
    গৌড়ের সুলতান
    ভাগীরথী তীরে গোবিন্দজীর
    দেউল হোক নির্মাণ
    এই মহিলারা চালাবেন সেটি
    থাকতে পারেন তথা
    সুলতান নিজে গিয়ে শুনবেন
    অন্য জনের কথা

    মুক্তকেশী সে নিশ্চুপ বসে
    খানকার দেউড়িতে
    পৌঁছলো একা এক অশ্বারোহী
    সামনে তার তড়িতে
    আলাউদ্দীন শিয়া আমি জাতে
    কাছে গৌড়েতে থাকি
    অন্যেরা সবে পেল সুবিচার
    তুমি কেন মা গো বাকি

    চিনেছি তোমায় হে রাজন্ তুমি
    হোসেন শা সুলতান
    নিন্দা তোমার শুনেছি শুনেছি
    শতগুণ গুণগান
    বলে তো ছিলাম আসব পরেতে
    যাই হোক এলে যদি
    শোনাই তোমায় যে সব চিন্তা
    ভাবাচ্ছে নিরবধি

    পিতা ব্রাহ্মণ আছে একখানি
    অতি ছোট টোল তাঁর
    পৌরোহিত্য করেই চালান
    দরিদ্র সংসার
    বাড়িতে তাঁহারি কাছেতে পেয়েছি
    কিছু বেদান্ত জ্ঞান
    বুঝেছি কি কথা অপরিহার্য
    কাকে করি সম্মান
    কিছুদিন হলো এখানে শুনছি
    ম্লেচ্ছ শাস্ত্র বাণী
    শব্দ ও ধ্বনি ভিন্ন কিন্তু
    অন্তঃসারখানি
    অমিলের চেয়ে মিল বেশি রাজা
    এইটুকু গেছি বুঝে
    ভিন্ন ক্রিয়ার এক উদ্দেশ্য
    পথ আমি নেব খুঁজে
    তাই বোলো নাকো ফিরতে আমায়
    আমি চাই পেতে সার
    বুঝতে মানুষ ছাড়ব মানুষ
    করে ত্যাগ সংসার

    যাও সুলতান ফিরে দরবারে
    হোক জগতের ভালো
    তোমার প্রথায় তুমি বুঝো সব
    করো মসনদ আলো

    শুনে মহীয়সী গ্ৰাম্য নারীর
    সে অসাধারণ বাণী
    নত মস্তকে জানালো হোসেন
    তার ইবাদত খানি
    অশ্বপৃষ্ঠে ফিরে যেতে যেতে
    ঘুরে দেখে সুলতান
    ঘন অরণ্য অতি নিকটেই
    বিদূষী সেদিকে যান

    মুক্তকেশী বা মুক্তোবিবির
    কথা অনেকেই জানে
    মনে মনে আজও শ্রদ্ধা জানায়
    হিন্দু মুসলমানে
    বিপদে আপদে ভক্ত জনেতে
    কাম্য বস্তু পেতে
    আজও গিয়ে তারা পূজে সে দেবীকে
    অরণ্যপ্রান্তেতে।।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ দীপঙ্কর ঘোষ
  • মুক্তোবিবি | সেন মহাশয়
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)