• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | Satyajit Ray | প্রবন্ধ
    Share
  • প্রসঙ্গ : কাঞ্চনজঙ্ঘা : নন্দন দত্ত

    ॥ ডিস্ক্লেমার ॥


    সত্যজিৎ রায়ই বলেছেন, "মুশকিল হয়েছে কি, সিনেমাটা একটা বারোয়ারি শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিনেমার ব্যাপারে দেখি যাঁরা 'সংগম' দেখছেন, তাঁরাই 'লা দোলচে ভিতা'তেও উঁকি দিচ্ছেন। এতে অবিশ্যি বলার কিছু নেই -- কারণ পকেটে পাঁচসিকা পয়সা এবং হাতে ঘন্টা তিনেক সময় থাকলেই যে কেউ যে কোনো ছবি দেখতে পারেন এবং তা নিয়ে মন্তব্যও করতে পারেন। .... রাম-শ্যাম-যদু সকলেই যদি পত্র-পত্রিকায় তাঁদের ভয়ংকরী বিদ্যার পরিচয় দিতে শুরু করেন ....." ইত্যাদি। [১]

    আন্তর্জালের দৌলতে এই পত্রপত্রিকার দৌড় আজকাল দুরন্ত। তাই ইন্টারনেট অ্যাক্সেস আর পরবাস সম্পাদকের প্রশ্রয় পেলেই যা কিছু সম্বন্ধে যে কেউ লিখে ছাপিয়ে ফেØলতে পারছি। যেমন আমি।

    বছর খানেক আগে পরবাস'এর রবীন্দ্রসংখ্যাতে গাল-ভরা এক গম্ভীর প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সে রূপকসাংকেতিক রবীন্দ্রনাট্য, গান্ধীবাদ, স্বাদেশিকতা, যান্ত্রবতা জুড়ে এক আকীর্ণ আমেজ। পরিচিত একজন কলকাতার, পড়ে-টড়ে বলেছিলেন ভালই, তবে নাটকের গ্র্যামার তুমি কিচ্ছু বোঝ না।
    -- আজ্ঞে, গ্ল্যামার?
    -- আহ গ্ল্যা নয়, গ্র্যা, গ্র্যামার, ব্যাকরণ।
    -- ও: সরি সরি !

    তাই এমন একটা ছন্দপতনের আগেই পাঠকদের এবার সাবধান করে দিই, আমি কিন্তু সিনেমার গ্র্যামার সম্বন্ধেও কিচ্ছু বুঝি না। আমি সামান্য কম্প্যুটরচি, ব্যাকস্পেস মারতে মারতে কড়ে-আঙুলে কড়া পড়ে গেছে। সত্যজিতের সিনেমা কেন, কোনো সাব্লইম ব্যাপারের সাথেই নিত্যকৃত্যের যোগ নেই। এতদিন রিসেশনের তোড়ে মিইয়ে ছিলাম, এবার বাজার একটু চড়কো শুনে চাঙ্গা লাগছে, খুচরো সংস্কৃতিচর্চাও শুরু করেছি। আবার। আনইনিসিয়েটেড মন নিয়ে সিনেমা দেখি পেরু বা ফØরারন্সে এই ফর্ম নিয়ে যে সব বৈপ্লবিক ভাঙাগড়া চলছে তার কোনো খবরই আমার কাছে পাবেন না, সম্প্রতি 'দিল চাহতা হ্যায়' বলে একটা বই দেখে বিশেষ আমোদ পেয়েছি।

    তবে সত্যজিৎ রায়কে দেখেছি কয়েকবার, একবার কাছ থেকে। টলিউডে ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে ঘরে-বাইরে'র শ্যুটিং, যে-দৃশ্যে সন্দীপের আত্মপ্রকাশ। আমি তখন নেহাতই নাবালক, ক্যামেরার খানিক থামার ফাঁকে দাদার সাথে গুটি গুটি গিয়েছিলাম অটোগ্রাফেØর আশায় । আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, কি নাম তোমার? হঠাৎ যেন মেঘ ডেকে উঠেছিল।

    এই মূলধন আর তারপরের সাম্প্রতিক গুগ্ল সার্চ থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা-কিছু, তাই নিয়ে শুরু করছি। অতএব এ-লেখাতে কোনো আসল মানে বা নতুন ইনসাইট পাবেন না। টীকার থেকে টিপ্পনী, বক্তব্যের থেকে মন্তব্য, দর্শনের থেকে ঘর্ষণই বেশি মিলবে। ডিস্ক্লেমার খুব উঠেছে আজকাল, ওয়েবসাইট থেকে টুথপেস্ট, সবেই সাঁটা থাকে অগ্রণী দায়মোচন তেমনই জুড়ে দিলাম আমিও। তবু ভয় হয়। বাঙালির বোধি তো বিশ্বব্যেপে মালদা, ময়মনসিংহ বা ম্যানহ্যাটন থেকে কেউ হয়ত পড়ে-টড়ে বলবেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার তুমি কিচ্ছু বোঝোনি।

    তা হয়ত নি'ই, তবে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিটা আমার বেশ অন্যরকম লাগে। (ব্যতিক্রমী লিখেও বদলালাম পাছে ত্রক্রমটা কি'র জেরায় জেরবার হতে হয়।) আর এই অন্যতার সন্ধানেই পরের কিছু স্বগতোক্তি।



    ॥ কাঞ্চনজঙ্ঘা : আপাত: অন্যতা ॥


    কাঞ্চনজঙ্ঘা মুক্তি পায় ১৯৬২ সালে। এই প্রথম কাহিনী-চিত্রনাট্য-সঙ্গীত-পরিচালনা'র চতুষ্টয়ী সত্যজিৎ। এই প্রথম রঙিন মাধ্যমে ছবি করলেন সত্যজিৎ। এই প্রথম কোনো পুরস্কার পেল না সত্যজিতের ছবি। এবং কাঞ্চনজঙ্ঘাই রে-ঘরানার হাতে গোনা কয়েকটি ছবির মধ্যে একটি, যা দেশে-বিদেশে একটিও অ্যাওয়ার্ড পায়নি। বাণিজ্যিক হিসাবেও সবথেকে অসফলদের অন্যতম।

    কাঞ্চনজঙ্ঘার পূর্বসূরীরা দিকপাল সব অপুত্রয়ী, জলসাঘর, দেবী, তিনকন্যা, রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্র। আত্মপ্রকাশের বছর কয়েকের মধ্যেই নিজস্ব শৈলী প্রতিষ্ঠিত করেছেন সত্যজিৎ। তাঁর কাছ থেকে কেমন চলচ্চিত্র আশা করা যায় সে-সম্বন্ধেও বিদগ্ধ ও সাধারণ দর্শকের মনে একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু এসত্বেও কাঞ্চনজঙ্ঘা এককথায় কোনো সাড়াই ফেØলল না। পত্র-পত্রিকায় দেশজ সমালোচকেরা গ্রাহ্য করলেন অল্প, যাঁরা করলেন, তাঁদের মন্তব্যও তির্যক। বিদেশে এই ছবির পরিবেশনা প্রায় হলই না, দেশের প্রতিক্রিয়ার জন্যই হয়ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অল্প নজর কাড়ল, য়ুরোপে মাত্র একটি উত্সবে দেখানো হয়েছিল, সাবটাইটেল সহ প্রিন্ট জোগাড় হয়নি বলে পরিবেশনায় বাধা পড়েছিল। ব্রিটিশ দূরদর্শনে প্রথম দেখানো হয় হালের ১৯৮৮'তে।

