


১.১. ছবি, সে কি স্বপ্ন, সত্য না প্রতিফল-মাত্র? ছবি কি উদ্দেশ্য ও উদ্দিষ্টের ছায়া-মাত্র - যার অবস্থান, দৈর্ঘ্য ও বহিরাকার নির্ভর করছে আলোর স্রোতের নিরিখে? সে কোথায়, কতটা, কোন দিকে ঘনাতে পারল তার উপর? যখন নিষ্প্রাণ নির্বিকার বিচরণভূমি নিজেই একজন ছায়াকার - "হাসি মুখ সেজে ... স্ফটিক সে নির্বিকার"[১] তখন সেই ছায়াটির কিছুমাত্র যায় না খোওয়া; বাঁচিয়ে-সরিয়ে কিছু হয় না রাখা রোমন্থনের নিরিখে, সবটাই দেওয়া হয় ফিরিয়ে। কত রূপ রঙ্গ রস হয় অঙ্কিত আকাশের নির্বিকার পটে ও দিনশেষে কালভেদে হারিয়েও যায় তারা, মোছা হয়ে যায় সব শেলেটে; ইতিমধ্যে নিয়ম মাফিক সূর্য ওঠে সূর্য ডোবে, স্বনিয়মে চলে চাঁদ - কৌতুক, কৌশল সব থাকে বাদ। ফলত বিধেয়-বাক্যে শুধু থেকে যায় শূন্যতা; ছায়ার ছায়াগুলি, ছায়াদের ফিরে না আসার হাহাকার।
১.২. একাকী ও দিশাহীন উদ্দেশ্যখানি এমনই একটি শুক্ল সন্ধ্যাবেলায় স্থির করে, আরশি'র সাথে ছায়া-ছায়া খেলা হবে ভাল। আরশিকে রেখে সাক্ষী সে দিল নিজের ছায়াখানি কবিকে, নিজেকে সরিয়ে নিল শেষে। মনে হল, অধরা থেকে গিয়ে খেলা হল বোধ করি শেষ নায়িকার। বসন্তের গীতিরঙে উন্মত্ত নিমিষ দিল মনকে বিক্ষিপ্ত ক'রে, ক'রে আত্মভোলা। বিধেয় করেছে ঠিক ছায়া নেবে "খেলা-ছলে" "হেলাভরে হেসে" - ভেবেছিল কখনও পরে তারও এক ছায়া এঁকে ফিরিয়ে দেবে বুঝি "তোমারি উদ্দেশে"। কিন্তু হল বিপরীত; উদ্দেশ্যের সেই ছায়া প্রথমে ভিতরে এসে হল প্রতিধ্বনি, পেল প্রাণ অফুরান শুধু গানে গানে, নিজেকে দিল সে ধরা কবির জুবানে। তাহলে দেখা যায় এ-গান তো সেই গীত নয় যার সুরলয়তালে রয়েছে মাত্র হাত উদ্দেশ্যেরই; এই গান, বস্তুতঃ "তোমার সে দান। / যদিবা দেখিতে তারে / পারিতে না চিনিবারে ... / আমার পরাণ পেয়ে / সে আজি তোমারো চেয়ে / বহুগুণে বেশি"।[২]
১.৩. তবে ছায়া তুমি কার? যে তাকে দিয়েছে সুরের মহিমা? যে তোমার খেয়াল দিল ক'রে ত্যাগ? যে ভুলেছে মর্ত্য, শুক্ল সন্ধ্যাকাল, বসন্তের সৌরভ? যে ভুলেছে আকরণ, বাক্য-বিভেদ? এ কি সেই যে পাখীর গানে গানে নিজের বাণীকে করেছে প্রোথিত প্রতিভাষিত[৩] - প্রতিটি নিমেষে যে গেয়ে ওঠে অনিমেষ গান? চিহ্ন হতে চিহ্নহীন রাতের সাগরপারে তরঙ্গের গর্জনে সে শোনে বুঝি "নিঃশব্দের মন্ত্রস্বর"! নিজের অস্তিত্ব ও ছায়াকেও মুছে ফেলে করেছে স্মরণ তাকে, বরণ করেছে - "নিজেরে আড়াল করি' / বর্ণে গন্ধে ভরি' / প্রেমের দিয়েছে পরিচয় / ফুলেরে করিয়া বাণীময়।"[৪]
২.১.
