• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Rabindranath Tagore | প্রবন্ধ
    Share
  • "সমকালের অস্ত্রে বিদ্ধ নিত্যকালের রবীন্দ্রনাথ -- সুমিতা চক্রবর্তী" : সুমিতা চক্রবর্তী



    বুদ্ধদেব বসুকে একটি পত্রাকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ জীবনের একেবারে অন্তিম পর্যায়ে। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা’ পত্রিকার ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যায়। তখন রবীন্দ্রনাথ সদ্য প্রয়াত। কাজেই ধরে নিতে হবে—এই প্রবন্ধটিতে যা তিনি বলেছিলেন তা তাঁর পরিণত বয়সেরও পরিণত মানসের অভিমত। রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধটি শুরু করেছিলেন এইভাবে—

    ‘‘আমরা যে ইতিহাসের দ্বারাই চালিত, একথা বারবার শুনেছি এবং বারবার ভিতরে ভিতরে জোরের সাথে মাথা নেড়েছি।’’

    এই মাথা নাড়া কিন্তু অ–সমর্থনের মাথা নাড়া। রবীন্দ্রনাথ এর পরেই লেখেন—

    ‘এ তর্কের মীমাংসা আমার নিজের অন্তরেই আছে, যেখানে আমি আর কিছু নই, কেবলমাত্র কবি। সেখানে আমি সৃষ্টিকর্তা, সেখানে আমি একক, আমি মুক্ত, বাহিরের বৃহত্তর ঘটনাপুঞ্জের দ্বারা আমি জালবদ্ধ নই। ঐতিহাসিক পণ্ডিত আমার সেই কাব্যসৃষ্টির কেন্দ্র থেকে আমাকে টেনে ফেলে যখন, আমার সেটা অসহ্য হয়’।

    রাষ্ট্রীয় প্রসঙ্গকে তিনি নিজের সৃষ্টির বৃত্তে গুরুত্ব দিতে চান না একথা স্পষ্ট করে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন—

    ‘‘আপন সৃষ্টিক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ একা, কোনো ইতিহাস তাকে সাধারণের সঙ্গে বাঁধেনি। ইতিহাস যেখানে সাধারণ সেখানে বৃটিশ সবজেক্ট ছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিল না। যেখানে রাষ্ট্রিক পরিবর্তনের বিচিত্র লীলা চলছিল, কিন্তু নারকেল গাছের পাতায় যে আলো ঝিলমিল করছিল সেটা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের রাষ্ট্রিক আমদানি নয়’’। (প্রবন্ধঃ ‘সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা’, ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, বিশ্বভারতী সংস্করণ, ১৯৪৩)।

    পূর্বোক্ত প্রবন্ধের উদ্ধৃতির সাপেক্ষে আমরা যদি রবীন্দ্রনাথের জীবৎকাল এবং তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের দিকে লক্ষ রাখি তাহলে বলতেই হবে তাঁর এই অভিমত যথেষ্ট বিস্ময়কর। রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ-উপনিবেশ ভারতেই জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস-এর প্রতিষ্ঠাকালে তাঁর বয়স চব্বিশ। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও ঠাকুর পরিবারের অনেকেই ছিলেন কংগ্রেস-ঘনিষ্ঠ। বঙ্গভঙ্গ-প্রতিরোধ আন্দোলনে ব্রিটিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে নেমেছিলেন প্রকাশ্য রাস্তায়। কিন্তু সেই সময়ও যেসব কবিতা ও গান তিনি লিখেছিলেন সেগুলিতে সমকালীন রাষ্ট্রনৈতিক বিক্ষোভের প্রত্যক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায় না। সেই-সব গানে সাহস, শৌর্য, সত্যনিষ্ঠা, দেশপ্রেম এবং ঐক্যবদ্ধ হবার সংকল্পের কথা আছে। কিন্তু ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ বা ১৩১২ বঙ্গাব্দের কোনও উল্লেখ নেই। ‘ব্রিটিশ’ শব্দটি একবার উচ্চারিত হয়নি। সেজন্য এই গানগুলি এই আন্দোলনের পরেও দেশাত্মবোধক এবং আত্মশক্তির উদ্বোধক রূপেই বহুবার গাওয়া হয়েছে। এখনও গাওয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই গানগুলি নতুনভাবে শক্তি সঞ্চার করেছিল পূর্ববঙ্গের বাঙালির চিত্তলোকে।

    সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনও তখন উত্তাল। মানিকতলার বোমার মামলা এবং ক্ষুদিরামের ফাঁসি ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বিপ্লবী আন্দোলন এবং ক্ষুদিরাম সম্পর্কে কোনো উল্লেখ যে নেই তাতে আমরা বিস্মিত হই না। নীতিগতভাবেই রবীন্দ্রনাথ সশস্ত্র পন্থা এবং সহিংস বিপ্লবীদের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ অগাস্ট তিনি তাঁর সুপরচিত ‘নমস্কার’ কবিতাটি লিখেছিলেন যার প্রথম পঙ্‌ক্তি হল—‘অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহ নমস্কার’। যে অল্প কয়েকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করেছেন এই কবিতাটি তার অন্যতম। কোন্‌ পরিস্থিতিতে কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ লিখলেন তা আমরা একটু দেখে নেব।

    ঠিক সেই সময়—১৯০৪ থেকে ১৯০৮—তিনটি পত্রিকা ব্রিটিশ-বিরোধী রচনা প্রকাশ করে চলেছিল নিয়মিত। পত্রিকাগুলি হল ‘সন্ধ্যা’, ‘যুগান্তর’, এবং ইংরেজি ‘বন্দেমাতরম’ (Bande Mataram)। যদিও তখন সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকার স্বাধীনতার নিয়ন্ত্রণমূলক সিডিশন আইন বলবৎ ছিল তবু এতকাল খুব বেশি দমনমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। কিন্তু এই সময়, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন এবং সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের উত্থানের প্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশ প্রশাসন ভিন্নতর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ১৬ জুন ১৯০৮ তারিখে। এই দুটি প্রবন্ধের জন্য কলকাতার প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডি. এইচ. কিংসফোর্ড সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে ২৪ জুলাই তারিখে একবছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। সে সময় ইংরেজি ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার প্রধান লেখক ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ। স্বনামে না হলেও অঘোষিত সম্পাদক ছিলেন তিনিই। ভূপেন্দ্রনাথের কারাদণ্ড ঘোষিত হওয়ার পরের দিনই তিনি সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এই রায়ের সমালোচনায়। প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘ওয়ান মোর ফর দি অলটার’ (One More For the Alter )। তাছাড়াও ২৮ জুলাই তারিখে তিনি ‘যুগান্তর’-এর বাংলা প্রবন্ধদুটির ইংরেজি অনুবাদ মুদ্রিত করেন ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকায়।

    এই ঘটনার আগে থেকেই ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকাটি ব্রিটিশ সরকারের কাছে রাজদ্রোহাত্মক বলে গণ্য হতে শুরু করেছিল। এই পত্রিকায় ২৭ জুন ১৯০৮ তারিখে ‘ইন্ডিয়া ফর ইন্ডিয়ান্‌স’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল যেটি ছিল সরকারের দৃষ্টিতে আপত্তিকর। সব মিলিয়ে অরবিন্দের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অগাস্ট। আড়াই হাজার টাকা জামিন দিয়ে তিনি মুক্ত হন। এই পরিস্থিতি পূর্বে অনুমান করেই অরবিন্দ ২ অগাস্ট তারিখে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দেন।

    এই সব ঘটনাই জ্ঞাত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দেশের মানুষের ক্ষোভ ও উত্তেজনা তিনি অনুভব করেন। তিনি নিজেও ছিলেন এই ক্ষোভের অংশীদার। ‘নমস্কার’ কবিতাটি ২৪ অগাস্ট ১৯০৮ তারিখে লিখে তিনি অরবিন্দকে পাঠিয়ে দেন। কবিতাটি মুদ্রিত হয় ভাদ্র সংখ্যা ১৩১৪ বঙ্গাব্দের ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায়।

    আমরা দেখতেই পাচ্ছি সমকালের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বাংলার জাতীয়তাবাদী মনীষীদের ভাবাবেগ এবং কার্যপদ্ধতি; সেইসঙ্গে বাক্-স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শাসকের দমননীতি এবং দেশবাসীর সার্বিক ক্ষুব্ধ ভাবাবেগ—এই সব কিছুর সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কিন্তু এই প্রসঙ্গে রচিত কবিতাটিতে কি লিখেছিলেন তিনি?