    অন্যসব মহৎ শিল্পীর মতই সত্যজিতের সৃষ্টিকেও বিষয়, বক্তব্য ও বিভঙ্গের নিরিখে ভাগ করা যায়। তবে এ-কথা মনে রাখা প্রয়োজন, এমন ক্ল্যাসিØংইকেশন আমাদের বোঝার সুবিধার জন্যই heuristic ছলা মাত্র। নির্মিতের কাছে এ পঙক্তিকরণ অর্থহীন আর নির্মাতার কাছেও অবান্তর বিঠোফেØন নিশ্চয়ই ভাবেননি, এইরে থার্ড ফেØজ বয়ে যাচ্ছে, এবার কষে নাইন্থ নামানো যাক ! অপুত্রয়ী তো তোড়ায় বাঁধা হয়েই আছে তেমন নাগরিক আলোআঁধারি নিয়ে প্রতিদ্বন্দী, সীমাবদ্ধ, জন-অরণ্য ফেØলুদাদ্বয়ী সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেØলুনাথ রবীন্দ্রসৃষ্টির ইন্টারপ্রিটেশনের চারুলতা ও ঘরে-বাইরে এবং তথাকথিত প্রকট সমাজচৈতনিক শেষ তিনটি ছবি। এছাড়াও জলসাঘর, অভিযান, দেবী, অরণ্যের দিনরাত্রি, কাপুরুষ ও মহাপুরুষ, অশনি সঙ্কেত প্রভৃতি ছবিগুলি আপাত সম্পৃক্ত না হলেও, সবকটিতেই কাহিনীধারা বা স্টোরিলাইনের দার্ঢ্য সন্দেহাতীত। এবং প্রতিটির ভিত্তিই প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যসৃষ্টির উপর। গুপী গাইন বাঘা বাইন ও হীরক রাজার দেশে'র মধ্যে মিল শুধু একটিই, দুটিতেই গুপী-বাঘা উপস্থিত। এছাড়া এমন দুটি অমিলের ছবি অল্পই মেলে। গুগাবাবা যেমনই স্বর্গিল স্বপ্নময়, হীরক রাজার দেশে তেমনই বক্র ব্যাঙ্গাত্মক। যে-সময়ের পটভূমিতে এ-ছবি, চার্লি চ্যাপলিনের গ্রেট ডিকটেটরের সাথে তুলনা বোধহয় না এসে পারে না। সত্যজিতের ছবিগুলির মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা অন্য সবকটির থেকেই স্বতন্ত্র। কাঞ্চনজঙ্ঘার পরে আরও প্রায় তিরিশ বছর ছবি করলেন সত্যজিত্‌, কিন্তু এমন ছবি আর একটিও করলেন না।



    ॥ কাঞ্চনজঙ্ঘা : বিষয় ও বিন্যাস ॥


    ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষে সত্যজিতের সৃষ্টি তিন কন্যা ও রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্র। ঠিক তার পরের বছরই কাঞ্চনজঙ্ঘা। কালজয়ী সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ন ও এক বিরাট ব্যাক্তিত্বের জীবনচর্যাকে তুলে ধরার ফাঁকে ফাঁকেই হয়ত সত্যজিৎ ভাবছিলেন একেবারে নতুন কিছু করার কথা। কাঞ্চনজঙ্ঘার মনীষা চরিত্রের অভিনেত্রী অলকানন্দা রায়'এর সাম্প্রতিক এক দূরদর্শন সাক্ষাত্কারে একটা নতুন তথ্য জানলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমার লোকেশন নাকি প্রথমে ভাবা হয়েছিল কলকাতার উপকন্ঠের এক বাগানবাড়ি। চিত্রনাট্য সম্পূর্ণ করতে সত্যজিৎ কয়েকদিনের নিভৃত সুযোগের খোঁজে দার্জিলিং'এ থাকতে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে শ্যুটিং'এর কাজ শুরু করার প্ল্যান । দার্জিলিং'এ থাকার সময়েই ছবির ইজেল বদলে ফেØললেন, শৈলশহরই হয়ে উঠল লোকেশন। ছবির নাম হয়ে গেল কাঞ্চনজঙ্ঘা। আগের পরিকপনা মাফিক ছবির কি নাম হত জানি না, তবে ছবির প্রধান চরিত্রকেই আবিষ্কার করলেন দার্জিলিং'এ, তাকেই রাখলেন নাম-ভূমিকায়।

    কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে প্রথমে যেটা চোখে পড়ে তা তার গল্পহীনতা। প্রায় শ'খানেক মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রে আছে বিভিন্ন চরিত্রের কোলাজ, তীক্ষণ সংলাপ, অসাধারণ নিসর্গদৃশ্য এবং স্পর্শী আবহসঙ্গীত, কিন্তু নেই কোনো সুস্পষ্ট কাহিনী। ছবির শুরু থেকে শেষ অবধি যতক্ষণের বর্ণনা পর্দায়, দর্শকের ঘড়ির কাঁটাতেও ঠিক ততখানিই সময় বয়ে যায়। একটা বাঁধা স্পেস-টাইমের বাতাবরণে কয়েকটি চরিত্রকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের ব্যক্তিক ও পারস্পরিক ডেভেলপমেন্টের কয়েকটা খণ্ডদৃশ্য আমাদের সামনে উঠে আসছে। গল্পের বাঁধা গৎ থেকে সরে আসার পরীক্ষা এই প্রথম করলেন সত্যজিত্‌, কাঞ্চনজঙ্ঘায়।

    সাহিত্যে বা সিনেমায়, সাধারণ পাঠক-দর্শক যা আশা করেন তা কিন্তু গল্পই। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, "পল্লী অঞ্চলের এক অল্পশিক্ষিতা বালিকা কর্ত্তৃক আমি একবার একটা গল্প বলতে অনুরুদ্ধ হই। মুখে মুখে বানিয়ে একটা যা তা গল্প তার কাছে করি। সে গল্প শুনে বলে -- গল্প না ছাই, এ আবার কি? তাকে বললুম কেন, কি দোষ হয়েছে? মেয়েটি বলে, এতে তো কিছুই হোল না, এ আবার কি গল্প? ... বর্ণনা বাদে, ভাষা বাদে, ঘটনাও বাদে, অথচ শেষ পর্য্যন্ত কিছুই হোল না, গল্পের এর চেয়ে বড় অখ্যাতি আর কিছুই নেই"। [২]

    শুধু পল্লী অঞ্চলের অল্পশিক্ষিতা বালিকা কেন, আমরা সকলেই গল্পে বা সিনেমায় এই হওয়া সম্বন্ধে খুব উদগ্রীব থাকি। শেষে গিয়ে নায়ক-নায়িকার মিলন নয় বিচ্ছেদ, নয় মরণের মাঝে প্রেমের অমরত্ব ইত্যাদি কিছু একটা জবরদস্ত হওয়া, যাতে করে 'লাস্টে কি হল'র' উত্তর টক করে মেলে, এমন না হওয়া বিব্রতির, বিভ্রান্তিরও। এই কাহিনীহীন কাহিনীচিত্র তুলে যে একটা ঝঁংউকি হচ্ছে সেটা সত্যজিৎ ভালই বুঝতেন। লিখেছেন, "The love of narrative, in no matter what disguised form, is too deeply ingrained in the human species. It is true that the audience has changed in the last fifty years, and equally true that the film makers have discovered a hundred different ways of telling a story where there were only a dozen" [৩] কাঞ্চনজঙ্ঘায় ব্যবহৃত ন্যারেটিভও হয়ত কোনো ডিসগাইজড ফর্ম, বা গল্প বলার শ'খানেক আঙ্গিকের একটি। কিন্তু ১৯৬১ সালের দর্শক তার জন্য খুব একটা প্রস্তুত ছিল না। এখন কতটা, প্রস্তুতি?



    ॥ কাঞ্চনজঙ্ঘা : কিছু নতুন নিরীক্ষা? ॥


    কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে কি হল (বা কি হলই না) তার বিস্তৃত আলোচনা করব না। সত্যজিৎ যা কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিতর দিয়ে বলেছেন, তা কলম পিষে প্রকাশ অসম্ভব, অন্তত আমার কলম পিষে। যাঁরা ছবিটা দেখেছেন, তাঁরা বিষয়-বিন্যাস জানেন। আর যাঁরা দেখেননি, তাঁদের কাছে এই লেখা অবান্তর।

    কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে কোনো গভীর-গম্ভীর অ্যানালিসিসও যে আমার বিদ্যের বাইরে, তা ডিস্ক্লেমারেই বলেছি। এই অধ্যায়ে শুধু কয়েকটি একান্ত ব্যাক্তিক অনুভবের কথা বলব, ছবির আনাচে-কানাচে যা খঁংউজে পেয়ে ঋদ্ধ হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি।

    সত্যজিৎ নিজে বলেছেন, "কাঞ্চনজঙ্ঘার কাহিনী বাংলাদেশের একটি শ্রেণীবিশেষকে কেন্দ্র করে। এই শ্রেণীর পোষাক-আষাকে, চলায় বলায় ইঙ্গবঙ্গ উচ্চ মধ্যবিত্তের ছাপ সুস্পষ্ট। কাহিনীর ঘটনাস্থল হল দার্জিলিং শহর।" [৪]