কেন এ আড়াল রয়ে যায় তবু মনে? কেন এ শঙ্কাবোধ -
"কেন এ কম্পিত প্রেম, অয়ি ভীরু, এনেছ সংসারে,
ব্যর্থ করি' রাখিবে কি তারে।"[৫]
নিজেকে আড়াল করে রাখে যক্ষরাজ। সুরঙ্গমা-সুরঞ্জনা খুঁজে মরে আমাকেই জানি। নিজেকে আড়াল করে গল্পচ্ছলে রাখে বৃহন্নলা। এ যেন নিজেকে দিয়েছে বাঁধা সংশয়ের বন্দীপত্রে তার, যার বাহিরের থেকে বাজে অন্তরের তীব্র পরাজয়। সে কি মাত্র এইজন্য যে ছায়াদের হতে নেই নিতে নেই নাম, কোনও গোত্র, পরিচয়? আর তাই -
"হায় সে যে পায় নাই আপন নিশ্চিত পরিচয়,
বন্দী তারে রেখেছে সংশয়"[৬]
এভাবেই "মুক্তিবন্ধনের সীমানায়" ('বিচিত্রিতা' পৃ. ৫৭) সংশয়ে সংশয়ে দিন যায় চলে।
২.২. তাহলে এ কি সে-ই যার আমি ছবি আঁকি মনে মনে? এ কি সেই "যে এখনো আসে নাই মোর পথে, / কখনো যে আসিবে না আমার জগতে, / তার ছবি আঁকিয়াছি মনে, -"[৭] কখনও মনে হয় এসব এমনই ছায়া যারা বহু আগে দুয়ারে ক'রে করাঘাত "চলে গেছে একেবারে, / ফাল্গুন মধ্যাহ্নবেলা শিরীষ ছায়ায় চুপি চুপি / তারা ছায়ারূপে / আসে যায় হিল্লোলিত শ্যাম দুর্ব্বাদলে"।[৮] অতীতে ফিরে গিয়ে নায়িকা দেখছেন সব দ্বার হয়ে গেছে "রুদ্ধ তোমার পশ্চাতে"[৯], যখন বসন্তের উৎসবের রাত্রিশেষে সব বাতি গেছে নিভে, সেতারের তার যখন মুখরতা ত্যাগ ক'রে নির্বাক নিশ্চিত চুপ - "শুষ্কমালা, ভস্মশেষ দগ্ধ গন্ধধূপ"। সামনের খোলা আকাশে, উদাস বর্ণহীন রাতে দিনে শুধু স্মৃতি শেষ, মত্ততার কলরব রুদ্ধ শেষ - শুধু "ভাষাহারা অশ্রুহারা অজ্ঞাত কাঁদন"।[১০]
এ যেন বক্ষকপাটের বেড়ায় "আত্মদানের রুদ্ধবাণী"[১১] মরছে ঘুরে ঘুরে; মনে হচ্ছে ছায়াটিই বুঝি আসল মানুষ, মূল যে সে নয় ("আপনি যেন আর কেহ সে, এই লাগে তার মনে)[১২] - ফলে সে তার আপনার ভাষায় কথা বলাও ভুলে যায় আপন জনের সাথে। শুধুমাত্র ইসারার উপভাষা চলেছে বিধির সাথে, বিশ্বের সাথে চলেছে নীরব আলাপচারিতা।[১৩]
২.৩.
বিধেয়ের সাথে উদ্দেশ্যের এই বার্তা, এই আলাপের পিছনে রয়েছে শুধু একগুচ্ছ সংশয়, দুর্ভাবনা। অবলুপ্ত উদ্দেশ্যপদ শুধু ক্রিয়াশীল, কেন কে বা জানে - "লুকানো নহো, তবু লুকানো থাকো"[১৪] বহুযুগে বহুবার হয়েছে দেখা, তবু "তোমারে আমি কখনো চিনিনাকো" - কারণ তোমার আবরণে থাকে ঢাকা সব বেদনাই, তোমার কথা বলে মৌন মুখ - যার অর্থ খুঁজে মরে কবি; আধেক হয় চেনা, রয়ে যায় আধেক অজানা:
"মৌন তব কী কথা বলে বুঝি,
অর্থ তারি বেড়াই মনে খুঁজি'।
চলিয়া যাও তখন মনে বাজে
চিনি না আমি, তোমারে চিনি না যে।।"[১৫]
২.৪.