    কবিতাটিতে আগাগোড়াই অর্পিত হয়েছে বিধাতার প্রতি অপরিসীম আস্থা। ব্রিটিশ সরকারের দিক থেকে অরবিন্দের প্রতি এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তাঁর কাছে যেন বিধাতার আশীর্বাদ।

    “তোমার প্রার্থনা আজি
    বিধাতা কি শুনেছেন। তাই উঠে বাজি
    জয়শঙ্খ তাঁর? তোমার দক্ষিণ করে
    তাই কি দিলেন আজই কঠোর আদরে
    দুঃখের দারুণ দীপ আলোক যাহার
    জ্বলিয়াছে বিদ্ধ করি দেশের আঁধার
    ধ্রুবতারার মতো”।

    কবিতাটি প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত ঈশ্বরের বাণীরূপেই রচিত হয়েছে। ঈশ্বর তাঁর ভক্তকে পাঠিয়ে দেন ‘কন্টককান্তারে/ রিক্ত হস্তে শত্রু-মাঝে রাত্রি অন্ধকারে’। শেষপর্যন্তও কবিতাটিতে ঐশী ঘোষণা—

    “ওরে ভীরু, ওরে মূঢ়, তোলো তোলো শির,
    আমি আছি, তুমি আছ, সত্য আছে স্থির”।

    এই অভ্যাস রবীন্দ্রনাথ কবিতায় বরাবর বজায় রেখেছিলেন। কবিতা তাঁর কাছে ছিল নিত্যকালের অনুভবের ব্যঞ্জনা। সেখানে ইতিহাসের ঘটনাপুঞ্জ তথা ব্রিটিশ সরকারের রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ স্থান করে নিতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথের কবিতার এই দিকটি উল্লেখ করে কেউ বলতে চান—ব্রিটিশ শাসককে বিরূপ করবেন না বলেই এমন করেছিলেন তিনি। এই অভিমত যথার্থ বলে মনে করি না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাধিক ছোট গল্পে (‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘রাজটীকা’, ‘বদনাম’), অনেক প্রবন্ধে সরাসরি ব্রিটিশ শাসকের অত্যাচারকে আঘাত এবং বিদ্রূপ করেছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর যিনি এককভাবে ব্রিটিশ সরকারের প্রদত্ত ‘স্যার’ উপাধি বর্জন করতে পারেন তাঁর সম্পর্কে পূর্বোক্ত অভিযোগ একেবারেই অচল। কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগের নাম নেই তাঁর কোনো কবিতায়। আরও অনেক পরে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে হিজলি জেলে বন্দীদের উপর কারারক্ষীদের গুলি চালনার ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং কবিতাও লিখেছিলেন—

    “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো
    তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ তুমি কি বেসেছো ভালো”।
                                                                    (প্রশ্ন)

    অনেকে বলেন হিজলি জেলে এই ঘটনার পর গান্ধীজি দেশবাসীর কাছে আবেদন করেছিলেন যে, অপরাধীদের যেন ক্ষমা করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘প্রশ্ন’ কবিতার প্রথম স্তবক—

    “ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে
             দয়াহীন সংসারে
    তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’, বলে গেল ‘ভালোবাসো—
             অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’’।
    বরণীয় তারা, স্মরণীয় তারা, তবুও বাহির-দ্বারে
    আজই দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে’’।

    পঙ্‌ক্তিগুলি পাঠ করলে সম্ভাবনাটি সত্য বলেই মনে হয়। ভগবানের দূত বলে হয়তো গান্ধীজির ক্ষমা করার নির্দেশকেই ইঙ্গিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কবিতাটিতে গান্ধীজির নাম তো নেই-ই, হিজলি জেল, ব্রিটিশ প্রশাসন, গুলিবর্ষণ ইত্যাদি কোনো কিছুরই উল্লেখ নেই। কবিতায় সমকালের ঘটনার প্রত্যক্ষ উল্লেখ করা রবীন্দ্রনাথের একেবারেই মনোমতো ছিল না।

    প্রথম মহাযুদ্ধের মতো বিশ্বে আলোড়ন তোলা আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিক দুর্যোগ ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের একেবারে চোখের সামনে। তিনি নিজেই তখন এক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হবার আগের বছরেই, ১৯১৩-তে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। এই যুদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে প্রকৃতপক্ষেই বিচলিত করেছিল। জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ১৯১৪-র ১ অগাস্ট তারিখে এবং ফ্রান্স-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ৩ অগাস্ট। প্রত্যুত্তরে ৪ অগাস্ট জার্মানি-অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ব্রিটেন। ৫ অগাস্ট তারিখে রবীন্দ্রনাথ এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি দেন শান্তিনিকেতনের আশ্রম মন্দিরে সাপ্তাহিক উপাসনার দিন। সেখানে তিনি বলেছিলেন—