    অ্যাণ্ড্রু রবিন্সন কৃত সারাংশ, খানিক একমাত্রিক হলেও উপাদেয়। "Set around 1961, it (the plot) shows a hundred-odd minutes in the life of a group of Calcutta Bengalis on the last day of their holiday in the hill station of Darjeeling, during which they have failed to catch a glimpse of the great peak Kanchenjungha. They are a family of rich industrialist, the director of five companies, who holds a title given him in British days of which he is still very proud. As the film begins, he is preparing to leave his hotel, along with his wife and younger daughter, to take a walk after lunch. He has arranged to meet a man whom he wants to be her future husband, and hopes that he will prpose to her if they are left alone together. Her feelings about this, and the unfavourable reactions to the idea of her mother, uncle, elder sister and brother-in-law, form the substance of the film, along with her feelings towards an outsider, a boy from Calcutta who meets her almost by accident. Although nothing definite develops between them, his very presence, combined with the inspiring mountain setting, decides the girl to reject her suitor. She is helped too by her knowledge of her mother's unhappiness and the obvious failure of her elder sister's marriage. By the time the walk is over and the industrialist arrives at a pre-arranged rendezvous, expecting to find his family gathered there with the succesful suitor, certain decisions have been taken and accomodations reached without his knowledge by each member of the group; and none of them is there to greet him - only Kanchenjungha" [৫] কয়েকটি বাক্যসমষ্টিতে হয়ত এর থেকে বেশি বোঝানো যায় না, তবে কাঞ্চনজঙ্ঘা এসব তো বটেই কিন্তু এর বাইরেও অনেক কিছুই।

    "It could be said of each of my first four or five films, that they are simple stories straightforwardly told. All of them have filmic qualities, but none of them has much variety of technique. The first exception to this undoubtedly comes with Kanchenjungha" [৬] ইত্যবধির নিজেকে ভেঙে বেরোনোর চেষ্টা তাহলে সত্যজিৎ করেছিলেন কাঞ্চনজঙ্ঘায় এবং এইরকম সচেতন বৈবর্তনিক প্রয়াস না থাকলে শিল্পীরা শেষ হন চট করেই।



    এই প্রথম রঙিন ছবি করলেন সত্যজিৎ। আবার বছর দশেক পরে রঙ সেই অশনিসঙ্কেত'এ। "চরিত্রের রূপ ফুটিয়ে তুলতেও যে রঙ সাহায্য করতে পারে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ... কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির আট ন'টি প্রধান চরিত্রে পোষাক নির্বাচনে সেইসব চরিত্রের সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিগত, মানসিক অবস্থা -- এ সব কিছুরই ইঙ্গিত দেবার প্রয়াস ছিল। সাদা-কালোয় একাজটা সম্ভব হত আংশিকভাবে, বাকিটুকু হয় অব্যক্ত থেকে যেত, না হয় সংলাপের সাহায্যে বলতে হত।"[৭] কাঞ্চনজঙ্ঘার কোনো চরিত্রেরই বেশ বদলের সুযোগ ছিল না, তাই যে একবস্ত্রেই তাঁরা পর্দায় উঠে এসেছেন, সেভাবেই আলাপ দর্শকদের সঙ্গে। ইন্দ্রনাথের ছেলের চড়া রঙের পোশাকেই ফোটে তার চটুলতা, মনীষার জাফরানি শাড়ি যেন প্রত্যাখানেরই পূর্বরাগ, অশোকের ছা-পোষা মাফলার তার কুন্ঠিত আলাপচারিতাই গাঢ় করে, লাবণ্যের মৃদু ম্লান শাল তাঁর উত্কন্ঠারই দ্যোতক। এছাড়া নভেম্বর মাসের দার্জিলিঙ'এর বিকেলের প্রকৃতি ধরা পড়ে নানা ব্যঞ্জনায়। ঝলমলে রোদ্দুর নেই, আছে কুয়াশার যাওয়া আসা, আলো ফিকে হয়ে আবার জেগে ওঠা। প্রায় পুরোটাই আউটডোরের একটা ছবিতে আলোর এত বিভিন্নময়তা বিরল। কর্তৃত্ব, বিশ্বাসহীনতা, বন্ধুতা, সঙ্কোচ, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি প্রত্যেকটি মুড'ই মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই মুহূর্তটির প্রকৃতির সাথে।

    কাঞ্চনজঙ্ঘার জগৎ সাদা-কালোর বীক্ষণ নয়। আলোও আছে, আঁধারও আছে, কুয়াশা আছে, রোদ'ও আছে, পরিচিতি আছে আবার অপরিচিতিও। চরিত্রেরা কেউই জাগান না ভীষণ ভাল লাগা বা ভীষণ মন্দ লাগা। বিরাট শিল্পসৃষ্টিকে মহাকাব্যিক বলার রীতি আছে, সেই ধারাকে বেঁকিয়ে নিয়ে বলা চলে, কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন এক সার্থক অ্যান্টি-এপিক। চড়চড়ে রোদ নেই, আছে সফ্ট ফোকাস । যা কিছু তীব্র, তা প্রকট নয়। রঙিন ফিল্ম ব্যবহার কাঞ্চনজঙ্ঘায় প্রতীকী, ভাবতে ভাল লাগে আমার। বর্ণালীর ফাঁকে ফাঁকে যে হাজারো অনামী রঙের মেলা, যারা ধর্তব্য শুধু চৈতন্যে, তাদের নিয়েই কারবার এখানে।

    রঙের ব্যবহার না হলেও হয়ত এ সবই ফোটানো যেত, কিন্তু তা হলে যেটি ব্যাহত হত সেটিই কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রধান আকর্ষণের একটি, ইকনমি অফ ফর্ম। ঠিক যেটুকু প্রয়োজন সেটুকুরই ইঙ্গিত, ব্যক্ত আর অব্যক্তের মধ্যে এক স্পন্দিত স্থিতাবস্থা। অনেকটা অপ্রকাশের মধ্যে অল্প প্রকাশের সঙ্কীর্ণ আল ধরে এই ছবি এগিয়েছে।

    সিনেমার মূল ধারার থেকে খানিক বিচ্ছিন্ন হলেও জগদীশ আর অশোকের অল্প খানিক্ষণের আলাপ দাগ কেটে যায়। মি: ব্যানার্জী আর মনীষাকে 'থ্রি ইজ অ্যা ত্রক্রাউডের' বিপত্তি থেকে বাঁচাতে জগদীশ অশোককে একরকম বগলদাবা করেই নিয়ে সরে এসেছেন। নিবিষ্ট হয়ে তাকে শোনাচ্ছেন তাঁর প্রিয় পাখিদের বিপদের কথা। আকাশ হতে আকাশ পথে তাদের পরিচিত উড়ানপথের ঠিকানা বদলে যাচ্ছে, মানুষের আনবিক লীলার অনুষঙ্গে। নিরীহ নভোচরদের গায়েও লাগছে সভ্যতার আগ্রাসী আঁচ। শিক্ষিত মানুষ, সংস্কৃত মানুষ মাত্রেই যে তাঁর প্রবৃত্তি ও প্রয়োজনের পৃথিবীটার বাইরের জগত্কে নিয়েও ভাবার দরকার দেখেন, তার ছোঁওয়া আমরা পাই জগদীশের কথায়। যারা রোস্ট হয়ে উদরপূর্তির যোগ্য নয়, বা জামাই হয়ে প্রতিপত্তি বৃদ্ধির, তাদের সাথেও যে ভাগ করে নিতে হয় সৃষ্টির সহাবস্থান, এমন চিন্তা যেন এক কোমল ধৈবতের মতো প্রবেশ করে ছবিতে। ১৯৬১ সালে পরিবেশচিন্তা নতুনই ছিল, শিল্পসৃষ্টিতে তার প্রবেশ ঘটেনি ব্যাপকভাবে। সার্থক শিল্পীরাই নিজের শিল্পের সঙ্গে সম্যক সম্পৃক্ত নয়, এমন ভাবনাও ভাবেন ও প্রকাশ করেন তাঁদের কৃষ্টি-কৃত্যে, সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়েই। রবীন্দ্রনাথের বৃক্ষরোপণ উত্সবের যখন প্রবর্তন, এনডেনজার্ড এনভায়ারনমেন্ট নিয়ে হতশ্বাস তখনো ফাযাশন হয়নি।

    জগদীশ চরিত্রটিই কাঞ্চনজঙ্ঘায় এসেছে কারণ নিছক গল্প বলতে বসা হয়নি। গল্প বলার যে নতুন আঙ্গিকের নিরীক্ষা এখানে তারই রূপায়নের রসদ জগদীশ।