ভয়ে মরে বিধেয়া বধূটি - "নিভৃতে দর্পণে / দেখে আপনার মুখ।/ শুধায়ে সভয়ে / হবো কি মনের মতো, পাবো কি হৃদয়ে"[১৬] স্থান কোনও সে-কথাই ভেবে থেকে "আগন্তুক অজানার ... উদ্দেশে নিজেরে সঁপে আগামিক প্রেমে" সে। এই আত্মবিসর্জনে মাঠ, রাঙা ধূলি, শীত, বাতাসের শ্বাস, শিহরণ - সবারই রয়েছে এক সম্মিলিত চক্রান্ত - অজানিতের হাতছানি:
"... শিহরণে ঘাসে,
কী কথা কহিল তোর কানে। ...
সৃষ্টির প্রথম স্মৃতি হোতে
সহসা আদিম স্পন্দ সঞ্চরিল তোর রক্তস্রোতে"।[১৭]
যখন জেগেছে প্রেম, শিহরণ লাভের জমানো কড়ি পড়ে থাকে পদতলে, "ভাবনা কোথায় চলে ধেয়ে"; "সাম্প্রতের আবরণ মন হ'তে" দ্রুত খসে "বিরাট কালের মাঝে ... ওঙ্কারধ্বনি"[১৮] ওঠে গুঞ্জরি। তখন শুধু চারিদিকে শব্দহীনতার স্বর'ই বাজে, গেয়ে চলে অনিদ্র কোকিল, যার "একরাতে আজ এই জীবনের শেষ কথাটি চাই"[১৯] -
কারণ "বদ্ধ বাণীর অস্ফুটতার" রহস্য-ভেদ করা তার চাই। তাকে বলতে হবে প্রেমের কথা "সবার চেয়ে গভীর যাহা নিবিড় ভাষায় সেই কথাটি", যার রক্তরঙীন ছায়া থাকে ঘিরে "তোমার চারিপাশে / ইঙ্গিতে আভাসে / ... দোলা দিয়ে বিনা ভাষায় আলাপ করে কানে কানে, / নাই কোনো যার মানে"[২০] - এ যেন এক "যুগলছায়ার স্বপ্ন খেলা"। যদিচ ছায়া, প্রতিচ্ছবি মনে - তবু মনে হয়
"প্রাণের যে-প্রশান্ত পূর্ণতা, লভি তাই
যখন তোমার কাছে যাই,"[২১]
৩.১. আমার 'বিচিত্রিতা' পাঠের প্রয়াসের সঙ্গে এই বিরল কাব্যগ্রন্থটির নবতম সংস্করণের (জানুয়ারি ২০১১; বিশ্বভারতী-প্রতিক্ষণ প্রকাশন) ভূমিকার একটি সাবধানবাণীর সম্বন্ধ রয়েছে, যেখানে সম্পাদক শ্রী আশিস পাঠক মন্তব্য করছেন: "দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ কবিতা ১৯৩২-এর জানুয়ারি থেকে মার্চ-এর মধ্যে লেখা, একটি জুলাইয়ে। ..... অর্থাৎ বিচিত্রিতা-র অধিকাংশ কবিতা খুব কম সময়ের মধ্যে পরপর লেখা। তবু এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির মধ্যে ভাবের কোনও সাক্ষ্য নেই।" (পৃ. জ) অবশ্য একই সঙ্গে তিনি বলছেন: "বিষয়ে একটি ঐক্য-প্রবণতা অবশ্য আছে, অধিকাংশ কবিতাই নারী-বিষয়ক"। (পৃ. ঐ) আবার ক'রে কাব্যগ্রন্থটি একাধিক বার আদ্যোপান্ত প'ড়ে আমার কিন্তু মনে হয়েছে - সূক্ষ্মভাবে হলেও - এই কবিতাগুলির মধ্যে কোথাও যেন একটা আন্তর্বয়ান বা ইন্টারটেক্সটুয়ালিটি রয়েছে। আর এই অর্বাচীন প্রতিক্রিয়ায় সেই বয়ানটিকেই ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার - এ হল সেই সময় যখন কবি রবীন্দ্রনাথ চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথ রূপেও বেশ জোরালো উপস্থিতি রেখেছেন আন্তর্জাতিক স্তরে এবং এই সময়ে পৌঁছতে পৌঁছতে ওঁর রঙে ও তুলিতে বেশ কিছু প্রতিকৃতি ও ভাবছায়া আমরা দেখতে পারছি।