    “সমস্ত য়ুরোপে আজ এক মহাযুদ্ধের ঝড় উঠেছে—কতদিন ধরে গোপনে গোপনে এই ঝড়ের আয়োজন চলছে। ... মানুষের এই যে প্রচণ্ড শক্তি এ বিধাতার দান। তিনি মানুষকে ব্রহ্মাস্ত্র দিয়েছেন এবং দিয়ে বলে দিয়েছেন—যদি তুমি একে কল্যাণের পক্ষে ব্যবহার কর, তবেই ভালো —আর যদি পাপের পক্ষে ব্যবহার কর, তবে এ ব্রহ্মাস্ত্র তোমার নিজের বুকেই বাজবে। আজ মানুষ মানুষকে পীড়ন করবার জন্য নিজের এই অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্রকে ব্যবহার করেছে তাই সে ব্রহ্মাস্ত্র আজ তারই বুকে বেজেছে”।
    এই উপাসনা-ভাষণটি মুদ্রিত হয়েছিল অব্যবহিত পরবর্তী ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার আশ্বিন-কার্ত্তিক সংখ্যায়। লিখনটির শিরোনাম ছিল ‘মা মা হিংসী’।

    ‘তত্ত্ববোধিনীর’-র ওই সংখ্যাটিতেই ‘পাপের মার্জনা’ নামে আরও একটি রবীন্দ্র-লিখন প্রকাশিত হয়েছিল যেটি ২৬ অগাস্ট তারিখে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছিলেন মন্দিরের উপাসনায়।—

    “আজ যে রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়েছে, সে যেন ব্যর্থ না হয়। রক্তের বন্যায় যেন পুঞ্জীভূত পাপ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যখনই পৃথিবীর পাপ স্তূপাকার হয়ে ওঠে, তখনই তো তাঁর মার্জনার দিন আসে”।

    তিনটি দিক এই ধরনের ভাষণগুলিতে লক্ষণীয়। প্রথমত, যুদ্ধের ঘটনা তাঁকে বিচলিত, বিমর্ষ ও ভারাক্রান্ত করেছে। দ্বিতীয়ত, তা সত্ত্বেও তিনি শুভ বিধানের প্রতি আস্থা রাখবার চেষ্টা করছেন। তৃতীয়ত, যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর আস্তিক্যবাদী এবং মঙ্গল-প্রত্যয়ী জীবন—বিশ্বাসের সঙ্গে এই ঘটমান যুদ্ধের যে বৈপরীত্য তার স্ববিরোধকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। প্রথম ভাষণটি লক্ষণীয়। ঈশ্বর মানুষকে শক্তি দিয়েছেন এবং কল্যাণের পথে তাকে ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ তা মানছে না। এই উক্তির ভিতর থেকে আপনা থেকেই বিধাতার ইচ্ছা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনের একটি সংশয় ফুটে ওঠে। বিধাতার ইচ্ছাতেও মানুষ অন্যায় ও হননের পথ থেকে নিবৃত্ত হচ্ছে না। রবীন্দ্রমানসে নিবিড় আস্তিকতার পাশাপাশি ক্রমশ এক নাস্তিকতার ভাবনাও প্রবেশ করেছিল। হয়তো এই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই তার সূত্রপাত ।

    ব্যক্তিগত চিঠিপত্রে প্রমাণ আছে যে বিশ্বযুদ্ধের গতিপ্রকৃতির দিকে লক্ষ রাখতেন রবীন্দ্রনাথ। যুদ্ধ-নিরপেক্ষ শান্তিবাদী দেশ বেলজিয়াম-এ অনৈতিকভাবে জার্মান সৈন্য প্রবেশ করলে ক্ষুদ্রদেশ বেলজিয়াম লড়াই করে কয়েকদিন ঠেকিয়ে রেখেছিল জার্মান বাহিনীকে। সে অবসরে প্রস্তুতি নেবার সময় পেয়েছিল মিত্র-বাহিনী। রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরীকে লিখেছিলেন—“বেলজিয়ামের কীর্ত্তি মনে খুব লেগেছে—সেদিন ছেলেদের এই নিয়ে কিছু বলেছিলুম—হয়ত দেখবে কবিতাও একটা বেরিয়ে যেতে পারে”। (চিঠিপত্র ৫, পত্রসংখ্যা ৩১)।