    সত্যজিতের পরবর্তী প্রায় সব ছবিতে সংলাপের যে প্রধান ভূমিকা, যা প্রায় চুম্বকের মতো টেনে রাখে দর্শককে, যার পরাকাষ্ঠা শেষ ছবি আগন্তুক'এ, তার সূচনা এই কাঞ্চনজঙ্ঘায়। দৃশ্য বাদ দিয়ে ছবির সাউণ্ডট্র্যাকটা শুনেছি বহুবার, আরেক অন্য উপভোগে ভরে উঠেছি।

    ইন্দ্রনাথ একভাবে কথা বলেন, লাবণ্য প্রায় বলেনই না, যখন বলেন, অন্যভাবে। অশোকের এক আঙ্গিক, জগদীশের আরেক, মনীষা মি: ব্যানার্জির সঙ্গে খানিক আড়ষ্ট ভঙ্গিতে, অশোকের সঙ্গে অনেক সাবলীল। অণিমার স্বামীর, 'পাথর হয়েছি আমি জেনে, জানবার আগে নয়', যেন বিপন্ন বিবাহের মহাকাব্য শুনিয়ে যায়। সেই একই দৃশ্যে চলে তাদের ধ্বস্ত সম্পর্কের মেরামতির চেষ্টাও। আর ঠিক তখনই তাদের একমাত্র কন্যা টাট্টু ঘোড়ায় চেপে প্রদক্ষিণ করে চলেছে ধরিত্রীর মত স্থির আশ্রয়ের পিতামাতাকে।

    বিভিন্নতার মধ্যেও বন্ধুতার প্রসঙ্গে মনীষার ও মি: ব্যানার্জীর আলাপ,
    -- সন্দীপ আর নিখিলেশ...,
    -- অ্যাঁ...
    -- আপনি ঘরে বাইরে পড়েননি?

    এ তো শুধু কয়েকটি শব্দের সমষ্টিই নয়।


    যে পাহাড়ী বালক পুরো সিনেমাটা জুড়ে যায় আসে, কাঞ্চনজঙ্ঘার মতই যুগল্পৎ ব্যাপ্ত অথচ বিচ্ছিন্ন, তার মুখে একটিও কথা দেননি পরিচালক, কিন্তু চরিত্রটি পুরোটাই একটি বক্তব্য, একটা বিরাট কনট্রাস্ট। ছেলেটি স্থানীয়তারও প্রতীক, কাঞ্চনজঙ্ঘার সাথে দার্জিলিং যেমন প্রায় সমার্থক, তেমন এই ছেলেটিও ।

    কথার পাশাপাশি হাঁটাও, কাঞ্চনজঙ্ঘায় এক্সপ্রেশনের অরেক দ্যোতনা । প্রায় পুরো ছবি জুড়েই এই চলতে থাকা, সকলেরই। কখনো জোরে হাঁটা, কখনো আস্তে, কখনো থেমে যাওয়া। মনীষার চলার লালিত্য মিলিয়ে যায় গতিতে, মি: ব্যানার্জীর সাথে সাক্ষাত্কার যতই ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগোতে থাকে।

    কাঞ্চনজঙ্ঘার আবহসঙ্গীতে সব থেকে উলেখ্য, ঘুরে ঘুরে ফিরে ফিরে আসা এক পার্বত্য ধুন। এই হন্টিং সুরধুনী ও অবগুন্ঠিতা কাঞ্চনজঙ্ঘা মিলে গিয়ে তৈরি হয় এক অদ্ভুত আবেশ। "একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে ইঙ্গ-বঙ্গ ভাব -- এই দুই মূল সূত্র থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার আবহসঙ্গীতের উদ্ভব। পাহাড়ী লোকসঙ্গীতের সুর ইচ্ছামত ভেঙে দেশী ও বিলাতী যন্ত্রে একক ও সমবেত ভাবে বাজিয়ে এ ছবির মেজাজ আনবার চেষ্টা হয়েছিল"। [৮] এমন ভাবেই সত্যজিৎ ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর প্রথম সঙ্গীত পরিচালনার প্রয়াস।

    আবহে বাজনা ছাড়াও কাঞ্চনজঙ্ঘায় রবীন্দ্রনাথের একটি গানের ব্যবহার আছে। এ পরবাসে রবে কে হায়, অমিতা ঠাকুরের কন্ঠে। বিষন্ন সন্ধ্যার নান্দীমুখে, আপ্লুত হয়ে গেয়েছেন লাবণ্য একলা, নি:শব্দ শ্রুতিতে কুয়াশাকীর্ণ চারপাশ। জগদীশ দাঁড়িয়েছেন এসে পিছনে এবং গানের শেষে লাবণ্য আবিষ্কার করেন তাঁকে এক কথার সংলাপ 'দাদা' আর জগদীশের উত্তর, ছবির স্পর্শীতম মুহূর্তগুলির অন্যতম। গানের নির্বাচন এখানে তাত্পর্যময়, মাত্র চারটি ছত্রের মধ্যে সংশয়, সন্তাপ, শোক ও দু:খভয়সঙ্কট। নি:সঙ্গতা নেই, রবীন্দ্রনাথের এমন গান মেলেই না হয়ত। তবে তেইশ বছরে লেখা এই গানে একাকীত্ব যেন জমাট বেঁধে আছে, সূচাগ্রপরিমাণ নিস্তার নেই, তেমন আপন কেহ নাহি এ প্রান্তরে, হায় রে। পুরো সিনেমায় লাবণ্য যে-কটি কথা বলেন তার থেকে গানের এ-কটি ছত্র অনেক বেশি বাঙ্ময়। যে গান থেকে তিনি ছিলেন বহুকালের নির্বাসনে, হঠাৎ তার স্‌Øংঊরণ আজ লাবণ্যকে দিল এক অভাবনীয় ঋজুতা। জগদীশের দৌত্যে ছোট মেয়েকে জানাতে চাইলেন, তার সিদ্ধান্তই হবে শেষ কথা, রায়বাহাদুরের ফতোয়ার দায় তিনি নিজে সামলাবেন। ছোট্ট একটা গান বেয়ে লাবণ্য যেন এক বিরাট পরিখা পেরিয়ে এলেন, আত্মজার জীবন থেকে কর্তৃত্বের ছায়া আড়াল করতে উঠলেন।

    রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যবহার সত্যজিতের ছবিতে ব্যাপক না হলেও বিশিষ্ট। কিছু ছবির কিছু মোহনায় এসেছে এইসব গান, পরিস্থিতিকে নিয়ে গেছে এককতায়। চারুলতা'র, আমি চিনি গো চিনি তোমারে ঘরে বাইরে'র বিধির বাঁধন কাটবে তুমি বা আগন্তুক'এর বাজিল কাহার বীণা এগুলি বাদ দিলেও আরো কয়েকটি সিকোয়েন্স মনে আসে। কাপুরুষ'এর পাহাড়ি পথের পিকনিক যাত্রায়, এ পথে আমি যে গেছি বারবার মণিহারা'র ত্রস্ত বাতাসে বাজে করুণ সুরে বা শাখা-প্রশাখার মুঙ্গারির চড়ুইভাতিতে মরি লো মরি আমায় খুব চেনা গানগুলিকেও যেন নতুন করে চিনিয়ে যায়।

    তবে আবহের সঙ্গীত বাদ দিলেও, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক অত্যন্ত সাঙ্গীতিক ছবি । একটি সুরলহরী যেমন নির্দিষ্ট তার সুর তাল ছন্দ লয়'এ, পুরোটাই কোনো আগাম পরিকল্পনা মাফিক চলে, তেমন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে বসে আমার মনে হয়েছে, দৃশ্য, সংলাপ, শব্দ, সঙ্গীত সবই এক নৈপথ্যিক কম্পোজিসনের ছকে খেলে বেড়াচ্ছে। একটা প্যাটার্ন আসছে যাচ্ছে, কিন্তু তাকে ধরা যাচ্ছে না, ঠিক পরেই কি হবে তার একটা আভাস যেন বাতাসে আছে, একটু খঁংউজলেই হয়ত পাওয়া যাবে, কিন্তু মিলছে না। কাঠামোটা একেবারেই প্রচ্ছন্ন, কিন্তু আছে। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতে সত্যজিতের অনুরাগ ও ব্যুত্পত্তি সুবিদিত। হয়ত সোনাটা ফর্ম বা তেমন কোনো স্ট্রাক্চারের নিরিখে ভেবেছিলেন ছবিটিকে। এর বেশি মর্মোদ্ঘাটন আমার বোধির বাইরে। তবু আজন্মিক পল্লবগ্রাহিতার তোড়ে এটুকু বলেই ফেললাম, শেষদৃশ্যের কাঞ্চনজঙ্ঘার স্বপ্রকাশ এক সার্থক coda'র মতোই মাতিয়ে দেয় ।