৪.২. শুরু করা যাক গগনেন্দ্রনাথের ছবি ও কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা 'কালো ঘোড়া' দিয়ে যা আখর-কবিতা সমেত ৩২টি কবিতার এই সংকলনে এসেছে ২৪তম পাঠ হয়ে, তিরিশটি পংক্তিতে তিনটি অনুচ্ছেদে সাজানো ১১২-শব্দের একটি কাব্যানুবাদ রূপে। শুধু ছবিটি দেখলে একথা স্পষ্ট যে আমরা দেখছি অমাবস-পুচ্ছময় সবলশরীর একটি কৃষ্ণাশ্ব যা উঠে চলেছে সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশ ঊর্ধমান, বল্গাহীন ধেয়ে চলা শূন্যপথ দিয়ে, আকাশে - গভীরে যেখানে অন্ধকার চারিপার্শ্বে ছেয়েছে আলোক-চেরা পথ, যার উপর আছে ছায়া, হ্রেষাধ্বনি বাজাবে এমন। আরও আছে অন্য কিছু মানুষের ছায়া, সে-কি উপবিষ্ট, বাদ্যরত অথবা পঠনে যোজিত? রুদ্র খরতর পদতলে কম্পিত ভগ্নপথ, আলোকবর্ষা। অশ্বে উপবিষ্টা নারী দীর্ঘকায়া কালাগ্নির শিখা-বিশেষ - যেন দুহাতে ঢাকা তার চোখ বস্ত্র দিয়ে যা তার ব্যথার মূর্চ্ছনাকেও দিয়েছে ঢেকে। হ্রেষারবে উঠছে জেগে আঁধার চিরে আলো, প্রতিধ্বনি পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘময়। পশ্চাতে ও পশ্চাৎপটে যেখানে আঁধার, সেখানেও মিশকালো অন্ধকারে উড়ন্ত অশরীরী কিছু দেহ খণ্ডকায়।
[১] 'আরশি' কবিতা থেকে উদ্ধৃত; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৩৩ ও ২০১১ প্রতিক্ষণ-বিশ্বভারতী সংস্করণ থেকে গৃহীত) পৃ. ১২।
[২] ঐ; পৃ. ১৩।
[৩] "তোমার পাখীর গানে
পাঠাও সে অলক্ষ্যের পানে
প্রতিভাষণের বাণী,
বলো তারে, হে অজানা, জানি আমি জানি,
তুমি ধন্য, তুমি প্রিয়তম -
নিমেষে নিমেষে তুমি চিরন্তন মম।" (ঐ; 'দান' কবিতা থেকে পৃ. ১৫)
[৪] ঐ, পৃ. ১৪।
[৫] ঐ, 'ভীরু' কবিতা থেকে, পৃ. ৩৬।
[৬] ঐ, পৃ. ৩৬।
[৭] 'অনাগতা' থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ৪৮।
[৮] ঐ, পৃ. ৪৮।
[৯] 'দ্বারে' কবিতা থেকে, পৃ. ৫৫।
[১০] ঐ, পৃ. ৫৬।
[১১] 'বেসুর' কবিতা থেকে, পৃ. ৪১।
[১২] ঐ, পৃ. ৪১।
[১৩] 'বিচিত্রিতা'র আখর-কবিতা নন্দলাল বসুকে উৎসর্গ-কবিতা 'আশীর্বাদ'।
[১৪] 'অচেনা' থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ৪।
[১৫] ঐ, পৃ. ৪।
[১৬] 'বধূ' কবিতা থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ৩।
[১৭] 'পসারিণী', পৃ. ৫।
[১৮] ঐ, পৃ. ৬।
[১৯] 'হার' কবিতা থেকে, বিচিত্রিতা, পৃ. ১৬।
[২০] 'মরীচিকা', পৃ. ১৮।
[২১] 'শ্যামলা' থেকে, পৃ. ২১।
পরবাস, ২২-শে শ্রাবণ, ২০১১
ছবিগুলি "বিচিত্রিতা" - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভূমিকা, শিল্পীপরিচয় ও সম্পাদনা - আশিস পাঠক, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের সহযোগিতায় দ্বিতীয় প্রতিক্ষণ সংস্করণ মে ২০১১ থেকে গৃহীত।