    এই অভিমত স্বীকৃত যে ‘বলাকা’ (১৯১৬) কবিতা-সংকলনের রচনাগুলিতে কোথাও কোথাও যে সংঘর্ষময় জীবন এবং বিপদ ও সংকটের সম্মুখীন হবার জন্য আহ্বানের বাণী পাওয়া যায় তার মূলে ছিল এই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হানাহানি। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় তিনটি কবিতার নাম—‘পাড়ি’, ‘শঙ্খ’, এবং ‘ঝড়ের খেয়া’। প্রতিটি কবিতাই প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হবার পরে লেখা। ‘পাড়ি’ কবিতাটির প্রসঙ্গে ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ‘বলাকা কাব্য-পরিক্রমা’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন যে মহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে এই কবিতাটি রচিত। দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ আরও স্পষ্টভাবে লিখেছেন যে রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁকে বলেছিলেন—‘পাড়ি’ কবিতাটির মাঝি বেলজিয়াম-এরই প্রতীক।

    ‘At the beginning of the European war this strain had become almost unbearable, owing both to the world tragedy of the war itself and the suffering of Belgium, which the poet felt most acutely. He wrote and published simultaneously in India and England three poems which expressed the inner conflict going on in his mind. The first of these was called the Boatman, and he told me, when he had written it that the woman in the silent courtyard, “Who sits on the dust and wails,” represented Belgium.’ (Letters to a Friend; No. 46)

    রবীন্দ্র কবিতার প্রবহমানতায় বলাকা-পর্বের কবিতাগুলিই বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতকে প্রথম ধারণ করেছিল।

    তা সত্ত্বেও কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধ সম্পর্কিত কোনো প্রত্যক্ষ নামবাচক বা স্থানবাচক উল্লেখ পাওয়া যায় না রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। প্রথম মহাযুদ্ধের ঠিক পরেই জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা আমরা আগেই বলেছি। চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ কারোর নাম নেই এই কবিতায়। গান্ধীজির মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে নিয়েও তাঁর কবিতা দু—তিনটি মাত্র। তার মধ্যে একটি একেবারেই আনুষ্ঠানিক, লেখা হয়েছিল গান্ধীজীর শান্তিনিকেতনে আসা উপলক্ষ্যে। আর একটি কবিতার কথা আমরা পরে উল্লেখ করব।

    ‘সাহিত্যে ঐতিহাসিকতা’ নামের পূর্ব-উল্লিখিত প্রবন্ধটি তিনি পরিণত বয়সেই লিখেছিলেন। সমকালের খণ্ডতা নয়, নিত্য-কালের পূর্ণতাকেই কবিতায় প্রস্ফুটিত করে তুলবেন— এমন একটা অভিলাষ সত্যিই ছিল রবীন্দ্রনাথের। যে–কারণে ১৯৪০-এ, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, তখনও লিখেছিলেন—‘এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি’ । কিন্তু মানুষের মন ঘোষিত অভিমত অনুসারে সব সময় চলে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, কোনো ঘটনার অভিঘাতে, সময়ের আলোড়নে এককালের আদর্শ সম্পূর্ণ অস্বীকৃত না-হোক, বিচলিত হতেই পারে যে-কোনো মুহূর্তে।

    সমকালীন সামাজিক ও বিশেষ করে রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে কবিতার অন্তর্লগ্ন করা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মত কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছিল প্রথম মহাযুদ্ধের পর; আরও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছিল ১৯৩৩-৩৪-এর পর—যখন প্রকৃতই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রনীতির ভয়ংকরত্ব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা হল তাঁর। বলা যায়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কে ব্যাপ্ত হল যে নিষ্ঠুর বৈনাশিকতা, তারই প্রতিক্রিয়ায়।

    ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের সমকালীন প্রসঙ্গ একটু এড়িয়ে চলছিলেন তিনি। এদেশীয় ব্যক্তিবর্গের নাম তিনি প্রায় করেনইনি। কিন্তু সম্পূর্ণ বাদ দেননি গান্ধীজির নাম। শেষ বয়সের লেখা (প্রকাশ ১৯৩৭) ‘সে’ বইটিতে ধানভানা শ্রমজীবিনী পুঁটু তাঁর সামনে এসে দাঁড়ানো বাঘকে বলছে ‘জানোনা কি আমি অস্পৃশ্য/ মহাত্মা গাঁধীজির শিষ্য’। পরিহাসের সুরে লেখা হলেও পঙ্‌ক্তিটির ব্যঞ্জনা অতলস্পর্শী। অস্পৃশ্য মেয়েটি তার অস্পৃশ্যতাকেই করে তুলেছে সাহসের ভিত্তি এবং প্রায় অহংকার। এমন হওয়া সম্ভব ছিল গান্ধীজির হরিজন আন্দোলনের ফলেই।

    কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সমকালীন রাষ্ট্রনীতির আন্তর্জাতিক স্বরূপই প্রকাশ পেয়েছে খোলাখুলি ভাবে। প্রবন্ধে যাকে তিনি বলেছেন ‘সভ্যতার সংকট’ তাকেই তুলে এনেছেন কোনো কোনো কবিতায়।

    জার্মানিতে ১৯৩৩-এ রাষ্ট্রপ্রধানের পদ অধিকৃত হল হিটলার-এর দ্বারা। ফ্যাসিবাদের উদ্ভব তার আগেই ঘটলেও হিটলার-এর শাসনে তার আগ্রাসী আক্রমণাত্মকতা পরিস্ফুট হয়। কিছুকাল পর থেকেই বিশ্বের শুভবোধ সম্পন্ন বুদ্ধিজীবিরা সংঘবদ্ধ হতে লাগলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। ভারতের প্রতিনিধিরাও যোগ দিয়েছিলেন ১৯৩৫-এ প্যারিস এবং ১৯৩৬-এ ব্রাসেলস-এ আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে। দ্বিতীয়টিতে প্রেরিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বাণী।

    ভারতে 'প্রগতি লেখক সংঘ' স্থাপিত হল ১৯৩৬-এ। তার বঙ্গীয় শাখা থেকে ১৯৩৭-এ ‘প্রগতি’ নামের যে মানবাধিকার-দ্যোতক সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়, সেটি রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করা হয়। মুখবন্ধের আগে উদ্ধৃত হয় ‘প্রশ্ন’ কবিতাটির কয়েকটি পঙ্‌ক্তি।

    এই সময়ে প্রকাশিত ‘শ্যামলী’ (১৯৩৬) সংকলনের অন্তর্গত ‘অমৃত’ কবিতাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। এই কবিতায় এক নারীকে ভালোবেসেছিল এক যুবক। কিন্তু বিত্তবান ঘরের মেয়েটির পাণিপ্রার্থী রূপে নিজেকে যোগ্য করে তোলার জন্য সে বড়োলোক হবার সাধনা করতে গেল। ইতোমধ্যে আবির্ভূত হল রায়বাহাদুরের ছেলে মহীভূষণ। তার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য—

    “লোকে বললে ওর বুদ্ধির কাঁচা ফলে
    ঠোকর দিয়েছে
             রাশিয়ার লক্ষ্মী খেদানো বাদুড়টা”।

    এই কবিতা লেখার তারিখ ৩ জুন ১৯৩৬। এই প্রথম ১৯৩০-এ রাশিয়া-প্রত্যাগত রবীন্দ্রনাথ ছয় বছর পরে কোনো কবিতায় ব্যবহার করলেন রাশিয়ার নাম। ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং পুঁজিবাদের আতিশয্যের বিরুদ্ধে সাম্যবাদী রাশিয়া কিছুটা হলেও প্রতিরোধের আদর্শ হয়ে উঠেছিল তারই তাৎপর্যময় স্বীকৃতি এই কবিতায়। কবিতার মেয়েটি মহীভূষণ সম্পর্কে বলেছে ‘তিনি আমাকে উদ্ধার করেছেন উপকরণের দুর্গ থেকে’। সাম্যবাদী আদর্শের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অন্তরের শ্রদ্ধাই এখানে অর্পিত হয়েছে।

    ‘আফ্রিকা’ কবিতাটি অমিয় চক্রবর্তীর অনুরোধে রচিত হয়েছিল ২৮ মাঘ ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে (১৯৩৭)। সমকালীনের একটা আবহ সে-কবিতায় আছে কিন্তু প্রত্যক্ষ কোনো সময়- চিহ্ন নেই। আফ্রিকা মহাদেশে বিগত শতাব্দীগুলিতেও যে অত্যাচার ও শোষণ চলেছিল তারই পূর্বাপরতা এই কবিতার বিষয়। তবু আফ্রিকার নাম চিহ্নিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শোষক শক্তিগুলির প্রতি ‘মানহারা মানবী'–র কাছে ক্ষমা চাইবার যে আহ্বান কবিতাটিতে ব্যক্ত করেছেন—এই সচেতনতা অবশ্যই বিশ শতকের প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তী কালে বিশেষভাবে জেগেছিল।

    জাপানের চীন আক্রমণ নিয়ে দুটি কবিতা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ খুব অল্প দিনের ব্যবধানে। একটি হল ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬)-এর সতেরো সংখ্যক কবিতা। বহু পঠিত কবিতা— তবু উদ্ধৃত করা যাক—