    ॥ কাঞ্চনজঙ্ঘা : কাঞ্চনজঙ্ঘা ॥



    ইস্কুলে একবার "যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে" প্রবাদটা খোলসা করার তাড়নায় উর্বর সহপাঠী বাক্য রচনা করেছিলেন, যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে, অতএব তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে লাভ নেই। কুপিত শিক্ষক নানা চতুষ্পদীয় সম্ভাষণ সেরে বলেন, ওরে প্রথমটা মহাভারত, দ্বিতীয়টা ভারতবর্ষ । তাই আগেই বলে নিই, এখানে প্রথমটা কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবি ও দ্বিতীয়টা কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়া।

    কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে কাঞ্চনজঙ্ঘাই যে প্রধান চরিত্র তা নামের ইঙ্গিতে ধরা পড়লেও দর্শকের কাছে পরিষ্কার হয় ধীরে ধীরে। প্রাথমিক পরিকল্পনা মাফিক কলকাতার কাছের বাগানবাড়ি ছবির লোকেশন হলেও হয়ত সত্যজিতের প্রতিভার জোরে তা সার্থক সিনেমাই হত। কিন্তু সব চরিত্র, সব সংলাপ, সব আবহও এক থাকলেও এই কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে তার মিল থাকতই না, কারণ কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বাদ দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ভাবাই যায় না। ছবিটির আবর্তন ও চরিত্রদের বিবর্তন, ঐকিক ও পারস্পরিক, সবেরই নেপথ্যে নায়ক ও নিয়ন্তা দার্জিলিং'এর প্রকৃতি এবং কুয়াশা-ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা, যা দেখা দেয় একবারই -- একদম শেষে, হয়ত মীমাংসার মতো।

    মানুষের চর্যায় প্রকৃতির প্রভাব নিয়ে শিল্পসৃষ্টি প্রচুর হয়েছে, তার মধ্যে উত্রেছেও অনেক। এমন সাহিত্যও অল্প নয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার মূল থীমের আলোচনায় তেমন কয়েকটির উল্লেখ অবান্তর হবে না।

    মেঘ ও রৌদ্র লেখা হয় একশো বছরেরও আগে, সাধনা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ ১৩০১ বঙ্গাব্দ। পরে গল্পগুচ্ছ'এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সূচনা এমন ভাবে,

    "পূর্বদিন বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আজ ক্ষান্তবষর্ণ প্রাত:কালে ম্লান রৌদ্র ও খণ্ড মেঘ মিলিয়া পরিপক্কপ্রায় আউশ ধানের ক্ষেত্রের উপর পর্যায়ক্রমে আপন আপন সুদীর্ঘ তুলি বুলাইয়া যাইতেছিল, সুবিস্তৃত শ্যাম চিত্রপট একবার আলোকের স্পর্শে উজ্জ্বল পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিতেছিল, আবার পরক্ষণেই ছায়াপ্রলেপে গাঢ় স্নিগ্ধতায় অঙ্কিত হইতেছিল।

    যখন সমস্ত আকাশরঙ্গভূমিতে মেঘ ও রৌদ্র, দুইটি মাত্র অভিনেতা আপন আপন অংশ অভিনয় করিতেছিল তখন নিম্নে সংসাররঙ্গভূমিতে কত স্থানে কত অভিনয় চলিতেছিল তাহার আর সংখ্যা নাই। " [৯]

    তারপরে গিরিবালা ও শশিভূষণের গল্প বলা হয় আট পরিচ্ছেদ ধরে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে গল্পের পটভূমি উপস্থিত করবার সময়, প্রকাশের যে শৈল্পিক স্বল্পতা, তা অনন্য এবং এখানে খানিক প্রক্ষিপ্ত মনে হলেও উদ্ধৃত না করে পারছি না। "গ্রামের মধ্যে আর সকলেই দলাদলি চক্রান্ত, ইক্ষুর চাষ, মিথ্যা মকদ্দমা এবং পাটের কারবার লইয়া থাকিত, ভাবের আলোচনা করিত কেবল শশিভূষণ ও গিরিবালা।" [১০] শুধু একটি বাক্যের ভিতর দিয়ে উঠে এসেছে একটা গোটা সামাজিক প্রেক্ষিত, যার উপরেই আঁকা হয়েছে এই দুই চরিত্রের পরিক্রমণ।

    এই গল্প, মেঘ ও রোদ্দুরের কোনো আবহাওয়িক আলোচনা নয় -- অমাবস্যার আলো যেমন খটকায় ফেØলেছিল চারুলতার ভূপতিকে -- এবং গল্পে যা হল আর যা হল না তা'তে মেঘ ও রৌদ্রের ভূমিকা আঙুল দিয়ে দেখানো কঠিন। তা সত্ত্বেও কাহিনীর গমন ও গন্তব্যের সাথে পরিচিত হয়ে অন্য কোনো নাম সংগত মনে হয় না। শশিভূষণ ও গিরিবালার মার্ত্যিক জীবনের ঘটনার সঙ্গে নির্লিপ্ত প্রকৃতির আকস্মিক ও বিচ্ছিন্ন লীলাকে যে সূত্রে গেঁথেছেন রবীন্দ্রনাথ, তা চেনেন ও চেনান মহৎ শিল্পীরাই।

    উপজীব্যে ও উপস্থাপনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি ছোটগল্পের কথাও এখানে মনে আসতে পারে। সমারসেট ম'ম-এর রেন। (Rain, by W Somerset Maugham) জাহাজ-যাত্রার দুর্যোগে দুটি ইংরাজ দম্পতি আশ্রয় নিয়েছেন প্রশান্ত মহাসাগরের একটি জনবিরল দ্বীপে, কবে নোঙর উঠবে তার ঠিকানা নেই। দ্বীপের অধিকাংশই স্বল্পসভ্য নেটিভ, দুয়েকজন শ্বেতাঙ্গবংশোদ্ভুত আধিকারীক, ব্যবসায়ীও আছেন। আরেকজন শ্বেতাঙ্গিনী উদিত হন, এক পেশাদার স্বৈরিণী, এবং নিজের বাণিজ্যও শুরু করেন নির্দ্বিধায়, পূর্বোক্ত দম্পতিদের নাকের ডগায়। কিন্তু এইসব অবস্থা ও ব্যবস্থা ছাপিয়ে ওঠে এক প্রাকৃতিক ঘটনা, অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। বর্ণনা এমন -- "his nerves. It was not like soft English rain that drops gently on the earth, it was unmerciful and somehow terrible; you felt in it the malignancy of the primitive powers of nature. It did not pour, it flowed. It was like a deluge from heaven and it rattled on the roof of the corrugated iron with a steady persistence that was maddenning. It seemed to have a fury of its own. And sometimes you felt that you must scream if it did not stop, and then suddenly you felt powerless, as though your bones had suddenly become soft and you were miserable and hopeless." [১১]এই গল্পের নিদারুণ ও চমকে দেওয়া যে পরিণতি তার সম্ভাবনা একমাত্র স্বীকার করা যায় এই বৃষ্টির ভূমিকা চিনতে পারলে। একনিষ্ঠ যাজক ডেভিড্সন যে ঘটনার শরিক হয়ে পড়লেন তা ঘটতে পারল শুধু ওই পরিবেশের জন্যই ওই অমোঘ অসহ্য ধারাপাত যেন ধুইয়ে দিয়েছিল তার অতীত, গলিয়ে দিয়েছিল তার অস্তিত্বের শিকড়গুলি। ইচ্ছা করেই কাহিনীটির গল্প বিশদ করে বলব না, কারণ এখানেও আশ্লেষটিই আসল, কি হল দু-কথায় বলা যায় না, এবং যেতে গেলে, অলীক, খেলো বা আরেকটু কল্পনাবিলাসীদের কাছে নিছক রিরংসিকও মনে হতে পারে।

    এই দুই গল্পে প্রকৃতি এসেছে দুই ভাবে। মেঘ ও রৌদ্র'তে নিসর্গের দুই দূতের লুকোচুরি বোনা হয়ে আছে গল্পের ঘটনার chiaroscuro'র মধ্যে এবং এমনই নিপুণ নিবিড়তায়, যা প্রায় শুধুই অনুভবগম্য। রেন'এ বৃষ্টি একইধারে প্রেক্ষিত ও পরিচালক, কয়েকটি মানুষকে এক অদ্ভুত, অভাবনীয় আবর্তে আটকে, আছড়ে চৌচির করে দিয়েছে। মেঘ ও রৌদ্র'তে প্রকৃতি যেমনই আলতো মেদুরতায়, রেন'এ তেমনই ভীষণ বিভঙ্গে। কাঞ্চনজঙ্ঘার অবস্থান, এই দুইয়ের মাঝামাঝি। কুয়াশার আনাগোনা, কাঞ্চনজঙ্ঘা অবগুন্ঠিতা, এরই মাঝে চরিত্রদের ঘোরা ফেরা । পরিচিত পৃথিবী ঢেকে যায়, অনেক যুগান্তিক প্রশ্নের উপর আড়াল চলে আসে, মনীষা বলে ওঠেন, মনে হয় মিস্ট হবে। যে নিজেদের নিয়ে প্রতিদিনের গেরস্থালি তাদের থেকে একটু ছাড়িয়ে যাওয়ার অবচেতনে চেষ্টা সকলেরই। যদিও সকলেই জানেন, এ তাত্ক্ষণিক, আবার ফিরতে হবে ইঁট কাঠের কলকাতায়, যেখানে প্রতিপত্তি প্রতিপন্ন, যেখানে টিউশ্যনি করে চালানোর কৃচ্ছ্র ফিকে করার কেউ বা কিছুই নেই। কিন্তু জানলেও তাকে মানতে ইচ্ছা হয় না, অন্তত আপাত: ও আপাতত:।

    কাঞ্চনজঙ্ঘা আছে, কিন্তু চোখের সামনে নেই এই অবস্থাটাই সিনেমায় বিশেষ মাত্রা এনে দিয়েছে। যাঁরা দার্জিলিং গেছেন এবং দিনের পর দিন নির্নিমেষে অপেক্ষা করেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘার জন্য, তারপরে দেখা হয়ত পাননি, হয়ত পেয়েছেন, তাঁরা জানেন কেমন একটা ennui ঘিরে ধরে প্রতীক্ষার দিনগুলিতে। এই পরিস্থিতির নিরিখেই ছবিটা বিশ্বাসযোগ্য ও অনুভবী হয়ে ওঠে । দার্জিলিং সত্যজিতের খুবই প্রিয় জায়গা ছিল, শৈশবে গেছেন বেশ ক'বার, সে কথা লিখেওছেন স্মৃতিচারণায়।

    শেষ দৃশ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘার উদ্বোধন। ইন্দ্রনাথ নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেখেন তিনি একা, কেউ আসেনি। বোঝেন কোথাও একটা ছক ওলট-পালট হয়েছে, মুখে বিরক্তি, ভ্রুকুটি। তারপর হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে, দেখেন কাঞ্চনজঙ্ঘা।

    অ্যাণ্ড্রু রবিনসন লিখেছেন, "As the mists at last roll away from the awesome summit, the industrialist is so pre-occupied, he no longer cares to admire it." [১২] শেষ সাতটি শব্দের সাথে একমত হতে পারি না । ইন্দ্রনাথের আত্মহারা ডাক জগদীশ, ব্যানার্জী....., তাঁর বিহবলতাকে চিনিয়ে দেয়। নিমেষের জন্য আজ বিকেলের অনেক তাবড় অ্যাজেণ্ডা ভুলে গিয়ে তিনিও ভরে যান অসাড় আবেগে। শেষ কয়েক নিমেষ ক্যামেরা স্থির থাকে, কিরণকিরীটে কাঞ্চনজঙ্ঘা, সৌকর্ষে অবিচল। ন্যারেটিভ পৌঁছে যায় শেষে, কিন্তু কোনো সমাধানে নয়। আবার হয়ত কুয়াশা হবে, ঢেকে যাবে শিখর, মিস্ট'এর মধ্যে হারানো অনেক কিছুই, বেরোবে হয়ত। পর্দা জুড়ে শুধু একটা মূহুর্ত এবং এই ক্ষণিক মূর্চ্ছনাতেই বাতি জলে ওঠে হলের (বা যারা টিভিতে দেখি, কোনো দাঁতন বা বিস্কুটের বিজ্ঞাপন ঝনঝনিয়ে ওঠে)। সিনেমার শেষ এবং তার পরের পুনশ্চের মাঝের যে-পথটা, সেটা দর্শককে নিজেকেই হাঁটতে হয়।

    মানুষের তুচ্ছ প্রয়াস-পরিশ্রান্তির বৈপরীত্যে প্রকৃতির নির্মোক নির্লিপ্তি, এমন অসীমাভ তত্ত্ব হয়ত খঁংউজলে পাওয়া যেতে পারে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঘেঁটে। তবে আমার মনে হয়, কাজ কি? শুধু গল্পেরই দায় থাকে মানে হওয়ার, কিছু দেখানোর বা কিছু শেখানোর। এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা যে গল্প নয় সে সাফাই তো আগেই গাওয়া হয়েছে।



    ॥ কাঞ্চনজঙ্ঘা : দর্শকের দিক থেকে ॥



    সিনেমায় দর্শকের ভূমিকা একরকম আবশ্যিকতার পর্যায়ে। কারণ, কবির ক্ষেত্রে যেখানে শিল্পচর্চার উপকরণ বলতে শুধুই কাগজ-কালি, চিত্রকরের রঙ-তুলি-ইজেল, পরিচালকের সেখানে তুলনায় বিরাট ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে নামতে হয় (বেশির ভাগ সময়ই যা কোনো কুবের প্রযোজকের)। একটা ছবি দর্শক না নিলে, পরিচালকের পরের ছবির আশা দুরাশাই থাকতে পারে।

    "Renoir once remarked that it was the alertness and receptivity of the french public that made possible the resurgnace of the French cinema in the 'thirties'. The public that would support a truly serious film venture in Bengal is so small that it makes nothing than a two reeler a safe business proposition. If one makes a film aimed solely at this minority, one obviously makes them for love. In reality, no director can afford to do this, for once the stigma of esotericism attaches to his name, his days in the profession are numbered" [১৩]

    এই দুর্বোধির দুর্নাম সত্যজিতের নামের সাথে কতটা সেঁটে ছিল সে-নিয়ে তর্কে না-গিয়েও এটা নিশ্চয়ই বলা যায় তাঁর সিনেমার দর্শকবলয় চিরকালই সঙ্কীর্ণ ও সীমিত। এটা কোনো পরিতাপের বিষয় নয়। শিল্পের স্তর থাকে বিস্তর এবং যেকোনো উপভোক্তারই নিজের পছন্দমতো পসরা খঁংউজে নেওয়ার স্বাধীনতা ও অধিকার আছে। যে-কারণে ব্র্যাণ্ডেনবার্গ কনচার্তো শোনেন কিছু লোক এবং কোনো অর্ধনারীশ্বর পপ গায়কের গলা-খাঁকারিতে দিব্যোন্মাদ হয়ে নাচেন কয়েক লাখ, ঠিক সেই কারণেই অল্প কিছু দর্শকই সত্যজিতের সিনেমা অনুধাবন ও অনুভব করতে পারেন।

    এই প্রেক্ষিতটা মাথায় রেখেই খোঁজা যাক কাঞ্চনজঙ্ঘার অভিঘাতের কারণগুলি, বিদেশে ও দেশে।

    পথের পাঁচালী'র বিদেশে পরিচিতি ও পুরস্কৃতির কারণ অনেকগুলি। পরিচালনার পারিপাট্য, কাহিনীর বৈশ্বিক আবেদন তো নিশ্চয়ই। তবে তার সাথে এটাও উলেখ করতে হয়, পথের পাঁচালীতে দেখানো ভারতবর্ষ বিদেশের কাছে ছিল বেশ চেনা এবং প্রত্যাশিতও। দুর্দম দারিদ্র্য, অনাহার, ব্যাধি, জরা, মৃত্যু এবং অবশ্যই তার থেকে উত্তরণের আপ্রাণ চেষ্টা এমন ছাঁচটা ওদিকে খুব সহজবোধ্য, ভারত-সংক্রান্ত ব্যাপারে। এই মানসিকতাটা এতই ব্যাপ্ত যে কলকাতা সম্বন্ধে এক বহু বিশ্রুত বইয়ে, শহরের প্রাণশক্তিকে প্রতিপন্ন করতে বিদেশী লেখককে প্রথম গেয়ে নিতে হয়েছে মহানগরীর দৈন্য, খিন্নতা ও কর্দমের সাতকাহন।

    তবে যা বাস্তব সত্য তা নিয়েই হয় শিল্প এবং তা'তে সঙ্কোচের স্থান নেই। তাই পথের পাঁচালীর সিকি শতাব্দী বাদে যখন সংসদে দাঁড়িয়ে বোম্বাইয়ের এক পড়তি নায়িকা, দেশের দৈন্য বাইরে দেখিয়ে ভারতের ভাবমূর্তি খাটো করার জন্য দোষেন সত্যজিত্কে (ভারত মাতার উপর আবার এই ভদ্রমহিলার একটু বিশেষ দাবি ছিল), তখন নিজের নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই প্রমাণ করতে পারেননি।

    পথের পাঁচালী ও তার ঠিক পরের ছবিগুলিতে এই পরিচিত ভারতবর্ষেরই প্রমাণ মিলেছিল বিদেশে। হোঁচট লাগল কাঞ্চনজঙ্ঘায় এসে। কলকাতার একটা সেমিনারে, এক মার্কিন মহিলা, হবেন হয়ত প্রখ্যাত ফিল্ম বোদ্ধা, সত্যজিত্কে সরাসরি বলে বসেন, "Who are these characters ? I don't like them at all." সত্যজিৎ টীকা জুড়েছেন, "She was only interested in the poor Indians, the lower class Indians, the Indians who suffer and are really rooted. These hybrid sort of characters disturbed her greatly" [১৪]

    সর্ষের ভিতরে ভূত এইখানেই। কাঞ্চনজঙ্ঘা তার গল্পহীনতায় আধুনিক হলেও, সময় ও সমাজের একটি বিশেষ স্থানাঙ্কেও তার শিকড় গভীর। এবং সেই পটভূমিকে চিনতে গেলে ভারতের আধুনিক ইতিহাস জানতে হবে ও তার প্রভাব বুঝতে হবে বর্তমানে। যে ইঙ্গ-বঙ্গ চরিত্রগুলিকে নিয়ে এই ছবি, তাদের জেনেসিসের মধ্যেই যে জড়িয়ে আছে দুশো বছরের ইংরাজ শাসন, তার থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রাম এবং একটি জাতির বিবর্তনের কম্বুরেখা। ভারত সম্বন্ধে তন্নিষ্ঠ আগ্রহ ও জানার অধ্যবসায় না থাকলে কোনো বিদেশীর পক্ষে এই প্রেক্ষাপট বোঝা অসম্ভব। এবং সেই না-বোঝার নিরিখে কাঞ্চনজঙ্ঘার চরিত্রদের অলীক মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

    এবার দেখা যাক, দেশীরা কেমন বুঝলেন। দেশী বলতে এখানে বাঙালিই, সত্যজিতের সিনেমার সাথে ভারতে অন্য প্রদেশের পরিচিতি মনে হয় বিদেশের থেকেও কম। আবার বাঙালিদের মধ্যেও যাঁরা হলে যান সত্যজিতের ছবি দেখতে, তাঁদের সকলেরই যে উপভোগে লাগে তাও হয়ত না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি। আগন্তুক রিলিজ করেছিল সত্যজিতের প্রয়াণের পরেই, ততদিনে অস্কার পেয়ে গেছেন, ভারতরত্নের ঘোষণাও যথারীতি অগত্য অত:পর। তারপর শ্রেষ্ঠ জাতীয় ছবিও হল, দেখার জন্য খানিক হুড়োহুড়ি ছিল। দক্ষিণ কলকাতার হলে শো'এর মধ্যে, সবে "নাসা, আর তার পাশেই নেশা" পেরিয়েছে, পিছনের সারি থেকে শুনছি, বেশ এক সম্ভ্রান্ত গৃহিনী ঝিমোন্ত পতিকে বলছেন, কি খালি সভ্যতা নিয়ে ভ্যাজভ্যাজানি। এঁরা এসব সিনেমায় এসেছিলেন, এখনও আসেন নিশ্চয়ই, সেই কারণেই যে-কারণে ড্রয়িংরুমে রবীন্দ্র রচনাবলীও সাজিয়ে রেখেছেন একসেট, চামড়ার বাঁধাইয়ে। এবং এঁরা তেমন হালের আমদানিও নন, বুদ্ধদেব বসু তো এঁদের অমর করেছেন সেই ১৯৬১'র রবীন্দ্র রচনাবলী গল্পেই।

    নিজের ভাষার দর্শকের কাছে নিজের ছবির এই প্রান্তিকতা সত্বেও সত্যজিৎ গড়েছিলেন নিজস্ব ও নিবিষ্ট এক দর্শকমণ্ডলী। এবং তাদেরই কাঞ্চনজঙ্ঘা বিব্রত করল, বিরক্তও।

    সালটা ১৯৬২, স্বাধীনতা তখনও ম্যাড়মেড়ে হয়নি। তত্কালীন সমাজের সমস্যার থেকে একান্তই সংস্রবহীন একটা পটভূমি, কিছু ইঙ্গ ঘেঁষা চরিত্র -- তাদের পুরোধা রায়বাহাদুর তো প্রকাশ্যে ও সদর্পেই তাঁর ইংরাজপ্রীতি জাহির করেন -- প্রায় ঘটনাহীন একটা ন্যারেটিভ, সত্যজিতের প্রতিভার অর্থহীন ব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয় মনে হয়েছিল অনেকের। এবং এই মনে হওয়া আরো জোরদার কারণ এই শ্রেণী তখনও সমাজে বেশ দৃশ্যমান হয়েই বর্তমান। যে অতীতকে পিছনে ফেলে দেশ তখন তথাকথিত এগোতে চাইছে, তার সাথে এতই শিকড়িত কাঞ্চনজঙ্ঘার চরিত্রেরা, যে তাদের নিয়ে চালচ্চিত্রিক চিকিত্সাও প্রতিপন্ন হল সেই অতীতকে গ্লোরিফাই করার প্রয়াস হিসেবেই। আজকের সিনিক্যাল চোখ দিয়ে হয়ত এমন দৃষ্টিভঙ্গি হাস্যকর বা অবিশ্বাস্যও লাগতে পারে, তবে তত্কালীন বিচারে এর যাথার্থ্যের প্রশ্ন ওঠেনি। সেই মার্কিনি মহিলার জেরার উত্তরে সত্যজিৎ বলেন, "Rememeber the two hundred year colonial rule and you will understand that these characaters are very valid, very true to India; there's nothing wrong with them as such. You may object to the fact that I have made a film about them. That's a different matter altogether."[১৫] এই অবজেকশনই কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতি তত্কালীন দেশীয় প্রতিক্রিয়ারও মূলে। বাইরে চরিত্রদের চেনাই গেল না বলে অবোধি, আর ভিতরে এত ভাল করেই চেনা গেল যে সিনেমার মূল্যায়নে দেশাত্মিক পক্ষপাতই বড় হল।

    তবেই এটাই একমাত্র কারণ নয়, আরেকটা আছে আরো গুহ্য, মুখ্যও হয়ত। যে ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজকে দেখানো হয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘায়, তাঁদের মতরাই কিন্তু ছিলেন সত্যজিতের দর্শকদের অন্যতম। যে দুশো বছরের কলোনিয়াল যুগ আধুনিক ভারতের ইতিহাস-কৃষ্টিকে সৃজিত ও চালিত করেছে, যার সংস্পর্শে ঋদ্ধ হয়েছেন রামমোহন, মাইকেল, বঙ্কিØম, রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ অবধি, তার সাথে প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলে সত্যজিতের শিল্পের মতো এক্লেক্টিক ব্যাপার বোঝা যায় কি? যে স্পেক্ট্রামে একই প্রসঙ্গ ছঁংউয়ে যায় নিখিলেশ-সন্দীপ ও ব্রাউনিং দম্পতি, তাকে উপভোগ করতে যে চর্চা ও শীলন লাগে, তা পাওয়া যেত সে সময় ওই দো-আঁশলা সমাজেই। এঁরা হবু-পত্নীর মন জয় করতে বলেন, দে সে, দে ডু সে, আই হ্যাভ এয ব্রাইট ফিউচার এঁরা দার্জিলিং'এ এসে বছরের কয়েকদিন অন্তত অবশিষ্ট সাহেব বা নেহাৎ অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ানদের সাথে স্বাজাত্য প্রমাণ করে যান। এবং এই দর্শকরাই নিজেদের খঁংউজে পেলেন কাঞ্চনজঙ্ঘার পর্দায়। নিজেদের চালচলন হাবভাব যে ভাবে ফুটে উঠেছে সিনেমায় তা দেখে অস্বস্তিত হলেন তাঁরা, এবং এতই যথাযথ সে চিত্রণ, যে ক্ষোভও এল। কাঞ্চনজঙ্ঘার এক সমালোচক, সত্যি কথাটাই লিখে ফেলেছিলেন, ছবিটা, " is a disquieting and unflattering mirror held up before the viewer. And the easiest way of escape is to refuse to see one's image on it " [১৬]

    একটি জাতির পরিণতি ও পরিশীলনের একধরণের মাপকাঠি নি:সন্দেহে সমালোচনার প্রতি সহিষ্ণুতা। ইংরাজি সাহিত্যে ইংরাজদের নিয়ে যত উপহাস, পরিহাস, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এবং সে সাহিত্য জনপ্রিয়ও হয়েছে। বাঙালিরা এ ব্যাপারে চিরকালই প্রতীপী। তদানীন্তন সমাজের মূলধারার থেকে বিচ্ছিন্ন এই ইঙ্গ-বঙ্গ'রা নিজেদের প্রতি কটাক্ষ খঁংউজে পেলেন কাঞ্চনজঙ্ঘায়, এবং তা তাঁদের সিনেমাটার প্রতিই বিরূপ করল। আসলে এঁরা ওই ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি'র লজিকে, আদবকায়দায় ইঙ্গ হলেও স্বভাবে সেই বঙ্গই ছিলেন।

    এখন, কাঞ্চনজঙ্ঘা নির্মাণের চল্লিশ বছর পরে, তার নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়নের বাধা আপাত: অনেক কম। স্বাধীনতা বহুদিনই গা সওয়া, সেই ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজও অপসৃত। আজকের বাঙালির কাছে ব্রাউনিং দম্পতি বা নিখিলেশ-সন্দীপ, সমানই দূর, সমানই অদরকারি। (তবে, বাঙালিকে চাড় দেওয়ার জন্য কিসব নতুন উদ্যোগ আজকাল শুরু হচ্ছে শুনছি। নব-উন্মেষ টুন্মেষ নামধারী সংস্থার কান্ডারিরা নাকি কোঁচা-কাছা সামলাতে সামলাতে গাঁ-গঞ্জে গিয়ে জাগো-টাগো বলে হাঁকেন হর-রোব্বারে। )

    যাইহোক, পারিস্থিতিক নৈকট্য নেই বলেই কাঞ্চনজঙ্ঘার আজকের নিরীক্ষণ আরও সংগত হবে এমন ভাবা যায় কি? এ প্রশ্ন বিতর্ক সাপেক্ষ। ওই চক্করে না পড়ে শোনা যাক বাংলাদেশের আরেক স্রষ্টার আক্ষেপ, "বাংলায় নিজের মনের ভাবটি ঠিক মতো করে প্রকাশ করা এমনি শক্ত, যে লেখাটা একটা লড়াই বিশেষ। ... যারা লেখাটা শুনবে তাদের সাধারণত: কোনো বিষয়ে কোনো কথা ভাল করে ভাবা অভ্যাস নেই, সেই জন্য সব কথাই ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে বিস্তারিত করে লেখা দরকার হয়ে পড়ে। যে কথাটাকে সংহত সংক্ষিপ্ত করে লিখলে তার ওরিজিন্যালিটি, তার উজ্জ্বলতা, পরিস্‌Øংউট হত, সে কথাটাকে জল মিশিয়ে ব্যাখ্যা করে নিতান্তই অকিঞ্চিত্কর করে তুলতে হয় .....। .... বাঙালিরা একটা কোনো ভাবের সূত্র মনে মনে সহজে অনুসরণ করতে পারে না, তারা এক-দম ফীলিঙে মেতে উঠতে চায় ....।" [১৭] যিনি লিখেছেন, তাঁকে লেখার ভাষাও তৈরি করে নিতে হয়েছিল, সত্যজিত্‌'ও তেমন বাংলা সিনেমার ভাষাও অনেকটাই তৈরি করেছেন। তবে এই লেখার পর শতাব্দীর বেশি কেটে গেছে, বাঙালির বীক্ষা কতটা বদলেছে?



    ॥ কাঞ্চনজঙ্ঘা : অত: কিম? ॥



    কাঞ্চনজঙ্ঘার মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ নিশ্চয়ই দর্শক সম্বন্ধে যা বোঝার বুঝে গেলেন, বা হয়ত আগেই বুঝতেন, যাচাই করে নিলেন। এর পরে তাঁর সৃজনশীলতা অন্য ও অনন্য ধারায় বইতে লাগল। অভিযান, মহানগর, চারুলতা, কাপুরুষ ও মহাপুরুষ তাঁর দর্শকবৃন্দকে প্রত্যাশামতই চমত্কৃত করল. পুরস্কারও পেল দেশে-বিদেশে। তবে ন্যারেটিভ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট তাঁর ফুরোয়নি ১৯৬৬ সালে এল নায়ক।

    কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং নায়কের মধ্যে মিল খুব গহনে, তবে আছে। খানিক্ষণের বাঁধা সময়ে, খানিকটা বাঁধা বৃত্তে কয়েকটি চরিত্রের নক্সিকাঁথা, ধারালো সংলাপ, এবং সেই শেষমেষ কিছুই না হওয়া। তবু এবার দর্শক খেলো, এবং গোগ্রাসে। এবং তার প্রধান কারণ অরিন্দমের সাথে অভিনেতা উত্তমের মহানায়কত্ব মিলেমিশে এক হয়ে যাওয়া। আইকনপ্রিয় বাঙালির কাছে উত্তমের মোড়কে সিনেমার আর সব কিছু এল সহজপাচ্য আর উপাদেয় হয়ে। নিজস্ব ভাষাতেই এবারও বললেন সত্যজিৎ তবে এবার দর্শক শুনল ও হাততালি দিল, বুঝলও হয়ত। শৈল্পিক অনন্যতার সঙ্গে জনপ্রিয়তার মিশেল, যা সেক্সপিয়র বা শ' দেখিয়েছেন চরম সাফল্যে, তা সত্যজিত্‌'ও রপ্ত করতে শুরু করলেন নায়ক থেকেই। তারপর আরো প্রায় পঁচিশ বছর ছবি করলেন সত্যজিত্‌, বহু বিষয়, বিন্যাস ও বক্তব্যকে জাগিয়ে তুললেন তাঁর মনীষার ছোঁওয়ায়।

    তবে কাঞ্চনজঙ্ঘা এককই হয়ে রইল। এটি হয়ত তেমনই এক সৃষ্টি দূরত্বের সাথে যা স্পষ্ট হয়। সময় এগিয়ে চলে, স্রষ্টা ফুরিয়ে যান, তবে সৃষ্টির একটা নিজস্ব জীবন থাকে, সে বাঁচতে থাকে নিজের মতো। আর সৃষ্টির জীবনে চল্লিশ বছর কোনো সময়ই নয়।

    নিশ্চয়ই আশা আছে, কাঞ্চনজঙ্ঘার কোনো মনোজ্ঞ মূল্যায়ন হবে সামনের কোনোদিন, হয়ত পরবাস'এর পাতাতেই। আমি সে সাহস করলাম না কেন তা ডিস্ক্লেমারেই পড়েছেন।
    তথ্যপঞ্জী

    ১. বিষয চলচ্চিত্র - সত্যজিৎ রায়। আনন্দ পেপারব্যাক , আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। চতুর্থ মুদ্রণ, জুলাই ১৯৯৭ - [বি:চ:]। পৃ: ৭৯
    ২. "ছোট গল্প" - বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়। শারদীয় দেশ ১৪০৮। পৃ: ১৩৭
    ৩. Our Films, Their Films - Satyajit Ray. Orient Longman. Reprint 2001 - [OFTF]. Pg 94
    ৪. বিষয় চলচ্চিত্র - পৃ ৬৯
    ৫. Satyajit Ray : The Inner Eye - Andrew Robinson. Rupa 1990 - [TIE] Pg 137
    ৬. TIE - Pg 140
    ৭. বিষয় চলচ্চিত্র - পৃ ১১৬
    ৮. বিষয় চলচ্চিত্র - পৃ ৬৯
    ৯. গল্পগুচ্ছ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, বৈশাখ ১৩৯৬ - [গ:গ:]। পৃ ২২৫
    ১০. গ:গ: - পৃ ২২৭
    ১১. Collected Short Stories Volume 1 - W.Somerset Maugham. Vintage Paperback.
    ১২. TIE - Pg 227
    ১৩. OFTF - Pg 39
    ১৪. TIE - Pg 140
    ১৫. TIE - Pg 140
    ১৬. TIE - Pg 136
    ১৭. ছিন্নপত্রাবলী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বভারতী, চৈত্র ১৩৯৯। পৃ ৩০০
    ছবি : অরুণাংশু সিংহ
    Published October 31, 2002
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)