         “যুদ্ধের দামামা উঠল বেজে,
    ওদের ঘাড় হল বাঁকা, চোখ হল রাঙা,
         কিড়মিড় করতে লাগল দাঁত।
    মানুষের কাঁচা মাংসে যমের ভোজ ভরতি করতে
         বেরোল দলে দলে।
    সবার আগে চলল দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে
         তাঁর পবিত্র আশীর্বাদের আশায়”।

    এই কবিতা ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে লেখা; অর্থাৎ ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর-এ। তার ঠিক পরেই ‘নবজাতক’ (১৯৪০) সংকলনের অন্তর্ভুক্ত ‘বুদ্ধভক্তি’ কবিতাটি রচিত ১৯৩৮-এর জানুয়ারি মাসে। বিষয়বস্তু ওই একই।

    হিংসার উষ্মায় দারুণ অধীর
    সিদ্ধির বর চায় করুণানিধির—
        ওরা তাই স্পর্ধায় চলে
         বুদ্ধের মন্দিরতলে।
    তূরী ভেরি বেজে ওঠে রোষে গরোগরো,
    ধরাতল কেঁপে ওঠে ত্রাসে থরোথরো।

    দুটি কবিতাতেই দেখা যায়, অভ্যাসমতোই রবীন্দ্রনাথ নাম করেননি জাপান বা চীনের। কিন্তু দ্বিতীয় কবিতাটির শিরোনামের নিচে প্রদত্ত আছে একটি জ্ঞাপিকা। সেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখে দিয়েছেন দুটি বাক্য—

    ‘জাপানের কোনো কাগজে পড়েছি জাপানি সৈনিক যুদ্ধের সাফল্য কামনা করে বুদ্ধ-মন্দিরে পূজা দিতে গিয়েছিল। ওরা শক্তির বাণ মারছে চীনকে; ভক্তির বাণ বুদ্ধকে’।

    রবীন্দ্রনাথের এই লিখন খুবই অ-রবীন্দ্রোচিত বলে মনে হয় আমাদের। সরাসরি সংবাদপত্রের সমকালীন খবর তাঁকে পূর্বোক্ত দুটি কবিতা লিখতে উদ্বেলিত করেছিল—তা এখানে স্বীকৃত। ইতিহাসের বন্ধন এখানে তাঁর কাছে অসহ্য মনে হয়নি। সমকালের রাষ্ট্রিক পরিস্থিতি থেকেই এই কবিতার উৎসারণ—

    “নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস
    শান্তির ললিতবাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস”।

    বহুল-উদ্ধৃত এই পঙ্‌ক্তিদ্বয় ১৯৩৭-এ লেখা, ‘প্রান্তিক’ (১৯৩৭) ১৮ নং কবিতার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এখানেও কোনো ঐতিহাসিক নামের চিহ্নিতকরণ নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘ অভ্যাস অনুসারে সার্বিক সংকটকালের একটি সাধারণ চিত্র দিয়েছেন। বিষাক্ত নিঃশ্বাসের উৎসভূমির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেননি।

    আমরা আগে বলেছি সারাজীবন ব্রিটিশ-অধিকৃত ভারতে নিজের সৃষ্টিকর্মে নিমগ্ন থাকলেও ব্রিটেন, ব্রিটিশ, ইংরেজ ইত্যাদি শব্দ নেই রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। একটি ব্যতিক্রম ‘ওরা কাজ করে’ কবিতাটি যা ‘আরোগ্য' (১৯৪১) সংকলনের অন্তর্গত।

    “আবার সেই শূন্যতলে
    আসিয়াছে দলে দলে
    লৌহবাঁধা পথে
    অনলনিশ্বাসী রথে
    প্রবল ইংরেজ
    বিকীর্ণ করেছে তার তেজ।

    এই কবিতার রচনাকাল ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪১। ইতিহাস-চিহ্ন ও ঐতিহাসিক নামাঙ্কন কবিতা-শরীরে মুদ্রিত করবার ব্যপারে রবীন্দ্রনাথের প্রবণতার পরিবর্তনের এও একটি দৃষ্টান্ত। ‘জন্মদিনে’ সংকলনের ১৬ সংখ্যক কবিতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উল্লেখ মোটের উপর স্পষ্টই।

    “দামামা ঐ বাজে,
    দিন বদলের পালা এল
    ঝোড়ো যুগের মাঝে।”
    এই কবিতা ১৯৪০-এর ৩১ মে তারিখে রচিত।

    রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিবাদের স্বরূপ হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত দেখেছিলেন। এই যুদ্ধের দায়ভাগ কাদের তা নিয়েও তাঁর মনে সংশয় ছিল না। আমরা আগে বলেছি যে, কবিতায় ঐতিহাসিক ব্যক্তিনাম ব্যবহারে তাঁর অনীহা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো কোনো তীক্ষ্ণ উপলব্ধির মুহূর্তে সমকালীন ইতিহাসের ক্ষমতালুব্ধ নেতাকে পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। ‘ছড়া’ (১৯৪১) সংকলনের অন্তর্গত ‘শ্রাদ্ধ’ কবিতাটি খুবই উল্লেখযোগ্য কবিতার করণ-কৌশলের দিক থেকেও অভিনব।

    একটি গ্রামের পরম্পরাশ্রিত জীবনযাত্রাকে মসৃণভাবে বর্ণনা করে চলেছেন কবি খুবই অনায়াস ভঙ্গিতে, আটপৌরে কথ্য চালে। কিন্তু প্রতিটি স্তবকের শেষে চার পঙ্‌ক্তির একটি করে ছোটো স্তবক ধ্রুবপদের মতো সংযোজিত। সেই পঙক্তিগুলির প্রধান চরিত্র হল রেডিও—যে-রেডিও প্রতিমুহূর্তে হাওয়ায় বয়ে নিয়ে আসে হত্যার বিভীষিকা। এই কবিতাটি লেখা হয়েছে ১৯৪০-এর ফেব্রুয়ারি মাসে।

    "ওই শোনা যায় রেডিওতে বোঁচা গোঁফের হুমকি
    দেশবিদেশে শহর-গ্রামে গলা কাটার ধূম কি!"

    ‘বোঁচা গোঁফ’ শব্দদুটিতে চোখের সামনে ভাসে হিটলার-এর মুখ। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ একেবারে কার্টুনিস্ট-এর পদ্ধতিতে এঁকে তুলেছেন ব্যক্তির প্রতিরূপ। যে-কোনো কার্টুনিস্ট হিটলারকে আঁকলে ওই গোঁফ তিনি বাদ দিতে পারবেন না। ওইখানেই অবলম্বন পাবে কার্টুনিস্টের তুলি! রবীন্দ্রনাথও ঠিক তাই করেছেন। আর, কার্টুনিস্টের ছবির অপরিহার্য প্রেক্ষাপট হল সমকাল। তাৎক্ষণিক সময়। ওই কবিতারই আরও দুটি পঙ্‌ক্তি—

    “গ্যাঁ গোঁ করে রেডিওটা কে জানে কার জিত;
    মেশিনগানে গুঁড়িয়ে দিল সভ্যবিধির ভিত”।

    আমরা শেষ করব রবীন্দ্রনাথের জীবনের ও মনের একটি বেদনার মুহূর্তের কবিতা-রূপ দিয়ে। তিনি তখন কালিম্পং–এ। শরীর রোগজীর্ণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলছে। আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র-পরিস্থিতিতে মেশিনগানে সভ্যবিধির ভিত নিত্যই চূর্ণ হচ্ছে। যে-রাশিয়াতে ১৯৩০-এ রবীন্দ্রনাথ নতুন যুগের সূচনা দেখে এসেছিলেন, অনুভব করেছিলেন যে ক্ষমতার আগ্রাসনকে তারাই রুখে দিতে পারবে—সেই রাশিয়াও তখন সন্নিহিত দুর্বলতর দেশগুলিকে অধিকৃত রাখতে তৎপর। ফিনল্যান্ড-কে রাশিয়া বরাবরই অধীনে রাখতে চেয়েছিল। যখন ১৯৩৯-এ রাষ্ট্রিক সীমান্ত নির্ণয়ের প্রয়াস চলছিল তখন ফিনল্যান্ড রাজি হয়নি নিজেদের জমি ছাড়তে। কিন্তু রাশিয়া তখন পরাক্রমশালী। তাদের আগ্রাসনে ফিনল্যান্ড ১৯৪০এ সন্ধি করতে বাধ্য হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘শান্ত ছবি’ নামে একটি কবিতা। কালিম্পঙের রূপময় নিসর্গপটে স্নিগ্ধ ছায়াময়, প্রশান্ত দিনযাপনের একটি চিত্র। সহসা কবিতাটি শেষ হয়ে যায় দুটি পঙক্তিতে—

    “টেলিগ্রাম এল সেই ক্ষণে
    ফিনল্যান্ড চূর্ণ হল সোভিয়েট বোমার বর্ষণে”।

    লেখার তারিখ ১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ (১৯৪০)। এমনি করেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিত্যকালের শান্তি বারবার বিদ্ধ হয়েছিল সমকালীন রাষ্ট্রীয় অশান্তির বর্শা-ফলকে।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments